জর্জ অরওয়েল : জনৈক গ্রন্থ-সমালোচকের স্বীকারোক্তি

গদ্য

অনুবাদ : এমদাদ রহমান

[১৯০৩ সালের ২৫ জুলাই ভারতের বিহারে জর্জ অরওয়েলের জন্ম। প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সর্বোপরি ঔপন্যাসিক। ইংল্যান্ডে পড়াশোনা শেষে যোগ দেন তৎকালীন ইন্ডিয়ান ইম্পিরিয়েল পুলিশবাহিনীতে। ১৯২৭ সালে লেখক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে চাকুরি ছেড়ে দেন। এরপর তৎকালীন বিশ্বব্যবস্থা তাকে চরমভাবে আতংকিত করে তোলে, যার ফলে যার ফলে শুরুতে নৈরাজ্যবাদী এবং পরে সমাজবাদী রূপে আত্মপ্রকাশ। ইংল্যান্ডে দারিদ্র্যপীড়িত ও বেকার লোকদের নিয়ে লিখতে শুরু করেন। তার দু-টি উপন্যাস বিশ্বসাহিত্যে অনবদ্য। ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত এ্যানিমেল ফার্ম আর ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত নাইনটিন এইটি ফোর অরওয়েলের জটিল মনোজাগতিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ। ১৯৫০ সালের ২১ জানুয়ারি জর্জ অরওয়েলের জীবনাবসান হয়।]


কোনোমতে শোয়া-বসা যায় এরকম এক শ্বাসরুদ্ধকর ও স্যাঁতস্যাঁতে কক্ষ, যেখানে পড়ে আছে সিগারেটের অবশিষ্ট টুকরো, গাদাগাদি করে রাখা আধ-খাওয়া চায়ের কাপ, আর, একটি নড়বড়ে টেবিল সামনে নিয়ে বসে আছে কীটদষ্ট ঢিলেঢালা পোশাক-পরা জনৈক ব্যক্তি । চারপাশে ছড়িয়ে থাকা কাগজের নোংরা স্তূপের ভেতর টাইপরাইটারটাকে একটুখানি ফাঁকা জায়গায় কোনোমতে রাখতে পারা যায় কি না, তার জন্য লোকটার কী প্রাণান্তকর চেষ্টা! টেবিল থেকে কাগজের স্তূপটাকে ছুঁড়ে ফেলতেও পারছে না সে, কেননা কাগজ ফেলবার ঝুড়িটা ইতোমধ্যে উপচে পড়ছিল, তাছাড়া পরিত্যক্ত কাগজের স্তূপের আশপাশেই রয়েছে উত্তর না-দেওয়া চিঠিগুলো আর অপরিশোধিত বিল; আর খুব সম্ভবত এই স্তূপের ভেতর একুশ শিলিঙের একখানা চেক,-এ-সম্পর্কে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে লোকটা ব্যাংকে গিয়ে ভাঙাতে বেমালুম ভুলে গেছে। আর পরিত্যক্ত এই স্তূপটির ভেতর ঠিকানা লেখা বেশ কয়েকখানা চিঠিও রয়েছে, সেগুলোকে সে তার নোটবইয়ে ঢুকিয়ে রাখবে বলে নিশ্চিতভাবেই ভেবে রেখেছিল; তবে যাই হোক, লোকটা ইতোমধ্যে তার সেই নোটবইটা খুইয়ে বসেছে এবং এটাও সে ভেবে রেখেছে যে, যে-করেই হোক এটাকে সে উদ্ধার করবে এবং আরো যা যা সে একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে, সবই সে তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করবে। এই বোধ তাকে আত্মঘাতী হবার তীব্র তাড়নার মতো সবসময়ই পীড়িত করে।

লোকটার বয়স পঁয়ত্রিশ হলেও, দেখায় ঠিক পঞ্চাশ বছরের মতো। মাথায় বিশাল একটা টাক আর হাত-পায়ের রগগুলো ফুলে ফুলে সারা শরীরে জেগে আছে এবং চোখে ভারী কাঁচের চশমা লাগানো, অথবা চশমা পড়বে, যদি না তার একমাত্র কাঁচটাও হারিয়ে না যায়-চিরস্থায়ীভাবে। আর খুব স্বাভাবিক কারণেই এইসব বৈশিষ্ট্য তার মতো লোকদের জন্য মামুলি ব্যাপার, কেননা সে-তো পুষ্টিহীনতায় ভুগবেই, কিন্তু, অধুনা যদি তার কাছে কোনো একটি শুভ বা সৌভাগ্যচিহ্নিত ডোরা-রেখা থাকে, সেটা হলো অতিরিক্ত মদ্যপানজনিত খোঁয়ারি। এখন সময় সকাল সাড়ে এগারোটা, সময়সূচির পরিকল্পনা অনুসারে, ঘণ্টা দুয়েক আগেই কাজকর্ম শুরু করার কথা ছিল, এমনকি যদিও সে এখনই এই মুহূর্তেই কাজ শুরুর প্রগাঢ় ইচ্ছাশক্তি নিয়ে বসেও যায়, তাহলেই, টেলিফোনের ঝনঝন, বাচ্চাকাচ্চাদের তীক্ষ্ণ স্বর, চিৎকার, রাস্তায় ড্রিল-মেশিনের আওয়াজ, সিঁড়ির ধাপগুলোয় পাওনাদারদের বুটজুতার গম্ভীর শব্দ, তাকে গভীর নৈরাশ্যে ফেলে দেবে। তবে সবচেয়ে নতুন যে সমস্যাটা এর সঙ্গে যোগ হয়েছে, তাহলো দ্বিতীয় ডাকে আসা একটি বস্তু, যা তার জন্য নিয়ে এসেছে দু-টি বিজ্ঞপ্তি আর লাল রঙে ছাপা আয়কর পরিশোধের হুকুমনামা!

এই কথা বলাই বাহুল্য যে, লোকটা একজন লেখক। হতে পারে সে একজন কবি, ঔপন্যাসিক, স্ক্রিপ্ট রাইটার কিংবা বেতারে প্রচারিত হয় এমন ধরনের প্রতিবেদন লেখক-সাহিত্যকর্মের সঙ্গে জড়িত লোকজন মোটামুটি এরকমই, কিন্তু আমি এখানে বলে ফেলতে চাই যে, লোকটা আসলে একজন গ্রন্থ-সমালোচক। এক স্তূপ কাগজের ভেতর লোকটার শরীর অর্ধেক লুকানো। যেগুলো আজ সকালেই পার্শেল হয়ে এসেছে, যার মধ্যে আছে পাঁচটি বিপুলাকার ভলিউম, জনৈক সম্পাদক তার কাছে পাঠিয়েছে। সঙ্গে এক নির্দেশনা-চিরকুট-সবকটির কাজ একবারেই শেষ করতে হবে। বিপুলায়তন বইগুলো তার হাতে এসেছে চার-পাঁচদিন আগে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই সমালোচককে গত আটচল্লিশ ঘণ্টা পার্শেলটির সুতলি কাটার বিপক্ষে তাড়া দিচ্ছিল, একধরনের নৈতিক অসাড়তা। গতকাল খুব দৃঢ়তার সঙ্গে সে পার্শেলটা খুলে ফেলে আর দেখা দেয় পুস্তকের পাঁচটি বিপুলায়তন খণ্ড -- মোড় পরিবর্তনের কালে ফিলিস্তিন, বৈজ্ঞানিক দুগ্ধ খামার, ইউরোপীয় গণতন্ত্রের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, (বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৮০, ওজন ৪ পাউন্ড), পর্তুগিজ পূর্ব আফ্রিকার আদিবাসীদের জীবনযাত্রা এবং একটি উপন্যাস-‘এটি খুব আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে শুয়ে পড়েছে’। খুব সম্ভব ভুল করে চলে এসেছে। সম্পাদকের নির্দেশনা : প্রতিটি বইয়ের জন্য শব্দসংখ্যা ৮০০, আর যেভাবেই হোক, আগামীকাল দুপুরের ভেতর এসে পৌঁছতে হবে।

বইগুলোর মধ্যে তিনটি বইয়ের বিষয় সম্পর্কে এই সমালোচক এতোই অজ্ঞ যে, তাকে শেষ পর্যন্ত ৫০ পৃষ্ঠা করে পড়তে হবে, যাতে তার দ্বারা সৃষ্ট যে-কোনো হাস্যকর পরিস্থিতিকে সে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়, যা-শুধু তার নিজের সঙ্গেই প্রতারণা নয়, বইগুলোর রচয়িতাদের সঙ্গেও (যারা অবশ্যই পুস্তক-পর্যালোচনাকারীদের অভ্যাস সম্পর্কে অবগত), এমনকি সাধারণ পাঠকের সঙ্গেও প্রতারণা করা হয়। সে যাই হোক, বিকেল চারটার দিকে, বইগুলোর র‌্যাপিং পেপার ছিঁড়ে বের করতে গিয়ে লোকটা টের পায় বইগুলোকে বুঝে-ওঠার পক্ষে তার স্নায়বিক দুর্বলতা অত্যন্ত প্রকট। এগুলোকে পড়ার জন্য তার যে-আকাঙ্ক্ষা, এমনকি পৃষ্ঠাগুলোর গন্ধ, সমালোচককে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে যে, জনাবের মনে হয় এই পরিস্থিতি হলো ক্যাসটার ওয়েলের স্বাদ আর গন্ধযুক্ত চাউলের পুডিং খাওয়ার মতোই এক আকাঙ্ক্ষা। আর সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপারটা হলো--তার রচনার অনুলিপিটি যথাসময়েই কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে পৌঁছে যাবে। আসলেই--যেভাবেই হোক না কেন-অনুলিপিগুলো যথাসময়েই কর্তৃপক্ষের হাতে পৌঁছে যায়। রাত আনুমানিক নয়টার দিকে তার মনমেজাজ ধীরে-ধীরে বেশ ঝরঝরে ও নির্ভার হয়ে আসে এবং যতক্ষণ না রাত গভীর হয়, সে বসেই থাকে। যখন সিগারেটের ধোঁয়া ঘন থেকে ঘনতর হয়ে ওঠে, তখন ঘরের ভেতরটাও শীতল থেকে ক্রমশ শীতলতর। আর ঠিক তখনই যথেষ্ট কুশলতার সঙ্গে একটার পর একটা বই আদ্যোপান্ত ওলটপালট করে, বলতে শুরু করে তার চূড়ান্ত মন্তব্য-‘হা ঈশ্বর, কী আবোল-তাবোল!’ শেষ রাতে ঝাপসা চোখ, খিটখিটে মেজাজ আর না-কামানো মুখ নিয়ে সমালোচকমহোদয় স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শাদা কাগজগুলোর দিকে, যতক্ষণ না তাকে তার ভীতিকর আঙুলগুলো তাকে কোনো কাজে প্রবৃত্ত হতে ততোধিক ভীতিকর অবস্থা জাগিয়ে রাখে। সে যেন আক্রোশে দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে। তারপর...তারপর সেই পচাবাসি-হয়ে-যাওয়া প্রবাদবাক্য- ‘এমন একটি বই যে-কারোরই বাদ দেয়া উচিত নয়’, ‘পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় মনে রাখার মতো বিষয়’, ‘প্রতিটি অধ্যায়েরই রয়েছে গভীর অর্থ আর তাৎপর্য’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বইগুলো একের পর এক এমনভাবে তাদের জায়গা বদলাচ্ছিল যে লোহার দণ্ডটি চুম্বকের সাহায্যে কাটা হচ্ছে। আর গ্রন্থসমালোচনাও শেষ হয়েছে যথাযথ মাপে এবং মাত্র তিনটি মিনিটও ব্যয় করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পারম্পর্যহীন, অনুত্তেজক আরো কিছু বই ডাকযোগে তার ঠিকানায় রওয়ানা হয়ে গেছে। তাই এ-প্রক্রিয়াটা চলতেই থাকবে। তারপরও, খুব বড়োমাপের আশা বুকে নিয়ে এই ধরনের নিপীড়ক, স্নায়ুঅবশকারী প্রাণীটি তার বৃত্তি শুরু করেছে, এই তো মাত্র কয়েকটি বছর আগে।

আমি কি বিষয়টাকে অতিরঞ্জিত করে ফেলেছি? আমি যে-কোনো একজন সমালোচককে জিজ্ঞেস করছি। মনে করা যাক, যে-কোনো একজন, যিনি নিয়মিত সমালোচনা করে থাকেন, বছরে কমপক্ষে একশখানা গ্রন্থ, যদি তিনি যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে সত্য বলে স্বীকার নাও করেন যে, তার অভ্যাস আর চরিত্র হচ্ছে ঠিক তেমন যেমন আমি বর্ণনা করছি। সকল লেখক যা-ই ঘটুক না কেন, নিঃসন্দেহে সেই ধরনের ব্যক্তি। কিন্তু এসব প্রলম্বিত, বাছ-বিচারহীন গ্রন্থসমালোচনা হলো ব্যতিক্রমধর্মিতার দিক দিয়ে প্রশংসার অযোগ্য চুলকানি সৃষ্টিকারী এবং চরমভাবে হওয়ার মতো কাজ। এই ধরনের সমালোচনা কিংবা আলোচনা কিংবা পর্যালোচনা মূল্যহীন স্তুতি আর বন্দনার আবর্জনা ছাড়া আর কিছুই নয়-শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, এই ধরনের কাজ এছাড়া আর কিছু নয়, যা আমি যে-কোনা মুহূর্তেই প্রদর্শন করতে পারি। আমার বিশ্বাস, এই ধরনের সমালোচনাগ্রন্থগুলোর প্রতি একধরনের প্রতিক্রিয়ার জন্ম হচ্ছে।

কোনো একটি বইয়ের আলোচনাতেও, সে বইটি মাথামুণ্ডু যাই হোক না কেন, জেগে উঠছে না কোনো স্বতঃপ্রণোদিত অনুভূতি। সমালোচকমহোদয় সম্ভবত একজন কংকালসার ব্যক্তি, পেশাগত দিক দিয়ে বইয়ের প্রতি প্রচণ্ড অনুরাগী। সংখ্যায় হাজারেরও বেশি বই, যেগুলো বছরের পর বছর ধরে হাজির হচ্ছে তার কাছে, আর হাজারখানার ভেতরে সম্ভবত পঞ্চাশ কিংবা একশোটি বই থাকছে এমন যেগুলো নিয়ে কিছু লিখতে পারার কারণে লোকটা আনন্দ পেয়েছে। যদি ধরেও নিই যে তার পেশায় একজন প্রথম শ্রেণির লোক সে, তাহলে সম্ভবত অজস্র বইয়ের ভেতর থেকে দশ কি বিশখানা বইকে সে বেছে নেবে, খুব সম্ভবত সে বেছে নেবে দুই থেকে তিনখানা বই। তারপর সবকিছু রূপান্তরিত হবে প্রশংসা কিংবা নিন্দায়, যা ধোকাবাজি ছাড়া আর কীই বা হতে পারে।

গ্রন্থসমালোচনার বৃহত্তর অংশই পাঠকদেরকে গ্রন্থ সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর এবং জগাখিচুড়িসুলভ মূল্যায়ন উপহার দেয়। যুদ্ধপরবর্তী সাহিত্য-সম্পাদকদেরকে এ-ব্যাপারে আরো বেশি মনোযাগী হওয়ার জন্য চাপ দিতে ব্যর্থ হয়। প্রতিটি বই সম্পর্কেই বন্দনাগীতি রচনার পরিবর্তে যুক্তিসংগত মূল্যায়ন আশা করেও পায়নি প্রকাশকরা। কিন্তু পুস্তক-পর্যালোচনার বিষয়টি দিনে দিনে জায়গার অভাবে আর অনিবার্য কারণবশত ধীরে ধীরে ছোটো হতে থাকে। এর পরিত্রাণ হিসেবে পাঠকরা মনে করেন-সমাধান লুকিয়ে আছে ভাড়া-করা লোকদের হাত থেকে পুস্তক আলোচনাসংক্রান্ত বিষয়কে সরিয়ে ফেলা। বিশেষায়িত জ্ঞানকেন্দ্রিক বইগুলো তাদের দ্বারাই পর্যালোচিত হওয়া উচিত, যারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী, বিষয় সম্পর্কে নিজে বোঝেন এবং বুঝাতেও সক্ষম। দেখা যায়-গ্রন্থ-পর্যালোচনার এক বিরাট অংশ, বিশেষ করে উপন্যাসের আলোচনা হয় আনাড়িনবিশ লেখকদের হাতে। প্রকৃতপক্ষে, প্রতিটি গ্রন্থই পারে পাঠকদের ভেতর লুকিয়ে-থাকা আবেগকে ধরে ঝাঁকুনি দিতে। কেবল বিরক্তিকর আলোচনাই পাঠককে গ্রন্থ পাঠ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। কোনো কোনো পাঠক বই নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমালোচকের অতিমূল্যায়িত তুচ্ছ বইকে মহান বলে ধরে নেয়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, যা প্রত্যেক সম্পাদকেরও বিষয়টা জানা যে, আলোচনা-সমালোচনার জটিল কাজগুলোর সুসমন্বয় কতো জটিল। সুতরাং, সম্পাদকরা সবসময়ই তাদের নিজেদের পছন্দের লেখককেই আলোচনার জন্য আহ্বান করেন, যাদের বলা হয়, সম্পাদকের নিয়মিত লেখক। গ্রন্থসমালোচনার ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান এই সমস্যা সত্ত্বেও, প্রতিটি গ্রন্থই উপযুক্তরূপে আলোচনার দাবি রাখে। মোটের ওপর শুধুমাত্র গুণকীর্তন আর বন্দনা করা ছাড়া বেশিরভাগ বইয়ের ভাগ্যে আর কী ই-বা জুটে। যতক্ষণ না পর্যন্ত কোনো একজনের সঙ্গে গ্রন্থের পেশাদারি সম্পর্ক গড়ে না উঠছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার পক্ষে বুঝে-ওঠা অসম্ভব যে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রন্থ-সমালোচনার ভেতর কী বিপুল পরিমাণ বাজে লেখা ও মন্তব্য ঢুকে গেছে। দেখা গেছে যে, দশটির ভেতর নয়টি বইয়ের আলোচনায় বস্তুনিষ্ঠ কথাটি হয়তো সমালোচক বলতে চায়-এই বইটি অর্থহীন; যেখানে হয়তো সমালোচকের সত্যিকার প্রতিক্রিয়াটি এমন হতে চায়-বইটি আমাকে ন্যূনতম আকর্ষণ করেনি, আমি এটি নিয়ে আলোচনা করতাম না, যদি না আমাকে এর জন্য পারিশ্রমিক দেওয়া হতো। কিন্তু লোকে তা কোনোভাবেই পড়তে চাইবে না। কেন চাইবে না? বইটি পড়ে ওঠার পক্ষে তারা সবসময়ই পূর্ব থেকে চমৎকার একটা ধারণা পেতে চায়, দিকনির্দেশনা পেতে চায়, চায় যে বইটিকে মূল্যায়ন করা হোক। এতে করে খুব দ্রুতই সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু মান পড়ে যায়। সপ্তায় অন্তত একবার করে যদি সকল সমালোচক এই কথা বলতে শুরু করেন-কিং লিয়র একটি ভালো নাটক এবং দ্য ফোর জাস্ট ম্যান একটি ভাল থ্রিলার, তাহলে ভালো শব্দটির অর্থটা কী দাঁড়াল?

সবচেয়ে ভালো হয় আমি মনে করি যে, আলোচনা-পর্যালোচনার জন্য রাশি রাশি বইয়ের বৃহত্তর অংশটিকেই অগ্রাহ্য করা হোক আর যে-বইয়ের আলোচনা করা হচ্ছে, তা হোক দীর্ঘ-কমপক্ষে এক হাজার শব্দ, যেসব বইকে অন্ততপক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হবে, তার আলোচনা একটু দীর্ঘায়িতই হোক। প্রকাশিতব্য বইয়ের ক্ষেত্রে একটি বা দু-টি টাকা, সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ইত্যাদি ঠিক আছে, কিন্তু চিরাচরিত মধ্যম মাপের পর্যালোচনা, যা মাত্র ছ-শ শব্দের ভেতরই সমালোচক মহোদয় সমাধান করেন বা সাধারণত তারা করতে চান, এইসব পুরোটাই অর্থহীন। আসলে সমালোচক এসব বিষয়ে লিখতে চায় না, দীর্ঘতম আলোচনা তো নয়ই, আর সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে এই লেখার প্রথম অংশেই আমি যে-রকম বর্ণনা দিয়েছি, ঠিক সেরকম ছোটো ছোটো চিরকুট আর টুকিটাকি লেখার উপাদান এতো বেশি মাত্রায় হয় যে, লেখাটিকে গ্রন্থ-সমালোচনার চাপে ‘ঢিলেঢালা আলখাল্লার ভেতর এক ভেঙে পড়া মানুষে’ পরিণত করে। যাই হোক, পৃথিবীতে প্রত্যেকেই বোধ হয় নিজের কাজকে বড়ো করে দেখে। অন্যদের কাজ হয়ে যায় তাদের কাছে তুচ্ছ। আর আমি অবশ্যই বলব, উভয়ের সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থেকে, একজন গ্রন্থ-সমালোচক অবশ্যই একজন সিনেমা-সমালোচক থেকে উত্তম। সিনেমা-সমালোচক কখনোই ঘরে বসে তার কাজটি করেন না, সকাল এগারোটায় যোগ দেন কেনা-বেচার প্রদর্শনীতে। আর এক বা ততোধিক লক্ষণীয় ব্যতিক্রম ছাড়া, তিনি এক গেলাস নিকৃষ্ট শেরির জন্য তার সম্ভ্রম বিক্রি করে দেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. সিনেমা সমালোচকদের ক্ষেত্রে তুলনামূলক বক্তব্যটি বর্তমানে সম্ভবত আর খাটে না; বরঞ্চ সময়ের সাথে গ্রন্থ-ক্রিটিক এক স্থুল আক্রোশে পরিণত হচ্ছে...।

    উত্তরমুছুন