আজ পনের বছর আমাদের বিবাহ হয়েছে তোমাকে চিঠি লিখিনি, চিরদিন কাছেই পড়ে আছি - মুখের কথা অনেক শুনেছ, আমিও শুনেছি, চিঠি লেখার মত ফাঁক টুকু পাওয়া যায়নি --------------
তুমি ভাবছ আমি মরতে যাচ্ছি - ভয় নেই, অমন পুরোনো ঠাট্টা তোমাদের সঙ্গে আমি করব না। মীরাবাঈ ও তো আমার ই মতো মেয়েমানুষ ছিল - তার শিকল ও তো কম ভারী ছিল না, তাকে তো বাঁচবার জন্যে মরতে হয়নি। মীরাবাঈ তার গানে বলেছিল "ছাড়ুক বাপ,ছাড়ুক মা, ছাড়ুক যে যেখানে আছে,মীরা কিন্তু লেগেই রইল প্রভু- তাতে তার যা হবার তা হোক। এই লেগে থাকাই তো বেঁচে থাকা।
আমিও বাঁচব।আমিও বাঁচলুম।
তোমাদের চরণতলাশ্রয়ছিন্ন
মৃণাল। "
বাংলাএ পত্রগল্প অথবা পত্রোপন্যাসের উদাহরণ হিসেবে প্রথমেই রবিঠাকুরের উপরে উল্লিখিত গল্প "স্ত্রীর পত্র" র কথা বলা যেতে পারে।আরম্ভ থেকে শেষ অব্দি লেখা সম্পূর্ন একটি চিঠির মাধ্যমেই পুরো গল্পটি এখানে বলা হয়েছে।
Epistolary novel বা পত্রোপন্যাস এমন এক বিশেষ ধরনের উপন্যাস এবং গল্প লেখার ধরন যেখানে document বা দলিল, letter বা চিঠিপত্র, diary বা রোজনামচা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করেই লেখক তাঁর লেখাকে এগিয়ে নিয়ে যান ও সম্পূর্ণ করেন।
চিঠিপত্রের মাধ্যমে বিকশিত গল্প-উপন্যাসে বর্ণিত চরিত্র গুলি লেখকের বাধাহীন উপস্থিতিতে সাবলিল, আন্তরিক ও অন্তরঙ্গ গতিতে এগিয়ে এক চরম, নাটকীয় মুহুর্তের উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়। এছাড়াও এই ধরনের লেখায় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাবলির বর্ণনা, গল্পে এক আলাদা মাত্রা প্রদান করে গল্পকে করে তোলে বড় বাস্তব।
সাধারনভাবে চিঠিপত্রই এই Epistolary বা পত্রোপন্যাসের মূল ভিত্তি হলেও রোজনামচা বা ডাইরি, সংবাদপত্রের ক্লিপিং ইত্যাদির ব্যবহারেও এই শ্রেনীর গল্পউপন্যাস রচিত হয়।আধুনিক কালে ইলেক্ট্রনিক দলিলসমূহ যেমন - রেকর্ডিং বা রেডিওর কথোপকথন, ব্লগ, ই-মেইল ইত্যাদিও এই ধরনের লেখার উপযোগী বিষয়বস্তু।
'Epistolary ' শব্দটি লাতিন, যেটি উদ্ভুত হয়েছে গ্রীক শব্দ 'epistole' থেকে,যার মানে 'পত্র'। এই পত্রোক্ত উপন্যাস বা গল্পের বিন্যাস তিনটি বিশেষ স্টাইল বা প্রক্রিয়ায় হয়।
১) Monologic বা একটি মাত্র চরিত্রের দ্বারা উল্লেখিত দলিলসমুখের বা চিঠিপত্রের সাহায্যে আখ্যায়িত গল্প।
২) Dialogic যার মূলে আছে দুটি চরিত্রের মধ্যে লিখিত চিঠিপত্রের আদানপ্রদানকে কেন্দ্র করে লিখিত উপন্যাস।
৩)Polylogic এ বর্ণিত আখ্যান বিভিন্ন, অন্তত: তিনজন বা তার বেশী চরিত্রের ভিতর লিখিত চিঠিপত্রের ভিত্তিতে মূর্ত হয়।
সাধারনভাবে Monologic পত্রোপন্যাসে একটা টান টান উত্তেজনা বজায় রাখা, dialogic এবং polylogic উপন্যাসের চেয়ে সহজ। যেহেতু monologic পত্রোপন্যাস কোনো একজনের দৃষ্টিভঙ্গির বেষ্টনির মধ্যেই ঘোরাফেরা করে।অপরপক্ষে dialogic কিংবা polylogic উপন্যাসে যেহেতু চরিত্রের সংখ্যা একাধিক, তাই আলাদা আলাদা ও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ দিয়ে প্রতি চরিত্রের জন্য ভিন্নধর্মী এক আকর্ষণ তৈরী করা এবং গল্পের শেষ অব্দি তা ধরে রাখা লেখকের পক্ষে খানিক কঠিন হয়ে পড়ে। এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে পাঠক রা যাতে বিভ্রান্ত না হন।
আবার অন্যদিকে এটাও ঠিক যে উপন্যাসে নাটকীয় মেজাজ ফুটিয়ে তুলতে লেখকরা চিঠিপত্র, ডাইরী ইত্যাদির ব্যবহার করে থাকেন। এগুলির ব্যবহারের ফলে প্রধান এবং পার্শ্বচরিত্র গুলির চরিত্রবিন্যাসের ক্ষেত্রে, প্রত্যেককে তার নিজস্ব বাচনভঙ্গি, নিজের নিজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজ ও সংসারকে বিশ্লেষণ ইত্যাদি ফুটিয়ে তোলা সহজ হয়ে ওঠে।
একজন সবজান্তা ধারাভাষ্যকারের বিবরণীর পরিবর্তে, বিভিন্ন চিঠির মাধ্যমে একটা পুরো গল্প কে পাঠকের কাছে আরো হৃদয়স্পর্শী করে তোলা যায়।অনেক লেখক তাঁদের লেখায় এই রীতিকে আংশিকভাবে প্রয়োগ করেছেন। কারন এই রীতিতে উপন্যাস আকর্ষনীয় হলেও এর প্রয়োগ খুব সহজ নয়।
একঘেয়েমি মুক্ত রাখার জন্য পত্রোপন্যাস চিঠি ভিত্তিক হয়েও কিন্তু প্রেরক ও প্রেরিতের যে চিঠিসমূহ তাতে প্রথাগত ভাবে বারবার 'সম্মোধন 'ও 'ইতি'র ব্যবহার করেনা। প্রথম ব্যবহৃত চিঠিটিতেই শুধু 'প্রিয় ----' দিয়ে শুরু ও 'ইতি-----' দিয়ে করা হয়। তবে এর ব্যতিক্রম ও আছে যেমন Jean Webster এর" Daddy Long Legs" সেখানে গল্পে ব্যবহৃত প্রতি চিঠিতেই সম্মোধন ও ইতি র সাহায্য নেওয়ার হয়েছে।
পাশ্চাত্যে অষ্টাদশ শতাব্দীর ঔপন্যাসিক স্যামুয়েল রিচার্ডসনের "পামেলা"(1740) এবং "ক্লারিসা"(1749) epistolary novel হিসেবে অতি জনপ্রিয়। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে প্রকাশিত ব্রামস্টকের গা ছমছমে উপন্যাস "ড্রাকুলা " ও এই বিশেষ ধরনের উপন্যাসের তালিকাভুক্ত।
বাংলায় রচিত গল্প উপন্যাসের মধ্যে "স্ত্রীর পত্র"র উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথেরই বিখ্যাত উপন্যাস "ঘরে-বাইরে"ও রোজনামচা বা ডাইরী লেখা কেন্দ্রিক। যেখানে তিনটি প্রধান চরিত্র - বিমলা,নিখিলেশ ও সন্দীপ তাদের আত্নকথার মাধ্যমেই গল্পকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গেছে।
আধুনিক বাংলা পত্রোপন্যাসের মধ্যে সন্তোষ কুমার ঘোষের "শ্রীচরণেষু মা", বুদ্ধদেব গুহর"অবরোহী",অতুল কুমার দাশের "অপ্রতিম দশা" র নাম উল্লেখনীয়।
পরিশেষে একসময়ের একটি অতি জনপ্রিয় বাংলা পত্রোপন্যাস "দৃষ্টিপাত " এর অল্প উদ্ধৃতি দিয়ে এই প্রসঙ্গে ইতি টানছি। উপন্যাসটি বিনয় মুখোপাধ্যায় 'যাযাবর' ছদ্মনামে লিখেছেন।এই উপন্যাসে প্রতি অধ্যায় এক একটি চিঠির মাধ্যমে বলা হয়েছে যদিও কোনো চিঠিটিতেই সম্মোধন কিংবা ইতি নেই।
"....... আজ সকালে ঘুম ভেঙেছে একটি মেয়ের চেঁচানিতে, অবশ্য আমি বলি চেঁচানি, মেয়েটির মা বলেন গান।মেয়েটি গান শিখছে। সেই সাত দিন ধরে, ক্রমাগত একসুরে 'বঁধু তুমি যে চলে গেলে ফিরে তো নাহি এলে' আমি বলি, বাছা যে গেছে সে একেবারেই গেছে এবং ঐ গান না থামলে ফিরছে না এও নিশ্চয়... "।
0 মন্তব্যসমূহ