আজকের সকালটি খুব কোমল এবং মোলায়েম। আমি এবং আমার ভাই বছরের প্রথম তুষার কণাগুলো জিভের ডগায় চেখে দেখার চেষ্টা করছি। আমাদের মা প্রায়ই সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমরা বারবার পিছিয়ে গিয়ে হা করে তুষার জমা করছি আমাদের জিভে। আজ মা বিরক্ত হচ্ছেন না একদমই। তিনি খুবই চিন্তিত ছিলেন এবারের তুষারপাতের দেরি দেখে। অক্টোবর গিয়ে নভেম্বর চলে গিয়েছিল, তবুও ঘাসের উপর এক ইঞ্চি তুষার জমেনি। এবারের ক্রিসমাস তুষারবিহীন হবে, এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না!
আজ সকালটি ঠিক গতকালের মত নয় বা গত পরশুর মতও নয়। আমাদের সামনের বাগানে সবুজ ঘাসের উপর সাদা ছিটছিটে তুষার দেখে মা একবারও কিছু বলেননি। কিন্তু সকালের নাশতায় আমার ভাই এর প্রিয় ওলকার স্যুপ বানিয়েছিলেন। আমার ভাইয়ের গলায় ঐ যে নীল রঙের স্কার্ফটি পেঁচানো, ওটা তিনি গতকাল সারারাত ধরে বুনেছেন। হলুদ খামে ভরে চিঠিটা আসার পর থেকেই, মা বোধহয় আসলে কথা কম বলছেন। কাজ করে যাচ্ছেন নিজের মত। চিঠিটা আমিই পড়ে শুনিয়েছিলাম মা কে। এক পৃষ্ঠায় টাইপ করে কোন নির্দেশ নয়, বরং অনুরোধ করা হয়েছে। যেন আমি এবং আমার মা, আমার ভাইটিকে আজকে সকালে শহরতলীর বড় মাঠটিতে পৌঁছে দিই।চিঠির শেষ লাইনে পৌঁছানোর আগেই আমার ভাইটি উত্তেজিত হয়ে ছুটে গিয়েছিল আমাদের প্রতিবেশি, ওর বন্ধু মিশকা’র বাড়িতে। একটু পরেই অবশ্য ফিরে এসেছিল আরও বেশি আনন্দে উত্তেজিত হয়ে। আমার ভাই শুধু একা নয়, মিশকা এবং ওদের সব বন্ধুদের বাড়িতেই একটি করে হলুদ খাম এসেছিল সেদিন সকালে। সেই সকালের পর থেকে বাতাস হয়েছিল আরও শুষ্ক এবং শীতল। আকাশের রঙ হয়েছিল ঠিক বছর খানিক আগে আমার ভাইয়ের কনুইতে হওয়া সেই ফোঁড়াটির মত-বর্ণহীন, ময়লা এবং ফ্যাকাশে। আমাদের সবার বাড়িতেই আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম কাপড় এবং শুকনো খাবার গোছাতে। ঝরা পাতাদের গুমাড়ানো শব্দ, আমরা খুব একটা টের পাইনি।
আজ সকালের আলো ঠিক অন্যদিনের মত নয়। হলুদ, নরম, তুলতুলে আলোটিকে ছুঁয়ে দিলেই মনে হচ্ছে সাদা বরফের গায়ে লেপ্টে যাবে। হলদে আভা ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমরা সবাই শহরতলীর শেষ মাঠটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার ভাইয়ের হাতটি মা তাঁর নিজের হাতের মুঠোয় ভরে নিলেন। ওর হাতে গরম মোজা আছে, তারপরও কেন যে মা বার বার ওর হাতে ফুঁ দিয়ে আলতো করে ঘষে দিচ্ছেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা!আমাদের কয়েক পা সামনেই মিশকা’র দাদী একটু পর পর নাতির টুপিটা টেনে টুনে ঠিক করে দিচ্ছেন। যদিও টুপিটা মিশকার মাথায় দারূণভাবে এঁটে আছে!আমরা সবাই পাশে, পিছনে, সামনে, ছোট ছোট দলে হাঁটছি। কিন্তু কেউ তেমন একটা কথা বলছিনা। নিঃশব্দ তুষারপাতের মত শব্দহীন আমরা।
শহরতলীর শেষ মাথার মাঠটিকে এখন বোধহয় একটি ক্যাম্পগ্রাউন্ড বলা উচিৎ। ছোট ছোট এক একটি দল নিজের মত করে গুছিয়ে নিচ্ছে। মা আগুন জ্বালতে ব্যস্ত, আমি চারপাশ ঘুরে দেখতে দেখতে আমার ভাইটিকেও খুঁজছি। এখানে এসে পৌঁছানোর পর থেকেই বন্ধুদের দলে মিশে গেছে ও। মা কিছু বলেননি কিন্তু আমি জানি তিনি আমার ভাইটিকে যতক্ষণ পারা যায় কাছে রাখতে চাইছেন।আমি একটু বিরক্তই বলা যায়। আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা তিনদিন এই খোলা আকশের নীচে রাত কাটানোর কী অর্থ থাকতে পারে!ওরা কী আমাদের সবার জন্য ছাদওয়ালা কোন বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেনি!অবশ্য, আমি জানি আমাদের কোষাগারের অবস্থা বিশেষ ভালো যাচ্ছেনা। তাছাড়া এতগুলো মানুষ সামলানোর মত জনবলেরও অভাব আছে। তবে আমি এবং আমার ধারণা মা নিজেও এতেই খুশি, যে অন্তত এই তিনদিন আমার ভাই আমাদের সাথে থাকতে পারবে।
আজ সকালে ঘাসের উপর প্রায় কয়েক সেন্টিমিটার বরফ জমেছে।ঘাসের গাঢ় সবুজ রঙ্গটিকে যেন ঠেলে ঠুলে কোনমতে চাপা দেয়া হয়েছে সাদা বরফের নীচে। আমার ভাই, ওর বন্ধু এবং ওদের সমবয়সী সবাইকে ক্যাম্পগ্রাউন্ডের পাশের খোলা জায়গাটিতে একত্রিত হওয়ার জন্য সকাল থেকেই বার বার মাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে। মা খুব আস্তে আস্তে আমার ভাইয়ের কোটের গলার কাছের বোতামগুলো বন্ধ করছেন। তাঁর আঙ্গুলের নীচে আমার ভাইয়ের শরীরটা এক ছুটে বের হয়ে যেতে চাইছে তা আমি টের পাচ্ছি। কিন্তু মা কেও তাড়া দিতে কেন যেন ইচ্ছে করছেনা!উত্তেজনায় ওর চোখগুলো চিকচিক করছে!সেই হলুদ খামে এক পৃষ্ঠার টাইপ করা শব্দগুলোয় হঠাৎ করেই ও যেন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের মতো মর্যাদা পেয়ে গেছে। আমার ভাই, আমার ছোট্ট ভাই, ওর ঠোঁটগুলো এখনও এত নরম আর গোলাপী!গলার স্বর এখনও এতটা কর্কশ হয়ে ওঠেনি যে অসহ্যকর মনে হয়।ওর দু’ চোখের পাপড়িগুলো কী দারুণ লম্বা আর ঘন কালো!ওর চোখের পিঙ্গল মণিগুলোতে যেন হাজারো বিস্ময়!মা শেষ বোতামটি আটকানোর সাথে সাথে একছুটে বেড়িয়ে গেল সে। মা আমার দিকে তাকালেন, সেই দৃষ্টিতে অনুরোধটি খুবই পরিষ্কার। অগত্যা আমিও পিছু নিলাম আমার ছোট্ট ভাইয়ের।
আমাদের ক্যাম্পগ্রাউন্ডের পাশের খোলা জায়গাটিতে এসে জড় হচ্ছে আমার ভাই, ওর বন্ধু মিশকা এবং ওদের সমবয়সী সব ছেলে। এদের সবার বয়স বার থেকে সতের’র মধ্যে। সেই চিঠিখানিতে এই বয়সের বিষয়টি খুব পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রতিটি পরিবারকে বিনীতভাবে অনুরোধ করা হয়েছে, যেন এই বয়সের কিশোর সদস্যটিকে এই মহৎকর্মে স্বেচ্ছায় নিয়োজিত করে সেবাদানের এক আশ্চর্য সুযোগ করে দেয়া হয়!আমি সম্পুর্ণভাবে নিশ্চিত নই এই ব্যাপারে, যে আমি এবং আমার মা, আমার ভাইকে ঠিক কতোটা আমাদের ইচ্ছায় এখানে নিয়ে এসেছি! আমি শুধু জানি, আমি কিংবা আমার মা, আমাদের কারোরই সেই হলুদ খাম, খামের উপর সেই সিল কিংবা এই অনুরোধ উপেক্ষা করার কথা একবারও মনে হয়নি!
আজ সারাদিন আকাশ মুখভার করে আছে। ক্যাম্পগ্রাউন্ডে আমাদের নির্দিষ্ট স্থানে আমার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিলো না।উদ্দেশ্যহীনভাবেই হেঁটে বেড়িয়েছি সারাদিন।আমি যখন মায়ের কাছে পৌঁছালাম, বাতাস আরও হিম শীতল হয়েছে। মা একা নয়, ছোট্ট আগুনের পাশে মিশকা’র দাদী এবং মাও বসে আছে। কেউ কোন কথা বলছেন না। সবাই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আগুনের উপর কালো পাত্রটি থেকে উঠা গরম বাষ্পের দিকে। কিছু একটা বলতে চাইলাম সবাইকে। কিন্তু কোন শব্দই যেন আমার মুখ থেকে বের হতে চাইলো না। মায়ের পাশে গিয়ে আগুনের উপর আমার ঠান্ডা হাতগুলো মেলে ধরলাম।আমার ভাই কিংবা মিশকা এখনও ফেরেনি!
আজ সকালেও সূর্য ওঠেনি।তুষারপাতের সাথে তীব্র বাতাসের বেগও সমান তালে পাল্লা দিয়ে যাচ্ছে।মাইকে কিছু একটা নির্দেশ দেয়া হচ্ছে কিন্তু বাতসের শোঁ শোঁ শব্দে সবই কেমন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। একটু সামনে এগিয়ে গেলাম যেন ভালো করে শুনতে পাই। আমার ছোট্ট ভাই, ওর বন্ধু মিশকা এবং ওদের সবাইকে আজই যেতে হবে!নিশ্চয় কোথাও কোন ভুল হচ্ছে! আজ রাতটিও আমার ভাই, মা এবং আমার সাথে কাটাবে! চিঠিতে এমনই বলা ছিল!আমার পড়তে ভুল হওয়ার কথা নয়!মা চুপ করে বসে পড়েছেন এক কোণায়। আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।
এর মধ্যেই তুষার জমে গেছে কয়েক ইঞ্চি!একটু আগেই ওদের একজন এসে নিয়ে গেছে আমার ভাইকে ক্যাম্পগ্রাউন্ডের পাশের মাঠটিতে। আমি দৌড়ানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু তুষারে বার বার বুটগুলো দেবে যাচ্ছে।আমি জানিনা আমি আদৌ কিছু করতে পারবো কী-না। কিন্তু অন্তত একবারের জন্য হলেও আমার ঐ মাঠটিতে যেতে হবে। আমার ছোট্ট ভাইটি ওদের একজনের সাথে বেড়িয়ে যাওয়ার পরই আমি প্রথমবারের মত উপলব্ধি করতে পারলাম, যে, আমার ভাই, ওর বন্ধু মিশকা কিংবা ওরা সবাই, কেউ আর ফিরবেনা! বার থেকে সতের বছরেরে এই সতেজ শরীরগুলো রাখা হবে সবার সামনে। যাকে বলা যায়, ওদের দিয়ে বানানো হবে মনুষ্য বর্ম। সাদা শুভ্র তুষার ওদের রক্তে ধীরে ধীরে লাল উঠবে!আমি ছুটছি, আমার হৃৎপিন্ডে অসম্ভব ব্যাথা হচ্ছে। সমস্ত বাতাস যেন আমার পাঁজরে আটকে আছে। আমি চীৎকার করতে চাইছি আমার সর্বস্ব শক্তি দিয়ে!ওরা লোহার গেট আটকে দিয়েছে।আমাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়া হয়েছে গেটের কাছ থেকে।আমি আবার ফিরে গেছি লোহার বেড়ার কাছে। ওই তো লোহার বেড়ার উপরেই এতগুলো মুখ! আমি খুঁজছি আমার ভাইয়ের মুখটি। আমি কোন মুখই আলাদা করতে পারছিনা! সবগুলো মুখই আমার ভাইয়ের মুখের সাথে এত মিল! সেই তো একই নাক কিংবা ভ্রু। মুখ টিপে হাসির ভঙ্গিটিতেও সবার কী আশ্চর্য মিল!
তীব্র ব্যর্থতা, হতাশা যে আক্রোশের জন্ম দেও, সেই সাথে তার শক্তিএক অলীক বিশ্বাসেরও জন্ম দেয় বুঝি! আমারও মনে হলো এই শক্ত লোহার বেড়াটি আমিও বোধহয় সজোরে উপড়ে ফেলতে পারবো।আমি লোহার তারগুলোকে খামচে ধরেছি। হিম শীতল তারগুলোর কোন অনুভূতি আমি টের পাচ্ছি না। আমার শুধু একবার আমার ছোট্ট ভাইয়ের মুখ ছুঁয়ে দেখতে হবে! আমার হাতের মুঠোয় ওর মুখের স্পর্শটুকু নিতে হবে!
লেখক পরিচিতি
রুবিনা খানম
জন্ম ও বেড়ে ওঠা ব্রক্ষ্মপুত্রের কোলঘেষা মফস্বল শহর ময়মনসিংহে। ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা সেই ছোটবেলা থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক করতে আসার বেশ আগেই তাই বিশ্ব সাহিত্যের সাথে পরিচয় হয়েছে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র’র হাত ধরে, কৈশোরে। এরপর দক্ষিন কোরিয়া থেকে ভাষা বিজ্ঞানের উপর স্নাতকোত্তর শেষ করে, বর্তমানে উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডায় পিএইচডি করছেন শিক্ষা অনুষদ এ। পড়তে ভালোবাসেন সব ভাষার, সব সময়কালের বই, সেই সাথে নিয়মিতই উপভোগ করেন দেশ বিদেশের নানা চলচ্চিত্র আর ঘুরোঘুরি।
অনিয়মিতভাবে হলেও লেখালেখি করছেন বহুদিন ধরেই। লেখার প্রকাশ এখন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রেখেছেন ছোট কাগজ, অনলাইন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা আর ব্লগে।
আজ সকালের আলো ঠিক অন্যদিনের মত নয়। হলুদ, নরম, তুলতুলে আলোটিকে ছুঁয়ে দিলেই মনে হচ্ছে সাদা বরফের গায়ে লেপ্টে যাবে। হলদে আভা ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমরা সবাই শহরতলীর শেষ মাঠটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার ভাইয়ের হাতটি মা তাঁর নিজের হাতের মুঠোয় ভরে নিলেন। ওর হাতে গরম মোজা আছে, তারপরও কেন যে মা বার বার ওর হাতে ফুঁ দিয়ে আলতো করে ঘষে দিচ্ছেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা!আমাদের কয়েক পা সামনেই মিশকা’র দাদী একটু পর পর নাতির টুপিটা টেনে টুনে ঠিক করে দিচ্ছেন। যদিও টুপিটা মিশকার মাথায় দারূণভাবে এঁটে আছে!আমরা সবাই পাশে, পিছনে, সামনে, ছোট ছোট দলে হাঁটছি। কিন্তু কেউ তেমন একটা কথা বলছিনা। নিঃশব্দ তুষারপাতের মত শব্দহীন আমরা।
শহরতলীর শেষ মাথার মাঠটিকে এখন বোধহয় একটি ক্যাম্পগ্রাউন্ড বলা উচিৎ। ছোট ছোট এক একটি দল নিজের মত করে গুছিয়ে নিচ্ছে। মা আগুন জ্বালতে ব্যস্ত, আমি চারপাশ ঘুরে দেখতে দেখতে আমার ভাইটিকেও খুঁজছি। এখানে এসে পৌঁছানোর পর থেকেই বন্ধুদের দলে মিশে গেছে ও। মা কিছু বলেননি কিন্তু আমি জানি তিনি আমার ভাইটিকে যতক্ষণ পারা যায় কাছে রাখতে চাইছেন।আমি একটু বিরক্তই বলা যায়। আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা তিনদিন এই খোলা আকশের নীচে রাত কাটানোর কী অর্থ থাকতে পারে!ওরা কী আমাদের সবার জন্য ছাদওয়ালা কোন বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেনি!অবশ্য, আমি জানি আমাদের কোষাগারের অবস্থা বিশেষ ভালো যাচ্ছেনা। তাছাড়া এতগুলো মানুষ সামলানোর মত জনবলেরও অভাব আছে। তবে আমি এবং আমার ধারণা মা নিজেও এতেই খুশি, যে অন্তত এই তিনদিন আমার ভাই আমাদের সাথে থাকতে পারবে।
আজ সকালে ঘাসের উপর প্রায় কয়েক সেন্টিমিটার বরফ জমেছে।ঘাসের গাঢ় সবুজ রঙ্গটিকে যেন ঠেলে ঠুলে কোনমতে চাপা দেয়া হয়েছে সাদা বরফের নীচে। আমার ভাই, ওর বন্ধু এবং ওদের সমবয়সী সবাইকে ক্যাম্পগ্রাউন্ডের পাশের খোলা জায়গাটিতে একত্রিত হওয়ার জন্য সকাল থেকেই বার বার মাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে। মা খুব আস্তে আস্তে আমার ভাইয়ের কোটের গলার কাছের বোতামগুলো বন্ধ করছেন। তাঁর আঙ্গুলের নীচে আমার ভাইয়ের শরীরটা এক ছুটে বের হয়ে যেতে চাইছে তা আমি টের পাচ্ছি। কিন্তু মা কেও তাড়া দিতে কেন যেন ইচ্ছে করছেনা!উত্তেজনায় ওর চোখগুলো চিকচিক করছে!সেই হলুদ খামে এক পৃষ্ঠার টাইপ করা শব্দগুলোয় হঠাৎ করেই ও যেন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের মতো মর্যাদা পেয়ে গেছে। আমার ভাই, আমার ছোট্ট ভাই, ওর ঠোঁটগুলো এখনও এত নরম আর গোলাপী!গলার স্বর এখনও এতটা কর্কশ হয়ে ওঠেনি যে অসহ্যকর মনে হয়।ওর দু’ চোখের পাপড়িগুলো কী দারুণ লম্বা আর ঘন কালো!ওর চোখের পিঙ্গল মণিগুলোতে যেন হাজারো বিস্ময়!মা শেষ বোতামটি আটকানোর সাথে সাথে একছুটে বেড়িয়ে গেল সে। মা আমার দিকে তাকালেন, সেই দৃষ্টিতে অনুরোধটি খুবই পরিষ্কার। অগত্যা আমিও পিছু নিলাম আমার ছোট্ট ভাইয়ের।
আমাদের ক্যাম্পগ্রাউন্ডের পাশের খোলা জায়গাটিতে এসে জড় হচ্ছে আমার ভাই, ওর বন্ধু মিশকা এবং ওদের সমবয়সী সব ছেলে। এদের সবার বয়স বার থেকে সতের’র মধ্যে। সেই চিঠিখানিতে এই বয়সের বিষয়টি খুব পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রতিটি পরিবারকে বিনীতভাবে অনুরোধ করা হয়েছে, যেন এই বয়সের কিশোর সদস্যটিকে এই মহৎকর্মে স্বেচ্ছায় নিয়োজিত করে সেবাদানের এক আশ্চর্য সুযোগ করে দেয়া হয়!আমি সম্পুর্ণভাবে নিশ্চিত নই এই ব্যাপারে, যে আমি এবং আমার মা, আমার ভাইকে ঠিক কতোটা আমাদের ইচ্ছায় এখানে নিয়ে এসেছি! আমি শুধু জানি, আমি কিংবা আমার মা, আমাদের কারোরই সেই হলুদ খাম, খামের উপর সেই সিল কিংবা এই অনুরোধ উপেক্ষা করার কথা একবারও মনে হয়নি!
আজ সারাদিন আকাশ মুখভার করে আছে। ক্যাম্পগ্রাউন্ডে আমাদের নির্দিষ্ট স্থানে আমার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিলো না।উদ্দেশ্যহীনভাবেই হেঁটে বেড়িয়েছি সারাদিন।আমি যখন মায়ের কাছে পৌঁছালাম, বাতাস আরও হিম শীতল হয়েছে। মা একা নয়, ছোট্ট আগুনের পাশে মিশকা’র দাদী এবং মাও বসে আছে। কেউ কোন কথা বলছেন না। সবাই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আগুনের উপর কালো পাত্রটি থেকে উঠা গরম বাষ্পের দিকে। কিছু একটা বলতে চাইলাম সবাইকে। কিন্তু কোন শব্দই যেন আমার মুখ থেকে বের হতে চাইলো না। মায়ের পাশে গিয়ে আগুনের উপর আমার ঠান্ডা হাতগুলো মেলে ধরলাম।আমার ভাই কিংবা মিশকা এখনও ফেরেনি!
আজ সকালেও সূর্য ওঠেনি।তুষারপাতের সাথে তীব্র বাতাসের বেগও সমান তালে পাল্লা দিয়ে যাচ্ছে।মাইকে কিছু একটা নির্দেশ দেয়া হচ্ছে কিন্তু বাতসের শোঁ শোঁ শব্দে সবই কেমন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। একটু সামনে এগিয়ে গেলাম যেন ভালো করে শুনতে পাই। আমার ছোট্ট ভাই, ওর বন্ধু মিশকা এবং ওদের সবাইকে আজই যেতে হবে!নিশ্চয় কোথাও কোন ভুল হচ্ছে! আজ রাতটিও আমার ভাই, মা এবং আমার সাথে কাটাবে! চিঠিতে এমনই বলা ছিল!আমার পড়তে ভুল হওয়ার কথা নয়!মা চুপ করে বসে পড়েছেন এক কোণায়। আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।
এর মধ্যেই তুষার জমে গেছে কয়েক ইঞ্চি!একটু আগেই ওদের একজন এসে নিয়ে গেছে আমার ভাইকে ক্যাম্পগ্রাউন্ডের পাশের মাঠটিতে। আমি দৌড়ানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু তুষারে বার বার বুটগুলো দেবে যাচ্ছে।আমি জানিনা আমি আদৌ কিছু করতে পারবো কী-না। কিন্তু অন্তত একবারের জন্য হলেও আমার ঐ মাঠটিতে যেতে হবে। আমার ছোট্ট ভাইটি ওদের একজনের সাথে বেড়িয়ে যাওয়ার পরই আমি প্রথমবারের মত উপলব্ধি করতে পারলাম, যে, আমার ভাই, ওর বন্ধু মিশকা কিংবা ওরা সবাই, কেউ আর ফিরবেনা! বার থেকে সতের বছরেরে এই সতেজ শরীরগুলো রাখা হবে সবার সামনে। যাকে বলা যায়, ওদের দিয়ে বানানো হবে মনুষ্য বর্ম। সাদা শুভ্র তুষার ওদের রক্তে ধীরে ধীরে লাল উঠবে!আমি ছুটছি, আমার হৃৎপিন্ডে অসম্ভব ব্যাথা হচ্ছে। সমস্ত বাতাস যেন আমার পাঁজরে আটকে আছে। আমি চীৎকার করতে চাইছি আমার সর্বস্ব শক্তি দিয়ে!ওরা লোহার গেট আটকে দিয়েছে।আমাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়া হয়েছে গেটের কাছ থেকে।আমি আবার ফিরে গেছি লোহার বেড়ার কাছে। ওই তো লোহার বেড়ার উপরেই এতগুলো মুখ! আমি খুঁজছি আমার ভাইয়ের মুখটি। আমি কোন মুখই আলাদা করতে পারছিনা! সবগুলো মুখই আমার ভাইয়ের মুখের সাথে এত মিল! সেই তো একই নাক কিংবা ভ্রু। মুখ টিপে হাসির ভঙ্গিটিতেও সবার কী আশ্চর্য মিল!
তীব্র ব্যর্থতা, হতাশা যে আক্রোশের জন্ম দেও, সেই সাথে তার শক্তিএক অলীক বিশ্বাসেরও জন্ম দেয় বুঝি! আমারও মনে হলো এই শক্ত লোহার বেড়াটি আমিও বোধহয় সজোরে উপড়ে ফেলতে পারবো।আমি লোহার তারগুলোকে খামচে ধরেছি। হিম শীতল তারগুলোর কোন অনুভূতি আমি টের পাচ্ছি না। আমার শুধু একবার আমার ছোট্ট ভাইয়ের মুখ ছুঁয়ে দেখতে হবে! আমার হাতের মুঠোয় ওর মুখের স্পর্শটুকু নিতে হবে!
লেখক পরিচিতি
রুবিনা খানম
জন্ম ও বেড়ে ওঠা ব্রক্ষ্মপুত্রের কোলঘেষা মফস্বল শহর ময়মনসিংহে। ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা সেই ছোটবেলা থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক করতে আসার বেশ আগেই তাই বিশ্ব সাহিত্যের সাথে পরিচয় হয়েছে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র’র হাত ধরে, কৈশোরে। এরপর দক্ষিন কোরিয়া থেকে ভাষা বিজ্ঞানের উপর স্নাতকোত্তর শেষ করে, বর্তমানে উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডায় পিএইচডি করছেন শিক্ষা অনুষদ এ। পড়তে ভালোবাসেন সব ভাষার, সব সময়কালের বই, সেই সাথে নিয়মিতই উপভোগ করেন দেশ বিদেশের নানা চলচ্চিত্র আর ঘুরোঘুরি।
অনিয়মিতভাবে হলেও লেখালেখি করছেন বহুদিন ধরেই। লেখার প্রকাশ এখন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রেখেছেন ছোট কাগজ, অনলাইন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা আর ব্লগে।
5 মন্তব্যসমূহ
আপু, ধন্যবাদ তোমার লেখার জন্য। গল্পের প্রতিটি লাইনেই খুব নিখুত এবং স্পষ্ট বর্ণনা দেয়া, এটা খুবই ভাল লেগেছে আমার। পড়তে পড়তেই শেষ হয়ে গেলো গল্পটা, মনে হচ্ছে আরও বড় হলে ভাল হত। খুব সুন্দর লেখা। আশা করি আরও লেখা পড়তে পারব তোমার। শুভ কামনা রইল।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ তোমাকে!
মুছুনগল্প ভালো হয় নাই। কারন গল্পপাঠ বলছে – “রুবিনা খানম এর “গল্প” ”। এগারো’শ তিরাশি শব্দের এই লিখাটির প্রতিটা লাইন , এক একটা গল্প । সেই হিসাবে “এত্তোগুলা” গল্প রুবিনা খানমের। “মিথ্যাবাদী” লেখককে মিথ্যার জগতে স্বাগতম । কেউ একজন বলেছিলো – মিথ্যা না হলে আসলে গল্প হয় না।
উত্তরমুছুনআমি দমবন্ধ করে গল্পগুলি পড়লাম। কেউ একজন গল্প লিখছে এবং সেটি বাংলায়। তার জন্য ভালোবাসা।ভালোবাসা দিলে খারাপবাসাও দিতে হয়। তাকে কিছুটা খারাপবাসাও দিলাম। খারাপবাসা দেয়ার কারন হচ্ছে সে পুরা গল্পে আমার নাম লিখেছে মাত্র একবার –“সাদা শুভ্র তুষার ওদের রক্তে ধীরে ধীরে লাল উঠবে”।
আর কোনো লিখা পড়তে চাই না তোমার । তবে...... যদি বলো নিয়মিত লিখবা তাইলে আশা করে থাকবো এবং পড়বো !
এক নিঃশ্বাসে পরে ফেললাম। অনেক সুন্দর একটা গল্প আপু। শুভ কামনা রইলো। আবারো লিখবেন।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
মুছুন