আমার একাডেমিক লাইফের শেষ পরীক্ষায় আমি লিখতে পারিনি। একজন শ্রুতি-লেখক সেই পরীক্ষায় লিখে দিয়েছিল। কারণ আমি যে হাতে লিখি, মানে আমার ডান হাত, ওটা তখন লেখার জন্য আনফিট ছিল। পুরো হাত ছিল প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে মোড়ানো। আর ডান হাতটা তখন সব সময় আমার গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখতাম। ওই হাতে পরবর্তী ছয় মাসে কলম ধরাই যাবে না। কিন্তু আমার মাস্টার্স পরীক্ষার শেষ পরীক্ষাটার কী হবে? মেজদা আর তুহিন গেল ভিসি স্যারের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে। সবকিছু শুনে ভিসি স্যার বললেন, উপায় একটা আছে; ও যদি কথা বলতে পারে, তাহলে শ্রুতি-লেখক নিয়ে পরীক্ষায় বসতে পারে। মেজদা আর তুহিন পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। শ্রুতি-লেখক কী? তুহিন মেজদাকে ইশারায় বলল, আগে স্যারের উপদেশটা শুনি, পরে তোমারে কইতাছি।
ভিসি স্যার বললেন, শ্রুতি-লেখকের জন্য ভিসি বরাবর আবেদন করতে হবে। সেই আবেদনের অনুলিপি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান, রেজিস্ট্রার আর প্রধান পরীক্ষকের বরাবরও দিতে হবে। আবেদনের সঙ্গে মেডিকেল সার্টিফিকেট আর প্রেসক্রিপশন দিতে হবে। আর যে শ্রুতি-লেখক হবে তার অঙ্গীকার নামাও দিতে হবে। পরীক্ষার্থী আর শ্রুতি-লেখকের শিক্ষাগত যোগ্যতার সকল সনদের ফটোকপিও দিতে হবে। আর এগুলো জমা দেওয়ার সময় আসল সনদপত্রও সঙ্গে আনতে হবে। একই সাবজেক্টে পড়াশোনা করেছে বা করছে এমন কেউ শ্রুতি-লেখক হতে পারবে না। শ্রুতি-লেখককে অবশ্যই অন্য সাবজেক্টের আর জুনিয়র হতে হবে।
ভিসি স্যারের কাছে এই কথা শুনে মেজদা আর তুহিন আবার গেল ডিপার্টমেন্টে চেয়ারম্যান স্যারের সঙ্গে দেখা করতে। চেয়ারম্যান স্যারই ওদের ভিসি স্যারের কাছে পাঠিয়েছিলেন। ওদের আবার দেখে স্যার জানতে চাইলেন, ভিসি স্যার কী বললেন? জবাবে ওরা বলল, মেডিকেল সার্টিফিকেট, প্রেসক্রিপশন, অঙ্গীকারনামা নিয়ে আবেদন করার জন্য। শ্রুতি-লেখক নিয়ে নাকি কৃষ্ণ পরীক্ষা দিতে পারবে। চেয়ারম্যান স্যার বললেন, তাহলে ওগুলো দ্রুত জোগাড় করে আবেদন করেন। আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
শ্রুতি-লেখক নিয়ে যে পরীক্ষা দেওয়া যায়, এই প্রথম মেজদা ব্যাপারটা শুনে তুহিনের কাছে এবার এর ব্যাখ্যা জানতে চাইল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে কলাবাগানের উদ্দেশে ওরা রিকশা নিল। রিকশায় বসে তুহিন বলল, শ্রুতি-লেখক হলো একজন সহযোগী লেখক। যার পরীক্ষা সে লিখবে না। লিখবে এই শ্রুতি-লেখক। কিন্তু যা যা লিখবে পাশে বসে যার পরীক্ষা সব তাকেই বলতে হবে। শ্রুতি-লেখক একটা কথাও নিজের লিখতে পারবে না। মানে আমি যদি কৃষ্ণর শ্রুতি-লেখক হই, পরীক্ষার হলে কৃষ্ণ যা যা বলবে, আমার শুধু খাতায় তাই লিখতে হবে। আমার নিজের থেকে কিছুই লেখা যাবে না। মেজদা বলল, তুমি যদি কিছু লেখো তা স্যাররা বুঝবে কীভাবে? জবাবে তুহিন বলল, সেই জন্যই একই সাবজেক্টের কেউ শ্রুতি-লেখক হতে পারবে না। যাতে শ্রুতি-লেখক নিজে কিছু লিখতে না পারে। যা লিখবে আসল পরীক্ষার্থীর কথাই লিখবে। মেজদা বলল, তালি বাইরে কাউরি না খুঁইজা তুমি হও শ্রুতি-লেখক। তালি কৃষ্ণরও একটু সুবিধা হবে। তুমি ওর সব কথা বোঝো। আবার ও তোমারে সহজে সব বুঝাতি পারবেনে। জবাবে তুহিন বলল, দেখি, কাউরি না পালি তো আমি আছি। মেজদা বলল, না, কাউরি আর জড়ানো দরকার নাই। তুমি হও শ্রুতি-লেখক।
তুহিন একটু চিন্তায় পড়ল। ব্যাপারটা মুখে বলার চেয়ে আসলে অত সহজ না। একটানা চার ঘণ্টা পরীক্ষার হলে পাশে বসে শুনে শুনে লেখার কাজটা অত সোজা না। তার পরও কৃষ্ণর জন্যি আমি এটুক করতে পারব না। নলি আমি কৃষ্ণর কিসের বন্ধু? নিজের চিন্তা নিজের ভেতরে রেখে তুহিন বলল, তার আগে মেডিকেল সার্টিফিকেট তুলতে হবে। আমার আর কৃষ্ণর সকল সার্টিফিকেট ফটোকপি করতে হবে। অঙ্গীকার নামা লিখতে হবে। অ্যাপ্লিকেশন লিখতে হবে। অনেক ঝামেলা আছে। এই দুই দিনে এত ফ্যাসাদ ঠিকঠাক করতি না পারলি কৃষ্ণর আর পরীক্ষা দেওয়া হবে না। শুনে মেজদা বলল, তুমি এই তিন দিন আর অন্য কোনো কাজে নতুন করে জড়াইও না। নলি কৃষ্ণর পরীক্ষাটা আর দেওয়া হবে না। আমি ঢাকা না থাকলি তো ওর চিকিৎসাই হতো না। ছোট্ট একটা আফসোস বুকের মধ্যে হজম করতে করতে মেজদা তুহিনের হাত চেপে ধরল। তুমি কৃষ্ণর পাশে না দাঁড়ালি ওর পরীক্ষা দেওয়া হবে না, তুহিন। জবাবে তুহিন মেজদার হাত আরও শক্ত করে ধরে বলল, চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হবে।
এরপর কারও মুখে কোনো কথা নেই। ওদের রিকশা নীলক্ষেত, নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, ঢাকা কলেজ, সায়েন্স ল্যাব, সিটি কলেজ ছাড়িয়ে মিরপুর রোড ধরে কলাবাগানের দিকে এগোতে থাকে। রাস্তার অন্য গাড়ি-রিকশা, মানুষ, জ্যাম, জটলা কারও দিকে ওদের কারও কোনো খেয়াল নেই। কলাবাগান ফার্স্ট লেইনের মুখে এসে রিকশাওয়ালা জানতে চাইল, আপনেরা কই নামবেন? জবাবে তুহিন বলল, আপনি ডান দিকে লেকসার্কাসের দিকে ঢুকে যান। রিকশাওয়ালা আবার সেই সুযোগে বলল, আপনারা তো লেকসার্কাসের কথা বলেন নাই। কলাবাগান বলেছেন? তুহিনের মেজাজ তখন হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। আপনি কী বুঝতিছেন, আমরা কি বিপদের মদ্দ্যি আছি? লেকসার্কাস নামালি কি আপনার কোস্টা রাম্বা হবে? রিকশাওয়ালা তুহিনের মেজাজ বুঝতে পেরে ঘোত ঘোত করতে থাকে। আর লেকসার্কাসের দিকে এগোতে থাকে। একপর্যায়ে তুহিন রিকশাওয়ালাকে নির্দেশ দেয়, ওই লন্ড্রির সামনে দাঁড়ান। মেজদা রিকশাভাড়া দিতে গেলে তুহিন বলল, ওরে দুই টাকা বেশি দাও। রিকশাওয়ালা পাঁচ টাকা বেশি দাবি করল। জবাবে তুহিন বলল, এখন মাইর ছাড়া আর কোনো বকশিশ নাই। লন্ড্রি থেকে এই সময় লিটন জানতে চায়, কী হইছে? জবাবে তুহিন বলল, আরে লিটন ভাই, আর কইয়েন না। শালার কত ঝামেলা। রিকশা কলাবাগান কইছি, লেকসার্কাস ক্যান কই নাই, এই জন্যি ভাড়া বেশি দিতি হবে। লিটন রিকশাওয়ালাকে বলল, এখন সোজা পশ্চিম দিকে ঘুরে ভাগো, নইলে তোমার পুটকি বরাবর মারব। এরপর জানতে চাইল, কৃষ্ণ কি পরীক্ষা দিতে পারবে? ওরা তিনজন এই বিষয়ে কথা বলতে বলতে বাসায় ঢুকল।
লেকসার্কাসের এই দোতলা বাসায় আমি আর লিটন প্রায় তিন বছর ধরে আছি। পাশের রুমে ফজলু আর মতি থাকে। তুহিনও একবার কাঁঠালবাগানের বাসা থেকে রাগ করে তিন মাসের জন্য আমাদের সঙ্গে মেসমেট হয়েছিল। প্রত্যেকের বাড়ি আলাদা জায়গায় হলেও সবার সঙ্গেই সবার খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তুহিন আর আমার বাড়ি পিরোজপুর। লিটনের বাড়ি নোয়াখালী। ফজলুর বাড়ি ফরিদপুর রাজবাড়ি আর মতির বাড়ি মানিকগঞ্জ। আমি যে পরীক্ষা দিতে পারব, এ কথা শোনার পর সবার মধ্যেই একটা আনন্দ কাজ করল। লিটন বলল, আমনেরা পারলে একটু প্র্যাকটিস কইরা নিয়েন। জবাবে তুহিন বলল, রাতে আমরা প্র্যাকটিস শুরু করব। বিকালে আমার একটু কাঁঠালবাগানে কাজ আছে। আর এই কয় দিন কৃষ্ণর সাথে থাকার জন্যি সব গুছাই আসতি হবে। শুনে লিটন বলল, মেজদা তাহলে একটু রেস্ট নেন। আমি কৃষ্ণদাকে নিয়ে মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়া আসি।
বিকালে লিটন আর আমি মেডিকেল সার্টিফিকেট আনার জন্য আগারগাঁও পঙ্গু হাসপাতালে গেলাম। ডাক্তার আকবর আলী খুব কঠিন মানুষ। একটু এদিক-ওদিক হলেই কড়া ধমক মারেন। আবার ভেতরে ভেতরে তিনি খুব রসিক। আমি ডাক্তার জাহাঙ্গীরের ছোট শ্যালক ফুয়াদের বন্ধু। এটা শোনার পর থেকেই আমাকে আর ধমক মারেন না। উল্টো রসিকতা করছেন। ডাক্তার আকবর আলী আমার বর্তমান অবস্থা সব খুঁটে খুঁটে শুনলেন। পেইন আছে কি না, চুলকায় কি না, ওষুধ ঠিকমতো খাইছি কি না। আমি আর লিটন এসবের জবাব দিলাম। পরীক্ষার জন্য মেডিকেল সার্টিফিকেট লাগবে শুনে ডাক্তার আকবর আলী খুব খুশি হন। আমি যে শ্রুতি-লেখক নিয়ে পরীক্ষা দিতে পারব, এটা শুনেই ডাক্তার আকবর আলী সার্টিফিকেট লিখতে বসে গেলেন। তোমরা বরং ডাক্তার জাহাঙ্গীরের ওখান থেকে ঘুরে আসো, আমি সার্টিফিকেট লিখতেছি। আর তোমার নামের পুরোটা এই কাগজে লেখো। আমি ডাক্তার আকবর আলীর দেওয়া সাদা কাগজে নিজের পুরো নাম লিখলাম-- জি. কৃষ্ণ মুনশী। এরপর কাগজটা ডাক্তার আকবর আলীকে দিয়ে লিটনসহ ডাক্তার জাহাঙ্গীরের রুমের দিকে হাঁটা দিলাম।
আমাদের আসতে দেখেই ডাক্তার জাহাঙ্গীর হাঁক ছাড়লেন, কি শালা, এখন কী অবস্থা? ব্যথা আছে? ডাক্তার আকবর ছিল? তোমরা কিছু খাবা? পরীক্ষার কি হবে? একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন। আমরা ডাক্তার জাহাঙ্গীরের চেম্বারে বসতে বসতে প্রশ্নের জবাব দেওয়া শুরু করলাম। সবকিছু আমাদের মুখে শোনার পর ডাক্তার জাহাঙ্গীর বললেন, পরীক্ষার পর ওই সুন্দরীকে নিয়া একবার আসো, যার জন্যি সুইসাইড করতি চাইছিলা? নইলে তোমার ওই প্লাস্টিক আর আমরা কাটতে পারব না। বাকি জীবন এইভাবে থাকবা। শালা, পরীক্ষার চিন্তা বাদ দিয়া সুন্দরীর জন্যি সুইসাইড মারাতি গেছিলা? এখন কেমন লাগে? শুনে আমি কঠিন কষ্টের মধ্যেও একটু মিটমিট করে উঠলাম।
ডাক্তার আকবর আলী তার প্যাডে লিখেছেন--
This is to certify that Mr. G. Krishna Munshi has been treatment under my supervision since 20 January 1996. A major surgery operation has been done in his right hand wrist. Almost all major veins and arteries of his right hand wrist have been cut off. We try our best to surgery it and it will need minimum six month to open the hand. In the mean time Krishna would be our regular supervision. We are hoping he would do work slowly after open his bandage. If the surgery have any major fault, he would face further major operation other wise his hand would be permanently disable to work.
If he gets sense in his fingers then we can proudly say that operation is success. But unless six months or more we could not apparently say that he could work properly by his right hand.
I hope his early recovery from his trauma and all success in future.
আমরা মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়ে লেকসার্কাস ফিরে আসতে আসতে ঘোর সন্ধ্যা। লিটন বলল, বাসায় না ঢুকে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে কিছুক্ষণ সময় কাটাই। গরম কিছু খাই। ভালো লাগবে। ফুচকা অর্ডার দিয়ে ধানমন্ডি ব্রিজের ঠিক দক্ষিণ পাশে লেকের পাড়ে বসেছি দুজন। লিটন জানতে চায়, মিরা দি’র আর কোনো খবর আছে? আমি চুপ করে আছি। লিটন বুঝতে পারল এই বিষয়ে আর কথা না ওঠানো ভালো। ইউনিভার্সিটি তো সুযোগ করে দিল পরীক্ষা দেওয়ার। এখন তুহিনকে নিয়ে প্র্যাকটিসটা ভালোমতো করেন। আপনাদের তো আবার অনেক আঁকাআঁকি আছে। ওগুলো একটু তুহিনকে দেখিয়ে দেন। আর একটা প্ল্যান করেন, সব প্রশ্নের শর্টকাট আনসার দেওয়ার জন্য। এই পেপারে আপনার ফোরটি পেলেও তো সেকেন্ড ক্লাস আসবে, কী বলেন? লিটনের এতক্ষণের কথার খেই ধরে জবাবে বললাম, দেখি, হয়তো আসবে। না এলেও ক্ষতি নেই। যেন লিটনই বাকি পরীক্ষাগুলো দিয়েছে, এমন একটা ভঙ্গি করে লিটন বলল, আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, আপনার মাইক্রো, ম্যাক্রো পরীক্ষা ভালো হয়েছে। আরেকটা যেন কী ছিল? জবাবে বললাম, ‘মানি অ্যান্ড ব্যাংকিং’। লিটন আবার বলল, ব্যাংকিংয়ে তো আপনি মিঞা মাস্টার। তাহলে এই পেপারে পাস হলেও সেকেন্ড ক্লাস থাকবে। নইলে আমার হাত এইবার আপনে কাইটা দিয়েন। আমি একটু নির্লিপ্তভাবে হাসলাম। সেই হাসির মধ্যে একটা গোপন বিষবাষ্প লুকানো ছিল। ফুচকা পুরোটা শেষ না করেই লিটনকে বললাম সিগারেটটা একটু জ্বালিয়ে দিতে। কারণ, এক হাতে আমি তখন আর সিগারেট ধরাতে পারি না। লিটন সিগারেট জ্বালিয়ে আমার হাতে দিলে সিগারেটে একটা টান মেরে বললাম, জীবনটা কেমন যেন বদলে গেল, লিটন ভাই। আচ্ছা, ‘ভলগা থেকে ভাগীরথী’ বইটা যেন কার লেখা?
লিটন বাংলার স্টুডেন্ট কিন্তু আমার প্রশ্নে সে এখন কিছুটা যেন বিব্রত। লেখকের নাম এই মুহূর্তে তার মনে পড়ছে না। পাল্টা সে জানতে চাইল, নিরোদ সি. চৌধুরীর লেখা আপনার কেমন লাগে? জবাবে বললাম, ভালো। নিরোদ সি. চৌধুরীর ‘বাঙালী জীবনে রমণী’ পড়েনি এমন শিক্ষিত পুরুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। কিন্তু তার মাস্টার পিস ‘দ্য অটোবায়োগ্রাফি অফ অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’ জিনিস একখান। ব্যাটা লেখাই শুরু করেছিলেন পঞ্চাশ বছর বয়সে। তারপর যা লিখলেন সব যেন সোনার টুকরা। আমরা পঞ্চাশ বছর বাঁচমু কি না কেউ জানি না। তার ‘আজ হতে শতবর্ষ আগে’ অনেক ভালো লেগেছে। জবাবে লিটন বলল, রবীন্দ্রনাথকে টেক্কা মারতে উনি এইটা লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন-- ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছ বসি...’
রাতে তুহিন আসলে আমরা প্র্যাকটিস শুরু করলাম। প্রথম ঘণ্টা গেল নানা ছোটখাটো তর্কেবিতর্কে। লিটন এসে আমাদের তর্কের মধ্যে ঢুকে পড়ল। পরীক্ষার হলে এরকম হলে সব যাবে গিয়া। মতি এসে শুনতে চাইল তর্কটা কী নিয়ে। ফজলু এসে ইশারায় ডাকল, চলেন দাদা ছাদ দিয়া ঘুইরা আসি। মাথা ঠান্ডা কইরা দেন আবার শুরু কইরেন। বুঝতাছি দুজনার মাথাই এখন গরম। পরে সবাই মিলে আমরা ছাদে গেলাম। আজকে শীতের ঝাঁজটা একটু কম। সিগারেট শেষ কইরা আমরা ছাদ থেকে নামব। মেজদার উপস্থিতির কারণে এই শীতের মধ্যেই ছাদে গিয়া এই সিগারেট খাওয়া। শেষে ফজলু আর লিটন পরামর্শ দিল-- আপনারা আগে একটা প্ল্যান করেন। চার ঘণ্টায় কয়টা প্রশ্ন লিখতে হবে? একটা প্রশ্নে সময় কতটুকু পাওয়া যায়? শ্রুতি-লেখক নিশ্চয়ই তার চেয়ে বেশি সময় লাগাবে লিখতে। তাই প্রশ্নের জবাব অবশ্যই ছোট করেন। আর উত্তর ভুল হোক শুদ্ধ হোক তুহিন শুধু লিখবেন। আপনি মাঝখানে কমেন্ট দিলে কৃষ্ণদা কিন্তু খেই হারিয়ে ফেলবে। চার ঘণ্টা টানা বক্তৃতা করার মতো ব্যাপার আর কি। অত সোজা না কিন্তু। টুকটাক আঁকাউকি একটু দেখান ওনাকে। দেখেন ভালো হবে। তর্ক করা মানে নিজেদের সময় নষ্ট করা। তুহিন ওর ভুল বুঝতে পেরে বলল, পরীক্ষার হলে তো আর তর্ক করব না। এখন করে নিচ্ছি যাতে আমার বুঝতে সুবিধা হয়। ছাদ থেকে নেমে তুহিন আর আমি আরও ঘণ্টা খানেক প্র্যাকটিস করলাম। এবার অনেকটা উন্নতির লক্ষণ।
সকালে তুহিন ফটোকপির দোকান থেকে আমার আর তুহিনের সকল সার্টিফিকেট ফটোকপি করল। মেডিকেল সার্টিফিকেট ফটোকপি করল। প্রেসক্রিপশন ফটোকপি করল। সাদা কাগজে অঙ্গীকার নামা লিখেছিল, ওটাও ফটোকপি করল। তুহিন আর মেজদা ইউনিভার্সিটি রওনা দেওয়ার আগে অঙ্গীকার নামাটা দেখে লিটন আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে শব্দ করে পড়া শুরু করল--
বরাবর
উপাচার্য,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
মাধ্যম: চেয়ারম্যান, ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিকস
বিষয়: শ্রুতি-লেখক হিসেবে অঙ্গীকার নামা
মহোদয়,
বিনীত নিবেদন এই যে, আমি তুহিন এ বছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজ থেকে বিকম পাস করেছি। বর্তমানে আমি একই কলেজ থেকে প্রিলিমিনারি মাস্টার্স (ম্যানেজমেন্ট) অধ্যয়নরত। আমি এই মর্মে অঙ্গীকার করছি যে, জনাব জি. কৃষ্ণ মুনশীর শ্রুতি-লেখক হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করব। চার ঘণ্টা পরীক্ষার হলে শুধু শ্রুতি-লেখক হিসেবে আমি কাজ করব। যদি এর কোনো ব্যত্যয় ঘটে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে।
আবেদনপত্রের সঙ্গে আমার সকল সনদের সত্যায়িত ফটোকপি সংযুক্ত করলাম।
অতএব, জনাবের নিকট প্রার্থনা, আমি যাতে জি. কৃষ্ণ মুনশীর শ্রুতি-লেখক হিসেবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাই তার যথাযথ ব্যবস্থা করতে কর্তৃপক্ষের আজ্ঞা হয়।
বিনীত নিবেদক
তুহিন
অনুলিপি:
১. চেয়ারম্যান, ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিকস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২. রেজিস্ট্রার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৩. প্রধান পরীক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পরদিন। সারা দিন ঘুরে ভিসি স্যারের দেখা পায় না ওরা। স্যার কোথায় যেন একটা সেমিনারে আছেন। বিকালে একটা মিটিংয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত রাত এগারোটায় ওরা ভিসি স্যারের দেখা পেলেন। ভিসি স্যার শ্রুতি-লেখকের জন্য আবেদনপত্র গ্রহণ করেছেন। মেজদা আর তুহিনকে বলেছেন, আমি এখন যে অনুমতিপত্রটা দেব, অনুলিপি যাদের দিয়েছেন, প্রত্যেককে এটার একটা কপি দিবেন। আর এই সব কাগজের ফটোকপি পরীক্ষা শেষে খাতার সঙ্গে পিনআপ করে দিবেন।
রমজান মাস। দুপুরে ওরা খাওয়ার সময় পায় নাই। সন্ধ্যায় ইফতারি দিয়ে লাঞ্চ সেরেছিল। কারণ পরদিন আমার পরীক্ষা। ভিসি স্যারকে না পেলে আমার আর পরীক্ষা দেওয়া হবে না। রাত বারোটায় ওরা বাসায় ফিরল। তুহিন বলল, এখন একটা টানা ঘুম দেব। সকালে প্র্যাকটিস যা করার করব। আমাকে বলল, তুইও ঘুমা। আমি রাত দুইটা পর্যন্ত একটু বইতে চোখ বোলালাম। একাডেমিক লাইফের শেষ পরীক্ষার পরিণতি কী হয় জানি না। একটা ঢিবঢিবানি মাথার মধ্যে সারাক্ষণ ঘড়ির কাঁটার মতো টিকটিক করছে। যা পড়ছি তা-ও কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। বিশাল এক অনিশ্চয়তা নিয়ে শেষ পর্যন্ত কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম নিজেও জানি না।
দুপুর একটায় পরীক্ষা শুরু হবে। সাড়ে বারোটার মধ্যে আমরা ক্যাম্পাসে গেলাম। যারাই আমাকে দেখছে জিজ্ঞেস করছে কী হয়েছে, আমি আর তুহিন সংক্ষিপ্ত জবাব দিচ্ছি। কয়েকটা বেঞ্চ ফাঁকা রেখে সেকেন্ড রোতে একদম সামনের বেঞ্চে আমাদের বসার ব্যবস্থা হলো। পরীক্ষা শুরু হলো। প্রশ্নপত্র মোটামুটি ভালো। তুহিনের সঙ্গে হিসাব করলাম। পাঁচটা প্রশ্নেরই উত্তর লিখব। তিনটা খুব ভালো জানা। দুইটায় চাপা মারতে হবে। আমরা তিনটার জন্য সময় নিলাম একশো ত্রিশ মিনিট। আরও হাতে আছে একশো দশ মিনিট। অর্থাৎ একটি প্রশ্নের জন্য গড়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আমার বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কারণ, আমি যা বলি, তুহিন পরীক্ষার খাতায় তা-ই লেখে। আমার বলা বন্ধ। তুহিনের কলমও বন্ধ। এমনিতে তুহিনের হাতের লেখা আমার মতো অত ভালো না। তুহিনের হরফগুলো বাচ্চাদের হাতের লেখার মতো বড় বড়। আমি বললাম, লিখবি একটু দ্রুত। হাতের লেখা কোনো ফ্যাক্টর না। আমি কী লিখছি সেটা ফ্যাক্টর। অন্তত পড়া গেলেই চলবে। তুহিন লিখতে পারে বেশ দ্রুত। এটা খুব ভালো কাজ দিয়েছে। তুহিন এক লাইন লিখতে লিখতে আমি পরের লাইন কী হবে সেটা চিন্তা করে বলার জন্য রেডি থাকি। তুহিনও আমাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে যে, পরীক্ষা ভালো হচ্ছে। আমি বারবার জল খাচ্ছি।
এরমধ্যে ইসলামের ইতিহাসের এক ম্যাডাম এসে জানতে চাইলেন, তোমার হাতে কী হয়েছে? জবাবে বললাম, ম্যাডাম আপনাকে বলতে গেলে আমার শ্রুতি-লেখকের কলম বন্ধ হয়ে যাবে। তার পরও উনি সারসংক্ষেপ শুনতে চাইলেন। আমি তখন আর মেজাজ কন্ট্রোলে রাখতে পারলাম না। সরাসরি বললাম, প্লিজ ডোন্ট ডিসটার্ব আস। লেট মি নো ইউ আফটার মাই এক্সাম। তার পরও উনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তখন আগুন চোখে বাঁ হাতে দরজা দেখিয়ে ম্যাডামকে ইশারা করলাম, জাস্ট গো...নইলে এরপর আমি ওনাকে মহা গালি পারতাম। ম্যাডাম গিয়ে আবার দরজার কাছে দাঁড়ানো নাসরিন আপার কাছে আমার বিষয়ে জানতে চাইলেন। খেয়াল করলাম, নাসরিন আপা ওই ম্যাডামকে আমার ব্যাপারে আপডেট দিচ্ছেন। আমরা আবার লেখায় মনোযোগী হব। তার আগে তুহিন আর আমার একটু বাথরুমে যাওয়া দরকার।
বাথরুমে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তুহিন বলল, তুই কিছু না বললে এরপর আমি ওনাকে আচ্ছামতো কিছু বলতাম। আমি বললাম, শালীর মাগি কোথাকার। দেখতে পাচ্ছে যে, আমি শ্রুতি-লেখক নিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছি। এখন আমি অন্য কারও সঙ্গে কথা বলা মানে আমার ডিসটার্ব। আর ওই লেডির এইটুকু জ্ঞান নাই। আবার নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার। আমার বালের টিচার। আবার আসলে আমি ওর শাড়ি খুলে রেখে দেব। ব্যাটি কি জানে, আজ আমার এই দশা কী কারণে? হলে গিয়ে আবার আমরা পরীক্ষা শুরু করলাম। আমার সর্বশেষ অর্থাৎ পাঁচ নম্বর প্রশ্ন। মাইগ্রেশন নিয়ে প্রশ্ন। চাপা মারতে হবে। হাতে আছে চল্লিশ মিনিট।
আমি চিন্তা করে করে বলছি। তুহিন তাই আমার পরীক্ষার খাতায় লিখছে। সাধারণভাবে মাইগ্রেশন বলতে আমরা বুঝি, কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির এক স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে (বসবাসের উদ্দেশ্যে) চলে যাওয়া বা গমন। এই গমন দেশের মধ্যেও হতে পারে, দেশের বাইরে, বিদেশেও হতে পারে। আবার পড়াশোনার জন্য একজন ছাত্রের এক বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াও মাইগ্রেশন। সারা বিশ্বে ঋতু বদলায়। ঋতু বৈচিত্র্যের কারণে অনেক সময় পাখিরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, কখনো কখনো এক দেশ থেকে অন্য দেশে গমন করে। এটাও মাইগ্রেশন। সে ক্ষেত্রে পরিভ্রমণশীল ওইসব পাখি হল মাইগ্রেটরি বার্ডস। মানুষের ক্ষেত্রে তারা মাইগ্রেটরি পিপল। স্টুডেন্টসের ক্ষেত্রে তারা মাইগ্রেটরি স্টুডেন্টস। আবার জলের নিচে মাছ ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অথবা জোয়ার-ভাটার কারণে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করে। সে ক্ষেত্রে তারা হলো মাইগ্রেটরি ফিস। এই যে স্থান ত্যাগ করে চলে যাওয়া বা গমনাগমন বা এই যে অবস্থা এটা হলো মাইগ্রেট। আর অভিপ্রয়াণকারী বা গমনকারী ব্যক্তি বা প্রাণীর দল হলো মাইগ্র্যান্ট। যদি কোনো ব্যক্তি বসবাসের জন্য বিদেশে গমন করেন, তিনি তখন ইমিগ্র্যান্ট। অর্থাৎ বহিরাগত বা অভিবাসী। আমরা যাদের বলি প্রবাসী। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয় অথচ রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় বা ছাত্রনেতাদের কল্যাণে যারা ছাত্রদের পাশাপাশি এখন হলে বসবাস করছে, যাদের আমরা বহিরাগত বা ক্যাডার বলি, তারাও মাইগ্র্যান্ট। তারা ছাত্র নয়, কিন্তু ছাত্রদের দমন পীড়ন করার জন্য হলে থাকে। তাহলে এরা হলো মাইগ্রেটরি ক্যাডার বা বহিরাগত দুশমন।
সূর্য থেকে আলো পৃথিবীতে আসে। পৃথিবীর নিজস্ব কোনো আলো নাই। তাই পৃথিবীর কাছে সূর্যের এই আলো হলো মাইগ্রেটরি লাইটস। বুড়িগঙ্গার জল শীতলক্ষ্যায় যাচ্ছে। শীতলক্ষ্যার জল ধলেশ্বরী বা মেঘনায় যাচ্ছে। মেঘনার জল বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে। ওদিকে পদ্মার জল মধুমতি যাচ্ছে। মধুমতির জল বলেশ্বরে যাচ্ছে। বলেশ্বরের জল ভৈরবে যাচ্ছে। ভৈরবের জল পশুর নদীতে যাচ্ছে। পশুর নদীর জল শিবসায় যাচ্ছে। শিবসার জল বঙ্গোপসাগের যাচ্ছে। এটা হলো জলের মাইগ্রেশন। আবার বঙ্গোপসাগরে সূর্যের তাপে জল বাষ্পীভূত হয়ে আকাশে মেঘের সৃষ্টি করছে। ফলে সেখানে বায়ুশূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। এই বায়ুশূন্যতা পূরণ করতে চারপাশ থেকে বায়ু এসে শূন্যস্থান পূরণ করার চেষ্টা করছে। তখন সেখানে বায়ুঘূর্ণি তৈরি হচ্ছে। এই বায়ুঘূর্ণি যখন আর ব্যালেন্স করতে পারছে না, তখন তা প্রবল হয়ে আকাশের মেঘকে ধাক্কা দিচ্ছে। মৌসুমি বায়ুর চরিত্র অনুযায়ী বাতাস নিত্য এই খেলা খেলছে। কখনো দক্ষিণ থেকে উত্তরে, কখনো উত্তর থেকে দক্ষিণে। বাতাসের চাপে আকাশের মেঘ উত্তরে গিয়ে হিমালয়ে আঘাত পাচ্ছে। ফলে আবার ব্যাকটার্ন করছে। আর তখনই নামছে বৃষ্টি বা ঝড়। কখনো কখনো প্রবল বাতাসের চাপে মেঘঘূর্ণির কারণে এমনিতেই বর্ষা হয়ে ঝরে পড়ছে। এই যে জলের বারবার স্থান বদল, এটাও জলের মাইগ্রেশন। আমরা যে বৃষ্টি দেখি সে আসলে মাইগ্রেটরি ক্লাউড। অথবা মাইগ্রেটরি ওয়াটার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্কুলে যেতে ভালো লাগত না। তাই তিনি বাড়িতে বসে পণ্ডিত মশাইর কাছে পড়তেন। কিন্তু বড় হয়ে তো আর বাড়িতে বসে থাকার জো নেই। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোট ছেলে রবিকে তাই ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলেত পাঠালেন। কিন্তু বিলেতে রবি বাবুর মন টিকল না। তিন মাস না যেতেই রবি আবার কলকাতায় ফিরে এলেন। পরে দেবেন্দ্রনাথ ছেলেকে জমিদারি দেখাশোনার জন্য বাংলাদেশের শিলাইদহে পাঠালেন। রবীন্দ্রনাথের লন্ডনের তিন মাস হলো মাইগ্রেটরি স্টুডেন্ট হিসেবে। আর শিলাইদহে বসবাস হলো মাইগ্রেশন বা অভিবাসন। তেমনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যশোরের মণিরামপুর থেকে চলে গেলেন লন্ডন। সেখানে ইংরেজ কবিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইংরেজিতে কবিতা লেখা শুরু করলেন। কিন্তু মাতৃভাষার প্রেমে আবার চলে এলেন ভারতবর্ষে। মাইকেলের এই লন্ডনে বসবাসকালীন সময়টা হলো মাইগ্রেশন। আর ফিরে আসাটা হলো স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।
সিরাজগঞ্জের কাজীপাড়ার যমুনার চরের মানুষজন, যারা বারবার নদীভাঙনের কারণে শেষ পর্যন্ত ঢাকায় এসে কড়াইল বস্তিতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে তারা হলো মাইগ্র্যান্ট পিপল। বেঁচে থাকার জন্য তারা বাড়িঘর-ভিটেমাটি সর্বস্ব হারিয়ে এখন ঢাকায় বস্তিতে বসবাস করছে। নদীভাঙনজনিত কারণে এরা মাইগ্রেটেড। আমার বন্ধু প্রকাশ পিরোজপুর থেকে ঢাকায় এসেছিল পড়াশোনার জন্য। পড়াশোনা শেষ করে উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় কানাডার টরেন্টোতে ইমিগ্র্যান্ট হয়ে চলে গেল। এখন ও কানাডিয়ান নাগরিক। প্রকাশও একজন মাইগ্র্যান্ট। আর তার কারণ উচ্চশিক্ষা আর উন্নত জীবনব্যবস্থার হাতছানি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব টুঙ্গিপাড়ায় বড় হয়েছেন। রাজনীতি করার কারণে পরবর্তী সময়ে ঢাকার ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে সেটেলড হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকায় সেটেলড হওয়াও মাইগ্রেশন। এটা হলো ইন্টারনাল মাইগ্রেশন। আবার বঙ্গবন্ধু পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট সপরিবারে নিহত হওয়ার সময় সৌভাগ্যক্রমে তার দুই কন্যা জার্মানিতে থাকায় বেঁচে যান। পরবর্তী সময়ে বড় মেয়ে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করলেও ছোট মেয়ে শেখ রেহানা ইংল্যান্ডে স্থায়ীভাবে থেকে যান। আবার শেখ রেহানার ছেলেমেয়েরা এবং শেখ হাসিনার ছেলেমেয়েরা যথাক্রমে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। এটা যদিও রাজনৈতিক কারণ। কিন্তু এটাও মাইগ্রেশন আর এটা হলো বহির্গমন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। মিলিটারি ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতা পেল খন্দকার মোশতাক আহমদ। তারপর ক্ষমতার পালাবদল শুরু। এরপর রাষ্ট্রক্ষমতা পেলেন জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা--এই যে ক্ষমতার পালাবদল, এটা হলো রাষ্ট্রক্ষমতার মাইগ্রেশন। যেখানে রাজনীতি, সময়, জনগণের সমর্থন, মিলিটারি সমর্থন, দুর্নীতি, দুঃশাসন, নির্যাতন, নিপীড়ন, সম্পদ লুণ্ঠন, খুন, হত্যা, গুম, ভোট চুরি, ষড়যন্ত্র, রাজনৈতিক প্রভাব, ইত্যাদি নানা কারণে এই ক্ষমতার পালাবদল। যাকে আমরা বলতে পারি ক্ষমতার মাইগ্রেশন।
কবি রণজিত দাশ লিখেছেন, ‘সময় সবুজ ডাইনি, পৃথিবীর উপকূলে থাকো; সন্ধ্যার উঠোনে তুমি, নাবিকের হাড় দিয়ে ভাঙা জাহাজের ছবি আঁকো, সময় সবুজ ডাইনি’...। সময় যাকে আমরা এভার গ্রিন বলতে পারি। কখনোই সে বুড়ো হয় না। কবি বলেছেন সবুজ ডাইনি। কোথায় থাকে সময়? কবির জবাব-- পৃথিবীর উপকূলে সে রাক্ষসের মতো ওত পেতে থাকে। সেই সময়, ডাইনির মতো যার সব আচরণ। সেই সময়, সন্ধ্যার নির্বাক আলো-আঁধারির মধ্যে কী করছে? কোনো এক দুর্ভাগ্যকবলিত জাহাজ, যেটি মলয় সাগরে বা অন্য কোনো সাগরে কোনো এক ঘোর দুর্বিপাকে ডুবে গিয়েছিল। যে জাহাজের এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। সেই জাহাজের নাবিকেরা সবাই মরে ভূত। সেই নাবিকদের কারও কোনো হাড় হয়তো সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে একসময় কূলে এসেছিল। সেই হাড় দিয়ে, ওই নাবিকের কোনো বংশধর বা উত্তরপুরুষ বা এ কালের কোনো ছোট্ট ছেলে সন্ধ্যার অবকাশে খোলা আকাশের নিচে উঠোনে বসে বসে সেই ডুবে যাওয়া ভাঙা জাহাজের ছবি আঁকার চেষ্টা করছে। অথচ সে জানে না, এই ভাঙা জাহাজ আর এই হাড়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক কতটা নিবিড়। কিন্তু সে নির্বিকারভাবে সেই নাবিকের হাড় দিয়ে একটি ভাঙা জাহাজের ছবি আঁকার চেষ্টা করছে। সময় কত নিষ্ঠুর। এখানে সময় নিজেই মাইগ্রেটেড। আর তার নিয়ামক নাবিকের ভাঙা হাড়। আর ওই ছোট্ট ছেলেটি হলো কাকতালীয় সেই নিয়ামকের প্রলুব্ধ শিকারি।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে। নিতাই বল, হরি বল। গোউর বল, হরি বল। নিতাই গোউর হরি বল। হরি বল, হরি বল। এই যে হরে কৃষ্ণ থেকে হরে রাম বা হরে রাম থেকে হরে কৃষ্ণ এটাও মাইগ্রেশন। এখানে এটা হলো মানুষের বিশ্বাসের মাইগ্রেশন। মানুষ আদিকাল থেকে এভাবে রাম বা কৃষ্ণর ওপর বিশ্বাস রেখে আসছে। তাই এটা মানুষের বিশ্বাসের মাইগ্রেশন। নিতাই গোউর হরি বল। হরি বল। হরি বল।
মানুষ মারা গেলে কোথায় যায়, আমরা কেউ জানি না। আমার দাদুভাই মারা গিয়ে কোথায় গেছেন, আমরা জানি না। আমার বাবা মারা গিয়ে কোথায় গেছেন, আমরা তা-ও জানি না। আমার মা মারা গিয়ে কোথায় হারিয়ে গেছেন, আমরা তা-ও বলতে পারি না। কিন্তু একটা জিনিস আমরা কেবল বলতে পারি, মানুষ মারা যাওয়ার পর অন্যলোকে চলে যায়। কেউ এটাকে বলে পরলোক গমন, কেউ বলেন ইহলোক ত্যাগ, কেউ বলেন জীবন থেকে মুক্তি। মানুষের এই যে গমন এটা কি মাইগ্রেশন নয়? এটাও তো স্থায়ীভাবে গমন। যেখান থেকে আজ পর্যন্ত কেউ ফিরে এসে চমক দিয়ে বলল না যে, আমরা সাব-মেরিনে করে সমুদ্রের নিচে গিয়ে আজগুবি ব্যাপার-স্যাপার সব দেখে এসেছি। কেউ এসে বলল না যে, আমরা সোলার রকেটে করে বৃহস্পতি গ্রহ থেকে ঘুরে এসেছি। কেউ এসে দাবি করল না যে, আমরা মৃত্যু জয় করে আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছি। ও খোকা, তুমি মোরে চেনতে পারছ? আমি কাদের মাঝি। হাটবারে উ-হাটবারে কতবার যে আমার নায় তোমরা বলেশ্বরের এপার ওপার করছ। আর এহোন চেনতে পারলা না? হেয়া কেমনে অয়! নদীর উপরে ব্রিজ অয়োনে কি আমারে এইভাবে ভুইলা গেলা? হায় কপাল!
এই সময় পর পর চারটা ঘণ্টা বাজল। মানে ঘড়ির কাঁটায় তখন পাঁচটা। দুপুর একটায় আমাদের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী চার ঘণ্টার পরীক্ষা শেষ। তুহিনকে বললাম, আরেকটা লাইন ল্যাখ-- মৃত্যু একটি স্থায়ী মাইগ্রেশন। আর তখন নাসরিন আপা উচ্চ স্বরে চেঁচিয়ে বললেন, স্টপ রাইটং।
জন্ম: ২১ এপ্রিল ১৯৭০ (৮ বৈশাখ ১৩৭৭), উত্তর বানিয়ারী, নাজিরপুর, পিরোজপুর, বাংলাদেশ।
পড়াশুনা: অর্থনীতি শাস্ত্রে স্নাতক সম্মান ও মাস্টার্স।
প্রকাশিত গ্রন্থ:
ছোটগল্প: বুনো বলেশ্বরী, ছোটগল্প সংকলন, ২০০৮। সোনার কঙ্কাল, ছোটগল্প সংকলন, ২০১০। সাধুসংঘ, ছোটগল্প সংকলন, ২০১১ । ভূমিপুত্র, ছোটগল্প সংকলন, ২০১৩
উপন্যাস: মা, ২০১২।
সমালোচনা: শূন্য দশমিক শূন্য, ২০১১।
কিশোর গল্প: বয়োঃসন্ধিকাল, ২০০৫।
শিশুতোষ: ময়নার বয়স তেরো, ২০০৩। গপ্পো টপ্পো না সত্যি, ২০১১
ভিসি স্যার বললেন, শ্রুতি-লেখকের জন্য ভিসি বরাবর আবেদন করতে হবে। সেই আবেদনের অনুলিপি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান, রেজিস্ট্রার আর প্রধান পরীক্ষকের বরাবরও দিতে হবে। আবেদনের সঙ্গে মেডিকেল সার্টিফিকেট আর প্রেসক্রিপশন দিতে হবে। আর যে শ্রুতি-লেখক হবে তার অঙ্গীকার নামাও দিতে হবে। পরীক্ষার্থী আর শ্রুতি-লেখকের শিক্ষাগত যোগ্যতার সকল সনদের ফটোকপিও দিতে হবে। আর এগুলো জমা দেওয়ার সময় আসল সনদপত্রও সঙ্গে আনতে হবে। একই সাবজেক্টে পড়াশোনা করেছে বা করছে এমন কেউ শ্রুতি-লেখক হতে পারবে না। শ্রুতি-লেখককে অবশ্যই অন্য সাবজেক্টের আর জুনিয়র হতে হবে।
ভিসি স্যারের কাছে এই কথা শুনে মেজদা আর তুহিন আবার গেল ডিপার্টমেন্টে চেয়ারম্যান স্যারের সঙ্গে দেখা করতে। চেয়ারম্যান স্যারই ওদের ভিসি স্যারের কাছে পাঠিয়েছিলেন। ওদের আবার দেখে স্যার জানতে চাইলেন, ভিসি স্যার কী বললেন? জবাবে ওরা বলল, মেডিকেল সার্টিফিকেট, প্রেসক্রিপশন, অঙ্গীকারনামা নিয়ে আবেদন করার জন্য। শ্রুতি-লেখক নিয়ে নাকি কৃষ্ণ পরীক্ষা দিতে পারবে। চেয়ারম্যান স্যার বললেন, তাহলে ওগুলো দ্রুত জোগাড় করে আবেদন করেন। আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
শ্রুতি-লেখক নিয়ে যে পরীক্ষা দেওয়া যায়, এই প্রথম মেজদা ব্যাপারটা শুনে তুহিনের কাছে এবার এর ব্যাখ্যা জানতে চাইল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে কলাবাগানের উদ্দেশে ওরা রিকশা নিল। রিকশায় বসে তুহিন বলল, শ্রুতি-লেখক হলো একজন সহযোগী লেখক। যার পরীক্ষা সে লিখবে না। লিখবে এই শ্রুতি-লেখক। কিন্তু যা যা লিখবে পাশে বসে যার পরীক্ষা সব তাকেই বলতে হবে। শ্রুতি-লেখক একটা কথাও নিজের লিখতে পারবে না। মানে আমি যদি কৃষ্ণর শ্রুতি-লেখক হই, পরীক্ষার হলে কৃষ্ণ যা যা বলবে, আমার শুধু খাতায় তাই লিখতে হবে। আমার নিজের থেকে কিছুই লেখা যাবে না। মেজদা বলল, তুমি যদি কিছু লেখো তা স্যাররা বুঝবে কীভাবে? জবাবে তুহিন বলল, সেই জন্যই একই সাবজেক্টের কেউ শ্রুতি-লেখক হতে পারবে না। যাতে শ্রুতি-লেখক নিজে কিছু লিখতে না পারে। যা লিখবে আসল পরীক্ষার্থীর কথাই লিখবে। মেজদা বলল, তালি বাইরে কাউরি না খুঁইজা তুমি হও শ্রুতি-লেখক। তালি কৃষ্ণরও একটু সুবিধা হবে। তুমি ওর সব কথা বোঝো। আবার ও তোমারে সহজে সব বুঝাতি পারবেনে। জবাবে তুহিন বলল, দেখি, কাউরি না পালি তো আমি আছি। মেজদা বলল, না, কাউরি আর জড়ানো দরকার নাই। তুমি হও শ্রুতি-লেখক।
তুহিন একটু চিন্তায় পড়ল। ব্যাপারটা মুখে বলার চেয়ে আসলে অত সহজ না। একটানা চার ঘণ্টা পরীক্ষার হলে পাশে বসে শুনে শুনে লেখার কাজটা অত সোজা না। তার পরও কৃষ্ণর জন্যি আমি এটুক করতে পারব না। নলি আমি কৃষ্ণর কিসের বন্ধু? নিজের চিন্তা নিজের ভেতরে রেখে তুহিন বলল, তার আগে মেডিকেল সার্টিফিকেট তুলতে হবে। আমার আর কৃষ্ণর সকল সার্টিফিকেট ফটোকপি করতে হবে। অঙ্গীকার নামা লিখতে হবে। অ্যাপ্লিকেশন লিখতে হবে। অনেক ঝামেলা আছে। এই দুই দিনে এত ফ্যাসাদ ঠিকঠাক করতি না পারলি কৃষ্ণর আর পরীক্ষা দেওয়া হবে না। শুনে মেজদা বলল, তুমি এই তিন দিন আর অন্য কোনো কাজে নতুন করে জড়াইও না। নলি কৃষ্ণর পরীক্ষাটা আর দেওয়া হবে না। আমি ঢাকা না থাকলি তো ওর চিকিৎসাই হতো না। ছোট্ট একটা আফসোস বুকের মধ্যে হজম করতে করতে মেজদা তুহিনের হাত চেপে ধরল। তুমি কৃষ্ণর পাশে না দাঁড়ালি ওর পরীক্ষা দেওয়া হবে না, তুহিন। জবাবে তুহিন মেজদার হাত আরও শক্ত করে ধরে বলল, চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হবে।
এরপর কারও মুখে কোনো কথা নেই। ওদের রিকশা নীলক্ষেত, নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, ঢাকা কলেজ, সায়েন্স ল্যাব, সিটি কলেজ ছাড়িয়ে মিরপুর রোড ধরে কলাবাগানের দিকে এগোতে থাকে। রাস্তার অন্য গাড়ি-রিকশা, মানুষ, জ্যাম, জটলা কারও দিকে ওদের কারও কোনো খেয়াল নেই। কলাবাগান ফার্স্ট লেইনের মুখে এসে রিকশাওয়ালা জানতে চাইল, আপনেরা কই নামবেন? জবাবে তুহিন বলল, আপনি ডান দিকে লেকসার্কাসের দিকে ঢুকে যান। রিকশাওয়ালা আবার সেই সুযোগে বলল, আপনারা তো লেকসার্কাসের কথা বলেন নাই। কলাবাগান বলেছেন? তুহিনের মেজাজ তখন হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। আপনি কী বুঝতিছেন, আমরা কি বিপদের মদ্দ্যি আছি? লেকসার্কাস নামালি কি আপনার কোস্টা রাম্বা হবে? রিকশাওয়ালা তুহিনের মেজাজ বুঝতে পেরে ঘোত ঘোত করতে থাকে। আর লেকসার্কাসের দিকে এগোতে থাকে। একপর্যায়ে তুহিন রিকশাওয়ালাকে নির্দেশ দেয়, ওই লন্ড্রির সামনে দাঁড়ান। মেজদা রিকশাভাড়া দিতে গেলে তুহিন বলল, ওরে দুই টাকা বেশি দাও। রিকশাওয়ালা পাঁচ টাকা বেশি দাবি করল। জবাবে তুহিন বলল, এখন মাইর ছাড়া আর কোনো বকশিশ নাই। লন্ড্রি থেকে এই সময় লিটন জানতে চায়, কী হইছে? জবাবে তুহিন বলল, আরে লিটন ভাই, আর কইয়েন না। শালার কত ঝামেলা। রিকশা কলাবাগান কইছি, লেকসার্কাস ক্যান কই নাই, এই জন্যি ভাড়া বেশি দিতি হবে। লিটন রিকশাওয়ালাকে বলল, এখন সোজা পশ্চিম দিকে ঘুরে ভাগো, নইলে তোমার পুটকি বরাবর মারব। এরপর জানতে চাইল, কৃষ্ণ কি পরীক্ষা দিতে পারবে? ওরা তিনজন এই বিষয়ে কথা বলতে বলতে বাসায় ঢুকল।
লেকসার্কাসের এই দোতলা বাসায় আমি আর লিটন প্রায় তিন বছর ধরে আছি। পাশের রুমে ফজলু আর মতি থাকে। তুহিনও একবার কাঁঠালবাগানের বাসা থেকে রাগ করে তিন মাসের জন্য আমাদের সঙ্গে মেসমেট হয়েছিল। প্রত্যেকের বাড়ি আলাদা জায়গায় হলেও সবার সঙ্গেই সবার খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তুহিন আর আমার বাড়ি পিরোজপুর। লিটনের বাড়ি নোয়াখালী। ফজলুর বাড়ি ফরিদপুর রাজবাড়ি আর মতির বাড়ি মানিকগঞ্জ। আমি যে পরীক্ষা দিতে পারব, এ কথা শোনার পর সবার মধ্যেই একটা আনন্দ কাজ করল। লিটন বলল, আমনেরা পারলে একটু প্র্যাকটিস কইরা নিয়েন। জবাবে তুহিন বলল, রাতে আমরা প্র্যাকটিস শুরু করব। বিকালে আমার একটু কাঁঠালবাগানে কাজ আছে। আর এই কয় দিন কৃষ্ণর সাথে থাকার জন্যি সব গুছাই আসতি হবে। শুনে লিটন বলল, মেজদা তাহলে একটু রেস্ট নেন। আমি কৃষ্ণদাকে নিয়ে মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়া আসি।
বিকালে লিটন আর আমি মেডিকেল সার্টিফিকেট আনার জন্য আগারগাঁও পঙ্গু হাসপাতালে গেলাম। ডাক্তার আকবর আলী খুব কঠিন মানুষ। একটু এদিক-ওদিক হলেই কড়া ধমক মারেন। আবার ভেতরে ভেতরে তিনি খুব রসিক। আমি ডাক্তার জাহাঙ্গীরের ছোট শ্যালক ফুয়াদের বন্ধু। এটা শোনার পর থেকেই আমাকে আর ধমক মারেন না। উল্টো রসিকতা করছেন। ডাক্তার আকবর আলী আমার বর্তমান অবস্থা সব খুঁটে খুঁটে শুনলেন। পেইন আছে কি না, চুলকায় কি না, ওষুধ ঠিকমতো খাইছি কি না। আমি আর লিটন এসবের জবাব দিলাম। পরীক্ষার জন্য মেডিকেল সার্টিফিকেট লাগবে শুনে ডাক্তার আকবর আলী খুব খুশি হন। আমি যে শ্রুতি-লেখক নিয়ে পরীক্ষা দিতে পারব, এটা শুনেই ডাক্তার আকবর আলী সার্টিফিকেট লিখতে বসে গেলেন। তোমরা বরং ডাক্তার জাহাঙ্গীরের ওখান থেকে ঘুরে আসো, আমি সার্টিফিকেট লিখতেছি। আর তোমার নামের পুরোটা এই কাগজে লেখো। আমি ডাক্তার আকবর আলীর দেওয়া সাদা কাগজে নিজের পুরো নাম লিখলাম-- জি. কৃষ্ণ মুনশী। এরপর কাগজটা ডাক্তার আকবর আলীকে দিয়ে লিটনসহ ডাক্তার জাহাঙ্গীরের রুমের দিকে হাঁটা দিলাম।
আমাদের আসতে দেখেই ডাক্তার জাহাঙ্গীর হাঁক ছাড়লেন, কি শালা, এখন কী অবস্থা? ব্যথা আছে? ডাক্তার আকবর ছিল? তোমরা কিছু খাবা? পরীক্ষার কি হবে? একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন। আমরা ডাক্তার জাহাঙ্গীরের চেম্বারে বসতে বসতে প্রশ্নের জবাব দেওয়া শুরু করলাম। সবকিছু আমাদের মুখে শোনার পর ডাক্তার জাহাঙ্গীর বললেন, পরীক্ষার পর ওই সুন্দরীকে নিয়া একবার আসো, যার জন্যি সুইসাইড করতি চাইছিলা? নইলে তোমার ওই প্লাস্টিক আর আমরা কাটতে পারব না। বাকি জীবন এইভাবে থাকবা। শালা, পরীক্ষার চিন্তা বাদ দিয়া সুন্দরীর জন্যি সুইসাইড মারাতি গেছিলা? এখন কেমন লাগে? শুনে আমি কঠিন কষ্টের মধ্যেও একটু মিটমিট করে উঠলাম।
ডাক্তার আকবর আলী তার প্যাডে লিখেছেন--
To Whom It May Concern
This is to certify that Mr. G. Krishna Munshi has been treatment under my supervision since 20 January 1996. A major surgery operation has been done in his right hand wrist. Almost all major veins and arteries of his right hand wrist have been cut off. We try our best to surgery it and it will need minimum six month to open the hand. In the mean time Krishna would be our regular supervision. We are hoping he would do work slowly after open his bandage. If the surgery have any major fault, he would face further major operation other wise his hand would be permanently disable to work.
If he gets sense in his fingers then we can proudly say that operation is success. But unless six months or more we could not apparently say that he could work properly by his right hand.
I hope his early recovery from his trauma and all success in future.
Dr. Akbar Ali
Prof. Orthopaedics
Specialist on Orthopaedic, Trauma, Bone & Joint
NITOR (Pongu Hospital)র
Sher-e-Bangla Nagar, Dhaka
আমরা মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়ে লেকসার্কাস ফিরে আসতে আসতে ঘোর সন্ধ্যা। লিটন বলল, বাসায় না ঢুকে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে কিছুক্ষণ সময় কাটাই। গরম কিছু খাই। ভালো লাগবে। ফুচকা অর্ডার দিয়ে ধানমন্ডি ব্রিজের ঠিক দক্ষিণ পাশে লেকের পাড়ে বসেছি দুজন। লিটন জানতে চায়, মিরা দি’র আর কোনো খবর আছে? আমি চুপ করে আছি। লিটন বুঝতে পারল এই বিষয়ে আর কথা না ওঠানো ভালো। ইউনিভার্সিটি তো সুযোগ করে দিল পরীক্ষা দেওয়ার। এখন তুহিনকে নিয়ে প্র্যাকটিসটা ভালোমতো করেন। আপনাদের তো আবার অনেক আঁকাআঁকি আছে। ওগুলো একটু তুহিনকে দেখিয়ে দেন। আর একটা প্ল্যান করেন, সব প্রশ্নের শর্টকাট আনসার দেওয়ার জন্য। এই পেপারে আপনার ফোরটি পেলেও তো সেকেন্ড ক্লাস আসবে, কী বলেন? লিটনের এতক্ষণের কথার খেই ধরে জবাবে বললাম, দেখি, হয়তো আসবে। না এলেও ক্ষতি নেই। যেন লিটনই বাকি পরীক্ষাগুলো দিয়েছে, এমন একটা ভঙ্গি করে লিটন বলল, আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, আপনার মাইক্রো, ম্যাক্রো পরীক্ষা ভালো হয়েছে। আরেকটা যেন কী ছিল? জবাবে বললাম, ‘মানি অ্যান্ড ব্যাংকিং’। লিটন আবার বলল, ব্যাংকিংয়ে তো আপনি মিঞা মাস্টার। তাহলে এই পেপারে পাস হলেও সেকেন্ড ক্লাস থাকবে। নইলে আমার হাত এইবার আপনে কাইটা দিয়েন। আমি একটু নির্লিপ্তভাবে হাসলাম। সেই হাসির মধ্যে একটা গোপন বিষবাষ্প লুকানো ছিল। ফুচকা পুরোটা শেষ না করেই লিটনকে বললাম সিগারেটটা একটু জ্বালিয়ে দিতে। কারণ, এক হাতে আমি তখন আর সিগারেট ধরাতে পারি না। লিটন সিগারেট জ্বালিয়ে আমার হাতে দিলে সিগারেটে একটা টান মেরে বললাম, জীবনটা কেমন যেন বদলে গেল, লিটন ভাই। আচ্ছা, ‘ভলগা থেকে ভাগীরথী’ বইটা যেন কার লেখা?
লিটন বাংলার স্টুডেন্ট কিন্তু আমার প্রশ্নে সে এখন কিছুটা যেন বিব্রত। লেখকের নাম এই মুহূর্তে তার মনে পড়ছে না। পাল্টা সে জানতে চাইল, নিরোদ সি. চৌধুরীর লেখা আপনার কেমন লাগে? জবাবে বললাম, ভালো। নিরোদ সি. চৌধুরীর ‘বাঙালী জীবনে রমণী’ পড়েনি এমন শিক্ষিত পুরুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। কিন্তু তার মাস্টার পিস ‘দ্য অটোবায়োগ্রাফি অফ অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’ জিনিস একখান। ব্যাটা লেখাই শুরু করেছিলেন পঞ্চাশ বছর বয়সে। তারপর যা লিখলেন সব যেন সোনার টুকরা। আমরা পঞ্চাশ বছর বাঁচমু কি না কেউ জানি না। তার ‘আজ হতে শতবর্ষ আগে’ অনেক ভালো লেগেছে। জবাবে লিটন বলল, রবীন্দ্রনাথকে টেক্কা মারতে উনি এইটা লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন-- ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছ বসি...’
রাতে তুহিন আসলে আমরা প্র্যাকটিস শুরু করলাম। প্রথম ঘণ্টা গেল নানা ছোটখাটো তর্কেবিতর্কে। লিটন এসে আমাদের তর্কের মধ্যে ঢুকে পড়ল। পরীক্ষার হলে এরকম হলে সব যাবে গিয়া। মতি এসে শুনতে চাইল তর্কটা কী নিয়ে। ফজলু এসে ইশারায় ডাকল, চলেন দাদা ছাদ দিয়া ঘুইরা আসি। মাথা ঠান্ডা কইরা দেন আবার শুরু কইরেন। বুঝতাছি দুজনার মাথাই এখন গরম। পরে সবাই মিলে আমরা ছাদে গেলাম। আজকে শীতের ঝাঁজটা একটু কম। সিগারেট শেষ কইরা আমরা ছাদ থেকে নামব। মেজদার উপস্থিতির কারণে এই শীতের মধ্যেই ছাদে গিয়া এই সিগারেট খাওয়া। শেষে ফজলু আর লিটন পরামর্শ দিল-- আপনারা আগে একটা প্ল্যান করেন। চার ঘণ্টায় কয়টা প্রশ্ন লিখতে হবে? একটা প্রশ্নে সময় কতটুকু পাওয়া যায়? শ্রুতি-লেখক নিশ্চয়ই তার চেয়ে বেশি সময় লাগাবে লিখতে। তাই প্রশ্নের জবাব অবশ্যই ছোট করেন। আর উত্তর ভুল হোক শুদ্ধ হোক তুহিন শুধু লিখবেন। আপনি মাঝখানে কমেন্ট দিলে কৃষ্ণদা কিন্তু খেই হারিয়ে ফেলবে। চার ঘণ্টা টানা বক্তৃতা করার মতো ব্যাপার আর কি। অত সোজা না কিন্তু। টুকটাক আঁকাউকি একটু দেখান ওনাকে। দেখেন ভালো হবে। তর্ক করা মানে নিজেদের সময় নষ্ট করা। তুহিন ওর ভুল বুঝতে পেরে বলল, পরীক্ষার হলে তো আর তর্ক করব না। এখন করে নিচ্ছি যাতে আমার বুঝতে সুবিধা হয়। ছাদ থেকে নেমে তুহিন আর আমি আরও ঘণ্টা খানেক প্র্যাকটিস করলাম। এবার অনেকটা উন্নতির লক্ষণ।
সকালে তুহিন ফটোকপির দোকান থেকে আমার আর তুহিনের সকল সার্টিফিকেট ফটোকপি করল। মেডিকেল সার্টিফিকেট ফটোকপি করল। প্রেসক্রিপশন ফটোকপি করল। সাদা কাগজে অঙ্গীকার নামা লিখেছিল, ওটাও ফটোকপি করল। তুহিন আর মেজদা ইউনিভার্সিটি রওনা দেওয়ার আগে অঙ্গীকার নামাটা দেখে লিটন আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে শব্দ করে পড়া শুরু করল--
বরাবর
উপাচার্য,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
মাধ্যম: চেয়ারম্যান, ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিকস
বিষয়: শ্রুতি-লেখক হিসেবে অঙ্গীকার নামা
মহোদয়,
বিনীত নিবেদন এই যে, আমি তুহিন এ বছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজ থেকে বিকম পাস করেছি। বর্তমানে আমি একই কলেজ থেকে প্রিলিমিনারি মাস্টার্স (ম্যানেজমেন্ট) অধ্যয়নরত। আমি এই মর্মে অঙ্গীকার করছি যে, জনাব জি. কৃষ্ণ মুনশীর শ্রুতি-লেখক হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করব। চার ঘণ্টা পরীক্ষার হলে শুধু শ্রুতি-লেখক হিসেবে আমি কাজ করব। যদি এর কোনো ব্যত্যয় ঘটে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে।
আবেদনপত্রের সঙ্গে আমার সকল সনদের সত্যায়িত ফটোকপি সংযুক্ত করলাম।
অতএব, জনাবের নিকট প্রার্থনা, আমি যাতে জি. কৃষ্ণ মুনশীর শ্রুতি-লেখক হিসেবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাই তার যথাযথ ব্যবস্থা করতে কর্তৃপক্ষের আজ্ঞা হয়।
বিনীত নিবেদক
তুহিন
অনুলিপি:
১. চেয়ারম্যান, ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিকস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২. রেজিস্ট্রার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৩. প্রধান পরীক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পরদিন। সারা দিন ঘুরে ভিসি স্যারের দেখা পায় না ওরা। স্যার কোথায় যেন একটা সেমিনারে আছেন। বিকালে একটা মিটিংয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত রাত এগারোটায় ওরা ভিসি স্যারের দেখা পেলেন। ভিসি স্যার শ্রুতি-লেখকের জন্য আবেদনপত্র গ্রহণ করেছেন। মেজদা আর তুহিনকে বলেছেন, আমি এখন যে অনুমতিপত্রটা দেব, অনুলিপি যাদের দিয়েছেন, প্রত্যেককে এটার একটা কপি দিবেন। আর এই সব কাগজের ফটোকপি পরীক্ষা শেষে খাতার সঙ্গে পিনআপ করে দিবেন।
রমজান মাস। দুপুরে ওরা খাওয়ার সময় পায় নাই। সন্ধ্যায় ইফতারি দিয়ে লাঞ্চ সেরেছিল। কারণ পরদিন আমার পরীক্ষা। ভিসি স্যারকে না পেলে আমার আর পরীক্ষা দেওয়া হবে না। রাত বারোটায় ওরা বাসায় ফিরল। তুহিন বলল, এখন একটা টানা ঘুম দেব। সকালে প্র্যাকটিস যা করার করব। আমাকে বলল, তুইও ঘুমা। আমি রাত দুইটা পর্যন্ত একটু বইতে চোখ বোলালাম। একাডেমিক লাইফের শেষ পরীক্ষার পরিণতি কী হয় জানি না। একটা ঢিবঢিবানি মাথার মধ্যে সারাক্ষণ ঘড়ির কাঁটার মতো টিকটিক করছে। যা পড়ছি তা-ও কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। বিশাল এক অনিশ্চয়তা নিয়ে শেষ পর্যন্ত কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম নিজেও জানি না।
দুপুর একটায় পরীক্ষা শুরু হবে। সাড়ে বারোটার মধ্যে আমরা ক্যাম্পাসে গেলাম। যারাই আমাকে দেখছে জিজ্ঞেস করছে কী হয়েছে, আমি আর তুহিন সংক্ষিপ্ত জবাব দিচ্ছি। কয়েকটা বেঞ্চ ফাঁকা রেখে সেকেন্ড রোতে একদম সামনের বেঞ্চে আমাদের বসার ব্যবস্থা হলো। পরীক্ষা শুরু হলো। প্রশ্নপত্র মোটামুটি ভালো। তুহিনের সঙ্গে হিসাব করলাম। পাঁচটা প্রশ্নেরই উত্তর লিখব। তিনটা খুব ভালো জানা। দুইটায় চাপা মারতে হবে। আমরা তিনটার জন্য সময় নিলাম একশো ত্রিশ মিনিট। আরও হাতে আছে একশো দশ মিনিট। অর্থাৎ একটি প্রশ্নের জন্য গড়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আমার বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কারণ, আমি যা বলি, তুহিন পরীক্ষার খাতায় তা-ই লেখে। আমার বলা বন্ধ। তুহিনের কলমও বন্ধ। এমনিতে তুহিনের হাতের লেখা আমার মতো অত ভালো না। তুহিনের হরফগুলো বাচ্চাদের হাতের লেখার মতো বড় বড়। আমি বললাম, লিখবি একটু দ্রুত। হাতের লেখা কোনো ফ্যাক্টর না। আমি কী লিখছি সেটা ফ্যাক্টর। অন্তত পড়া গেলেই চলবে। তুহিন লিখতে পারে বেশ দ্রুত। এটা খুব ভালো কাজ দিয়েছে। তুহিন এক লাইন লিখতে লিখতে আমি পরের লাইন কী হবে সেটা চিন্তা করে বলার জন্য রেডি থাকি। তুহিনও আমাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে যে, পরীক্ষা ভালো হচ্ছে। আমি বারবার জল খাচ্ছি।
এরমধ্যে ইসলামের ইতিহাসের এক ম্যাডাম এসে জানতে চাইলেন, তোমার হাতে কী হয়েছে? জবাবে বললাম, ম্যাডাম আপনাকে বলতে গেলে আমার শ্রুতি-লেখকের কলম বন্ধ হয়ে যাবে। তার পরও উনি সারসংক্ষেপ শুনতে চাইলেন। আমি তখন আর মেজাজ কন্ট্রোলে রাখতে পারলাম না। সরাসরি বললাম, প্লিজ ডোন্ট ডিসটার্ব আস। লেট মি নো ইউ আফটার মাই এক্সাম। তার পরও উনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তখন আগুন চোখে বাঁ হাতে দরজা দেখিয়ে ম্যাডামকে ইশারা করলাম, জাস্ট গো...নইলে এরপর আমি ওনাকে মহা গালি পারতাম। ম্যাডাম গিয়ে আবার দরজার কাছে দাঁড়ানো নাসরিন আপার কাছে আমার বিষয়ে জানতে চাইলেন। খেয়াল করলাম, নাসরিন আপা ওই ম্যাডামকে আমার ব্যাপারে আপডেট দিচ্ছেন। আমরা আবার লেখায় মনোযোগী হব। তার আগে তুহিন আর আমার একটু বাথরুমে যাওয়া দরকার।
বাথরুমে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তুহিন বলল, তুই কিছু না বললে এরপর আমি ওনাকে আচ্ছামতো কিছু বলতাম। আমি বললাম, শালীর মাগি কোথাকার। দেখতে পাচ্ছে যে, আমি শ্রুতি-লেখক নিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছি। এখন আমি অন্য কারও সঙ্গে কথা বলা মানে আমার ডিসটার্ব। আর ওই লেডির এইটুকু জ্ঞান নাই। আবার নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার। আমার বালের টিচার। আবার আসলে আমি ওর শাড়ি খুলে রেখে দেব। ব্যাটি কি জানে, আজ আমার এই দশা কী কারণে? হলে গিয়ে আবার আমরা পরীক্ষা শুরু করলাম। আমার সর্বশেষ অর্থাৎ পাঁচ নম্বর প্রশ্ন। মাইগ্রেশন নিয়ে প্রশ্ন। চাপা মারতে হবে। হাতে আছে চল্লিশ মিনিট।
আমি চিন্তা করে করে বলছি। তুহিন তাই আমার পরীক্ষার খাতায় লিখছে। সাধারণভাবে মাইগ্রেশন বলতে আমরা বুঝি, কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির এক স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে (বসবাসের উদ্দেশ্যে) চলে যাওয়া বা গমন। এই গমন দেশের মধ্যেও হতে পারে, দেশের বাইরে, বিদেশেও হতে পারে। আবার পড়াশোনার জন্য একজন ছাত্রের এক বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াও মাইগ্রেশন। সারা বিশ্বে ঋতু বদলায়। ঋতু বৈচিত্র্যের কারণে অনেক সময় পাখিরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, কখনো কখনো এক দেশ থেকে অন্য দেশে গমন করে। এটাও মাইগ্রেশন। সে ক্ষেত্রে পরিভ্রমণশীল ওইসব পাখি হল মাইগ্রেটরি বার্ডস। মানুষের ক্ষেত্রে তারা মাইগ্রেটরি পিপল। স্টুডেন্টসের ক্ষেত্রে তারা মাইগ্রেটরি স্টুডেন্টস। আবার জলের নিচে মাছ ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অথবা জোয়ার-ভাটার কারণে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করে। সে ক্ষেত্রে তারা হলো মাইগ্রেটরি ফিস। এই যে স্থান ত্যাগ করে চলে যাওয়া বা গমনাগমন বা এই যে অবস্থা এটা হলো মাইগ্রেট। আর অভিপ্রয়াণকারী বা গমনকারী ব্যক্তি বা প্রাণীর দল হলো মাইগ্র্যান্ট। যদি কোনো ব্যক্তি বসবাসের জন্য বিদেশে গমন করেন, তিনি তখন ইমিগ্র্যান্ট। অর্থাৎ বহিরাগত বা অভিবাসী। আমরা যাদের বলি প্রবাসী। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয় অথচ রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় বা ছাত্রনেতাদের কল্যাণে যারা ছাত্রদের পাশাপাশি এখন হলে বসবাস করছে, যাদের আমরা বহিরাগত বা ক্যাডার বলি, তারাও মাইগ্র্যান্ট। তারা ছাত্র নয়, কিন্তু ছাত্রদের দমন পীড়ন করার জন্য হলে থাকে। তাহলে এরা হলো মাইগ্রেটরি ক্যাডার বা বহিরাগত দুশমন।
সূর্য থেকে আলো পৃথিবীতে আসে। পৃথিবীর নিজস্ব কোনো আলো নাই। তাই পৃথিবীর কাছে সূর্যের এই আলো হলো মাইগ্রেটরি লাইটস। বুড়িগঙ্গার জল শীতলক্ষ্যায় যাচ্ছে। শীতলক্ষ্যার জল ধলেশ্বরী বা মেঘনায় যাচ্ছে। মেঘনার জল বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে। ওদিকে পদ্মার জল মধুমতি যাচ্ছে। মধুমতির জল বলেশ্বরে যাচ্ছে। বলেশ্বরের জল ভৈরবে যাচ্ছে। ভৈরবের জল পশুর নদীতে যাচ্ছে। পশুর নদীর জল শিবসায় যাচ্ছে। শিবসার জল বঙ্গোপসাগের যাচ্ছে। এটা হলো জলের মাইগ্রেশন। আবার বঙ্গোপসাগরে সূর্যের তাপে জল বাষ্পীভূত হয়ে আকাশে মেঘের সৃষ্টি করছে। ফলে সেখানে বায়ুশূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। এই বায়ুশূন্যতা পূরণ করতে চারপাশ থেকে বায়ু এসে শূন্যস্থান পূরণ করার চেষ্টা করছে। তখন সেখানে বায়ুঘূর্ণি তৈরি হচ্ছে। এই বায়ুঘূর্ণি যখন আর ব্যালেন্স করতে পারছে না, তখন তা প্রবল হয়ে আকাশের মেঘকে ধাক্কা দিচ্ছে। মৌসুমি বায়ুর চরিত্র অনুযায়ী বাতাস নিত্য এই খেলা খেলছে। কখনো দক্ষিণ থেকে উত্তরে, কখনো উত্তর থেকে দক্ষিণে। বাতাসের চাপে আকাশের মেঘ উত্তরে গিয়ে হিমালয়ে আঘাত পাচ্ছে। ফলে আবার ব্যাকটার্ন করছে। আর তখনই নামছে বৃষ্টি বা ঝড়। কখনো কখনো প্রবল বাতাসের চাপে মেঘঘূর্ণির কারণে এমনিতেই বর্ষা হয়ে ঝরে পড়ছে। এই যে জলের বারবার স্থান বদল, এটাও জলের মাইগ্রেশন। আমরা যে বৃষ্টি দেখি সে আসলে মাইগ্রেটরি ক্লাউড। অথবা মাইগ্রেটরি ওয়াটার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্কুলে যেতে ভালো লাগত না। তাই তিনি বাড়িতে বসে পণ্ডিত মশাইর কাছে পড়তেন। কিন্তু বড় হয়ে তো আর বাড়িতে বসে থাকার জো নেই। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোট ছেলে রবিকে তাই ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলেত পাঠালেন। কিন্তু বিলেতে রবি বাবুর মন টিকল না। তিন মাস না যেতেই রবি আবার কলকাতায় ফিরে এলেন। পরে দেবেন্দ্রনাথ ছেলেকে জমিদারি দেখাশোনার জন্য বাংলাদেশের শিলাইদহে পাঠালেন। রবীন্দ্রনাথের লন্ডনের তিন মাস হলো মাইগ্রেটরি স্টুডেন্ট হিসেবে। আর শিলাইদহে বসবাস হলো মাইগ্রেশন বা অভিবাসন। তেমনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যশোরের মণিরামপুর থেকে চলে গেলেন লন্ডন। সেখানে ইংরেজ কবিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইংরেজিতে কবিতা লেখা শুরু করলেন। কিন্তু মাতৃভাষার প্রেমে আবার চলে এলেন ভারতবর্ষে। মাইকেলের এই লন্ডনে বসবাসকালীন সময়টা হলো মাইগ্রেশন। আর ফিরে আসাটা হলো স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।
সিরাজগঞ্জের কাজীপাড়ার যমুনার চরের মানুষজন, যারা বারবার নদীভাঙনের কারণে শেষ পর্যন্ত ঢাকায় এসে কড়াইল বস্তিতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে তারা হলো মাইগ্র্যান্ট পিপল। বেঁচে থাকার জন্য তারা বাড়িঘর-ভিটেমাটি সর্বস্ব হারিয়ে এখন ঢাকায় বস্তিতে বসবাস করছে। নদীভাঙনজনিত কারণে এরা মাইগ্রেটেড। আমার বন্ধু প্রকাশ পিরোজপুর থেকে ঢাকায় এসেছিল পড়াশোনার জন্য। পড়াশোনা শেষ করে উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় কানাডার টরেন্টোতে ইমিগ্র্যান্ট হয়ে চলে গেল। এখন ও কানাডিয়ান নাগরিক। প্রকাশও একজন মাইগ্র্যান্ট। আর তার কারণ উচ্চশিক্ষা আর উন্নত জীবনব্যবস্থার হাতছানি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব টুঙ্গিপাড়ায় বড় হয়েছেন। রাজনীতি করার কারণে পরবর্তী সময়ে ঢাকার ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে সেটেলড হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকায় সেটেলড হওয়াও মাইগ্রেশন। এটা হলো ইন্টারনাল মাইগ্রেশন। আবার বঙ্গবন্ধু পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট সপরিবারে নিহত হওয়ার সময় সৌভাগ্যক্রমে তার দুই কন্যা জার্মানিতে থাকায় বেঁচে যান। পরবর্তী সময়ে বড় মেয়ে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করলেও ছোট মেয়ে শেখ রেহানা ইংল্যান্ডে স্থায়ীভাবে থেকে যান। আবার শেখ রেহানার ছেলেমেয়েরা এবং শেখ হাসিনার ছেলেমেয়েরা যথাক্রমে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। এটা যদিও রাজনৈতিক কারণ। কিন্তু এটাও মাইগ্রেশন আর এটা হলো বহির্গমন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। মিলিটারি ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতা পেল খন্দকার মোশতাক আহমদ। তারপর ক্ষমতার পালাবদল শুরু। এরপর রাষ্ট্রক্ষমতা পেলেন জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা--এই যে ক্ষমতার পালাবদল, এটা হলো রাষ্ট্রক্ষমতার মাইগ্রেশন। যেখানে রাজনীতি, সময়, জনগণের সমর্থন, মিলিটারি সমর্থন, দুর্নীতি, দুঃশাসন, নির্যাতন, নিপীড়ন, সম্পদ লুণ্ঠন, খুন, হত্যা, গুম, ভোট চুরি, ষড়যন্ত্র, রাজনৈতিক প্রভাব, ইত্যাদি নানা কারণে এই ক্ষমতার পালাবদল। যাকে আমরা বলতে পারি ক্ষমতার মাইগ্রেশন।
কবি রণজিত দাশ লিখেছেন, ‘সময় সবুজ ডাইনি, পৃথিবীর উপকূলে থাকো; সন্ধ্যার উঠোনে তুমি, নাবিকের হাড় দিয়ে ভাঙা জাহাজের ছবি আঁকো, সময় সবুজ ডাইনি’...। সময় যাকে আমরা এভার গ্রিন বলতে পারি। কখনোই সে বুড়ো হয় না। কবি বলেছেন সবুজ ডাইনি। কোথায় থাকে সময়? কবির জবাব-- পৃথিবীর উপকূলে সে রাক্ষসের মতো ওত পেতে থাকে। সেই সময়, ডাইনির মতো যার সব আচরণ। সেই সময়, সন্ধ্যার নির্বাক আলো-আঁধারির মধ্যে কী করছে? কোনো এক দুর্ভাগ্যকবলিত জাহাজ, যেটি মলয় সাগরে বা অন্য কোনো সাগরে কোনো এক ঘোর দুর্বিপাকে ডুবে গিয়েছিল। যে জাহাজের এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। সেই জাহাজের নাবিকেরা সবাই মরে ভূত। সেই নাবিকদের কারও কোনো হাড় হয়তো সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে একসময় কূলে এসেছিল। সেই হাড় দিয়ে, ওই নাবিকের কোনো বংশধর বা উত্তরপুরুষ বা এ কালের কোনো ছোট্ট ছেলে সন্ধ্যার অবকাশে খোলা আকাশের নিচে উঠোনে বসে বসে সেই ডুবে যাওয়া ভাঙা জাহাজের ছবি আঁকার চেষ্টা করছে। অথচ সে জানে না, এই ভাঙা জাহাজ আর এই হাড়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক কতটা নিবিড়। কিন্তু সে নির্বিকারভাবে সেই নাবিকের হাড় দিয়ে একটি ভাঙা জাহাজের ছবি আঁকার চেষ্টা করছে। সময় কত নিষ্ঠুর। এখানে সময় নিজেই মাইগ্রেটেড। আর তার নিয়ামক নাবিকের ভাঙা হাড়। আর ওই ছোট্ট ছেলেটি হলো কাকতালীয় সেই নিয়ামকের প্রলুব্ধ শিকারি।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে। নিতাই বল, হরি বল। গোউর বল, হরি বল। নিতাই গোউর হরি বল। হরি বল, হরি বল। এই যে হরে কৃষ্ণ থেকে হরে রাম বা হরে রাম থেকে হরে কৃষ্ণ এটাও মাইগ্রেশন। এখানে এটা হলো মানুষের বিশ্বাসের মাইগ্রেশন। মানুষ আদিকাল থেকে এভাবে রাম বা কৃষ্ণর ওপর বিশ্বাস রেখে আসছে। তাই এটা মানুষের বিশ্বাসের মাইগ্রেশন। নিতাই গোউর হরি বল। হরি বল। হরি বল।
মানুষ মারা গেলে কোথায় যায়, আমরা কেউ জানি না। আমার দাদুভাই মারা গিয়ে কোথায় গেছেন, আমরা জানি না। আমার বাবা মারা গিয়ে কোথায় গেছেন, আমরা তা-ও জানি না। আমার মা মারা গিয়ে কোথায় হারিয়ে গেছেন, আমরা তা-ও বলতে পারি না। কিন্তু একটা জিনিস আমরা কেবল বলতে পারি, মানুষ মারা যাওয়ার পর অন্যলোকে চলে যায়। কেউ এটাকে বলে পরলোক গমন, কেউ বলেন ইহলোক ত্যাগ, কেউ বলেন জীবন থেকে মুক্তি। মানুষের এই যে গমন এটা কি মাইগ্রেশন নয়? এটাও তো স্থায়ীভাবে গমন। যেখান থেকে আজ পর্যন্ত কেউ ফিরে এসে চমক দিয়ে বলল না যে, আমরা সাব-মেরিনে করে সমুদ্রের নিচে গিয়ে আজগুবি ব্যাপার-স্যাপার সব দেখে এসেছি। কেউ এসে বলল না যে, আমরা সোলার রকেটে করে বৃহস্পতি গ্রহ থেকে ঘুরে এসেছি। কেউ এসে দাবি করল না যে, আমরা মৃত্যু জয় করে আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছি। ও খোকা, তুমি মোরে চেনতে পারছ? আমি কাদের মাঝি। হাটবারে উ-হাটবারে কতবার যে আমার নায় তোমরা বলেশ্বরের এপার ওপার করছ। আর এহোন চেনতে পারলা না? হেয়া কেমনে অয়! নদীর উপরে ব্রিজ অয়োনে কি আমারে এইভাবে ভুইলা গেলা? হায় কপাল!
এই সময় পর পর চারটা ঘণ্টা বাজল। মানে ঘড়ির কাঁটায় তখন পাঁচটা। দুপুর একটায় আমাদের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী চার ঘণ্টার পরীক্ষা শেষ। তুহিনকে বললাম, আরেকটা লাইন ল্যাখ-- মৃত্যু একটি স্থায়ী মাইগ্রেশন। আর তখন নাসরিন আপা উচ্চ স্বরে চেঁচিয়ে বললেন, স্টপ রাইটং।
জন্ম: ২১ এপ্রিল ১৯৭০ (৮ বৈশাখ ১৩৭৭), উত্তর বানিয়ারী, নাজিরপুর, পিরোজপুর, বাংলাদেশ।
পড়াশুনা: অর্থনীতি শাস্ত্রে স্নাতক সম্মান ও মাস্টার্স।
প্রকাশিত গ্রন্থ:
ছোটগল্প: বুনো বলেশ্বরী, ছোটগল্প সংকলন, ২০০৮। সোনার কঙ্কাল, ছোটগল্প সংকলন, ২০১০। সাধুসংঘ, ছোটগল্প সংকলন, ২০১১ । ভূমিপুত্র, ছোটগল্প সংকলন, ২০১৩
উপন্যাস: মা, ২০১২।
সমালোচনা: শূন্য দশমিক শূন্য, ২০১১।
কিশোর গল্প: বয়োঃসন্ধিকাল, ২০০৫।
শিশুতোষ: ময়নার বয়স তেরো, ২০০৩। গপ্পো টপ্পো না সত্যি, ২০১১
0 মন্তব্যসমূহ