অভিজিৎ সেনের গল্প নিয়ে আলোচনা
এমদাদ রহমান
আমরা যারা অভিজিৎ সেনের ব্যথার জগৎ গল্পটি পড়ব কিংবা পড়েছি, তারা আসলে কী খুঁজব, কী খুঁজে পাব, এই গল্পের শেষে? এই প্রশ্নের উত্তর তো কিছুদিন আগে, গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেসকে নিয়ে পাঠ-অভিজ্ঞতামূলক একটি লেখায় আমাদের বাংলা ভাষার, সাহিত্যের উচ্চতম মাইলফলক দেবেশ রায় বলে দিয়েছেন।
আমাদের প্রচণ্ড আগ্রহের এই লেখক, কি বলেছিলেন; শুধু লাতিন নয়, সমগ্র বিশ্বের কাছে সমাদৃত গারসিয়া মার্কেসের মৃত্যুর কিছুদিন পর, তাঁকেই স্মরণ করে, আসুন তবে পড়ে ফেলা যাক, কথাগুলি-
'গল্প কী, উপন্যাস কী, কল্পনা কী, অভিজ্ঞতা কী-- এসব প্রশ্নের কোনও এক নিষ্পত্তি না- করে গল্প-উপন্যাস লেখা যায় না। যিনি গল্প-উপন্যাস লেখেন তাঁকে তাঁর সময়টাকেই জানতে হয়। আর, তাঁর জানার একমাত্র উপায় তাঁর সময় তাঁর কাছে কোন গল্পের আকারে আসছে। এমনটা নয়, কখনওই নয়, যে, সময়ের একটা আকার দেওয়ার জন্য তিনি একটা যোগ্য ও যথাযথ গল্প তৈরি করেন। গল্পটাই তাঁর সময়ের আকার হয়ে আসে। একজন কবির কাছে তাঁর সময়ের আকার হয়ে আসে একটি বা কয়েকটি চরণ বা একটি ও একটিমাত্র উপমা। উস্তাদ হাফিজ আলির কাছে তাঁর সময়ের আকার হয়ে আসে দরবারি কানাড়ার কোমল গান্ধার।
কোনও শিল্প-ই আরোহী বা অবরোহী পদ্ধতিতে নিষ্কাশিত হয় না। শিল্প একটা আকার নিয়ে জন্মায়। সেই আকারটিকে স্পষ্ট করে তুলতেই গল্প লেখা, কবিতা রচনা, ভাস্কর্যে শূন্যতাকে ধরা, দরবারি কানাড়ায় কোমল গান্ধার লাগানো।'
অভিজিৎ সেন তাঁর ব্যথার জগৎ গল্পে আমাদের কি বলতে চাইলেন? আমরা কি এই প্রশ্নের কোনও প্রচ্ছন্ন উত্তর কিংবা সরাসরি কোনও ইঙ্গিত কি পেয়ে গেছি দেবেশ রায়ের কথাগুলি থেকে? হ্যাঁ, এই কথা আমরা তো মেনেই নিয়েছি যে শিল্প একটা আকার নিয়ে জন্মায়। সেই আকারের একটি বিশেষ প্রকাশ এই গল্পটি। লেখক, অভিজিৎ রায়, এখানে যেন আমাদের মনের ভিতর একটি কাটা পায়ের মায়া জাগিয়ে তাঁর কিংবা আমাদের যাপিত জীবনের ক্ষতটিকে দেখিয়ে দিলেন। বেশি কিছু বললেন না তিনি। শুধু কিছু ইঙ্গিত দিলেন।
মারাত্মক দুর্ঘটনায় সম্পূর্ণ একটা পা কাটা গেল অভয়পদ নামের একজন খুব সাধারণ মানুষের। তার জীবন এখানে অচল হয়ে পড়ল। জীবনের শক্তিটুকু যেন হাসপাতালের সারজিক্যাল ওয়ার্ড তার কাছ থেকে কেড়ে নিল।
সাহিত্য তার পাঠকের সংবেদনের দরজায় কড়া নাড়ে। ব্যথার জগৎ গল্পের অভয়পদর পা হারানোর যন্ত্রণা পাঠকের মনের ভিতর, মগজের ভিতর গেঁথে যায়।
এই গল্পে একজন কথক আছেন। হয়ত স্বয়ং লেখকই সেই চরিত্র। তিনি উত্তম পুরুষে আমাদের কাছে খুব ধীরে ধীরে, কিছু ব্যাপার বলতে থাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি এই গল্পের মুখ্য চরিত্র থাকেন না। কিন্তু এখানে সূত্রধর। গল্প এগিয়ে নিয়ে যান। পাঠকের কাছে আসল কথাটি তিনিই বলেন। তিনি এমনভাবে বলেন, দেবেশ রায়ের ভাষায় এভাবে বলা যায়-
'বড় চেনা প্রাচীন, বড় অনুভবের বর্তমান।'
ব্যথার জগৎ-এ কথকের বলা শুরু হয় এভাবে--
'বাইরে প্রবল বৃষ্টিপাত হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে। জেলা হাসপাতালের লম্বা ঘরখানার দু-পাশের দেয়াল জুড়ে শয্যা পাতা। পশ্চিমের দেয়ালে বড়ো বড়ো জানালা। ওয়ার্ডের সব শয্যাতেই রোগী আছে। শয্যা ছাড়াও মেঝেতেও বেশ কয়েকজন রোগীকে রাখা হয়েছে।'
এই যে প্রথম কথাটি, 'বাইরে প্রবল বৃষ্টিপাত হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে', আমাদের কীভাবে জানি আচ্ছন্ন করে ফেলে। একটা মানুষ হাসপাতালের বেডে শুয়ে বৃষ্টির কথা বলছে! আমাদের অবচেতনে হয়ত আরও একটি গল্পের মুখ উঁকি দিয়ে যায়। সেই গল্পটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের। গল্পের নাম নিরুদ্দেশ যাত্রা। সেই গল্পটি শুরু হয়েছিল এমন কিছু কথা দিয়ে-
'এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। রাত এগারোটা পার হয় হয়, এখনো রাস্তার রিকশা চলছে ছল ছল করে যেনো গোটিয়ার বিলে কেউ নৌকা বাইছে, 'তাড়াতাড়ি করো বাহে, ঢাকার গাড়ি বুঝি ছাড়ি যায়।' আমার জানালায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারের ভিজে গন্ধভরা সারি, বিষাদবর্ণ দেওয়াল; অনেকদিন পর আমার ভারি ভালো লাগছে। ছমছম করা এই রাত্রি, আমারি জন্যে তৈরি এরকম লোনলী-লগ্ন আমি কতোদিন পাইনি, কতোকাল, কোনোদিন নয়।'
হ্যাঁ, এভাবেও শিল্প তাঁর পাঠকের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করে- আমাদের নিজেদের নিরুদ্দেশ যাত্রার সঙ্গে, আমাদের নিজস্ব ব্যথার জগতের সঙ্গে। কিন্তু কোন সে জগৎ? আমাদের অন্তর্গত রক্তে খেলা করে যে জগৎ? যেমন, জীবনানন্দ আমাদের অবিরাম বলতে থাকেন-
'অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত - ক্লান্ত করে;
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের 'পরে।'
আর, অভিজিৎ সেন আমাদের সংবেদনে আরও কিছু কথা জুড়ে দেন তাঁর এই গল্পে-
'হাসপাতালের সারজিক্যাল ওয়ার্ড ব্যথার জগৎ, ব্যথা নিবৃত্তির জগৎও। ব্যথার উপলব্ধি, অভিব্যক্তি এবং ব্যথাকে গ্রহণ করার শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা এক এক জন মানুষের এক এক রকম। কালকের রাত্রে আসা লোকটি যে ব্যথা সহ্য করার পরীক্ষায় প্রথম দিকে থাকবে, এ ব্যাপারটা আমি পরে বুঝেছিলাম। আমি নিজেও যে যথেষ্ট সহ্যশক্তির অধিকারী এ উপলব্ধিও এই দুর্ঘটনার শিকার না হলে আমার ধারণায় আসত না। হাসপাতালে এই ন-দিন অবস্থানে ব্যথার শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া কত রকম হতে পারে তা বোঝার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমার মনে হয়েছে ব্যথা এবং ব্যথাহীনতার মধ্যে তৃতীয় আর একটি স্তর আছে। কী অভিধা নির্দিষ্ট করা যায় তার জন্য? তিতিক্ষা? নিতান্তই সাধারণ শব্দ সহ্যশক্তি? কিংবা কৃচ্ছ্রব্রত? ব্যথাকে ঐশ্বরিক অভিপ্রায় হিসাবে মেনে নেয় এমন লোকও তো আছে। পছন্দ মতো শব্দ খুঁজে পেলাম না।'
অবশ্য, তখন আমরা হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা অভয়পদর সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছি। আমাদের মনোজগৎ আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। ব্যথায় আমরাও আক্রান্ত হচ্ছি। কিন্তু, কী সেই অমোঘ কথা, যা এই গল্প দিয়ে বোঝাতে বা বলতে চাইলেন, কথাসাহিত্যিক অভিজিৎ সেন? অভয়পদ কি এখানে প্রতীক? প্রতীক হলে কীসের প্রতীক এই মানুষটি? আমাদের বিপন্নতার? আমাদের একাকীত্বের?
অপারেশন থিয়েটারে একটা পা রেখে অভয়পদ বেডে আসল। গল্পের কারবার, মানে যাকে আমরা শিল্পের অভিঘাত বলি, তা শুরু হয়। আমাদের মনে হতে থাকে, অভয়পদর নয়, আমাদেরই বুঝি পুরো একটা পা কেটে ফেলা হয়েছে! কিন্তু, অভয়পদ পা হারিয়ে কিরকম বিপন্ন হয়ে পড়ে, আমরা কি তা টের পাই? সে আকুল হয়ে বলতে থাকে- 'হামার পাওখান নিয়া ডাক্তারবাবুরা কী কইরবে?'
'পাওখানার সৎকাজ হবে না! জ্যান্ত মানুষের পাওখান শিয়াল কুকুরে টানাটানি কইরে খাবে! হা গোঁসাই!'
অভয়পদ যেন নিজেকে দেখতে পাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছে তার শরীরের একটা অংশ মরে গেছে, তারই সামনে শিয়ালে কুকুরে টানাটানি করে খাচ্ছে তারই পরম নির্ভরতার আধখানা শরীর!
কিন্তু, গল্প আমাদের মনকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। আমরা অন্য আরেক ব্যথার জগতে প্রবেশ করি। অভয়পদ তখন অনুভব করতে শুরু করেছে, পা-হীনতার যন্ত্রণা। একটা অব্যক্ত শূন্যতার বোধ তার মনে। পাখির অসহায় ডানা ঝাপটানো যেন! নার্স রোজমেরিকে অভয়পদ বলছে-
'ডাক্তার বাবুরা কি পাওখান কাইটে বাদ দিয়েছে, দিদি?'
'হ্যাঁ, সে তো আপনাকে বলাই হয়েছিল।'
'না, তাই বলি। অ্যানা জল দিবেন না, দিদি?'
'না, জল খেলে বমি হবে। কষ্ট বেশি হবে।'
পাওখানায় যে বড়ো ব্যথা হচ্ছে, দিদি?'
'ও তো একটু হবে। অপারেশন হয়েছে তো।'
'না-না, তা কছি না। পাওয়ের গোছে, গোড়ালিতে--'
'ও ঠিক হয়ে যাবে, ঘুমোন আপনি।'
তারপর অভয়পদর প্রাণের আশ্রয় গোঁসাই আসেন, হাসপাতালে। তাকে পেয়ে অভয়পদ শিশুর মত নিজেকে যেন সমর্পণ করতে চায়-
'কাক ও ক'বার পারি না, কেও বিশ্বাস কইরবে না। এই যে পাওখান নাই, গোঁসাই, ওই পাওখান কিন্তু আছে, ওই পাওয়ে জব্বের বেথা, গোঁসাই। হাঁটু থিকা পাওয়ের পাতা তক মরণ বেথা গোঁসাই!'
আবার ফিরতে ইচ্ছা করছে দেবেশ রায়ের কাছে। তিনি দুটি উপন্যাস নিয়ে কথা বলছেন। একটি 'কপালকুণ্ডলা', অন্যটি 'অন্তর্জলী যাত্রা'। তিনি আমাদের বলছেন,-
এই দু'টো উপন্যাসেই প্রত্যেকটি মানুষ প্রত্যেকের সঙ্গে বাঁধা, কিন্তু প্রত্যেকের কাছেই সেটা বন্ধন। প্রত্যেকেই সে-বন্ধন থেকে মুক্তি চাইছে অথচ বন্ধন এড়াতে পারছে না।'
দেবেশ এখানে মার্কেসের 'প্রেম ও অন্যান্য দানব' নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বাংলা ভাষার দুই স্তম্ভ, এই দুটি উপন্যাসের উল্লেখ করছেন, আর আমরা সেই ভাবটিকে অভিজিৎ সেনের গল্পের ভাবের সঙ্গে মিলিয়ে দিচ্ছি! এ এক আশ্চর্য খেলা মহাশয়। ব্যথার জগৎ গল্পের গোঁসাই যেন সেই মানুষ, যে মানুষের সঙ্গে আমরা সবাই সম্পর্কিত থাকি জীবনের প্রতিটি স্তরে। আমরা গল্পে পড়েছি-
'গোঁসাইকে দেখে অভয়পদ একেবারে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। বয়স্ক পুরুষ মানুষের এমন নির্ভরতা আমি আগে কখনও দেখিনি।
'গোঁসাই কুনঠে গেছিলেন তুমি? হামি এঠে মইরে যাচ্ছি--'
বেডের পাশে গিয়ে ঝুঁকে অভয়পদর মাথাটা দু-হাতের মধ্যে ধরে রাখল গোঁসাই। এ ক-দিনের মধ্যে অভয়পদকে আমি একবারও এমন অধৈর্য কিংবা দিশেহারা হতে দেখিনি। প্রায় সমবয়স্ক একজন মানুষের কাছে এমন সমর্পণ ভাবাই যায় না।
'মাত্র তিন দিনের তংকে বেটির বাড়িত গিছুনু হামি, আর তার মধ্যেই এত সব কাণ্ড কইরে বসি আছেন তুমরা!' গোঁসাই তার মাথায় হাত বুলাতে লাগল।
একটু সময় পরে খানিকটা শান্ত হয়ে অভয়পদ বলল, 'তোমার পায়ের ধুলা দেন গোঁসাই, নালে দেহমন কেছুই শান্ত হবে না।'
এভাবেই কি অভয়পদ কিংবা আমরা, জীবনের পরম আশ্রয়ের কাছে ফিরতে চাই? 'আমরা দেখেছি যারা জীবনের এইসব নিভৃত কুহক'!
গল্পের কথক এখানে, অভয়পদর জটিল মনস্তাত্বিক অবস্থার সমর্থনে আমাদেরকে একটি বিশেষ ঘটনা মনে পড়িয়ে দেন, এভাবে-
'প্রথমে হাসি পেলেও আমার মনে পড়ল এরকম কথা আমি গল্পে পড়েছিলাম। যুদ্ধের হাসপাতালে কাটা পা চুলকোচ্ছিল আহত সৈনিকের। শেষ পর্যন্ত মর্গের ডাঁই করে রাখা মৃত মানুষ এবং ব্যবছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভিতর থেকে নির্দিষ্ট পা খানা খুঁজে বের করে চুলকে দিলে সৈনিকটি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। অল্প বয়সে এই গল্প পড়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিল যুদ্ধের আজগুবি গল্প আরেকটা।'
কাটা পায়ের অনুষঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যায় আরও একজন প্রিয় লেখকের নাম। তিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। ১৯৯৫ সালে তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর থেকে তিনি পায়ে ব্যথা অনুভব করতে থাকেন। চিকিৎসকরা প্রথমে বাতের ব্যথা মনে করে চিকিৎসা শুরু করেন। কিন্তু তার পায়ের হাড়ে ক্যান্সার হয়ে ছিল! পরের বছরের মার্চে ডাক্তাররা ইলিয়াসের ডান পা সম্পূর্ণ কেটে ফেলেন। সেই কাটা পায়ে তিনি ব্যথা অনুভব করতেন, চুলকানি অনুভব করতেন আর চুলকাতে গিয়ে দেখতেন... ওখানে পা নেই। পুরান ঢাকা থেকে আরম্ভ করে যমুনার চর, সাতক্ষীরা, বরিশাল, পঞ্চগড়, তেঁতুলিয়া'র ধুলিলাগা পা, নেই! অসীম শূন্যতা সেখানে।
এই গল্পটির উদ্দেশ্য কি জীবনের সঙ্গে জীবনের বন্ধন রচনা? গল্পের গোঁসাই কি সেই বন্ধনের প্রতীক? আমাদের কি মনে একবারও মনে পড়েছে কুরোশাওয়ার রশোমন ছবিটির কোনও অনুষঙ্গ? কাউকে না কাউকে বিশ্বাস করবার দর্শনটিকে? আমি জানি না, অভিজিৎ সেনের গল্পটি পড়তে পড়তে কোনও পাঠকের 'নো ম্যান্স ল্যান্ড' ছবিটির কথা মনে পড়বে কিনা। একটি ভয়ানক বাউন্সিং মাইনের উপর শুয়ে থাকা এক আহত সৈনিকের অসহায়ত্বের কথা মনে পড়বে কিনা! 'যুদ্ধের হাসপাতালে কাটা পা চুলকোচ্ছিল আহত সৈনিকের। শেষ পর্যন্ত মর্গের ডাঁই করে রাখা মৃত মানুষ এবং ব্যবছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভিতর থেকে নির্দিষ্ট পা খানা খুঁজে বের করে চুলকে দিলে সৈনিকটি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে'- এই গল্পটি পড়ে, আমরা বুঝতে পারি- মানবমনের গভীর গোপনে লুকিয়ে থাকা যুদ্ধের বিভীষিকা, যা যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, মানুষের মনে থেকে যায়, চিরস্থায়ী হয়ে।
পাঠক, শিল্পের সংবেদনকে এবার রক্তে অনুভব করুন। অভিজিৎ সেনের এই আশ্চর্য গল্পটি পড়ে, নিজের মত একটি ভাবনা তৈরি করুন। তারপর, দেখবেন, নিজের অজান্তেই বারে বারে ফিরে ফিরে পড়ছেন এই গল্পটি, আপনার পছন্দের লেখাগুলির কাছে যেভাবে ফিরে যান।
...
মানুষের বুকের
মাঝে যে নির্জনতা থাকে ...
ট্রেনে ওয়াটারলু যেতে যেতে পড়ছিলাম অভিজিৎ সেনের গল্পের বই 'দেবাংশী ও অন্যান্য গল্প'। এই বইয়ের গল্প 'ব্যথার জগত'! আমাদের বুকের ভিতর যে নির্জনতা, যে বিপন্নতা থাকে- এ যেন সেই গল্প! লেখকের ভাষায়, 'পশ্চিমবঙ্গের অনেকগুলো জেলা আমি শুধু পরিদর্শন করিনি, রীতিমতো সেখানকার গ্রাম শহরের মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত মিশে বসবাসও করেছি দীর্ঘকাল ধরে।'
অভিজিৎ সেনকে নমস্কার|
অভিজিৎ সেনের ব্যথার জগৎ গল্পটির পড়ুন : লিঙ্ক
এমদাদ রহমান
আমরা যারা অভিজিৎ সেনের ব্যথার জগৎ গল্পটি পড়ব কিংবা পড়েছি, তারা আসলে কী খুঁজব, কী খুঁজে পাব, এই গল্পের শেষে? এই প্রশ্নের উত্তর তো কিছুদিন আগে, গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেসকে নিয়ে পাঠ-অভিজ্ঞতামূলক একটি লেখায় আমাদের বাংলা ভাষার, সাহিত্যের উচ্চতম মাইলফলক দেবেশ রায় বলে দিয়েছেন।
আমাদের প্রচণ্ড আগ্রহের এই লেখক, কি বলেছিলেন; শুধু লাতিন নয়, সমগ্র বিশ্বের কাছে সমাদৃত গারসিয়া মার্কেসের মৃত্যুর কিছুদিন পর, তাঁকেই স্মরণ করে, আসুন তবে পড়ে ফেলা যাক, কথাগুলি-
'গল্প কী, উপন্যাস কী, কল্পনা কী, অভিজ্ঞতা কী-- এসব প্রশ্নের কোনও এক নিষ্পত্তি না- করে গল্প-উপন্যাস লেখা যায় না। যিনি গল্প-উপন্যাস লেখেন তাঁকে তাঁর সময়টাকেই জানতে হয়। আর, তাঁর জানার একমাত্র উপায় তাঁর সময় তাঁর কাছে কোন গল্পের আকারে আসছে। এমনটা নয়, কখনওই নয়, যে, সময়ের একটা আকার দেওয়ার জন্য তিনি একটা যোগ্য ও যথাযথ গল্প তৈরি করেন। গল্পটাই তাঁর সময়ের আকার হয়ে আসে। একজন কবির কাছে তাঁর সময়ের আকার হয়ে আসে একটি বা কয়েকটি চরণ বা একটি ও একটিমাত্র উপমা। উস্তাদ হাফিজ আলির কাছে তাঁর সময়ের আকার হয়ে আসে দরবারি কানাড়ার কোমল গান্ধার।
কোনও শিল্প-ই আরোহী বা অবরোহী পদ্ধতিতে নিষ্কাশিত হয় না। শিল্প একটা আকার নিয়ে জন্মায়। সেই আকারটিকে স্পষ্ট করে তুলতেই গল্প লেখা, কবিতা রচনা, ভাস্কর্যে শূন্যতাকে ধরা, দরবারি কানাড়ায় কোমল গান্ধার লাগানো।'
অভিজিৎ সেন তাঁর ব্যথার জগৎ গল্পে আমাদের কি বলতে চাইলেন? আমরা কি এই প্রশ্নের কোনও প্রচ্ছন্ন উত্তর কিংবা সরাসরি কোনও ইঙ্গিত কি পেয়ে গেছি দেবেশ রায়ের কথাগুলি থেকে? হ্যাঁ, এই কথা আমরা তো মেনেই নিয়েছি যে শিল্প একটা আকার নিয়ে জন্মায়। সেই আকারের একটি বিশেষ প্রকাশ এই গল্পটি। লেখক, অভিজিৎ রায়, এখানে যেন আমাদের মনের ভিতর একটি কাটা পায়ের মায়া জাগিয়ে তাঁর কিংবা আমাদের যাপিত জীবনের ক্ষতটিকে দেখিয়ে দিলেন। বেশি কিছু বললেন না তিনি। শুধু কিছু ইঙ্গিত দিলেন।
মারাত্মক দুর্ঘটনায় সম্পূর্ণ একটা পা কাটা গেল অভয়পদ নামের একজন খুব সাধারণ মানুষের। তার জীবন এখানে অচল হয়ে পড়ল। জীবনের শক্তিটুকু যেন হাসপাতালের সারজিক্যাল ওয়ার্ড তার কাছ থেকে কেড়ে নিল।
সাহিত্য তার পাঠকের সংবেদনের দরজায় কড়া নাড়ে। ব্যথার জগৎ গল্পের অভয়পদর পা হারানোর যন্ত্রণা পাঠকের মনের ভিতর, মগজের ভিতর গেঁথে যায়।
এই গল্পে একজন কথক আছেন। হয়ত স্বয়ং লেখকই সেই চরিত্র। তিনি উত্তম পুরুষে আমাদের কাছে খুব ধীরে ধীরে, কিছু ব্যাপার বলতে থাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি এই গল্পের মুখ্য চরিত্র থাকেন না। কিন্তু এখানে সূত্রধর। গল্প এগিয়ে নিয়ে যান। পাঠকের কাছে আসল কথাটি তিনিই বলেন। তিনি এমনভাবে বলেন, দেবেশ রায়ের ভাষায় এভাবে বলা যায়-
'বড় চেনা প্রাচীন, বড় অনুভবের বর্তমান।'
ব্যথার জগৎ-এ কথকের বলা শুরু হয় এভাবে--
'বাইরে প্রবল বৃষ্টিপাত হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে। জেলা হাসপাতালের লম্বা ঘরখানার দু-পাশের দেয়াল জুড়ে শয্যা পাতা। পশ্চিমের দেয়ালে বড়ো বড়ো জানালা। ওয়ার্ডের সব শয্যাতেই রোগী আছে। শয্যা ছাড়াও মেঝেতেও বেশ কয়েকজন রোগীকে রাখা হয়েছে।'
এই যে প্রথম কথাটি, 'বাইরে প্রবল বৃষ্টিপাত হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে', আমাদের কীভাবে জানি আচ্ছন্ন করে ফেলে। একটা মানুষ হাসপাতালের বেডে শুয়ে বৃষ্টির কথা বলছে! আমাদের অবচেতনে হয়ত আরও একটি গল্পের মুখ উঁকি দিয়ে যায়। সেই গল্পটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের। গল্পের নাম নিরুদ্দেশ যাত্রা। সেই গল্পটি শুরু হয়েছিল এমন কিছু কথা দিয়ে-
'এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। রাত এগারোটা পার হয় হয়, এখনো রাস্তার রিকশা চলছে ছল ছল করে যেনো গোটিয়ার বিলে কেউ নৌকা বাইছে, 'তাড়াতাড়ি করো বাহে, ঢাকার গাড়ি বুঝি ছাড়ি যায়।' আমার জানালায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারের ভিজে গন্ধভরা সারি, বিষাদবর্ণ দেওয়াল; অনেকদিন পর আমার ভারি ভালো লাগছে। ছমছম করা এই রাত্রি, আমারি জন্যে তৈরি এরকম লোনলী-লগ্ন আমি কতোদিন পাইনি, কতোকাল, কোনোদিন নয়।'
হ্যাঁ, এভাবেও শিল্প তাঁর পাঠকের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করে- আমাদের নিজেদের নিরুদ্দেশ যাত্রার সঙ্গে, আমাদের নিজস্ব ব্যথার জগতের সঙ্গে। কিন্তু কোন সে জগৎ? আমাদের অন্তর্গত রক্তে খেলা করে যে জগৎ? যেমন, জীবনানন্দ আমাদের অবিরাম বলতে থাকেন-
'অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত - ক্লান্ত করে;
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের 'পরে।'
আর, অভিজিৎ সেন আমাদের সংবেদনে আরও কিছু কথা জুড়ে দেন তাঁর এই গল্পে-
'হাসপাতালের সারজিক্যাল ওয়ার্ড ব্যথার জগৎ, ব্যথা নিবৃত্তির জগৎও। ব্যথার উপলব্ধি, অভিব্যক্তি এবং ব্যথাকে গ্রহণ করার শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা এক এক জন মানুষের এক এক রকম। কালকের রাত্রে আসা লোকটি যে ব্যথা সহ্য করার পরীক্ষায় প্রথম দিকে থাকবে, এ ব্যাপারটা আমি পরে বুঝেছিলাম। আমি নিজেও যে যথেষ্ট সহ্যশক্তির অধিকারী এ উপলব্ধিও এই দুর্ঘটনার শিকার না হলে আমার ধারণায় আসত না। হাসপাতালে এই ন-দিন অবস্থানে ব্যথার শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া কত রকম হতে পারে তা বোঝার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমার মনে হয়েছে ব্যথা এবং ব্যথাহীনতার মধ্যে তৃতীয় আর একটি স্তর আছে। কী অভিধা নির্দিষ্ট করা যায় তার জন্য? তিতিক্ষা? নিতান্তই সাধারণ শব্দ সহ্যশক্তি? কিংবা কৃচ্ছ্রব্রত? ব্যথাকে ঐশ্বরিক অভিপ্রায় হিসাবে মেনে নেয় এমন লোকও তো আছে। পছন্দ মতো শব্দ খুঁজে পেলাম না।'
অবশ্য, তখন আমরা হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা অভয়পদর সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছি। আমাদের মনোজগৎ আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। ব্যথায় আমরাও আক্রান্ত হচ্ছি। কিন্তু, কী সেই অমোঘ কথা, যা এই গল্প দিয়ে বোঝাতে বা বলতে চাইলেন, কথাসাহিত্যিক অভিজিৎ সেন? অভয়পদ কি এখানে প্রতীক? প্রতীক হলে কীসের প্রতীক এই মানুষটি? আমাদের বিপন্নতার? আমাদের একাকীত্বের?
অপারেশন থিয়েটারে একটা পা রেখে অভয়পদ বেডে আসল। গল্পের কারবার, মানে যাকে আমরা শিল্পের অভিঘাত বলি, তা শুরু হয়। আমাদের মনে হতে থাকে, অভয়পদর নয়, আমাদেরই বুঝি পুরো একটা পা কেটে ফেলা হয়েছে! কিন্তু, অভয়পদ পা হারিয়ে কিরকম বিপন্ন হয়ে পড়ে, আমরা কি তা টের পাই? সে আকুল হয়ে বলতে থাকে- 'হামার পাওখান নিয়া ডাক্তারবাবুরা কী কইরবে?'
'পাওখানার সৎকাজ হবে না! জ্যান্ত মানুষের পাওখান শিয়াল কুকুরে টানাটানি কইরে খাবে! হা গোঁসাই!'
অভয়পদ যেন নিজেকে দেখতে পাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছে তার শরীরের একটা অংশ মরে গেছে, তারই সামনে শিয়ালে কুকুরে টানাটানি করে খাচ্ছে তারই পরম নির্ভরতার আধখানা শরীর!
কিন্তু, গল্প আমাদের মনকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। আমরা অন্য আরেক ব্যথার জগতে প্রবেশ করি। অভয়পদ তখন অনুভব করতে শুরু করেছে, পা-হীনতার যন্ত্রণা। একটা অব্যক্ত শূন্যতার বোধ তার মনে। পাখির অসহায় ডানা ঝাপটানো যেন! নার্স রোজমেরিকে অভয়পদ বলছে-
'ডাক্তার বাবুরা কি পাওখান কাইটে বাদ দিয়েছে, দিদি?'
'হ্যাঁ, সে তো আপনাকে বলাই হয়েছিল।'
'না, তাই বলি। অ্যানা জল দিবেন না, দিদি?'
'না, জল খেলে বমি হবে। কষ্ট বেশি হবে।'
পাওখানায় যে বড়ো ব্যথা হচ্ছে, দিদি?'
'ও তো একটু হবে। অপারেশন হয়েছে তো।'
'না-না, তা কছি না। পাওয়ের গোছে, গোড়ালিতে--'
'ও ঠিক হয়ে যাবে, ঘুমোন আপনি।'
তারপর অভয়পদর প্রাণের আশ্রয় গোঁসাই আসেন, হাসপাতালে। তাকে পেয়ে অভয়পদ শিশুর মত নিজেকে যেন সমর্পণ করতে চায়-
'কাক ও ক'বার পারি না, কেও বিশ্বাস কইরবে না। এই যে পাওখান নাই, গোঁসাই, ওই পাওখান কিন্তু আছে, ওই পাওয়ে জব্বের বেথা, গোঁসাই। হাঁটু থিকা পাওয়ের পাতা তক মরণ বেথা গোঁসাই!'
আবার ফিরতে ইচ্ছা করছে দেবেশ রায়ের কাছে। তিনি দুটি উপন্যাস নিয়ে কথা বলছেন। একটি 'কপালকুণ্ডলা', অন্যটি 'অন্তর্জলী যাত্রা'। তিনি আমাদের বলছেন,-
এই দু'টো উপন্যাসেই প্রত্যেকটি মানুষ প্রত্যেকের সঙ্গে বাঁধা, কিন্তু প্রত্যেকের কাছেই সেটা বন্ধন। প্রত্যেকেই সে-বন্ধন থেকে মুক্তি চাইছে অথচ বন্ধন এড়াতে পারছে না।'
দেবেশ এখানে মার্কেসের 'প্রেম ও অন্যান্য দানব' নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বাংলা ভাষার দুই স্তম্ভ, এই দুটি উপন্যাসের উল্লেখ করছেন, আর আমরা সেই ভাবটিকে অভিজিৎ সেনের গল্পের ভাবের সঙ্গে মিলিয়ে দিচ্ছি! এ এক আশ্চর্য খেলা মহাশয়। ব্যথার জগৎ গল্পের গোঁসাই যেন সেই মানুষ, যে মানুষের সঙ্গে আমরা সবাই সম্পর্কিত থাকি জীবনের প্রতিটি স্তরে। আমরা গল্পে পড়েছি-
'গোঁসাইকে দেখে অভয়পদ একেবারে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। বয়স্ক পুরুষ মানুষের এমন নির্ভরতা আমি আগে কখনও দেখিনি।
'গোঁসাই কুনঠে গেছিলেন তুমি? হামি এঠে মইরে যাচ্ছি--'
বেডের পাশে গিয়ে ঝুঁকে অভয়পদর মাথাটা দু-হাতের মধ্যে ধরে রাখল গোঁসাই। এ ক-দিনের মধ্যে অভয়পদকে আমি একবারও এমন অধৈর্য কিংবা দিশেহারা হতে দেখিনি। প্রায় সমবয়স্ক একজন মানুষের কাছে এমন সমর্পণ ভাবাই যায় না।
'মাত্র তিন দিনের তংকে বেটির বাড়িত গিছুনু হামি, আর তার মধ্যেই এত সব কাণ্ড কইরে বসি আছেন তুমরা!' গোঁসাই তার মাথায় হাত বুলাতে লাগল।
একটু সময় পরে খানিকটা শান্ত হয়ে অভয়পদ বলল, 'তোমার পায়ের ধুলা দেন গোঁসাই, নালে দেহমন কেছুই শান্ত হবে না।'
এভাবেই কি অভয়পদ কিংবা আমরা, জীবনের পরম আশ্রয়ের কাছে ফিরতে চাই? 'আমরা দেখেছি যারা জীবনের এইসব নিভৃত কুহক'!
গল্পের কথক এখানে, অভয়পদর জটিল মনস্তাত্বিক অবস্থার সমর্থনে আমাদেরকে একটি বিশেষ ঘটনা মনে পড়িয়ে দেন, এভাবে-
'প্রথমে হাসি পেলেও আমার মনে পড়ল এরকম কথা আমি গল্পে পড়েছিলাম। যুদ্ধের হাসপাতালে কাটা পা চুলকোচ্ছিল আহত সৈনিকের। শেষ পর্যন্ত মর্গের ডাঁই করে রাখা মৃত মানুষ এবং ব্যবছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভিতর থেকে নির্দিষ্ট পা খানা খুঁজে বের করে চুলকে দিলে সৈনিকটি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। অল্প বয়সে এই গল্প পড়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিল যুদ্ধের আজগুবি গল্প আরেকটা।'
কাটা পায়ের অনুষঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যায় আরও একজন প্রিয় লেখকের নাম। তিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। ১৯৯৫ সালে তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর থেকে তিনি পায়ে ব্যথা অনুভব করতে থাকেন। চিকিৎসকরা প্রথমে বাতের ব্যথা মনে করে চিকিৎসা শুরু করেন। কিন্তু তার পায়ের হাড়ে ক্যান্সার হয়ে ছিল! পরের বছরের মার্চে ডাক্তাররা ইলিয়াসের ডান পা সম্পূর্ণ কেটে ফেলেন। সেই কাটা পায়ে তিনি ব্যথা অনুভব করতেন, চুলকানি অনুভব করতেন আর চুলকাতে গিয়ে দেখতেন... ওখানে পা নেই। পুরান ঢাকা থেকে আরম্ভ করে যমুনার চর, সাতক্ষীরা, বরিশাল, পঞ্চগড়, তেঁতুলিয়া'র ধুলিলাগা পা, নেই! অসীম শূন্যতা সেখানে।
এই গল্পটির উদ্দেশ্য কি জীবনের সঙ্গে জীবনের বন্ধন রচনা? গল্পের গোঁসাই কি সেই বন্ধনের প্রতীক? আমাদের কি মনে একবারও মনে পড়েছে কুরোশাওয়ার রশোমন ছবিটির কোনও অনুষঙ্গ? কাউকে না কাউকে বিশ্বাস করবার দর্শনটিকে? আমি জানি না, অভিজিৎ সেনের গল্পটি পড়তে পড়তে কোনও পাঠকের 'নো ম্যান্স ল্যান্ড' ছবিটির কথা মনে পড়বে কিনা। একটি ভয়ানক বাউন্সিং মাইনের উপর শুয়ে থাকা এক আহত সৈনিকের অসহায়ত্বের কথা মনে পড়বে কিনা! 'যুদ্ধের হাসপাতালে কাটা পা চুলকোচ্ছিল আহত সৈনিকের। শেষ পর্যন্ত মর্গের ডাঁই করে রাখা মৃত মানুষ এবং ব্যবছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভিতর থেকে নির্দিষ্ট পা খানা খুঁজে বের করে চুলকে দিলে সৈনিকটি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে'- এই গল্পটি পড়ে, আমরা বুঝতে পারি- মানবমনের গভীর গোপনে লুকিয়ে থাকা যুদ্ধের বিভীষিকা, যা যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, মানুষের মনে থেকে যায়, চিরস্থায়ী হয়ে।
পাঠক, শিল্পের সংবেদনকে এবার রক্তে অনুভব করুন। অভিজিৎ সেনের এই আশ্চর্য গল্পটি পড়ে, নিজের মত একটি ভাবনা তৈরি করুন। তারপর, দেখবেন, নিজের অজান্তেই বারে বারে ফিরে ফিরে পড়ছেন এই গল্পটি, আপনার পছন্দের লেখাগুলির কাছে যেভাবে ফিরে যান।
...
মানুষের বুকের
মাঝে যে নির্জনতা থাকে ...
ট্রেনে ওয়াটারলু যেতে যেতে পড়ছিলাম অভিজিৎ সেনের গল্পের বই 'দেবাংশী ও অন্যান্য গল্প'। এই বইয়ের গল্প 'ব্যথার জগত'! আমাদের বুকের ভিতর যে নির্জনতা, যে বিপন্নতা থাকে- এ যেন সেই গল্প! লেখকের ভাষায়, 'পশ্চিমবঙ্গের অনেকগুলো জেলা আমি শুধু পরিদর্শন করিনি, রীতিমতো সেখানকার গ্রাম শহরের মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত মিশে বসবাসও করেছি দীর্ঘকাল ধরে।'
অভিজিৎ সেনকে নমস্কার|
অভিজিৎ সেনের ব্যথার জগৎ গল্পটির পড়ুন : লিঙ্ক
0 মন্তব্যসমূহ