সাক্ষাৎকার গ্রহণ : অলাত এহ্সান
[ফজল হাসান গল্পকার, ছড়াকার এবং অনুবাদক। মধ্যসত্তরে দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় গল্প দিয়ে লেখালেখির শুরু। ঢাকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাহিত্য পাতায়, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে তার মৌলিক এবং অনুবাদ গল্প।
এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে দুটি গল্পের সংকলন, ‘চন্দ্রপুকুর’ (২০০৮) ও ‘কতোটা পথ পেরোলে তবে’ (২০১০)। এছাড়া, তার অনুবাদে 'আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প' (২০১৩), নির্বাচিত নোবেল বিজয়ীদের সেরা গল্প(২০১৩), ইরানের শ্রেষ্ঠ গল্প(২০১৪) ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। এ বছর বেরিয়েছে 'চীনের শ্রেষ্ঠ গল্প' ও 'নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প'। একজন অনুবাদক হিসাবে, তার কাছে আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা ছিল। এখানে সেইসব জিজ্ঞাসার জবাবে ফজল হাসানের কথাগুলি ছাপা হল। ]
অলাত এহ্সান : অনুবাদ তো একটা পরিণত কাজ। আপনার কাছে অনুবাদক হয়ে ওঠার প্রস্তুতি কী রকম?
ফজল হাসান :
আমার অনুবাদক হওয়ার প্রস্তুতি ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ঘটা করে হয়নি, কিংবা কোনো ঝলমলে অনুষ্ঠানে লাল ফিতে কেটে জানান দেওয়া হয়নি। বলা যায়, অনেকটা চুপিচুপি এবং অলক্ষ্যেই। তবে আমার কছে অনুবাদক হয়ে ওঠার পেছনে গল্প আছে।
একসময় আমি প্রচুর ছোটগল্প এবং ছড়া লিখেছি। সময়টা ছিল মধ্যসত্তর। তারপর আশির দশকের শুরুতে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জনের জন্য অষ্ট্রেলিয়ায় আসি এবং পরে ডিগ্রী নিয়ে স্বদেশে ফিরে যাই। ছয় মাস কোথাও চাকুরি না পেয়ে পুনরায় ‘পিতৃভূমি’ অষ্ট্রেলিয়ায় ফিরে আসি। নতুন চাকুরি জীবন শুরু, সংসারের মায়াজালে জড়িয়ে পড়া ও সন্তানদের দেখভাল করা–দেখতে দেখতে এই ফাঁকে অনেকগুলো বছর কেটে যায়। (এখানে বলে রাখা ভাল যে, অষ্ট্রেলিয়াকে আমি আমার পিতৃভূমি মনে করি। তার কারণ, এ দেশ আমাকে নাগরিকত্ব, একটা ভালো এবং সম্মানজনক চাকুরি, অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা এবং বাড়ি-গাড়ি করার অপূর্ব সুযোগ দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ আমার মাতৃভূমি। আমি সেই দেশে জন্ম নিয়েছি, আলো-হাওয়ায় শৈশব-কৈশোর এবং যৌবনের রঙিন দিনগুলো পার করেছি।) যাহোক, ২০০৭ সালের শুরুতে কোনো এক অলস সময়ে জিয়ল মাছের মতো আচমকা মনের স্নিগ্ধ সরোবরে লাফিয়ে ওঠে, ‘আমি তো লিখতে পারি। তবে লিখছি না কেন? নিদেন হলেও তো মনের কষ্টগুলো প্রকাশের মাধ্যমে পাঠকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে মনকে খানিকটা হালকা করতে পারি।’
যেই ভাবা, সেই কাজ। তখন থেকেই পুনরায় মৌলিক গল্প লেখা শুরু করি। বলতে পারেন, লেখার ভুবনে একধরনের পুনর্জন্ম। সেসময় আমার গল্পের অন্যতম মূল বিষয় ছিল বিদেশের নিশ্চিত জীবনযাপনের পরও মাতৃভূমির প্রতি প্রচণ্ড টান এবং পার্থিব জীবনে চাওয়া-পাওয়ার মাঝেও যে বুকের ভেতর বেড়ে ওঠা কষ্ট নামক অদৃশ্য পাখির গান। এই স্পর্শকাতর বিষয়কে কেন্দ্র করে ২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘চন্দ্রপুকুর’এবং ২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘কতটা পথ পেরোলে তবে’ গল্পগ্রন্থে গোটা কয়েক মৌলিক গল্প সন্নিবেশিত করেছি। যাহোক, একটা বিষয় না উল্লেখ করলেই নয়। যদিও তখন ঢাকার বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক এবং পাক্ষিক ম্যাগাজিনের কোনো সম্পাদক কিংবা সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে আমার চেনাশুনা বা পরিচয় ছিল না, তবুও অনেকে আমার লেখা মৌলিক গল্প নির্দ্বিধায় ছেপেছেন, যা আমাকে রীতিমতো উৎসাহিত করেছে। আমি প্রত্যেকের কাছে কৃতজ্ঞ। যাহোক, হয়তো প্রবাসে না থাকলে দেশপ্রেমের সঠিক সংজ্ঞা বুঝতাম না। প্রবাস জীবনের এই দেশপ্রেমই আমাকে পুনরায় সাহিত্য ভুবনে প্রবেশের জন্য উৎসাহিত করেছে।
হঠাৎ একসময় মৌলিক লেখালেখিতে খানিকটা ভাটা পড়ে। সেই বন্ধ্যা সময় কাটিয়ে ওঠার জন্য আমি বিদেশি সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হই। কেন জানি তখন আফগান এবং ইরানের সাহিত্য আমাকে প্রবল ভাবে কাছে টেনেছে। আফগানিস্তানের সাহিত্যের ইতিহাস এবং বেশ অনেকগুলো গল্প পড়ার পর আমার মনে হল যে, এসব ভাল গল্প তো আমি বাংলা ভাষাভাষি পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করতে পারি। তখনই সুড়সুড় করে ঢুকে গেলাম অনুবাদের জগতে। ঢাকার বিভিন্ন দৈনিকের সাহিত্য বিভাগে, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও অনলাইন ম্যাগাজিনে গল্পগুলো বেশ সাদরেই প্রকাশিত হতে থাকে। আমি রীতিমতো উৎসাহিত হই।
এখানে একটা ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। ২০০১ সালের মার্চে আফগানিস্তানের বামিয়ান পাহাড়ে তালেবানদের হাতে তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংস হওয়ার পর তালেবানদের মানসিক অবস্থার কথা ‘বিচূর্ণ মূর্তির ধুলিকণা’ (পরবর্তীতে ২০১৩ সালে আমার অনুবাদে ‘ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ’ থেকে প্রকাশিত ‘আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প’ সংকলনে সন্নিবেশি) গল্পটিতে তুলে ধরা হয়েছে। ঘটনার পরপরই লেখক জালমে বাবকোহি গল্পটি লিখে পাঠকমহলে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেন। যাহোক, গল্পটা আমি অনুবাদ করে সরাসরি ‘সাপ্তাহিক’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক জনাব গোলাম মোর্তাজার কাছে (বলাবাহুল্য, তার সঙ্গে আমার কোনো জানাশুনা ছিল না, কিংবা কখনই সরাসরি দেখা-সাক্ষাত হয়নি) ইমেইলে পাঠিয়ে দিই। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফিরতি ইমেইলে জানালেন, ‘আমরা গল্প ছাপাই না। তবে যেহেতু এটা ভিন্ন একটা গল্প, তাই আমি পরে দেখে জানাবো ।’ অবশ্য তিনি এক সপ্তাহের মধ্যেই লিখলেন, ‘আমরা লেখাটি ছাপবো ।’ তিনি সেই সপ্তাহেই ‘সাপ্তাহিক’-এ (১৭ মে ২০১২) গল্পটি ছেপেছেন। সত্যি বলতে কি, আমার কাছে এই ঘটনা ছিল অনুবাদক হিসাবে আত্মপ্রকাশের জন্য একটা বিরাট ‘টার্নিং পয়েন্ট’। সেই থেকে অনুবাদ ভুবনে আমার পদচারণা শুরু। যাহোক, পরবর্তীতে তিনি সাধারণ এবং ঈদের বিশেষ সংখ্যায় আমার বেশ কয়েকটি আফগানিস্তান, ইরান এবং চীনের অনুবাদ গল্প পত্রস্থ করেছেন। পরে অনেক সাহিত্য সম্পাদক (এখানে সবার নাম উল্লেখ করলাম না। তবে তাদের সবাইকে বিভিন্ন গ্রন্থে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি) উৎসাহ দিয়েছেন, যা আমার কাছে পাথেয় ।
আমার অনুবাদক হওয়ার প্রস্তুতি ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ঘটা করে হয়নি, কিংবা কোনো ঝলমলে অনুষ্ঠানে লাল ফিতে কেটে জানান দেওয়া হয়নি। বলা যায়, অনেকটা চুপিচুপি এবং অলক্ষ্যেই। তবে আমার কছে অনুবাদক হয়ে ওঠার পেছনে গল্প আছে।
একসময় আমি প্রচুর ছোটগল্প এবং ছড়া লিখেছি। সময়টা ছিল মধ্যসত্তর। তারপর আশির দশকের শুরুতে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জনের জন্য অষ্ট্রেলিয়ায় আসি এবং পরে ডিগ্রী নিয়ে স্বদেশে ফিরে যাই। ছয় মাস কোথাও চাকুরি না পেয়ে পুনরায় ‘পিতৃভূমি’ অষ্ট্রেলিয়ায় ফিরে আসি। নতুন চাকুরি জীবন শুরু, সংসারের মায়াজালে জড়িয়ে পড়া ও সন্তানদের দেখভাল করা–দেখতে দেখতে এই ফাঁকে অনেকগুলো বছর কেটে যায়। (এখানে বলে রাখা ভাল যে, অষ্ট্রেলিয়াকে আমি আমার পিতৃভূমি মনে করি। তার কারণ, এ দেশ আমাকে নাগরিকত্ব, একটা ভালো এবং সম্মানজনক চাকুরি, অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা এবং বাড়ি-গাড়ি করার অপূর্ব সুযোগ দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ আমার মাতৃভূমি। আমি সেই দেশে জন্ম নিয়েছি, আলো-হাওয়ায় শৈশব-কৈশোর এবং যৌবনের রঙিন দিনগুলো পার করেছি।) যাহোক, ২০০৭ সালের শুরুতে কোনো এক অলস সময়ে জিয়ল মাছের মতো আচমকা মনের স্নিগ্ধ সরোবরে লাফিয়ে ওঠে, ‘আমি তো লিখতে পারি। তবে লিখছি না কেন? নিদেন হলেও তো মনের কষ্টগুলো প্রকাশের মাধ্যমে পাঠকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে মনকে খানিকটা হালকা করতে পারি।’
যেই ভাবা, সেই কাজ। তখন থেকেই পুনরায় মৌলিক গল্প লেখা শুরু করি। বলতে পারেন, লেখার ভুবনে একধরনের পুনর্জন্ম। সেসময় আমার গল্পের অন্যতম মূল বিষয় ছিল বিদেশের নিশ্চিত জীবনযাপনের পরও মাতৃভূমির প্রতি প্রচণ্ড টান এবং পার্থিব জীবনে চাওয়া-পাওয়ার মাঝেও যে বুকের ভেতর বেড়ে ওঠা কষ্ট নামক অদৃশ্য পাখির গান। এই স্পর্শকাতর বিষয়কে কেন্দ্র করে ২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘চন্দ্রপুকুর’এবং ২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘কতটা পথ পেরোলে তবে’ গল্পগ্রন্থে গোটা কয়েক মৌলিক গল্প সন্নিবেশিত করেছি। যাহোক, একটা বিষয় না উল্লেখ করলেই নয়। যদিও তখন ঢাকার বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক এবং পাক্ষিক ম্যাগাজিনের কোনো সম্পাদক কিংবা সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে আমার চেনাশুনা বা পরিচয় ছিল না, তবুও অনেকে আমার লেখা মৌলিক গল্প নির্দ্বিধায় ছেপেছেন, যা আমাকে রীতিমতো উৎসাহিত করেছে। আমি প্রত্যেকের কাছে কৃতজ্ঞ। যাহোক, হয়তো প্রবাসে না থাকলে দেশপ্রেমের সঠিক সংজ্ঞা বুঝতাম না। প্রবাস জীবনের এই দেশপ্রেমই আমাকে পুনরায় সাহিত্য ভুবনে প্রবেশের জন্য উৎসাহিত করেছে।
হঠাৎ একসময় মৌলিক লেখালেখিতে খানিকটা ভাটা পড়ে। সেই বন্ধ্যা সময় কাটিয়ে ওঠার জন্য আমি বিদেশি সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হই। কেন জানি তখন আফগান এবং ইরানের সাহিত্য আমাকে প্রবল ভাবে কাছে টেনেছে। আফগানিস্তানের সাহিত্যের ইতিহাস এবং বেশ অনেকগুলো গল্প পড়ার পর আমার মনে হল যে, এসব ভাল গল্প তো আমি বাংলা ভাষাভাষি পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করতে পারি। তখনই সুড়সুড় করে ঢুকে গেলাম অনুবাদের জগতে। ঢাকার বিভিন্ন দৈনিকের সাহিত্য বিভাগে, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও অনলাইন ম্যাগাজিনে গল্পগুলো বেশ সাদরেই প্রকাশিত হতে থাকে। আমি রীতিমতো উৎসাহিত হই।
এখানে একটা ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। ২০০১ সালের মার্চে আফগানিস্তানের বামিয়ান পাহাড়ে তালেবানদের হাতে তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংস হওয়ার পর তালেবানদের মানসিক অবস্থার কথা ‘বিচূর্ণ মূর্তির ধুলিকণা’ (পরবর্তীতে ২০১৩ সালে আমার অনুবাদে ‘ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ’ থেকে প্রকাশিত ‘আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প’ সংকলনে সন্নিবেশি) গল্পটিতে তুলে ধরা হয়েছে। ঘটনার পরপরই লেখক জালমে বাবকোহি গল্পটি লিখে পাঠকমহলে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেন। যাহোক, গল্পটা আমি অনুবাদ করে সরাসরি ‘সাপ্তাহিক’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক জনাব গোলাম মোর্তাজার কাছে (বলাবাহুল্য, তার সঙ্গে আমার কোনো জানাশুনা ছিল না, কিংবা কখনই সরাসরি দেখা-সাক্ষাত হয়নি) ইমেইলে পাঠিয়ে দিই। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফিরতি ইমেইলে জানালেন, ‘আমরা গল্প ছাপাই না। তবে যেহেতু এটা ভিন্ন একটা গল্প, তাই আমি পরে দেখে জানাবো ।’ অবশ্য তিনি এক সপ্তাহের মধ্যেই লিখলেন, ‘আমরা লেখাটি ছাপবো ।’ তিনি সেই সপ্তাহেই ‘সাপ্তাহিক’-এ (১৭ মে ২০১২) গল্পটি ছেপেছেন। সত্যি বলতে কি, আমার কাছে এই ঘটনা ছিল অনুবাদক হিসাবে আত্মপ্রকাশের জন্য একটা বিরাট ‘টার্নিং পয়েন্ট’। সেই থেকে অনুবাদ ভুবনে আমার পদচারণা শুরু। যাহোক, পরবর্তীতে তিনি সাধারণ এবং ঈদের বিশেষ সংখ্যায় আমার বেশ কয়েকটি আফগানিস্তান, ইরান এবং চীনের অনুবাদ গল্প পত্রস্থ করেছেন। পরে অনেক সাহিত্য সম্পাদক (এখানে সবার নাম উল্লেখ করলাম না। তবে তাদের সবাইকে বিভিন্ন গ্রন্থে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি) উৎসাহ দিয়েছেন, যা আমার কাছে পাথেয় ।
অলাত এহ্সান : অনুবাদ তো শুধু ভাষার পরিবর্তন নয়, ভাবের অনুবাদের ক্ষেত্রে ভাবের অনুবাদ তো একটা মৌলিক সমস্যা। আপনি এই সমস্যা দূর করতে কি করেন?
ফজল হাসান :
কোনো লেখা যদি সরাসরি মূল ভাষা থেকে অনুবাদ না হয়ে অন্য আরেক ভাষা থেকে অনুবাদ করা হয়, তাতে কিছু সমস্যা তো থাকবেই। এ বিষয়ে দু’টো সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার মতামত আছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, ইংরেজি ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা থেকে সরাসরি অনূদিত না হলে, অর্থাৎ অনুবাদ থেকে অনুবাদ হলে, শেষের অনুবাদে হয়তো কিছুটা খামতি দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে ভাবের। তবে বলা হয় যে, অনুবাদকের দুটো আলাদা ভাষার দক্ষতা অনেক সময় সেই খামতি পূরণ করতে পারে। অন্যদিকে ইংরেজিতে অনুবাদ সাহিত্যের জন্য বৃটেনের পেন ক্লাব পদক এবং বানিপাল ট্রাস্ট পুরস্কার প্রাপ্ত সমকালীন আধুনিক আরবী সাহিত্যের সেরা অনুবাদক হামফ্রে ডেভিসের মতে, সাহিত্যের অনুবাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যে ভাষায় অনুবাদ করা হচ্ছে, শুরুতেই সেই ভাষাভাষি পাঠকের কাছে পরিচিত একটা গল্প বলার স্টাইল খুঁজে বের করা। তিনি বলেছেন, এই স্টাইল হবে এমন যা মূল গল্প বলার স্টাইলের সঙ্গে ‘ম্যাচ’ করে, অর্থাৎ খাপ খায়। এটা একমাত্র সম্ভব, যখন কোনো অনুবাদক মূল গল্পের ব্যাকরণ ও ভাষার বাইরেও প্রতিটি শব্দ এবং বাক্যের ব্যবহারের বিষয়গুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছেন ।
প্রথমে আমি গল্পটি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ি এবং অনুবাদের যোগ্য কি না–সেটা যাচাই করি। কেননা উইলিয়াম রাদিচের ভাষায় বলতে হয়, সব গল্পই অনুবাদ করা যায় না। তিনি আরও বলেছেন, যেসব গল্প অনুবাদ যোগ্য এবং অনুবাদে মূল সৌন্দর্য্য হারাবে না, শুধু সেগুলোই অনুবাদ করা উচিত। আমি তার কথাগুলো মনে রেখে গল্প বাছাই করি।
কোনো লেখা যদি সরাসরি মূল ভাষা থেকে অনুবাদ না হয়ে অন্য আরেক ভাষা থেকে অনুবাদ করা হয়, তাতে কিছু সমস্যা তো থাকবেই। এ বিষয়ে দু’টো সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার মতামত আছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, ইংরেজি ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা থেকে সরাসরি অনূদিত না হলে, অর্থাৎ অনুবাদ থেকে অনুবাদ হলে, শেষের অনুবাদে হয়তো কিছুটা খামতি দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে ভাবের। তবে বলা হয় যে, অনুবাদকের দুটো আলাদা ভাষার দক্ষতা অনেক সময় সেই খামতি পূরণ করতে পারে। অন্যদিকে ইংরেজিতে অনুবাদ সাহিত্যের জন্য বৃটেনের পেন ক্লাব পদক এবং বানিপাল ট্রাস্ট পুরস্কার প্রাপ্ত সমকালীন আধুনিক আরবী সাহিত্যের সেরা অনুবাদক হামফ্রে ডেভিসের মতে, সাহিত্যের অনুবাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যে ভাষায় অনুবাদ করা হচ্ছে, শুরুতেই সেই ভাষাভাষি পাঠকের কাছে পরিচিত একটা গল্প বলার স্টাইল খুঁজে বের করা। তিনি বলেছেন, এই স্টাইল হবে এমন যা মূল গল্প বলার স্টাইলের সঙ্গে ‘ম্যাচ’ করে, অর্থাৎ খাপ খায়। এটা একমাত্র সম্ভব, যখন কোনো অনুবাদক মূল গল্পের ব্যাকরণ ও ভাষার বাইরেও প্রতিটি শব্দ এবং বাক্যের ব্যবহারের বিষয়গুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছেন ।
প্রথমে আমি গল্পটি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ি এবং অনুবাদের যোগ্য কি না–সেটা যাচাই করি। কেননা উইলিয়াম রাদিচের ভাষায় বলতে হয়, সব গল্পই অনুবাদ করা যায় না। তিনি আরও বলেছেন, যেসব গল্প অনুবাদ যোগ্য এবং অনুবাদে মূল সৌন্দর্য্য হারাবে না, শুধু সেগুলোই অনুবাদ করা উচিত। আমি তার কথাগুলো মনে রেখে গল্প বাছাই করি।
অলাত এহ্সান : লেখার সঙ্গে, বিশেষত সাহিত্যের সঙ্গে দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি-মিথ ইত্যাদি গভীর ভাবে যুক্ত। সেক্ষেত্রে অনুবাদের জন্য লেখকের দেশ-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা খুবই জরুরি।
ফজল হাসান : অবশ্যই অনুবাদের জন্য লেখকের দেশ-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা খুবই জরুরি। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আমি যখন সিদ্ধান্ত নিই যে চীনের গল্প অনুবাদ করবো, তখন আমি চীনের সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাস, বিশেষ করে উৎস থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত, বিভিন্ন রাজতন্ত্রের কাহিনী, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সর্বোপরি গল্প লেখকের জীবন সম্পর্কে, তার লেখার ধরন বা স্টাইল এবং কোন ‘টোন’-এ সাধারণত তিনি লেখেন, এসব বিষয়ে প্রচুর পড়াশুনা করেছি। ‘চীনের শ্রেষ্ঠ গল্প’ বইয়ের সুদীর্ঘ ভূমিকা পড়লেই তা বোঝা যাবে। এছাড়া আফগানিস্তান এবং ইরানের গল্প অনুবাদ করার সময়ও আমি সেসব দেশ ও শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রচুর পড়াশুনা করেছি, যা গল্প অনুবাদ করার সময় ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল ।
অলাত এহ্সান : অনুবাদের দক্ষতা অর্জনের জন্য কোনো একটা দেশ বা মহাদেশ এবং ভাষাকেই বেছে নেয়া উত্তম। তাই না?
ফজল হাসান : সবিনয়ে জানাচ্ছি যে, আপনার এই প্রশ্নের সঙ্গে আমি সহমত প্রকাশ করতে পারছি না। আপনি হয়তো জানেন, আমি বাংলা এবং ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানি না। তাই বলে কি আমি বিশ্বের যে কোনো ভালো সাহিত্যকর্মকে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে বাংলা ভাষাভাষিদের জন্য প্রকাশ করতে পারবো না? আমি মনে করি, অবশ্যই পারবো। আমর দৃঢ় বিশ্বাস, ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করার জন্য বাংলা এবং ইংরেজী ভাষায় আমার যথেষ্ঠ দখল আছে। এছাড়া অনুবাদক, লেখক এবং পাঠকরা যে যত পড়বে, সে তত বেশি জানবে এবং শিখবে। তাই এক দেশ কিংবা এক ভাষার মধ্যে অনুবাদকের সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয় ।
অলাত এহ্সান : একজন লেখক তো লেখায় মেজাজ-মর্জি-ছন্দ-গতি দিয়ে লেখেন। অনুবাদেও সেই মেজাজ-ছন্দের জন্য সেই লেখকের ওপর প্রস্তুতি দরকার। এজন্য একজন লেখককে নির্বাচন করাই ঠিক, নয় কি?
ফজল হাসান : এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়, যে কোনো লেখকের লেখার মধ্যে তার নিজস্ব মেজাজ-মর্জি ও ছন্দ-গতি থাকবেই। তবে অনুবাদ করার জন্য সবসময় যে একজন লেখককে নির্বাচন করতে হবে, এটা কোনো ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ নয়। অনুবাদকের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা এবং ভালো পাঠ ও বোঝার ক্ষমতা থাকলে যে কোনও ভাল লেখকের লেখা অনুবাদ করা যেতে পারে। যেমন ধরুন, ইতিমধ্যে আমি আফগানিস্তান, ইরান এবং চীনের গল্প সহ নোবেল বিজয়ী ও ম্যানবুকার বিজয়ী লেখকদের ছোটগল্প অনুবাদ করেছি। তবে নোবেল বিজয়ী ও ম্যানবুকার বিজয়ী লেখকরা এক দেশ কিংবা এক ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নন। যখন কোনো গল্প অনুবাদ করার জন্য আমি চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই, তখন সেই লেখক ও তার লেখার ধরন এবং দেশ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারনা নিই। তাতে আমার অনুবাদ কাজ সহজ হয় ।
অলাত এহ্সান : একজন অনুবাদকের তৃপ্তি কোথায়, একটি অনুবাদ করায়, না একটি ভাষা-দেশ-সংস্কৃতি-লেখক সম্পর্কে গভীরভাবে জানায়?
ফজল হাসান : অনেকের মতো আমিও দুটো কাজেই অনুবাদকের তৃপ্তি মনে করি। তবে আমি আরো মনে করি যে, পাঠকরা যখন কোনো অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ হয় এবং অনুবাদক যদি পাঠকের মনে আরও পড়ার স্পৃহা জাগাতে পারে, তাহলেও একজন অনুবাদক তার অনুবাদ কর্মে তৃপ্তি লাভে সক্ষম হবে ।
অলাত এহ্সান : প্রায়ই শোনা যায়, অনুবাদ কোনো সাহিত্য নয়। অনুবাদকে সাহিত্য হয়ে ওঠায় অন্তরায়টা কোথায়? অনুবাদ কি ভাবে সাহিত্য হয়ে ওঠতে পারে?
ফজল হাসান :
অবশ্যই অনুবাদ এক ‘বিশেষ’ ধরনের সাহিত্য এবং সৃষ্টিশীল লেখা। আমরা জানি (স্বীকার করি, বা না-করি), যে-কোনও দেশের সাহিত্যের দু’টো ধারা বহমান-- একটি মৌলিক এবং অন্যটি অনুবাদ। তাই অনুবাদ কোনো সাহিত্য নয়--যারা মনে করেন, কিংবা বলেন, তাদের মন সংকীর্ণ, তারা উন্নাসিক এবং হীনমন্যতায় ভোগেন। কথায় বলে, সমালোচক তারাই, যারা নিজেরা কিছুই লিখতে পারেন না, শুধু অন্যের সমালোচনা করেন। তবে অনুবাদ সাহিত্য হয়ে ওঠার জন্য অনুবাদকে আন্তরিক হতে হবে এবং যারা মূল্যায়ন করবে, তাদের সহনশীল এবং উদার মনের হতে হবে। কোথায় যেন পড়েছি, এখন মনে নেই, তবে কথাটা ছিল এরকম, ‘অনুবাদ করা আর অন্যকে দিয়ে পিঠ চুলকানো-- দু’টোই এক। কিছুতেই সুখ পাওয়া যায় না।’ আমি এই মতবাদে বিশ্বাসী নই।
অবশ্যই অনুবাদ এক ‘বিশেষ’ ধরনের সাহিত্য এবং সৃষ্টিশীল লেখা। আমরা জানি (স্বীকার করি, বা না-করি), যে-কোনও দেশের সাহিত্যের দু’টো ধারা বহমান-- একটি মৌলিক এবং অন্যটি অনুবাদ। তাই অনুবাদ কোনো সাহিত্য নয়--যারা মনে করেন, কিংবা বলেন, তাদের মন সংকীর্ণ, তারা উন্নাসিক এবং হীনমন্যতায় ভোগেন। কথায় বলে, সমালোচক তারাই, যারা নিজেরা কিছুই লিখতে পারেন না, শুধু অন্যের সমালোচনা করেন। তবে অনুবাদ সাহিত্য হয়ে ওঠার জন্য অনুবাদকে আন্তরিক হতে হবে এবং যারা মূল্যায়ন করবে, তাদের সহনশীল এবং উদার মনের হতে হবে। কোথায় যেন পড়েছি, এখন মনে নেই, তবে কথাটা ছিল এরকম, ‘অনুবাদ করা আর অন্যকে দিয়ে পিঠ চুলকানো-- দু’টোই এক। কিছুতেই সুখ পাওয়া যায় না।’ আমি এই মতবাদে বিশ্বাসী নই।
অলাত এহ্সান : অনেক সময় দেখা যায়, কোনো লেখক বা দেশের কিছু গল্প অনুবাদ করেই তাকে ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ বলে দিচ্ছে। বইয়ের ভূমিকায়ও এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু থাকে না যে, এগুলো কেন শ্রেষ্ঠ গল্প। কিভাবে বাছাই করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে পাঠকরা কি প্রতারিত হচ্ছেন না?
ফজল হাসান : এ কথার সঙ্গে আমি পুরোপুরি সহমত পোষণ করি না। হয়তো কিছু কিছু অনুবাদক এবং অনেক সময় বইয়ের কাটতি বাড়ানো ও মুনাফা লাভের আশায় এক শ্রেণির প্রকাশকেরা প্রচ্ছদ এবং বইয়ের ভেতরে ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ তকমা লাগিয়ে পাঠকদের বিভ্রান্ত করেন। আমি হলপ করে বলতে পারি, তিনটি ভিন্ন দেশের (আফগানিস্তান, ইরান এবং চীন) গল্প সংকলনে আমি ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ ব্যবহার করেছি। এর পেছনে একাধিক কারণ আছে। যেমন আমার কাছে কোনো গল্প ভালো লাগার অর্থ এই নয় যে, সেই গল্পটি সেই দেশের বা লেখকের শ্রেষ্ঠ গল্প। আমি ভালো লাগা গল্পটি নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করি। গল্পটি সম্পর্কে বিভিন্ন সমালোচকদের মন্তব্য এবং গল্পটি কি কোনো পুরস্কার পেয়েছে কি না, তা খুঁজে বের করি। এছাড়া লেখকের কয়টি সংকলনে, কিংবা কয়জন সম্পাদক তাদের সংকলনে গল্পটি অন্তর্ভুক্ত করেছেন, সেসব বিষয়গুলোর খুঁজে বের করি। আমার অনূদিত বইগুলোর ভূমিকাতে এবং গল্পসূত্রে আমি এসব বিষয়গুলো উল্লেখ করেছি। আমি আমার দায়বদ্ধতা এবং স্বচ্ছতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। আশাকরি, এ বিষয়ে আমার অবস্থান আমি পরিস্কার করে তুলে ধরতে পেরেছি।
অলাত এহ্সান : আমাদের দেশে সাধারণত যে অনুবাদগুলো হয় সেগুলো মূলভাষা থেকে নয়, দ্বিতীয় কোনো ভাষা, বিশেষত ইংরেজি থেকে। তাহলে আমরা ‘সূর্যের রশ্মি থেকে তাপ না নিয়ে বালি থেকে তাপ নিচ্ছি’ বলে মনে হয় না?
ফজল হাসান : একটা উজ্জ্বল উদাহরণ দিই। জার্মান কবি গ্যাটে কিন্তু কালিদাসের ‘শকুন্তলা’র অনুবাদ পড়েই বিমোহিত হননি, তিনি অনুবাদের অনুবাদ (সংস্কৃত থেকে ইংরেজি হয়ে জার্মান) পড়েছিলেন। তাই আমি মনে করি, ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামাও ভালো’। আপনিই বলুন, ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ না? অবশেষে বলবো, নাহয় আমরা দুধের স্বাদ খানিকটা ঘোলেই মিটালাম। ‘সূর্য্যের রশ্মি থেকে তাপ না নিয়ে বালি থেকে তাপ নিচ্ছি’—তাতে ক্ষতি কি? যে উৎস থেকে হোক না কেন, মোদ্দা কথা হলো উষ্ণতা তো পাচ্ছি।
অলাত এহ্সান : অধিকাংশ অনুবাদই বিশ্বের জনপ্রিয় বা বহুল আলোচিত, মানে ‘বেস্ট সেলার’ বইগুলো হয়ে থাকে। এই অনুবাদ দ্বারা একটি দেশের সাহিত্য কতটুকু উপকৃত হতে পারে?
ফজল হাসান : বিশ্বের জনপ্রিয় বা বহুল আলোচিত, মানে ‘বেস্ট সেলার’, বইয়ের অনুবাদ দ্বারা একটি দেশের সাহিত্য পুরোপুরি উপকৃত হতে পারে না। তবে সম্পূর্ণ উপকার পেতে হলে অন্যান্য ভালো লেখাও অনুবাদ করা উচিত। যেহেতু বই ব্যবসা অন্যান্য পণ্যের মতো বাজার অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল, তাই এ ব্যাপারে অর্থনীতির ভাষায় সরকারের সক্রিয় ‘ইন্টারভেনশন’ প্রয়োজন, কিন্তু কোনো ধরনের ‘কন্ট্রোল’ থাকতে পারবে না ।
অলাত এহ্সান : বিশ্বের অনেক বিখ্যাত গ্রন্থ আছে যে গুলো ভাল, কিন্তু বহুল আলোচিত নয়। যেখানে প্রকাশকরাও বিনিয়োগ করতে চায় না। সেক্ষেত্রে মানসম্মত সাহিত্য অনুবাদ কি করে পেতে পারি?
ফজল হাসান : যেহেতু প্রকাশকেরা ব্যবসায়ি (তবে অনেকে সাহিত্য বোদ্ধাও), তাই তারা কখনই ক্ষতির হিসেবের অংক কষবেন না। তবে মানসম্মত অনুবাদ পাওয়ার জন্য পাঠক শ্রেণি গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশকদের উদীপ্ত করতে হবে। এছাড়া প্রকাশকদের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার জন্য অনেক বিদেশি গ্রন্থের স্বত্ব ক্রয় করার জন্য সরকারকে বিশেষ নিয়মে ভর্তুকি দেওয়া উচিত ।
অলাত এহ্সান : একটি দেশ উপনিবেশ মুক্ত হওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বিশ্বের সেরা সাহিত্য, জ্ঞানগর্ভ-মননশীল-চিন্তাশীল বইগুলো ব্যাপক ভাবে, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই, দেশি ভাষায় অনুবাদ করা। আমাদের দেশে তা হয়নি। এটা কি আমাদের দেশের সাহিত্যের অগ্রগতিতে প্রভাব ফেলেছে মনে করেন?
ফজল হাসান : কথাটা সত্যি এবং অবশ্যই আমাদের দেশের সাহিত্যের অগ্রগতিতে প্রভাব ফেলছে। আমরা, অর্থাৎ রাষ্ট্র, কি শুধু সাহিত্য নিয়ে ব্যস্ত? আমাদের রাষ্ট্র নানান ধরনের সমস্যায় জর্জরিত, বিশেষ করে রাজনৈতিক। সাহিত্য কিংবা শিল্প-সংস্কৃতিতে মাথা ঘামানোর জন্য অত সময় কোথায়?
অলাত এহ্সান : ট্যাকনিক্যাল শব্দগুলো ছাড়াও অন্য ভাষার সাহিত্য অনুবাদে সংকট হলো যথাযথ পরিভাষার অভাব। আমাদের দেশে পরিভাষা তৈরির তেমন কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেই। সেক্ষেত্রে আমাদের কি করনীয়?
ফজল হাসান : পরিভাষা তৈরির জন্য রাষ্ট্র অর্থকড়ির যোগান দিতে পারে, তবে ‘বিশিষ্ট’ ব্যক্তি, শিক্ষাবিদ কিংবা ভাষাবিদদের এ ব্যাপারে অগ্রগামী ভূমিকা নিতে হবে। সব বিদেশি শব্দের পরিভাষার প্রয়োজন নেই। কেননা অনেক বিদেশি শব্দ এখন বাংলা ভাষায় ঢুকে গেছে এবং আকছার ব্যবহৃত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চেয়ারের বাংলা শব্দ যদি কেদারা লিখি, তাহলে ক’জন বুঝবেন? এরকম অসংখ্য বিদেশি শব্দ আছে, যা বাংলা ভাষার ভেতর ঢুকে গেছে। এসব শব্দের বাংলা পরিভাষা ব্যবহার না করাই উচিত ।
অলাত এহ্সান : অনেকেই মনে করেন অনুবাদের মান রক্ষার জন্য দেশে রেগুলেটরি স্থাপন করা দরকার। আপনার কি মনে হয়? আমরা কিভাবে মানসম্মত অনুবাদ পেতে পারি?
ফজল হাসান : এসব তাত্ত্বিক এবং কঠোর ব্যবস্থা থাকলেই যে মানসম্মত অনুবাদ হবে, তার নিশ্চয়তা কত শতাংশ? আসলে অনুবাদ কর্মের মান নির্ভর করে অনুবাদকের নিষ্ঠা, আন্তরিকতা এবং ভাষা-জ্ঞানের উপর। আমি মনে করি, ভালো অনুবাদক তৈরি করার জন্য বিভিন্ন উপায়ে (যেমন দেশ-বিদেশের প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন কর্মশালায় যোগদানের ব্যবস্থা করা, পুরস্কার প্রদান ইত্যাদি) তাদের উৎসাহ দেওয়া উচিত। তাহলে তাদের দায়বদ্ধতা বাড়বে এবং তারা নিজেদের কাজে নিষ্ঠাবান হবেন।
অলাত এহ্সান : অনেকেই পাঠের জন্য মূলগ্রন্থ পাঠকেই গুরুত্ব দেন। লেখক প্রস্তুতি হিসেবে অনুবাদ সাহিত্য পাঠকে আপনি কতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?
ফজল হাসান : যারা পাঠের জন্য মূলগ্রন্থ পাঠকেই গুরুত্ব দেন, তারা সংখ্যায় নগণ্য। কেননা একজন লেখক-পাঠকের জন্য বিশ্বের সব ভাষা জানা সম্ভব নয়। তাই তাকে অবশ্যই অনুবাদের শরণাপন্ন হতে হবে। একজন ভালো লেখক হতে হলে তাকে অবশ্যই দেশ-বিদেশের নানা ধরনের লেখার সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। আগেই বলেছি, একজনের পক্ষে বিশ্বের সব ভাষা জানা সম্ভব নয়। তাই অনুবাদ সাহিত্য পাঠ করার কোনো বিকল্প নেই।
অলাত এহ্সান : প্রতিবছরই দেশে প্রচুর অনুবাদ হয়। তার সবই জনপ্রিয় ও বহুলালোচিত গ্রন্থ। অপরিচিত কিন্তু শক্তিশালী লেখক বা বই, অনুবাদকের তেমন কোনো আবিষ্কার নেই। এটা কি অনুবাদকের দূর্বলতা, না অন্যকিছু?
ফজল হাসান : এটা অনুবাদকের দূর্বলতা বলা যাবে না। কেননা অনুবাদক যদি মনে করেন যে, একজন শক্তিশালী লেখক বা জনপ্রিয় এবং বহুল আলোচিত বই আছে, তাহলে অনুবাদক সেটা অনুবাদ করলেন, কিন্তু প্রকাশক প্রকাশ করতে রাজী হলেন না। তাহলে কি অনুবাদকের শ্রম বিফলে যাবে না? অথচ অনুবাদক চাইবেন তার অনুবাদ কর্মটি যেন অধিক পাঠকের হাতে পৌঁছে। তাই অনুবাদক এবং প্রকাশকের মধ্যে একধরনের সমঝোতা এবং যৌথ সিদ্ধান্তে অপরিচিত লেখকের ভালো লেখা অনুবাদ এবং প্রকাশের মাধ্যমে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব ।
অলাত এহ্সান : রবার্ট ফ্রস্ট, টি এস এলিয়ট, শার্ল বোদলেয়ার, শাহানামা অনেক অনুবাদ করেছেন; কিন্তু শামসুর রাহমান, বুদ্ধদেব বসু, কাজী নজরুল ইসলামের মতো কেউ করতে পারেননি মনে করা হয়। কবিতার অনুবাদ কবি, গল্পের অনুবাদ একজন গল্পকার করলে সেরাটা পাওয়া সম্ভব বলে অনেকে মনে করেন। আপনি কি মনে করেন?
ফজল হাসান : হ্যাঁ, কথাটা নিরেট সত্য এবং আমি একশত ভাগ বিশ্বাস করি। আমি কখনই কবিতা অনুবাদ করবো না, যদিও সেটা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিতা হোক না কেন। তার কারণ, আমাকে দিয়ে ওটা হবে না। কথায় আছে, কামারকে দিয়ে কুমারের কাজ ভালো হয় না। এছাড়া প্রবাদ আছে, ‘যার কাজে যে সাজে, অন্যজনে লাঠি বাজে।’ আমি গল্প লেখায় স্বাচ্ছন্দ বোধ করি এবং আমি আগামীতে বিদেশি গল্পই অনুবাদ করবো।
অলাত এহ্সান : অনুবাদ তো দুই ভাবেই হতে পারে। বিদেশি সাহিত্য দেশি ভাষায়, দেশি সাহিত্য বিদেশি ভাষায়। আমরা কিন্তু তা দেখছি না। এর কারণ কি? এ সমস্যা থেকে উত্তোরণের উপায় কি বলে মনে করেন?
ফজল হাসান : হ্যাঁ, অনুবাদ দু’তরফাই হতে পারে, অর্থাৎ ‘ভাইস ভার্সা’। তবে আমার মনে হয়, বিদেশিদের কাছে আমাদের শিল্প-সাহিত্যের তেমন কোনো পরিচিতি কিংবা চাহিদা নেই। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের অন্যতম উপায় হচ্ছে বাংলা সাহিত্যকে বিদেশি পাঠকের কাছে উপস্থাপন এবং আমাদের সাহিত্য পড়ার জন্য উৎসাহিত করা। অবশ্যই এর জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন অনুবাদকের প্রয়োজন, যিনি দেশি সাহিত্যকে বিদেশি ভাষায় ভালো অনুবাদ করতে পারবেন। এছাড়া মার্কেটিংয়ের বিষয়টিও ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
অলাত এহ্সান : এবার বই মেলায় আপনার 'চীনের শ্রেষ্ঠ গল্প' এবং 'নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প' নামক অনুবাদ গ্রন্থ বের হচ্ছে। সে সম্পর্কে বলুন ।
ফজল হাসান :
আপনি ঠিকই বলেছেন, এবার বইমেলায় আমার অনুবাদে দুটো ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো হলো: চীনের শ্রেষ্ঠ গল্প এবং নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প।
চীনের আধুনিক এবং সমকালীন ছোটগল্প নিয়ে বাংলা ভাষায় অনূদিত এটাই একমাত্র সংকলন। এতে চীনা সাহিত্যের সুপরিচিত লু স্যুন, গাও ঝিংজিয়ান এবং মো ইয়ান ছাড়াও ইউ ডাফু, ইয়ে সেংটাও, বা জিন, লিন ইউতাং, পিং সিন, লিং শুহুয়া, ডিং লিং ও আই য়ু সহ মোট কুড়িজন গল্পকারের গল্প আছে। অনূদিত গল্পগুলোতে চীনের রাজনীতি, সাম্রাজ্যবাদী শাসন, বহির্গত আক্রমন, গৃহযুদ্ধ এবং আর্থ-সামাজিক পরিবেশের বিভিন্ন বিষয়গুলো বারবার উঠে এসেছে ।
অন্যদিকে ম্যান বুকার বিজয়ী লেখকদের বাছাইকৃত গল্পের অনুবাদ নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে 'নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প'। ভি এস নাইপল, জন বার্গার, নাডিন গর্ডিমার, জে এম কোয়েৎজি ও কিংসলে অ্যামিস সহ তেরজন ম্যান বুকার বিজয়ী লেখকের মোট চৌদ্দটি গল্প স্থান পেয়েছে এ বইটিতে। এছাড়া এ বইয়ে 'ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল' পুরস্কার বিজয়ী লেখক চিনুয়া আচেবে এবং লিডিয়া ডেভিসেরও গল্প রয়েছে।
বই দুটোর প্রকাশক বাংলাদেশের জনপ্রিয় প্রকাশনা সংস্থা- ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ।
আপনি ঠিকই বলেছেন, এবার বইমেলায় আমার অনুবাদে দুটো ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো হলো: চীনের শ্রেষ্ঠ গল্প এবং নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প।
চীনের আধুনিক এবং সমকালীন ছোটগল্প নিয়ে বাংলা ভাষায় অনূদিত এটাই একমাত্র সংকলন। এতে চীনা সাহিত্যের সুপরিচিত লু স্যুন, গাও ঝিংজিয়ান এবং মো ইয়ান ছাড়াও ইউ ডাফু, ইয়ে সেংটাও, বা জিন, লিন ইউতাং, পিং সিন, লিং শুহুয়া, ডিং লিং ও আই য়ু সহ মোট কুড়িজন গল্পকারের গল্প আছে। অনূদিত গল্পগুলোতে চীনের রাজনীতি, সাম্রাজ্যবাদী শাসন, বহির্গত আক্রমন, গৃহযুদ্ধ এবং আর্থ-সামাজিক পরিবেশের বিভিন্ন বিষয়গুলো বারবার উঠে এসেছে ।
অন্যদিকে ম্যান বুকার বিজয়ী লেখকদের বাছাইকৃত গল্পের অনুবাদ নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে 'নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প'। ভি এস নাইপল, জন বার্গার, নাডিন গর্ডিমার, জে এম কোয়েৎজি ও কিংসলে অ্যামিস সহ তেরজন ম্যান বুকার বিজয়ী লেখকের মোট চৌদ্দটি গল্প স্থান পেয়েছে এ বইটিতে। এছাড়া এ বইয়ে 'ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল' পুরস্কার বিজয়ী লেখক চিনুয়া আচেবে এবং লিডিয়া ডেভিসেরও গল্প রয়েছে।
বই দুটোর প্রকাশক বাংলাদেশের জনপ্রিয় প্রকাশনা সংস্থা- ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ।
অলাত এহ্সান : অনুবাদের জন্য ওইসব লেখক ও গল্পগুলো বেছে নিলেন কেন?
ফজল হাসান : দেশগুলো (আফগানিস্তান, ইরান এবং চীন) বেছে নেওয়ার মূল কারণ হল, এসব দেশের ছোটগল্প নিয়ে বাংলা ভাষায় অনূদিত কোনো সংকলন নেই। অথচ এসব দেশের সাহিত্য এবং শিল্প-সংস্কৃতি অত্যন্ত প্রাচীন, ঐতিহ্যে মহিমান্বিত, গৌরবময় এবং প্রাচুর্য্যে ভরা। লেখকরা প্রায় সবাই পরিচিত ও বিখ্যাত এবং তাদের লেখা গল্পগুলো বিভিন্ন দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া গল্পগুলো আমার কাছে ভাল লেগেছে।
অলাত এহ্সান : এখানে অনেক গল্প তো আগেও অনুবাদ হয়েছে। আপনিও করলেন। ব্যাপারটা মনোটোনাস হয়ে গেল না? কিংবা আপনার বিশেষত্ব কোথায়?
ফজল হাসান : ধরুন, একটা গল্প তিনজন অনুবাদ করলেন। আপনার কি মনে হয়, অনুবাদগুলো হুবহু একই হবে এবং সমান ভাবে পাঠকপ্রিয়তা অর্জণ করবে? কিছুতেই না। কারণ অনুবাদের ভেতরে অবশ্যই ভিন্নতা থাকবে। একেক জনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রকাশ করার কৌশল আলাদা। বিচক্ষণ পাঠকরাই বুঝবে, কার অনুবাদ স্বচ্ছন্দ এবং সুখপাঠ্য। আমি পাঠকের কথা ভেবেই অনুবাদ করি। এ প্রসঙ্গে ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই। ২০১৩ সালে ‘ম্যানবুকার’ বিজয়ী নারী লেখক নিউজিল্যান্ডের এলিনর ক্যাটন। আমি তার ‘নেক্রোপলিস’ গল্পটি অনুবাদ করেছি, যা পরবর্তীতে ‘নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত। ‘নেক্রোপলিস’ শব্দের আক্ষরিক বাংলা শব্দ হলো ‘কবরস্থান’, বা ‘গোরস্থান’। অবশ্য একজন অনুবাদক গল্পটির শিরোনাম দিয়েছেন ‘কবরস্থান’। অথচ আমি কিন্তু গল্পের নামকরণে কোনটাই ব্যবহার করিনি। আমার কাছে মনে হয়েছে, দুটোর একটা শব্দ ব্যবহার করলে পাঠক হয়তো গল্পটা পড়তে চাইবে না। তার কারণ, কবরস্থান বা গোরস্থান শুনলে আমরা সবাই কম-বেশী ভয় পাই। আমি ‘নেক্রোপলিস’য়ের প্রতিশব্দ ‘মৃতদের আবাসভূমি’ ব্যবহার করেছি। আমার বিশ্বাস, গল্পটি পড়ার জন্য পাঠকরা উৎসাহিত হবে।
অলাত এহ্সান : অনুবাদের ক্ষেত্রে অনেকে ভাষা, অনেকে ভাব, অনেকে মূলবক্তব্য অনুসরণ করেন। এতে কি একটি সাহিত্যের প্রকৃতাবস্থার হেরফের ঘটে যায় না?
ফজল হাসান : দেখুন, অনুবাদের দুটো আলাদা ধারা বা পথ রয়েছে, যা আমরা মেটাফ্রেস্টিক বা মুলানুগ অনুবাদ এবং প্যারাফ্রেস্টিক বা স্বাধীন অনুবাদ। যেহেতু আমি অনুবাদের অনুবাদ করি, তাই মূল ভাষার রস আচ্ছাদন করার সুযোগ আমার নেই। তাই আমি সবসময় ইংরেজি ভাষায় অনূদিত মুলানুগ অনুবাদ করার প্রতি সচেষ্ট থাকি। কেননা স্বাধীন অনুবাদে আসল ভাব কতটুকু বজায় রাখা সম্ভব, সে বিষয়ে আমি কিছুটা সন্দিহান। তবে অনেক সময় মুলানুগ অনুবাদের সঙ্গে নিজের সৃষ্টিশীলতারও খানিক স্পর্শ লেগে থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে আমি যা অনুবাদ করি, সংক্ষেপে বলতে হয়, যখন আমি সিদ্ধান্ত নিই যে একটা ভালো গল্প অনুবাদ করবো (আগেই উল্লেখ করেছি, সব গল্পই অনুবাদ করা যায় না), আমি সেই গল্প লেখকের জীবন সম্পর্কে, তার লেখার ধরন বা স্টাইল এবং কোন ‘টোন-এ তিনি লেখেন, এসব বিষয় সম্পর্কে ধারনা নিই এবং লেখককে বোঝার চেষ্টা করি। তারপর গল্প অনুবাদ করার সময় সেই জ্ঞানটুকু কাজে লাগাই। এ ভাবেই আমি মূল লেখার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করি। তবে এ কথা সত্যি যে, অনুবাদকে পাঠকের কাছে মনোগ্রাহী করার জন্য অনুবাদককে মাঝে মাঝে কিছুটা স্বাধীনতা নিতে হয়। মূল কথা হলো, অনুবাদককে সত্যনিষ্ঠা এবং বিশ্বস্ত হতে হবে।
অলাত এহ্সান : অন্যান্য অনুবাদক থেকে নিজেকে কিভাবে আলাদা করেন?
ফজল হাসান :
আমি ফজল হাসান--একজন অনুবাদক। বিশ্বের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ লেখকের গল্প বাংলায় অনুবাদ করে বিদেশি সাহিত্যের সঙ্গে বাংলা ভাষাভাষি পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়াই আমার মূল উদ্দেশ্য। অনুবাদ কর্ম আমার মূল পেশা নয়। বলা যায়, একধরনের নেশা। যাহোক, ব্যক্তি হিসাবে, বিশেষ করে মন ও মননে এবং চিন্তা ও চেতনায়, আমি হয়তো অন্য দশজনের চেয়ে পৃথক। কিন্তু অনুবাদক হিসাবে অন্যান্য অনুবাদক থেকে আলাদা কি না এবং আলাদা হলে কতটুকু--সেই বিচারের দায়ভার পাঠকের। এ ব্যাপারে তারাই যোগ্য বিচারক এবং আমার সম্পর্কে ভালো বলতে পারবেন।
আমি ফজল হাসান--একজন অনুবাদক। বিশ্বের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ লেখকের গল্প বাংলায় অনুবাদ করে বিদেশি সাহিত্যের সঙ্গে বাংলা ভাষাভাষি পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়াই আমার মূল উদ্দেশ্য। অনুবাদ কর্ম আমার মূল পেশা নয়। বলা যায়, একধরনের নেশা। যাহোক, ব্যক্তি হিসাবে, বিশেষ করে মন ও মননে এবং চিন্তা ও চেতনায়, আমি হয়তো অন্য দশজনের চেয়ে পৃথক। কিন্তু অনুবাদক হিসাবে অন্যান্য অনুবাদক থেকে আলাদা কি না এবং আলাদা হলে কতটুকু--সেই বিচারের দায়ভার পাঠকের। এ ব্যাপারে তারাই যোগ্য বিচারক এবং আমার সম্পর্কে ভালো বলতে পারবেন।
অলাত এহ্সান : অনুবাদকের স্বাধীনতা, শব্দ তৈরি ইত্যাদি দিক অনেকে সামনে আনেন। এটাকে আপনি কি ভাবে দেখেন? তা ছাড়া অনুবাদকের আদৌ কোনো স্বাধীনতা আছে কি?
ফজল হাসান : অবশ্যই অনুবাদকের স্বাধীনতা আছে। কেননা অনেক সময় অনুবাদককে তার কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করতে হয়। তবে তাকে তার স্বাধীনতার সীমানা জানতে হবে। সেই সীমানার বাইরে যাওয়া তার উচিত হবে না। আসল কথা হলো, পাঠককে কোনো ভাবেই ঠকানো যাবে না, অর্থাৎ তাদের আস্থা এবং বিশ্বাস ভঙ্গ করা যাবে না।
অলাত এহ্সান : অনুবাদ আমাদের সাহিত্যে কী অবদান রাখছে?
ফজল হাসান : যে কোনো দেশের সাহিত্যের উৎকর্ষতা এবং সমৃদ্ধির জন্য অনুবাদের ভূমিকা অপরিসীম। বলা হয়, অনুবাদ সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের সেতুবন্ধন। কেননা অনুবাদের মাধ্যমেই কেবল বিশেষ কোনো জাতি বা দেশ, এমনকি বিশ্বনন্দিত লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পথ সুগম হয়। এই অনুবাদের সুবাদেই আমরা এখন বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত। পরিশেষে বলা যায়, বিশ্বসাহিত্যের একটি অংশ অনূদিত হয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ঋদ্ধ এবং সমৃদ্ধ করেছে।
অলাত এহ্সান : অন্য একটি ভাষায় লেখা অনুবাদ হচ্ছে। অথচ লেখক জানছেন না, রয়েলটি পাচ্ছেন না। মূলানুগ অনুবাদের জন্যও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে না। বিষয়টা কিভাবে দেখেন?
ফজল হাসান : বেশির ভাগ সময় আমি লেখক, ইংরেজীর অনুবাদক, প্রকাশক কিংবা ম্যাগাজিনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আজ অবধি কেউ নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেনি। হয়তো তার কারণ হলো, আমি বিভিন্ন লেখকের শুধু গল্প অনুবাদ করি। এসব ছোটখাটো কাজে তাদের কোনো আপত্তি নেই।
অলাত এহ্সান : লেখালেখির ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের কথা প্রায়ই শোনা যায়। আমাদের দেশে অনুবাদের তেমন পেশাদারিত্ব দেখছি না। অনুবাদের মানোন্নয়নের জন্য পেশাদারিত্বের ভূমিকা কী মনে করেন আপনি?
ফজল হাসান : অনুবাদক তো দূরের কথা, বাংলাদেশে ক’জন ‘ফুলটাইম পেশাদারী’ লেখক আছেন? একজন অনুবাদক তখনই পেশাদারিত্বের কথা ভাববেন, যখন তিনি তার ভরণ-পোষণের নিশ্চয়তা সম্পর্কে ‘কনফার্ম’ হতে পারবেন। অবশ্যই অনুবাদের মানোন্নয়নের জন্য পেশাদারিত্বের ভূমিকা রয়েছে।
অলাত এহ্সান : নতুন লেখক তৈরির ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়। আজকের দিনে অনেকের মধ্যে অনুবাদক হওয়ার চিন্তাও দেখা যায়। অনুবাদক তৈরির ক্ষেত্রে কোনো মাধ্যমটি আপনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন? আদৌ কি তেমন কোনো মাধ্যম আছে?
ফজল হাসান : অনুবাদকের জন্য পরিধি যতো বিশাল হবে, লেখা প্রকাশের জন্য ততো বেশী সুবিধা পাবে। যেহেতু দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য বিভাগ এবং সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক ম্যাগাজিনের একধরনের অলিখিত সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তাই লিটল ম্যাগ এবং অনলাইন ম্যাগাজিনগুলো এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
অলাত এহ্সান : অনুবাদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে একুশে পদকও দেয়া হচ্ছে। এটা আমাদের দেশে মানসম্মত অনুবাদের ক্ষেত্রে কি কোনো ভূমিকা রাখছে?
ফজল হাসান : অনুবাদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে একুশে পদকও দেওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং এটা আমাদের দেশে অনুবাদের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। আমি মনে করি, অনুবাদের জন্য কোনো অনুবাদক তার কাজের যথার্থ স্বীকৃতি পেলে সে আরও বেশী উৎসাহিত হবে এবং নিঃসন্দেহে ভালো কাজ করার অনুপ্রেরণা পাবে। আপনিই বলুন, পুরস্কার পেলে কার না ভালো লাগে?
অলাত এহ্সান : এই মুহুর্তে দেশে যে অনুবাদ হচ্ছে, তার মান নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট?
আমাদের দেশে বিশ্বসাহিত্যের ভালো অনুবাদের খুব অভাব। তার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, (আমি আগেই বলেছি) আমার জানা মতে বাংলাদেশের অনুবাদকেরা কেউ ‘ফুল টাইম’ অনুবাদক নন। তারা অনুবাদের মতো একটা একাকীত্বের কাজে সময় ও শ্রম ব্যয় করেন শুধুমাত্র নিজেদের মনের আনন্দের জন্য, অর্থাৎ তারা সৌখিন অনুবাদক। বিদেশি সাহিত্যিকদের যেসব লেখা তারা হাতের কাছে পান এবং যেসব লেখা ভালো লাগে, সেসব লেখাই তারা অনুবাদ করেন। ফলে অনেক সময় বিশ্বসাহিত্যের ভালো অনুবাদ দেখা যায় না। এছাড়া ‘কপি রাইট’ এবং মূল ভাষায় দৈন্যতা তো রয়েছে। যাহোক, ভালো অনুবাদের অভাব আছে জানি, কিন্তু যেটুকু অনুবাদ হচ্ছে, তা যদি আদৌ না হতো, তাহলে কেমন হতো?
অলাত এহ্সান : আমাদের দেশে অনেক অনুবাদক আছেন। বাজারে তাদের অনেক বইও আছে। আপনি কাদেরকে আদর্শ অনুবাদক বলে মনে করেন?
ফজল হাসান : আমাদের দেশে অনেক অনুবাদক আছেন এবং বাজারে তাদের অনেক বইও আছে--এ সম্পর্কে আমার কাছে কোনও নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে আমি তাদেরকেই আদর্শ অনুবাদক বলে মনে করি, যাদের অনুবাদের ভাষা সহজ, সরল এবং প্রাঞ্জল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এসব অনুবাদকেরা পাঠককে অনায়াসে লেখার গভীরে নিয়ে যেতে পারবে এবং সেখানেই অনুবাদকের সার্থকতা। উল্লেখ্য, ইচ্ছে করেই আমি এখানে কোনো আদর্শ অনুবাদকের নাম বলতে চাই না।০
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীর পরিচিতি
অলাত এহ্সান
জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। কঠিন-কঠোর জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। পড়াশুনা করেছেন মানিকগঞ্জের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ(ইন্টারমিডিয়েট) ও ঢাকা কলেজে(অনার্স-মাস্টর্স)। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। প্রবন্ধ লিখেন। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ব ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে।
0 মন্তব্যসমূহ