অভীক মুখোপাধ্যায়ের গল্প : শুভদা

শুভদা। তার শুভনাম শ্যামাশ্যাম কৃষ্ণপূজারী চৌধুরী হলেও পাড়ায় এবং পরিচিত মহলে শুভ নামেই সকলে চিনত আর ডাকতও। এই শুভদাই আজ আমার কাহিনীর মূল চরিত্র।

শুভদার সবথেকে বেশি পরিচিতি হয়েছিল অ্যাংলো কলেজের জি.এস. হিসাবে। বলা যেতে পারে পপুলারিটির দিক দিয়ে একেবারে গোল্ডেন টাইম। যদিও আমি ওকে চিনতাম সেই ছোট থেকেই, আর সেটা অবশ্যই এক পাড়ায় থাকার সুবাদে, সেদিনগুলোয় শুভদা ছিল আমাদের ফুটবল খেলার সাথী। ওর ভালো নামে কেউ ওকে ডাকছে এটা শোনার কথা আমি মনে করতে পারছিনা, আর ও নিজেও এটা কোনোদিন চাইতনা সে আমি খুব ভালো করেই জানি। নামটা ওর কাছে ওর ব্যারিস্টার বাবার ওল্ড মডেল বেবি ট্যাক্সির মতই ব্যাকডেটেড ছিল, আর ওদের পদবীতে নাকি একটা অতি সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রকট গন্ধ মিলত এটা শুভদাই আমাকে বলেছিল। প্রথমে বামপন্থা এবং পরবর্তী জীবনে অতি উগ্র বামপন্থার দিকে ঢলে পড়া শুভদার উপর কংগ্রেসি বাবা ‘সিনিয়র’ চৌধুরী অতিশয় ক্ষুব্ধ ছিলেন নানা কারণেই, বলা চলে কোনও কিছুতেই দুজনের মত মিলত না। বাপ-ব্যাটার এই খারাখারির ইতিহাস নিয়ে যদি কেউ বসত হয়ত তা মোগলদের পতনের কারণের পয়েন্টের থেকেও মনে রাখা বেশি কঠিন হত।


ছিপছিপে নির্মেদ চেহারা, একেবারে বিশেষত্বহীন মুখ-চোখ, গড়পড়তা হাইট আর ব্রিটিশ আমলে জন্মালে যাকে গায়ের রঙের জন্য কালাআদমি বলা যেত এরকম গাত্রবর্ণ এই সব কিছু মিলিয়ে শুভদার যে ইমেজ দাঁড় করানো যায় তাতে ওকে যদি কেউ একবার মাত্র দেখে মনে রাখতে পারবে না, অর্থাৎ মনে রাখার মত চেহারা নয় আর কি। শুধু একটা জিনিসই অন্যরকম লাগত, ওর চোখ জোড়া ছিল খুব উজ্জ্বল, একেবারে ‘জ্বলজ্বলিং’। অসম্ভব মেধা ঠিকরে আসত যেন!


এহেন অনায়কোচিত চেহারার একটি ছেলেকে নিয়ে গল্প ফাঁদলে আপনারাই বলবেন যে এ নায়ক হবার মত নয় বাপু! তাই আগেই বলি শুভদা নায়ক না হতে পারলেও ওর জীবনে মালমসলা যেটুকু ছিল তা দিয়ে অনেক কিছু করা যাবে। শুভদা উচ্চবংশ এবং গোঁড়া ধার্মিক পিতার কালাপাহাড় সন্তান। যে বাড়ির বাল গোপালের নিত্য সেবার ভোগ না দিলে বাড়ির সেই দিনের শুভ সূচনা হত না সে বাড়ির ছেলে হয়ে শুভদা রোজ বাল গোপালকে খিস্তি করত। আগেই বলেছি শুভদা জি.এস. ছিল কলেজের। আপনারা এখন যেমন ফেলুদা জি.এস. দেখেন যারা বছর বছর একই ক্লাসে থাকে তেমন না মোটেই। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও রীতিমত রাষ্ট্র বিজ্ঞানীর মত জ্ঞান ছিল ওর। কলেজের বক্তৃতায় তুলে আনত জ্বালাময়ী ভাষণ, যেগুলো তখন দেওয়ালে লিখলে আর নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার মত অবস্থায় থাকতে পারত না কেউ। র‍্যাডিকলিজমের জ্বাজল্য উদাহরণ। আমি শুভদার কাছে যেতাম সন্ধ্যেবেলায়, আমার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার ঠিক আগে আগেই। তবে সে যাওয়া আমার বাড়ির লোকের তাড়নায় বেশি দিন টেকেনি। যাই হোক, ঐ ছমাসে আমি এত কিছু শিখেছিলাম শুভদার কাছে! শ্যামবাজার ট্রাম ডিপোতে ট্রামগুলো তখন দিনের শেষে গরুর গোয়ালে ফেরার মত টুংটাং আওয়াজ করে ফিরছে, নেতাজি পাঁচমাথার মোড়ে ঠিক আজকের মতই একই রকম ঘোড়ায় চড়ে দিল্লির দিক দেখিয়ে দিচ্ছেন বাঙালিকে , আমি তখন শুভদার বইভরা ঘরের মধ্যে বসে। শুভদা মাটিতে আর আমি ওর বাড়ির বনেদি পালঙ্কে। কত কি আওড়ে যেত শুভদা! গুজরাতিদের বিয়ে দুপুরে হয়, বিয়েতে ওদের মেয়েরা সবুজ বা লাল শাড়ি পরে; ফিলিস্তিনী ভাষায় মরুভূমিকে ‘অরবত’ বলে, আর তাই থেকেই ‘আরব ’দেশের নামকরণ হয়েছে; এরকম বহু অজানা জিনিস ও আমাকে শোনাত। ওর জানার শেষ নেই আর আমার না জানার শেষ নেই, এটা আমরা দুজনেই জানতাম, তাই মিথোজীবীর মত অবস্থান করতাম আমরা দুই অসমবয়সী বন্ধুতে।

হ্যাঁ, একটু মাও-জে-দং এর অনুসরণ করত বটে, মাও সাহেব নাকি একবার একটা রিক্সায় চেপে যাবার সময় রিক্সার চালককে বলেন, ‘তুমি আমাকে অর্ধেক রাস্তা চাপিয়ে নিয়ে চল, বাকী অর্ধেক আমি তোমাকে টানব।’ আমি আগ্রহভরে শুনতাম এসব। ওর ঘরটা আমার লাইব্রেরি মনে হত এত বই ছিল ওখানে। শুভদার হাজারটা বইয়ের মাঝে কোনও মাইথোলজির বই না দেখে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম সে ব্যাপারে। উত্তরটা দু অক্ষরের একটা ছোট খিস্তি দিয়ে শুরু করে বলল, ‘তোর কি মনে হয়? সে যুগে সব সাধু ছিল? আর আমরা চদু? চদু বুঝিস? দেখবি ব্যান্ড পার্টি গেলে বড় একটা ড্রাম পিঠে বয়ে নিয়ে যে যায় তাকে বলে। গোটা দলের সব থেকে বড় পাঁঠা যে হয় তাকেই ঐ কাজটা দেয়। কারণ তার দ্বারা কোনও বুদ্ধির কাজ হবে না।’ ভয়ে ভয়ে জানতে চাইব কিনা ভাবছি, তার মাঝেই আর একটা ছক্কা হাঁকিয়ে বলে বসল, ‘তোর কি মনে হয় না একলব্যর কেসটা শিডিউলড ট্রাইবদের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত একটা বঞ্চনার ব্যাপার! এস. টি. বলেই ওর ন্যায্য বিচার হল না।’ শুভদার জ্ঞান যে এখানেও শুধু পড়াতে আটকে না থেকে বিশ্লেষণের চরম স্তরে গেছে সেটা বুঝে আমি সম্মতির লক্ষণ হিসাবে মৌনতা অবলম্বন করলাম।

শুভদা কাফকা পড়ত, ফকনার পড়ত, আমি বুঝতেই পারতাম না কিছু। মা – মরা শুভদার একটা দুঃখ ছিল, ‘সিনিয়র’ চৌধুরী নিজের মিসেসের পোস্ট ফাঁকা রাখেননি। তিনি শুভদার জন্য বিমাতা আনেন যে কিনা বয়সে শুভদার থেকে বছর পাঁচেকের বড় ছিল হার্ডলি। মুখে আক্ষেপ না করলেও আমি বুঝতাম সেটা। সে যুগে বাংলার মসনদে ছিলেন সিদ্ধার্থ, আর বামপন্থার লাল আরও গাঢ় হয়ে উঠছিল। খাঁটি বাম আচরণে বিশ্বাসী হয়ে উঠছিল শুভদা, তবে শুধু বাম নয় ‘বামা’তেও মন দিয়েছিল। একটা অদ্ভুত দাগের মত ওর চরিত্রে সেটাই বড্ড চোখে পড়ছিল, কোনও প্রেমিকা নয়, বয়সে নিজের থেকে বড় এবং সম্পর্কে বৌদি হয় বেশ এরকম কয়েকজনের সাথে জড়িয়ে পড়েছিল শুভদা। আর অবশ্যই এই সম্পর্কগুলোর কোন প্লেটোনিক দিক ছিল বলে আমি মনে করিনা। আমি এ পাড়ায় এমন অনেককে এখন দেখি যাদের জন্ম ঐ মোটামুটি ৭১ নাগাদ এবং মুখের আদল হুবহু শুভদার মতই। শুভদা এক্ষেত্রেও একটা রেভলিউশন করেছিল, সবাইকে এক দেখতে চিনাদের যেমন হয় আর কি! অবশ্য শুভদার দোষ নেই খুব একটা, যুগটাই টুপি পরানোর ছিল, কিন্তু নিজে কে আর টুপি পরতে চায়! এখন হলএ ওকে ‘শুভ ডোনার’ বলা হত হয়ত, তবে ও কিন্তু প্রকৃত ডোনার, এক টাকাও নেয়নি। তবে আমি লাজুক ছিলাম বলে আমার সাথে এই নিয়ে মস্করা করত। এখন লোকে নিউজ দেখার মতই অনেক এমন জিনিস দেখে রোজ যা আমরা জানতামই না সেযুগে। যেমন জাপানের নাম শুনেছিলাম, ওদের পুতুল বিখ্যাত আর বোমা কুখ্যাত জানতাম, কিন্তু ওদের যে তেলও আছে বেশ সে আইডিয়া ছিল না। শুভদার কিন্তু জ্ঞান এব্যাপারেও টনটনে ছিল। বলত, ‘আসল তেল চিনবি কী করে?’ আর আমার যে জানা নেই সেটা বুঝে বলেই দিত, ‘ই-কারটা ফলো করবি’। একটু লাজ ভেঙে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে ও নিজে ব্যবহার করেছে নাকি! গম্ভীর উত্তর এসেছিল, ‘চেনা বামুনের পৈতে লাগে না’।

সব্বাই কানাকানি শুরু করল যে শুভদা নাকি কানু সান্যালের দলে নাম লিখিয়েছে, দ্রোণাচার্য ওর গুরু হয়েছে, চারু বাবুর সাথে ওর কন্টাক্ট, কিন্তু যার বিয়ে তার হুঁশ বরাবরের কমই থাকে এটা দেখেছি। শুভদা কিন্তু কেয়ারলেস বিউটি, যাকে এযুগে বলে বিন্দাস। সালটা একদম ৭০ - এর পরে আর ৭২ - এর আগে। প্রতি বছরের প্রথামত ‘সিনিয়র’ চৌধুরী মহালয়ার কাক ভোরে গঙ্গায় তর্পণে যাবেন বলে উঠলেন, চোখে পড়ল শুভদার ঘরের দরজা হাট করে খোলা, নিজের প্রাইভেসিতে সচেতন শুভদা দরজা খুলে শোবেনা এটা বলাই বাহুল্য আর যে ছেলে ৭ টার আগে বিছানা ছাড়ে না সে কোনও কারণেই অরুণোদয় দেখতে উঠবে না এটা ‘সিনিয়র’ চৌধুরী আন্দাজ করেই এগিয়ে গেলেন শুভদার ঘরে। সেগুনের টেবিলে এম. এন. রয়ের বইয়ের নিচে চাপা রাখা একটা চিরকুট, তাতে একটাই কথা লেখা , ‘এলাম’। সম্বোধন নেই বোধ হয় ‘সিনিয়র’ চৌধুরীকে ‘বাবা’ বলে ডাকত না বলেই।

শুভদার এই নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রার নানা তত্ত্ব তুলে এনেছিল পুলিশ আর পাড়ার সেইসব কাকিমা – জেঠিমারা যারা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আরশোলার মত আমাদের সবার পাড়াতেই ছিল, আছে এবং থাকবেও। লালবাজারের কর্তারা মনে করছিল নক্সালাইট মুভমেন্টে জড়িত হয়ে শুভদা আণ্ডারগ্রাউণ্ডে চলে গেছে। একটা প্যারালাল ফর্মুলা উঠে এসেছিল। শুভদার বাড়ির তিনতলার চিলেকোঠার খড়খড়ি তুলে নাকি কাজের ঝি মানদা দেখেছিল শুভদার বিমাতা ওর সাথে বিপরীতরত্যাতুরা। তবে শুধু মানদাই ওদের দেখেছিল তা নয়কো, ওরাও নাকি বাৎস্যায়ন প্র্যাকটিস করতে করতে মানদাকে দেখেছিল। আর নিউটনের থার্ড ল মেনে শুভদা নাকি তাই পরদিন ভোরেই গচ্ছতি ভবান।


আমি অবশ্য এসব বিশ্বাস করিনি, সমাজ তো নিন্দে করেই। বিশেষ করে যারা একটু উলটো পথে হাঁটে তাদেরকেই। শুভদা চলে যাবার পরে স্বাভাবিক ভাবেই জীবন কিন্তু থেমে থাকেনি। ৭২ – এর ‘সিনিয়র’ চৌধুরী আবার বাবা হলেন, মানে শুভদা এবার সত্যি দাদা হল। ছেলে। ঘটা করে নামকরণ হল ‘ঘনশ্যাম কৃষ্ণপূজারী চৌধুরী’। জানিনা শুভদার রক্তের সেই গাঢ় বামপন্থার লাল ও কোথা থেকে পেয়েছিল! ওর ভাই কিন্তু ওর মত হয়নি, যদিও তাকে দেখতে শুভদার মত বয়সে অবিকল শুভদার মতই হয়েছিল। আমি আজও তাকে আমার পাড়ায় দেখছি, কিন্তু শুভদার সাথে মিল পাইনি, কিন্তু নিন্দুকেরা বলে .... ....




লেখক পরিচিতি
অভিক মুখোপাধ্যায়

নবদ্বীপ। পশ্চিম বঙ্গ।
গল্পকার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ