অলাত এহ্সান
খাবার টেবিলে জ্বলা মোমবাতির আগুনটা একবার বাম দিকে, একবার ডানদিকে কাত হয়ে যায়। দেখে মনে হয় টেবিলের দুইপাশে বসা মানুষ দু’টো আগুনকে একেবারে অস্বীকার করে একজন আরেক জনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিংবা তা দখলে নেয়ার জন্য অশ্লীলভাবে রশি টানাটানি করছে। আগুনের শিখার সময় সময় এক পাক ঘুড়ে থেবড়ে যাওয়া দেখে মনে হয়, কয়লার আগুনে পোড়া গণগণে লোহা ফাইলের উপর রেখে দু’জন কামার বেধড়ক পেটাচ্ছে। মোম একটাই জ্বলছে টেবিলে। নৈশ্বব্দের এই নৈশভোজে অংশ গ্রহণ করা বড় দুই জন ছাড়াও যে শিশুটি খাবার খাচ্ছে, তার শিশুতোষ উচ্ছাস এখন স্তিমিত। খানিক আগে ছিল। তখন বৈদ্যুতিক বাতিও ছিল। তখন কাঁচের বাসন-কোষণের উচ্চ শব্দ করে নড়াচড়ার মতোই গমগম করে কথা হচ্ছিল। এখন শুধু প্লেটে চামচ টানার সরসর কিংবা টুংটাং শব্দ। নিস্তবদ্ধতায় সব কিছু একদম জমে যাওয়ার আগে পান্নু মৃধার কন্ঠের শব্দ হয়। ঢক ঢক করে পানি পানের শব্দ। জজের টেবিলে কাঠের হাতুড়ি ঠুকে পুরো ঘরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার মতো, টেবিলে পানির গ্লাস রাখার শব্দে সে এবার নির্দেশ দেয়, ‘তুমি আর ওখানে যাবে না। ওসব তোমার দরকার নেই। আর তোমার ঐখানে আর যাওয়া লাগবে না। আমি ইডি (ইক্সক্লুসিভ ড্রিরেক্টর) মঞ্জু সাহেবকে বলে দেবো।’
সুলতানা কোনো উত্তর দেয় না। সুপের বাটিতে দেয়া চুমুক তার নিঃশব্দতা ও দীর্ঘায়িতা নিয়ে সম্পন্ন হয়। সে এ নিয়ে এতোক্ষণ অনেক কথা বলেছে। খুব ক্লান্ত অনুভব করে। তর্কের নিঃসফলতা নিয়েও সে তার সন্দিহান নয়। তাই খান্তি দিয়েছে। সে জানে আপাত নিরীহ ও গম্ভীর প্রকৃতির মানুষটি গন্ডারের মতো কি রকম হিংস্র হতে পারে। নির্লজ্জের মতো নাকের উপরের শিং দিয়েই আশ্রয়ের শেষ গাছটাও চিড়ে-ফেঁড়ে ফেলতে পারে। তখন উন্মূল মানুষের মতো পাতার ছায়ায় আশ্রয় টুকুও থাকবে না।
শিমুলের ইতোমধ্যেই খাওয়া শেষ। সুলতানা তার দিকে তাকাতেই শিমুল উঠে আরোপিত পায়ে শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। সুলতানা তাকে পেছন থেকে অস্ফুট বলে, ‘তুমি গিয়ে শো, আমি আসছি।’ চোখ ফেরাতেই দেখে পান্নু মৃধা তার দিকে তাকিয়ে আছে। কামুক আর ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে। হাতের চামচ দু’টো নামিয়ে রেখে টিস্যুতে মুখ মুছে। শিমুলের উল্টো দিকে শোবার ঘরের দিকে রওনা দেয়। এটা সুলতানা ও পান্নুর একান্ত ঘর। যেতে যেতে শুধু বলে, রাত অনেক হয়েছে। পোশাক পড়ে রুমে আসো। আমি ক্লান্ত।’
সুলতানা কি তবে পোশাক পড়ে নি? তার খেয়াল হয়, সে এখনো শাড়ীটা পড়েই আছে। প্রতিদিনকার মতো বাসায় এসে গ্রাউন বা নাইট ড্রেস পরেনি। শাড়ী সে সব সময়ই পরে, বাইরে যেতে, অফিসের কাজে যেতে। কিন্তু শাড়ীটা আজ আলাদা পোশাক মনে হয়। সব চেয়ে আলাদা লাগে পান্নু মৃধার আচরণ। শুধু মাত্র শাহবাগে যাওয়ার জন্য সে এ ভাবে ক্ষেপে উঠবে, তা সুলতানা চিন্তাও করেনি। আট দিন পর স্বামীকে কাছে পাওয়াও তার বিষম খায়। যদিও তার আরো সপ্তাহ খানেক পরে বাড়ি ফেরার কথা ছিল তার। তবু সুলতানার মনে এ নিয়ে কোনো তরঙ্গ তৈরি হয় না। এক সময় হতো। সে সব ভাবতে গিয়ে সে যারপরনাই বিস্মিত হতে হয়। পান্নু মৃধার হেঁটে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে সে কথাই ভাবে সুলতানা। ভাবতে থাকে পরিচয় থেকে আজকের দিনের সংসার পর্যন্ত জীবনের খতিয়ান।
সুলতানা তখন ইডেন কলেজে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের পড়ে। সমাজ কর্ম বিভাগে। আর টিএসসি’র এক আবৃতি সংগঠনের সদস্যা। সংগঠনের সমন্বয়ক বড় ভাই মাসউদের বন্ধু পান্নু মৃধা। তখন মাস্টার্সে পড়ে। সেও সমাজ কর্মে। আবৃতির সাথে সম্পৃক্ত না থাকলেও সে পাঠচক্রে প্রায়ই আসে। সে খানেই পরিচয় দু’জনের। সংগঠনের বড় ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে যেচে পড়ে উপদেশ দেয়ার এখতিয়ার তার আছে। তাছাড়া, একই বিভাগের ছাত্র হওয়ায় বড় ভাইয়ের কাছ থেকে একটু আধটু দিক নির্দেশনা সুলতানার অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। তারপর সুলতানার সংকটের সময় তাকে একটি টিউশনি দিয়ে পরম উপকার করেছে। সেখান থেকেই দু’জন দু’জনার প্রতি যে অনুরক্ত তা পরিস্কার হয়ে যায়। ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিকে গড়াতেও সময় লাগে নি।
পান্নুর সাথে তার সম্পর্কের জের ধরে আবৃতি সংগঠনের সমন্বয়ক বড় ভাই মাসউদ তাকে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় দেয়। সংগঠন থেকে যে সাহিত্যপত্র বের হয় সেখানে তাকে সম্পাদনা পরিষদে রাখে। কয়েকটি কবিতাও স্থান পেয়েছে। তখন সুলতানার উর্বশি মনে সাহিত্যিক হওয়ার চিন্তা দু’চারবার উঁকি যে দেয় নি, তা নয়। কিন্তু তার বিস্তার সময় ভরে গেছে, পান্নুর সাথে এখানে সেখানে আড্ডা দিতেই। প্রথমে অনিচ্ছা ছিল, তা সত্বেও সম্পর্কের জের ধরে সে কয়েক বার পান্নুর বন্ধুদের মেসে গেছে। সেসব মেসে তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও হয়েছে বেশ কয়েক বার।
পান্নু বোঝাতো- মনে যদি দূরত্ব না থেকে তাহলে শরীরের দূরত্ব কিসের? সম্পর্কের পূর্ণতা আনতে বা সকল দূরত্ব ঘোঁচানোর জন্যই শারীরিক সম্পর্ক দরকার। পারস্পারিক বিশ্বস্ততার থেকেই এ সম্পর্ক। সুলতানা ভয় পেয়েই গিয়েছিল। কিন্তু পান্নু সে রকম নয়, বেশ দায়িত্বশীল।
পান্নু তখন শেয়ার বাজারে নতুন বিনিয়োগ করছে। তারপর সম্পর্কের চার বছরের মাথায় সুলতানাকে যখন বিয়ে করে। তখন তার যথেষ্ট টাকা। দক্ষ বিনিয়োগকারী। ছিয়ানব্বইতে শেয়ার বাজারে যখন ধস নামলো সুলতানা তখন তারে উপরে উঠতে দেখেছে। সে সময়ই দেশের বড় বড় আমলা-মন্ত্রীদের সাথে তার দারুন যোগাযোগ।
সুলতানা সবচেয়ে বিস্মিত হয়ে যেত যখন দেখতো, পান্নুর কথা আর সরকারি প্রেস নোটে প্রায় একই বক্তব্য। ছিয়ানব্বইয়ের পর থেকে সে আসতে আসতে আমদানি-রপ্তানির দিকে ঝুঁকেছে। গতবার যখন বিশ্ব বাজার-দেশের শেয়ার বাজারে ধস নামলো তখন তার হাতে আসে বিপুল টাকা। তখন সুলতানার নামেও একটা একাউন্ট হয়েছে। অবশ্য তাতে দৈনিক কত টাকা লেনদেন হয়, তা সে কিছুই জানে না। ক্রেডিট কার্ডও তার কাছে নেই। তবে কখনো বড় অংকের টাকা তোলার দরকার হলে তাকে চেক স্বাক্ষর করে দিতে হয়।
এখন একটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চেষ্টা করছে পান্নু। একজন্য তাকে প্রায়ই দেশের বাইরে যেতে হয়। থাকতে হয়। বিয়ের পর প্রথম প্রথম সুলতানাকে একাই থাকতে হতো। তখন সুলতানা চাকুরির কথা বলতো। কিন্তু পান্নু তাতে কিছুতেই রাজি হয় নি। তারপর শিমুলের জন্ম। সুলতানা বুঝে, শিমুলের জন্ম তখন নেতাত সন্তান প্রীতি বা দায়িত্ব বোধ কিংবা রতিক্রিয়ার ফল ছিল না। এর মধ্য দিয়ে পান্নু তাকে চাকুরি চাওয়ার এক প্রকার জবাব দিয়েছে।
সুলতানা সে দিনই বেশি অবাক হয়েছিল, যখন পান্নু নিজেই তাকে একটি চাকরির কথা বললো। ততদিনে ঢাকায় তাদের বাড়ি হয়েছে। গাড়ি হয়েছে, তারপরও চাকরি। চাকরিটা একটা এনজিওতে। নারী ও শিশু নির্যাতন বিরোধী এনজিও। পরে বুঝেছে, এটা পান্নুর এক ব্যবসায়িক পাটনারের এনজিও। পাটনারের স্ত্রীই এর প্রধান। সুলতানা আকারে প্রকারে বুঝেছে, এখানে পান্নুরও একটা অংশ আছে। সুলতানা ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছে, এই চাকরির মধ্যদিয়ে যে আরেক দফা পান্নুর হাতে বন্দি হলো। এর মাধ্যমে পান্নুর কাজ কর্ম, কোথায় কি করে—এসব সম্পর্কে জানার অধিকার হারাতে শুরু করেছে। পান্নুর সমাজের উপযোগি করে তুলেছে। তার মানে, কখনো বাড়িতে তার ব্যবসায়িক পার্টনারদের সাথে ড্রিংস পার্টি তাকে সহ্য করতে হবে। প্রয়োজনে কখনো বাসাটা একটু খালি করে দিতে হবে। বা সাদরে অংশ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে। সুলতানার এখন এই সব কান্ড কিংবা একাকিত্ব গা সওয়া হয়েছে।
সুলতানার ব্যতিব্যস্ততা এখন শুধু শিমুল আর এনজিও নিয়ে। তার এনজিও এখন দেশের লিডিং এনজিওগুলো একটা। নারীদের শারীরিক-মানসিক নির্যাতন ও বৈকল্য নিয়ে অনেক কিছুই করেছে। কিন্তু এই সব চিন্তা তার ক্ষেতে কতটা প্রযোজ্য, তা নিয়ে একেবারে চিন্তা করতে চায় না। তাতে তিক্ততা-রিক্ততা দুই-ই বাড়বে। তার চেয়ে সে বরং নারী ও শিশুর জন্য কিছু করছে, প্রকারান্তে সমাজের জন্য কিছু করছে—এই তৃপ্তি টুকু নিতে চায়। কিন্তু সে চিন্তাতেও এখন ফাঁটল ধরেছে। এটা বছর দুই আগে তার পরিবারের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া একটা দূর্ঘটনা কেন্দ্র করেই।
সেদিনও পান্নু মৃধা বিদেশ থেকে সবে এসেছে। সন্ধ্যার পর। এসেই বললো, ঘর দোড় পরিষ্কার না কেন? কাজের লোক সব করে কি? কই, সবই তো পরিষ্কার, সকালেই কাজে লোক সব পরিষ্কার করেছে। পর দিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় পান্নু মৃধা হাক-ডাক দিয়ে উঠে, বিদেশ থেকে আনা দামী লাইটার কোথায়? কোথাও পাচ্ছে না। বাড়ির তের বছরের কাজের ছেলেটাকে সাব্বস্ত করে নানান ধমক ধামকি আর চড়থাপ্পড় করা হয়। তারপর বুট জোড়া রাতে পরিষ্কার না করার জন্য ছেলেটাকে আরেক দফা যা-তা বকাঝকা করা হয়। ছেলেটা যখন বুট পলিশ করছে তখনও তাকে ছোটজাত-চোর-বেজম্মা ইত্যাদি বলে গালাগালি চলছিল। এক সময় ছেলেটা ফুঁপসে উঠে, ‘বেজম্মা আমরা না আপনেরা। এই বাইত্তে কি অয় তা বুজি না, ন্যা? চোর আমরা না। দুই ট্যাহার জন্নি কত দুশ, মাইনসে যে কুটি কুটি ট্যাহা চুরি করে, পুলিশ খুঁজে, হ্যাগো দুশ নাই?’
পান্নু মৃধাকে একবার পুলিশে খুঁজে ছিল বটে। তবে ওই টুকুই। সেও অনেক দিন আগে। কাজের ছেলেও আসারও অনেক দিন আছে। সে হয়তো অনুমানে বা ভুল করে বলে ফেলেছে। কিন্তু কথাটা শোনার পর সে আর এক মুহুর্তও সময় দেয় নি। একটা কষে চড় মাড়লে দো’তলা থেকে একদম সিটকে নিজ তলার মেঝেতে। গরীবের কাহেল শরীরের মতো প্রাণটাও দূর্বল। ফ্লোরে পড়েই মর মর কোকানি শুরু হয়ে যায়। সুলতানাও তখন অফিসে যাওয়ার জন্য ঘরের ভেতর তৈরি হচ্ছিল। এই নিয়েই তার এনজিও। দেখেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলে। ছেলেটিকে ভাল একটি হাসপাতালে ভর্তি করা, মিডিয়া ঠেকানো, থানা মিটানো—সব কিছু নিজেই করেছে। তারপরও দু’একটা ছোটখাট পত্রিকায় এ নিয়ে সামান্য রিপোর্ট হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালে ছেলেটা মারা যাওয়ার পর কোনো পত্রিকায় এ নিয়ে কিছুই লেখা হয় নি। সে নিজে ছেলেটার বাবা-মা’র হাতে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে বিষয়টা সুরাহা করেছে। অবশ্য টাকা তার স্বামী পান্নু মৃধাই তাকে দিয়ে ছিল। সেই কিছু দিন সুলতানা তার স্বামীকে তার মুখাপেক্ষি ও কাতর হতে দেখেছে। সুলতানা তখন মনে হয়েছে, তার পেশা জীবন কারো না কারো চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে। সমাজ সেবার তৃপ্তি সে দিন থেকে আর নেই।
অনেক দিনপর জামা-কাপড় গোছাতে গিয়ে যখন লাইটারটা সেদিনের কোর্টের পকেটেই পেয়েছিল, তখন সুলতানার চোখে আবার ছেলেটার মা’র কান্নার দৃশ্যটাই বারবার ভেসে উঠেছে। তার মনে পড়ে, তাদের অফিসের সবচেয়ে তৎপর শাখা, সেই উত্তর-বঙ্গ থেকে সে নিজে ছেলেটিকে নিয়ে এসেছিল। ভরণ পোষণ ও পড়াশোনা করাবে বলে। কিন্তু তাকে মেরেফেলেছে। কথাটা ভাবতেই নিজে দারুন অপরাধী মনে হয়েছে।
এখন পান্নু মৃধার ফার্মর থেকেও বৎসরে বেশ কিছু টাকা তার এনজিওকে দিয়ে থাকে। সে কথাই আজ পান্নু মৃধা কথায় কথায় মনে করিয়ে দিল। শেষ পর্যন্ত সুলতানা তার শাহবাগের আন্দোলনে যাওয়াটকে শ্রেফ অফিসিয়াল ব্যাপার বলে দাঁড় করাতে চেয়ে ছিল।
হ্যা ’৭১-এ যেহেতু দুই লাখ নারী ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং অসংখ্য নিরীহ নারী-শিশু হত্যা কান্ডের শিকার হয়েছিল। আর এর সাথে রাজাকার-আলবদার-আলসামস-জামাত-শিবির জড়িত। তাই এদের ফাঁসির দাবিকে তারা অফিসিয়ালি সমর্থন দিচ্ছে। অংশ গ্রহণ করছে।’ কিন্তু পান্নু মৃধা এসব শোনার মানুষ নয়। কথার শুরুতেই থামিয়ে দিয়ে বলে,‘তোমাদের অফিস কোথায় থেকে কয় পয়সা পায় আর কি করে তা জানি। ওসব আমাদের বোঝাতে এসো না। গ্রামের বোকা মহিলাদের বোঝিও। আমি যা বলছি তাই কর।’ সুলতানা এতক্ষণ নীতি-নৈতিকতা-আন্দোলনের যৌক্তিকতা অনেক কথা বলেছে। সে আবারা অফিসের বাধ্যবাধকতা বোঝাতে চায়। তবে এতো মাঠা ঘেটে মাখনের জন্য অপেক্ষা করার জন্য পান্নু মৃধা রাজি না। এতে তার রাগ আরো বেড়ে যায়। সে সব সময় দেখে এসেছে, মাঠা যতই হোক, মাখন তার উপর ভাসে। তাই সে নিগূড় কথা বলে দেয়,‘তোমার অফিসের বিষয়টা আমাকে বোঝাতে এসো না। অমন অফিস দাতারা চাইলে মুহুর্তে জন্ম হতে পারে। মরতেও পারে। ওখানে কে কিসের ধান্দায় যায়, তা জানি। যতসব ধান্দাবাজি...’ কথা বলতে বলতে কি এক ঘৃণা আর ক্রোধ থেকে হয়তো, অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ছিল। সে আরো ক্ষিপ্রতা নিয়ে মুখ ফেরায়। ‘আর টাকা বন্ধ হয়েগেলে এই সব ভাল কথার বলার একজনও পাবে না। তোমার অফিসও কাল থেকে ওখানে যাবে না। যা বলছি শোন। নিজে তো গেছই, ছেলেটাকেও সাথে নিয়ে গেছ।’
একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে স্তিমিত হয় সুলতানার বুক। মোমবাতির লালচে আলোয় পাশ থেকে শিমুল, ভেঙচি কাটার মত দাঁতাল মুখ আর চোয়ালের ক্রমাগত ওঠা-নামা দেখে। চরম কথা এতো ক্ষণে পান্নুর মুখে শোনা যায়। ‘ঐ জাগরণ-ফাগরণ বাদ দাও। অতো মাতামাতি করো না। যাদের বিচার চাইছে তাদের ফাঁসি হলো তোমরা না খেয়ে মরবে। তোমার অফিস বন্ধ হয়ে যাবে।’ অনেক বেশি নির্দেশ দানের মতো কথা বলে পান্নু। আঙুলের ফাঁকে আটকে থাকা চামচটা যেন হাঁতুড়ির মতো এক একটি গজাল ঠুঁকে দিচ্ছে।
‘বোঝো না, আর সব এনজিও বিদেশী ফান্ডের জন্য ফ্যা ফ্যা করে ঘুরের বেড়ায়, আর তোমরা প্রতিবারই বড় ফান্ড পাও। তা ফুরালেও কেন অসুবিধা হয় না। বোঝো না?’ বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে যায় পান্নু মৃধা। চেয়ারের হেলান থেকে অনেকটাই এগিয়ে আসে। ভয়ংকর দৃঢ় ভাবে বলে উঠে,‘ওখানে অতশত লোকের কথা বাদ দাও। ওখানে একটা বোম ফুটলে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আর..’ দারুন উত্তেজনায় উঠা-নামা করতে করতে ডান হাতে পড়া ঘড়িটা পানির জগের মাথায় লেগে শব্দ করে উঠলে মাঝ পথেই কথায় দম দেয় সে। সে দিকে সামান্য চোখ ফেরায় শুধু। তার কথার মাঝে প্রচন্ড ক্ষোভ আর ঘৃণা। সুলতানার মুখের দিকে তাক করা তর্জনীটা হার্টবিট রিডারের মতো উঠা-নামা করছে। যেন তার কপালে অমঘ কিছু একটা লিখে দিতে চায়। ‘ওখানে গিয়ে এতো লোকের সামনে যেমন কর, তা কি কোনো ভদ্র লোকের স্ত্রী করে? মিডিয়ার সামনে যেসব কথা বল, একবার টার্গেটে পড়েগেলে তোমাদের বাঁচানো যাবে? তোমরা না গেলে তাতে কারো কিচ্ছু হবে না।’ ভদ্রলোকের স্ত্রী করে কি না এটা যেমন, পান্নু মৃধা আদৌ ভদ্রলোক কি না সে আরেক প্রসঙ্গ। এবার সুলতানা বুঝতে পারে, পান্নু তাকে টেলিশনে দেখে ক্ষেপতে ক্ষেপতে দেশে এসেছে। তবে তার উদ্বেগ দেখে আতঙ্কিত হয় সুলতানা। ‘এই হত্যাকান্ড-বোমাবাজির সাথে কি তবে...’ সুলতানা আর ভাবতে পারে না। শুধু নির্ভারের মতো আওড়ায়—‘সত্যি, সে না গেলে শাহবাগের কিছুই হবে না। যেমন নেই পান্নু মৃধারা। তবুও সেখানে মানুষের অভাব পড়ছে না। প্রতিদিনই কত কত নতুন মুখ আসছে। দেশের আনাচে কানাচে, প্রত্যন্ত জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে আন্দোলন। পরাজিতের মতো সে-ই শুধু পরে থাকবে ঘরে, টিভি সেটের সামনে। কিন্তু তার কারণে যদি শিমুলের ক্ষতি হয়, যে আজও নেচে নেচে ¯েøাগান দিয়েছে। যদি মেরে ফেলে তাকে? তবে সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে কি? এই ঘরের তলেই বা থাকবে কি করে? অথচ শিমুল, বেচারা, যে এই ঘর আর স্কুলের চারদেয়াল, কম্পিউটার গেমস্ আর টিভি সেটের বাইরে এই প্রথম এক রোমাঞ্চের সাথে পরিচয় হয়েছে। আবার তাকে পুরনো ধাঁধাঁয় ঘোরপাক খেতে হবে। আসলে সে কি পারবে, এই কয়েক দিনের মধ্যে তার ভেতরে যে বিজ বপিত হয়েছে, তা ধরে রাখতে?’
খুব ধীরে উঠে দাঁড়ায় সুলতানা। নিস্বীম অন্ধকারে যেন ডুব গেছে ঘর। চারপাশ জুড়ে নিষেধাজ্ঞার হিসহিস। দ্বিধায় আরষ্ঠ হয়ে আসে পা। ভারাক্রান্ত শরীসৃপের মতো ধীরে এগুতে থাকে সে। বুক ঘসে ঘসে। কুঁচি ভাঙা শাড়ীটা তার পায়ের ধাক্কায় খানিক ছড়িয়ে যায়। আবার ভাঁজ পরে। শাড়ীটার প্রতি তার অদ্ভুত মায়া লাগে। তার চেয়ে বরং দুঃখ ও ঘৃণা হয় নিজের প্রতি। এতসব কথার পর তাকে এখন শাড়ী বদলে মালয়শিয়া থেকে এনে দেয়া ঢুলঢাল নাইট ড্রেসে পান্নু মৃধার বাহুতে আবদ্ধ হতে হবে। তার রতিক্রিয়া সহ্য করতে হবে। গা ঘিন ঘিন করে উঠে তার। হাঁটতে হাঁটতে সে দরজার একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়। ওপাশের দরজা খুলে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে পান্নু মৃধা। ঘরের বাতিটা জ্বালেনি সে। আবছা অন্ধকারে তার চেহারা খুব বেশি বোঝা যায় না। মনে হয়, উদাম শরীরের আঠাশ বছরের কোনো যুবক। খাটের উপর বিছানা টানটান করে পাতা। আসন্ন সঙ্গমে আন্দোলিত হচ্ছে চারপাশ। খাটের রেলিংয়ে সাদা নাইট ড্রেসটা ঝুলছে। দেখে সুলতানার ভেতরটা হু হু করে কেঁদ উঠে। তার কাছে মনে হয়, যেন কোন এক মাঝ বয়সি নারী ফাঁস নিয়ে ঝুলে আছে।০
লেখক পরিচিতি
অলাত এহ্সান
জন্ম ঢাকা জেলার অদূরে নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। কঠিন-কঠোর জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। পড়াশুনা করেছেন সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ ও ঢাকা কলেজে। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। প্রবন্ধ লিখেন। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ব ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে।০
খাবার টেবিলে জ্বলা মোমবাতির আগুনটা একবার বাম দিকে, একবার ডানদিকে কাত হয়ে যায়। দেখে মনে হয় টেবিলের দুইপাশে বসা মানুষ দু’টো আগুনকে একেবারে অস্বীকার করে একজন আরেক জনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিংবা তা দখলে নেয়ার জন্য অশ্লীলভাবে রশি টানাটানি করছে। আগুনের শিখার সময় সময় এক পাক ঘুড়ে থেবড়ে যাওয়া দেখে মনে হয়, কয়লার আগুনে পোড়া গণগণে লোহা ফাইলের উপর রেখে দু’জন কামার বেধড়ক পেটাচ্ছে। মোম একটাই জ্বলছে টেবিলে। নৈশ্বব্দের এই নৈশভোজে অংশ গ্রহণ করা বড় দুই জন ছাড়াও যে শিশুটি খাবার খাচ্ছে, তার শিশুতোষ উচ্ছাস এখন স্তিমিত। খানিক আগে ছিল। তখন বৈদ্যুতিক বাতিও ছিল। তখন কাঁচের বাসন-কোষণের উচ্চ শব্দ করে নড়াচড়ার মতোই গমগম করে কথা হচ্ছিল। এখন শুধু প্লেটে চামচ টানার সরসর কিংবা টুংটাং শব্দ। নিস্তবদ্ধতায় সব কিছু একদম জমে যাওয়ার আগে পান্নু মৃধার কন্ঠের শব্দ হয়। ঢক ঢক করে পানি পানের শব্দ। জজের টেবিলে কাঠের হাতুড়ি ঠুকে পুরো ঘরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার মতো, টেবিলে পানির গ্লাস রাখার শব্দে সে এবার নির্দেশ দেয়, ‘তুমি আর ওখানে যাবে না। ওসব তোমার দরকার নেই। আর তোমার ঐখানে আর যাওয়া লাগবে না। আমি ইডি (ইক্সক্লুসিভ ড্রিরেক্টর) মঞ্জু সাহেবকে বলে দেবো।’
সুলতানা কোনো উত্তর দেয় না। সুপের বাটিতে দেয়া চুমুক তার নিঃশব্দতা ও দীর্ঘায়িতা নিয়ে সম্পন্ন হয়। সে এ নিয়ে এতোক্ষণ অনেক কথা বলেছে। খুব ক্লান্ত অনুভব করে। তর্কের নিঃসফলতা নিয়েও সে তার সন্দিহান নয়। তাই খান্তি দিয়েছে। সে জানে আপাত নিরীহ ও গম্ভীর প্রকৃতির মানুষটি গন্ডারের মতো কি রকম হিংস্র হতে পারে। নির্লজ্জের মতো নাকের উপরের শিং দিয়েই আশ্রয়ের শেষ গাছটাও চিড়ে-ফেঁড়ে ফেলতে পারে। তখন উন্মূল মানুষের মতো পাতার ছায়ায় আশ্রয় টুকুও থাকবে না।
শিমুলের ইতোমধ্যেই খাওয়া শেষ। সুলতানা তার দিকে তাকাতেই শিমুল উঠে আরোপিত পায়ে শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। সুলতানা তাকে পেছন থেকে অস্ফুট বলে, ‘তুমি গিয়ে শো, আমি আসছি।’ চোখ ফেরাতেই দেখে পান্নু মৃধা তার দিকে তাকিয়ে আছে। কামুক আর ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে। হাতের চামচ দু’টো নামিয়ে রেখে টিস্যুতে মুখ মুছে। শিমুলের উল্টো দিকে শোবার ঘরের দিকে রওনা দেয়। এটা সুলতানা ও পান্নুর একান্ত ঘর। যেতে যেতে শুধু বলে, রাত অনেক হয়েছে। পোশাক পড়ে রুমে আসো। আমি ক্লান্ত।’
সুলতানা কি তবে পোশাক পড়ে নি? তার খেয়াল হয়, সে এখনো শাড়ীটা পড়েই আছে। প্রতিদিনকার মতো বাসায় এসে গ্রাউন বা নাইট ড্রেস পরেনি। শাড়ী সে সব সময়ই পরে, বাইরে যেতে, অফিসের কাজে যেতে। কিন্তু শাড়ীটা আজ আলাদা পোশাক মনে হয়। সব চেয়ে আলাদা লাগে পান্নু মৃধার আচরণ। শুধু মাত্র শাহবাগে যাওয়ার জন্য সে এ ভাবে ক্ষেপে উঠবে, তা সুলতানা চিন্তাও করেনি। আট দিন পর স্বামীকে কাছে পাওয়াও তার বিষম খায়। যদিও তার আরো সপ্তাহ খানেক পরে বাড়ি ফেরার কথা ছিল তার। তবু সুলতানার মনে এ নিয়ে কোনো তরঙ্গ তৈরি হয় না। এক সময় হতো। সে সব ভাবতে গিয়ে সে যারপরনাই বিস্মিত হতে হয়। পান্নু মৃধার হেঁটে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে সে কথাই ভাবে সুলতানা। ভাবতে থাকে পরিচয় থেকে আজকের দিনের সংসার পর্যন্ত জীবনের খতিয়ান।
সুলতানা তখন ইডেন কলেজে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের পড়ে। সমাজ কর্ম বিভাগে। আর টিএসসি’র এক আবৃতি সংগঠনের সদস্যা। সংগঠনের সমন্বয়ক বড় ভাই মাসউদের বন্ধু পান্নু মৃধা। তখন মাস্টার্সে পড়ে। সেও সমাজ কর্মে। আবৃতির সাথে সম্পৃক্ত না থাকলেও সে পাঠচক্রে প্রায়ই আসে। সে খানেই পরিচয় দু’জনের। সংগঠনের বড় ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে যেচে পড়ে উপদেশ দেয়ার এখতিয়ার তার আছে। তাছাড়া, একই বিভাগের ছাত্র হওয়ায় বড় ভাইয়ের কাছ থেকে একটু আধটু দিক নির্দেশনা সুলতানার অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। তারপর সুলতানার সংকটের সময় তাকে একটি টিউশনি দিয়ে পরম উপকার করেছে। সেখান থেকেই দু’জন দু’জনার প্রতি যে অনুরক্ত তা পরিস্কার হয়ে যায়। ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিকে গড়াতেও সময় লাগে নি।
পান্নুর সাথে তার সম্পর্কের জের ধরে আবৃতি সংগঠনের সমন্বয়ক বড় ভাই মাসউদ তাকে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় দেয়। সংগঠন থেকে যে সাহিত্যপত্র বের হয় সেখানে তাকে সম্পাদনা পরিষদে রাখে। কয়েকটি কবিতাও স্থান পেয়েছে। তখন সুলতানার উর্বশি মনে সাহিত্যিক হওয়ার চিন্তা দু’চারবার উঁকি যে দেয় নি, তা নয়। কিন্তু তার বিস্তার সময় ভরে গেছে, পান্নুর সাথে এখানে সেখানে আড্ডা দিতেই। প্রথমে অনিচ্ছা ছিল, তা সত্বেও সম্পর্কের জের ধরে সে কয়েক বার পান্নুর বন্ধুদের মেসে গেছে। সেসব মেসে তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও হয়েছে বেশ কয়েক বার।
পান্নু বোঝাতো- মনে যদি দূরত্ব না থেকে তাহলে শরীরের দূরত্ব কিসের? সম্পর্কের পূর্ণতা আনতে বা সকল দূরত্ব ঘোঁচানোর জন্যই শারীরিক সম্পর্ক দরকার। পারস্পারিক বিশ্বস্ততার থেকেই এ সম্পর্ক। সুলতানা ভয় পেয়েই গিয়েছিল। কিন্তু পান্নু সে রকম নয়, বেশ দায়িত্বশীল।
পান্নু তখন শেয়ার বাজারে নতুন বিনিয়োগ করছে। তারপর সম্পর্কের চার বছরের মাথায় সুলতানাকে যখন বিয়ে করে। তখন তার যথেষ্ট টাকা। দক্ষ বিনিয়োগকারী। ছিয়ানব্বইতে শেয়ার বাজারে যখন ধস নামলো সুলতানা তখন তারে উপরে উঠতে দেখেছে। সে সময়ই দেশের বড় বড় আমলা-মন্ত্রীদের সাথে তার দারুন যোগাযোগ।
সুলতানা সবচেয়ে বিস্মিত হয়ে যেত যখন দেখতো, পান্নুর কথা আর সরকারি প্রেস নোটে প্রায় একই বক্তব্য। ছিয়ানব্বইয়ের পর থেকে সে আসতে আসতে আমদানি-রপ্তানির দিকে ঝুঁকেছে। গতবার যখন বিশ্ব বাজার-দেশের শেয়ার বাজারে ধস নামলো তখন তার হাতে আসে বিপুল টাকা। তখন সুলতানার নামেও একটা একাউন্ট হয়েছে। অবশ্য তাতে দৈনিক কত টাকা লেনদেন হয়, তা সে কিছুই জানে না। ক্রেডিট কার্ডও তার কাছে নেই। তবে কখনো বড় অংকের টাকা তোলার দরকার হলে তাকে চেক স্বাক্ষর করে দিতে হয়।
এখন একটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চেষ্টা করছে পান্নু। একজন্য তাকে প্রায়ই দেশের বাইরে যেতে হয়। থাকতে হয়। বিয়ের পর প্রথম প্রথম সুলতানাকে একাই থাকতে হতো। তখন সুলতানা চাকুরির কথা বলতো। কিন্তু পান্নু তাতে কিছুতেই রাজি হয় নি। তারপর শিমুলের জন্ম। সুলতানা বুঝে, শিমুলের জন্ম তখন নেতাত সন্তান প্রীতি বা দায়িত্ব বোধ কিংবা রতিক্রিয়ার ফল ছিল না। এর মধ্য দিয়ে পান্নু তাকে চাকুরি চাওয়ার এক প্রকার জবাব দিয়েছে।
সুলতানা সে দিনই বেশি অবাক হয়েছিল, যখন পান্নু নিজেই তাকে একটি চাকরির কথা বললো। ততদিনে ঢাকায় তাদের বাড়ি হয়েছে। গাড়ি হয়েছে, তারপরও চাকরি। চাকরিটা একটা এনজিওতে। নারী ও শিশু নির্যাতন বিরোধী এনজিও। পরে বুঝেছে, এটা পান্নুর এক ব্যবসায়িক পাটনারের এনজিও। পাটনারের স্ত্রীই এর প্রধান। সুলতানা আকারে প্রকারে বুঝেছে, এখানে পান্নুরও একটা অংশ আছে। সুলতানা ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছে, এই চাকরির মধ্যদিয়ে যে আরেক দফা পান্নুর হাতে বন্দি হলো। এর মাধ্যমে পান্নুর কাজ কর্ম, কোথায় কি করে—এসব সম্পর্কে জানার অধিকার হারাতে শুরু করেছে। পান্নুর সমাজের উপযোগি করে তুলেছে। তার মানে, কখনো বাড়িতে তার ব্যবসায়িক পার্টনারদের সাথে ড্রিংস পার্টি তাকে সহ্য করতে হবে। প্রয়োজনে কখনো বাসাটা একটু খালি করে দিতে হবে। বা সাদরে অংশ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে। সুলতানার এখন এই সব কান্ড কিংবা একাকিত্ব গা সওয়া হয়েছে।
সুলতানার ব্যতিব্যস্ততা এখন শুধু শিমুল আর এনজিও নিয়ে। তার এনজিও এখন দেশের লিডিং এনজিওগুলো একটা। নারীদের শারীরিক-মানসিক নির্যাতন ও বৈকল্য নিয়ে অনেক কিছুই করেছে। কিন্তু এই সব চিন্তা তার ক্ষেতে কতটা প্রযোজ্য, তা নিয়ে একেবারে চিন্তা করতে চায় না। তাতে তিক্ততা-রিক্ততা দুই-ই বাড়বে। তার চেয়ে সে বরং নারী ও শিশুর জন্য কিছু করছে, প্রকারান্তে সমাজের জন্য কিছু করছে—এই তৃপ্তি টুকু নিতে চায়। কিন্তু সে চিন্তাতেও এখন ফাঁটল ধরেছে। এটা বছর দুই আগে তার পরিবারের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া একটা দূর্ঘটনা কেন্দ্র করেই।
সেদিনও পান্নু মৃধা বিদেশ থেকে সবে এসেছে। সন্ধ্যার পর। এসেই বললো, ঘর দোড় পরিষ্কার না কেন? কাজের লোক সব করে কি? কই, সবই তো পরিষ্কার, সকালেই কাজে লোক সব পরিষ্কার করেছে। পর দিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় পান্নু মৃধা হাক-ডাক দিয়ে উঠে, বিদেশ থেকে আনা দামী লাইটার কোথায়? কোথাও পাচ্ছে না। বাড়ির তের বছরের কাজের ছেলেটাকে সাব্বস্ত করে নানান ধমক ধামকি আর চড়থাপ্পড় করা হয়। তারপর বুট জোড়া রাতে পরিষ্কার না করার জন্য ছেলেটাকে আরেক দফা যা-তা বকাঝকা করা হয়। ছেলেটা যখন বুট পলিশ করছে তখনও তাকে ছোটজাত-চোর-বেজম্মা ইত্যাদি বলে গালাগালি চলছিল। এক সময় ছেলেটা ফুঁপসে উঠে, ‘বেজম্মা আমরা না আপনেরা। এই বাইত্তে কি অয় তা বুজি না, ন্যা? চোর আমরা না। দুই ট্যাহার জন্নি কত দুশ, মাইনসে যে কুটি কুটি ট্যাহা চুরি করে, পুলিশ খুঁজে, হ্যাগো দুশ নাই?’
পান্নু মৃধাকে একবার পুলিশে খুঁজে ছিল বটে। তবে ওই টুকুই। সেও অনেক দিন আগে। কাজের ছেলেও আসারও অনেক দিন আছে। সে হয়তো অনুমানে বা ভুল করে বলে ফেলেছে। কিন্তু কথাটা শোনার পর সে আর এক মুহুর্তও সময় দেয় নি। একটা কষে চড় মাড়লে দো’তলা থেকে একদম সিটকে নিজ তলার মেঝেতে। গরীবের কাহেল শরীরের মতো প্রাণটাও দূর্বল। ফ্লোরে পড়েই মর মর কোকানি শুরু হয়ে যায়। সুলতানাও তখন অফিসে যাওয়ার জন্য ঘরের ভেতর তৈরি হচ্ছিল। এই নিয়েই তার এনজিও। দেখেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলে। ছেলেটিকে ভাল একটি হাসপাতালে ভর্তি করা, মিডিয়া ঠেকানো, থানা মিটানো—সব কিছু নিজেই করেছে। তারপরও দু’একটা ছোটখাট পত্রিকায় এ নিয়ে সামান্য রিপোর্ট হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালে ছেলেটা মারা যাওয়ার পর কোনো পত্রিকায় এ নিয়ে কিছুই লেখা হয় নি। সে নিজে ছেলেটার বাবা-মা’র হাতে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে বিষয়টা সুরাহা করেছে। অবশ্য টাকা তার স্বামী পান্নু মৃধাই তাকে দিয়ে ছিল। সেই কিছু দিন সুলতানা তার স্বামীকে তার মুখাপেক্ষি ও কাতর হতে দেখেছে। সুলতানা তখন মনে হয়েছে, তার পেশা জীবন কারো না কারো চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে। সমাজ সেবার তৃপ্তি সে দিন থেকে আর নেই।
অনেক দিনপর জামা-কাপড় গোছাতে গিয়ে যখন লাইটারটা সেদিনের কোর্টের পকেটেই পেয়েছিল, তখন সুলতানার চোখে আবার ছেলেটার মা’র কান্নার দৃশ্যটাই বারবার ভেসে উঠেছে। তার মনে পড়ে, তাদের অফিসের সবচেয়ে তৎপর শাখা, সেই উত্তর-বঙ্গ থেকে সে নিজে ছেলেটিকে নিয়ে এসেছিল। ভরণ পোষণ ও পড়াশোনা করাবে বলে। কিন্তু তাকে মেরেফেলেছে। কথাটা ভাবতেই নিজে দারুন অপরাধী মনে হয়েছে।
এখন পান্নু মৃধার ফার্মর থেকেও বৎসরে বেশ কিছু টাকা তার এনজিওকে দিয়ে থাকে। সে কথাই আজ পান্নু মৃধা কথায় কথায় মনে করিয়ে দিল। শেষ পর্যন্ত সুলতানা তার শাহবাগের আন্দোলনে যাওয়াটকে শ্রেফ অফিসিয়াল ব্যাপার বলে দাঁড় করাতে চেয়ে ছিল।
হ্যা ’৭১-এ যেহেতু দুই লাখ নারী ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং অসংখ্য নিরীহ নারী-শিশু হত্যা কান্ডের শিকার হয়েছিল। আর এর সাথে রাজাকার-আলবদার-আলসামস-জামাত-শিবির জড়িত। তাই এদের ফাঁসির দাবিকে তারা অফিসিয়ালি সমর্থন দিচ্ছে। অংশ গ্রহণ করছে।’ কিন্তু পান্নু মৃধা এসব শোনার মানুষ নয়। কথার শুরুতেই থামিয়ে দিয়ে বলে,‘তোমাদের অফিস কোথায় থেকে কয় পয়সা পায় আর কি করে তা জানি। ওসব আমাদের বোঝাতে এসো না। গ্রামের বোকা মহিলাদের বোঝিও। আমি যা বলছি তাই কর।’ সুলতানা এতক্ষণ নীতি-নৈতিকতা-আন্দোলনের যৌক্তিকতা অনেক কথা বলেছে। সে আবারা অফিসের বাধ্যবাধকতা বোঝাতে চায়। তবে এতো মাঠা ঘেটে মাখনের জন্য অপেক্ষা করার জন্য পান্নু মৃধা রাজি না। এতে তার রাগ আরো বেড়ে যায়। সে সব সময় দেখে এসেছে, মাঠা যতই হোক, মাখন তার উপর ভাসে। তাই সে নিগূড় কথা বলে দেয়,‘তোমার অফিসের বিষয়টা আমাকে বোঝাতে এসো না। অমন অফিস দাতারা চাইলে মুহুর্তে জন্ম হতে পারে। মরতেও পারে। ওখানে কে কিসের ধান্দায় যায়, তা জানি। যতসব ধান্দাবাজি...’ কথা বলতে বলতে কি এক ঘৃণা আর ক্রোধ থেকে হয়তো, অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ছিল। সে আরো ক্ষিপ্রতা নিয়ে মুখ ফেরায়। ‘আর টাকা বন্ধ হয়েগেলে এই সব ভাল কথার বলার একজনও পাবে না। তোমার অফিসও কাল থেকে ওখানে যাবে না। যা বলছি শোন। নিজে তো গেছই, ছেলেটাকেও সাথে নিয়ে গেছ।’
একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে স্তিমিত হয় সুলতানার বুক। মোমবাতির লালচে আলোয় পাশ থেকে শিমুল, ভেঙচি কাটার মত দাঁতাল মুখ আর চোয়ালের ক্রমাগত ওঠা-নামা দেখে। চরম কথা এতো ক্ষণে পান্নুর মুখে শোনা যায়। ‘ঐ জাগরণ-ফাগরণ বাদ দাও। অতো মাতামাতি করো না। যাদের বিচার চাইছে তাদের ফাঁসি হলো তোমরা না খেয়ে মরবে। তোমার অফিস বন্ধ হয়ে যাবে।’ অনেক বেশি নির্দেশ দানের মতো কথা বলে পান্নু। আঙুলের ফাঁকে আটকে থাকা চামচটা যেন হাঁতুড়ির মতো এক একটি গজাল ঠুঁকে দিচ্ছে।
‘বোঝো না, আর সব এনজিও বিদেশী ফান্ডের জন্য ফ্যা ফ্যা করে ঘুরের বেড়ায়, আর তোমরা প্রতিবারই বড় ফান্ড পাও। তা ফুরালেও কেন অসুবিধা হয় না। বোঝো না?’ বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে যায় পান্নু মৃধা। চেয়ারের হেলান থেকে অনেকটাই এগিয়ে আসে। ভয়ংকর দৃঢ় ভাবে বলে উঠে,‘ওখানে অতশত লোকের কথা বাদ দাও। ওখানে একটা বোম ফুটলে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আর..’ দারুন উত্তেজনায় উঠা-নামা করতে করতে ডান হাতে পড়া ঘড়িটা পানির জগের মাথায় লেগে শব্দ করে উঠলে মাঝ পথেই কথায় দম দেয় সে। সে দিকে সামান্য চোখ ফেরায় শুধু। তার কথার মাঝে প্রচন্ড ক্ষোভ আর ঘৃণা। সুলতানার মুখের দিকে তাক করা তর্জনীটা হার্টবিট রিডারের মতো উঠা-নামা করছে। যেন তার কপালে অমঘ কিছু একটা লিখে দিতে চায়। ‘ওখানে গিয়ে এতো লোকের সামনে যেমন কর, তা কি কোনো ভদ্র লোকের স্ত্রী করে? মিডিয়ার সামনে যেসব কথা বল, একবার টার্গেটে পড়েগেলে তোমাদের বাঁচানো যাবে? তোমরা না গেলে তাতে কারো কিচ্ছু হবে না।’ ভদ্রলোকের স্ত্রী করে কি না এটা যেমন, পান্নু মৃধা আদৌ ভদ্রলোক কি না সে আরেক প্রসঙ্গ। এবার সুলতানা বুঝতে পারে, পান্নু তাকে টেলিশনে দেখে ক্ষেপতে ক্ষেপতে দেশে এসেছে। তবে তার উদ্বেগ দেখে আতঙ্কিত হয় সুলতানা। ‘এই হত্যাকান্ড-বোমাবাজির সাথে কি তবে...’ সুলতানা আর ভাবতে পারে না। শুধু নির্ভারের মতো আওড়ায়—‘সত্যি, সে না গেলে শাহবাগের কিছুই হবে না। যেমন নেই পান্নু মৃধারা। তবুও সেখানে মানুষের অভাব পড়ছে না। প্রতিদিনই কত কত নতুন মুখ আসছে। দেশের আনাচে কানাচে, প্রত্যন্ত জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে আন্দোলন। পরাজিতের মতো সে-ই শুধু পরে থাকবে ঘরে, টিভি সেটের সামনে। কিন্তু তার কারণে যদি শিমুলের ক্ষতি হয়, যে আজও নেচে নেচে ¯েøাগান দিয়েছে। যদি মেরে ফেলে তাকে? তবে সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে কি? এই ঘরের তলেই বা থাকবে কি করে? অথচ শিমুল, বেচারা, যে এই ঘর আর স্কুলের চারদেয়াল, কম্পিউটার গেমস্ আর টিভি সেটের বাইরে এই প্রথম এক রোমাঞ্চের সাথে পরিচয় হয়েছে। আবার তাকে পুরনো ধাঁধাঁয় ঘোরপাক খেতে হবে। আসলে সে কি পারবে, এই কয়েক দিনের মধ্যে তার ভেতরে যে বিজ বপিত হয়েছে, তা ধরে রাখতে?’
খুব ধীরে উঠে দাঁড়ায় সুলতানা। নিস্বীম অন্ধকারে যেন ডুব গেছে ঘর। চারপাশ জুড়ে নিষেধাজ্ঞার হিসহিস। দ্বিধায় আরষ্ঠ হয়ে আসে পা। ভারাক্রান্ত শরীসৃপের মতো ধীরে এগুতে থাকে সে। বুক ঘসে ঘসে। কুঁচি ভাঙা শাড়ীটা তার পায়ের ধাক্কায় খানিক ছড়িয়ে যায়। আবার ভাঁজ পরে। শাড়ীটার প্রতি তার অদ্ভুত মায়া লাগে। তার চেয়ে বরং দুঃখ ও ঘৃণা হয় নিজের প্রতি। এতসব কথার পর তাকে এখন শাড়ী বদলে মালয়শিয়া থেকে এনে দেয়া ঢুলঢাল নাইট ড্রেসে পান্নু মৃধার বাহুতে আবদ্ধ হতে হবে। তার রতিক্রিয়া সহ্য করতে হবে। গা ঘিন ঘিন করে উঠে তার। হাঁটতে হাঁটতে সে দরজার একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়। ওপাশের দরজা খুলে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে পান্নু মৃধা। ঘরের বাতিটা জ্বালেনি সে। আবছা অন্ধকারে তার চেহারা খুব বেশি বোঝা যায় না। মনে হয়, উদাম শরীরের আঠাশ বছরের কোনো যুবক। খাটের উপর বিছানা টানটান করে পাতা। আসন্ন সঙ্গমে আন্দোলিত হচ্ছে চারপাশ। খাটের রেলিংয়ে সাদা নাইট ড্রেসটা ঝুলছে। দেখে সুলতানার ভেতরটা হু হু করে কেঁদ উঠে। তার কাছে মনে হয়, যেন কোন এক মাঝ বয়সি নারী ফাঁস নিয়ে ঝুলে আছে।০
লেখক পরিচিতি
অলাত এহ্সান
জন্ম ঢাকা জেলার অদূরে নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। কঠিন-কঠোর জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। পড়াশুনা করেছেন সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ ও ঢাকা কলেজে। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। প্রবন্ধ লিখেন। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ব ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে।০
0 মন্তব্যসমূহ