‘গল্পের বিষয়বস্তু যেমনই হোক, উপস্থাপনার ভেতর দিয়েই তা প্রকৃত বৈচিত্র্যের মাত্রাটি পায়’
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: অলাত এহ্সান
তরুণ গল্পকার সাইফুল্লাহ সাইফ। পড়ছেন প্রকৌশল বিদ্যায়। এবার বই মেলায় এসেছে তার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ। এরজন্য সময় নিয়েছেন দুই বছর। তার গল্প লেখার প্রস্তুতি গভীর। বিষয় বিবেচনা ও উপস্থাপনের ভেতরেই তা ধরা পড়ে। লেখার পরীক্ষা-নিরীক্ষা সঙ্গে চিন্তার সূক্ষ্ণ যাত্রার ইশারা আছে। গল্পনিয়ে আলাপে তার গল্প ভাবনা ও চিন্তার বিভিন্ন দিকে উঠে এসেছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গল্পকার অলাত এহ্সান।
-----------------------------------------------------------------------
অলাত এহ্সান: ‘মৃত ও জীবিতের জীবনগুলি’ আপনার ২য় গল্পগ্রন্থ, গল্প লেখা শুরু করেছেন আরো অনেক আগে, তা কতদিন ধরে লেখা গল্পগুলো এবার বই আকারে প্রকাশ করলেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: প্রথম বই ‘কয়েকটি ডানাকাটা প্রজাপতির উড়ে যাওয়ার স্বপ্ন’ অনেকটা ঝোঁকের বসেই প্রকাশিত হয়েছিল ১৩ এর বইমেলায় সাহিত্যকাল প্রকাশন থেকে । মাঝখানে একবছর গ্যাপ দিয়ে এবারের ‘মৃত ও জীবিতের জীবনগুলি’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হচ্ছে ‘নওরোজ কিতাবিস্তান’ থেকে । গত দুই বছরের ১৩টি গল্পকে অন্তর্ভুক্ত করেছি সংকলনটিতে ।
অলাত এহ্সান: এই সময় ধরে লেখা গল্পগুলোর মধ্যে আপনার গল্পে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন কি?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: হ্যাঁ, পরিবর্তন আছে। প্রথম বইয়ের গল্পগুলোতে বর্ণনায় একটি নিপাট সরলতা ছিল। গল্পকে শুধুমাত্র প্লটের উপর দাঁড় করানো হয়েছিল। গল্পের ফর্ম নিয়ে খুব একটা কাজ করিনি। কিন্তু দ্বিতীয় এই বইটিতে গল্পের গঠন ও বিন্যাস নিয়ে ব্যাপক কাজ করেছি। আছে সাবজেক্ট ভেরিয়েশন এবং চিন্তার গভীরতা।
এহ্সান: এই বইতে ১৩টি গল্প আছে। গল্পগুলো কি কি বিষয় নিয়ে লেখা?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: মনস্তাত্ত্বিক বোঝাপড়া এবং সমাজকে পরোক্ষভাবে স্যাটায়ার। কিছু কিছু গল্পে পরাবাস্তবতার ভেতর দিয়ে আধুনিক সময়ের অস্তিত্বসঙ্কটকে তুলে ধরা।
এহ্সান: আপনি কি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বস্তু নিয়ে লিখতে পছন্দ করেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: না। কারণ নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু নিয়ে লিখতে গেলে লেখার ব্যাপকতা হারিয়ে যায়। দেখা যায়, কোন কোন পরিস্থিতিতে খুব সামান্য কোন ঘটনা বা বিষয়ও একটি গল্পের সাবজেক্ট হয়ে উঠতে পারে। যেমন টিকটিকে নিয়ে আমার একটি গল্প আছে।
এহ্সান: গল্পগুলোর উপস্থাপনেও বৈচিত্র্য আছে কি?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: এটা মূল্যায়ন করবেন পাঠক। গল্পের বিষয়বস্তু যেমনই হোক, উপস্থাপনার ভেতর দিয়েই তা প্রকৃত বৈচিত্র্যের মাত্রাটি পায়। বর্তমানে বাংলাদেশে গল্পের আঙ্গিক নিয়ে ভালো কাজ হচ্ছে, আমিও চেষ্টা করেছি। তবে সবশেষে এই মূল্যায়নটা পাঠকের উপরই ছেড়ে দিলাম।
এহ্সান: কোনো বিশেষ স্টাইলের প্রতি আপনা দূর্বলতা আছে কি, মানে আপনি স্বাচ্ছন্দ করেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: বাস্তবতার সাথে বিমূর্ততার একটা সম্পর্ক নির্মাণের চেষ্টা করি কখনো কখনো। এর প্রতি এক ধরণের দুর্বলতা আছে বলতে পারেন।
এহ্সান: আপনার গল্পগুলো কি আন্তঃসম্পর্কিত?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: না। বরঞ্চ এখানে তিনটি ধারায় আমি ফেলতে পারি গল্পগুলোকে। নিন্ম-মধ্যবিত্ত জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, বর্তমান সময়ে মানুষের সঙ্কট ও মনস্তাত্ত্বিক বোঝাপড়া এবং প্লট-কনসট্রাকশনে পরাবাস্তবতার একটা সংযুক্তি।
এহ্সান: গল্পগুলোতে আপনি কি বলতে চেয়েছেন, কোনো বিশেষ বিষয়কে উপস্থান বা ম্যাসেজ দিতে চেয়েছেন কি?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: মানবীয় সম্পর্ক। সর্বোপরি আমি জীবনকেই প্রকাশক করতে চেয়েছি।
এহ্সান: গল্পের বিষয়বস্তু আপনি কি ভাবে নির্ধারণ করেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: অভিজ্ঞতা থেকে।
এহ্সান: একটি ঘটনা বা অভিজ্ঞতা কি করে আপনি গল্পে রূপান্তর করেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: প্রতিদিন চলতে চলতে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা দেখা মানুষগুলো আমার ভেতর জড়ো হতে থাকে প্রতিনিয়ত। দীর্ঘদিন পর, কোন একসময় টের পাই, তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রবল আন্দোলন করে ক্ষত-বিক্ষত করছে আমাকে এবং বেরিয়ে আসার প্রবল চেষ্টা করছে ভেতর থেকে। লেখার মাধ্যমেই তাদের মুক্তি ঘটে।
এহ্সান: গল্পে আপনার ব্যক্তিগত ছাপ আছে কি?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: প্রত্যেক লেখকের মধ্যেই ব্যক্তিগত অনুপ্রেরণা কাজ করে কিন্তু অনুসরণ না। আমি আমার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চেয়েছি কিন্তু প্রতিলিপি তৈরি করিনি কোথাও।
এহ্সান: গল্প উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আপনি মেটাফোর, নিজস্ব শব্দ তৈরি করেন কি না?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: করি। যেমন ‘দেয়ালবন্ধু’ একটি নতুন শব্দ, এমন আরও কিছু নতুন শব্দ পাবেন। ‘দেয়ালবন্ধু’ নামে আমার একটি মেটাফরিক গল্প আছে। ‘একটি পৌরাণিক গল্প’ শিরোনামের গল্পটি আগাগোড়া একটি রূপক গল্প।
এহ্সান: প্রত্যেক লেখকই চায় তার একটা নিজস্বতা তৈরি করতে, তো বর্তমান গল্পকারদের সঙ্গে আপনার গল্পের পার্থক্য করেন কী ভাবে?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: বাস্তবতার সাথে এই যে বিমূর্ততা ও পরাবাস্তবতার একটি কানেকশন করার চেষ্টা, আমার ধারণা, এটাই আমাকে নিজস্বতা দেবে।
এহ্সান: শুধু উস্থাপনের স্টাইল দ্বারা তো আর একজন গল্পকার মহৎ হয়ে ওঠেন না। চিন্তার ও দেখার বৈচিত্র্য ও গভীরতা দরকার হয়। আপনার গল্পগুলোতে জীবনের তেমন কোনো সত্য আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন কি?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: আমি যে ফর্ম নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি, তাতে জীবনের গভীরতা এমনি চলে আসে।
এহ্সান: প্রায় সব গল্পেই তো কোনো না কোনো অনুসন্ধান থাকে। যেমন- আত্ম, নৃ-তাত্ত্বিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, মেট্রপলিটন ইত্যাদি। আপনি কোন ধরনের অনুসন্ধানে গল্প রচনা করেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: আত্ম-অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে মানুষের মৌলিকতাকে খুঁজে দেখার চেষ্টা।
এহ্সান: গল্পের বিষয় বস্তুর নির্বাচনের সঙ্গে দর্শনের একটা যোগাযোগ আছে। আপনি গল্পে তেমন কি কোনো দর্শনের প্রতিফল বা প্রভাব দেখাতে চেষ্টা করেছেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: দর্শন ছাড়া কোন গল্পই গল্প হয়ে উঠে না। এক গ্লাস সরবতে পানির সাথে চিনির দ্রবণের মত গল্পের ভেতরেই দর্শন থাকে। শুধু দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করাতে গেলে যেমন গল্পের গতি হারাবে, আবার দর্শন না থাকলেও গল্প গল্পের মর্যাদা পাবে না।
এহ্সান: আপনা গল্পগুলোকে কি কোনো বিশেষ ধারা বা ঘরাণার-যেমন মার্কসবাদী, জীবনবাদী, নারীবাদী, ফ্রয়েডিয় ইত্যাদি বলে মনে করেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: মার্কস এবং ফ্রয়েড আমাদের সাহিত্যে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তারকারী কিন্তু আমি মনে করি, ফ্রয়েড এবং মার্কস থেকে আমাদের বের হয়ে আসার সময় হয়েছে। এই মুহূর্তে আধুনিক জীবনে যেটা সবচেয়ে প্রকটভাবে আসছে, সেটা হচ্ছে অস্তিত্বসঙ্কট। আমি অস্তিত্ব সঙ্কটের ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিয়েছি।
এহ্সান: এর আগে প্রকাশিত গ্রন্থের সঙ্গে এই বইয়ের গল্পগুলোর বিশেষ পার্থক্য আছে?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: হ্যাঁ। আছে।
এহ্সান: এই সময়ের প্রকাশিত গল্পগ্রন্থগুলোর সঙ্গে আপনার গল্পের পার্থক্য কি?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: বিষয়বৈচিত্র্য, উপস্থাপন এবং নিজস্ব ভাবনা।
এহ্সান: বইটি ‘মৃত ও জীবিতের জীবনগুলি’ নামের কারণ কি?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: ‘মৃত ও জীবিতের জীবনগুলি’ শিরোনামের মাধ্যমে মানুষের অস্তিত্ব সঙ্কটের প্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করেছি। আধুনিক সময়ের একটি প্রধানতম সমস্যা হচ্ছে নিজেকে চিনতে না পারা। এখানে মানুষের সবকিছুই আছে কিন্তু কিছুই যেন নেই, এমনই এক দ্বৈততা থেকে মানুষের মানসিক মৃত্যু প্রবল হয়ে উঠছে। ‘মৃত ও জীবিতের জীবনগুলি’ মূলত মানুষের মানুষিক মৃত্যুরই ইঙ্গিত দেয়।
এহ্সান: আমরা দেখি বাংলা সাহিত্যে উত্তারাধিকারের ধারা বহন করেছেন অনেক লেখক। আপনি কি নিজেকে কোনো সাহিত্যধারার উত্তরাধিকারী মনে করেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: হ্যাঁ। পরম্পরা তো থাকবেই। কোন কিছু যখন একবার আবিষ্কৃত হয়, তখন দ্বিতীয়বার কেউ এসে আর সেই একই জিনিস আবিষ্কার করতে যাবে না। তার পূর্বসূরি যেটুকু রেখে গেছে, তাকে সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। সাহিত্যেও ব্যাপারটা একইভাবে ভাবতে পারি। পূর্ববর্তী লেখকদের কাছে আমরা যতটুকু পেয়েছি, সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে সামনে।
এহ্সান: উত্তরাধিকারীধারায় অনেক সাহিত্যিক অগ্রজ সাহিত্যিকের কাছে ঋণ স্বীকার করেন। আপনি কি তেমন কোনো সাহিত্যিকের নাম বলবেন কি, যার প্রভার আপনি অনুভব করেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: আমার লেখালেখির শুরুতে হুমায়ূন আহমেদের গদ্য ভাষায় বেশ প্রভাবিত হই। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে আমি সম্পূর্ণ নিজস্বতার উপর দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।
এহ্সান: আপনার সমসাময়িক সাহিত্যিকদের মধ্যে কার সাহিত্য আপনার ভাল লাগে, ভাল করছে?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: আমার সমসাময়িক বলতে গেলে এখানে সাহিত্যের দশকের বিভাজনটা চলে আসে কিন্তু আমি দশক বিভাজনের পক্ষপাতী নই। যদি তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল লেখকদের কথা বলতে হয়, তবে আনিফ রুবেদ, মেহেদী উল্লাহ, শাহনেওয়াজ বিপ্লবসহ অনেকেই আছেন যারা বেশ ভালো লিখছেন।
এহ্সান: বাংলা সাহিত্যে এখন উত্তরাধুনিক সাহিত্যের নামে একধরনের সাহিত্য চর্চা হচ্ছে, এতে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। তাই প্রত্যেক গল্পকার তার স্বাতন্ত্র নিয়ে ভাবেন, এটা অবাঞ্চিত কিছু নয়। এই ব্যক্তি সাতন্ত্র আমাদের সাহিত্যের কি রূপ দিচ্ছে?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: এর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দু’টি দিকই আছে। ব্যক্তির ভেতর দিয়েই আসলে গোষ্ঠীকে প্রকাশ করা হয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত হয়েও ব্যক্তিকেন্দ্রিক না। এটাকে ইতিবাচকই বলবো। তবে এর খুব বেশি চর্চা সার্থবাদী সময়ের দিকে আমাদের নিয়ে যেতে পারে।
এহ্সান: সাহিত্যের দশক বিচার প্রচলিত আছে। আপনি আপনার দশককে কি ভাবে উপস্থান বা চিহ্নিত করছেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: আমি দশক বিভাজনে বিশ্বাসী নই।
এহ্সান: একটা বই প্রকাশ করা আর একটা ভাল গল্প লেখা, কোনটা আপনাকে বেশি তৃপ্তি দিবে?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: একটা বই প্রকাশ করার চেয়ে অবশ্যই একটি ভালো গল্প লেখা আমাকে বেশি তৃপ্ত করবে।
এহ্সান: পরবর্তী বই নিয়ে আপনার কি কোনো চিন্তা আছে?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: না। বই নিয়ে আপাতত কোন প্ল্যান নেই। তবে বড় প্রেক্ষাপট নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছি। সেটাই পরবর্তী বই হতে পারে।
এহ্সান: আপনার না লেখা কোনো গল্প আছে, যা আপনি লিখতে চান?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: এমন অসংখ্য গল্প আছে। আমি জানি বেঁচে থাকলে আমি গল্পগুলো লিখে যেতে পারবো। এই মুহূর্তে লিখতে পারছি না কারণ, গল্পগুলো লেখার জন্য এখনো নিজেকে প্রস্তুত মনে করছি না।
এহ্সান: এক বসায় গল্প লেখেন না ধীরে ধীরে, কেঁটে-ছিড়ে লিখে থাকেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: আমি সাধারণত টানা গল্প লিখি, এক বসাতেই। তারপর কাট-ছাঁট করি। লেখা শুরু করার আগেই আমার গল্পের প্রস্তুতিটা নিয়ে নিতে হয়।
এহ্সান: গল্প লেখার কোনো অতৃপ্ততা আছে কি?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: হ্যাঁ। অতৃপ্ততা তো আছেই। যত দিন যায়, অতৃপ্ততার মাত্রাটা বাড়ছেই।
এহ্সান: আজকের দিনে সবাই যখন উপন্যাসের দিকে ঝুঁকছে, আপনি সেখানে ছোটগল্পকে কিভাবে দেখছেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: সাহিত্যে আমি কবিতার পরেই রাখবো গল্পকে। গল্পে চেতনার প্রকাশটা উপন্যাসের চেয়ে গভীর এবং নান্দনিক।
এহ্সান: গল্প উপস্থাপনে আপনি ন্যারেটিভ টাইপ লিখেন, নাকি মূল গল্পটিকে আপনার গল্পের সারা শরীরে ছড়িয়ে দিতে পছন্দ করেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: দু’টোই। যখন যেটাকে প্রয়োজন মনে করি।
এহ্সান: লেখক প্রস্তুতি হিসেবে দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, বিশেষত দেশিয় সাহিত্যপাঠ ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজকের দিনে অনেক অবশ্য এতো গভীরে যেতে চান না। আপনার কাছে এগুলো কি মনে হয়?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: সাহিত্যে ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, ইতিহাস অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো ছাড়া সাহিত্য তার মাত্রা হারিয়ে ফেলে। তবে লেখায় এদের ব্যবহার সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতনতা জরুরি। একটি ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে, মতবাদের চাপে পড়ে যেন গল্পটাই হারিয়ে না যায়।
এহ্সান: ভাল গল্প বলতে আপনি কোনগুলোকে বোঝেন, মানে আপনার চোখে কোন গল্পগুলো ভাল?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: সার্থক গল্প কোন একটি তুচ্ছ বিষয়কেও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারে। আমি গল্পের মানদণ্ড হিসেবে নিন্মক্তো এই ব্যাপারগুলকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। গল্পটি-
সময় এবং পরিবেশকে কতটুকু ধারণ করল, বিষয় যাই হোক, গভীরতা কেমন, উপস্থাপনার সাবলীলতা, সব শেষে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগাতে পারল কিনা।
এহ্সান: আপনি কি বাংলাদেশের বর্তমানে রচিত গল্পগুলো নিয়ে সন্তুষ্ট? একটু বিস্তারিত যদি বলেন।
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: সন্তুষ্টি যেমন আছে, তেমনই অভিযোগও আছে। বর্তমান সময়ে গল্পের ক্ষেত্রে আমরা অনেকদূর এগিয়ে এসেছি। বাংলাদেশের গল্প এখন শক্তিশালী ফর্মে পৌঁছে গেছে। আছে ব্যাপক বিস্তৃতি এবং গভীরতাও।
বাংলাদেশি সমসাময়িক লেখকদের লেখা নিয়ে অভিযোগের প্রসঙ্গটাও বলি, একটি প্রবণতা দেখছি ইদানীং- সেই এক নিন্মবর্গের জীবন নিয়ে না লিখলে যেন গল্পই হয় না! এজন্য তারা বারবার একই মানুষগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন ছাঁচে তুলছেন। ঘুরেফিরে প্রতিটি গল্পে একই কথাই বারবার বলছেন। এটা কোনভাবেই কাম্য না।
আরও একটা ব্যাপার, অনেকই গল্পের আঙ্গিক এবং ভাষা নিয়ে এতো বেশি টানাটানি করছেন তাতে স্পষ্টতর গল্পে আর গল্পের গতিশীলতা খুঁজে পাই না। গল্প হয়ে উঠে নির্মোহ এবং মেদবহুল।
এহসান : আপনাকে ধন্যবাদ।
সাইফুল্লাহ সাইফ : আপনাকেও ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীর পরিচিতি:
অলাত এহ্সান
জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। কঠিন-কঠোর জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। পড়াশুনা করেছেন সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ ও ঢাকা কলেজে। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। প্রবন্ধ লিখেন। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ব ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: অলাত এহ্সান

-----------------------------------------------------------------------
অলাত এহ্সান: ‘মৃত ও জীবিতের জীবনগুলি’ আপনার ২য় গল্পগ্রন্থ, গল্প লেখা শুরু করেছেন আরো অনেক আগে, তা কতদিন ধরে লেখা গল্পগুলো এবার বই আকারে প্রকাশ করলেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: প্রথম বই ‘কয়েকটি ডানাকাটা প্রজাপতির উড়ে যাওয়ার স্বপ্ন’ অনেকটা ঝোঁকের বসেই প্রকাশিত হয়েছিল ১৩ এর বইমেলায় সাহিত্যকাল প্রকাশন থেকে । মাঝখানে একবছর গ্যাপ দিয়ে এবারের ‘মৃত ও জীবিতের জীবনগুলি’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হচ্ছে ‘নওরোজ কিতাবিস্তান’ থেকে । গত দুই বছরের ১৩টি গল্পকে অন্তর্ভুক্ত করেছি সংকলনটিতে ।
অলাত এহ্সান: এই সময় ধরে লেখা গল্পগুলোর মধ্যে আপনার গল্পে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন কি?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: হ্যাঁ, পরিবর্তন আছে। প্রথম বইয়ের গল্পগুলোতে বর্ণনায় একটি নিপাট সরলতা ছিল। গল্পকে শুধুমাত্র প্লটের উপর দাঁড় করানো হয়েছিল। গল্পের ফর্ম নিয়ে খুব একটা কাজ করিনি। কিন্তু দ্বিতীয় এই বইটিতে গল্পের গঠন ও বিন্যাস নিয়ে ব্যাপক কাজ করেছি। আছে সাবজেক্ট ভেরিয়েশন এবং চিন্তার গভীরতা।
এহ্সান: এই বইতে ১৩টি গল্প আছে। গল্পগুলো কি কি বিষয় নিয়ে লেখা?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: মনস্তাত্ত্বিক বোঝাপড়া এবং সমাজকে পরোক্ষভাবে স্যাটায়ার। কিছু কিছু গল্পে পরাবাস্তবতার ভেতর দিয়ে আধুনিক সময়ের অস্তিত্বসঙ্কটকে তুলে ধরা।
এহ্সান: আপনি কি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বস্তু নিয়ে লিখতে পছন্দ করেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: না। কারণ নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু নিয়ে লিখতে গেলে লেখার ব্যাপকতা হারিয়ে যায়। দেখা যায়, কোন কোন পরিস্থিতিতে খুব সামান্য কোন ঘটনা বা বিষয়ও একটি গল্পের সাবজেক্ট হয়ে উঠতে পারে। যেমন টিকটিকে নিয়ে আমার একটি গল্প আছে।
এহ্সান: গল্পগুলোর উপস্থাপনেও বৈচিত্র্য আছে কি?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: এটা মূল্যায়ন করবেন পাঠক। গল্পের বিষয়বস্তু যেমনই হোক, উপস্থাপনার ভেতর দিয়েই তা প্রকৃত বৈচিত্র্যের মাত্রাটি পায়। বর্তমানে বাংলাদেশে গল্পের আঙ্গিক নিয়ে ভালো কাজ হচ্ছে, আমিও চেষ্টা করেছি। তবে সবশেষে এই মূল্যায়নটা পাঠকের উপরই ছেড়ে দিলাম।
এহ্সান: কোনো বিশেষ স্টাইলের প্রতি আপনা দূর্বলতা আছে কি, মানে আপনি স্বাচ্ছন্দ করেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: বাস্তবতার সাথে বিমূর্ততার একটা সম্পর্ক নির্মাণের চেষ্টা করি কখনো কখনো। এর প্রতি এক ধরণের দুর্বলতা আছে বলতে পারেন।
এহ্সান: আপনার গল্পগুলো কি আন্তঃসম্পর্কিত?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: না। বরঞ্চ এখানে তিনটি ধারায় আমি ফেলতে পারি গল্পগুলোকে। নিন্ম-মধ্যবিত্ত জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, বর্তমান সময়ে মানুষের সঙ্কট ও মনস্তাত্ত্বিক বোঝাপড়া এবং প্লট-কনসট্রাকশনে পরাবাস্তবতার একটা সংযুক্তি।
এহ্সান: গল্পগুলোতে আপনি কি বলতে চেয়েছেন, কোনো বিশেষ বিষয়কে উপস্থান বা ম্যাসেজ দিতে চেয়েছেন কি?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: মানবীয় সম্পর্ক। সর্বোপরি আমি জীবনকেই প্রকাশক করতে চেয়েছি।
এহ্সান: গল্পের বিষয়বস্তু আপনি কি ভাবে নির্ধারণ করেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: অভিজ্ঞতা থেকে।
এহ্সান: একটি ঘটনা বা অভিজ্ঞতা কি করে আপনি গল্পে রূপান্তর করেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: প্রতিদিন চলতে চলতে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা দেখা মানুষগুলো আমার ভেতর জড়ো হতে থাকে প্রতিনিয়ত। দীর্ঘদিন পর, কোন একসময় টের পাই, তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রবল আন্দোলন করে ক্ষত-বিক্ষত করছে আমাকে এবং বেরিয়ে আসার প্রবল চেষ্টা করছে ভেতর থেকে। লেখার মাধ্যমেই তাদের মুক্তি ঘটে।
এহ্সান: গল্পে আপনার ব্যক্তিগত ছাপ আছে কি?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: প্রত্যেক লেখকের মধ্যেই ব্যক্তিগত অনুপ্রেরণা কাজ করে কিন্তু অনুসরণ না। আমি আমার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চেয়েছি কিন্তু প্রতিলিপি তৈরি করিনি কোথাও।
এহ্সান: গল্প উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আপনি মেটাফোর, নিজস্ব শব্দ তৈরি করেন কি না?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: করি। যেমন ‘দেয়ালবন্ধু’ একটি নতুন শব্দ, এমন আরও কিছু নতুন শব্দ পাবেন। ‘দেয়ালবন্ধু’ নামে আমার একটি মেটাফরিক গল্প আছে। ‘একটি পৌরাণিক গল্প’ শিরোনামের গল্পটি আগাগোড়া একটি রূপক গল্প।
এহ্সান: প্রত্যেক লেখকই চায় তার একটা নিজস্বতা তৈরি করতে, তো বর্তমান গল্পকারদের সঙ্গে আপনার গল্পের পার্থক্য করেন কী ভাবে?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: বাস্তবতার সাথে এই যে বিমূর্ততা ও পরাবাস্তবতার একটি কানেকশন করার চেষ্টা, আমার ধারণা, এটাই আমাকে নিজস্বতা দেবে।
এহ্সান: শুধু উস্থাপনের স্টাইল দ্বারা তো আর একজন গল্পকার মহৎ হয়ে ওঠেন না। চিন্তার ও দেখার বৈচিত্র্য ও গভীরতা দরকার হয়। আপনার গল্পগুলোতে জীবনের তেমন কোনো সত্য আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন কি?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: আমি যে ফর্ম নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি, তাতে জীবনের গভীরতা এমনি চলে আসে।
এহ্সান: প্রায় সব গল্পেই তো কোনো না কোনো অনুসন্ধান থাকে। যেমন- আত্ম, নৃ-তাত্ত্বিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, মেট্রপলিটন ইত্যাদি। আপনি কোন ধরনের অনুসন্ধানে গল্প রচনা করেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: আত্ম-অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে মানুষের মৌলিকতাকে খুঁজে দেখার চেষ্টা।
এহ্সান: গল্পের বিষয় বস্তুর নির্বাচনের সঙ্গে দর্শনের একটা যোগাযোগ আছে। আপনি গল্পে তেমন কি কোনো দর্শনের প্রতিফল বা প্রভাব দেখাতে চেষ্টা করেছেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: দর্শন ছাড়া কোন গল্পই গল্প হয়ে উঠে না। এক গ্লাস সরবতে পানির সাথে চিনির দ্রবণের মত গল্পের ভেতরেই দর্শন থাকে। শুধু দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করাতে গেলে যেমন গল্পের গতি হারাবে, আবার দর্শন না থাকলেও গল্প গল্পের মর্যাদা পাবে না।
এহ্সান: আপনা গল্পগুলোকে কি কোনো বিশেষ ধারা বা ঘরাণার-যেমন মার্কসবাদী, জীবনবাদী, নারীবাদী, ফ্রয়েডিয় ইত্যাদি বলে মনে করেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: মার্কস এবং ফ্রয়েড আমাদের সাহিত্যে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তারকারী কিন্তু আমি মনে করি, ফ্রয়েড এবং মার্কস থেকে আমাদের বের হয়ে আসার সময় হয়েছে। এই মুহূর্তে আধুনিক জীবনে যেটা সবচেয়ে প্রকটভাবে আসছে, সেটা হচ্ছে অস্তিত্বসঙ্কট। আমি অস্তিত্ব সঙ্কটের ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিয়েছি।
এহ্সান: এর আগে প্রকাশিত গ্রন্থের সঙ্গে এই বইয়ের গল্পগুলোর বিশেষ পার্থক্য আছে?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: হ্যাঁ। আছে।
এহ্সান: এই সময়ের প্রকাশিত গল্পগ্রন্থগুলোর সঙ্গে আপনার গল্পের পার্থক্য কি?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: বিষয়বৈচিত্র্য, উপস্থাপন এবং নিজস্ব ভাবনা।
এহ্সান: বইটি ‘মৃত ও জীবিতের জীবনগুলি’ নামের কারণ কি?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: ‘মৃত ও জীবিতের জীবনগুলি’ শিরোনামের মাধ্যমে মানুষের অস্তিত্ব সঙ্কটের প্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করেছি। আধুনিক সময়ের একটি প্রধানতম সমস্যা হচ্ছে নিজেকে চিনতে না পারা। এখানে মানুষের সবকিছুই আছে কিন্তু কিছুই যেন নেই, এমনই এক দ্বৈততা থেকে মানুষের মানসিক মৃত্যু প্রবল হয়ে উঠছে। ‘মৃত ও জীবিতের জীবনগুলি’ মূলত মানুষের মানুষিক মৃত্যুরই ইঙ্গিত দেয়।
এহ্সান: আমরা দেখি বাংলা সাহিত্যে উত্তারাধিকারের ধারা বহন করেছেন অনেক লেখক। আপনি কি নিজেকে কোনো সাহিত্যধারার উত্তরাধিকারী মনে করেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: হ্যাঁ। পরম্পরা তো থাকবেই। কোন কিছু যখন একবার আবিষ্কৃত হয়, তখন দ্বিতীয়বার কেউ এসে আর সেই একই জিনিস আবিষ্কার করতে যাবে না। তার পূর্বসূরি যেটুকু রেখে গেছে, তাকে সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। সাহিত্যেও ব্যাপারটা একইভাবে ভাবতে পারি। পূর্ববর্তী লেখকদের কাছে আমরা যতটুকু পেয়েছি, সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে সামনে।
এহ্সান: উত্তরাধিকারীধারায় অনেক সাহিত্যিক অগ্রজ সাহিত্যিকের কাছে ঋণ স্বীকার করেন। আপনি কি তেমন কোনো সাহিত্যিকের নাম বলবেন কি, যার প্রভার আপনি অনুভব করেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: আমার লেখালেখির শুরুতে হুমায়ূন আহমেদের গদ্য ভাষায় বেশ প্রভাবিত হই। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে আমি সম্পূর্ণ নিজস্বতার উপর দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।
এহ্সান: আপনার সমসাময়িক সাহিত্যিকদের মধ্যে কার সাহিত্য আপনার ভাল লাগে, ভাল করছে?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: আমার সমসাময়িক বলতে গেলে এখানে সাহিত্যের দশকের বিভাজনটা চলে আসে কিন্তু আমি দশক বিভাজনের পক্ষপাতী নই। যদি তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল লেখকদের কথা বলতে হয়, তবে আনিফ রুবেদ, মেহেদী উল্লাহ, শাহনেওয়াজ বিপ্লবসহ অনেকেই আছেন যারা বেশ ভালো লিখছেন।
এহ্সান: বাংলা সাহিত্যে এখন উত্তরাধুনিক সাহিত্যের নামে একধরনের সাহিত্য চর্চা হচ্ছে, এতে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। তাই প্রত্যেক গল্পকার তার স্বাতন্ত্র নিয়ে ভাবেন, এটা অবাঞ্চিত কিছু নয়। এই ব্যক্তি সাতন্ত্র আমাদের সাহিত্যের কি রূপ দিচ্ছে?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: এর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দু’টি দিকই আছে। ব্যক্তির ভেতর দিয়েই আসলে গোষ্ঠীকে প্রকাশ করা হয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত হয়েও ব্যক্তিকেন্দ্রিক না। এটাকে ইতিবাচকই বলবো। তবে এর খুব বেশি চর্চা সার্থবাদী সময়ের দিকে আমাদের নিয়ে যেতে পারে।
এহ্সান: সাহিত্যের দশক বিচার প্রচলিত আছে। আপনি আপনার দশককে কি ভাবে উপস্থান বা চিহ্নিত করছেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: আমি দশক বিভাজনে বিশ্বাসী নই।
এহ্সান: একটা বই প্রকাশ করা আর একটা ভাল গল্প লেখা, কোনটা আপনাকে বেশি তৃপ্তি দিবে?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: একটা বই প্রকাশ করার চেয়ে অবশ্যই একটি ভালো গল্প লেখা আমাকে বেশি তৃপ্ত করবে।
এহ্সান: পরবর্তী বই নিয়ে আপনার কি কোনো চিন্তা আছে?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: না। বই নিয়ে আপাতত কোন প্ল্যান নেই। তবে বড় প্রেক্ষাপট নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছি। সেটাই পরবর্তী বই হতে পারে।
এহ্সান: আপনার না লেখা কোনো গল্প আছে, যা আপনি লিখতে চান?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: এমন অসংখ্য গল্প আছে। আমি জানি বেঁচে থাকলে আমি গল্পগুলো লিখে যেতে পারবো। এই মুহূর্তে লিখতে পারছি না কারণ, গল্পগুলো লেখার জন্য এখনো নিজেকে প্রস্তুত মনে করছি না।
এহ্সান: এক বসায় গল্প লেখেন না ধীরে ধীরে, কেঁটে-ছিড়ে লিখে থাকেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: আমি সাধারণত টানা গল্প লিখি, এক বসাতেই। তারপর কাট-ছাঁট করি। লেখা শুরু করার আগেই আমার গল্পের প্রস্তুতিটা নিয়ে নিতে হয়।
এহ্সান: গল্প লেখার কোনো অতৃপ্ততা আছে কি?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: হ্যাঁ। অতৃপ্ততা তো আছেই। যত দিন যায়, অতৃপ্ততার মাত্রাটা বাড়ছেই।
এহ্সান: আজকের দিনে সবাই যখন উপন্যাসের দিকে ঝুঁকছে, আপনি সেখানে ছোটগল্পকে কিভাবে দেখছেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: সাহিত্যে আমি কবিতার পরেই রাখবো গল্পকে। গল্পে চেতনার প্রকাশটা উপন্যাসের চেয়ে গভীর এবং নান্দনিক।
এহ্সান: গল্প উপস্থাপনে আপনি ন্যারেটিভ টাইপ লিখেন, নাকি মূল গল্পটিকে আপনার গল্পের সারা শরীরে ছড়িয়ে দিতে পছন্দ করেন?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: দু’টোই। যখন যেটাকে প্রয়োজন মনে করি।
এহ্সান: লেখক প্রস্তুতি হিসেবে দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, বিশেষত দেশিয় সাহিত্যপাঠ ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজকের দিনে অনেক অবশ্য এতো গভীরে যেতে চান না। আপনার কাছে এগুলো কি মনে হয়?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: সাহিত্যে ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, ইতিহাস অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো ছাড়া সাহিত্য তার মাত্রা হারিয়ে ফেলে। তবে লেখায় এদের ব্যবহার সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতনতা জরুরি। একটি ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে, মতবাদের চাপে পড়ে যেন গল্পটাই হারিয়ে না যায়।
এহ্সান: ভাল গল্প বলতে আপনি কোনগুলোকে বোঝেন, মানে আপনার চোখে কোন গল্পগুলো ভাল?
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: সার্থক গল্প কোন একটি তুচ্ছ বিষয়কেও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারে। আমি গল্পের মানদণ্ড হিসেবে নিন্মক্তো এই ব্যাপারগুলকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। গল্পটি-
সময় এবং পরিবেশকে কতটুকু ধারণ করল, বিষয় যাই হোক, গভীরতা কেমন, উপস্থাপনার সাবলীলতা, সব শেষে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগাতে পারল কিনা।
এহ্সান: আপনি কি বাংলাদেশের বর্তমানে রচিত গল্পগুলো নিয়ে সন্তুষ্ট? একটু বিস্তারিত যদি বলেন।
সাইফুল্লাহ সা্ইফ: সন্তুষ্টি যেমন আছে, তেমনই অভিযোগও আছে। বর্তমান সময়ে গল্পের ক্ষেত্রে আমরা অনেকদূর এগিয়ে এসেছি। বাংলাদেশের গল্প এখন শক্তিশালী ফর্মে পৌঁছে গেছে। আছে ব্যাপক বিস্তৃতি এবং গভীরতাও।
বাংলাদেশি সমসাময়িক লেখকদের লেখা নিয়ে অভিযোগের প্রসঙ্গটাও বলি, একটি প্রবণতা দেখছি ইদানীং- সেই এক নিন্মবর্গের জীবন নিয়ে না লিখলে যেন গল্পই হয় না! এজন্য তারা বারবার একই মানুষগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন ছাঁচে তুলছেন। ঘুরেফিরে প্রতিটি গল্পে একই কথাই বারবার বলছেন। এটা কোনভাবেই কাম্য না।
আরও একটা ব্যাপার, অনেকই গল্পের আঙ্গিক এবং ভাষা নিয়ে এতো বেশি টানাটানি করছেন তাতে স্পষ্টতর গল্পে আর গল্পের গতিশীলতা খুঁজে পাই না। গল্প হয়ে উঠে নির্মোহ এবং মেদবহুল।
এহসান : আপনাকে ধন্যবাদ।
সাইফুল্লাহ সাইফ : আপনাকেও ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীর পরিচিতি:
অলাত এহ্সান
জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। কঠিন-কঠোর জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। পড়াশুনা করেছেন সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ ও ঢাকা কলেজে। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। প্রবন্ধ লিখেন। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ব ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে।
2 মন্তব্যসমূহ
ভাই, এগিয়ে চলুন সামনের পথে............ :)
উত্তরমুছুনসুন্দর সাক্ষাত্কার । ভালো লাগলো ।
উত্তরমুছুন