তরা ব্রিজের নিচে ধলেশ্বরী নদীতে গোটাচারি ইলিশ ধরা পরে রতনের জালে। রতন চোখ চক চক করে উঠে—ইলিশ, ইলিশ। আহা! নদীর ইলিশ। কেউ খাবে কি, দেখেই নি বহু দিন। পাড়ের লোকজনের কান খাড়া হয়ে যায়, নিজেদের মধ্যে দাম হাকে। ‘এই মাছ আমি এহানে বেচুম না’ রতন জেলের এক কথা ‘ঢাকায় নিয়া যামু’। অনেকে জোরাবলি করে। রতন কারো কথায় কান দেয় না। ‘নদীর ইলিশের দাম আছে। এহানে দাম পামু না। ঢাকায় কম কৈর্যা হইলেও চাইর-পাচ আজার যাইবো।’ অনেক দিন মাছ উঠে না জালে, ইলিশ মাছ রতনের কাছেই অবিশ্বাস্য লাগে। মাছগুলো একটা লোহার তারে গেঁথে পাকা রাস্তায় এসে দাঁড়ায়, তারপর দৌড়াতে শুরু করে। রতনের কাছা দেয়া ধুতিটা আলগা হয়ে নিচের দিকে নামে আসে। সে দৌড়ায়। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যর্থ ক্রেতারা নানান মন্তব্য করে।
‘হালায় দৌড়াইয়্যাই ঢাকায় যাইবো নি কি?’
‘জাইল্যা তো আর নিক্যারি না, কতথুন পরে উপর ওইয়্যা পরব্যানে।’
‘ঢাকায় আর যাউন লাগবো না, বাসস্ট্যাণ্ড পর্যন্ত গ্যালে এ্যামনেই কাইরা নিয়া যাইব্যানে। এতোখুণে খবর গ্যাছে না?’- দৃঢ়তার সাথে বলে লোকটা।
‘হালা মালায়ন, কাইট্যার জাত আর কইছে কারে। আমাগো এনে থাইক্যা আমাগো কাছেই বেচলো না ! নেক গা মাইনসে।’—ক্ষোভের সাথে বলে আরেকজন।
‘কইলো আর ওইলো। হরি এত খাবলা খাবলা না। ঢাকায় গেলেই কি দাম পাওয়া যায়? ওয়া নিয়া কাউরান বাজারে ঢুকপ্যারই পারবো না। দুকানদাররা ওরে বইব্যার দিলে সে?’—লোকটার কণ্ঠে উপেক্ষার স্বর।
এক কেতাদুস্তর লোক, ধীর স্থির ভাবে বলে—‘ঢাকায় ও বিশ্বাস করাইব্যার পারবো না, এইড্যা নদীর ইলিশ।’
শেষ কথাটা রতন হয়তো শুনে ফেলে, দাঁড়ায়। হোটেলের তাওয়ার মতো গরম রাস্তা। সে মাছের দিকে তাকায়। মাছগুলো মরে গেছে। হা করে আছে। ঠাকুর দাদা যেমন ছিল, ধলেশ্বরীতে নৌকায়, হা করে। হাতে ধরা মাছ মনে হয়— কারো কলিজা ছেড়া। অপরাধির মতো লাগে। রাস্তার দিকে তাকায়, ধু ধু শূন্য। ঢাকার দূরত্ব বেড়ে যায়। রাস্তার উপর জলের মতো ঢেউ খেলছে রোদ। এর মধ্যে যেন নৌকা বাওয়া যাবে। রতনের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে।
সেই রোদ একটু থিতিয়ে এলে, ধানমন্ডি লেকের পাড়ের কড়ই গাছের নিচে ছেলেকে ঘুমপাড়ায় শিউলী। বড় তুড়বুড়ে ছেলেটা। সহজে ঘুমতে চায় না। বয়স বেশি কিছু নয়, এক বছর হবে। বড়টার বয়স চার। ওই তো, লেকের ধারে, ল্যাঙ্কটা; শিশ্ন নেড়ে চেড়ে খেলছে, টানছে। আর বাতাসে ভেঙে পড়া কড়ইর ছিটে ডাল দিয়ে লেকের জলে পেটাচ্ছে। পানিতে ডুবে থাকা ব্যাঙাচি, উপরের পানি-চাট পোকাগুলো মারবে। ওকে নিয়ে ততটা চিন্তা নেই, যতটা এই ছোটকে নিয়ে।
হঠাৎ কিছু লোক হুড়মুড় করে ঢোকার শব্দে শিউলী সোজা হয়ে বসে। মাথার লম্বা চুলগুলো তখনো এলিয়ে পড়ে শিশুটার মুখ আড়াল করে রেখেছে। প্রথমে ভেবে ছিল পুলিশের লোকজন। এখন আর পুলিশকে আলাদা করে চেনা যায় না। মাসখানি আগে শাহাদাতকে, শিউলীর স্বামী, সবাই তা-ই জানে, ধরে নিয়ে গেল। তারাও এরকম ছিল, সাধারণ পোশাকে। শাহাদাতের কাছে পুরিয়া পাওয়া গিয়েছিল। হরতালের সময় নাকি পাটকাও দেয়। কিন্তু এবারকার পুরুষগুলোর সাথে মহিলা আছে। কি সুন্দর! সাজগোজ করা, সুডৌল শরীর। চাপা পোশাক। ওড়নাটা গলায় উঠানো, বুকটাকে আলাদা করে বোঝা যায়। সাহেবদের দিকে তাকিয়ে চুলের খোঁপা করতে করতে একবার নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পায় শিউলী। চুলের গুছি খোঁপায় গুজে দিতে দিতে বাম হাতে গলা হাতাড়ে ওড়না খুঁজে। পাহাড়াদারি চোখ তখনো সাহেবদের দিকে নিবন্ধ। ওড়না সেখানে নেই, বিড়ে করে ছেলেটার মাথার নিচে দিয়েছে। ঝোলা থেকে পুরনো কাপড় ছিড়ে তৈরি ওড়নার মতো একটুকরো কাপড় বুকের উপর ছড়িয়ে দিয়ে ছেলেকে ডাক দেয়,‘ওয় মানিক, এ্যানে আয়।’ শিউলী আগত লোকগুলোর প্রতি কৌতুহলী হয়। পুরুষগুলোর হাতে রাবারের গ্লপস। মহিলাদের হাতে প্ল্যা কার্ড আর ফেস্টুন। তাকে কি লিখা সে পড়তে পারে না। তারা আসার সাথে সাথে লেকের পরিচ্ছন্নতার কর্মীরা ময়লা ফেলার ভ্যান, বড় ঝাকা, বালতি, নৌকা নিয়ে আসে। তারপর তারা কাজে নামে- লেক পরিচ্ছনতা অভিযান। একজন সারাক্ষণ কি যেন বলেই যাচ্ছে। শিউলি আগবাড়িয়ে বলে,‘সারেরা ল্যাক ছাপ করবেন?’ আগ্রহ করে বলে,‘তাইলে আমাগো ন্যান, আমরা কইর্যা দেই।’ ‘এটা আমাদের কাজ, আমাদের করতে দাও। আমরা কাজ করছি দেখলে অনেকে সচেতন হবে। উদ্বুদ্ধ হবে।’ গাম্ভীর্যহীন ভাবে বলেন কথা বলা লোকটা। তার কথার মাথা মুণ্ডু কিছুই বোঝে না শিউলী। শুধু বিস্ময়— এই কাজ আবার তাদের হয় কি করে! আরো দুই কথা হতে পারতো, লেকের গার্ড আর পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা এগিয়ে এলে শিউলি চুপ মেরে যায়, ধীরে কেটে পরে। এইগুলো হারামি, চিকার মতো, সারা ক্ষণ ছোঁক ছোঁক করে। ফুটো পেলে ওমনি ঢুকে পরে। এখন তার চিন্তা যেন ছেলেটার ঘুম ভেঙে না যায়। সাহেবদের মতো দুপুরের ভাত-ঘুম হলে ভয় ছিল না। এর-ওর থেকে কি খেয়েছে না-খেয়েছে, তা নিজেও জানে না। ওতে কি আর পেট ভরে? ঘুম হয়? একটু শব্দ হলেই জেগে যাবে। শেষে রাত ভর ঘুমাবে। তখন হবে জ্বালা। কাজ করতে দিবে না। কাজ না করলে খাবে কি?
রাতে বাচ্চা পোলাপান চুরি হয়। গত বছরই তো, লাইজুর মেয়েটা চুরি হয়ে গেল। তখন তারা কড়াইল বস্তিতে থাকে। মেয়ে হওয়ার পর লাইজুর স্বামী আলতাপ আর ঘরে আসতো না, চার মাস পরে শুনেছে তাকে পুলিশ ধরে নিয়েগেছে। আগে থেকেই বস্তির জালালের সাথে লাইজুর ভাব ছিল। আলতাপ জেলে যাওয়ার পর জালালই আসতো-যেত। প্রথমে বুঝতে পারে নি। জালাল গানজুট্টি তলে তলে এতো হারামি। লাইজু ভেবে ছিল জালালের সাথেই সংসার পাতবে। কিন্তু মেয়েটা দুধ ছাড়া হওয়ার পর সোহাগ করা নাম করে, একদিন জালাল যেন কি খাওয়ায় তাকে। সেই রাতে কোলের শিশুটা নিয়ে চম্পট, মহল্লায় আর আসে নি জালাল। শেষে বস্তিতে আগুন লাগলে এই লেকের ধারেই আশ্রয় নিয়েছে লাইজু। সে-ই এখানে শিউলীর একমাত্র বান্ধবী। রাতে কাম এনে দেয়। লাইজুই বলেছে, রাতে পুলাপান চুরি হয়। একজন আসে খোদ্দের হয়ে, কয়জন আসে পোলাপান চুরে করতে। ছোট ছোট দুইজন থাকলে তো আরো জ্বালা। একজন জন দৌড় দেয় একটা নিয়ে আরেক জন দৌড় দেয় আরেকটা নিয়ে। বাচ্চা উঠা মুরগীর দশা। দুয়ারের বাচ্চা বাঁচাতে গেলে পাখের তলেরটা চিলের মুখে যায়, আর পাখের তলেরগুলো বাঁচতে গেলে দুয়ারেরটা যায়। শিউলী তাই দিনে ছেলেটাকে ঘুম আনায়, রাতে জেগে থাকবে বলে। যেন কেউ নিতে আসলে কেঁদে উঠে। কিন্তু সাহেবদের জ্বালায় ঘুমতেও পারবে না। তাদের কথা-বার্তা খুব বিরক্ত লাগে তার কাছে। বাদুরের কিচির মিচির মনে হয়। ম্যাডামগুলো ব্যাঙের মতো রাস্তার এপাশ-ওপাশ, জায়গা বদল করছে, হাসি-ঠাট্টা করছে। সাহেবরা লেকের ঢাল-জলের কিনার-পানির নিচের প্লাস্টিকের বোতল-পলিথিন তুলে তুলে ঝাকায় রাখে। মাটির নিচে চাপা পড়া পালিথিনও টেনে ছিঁড়ে তুলছে। ঘোড়ায় ঘাস খাওয়ার মতো, মাটি সমান করে। একজন ছবি তুলছে অনবরত। সাহেবরা একটা ময়লা রাখে, আর পোজ দিয়ে ছবি তুলে। লেকের জল স্বচ্ছ। ডাঙায় বসে এক হাঁটু পানির নিচে কি আছে দেখা যায়। সেই কথা-বলা সাহেব দেড় হাত লম্বা কাঠি দিয়ে তা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলেন।
‘এই তোমার হাতের লাঠিটা দাও তো।’ পাশেই দাঁড়ানো ল্যাংটা মানিকের উদ্দেশ্যে বলেন তিনি। তার মানিক থ মেরে থাকে। সাহেব বুঝতে পারেন না। তিনি আবার বলেন, ‘এই ছেলে, লাঠিটা একটু দেখি।’
‘ইইইইহ্’, স্বর করে উঠে মানিক, শরীরটা বাঁকা হয়ে লাঠিটা আরেক পাশে সামলে নিয়ে, ‘খানকির পোলা।’শিউলী দাঁতে ফোড়ন কাটে।‘মানিক, বহা দেয় না বাবা, ওনারা ভদ্রলোক। এহানে আয়।’ প্রতিবাদ করে উঠে মানিক,‘তাইলে আমার লাঠি চায় ক্যা?’ কথা বলা সাহেব খানিক চুপ করে থাকেন, তারপর লাঠিদিয়ে পানিটা ঘোলা করে সেখান থেকে সরে যায়। তখন পানির নিচের কিছুই আর দেখা যায় না। সাহেবটা আবার একটু দূর এগিয়ে গিয়ে আবার পানিতে লাঠি ডোবান। রাস্তায় দাঁড়ানো মহিলারা তার দিতে তাকিয়ে। তিনি ম্যাজিক ম্যানের মতো লাঠির ডগায় পলিথিন, এক্স-রে রিপোর্ট পেপার, ছেঁড়া মানিব্যাগ, বিয়ারের ক্যান, প্লাস্টিকের বোতল তুলেন। কিছুক্ষণ খুঁচিয়ে খুচিয়ে যা তুলেন তা শ্যালায় নীল হয়েগেছে। তবু চেনা যায়, কনডম। রাস্তায় দাঁড়ানো ম্যাডামরা মিটমিট করে হাসেন। সাহেবও মুচকি হাসেন— বোকা ও আতুর। তারপর কনডমটা পুনঃরায় পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে অন্যকিছু খুঁজতে থাকেন। তারপর আরো একটা উঠে, এবারেটা নতুন। শিউলী আর সেদিকে খেয়াল করে না। তারা তাদের কাজ করতে থাকে।
অনেক ক্ষণ পর শিউলী আবার মানুষের জুতার শব্দ পায়। সেই লোকগুলো, এবার বেড়িয়ে যাচ্ছে। একজন তাড়া দিচ্ছে— এই চলো চলো, অফিস টাইম প্রায় শেষ। বেরিয়ে যাওয়ার আগে আজকের খরচের হিসেব করেন, ভাউচার আনা হয়েছে কিনা খোঁজ নেন।
হাতের গ্লভস-৩ ডজন, ফেস্টুন তৈরি-১৪টি, তিন জন গেস্টের হালকা নাস্তা, মিনারেল ওয়াটার, ২ লিটার কোক ও বেনসন সিগারেটসহ—১,১৪৭ টাকা, লেকের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের দেয়া— ৭০০ টাকা, মিডিয়া কমিউনিকেন মিলিয়ে প্রায় ২,৭০০ টাকা। শিউলী আশ্চর্য হয়, পাশ থেকে বলে ‘এই টুক সুময় এতো ট্যাকা, আমাগো চাইর-পাচ শ ট্যাকা দিলেই তো হারা দিন কৈর্যা দিতাম।’ অসভ্য, নটী কোথাকার। নিজেকে তাদের সমান ভাবে!
সবাই দ্রুত পায়ে বেরিয় যায়। শিউলীর ছোট ছেলে তখন নির্বিঘেœ ঘুমাচ্ছে। লেকের জলে সদ্য ফেলা বোতলের মতো নড়ছে তার পেট। সাহেবদের ফেলা দেয়া কনডমে হাওয়া ঢুকে ঘোলভ জলে ইঁদুরের মতো ভাসছে। সূর্যের তেজ তখন কমতে শুরু করেছে। একটু পর সন্ধ্যা নামবে। তারপর রাত। এর মধ্যেই সব ঠিক করে ফেলতে হবে। আজ সারা দিনে কোনো হোটেলে সাপ্লাই পানি এনে দেয়ার কাজও বলেনি কেউ। সাহেবদের সাথেও কাজটা হলো না। হলে চিন্তা ছিল না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসেছে। শিউলী অপেক্ষা করতে থাকে।
ঢাকায় এই ঘটনা ঘটতে ঘটতে রতনের বাড়ির লোকজন অপেক্ষায় অতিষ্ট হয়ে ওঠে। সন্ধ্যার পর একদল লোক খুঁজতে বের হয়।
কেউ বলে— রতনের কাছ থেকে ভূতে মাছ কেড়ে নিয়েগেছে, তাই মরেছে। রতন গরমে মাথা ঘুরে মরেছে বলে কেউ। কেউ বলে রতন অনেক দিন পর অতগুলো ইলিশ মাছের গরমেই মরে গেছে। কিন্তু রতনের পালিত পিতা কিরণ জলদাস হাট থেকে ফেরার পথে রতনকে রাস্তার ওপর মৃত ইলিশের মতো চিৎ হয়ে পড়ে আছে দেখে বজ্রে পোড়া বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো কথা বলতে পারে না। জেলেপাড়ায় কিরণ জলদাসের এই নির্বাক মূর্তির রহস্য খুঁজতে নারী-পুরুষ সব দৌড়ে আসতে থাকে। ধলেশ্বরীর ওপার থেকে তখন ভেসে আসছে— হরি হরি বোলো, হরি হরি বোলো, হরি হরি বোলো। যত তারা কাছে আসতে থাকে এই হরিধ্বনি তাদের কানে প্রকান্ড থেকে প্রকান্ড শব্দে ধাক্কা দিতে থাকে। ধলেশ্বরীর ওপারে মানুষ জন দাঁড়িয়ে রতনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। বোশেখের কল্লোলিত নদীতে তখন ঢেউয়ের দোলা যুবতী হয়ে উঠছে। ক্রমশ অন্ধকারে ধলেশ্বরী পাড়ের দৃশ্য চোখ থেকে খসে পড়ে। তবুও কর্ণকুহরে ধ্বনিত হতে থাকে— হরি হরি বোলো, হরি হরি বোলো, হরি হরি বোলো। ০
জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। কঠিন-কঠোর জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। পড়াশুনা করেছেন সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ ও ঢাকা কলেজে। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। প্রবন্ধ লিখেন। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ব ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে কর্মরত।
‘হালায় দৌড়াইয়্যাই ঢাকায় যাইবো নি কি?’
‘জাইল্যা তো আর নিক্যারি না, কতথুন পরে উপর ওইয়্যা পরব্যানে।’
‘ঢাকায় আর যাউন লাগবো না, বাসস্ট্যাণ্ড পর্যন্ত গ্যালে এ্যামনেই কাইরা নিয়া যাইব্যানে। এতোখুণে খবর গ্যাছে না?’- দৃঢ়তার সাথে বলে লোকটা।
‘হালা মালায়ন, কাইট্যার জাত আর কইছে কারে। আমাগো এনে থাইক্যা আমাগো কাছেই বেচলো না ! নেক গা মাইনসে।’—ক্ষোভের সাথে বলে আরেকজন।
‘কইলো আর ওইলো। হরি এত খাবলা খাবলা না। ঢাকায় গেলেই কি দাম পাওয়া যায়? ওয়া নিয়া কাউরান বাজারে ঢুকপ্যারই পারবো না। দুকানদাররা ওরে বইব্যার দিলে সে?’—লোকটার কণ্ঠে উপেক্ষার স্বর।
এক কেতাদুস্তর লোক, ধীর স্থির ভাবে বলে—‘ঢাকায় ও বিশ্বাস করাইব্যার পারবো না, এইড্যা নদীর ইলিশ।’
শেষ কথাটা রতন হয়তো শুনে ফেলে, দাঁড়ায়। হোটেলের তাওয়ার মতো গরম রাস্তা। সে মাছের দিকে তাকায়। মাছগুলো মরে গেছে। হা করে আছে। ঠাকুর দাদা যেমন ছিল, ধলেশ্বরীতে নৌকায়, হা করে। হাতে ধরা মাছ মনে হয়— কারো কলিজা ছেড়া। অপরাধির মতো লাগে। রাস্তার দিকে তাকায়, ধু ধু শূন্য। ঢাকার দূরত্ব বেড়ে যায়। রাস্তার উপর জলের মতো ঢেউ খেলছে রোদ। এর মধ্যে যেন নৌকা বাওয়া যাবে। রতনের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে।
সেই রোদ একটু থিতিয়ে এলে, ধানমন্ডি লেকের পাড়ের কড়ই গাছের নিচে ছেলেকে ঘুমপাড়ায় শিউলী। বড় তুড়বুড়ে ছেলেটা। সহজে ঘুমতে চায় না। বয়স বেশি কিছু নয়, এক বছর হবে। বড়টার বয়স চার। ওই তো, লেকের ধারে, ল্যাঙ্কটা; শিশ্ন নেড়ে চেড়ে খেলছে, টানছে। আর বাতাসে ভেঙে পড়া কড়ইর ছিটে ডাল দিয়ে লেকের জলে পেটাচ্ছে। পানিতে ডুবে থাকা ব্যাঙাচি, উপরের পানি-চাট পোকাগুলো মারবে। ওকে নিয়ে ততটা চিন্তা নেই, যতটা এই ছোটকে নিয়ে।
হঠাৎ কিছু লোক হুড়মুড় করে ঢোকার শব্দে শিউলী সোজা হয়ে বসে। মাথার লম্বা চুলগুলো তখনো এলিয়ে পড়ে শিশুটার মুখ আড়াল করে রেখেছে। প্রথমে ভেবে ছিল পুলিশের লোকজন। এখন আর পুলিশকে আলাদা করে চেনা যায় না। মাসখানি আগে শাহাদাতকে, শিউলীর স্বামী, সবাই তা-ই জানে, ধরে নিয়ে গেল। তারাও এরকম ছিল, সাধারণ পোশাকে। শাহাদাতের কাছে পুরিয়া পাওয়া গিয়েছিল। হরতালের সময় নাকি পাটকাও দেয়। কিন্তু এবারকার পুরুষগুলোর সাথে মহিলা আছে। কি সুন্দর! সাজগোজ করা, সুডৌল শরীর। চাপা পোশাক। ওড়নাটা গলায় উঠানো, বুকটাকে আলাদা করে বোঝা যায়। সাহেবদের দিকে তাকিয়ে চুলের খোঁপা করতে করতে একবার নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পায় শিউলী। চুলের গুছি খোঁপায় গুজে দিতে দিতে বাম হাতে গলা হাতাড়ে ওড়না খুঁজে। পাহাড়াদারি চোখ তখনো সাহেবদের দিকে নিবন্ধ। ওড়না সেখানে নেই, বিড়ে করে ছেলেটার মাথার নিচে দিয়েছে। ঝোলা থেকে পুরনো কাপড় ছিড়ে তৈরি ওড়নার মতো একটুকরো কাপড় বুকের উপর ছড়িয়ে দিয়ে ছেলেকে ডাক দেয়,‘ওয় মানিক, এ্যানে আয়।’ শিউলী আগত লোকগুলোর প্রতি কৌতুহলী হয়। পুরুষগুলোর হাতে রাবারের গ্লপস। মহিলাদের হাতে প্ল্যা কার্ড আর ফেস্টুন। তাকে কি লিখা সে পড়তে পারে না। তারা আসার সাথে সাথে লেকের পরিচ্ছন্নতার কর্মীরা ময়লা ফেলার ভ্যান, বড় ঝাকা, বালতি, নৌকা নিয়ে আসে। তারপর তারা কাজে নামে- লেক পরিচ্ছনতা অভিযান। একজন সারাক্ষণ কি যেন বলেই যাচ্ছে। শিউলি আগবাড়িয়ে বলে,‘সারেরা ল্যাক ছাপ করবেন?’ আগ্রহ করে বলে,‘তাইলে আমাগো ন্যান, আমরা কইর্যা দেই।’ ‘এটা আমাদের কাজ, আমাদের করতে দাও। আমরা কাজ করছি দেখলে অনেকে সচেতন হবে। উদ্বুদ্ধ হবে।’ গাম্ভীর্যহীন ভাবে বলেন কথা বলা লোকটা। তার কথার মাথা মুণ্ডু কিছুই বোঝে না শিউলী। শুধু বিস্ময়— এই কাজ আবার তাদের হয় কি করে! আরো দুই কথা হতে পারতো, লেকের গার্ড আর পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা এগিয়ে এলে শিউলি চুপ মেরে যায়, ধীরে কেটে পরে। এইগুলো হারামি, চিকার মতো, সারা ক্ষণ ছোঁক ছোঁক করে। ফুটো পেলে ওমনি ঢুকে পরে। এখন তার চিন্তা যেন ছেলেটার ঘুম ভেঙে না যায়। সাহেবদের মতো দুপুরের ভাত-ঘুম হলে ভয় ছিল না। এর-ওর থেকে কি খেয়েছে না-খেয়েছে, তা নিজেও জানে না। ওতে কি আর পেট ভরে? ঘুম হয়? একটু শব্দ হলেই জেগে যাবে। শেষে রাত ভর ঘুমাবে। তখন হবে জ্বালা। কাজ করতে দিবে না। কাজ না করলে খাবে কি?
রাতে বাচ্চা পোলাপান চুরি হয়। গত বছরই তো, লাইজুর মেয়েটা চুরি হয়ে গেল। তখন তারা কড়াইল বস্তিতে থাকে। মেয়ে হওয়ার পর লাইজুর স্বামী আলতাপ আর ঘরে আসতো না, চার মাস পরে শুনেছে তাকে পুলিশ ধরে নিয়েগেছে। আগে থেকেই বস্তির জালালের সাথে লাইজুর ভাব ছিল। আলতাপ জেলে যাওয়ার পর জালালই আসতো-যেত। প্রথমে বুঝতে পারে নি। জালাল গানজুট্টি তলে তলে এতো হারামি। লাইজু ভেবে ছিল জালালের সাথেই সংসার পাতবে। কিন্তু মেয়েটা দুধ ছাড়া হওয়ার পর সোহাগ করা নাম করে, একদিন জালাল যেন কি খাওয়ায় তাকে। সেই রাতে কোলের শিশুটা নিয়ে চম্পট, মহল্লায় আর আসে নি জালাল। শেষে বস্তিতে আগুন লাগলে এই লেকের ধারেই আশ্রয় নিয়েছে লাইজু। সে-ই এখানে শিউলীর একমাত্র বান্ধবী। রাতে কাম এনে দেয়। লাইজুই বলেছে, রাতে পুলাপান চুরি হয়। একজন আসে খোদ্দের হয়ে, কয়জন আসে পোলাপান চুরে করতে। ছোট ছোট দুইজন থাকলে তো আরো জ্বালা। একজন জন দৌড় দেয় একটা নিয়ে আরেক জন দৌড় দেয় আরেকটা নিয়ে। বাচ্চা উঠা মুরগীর দশা। দুয়ারের বাচ্চা বাঁচাতে গেলে পাখের তলেরটা চিলের মুখে যায়, আর পাখের তলেরগুলো বাঁচতে গেলে দুয়ারেরটা যায়। শিউলী তাই দিনে ছেলেটাকে ঘুম আনায়, রাতে জেগে থাকবে বলে। যেন কেউ নিতে আসলে কেঁদে উঠে। কিন্তু সাহেবদের জ্বালায় ঘুমতেও পারবে না। তাদের কথা-বার্তা খুব বিরক্ত লাগে তার কাছে। বাদুরের কিচির মিচির মনে হয়। ম্যাডামগুলো ব্যাঙের মতো রাস্তার এপাশ-ওপাশ, জায়গা বদল করছে, হাসি-ঠাট্টা করছে। সাহেবরা লেকের ঢাল-জলের কিনার-পানির নিচের প্লাস্টিকের বোতল-পলিথিন তুলে তুলে ঝাকায় রাখে। মাটির নিচে চাপা পড়া পালিথিনও টেনে ছিঁড়ে তুলছে। ঘোড়ায় ঘাস খাওয়ার মতো, মাটি সমান করে। একজন ছবি তুলছে অনবরত। সাহেবরা একটা ময়লা রাখে, আর পোজ দিয়ে ছবি তুলে। লেকের জল স্বচ্ছ। ডাঙায় বসে এক হাঁটু পানির নিচে কি আছে দেখা যায়। সেই কথা-বলা সাহেব দেড় হাত লম্বা কাঠি দিয়ে তা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলেন।
‘এই তোমার হাতের লাঠিটা দাও তো।’ পাশেই দাঁড়ানো ল্যাংটা মানিকের উদ্দেশ্যে বলেন তিনি। তার মানিক থ মেরে থাকে। সাহেব বুঝতে পারেন না। তিনি আবার বলেন, ‘এই ছেলে, লাঠিটা একটু দেখি।’
‘ইইইইহ্’, স্বর করে উঠে মানিক, শরীরটা বাঁকা হয়ে লাঠিটা আরেক পাশে সামলে নিয়ে, ‘খানকির পোলা।’শিউলী দাঁতে ফোড়ন কাটে।‘মানিক, বহা দেয় না বাবা, ওনারা ভদ্রলোক। এহানে আয়।’ প্রতিবাদ করে উঠে মানিক,‘তাইলে আমার লাঠি চায় ক্যা?’ কথা বলা সাহেব খানিক চুপ করে থাকেন, তারপর লাঠিদিয়ে পানিটা ঘোলা করে সেখান থেকে সরে যায়। তখন পানির নিচের কিছুই আর দেখা যায় না। সাহেবটা আবার একটু দূর এগিয়ে গিয়ে আবার পানিতে লাঠি ডোবান। রাস্তায় দাঁড়ানো মহিলারা তার দিতে তাকিয়ে। তিনি ম্যাজিক ম্যানের মতো লাঠির ডগায় পলিথিন, এক্স-রে রিপোর্ট পেপার, ছেঁড়া মানিব্যাগ, বিয়ারের ক্যান, প্লাস্টিকের বোতল তুলেন। কিছুক্ষণ খুঁচিয়ে খুচিয়ে যা তুলেন তা শ্যালায় নীল হয়েগেছে। তবু চেনা যায়, কনডম। রাস্তায় দাঁড়ানো ম্যাডামরা মিটমিট করে হাসেন। সাহেবও মুচকি হাসেন— বোকা ও আতুর। তারপর কনডমটা পুনঃরায় পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে অন্যকিছু খুঁজতে থাকেন। তারপর আরো একটা উঠে, এবারেটা নতুন। শিউলী আর সেদিকে খেয়াল করে না। তারা তাদের কাজ করতে থাকে।
অনেক ক্ষণ পর শিউলী আবার মানুষের জুতার শব্দ পায়। সেই লোকগুলো, এবার বেড়িয়ে যাচ্ছে। একজন তাড়া দিচ্ছে— এই চলো চলো, অফিস টাইম প্রায় শেষ। বেরিয়ে যাওয়ার আগে আজকের খরচের হিসেব করেন, ভাউচার আনা হয়েছে কিনা খোঁজ নেন।
হাতের গ্লভস-৩ ডজন, ফেস্টুন তৈরি-১৪টি, তিন জন গেস্টের হালকা নাস্তা, মিনারেল ওয়াটার, ২ লিটার কোক ও বেনসন সিগারেটসহ—১,১৪৭ টাকা, লেকের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের দেয়া— ৭০০ টাকা, মিডিয়া কমিউনিকেন মিলিয়ে প্রায় ২,৭০০ টাকা। শিউলী আশ্চর্য হয়, পাশ থেকে বলে ‘এই টুক সুময় এতো ট্যাকা, আমাগো চাইর-পাচ শ ট্যাকা দিলেই তো হারা দিন কৈর্যা দিতাম।’ অসভ্য, নটী কোথাকার। নিজেকে তাদের সমান ভাবে!
সবাই দ্রুত পায়ে বেরিয় যায়। শিউলীর ছোট ছেলে তখন নির্বিঘেœ ঘুমাচ্ছে। লেকের জলে সদ্য ফেলা বোতলের মতো নড়ছে তার পেট। সাহেবদের ফেলা দেয়া কনডমে হাওয়া ঢুকে ঘোলভ জলে ইঁদুরের মতো ভাসছে। সূর্যের তেজ তখন কমতে শুরু করেছে। একটু পর সন্ধ্যা নামবে। তারপর রাত। এর মধ্যেই সব ঠিক করে ফেলতে হবে। আজ সারা দিনে কোনো হোটেলে সাপ্লাই পানি এনে দেয়ার কাজও বলেনি কেউ। সাহেবদের সাথেও কাজটা হলো না। হলে চিন্তা ছিল না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসেছে। শিউলী অপেক্ষা করতে থাকে।
ঢাকায় এই ঘটনা ঘটতে ঘটতে রতনের বাড়ির লোকজন অপেক্ষায় অতিষ্ট হয়ে ওঠে। সন্ধ্যার পর একদল লোক খুঁজতে বের হয়।
কেউ বলে— রতনের কাছ থেকে ভূতে মাছ কেড়ে নিয়েগেছে, তাই মরেছে। রতন গরমে মাথা ঘুরে মরেছে বলে কেউ। কেউ বলে রতন অনেক দিন পর অতগুলো ইলিশ মাছের গরমেই মরে গেছে। কিন্তু রতনের পালিত পিতা কিরণ জলদাস হাট থেকে ফেরার পথে রতনকে রাস্তার ওপর মৃত ইলিশের মতো চিৎ হয়ে পড়ে আছে দেখে বজ্রে পোড়া বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো কথা বলতে পারে না। জেলেপাড়ায় কিরণ জলদাসের এই নির্বাক মূর্তির রহস্য খুঁজতে নারী-পুরুষ সব দৌড়ে আসতে থাকে। ধলেশ্বরীর ওপার থেকে তখন ভেসে আসছে— হরি হরি বোলো, হরি হরি বোলো, হরি হরি বোলো। যত তারা কাছে আসতে থাকে এই হরিধ্বনি তাদের কানে প্রকান্ড থেকে প্রকান্ড শব্দে ধাক্কা দিতে থাকে। ধলেশ্বরীর ওপারে মানুষ জন দাঁড়িয়ে রতনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। বোশেখের কল্লোলিত নদীতে তখন ঢেউয়ের দোলা যুবতী হয়ে উঠছে। ক্রমশ অন্ধকারে ধলেশ্বরী পাড়ের দৃশ্য চোখ থেকে খসে পড়ে। তবুও কর্ণকুহরে ধ্বনিত হতে থাকে— হরি হরি বোলো, হরি হরি বোলো, হরি হরি বোলো। ০
লেখক
পরিচিতি:
অলাত এহ্সান জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। কঠিন-কঠোর জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। পড়াশুনা করেছেন সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ ও ঢাকা কলেজে। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। প্রবন্ধ লিখেন। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ব ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে কর্মরত।
0 মন্তব্যসমূহ