চিনুয়া আচেবে
অনুবাদ: মেহেদী হাসান
ম্যাডাম, এই দিকে-- ফাঁপানো পরচুলাপরা
মেয়েটি সুপার মার্কেটের এক সারি ক্যাশ মেশিনের একটিতে মনোনিবেশ করতে করতে আহ্বান জানাল।
মিসেস এমেনিকে তার বাজার ভর্তি ট্রলিটি হালকাভাবে ঘুরিয়ে মেয়েটির দিকে নিয়ে আসল।
ম্যাডাম, আপনি তো আমার দিকে আসছিলেন--পার্শ্ববর্তী
মেশিনের সম্মুখে বসা বঞ্চিত মেয়েটি অভিযোগ তুলল।
ওহহ, আমি আসলেই দুঃখিত, আরেক সময়
আসব।
শুভ সন্ধ্যা, ম্যাডাম--মিষ্টি কণ্ঠের
মেয়েটি সম্বোধন জানায় যে ইতিমধ্যেই ট্রলি খালি করে জিনিসপত্রগুলো তার কাউন্টারে সাজাতে
শুরু করেছে।
নগদ টাকা দিবেন নাকি আপনার একাউন্ট
থেকে কেটে রাখব, ম্যাডাম?
নগদ টাকা।
মেয়েটি খুব দ্রুত টিপটিপ করে আলো
জ্বালার সঙ্গে সঙ্গে বোতাম চেপে প্রত্যেকটা জিনিসের আলাদা আলাদা মূল্য মেশিনে প্রবেশ
করায় এবং মোট মূল্য ঘোষণা করে। নয় পাউন্ড পনের সেন্টস। মিসেস এমেনিকে তার হাতব্যাগটি
খুলে ভেতর থেকে একটি ওয়ালেট বের করে ওটার জিপার খুলে চকচকে এবং কড়কড়ে দুখানা পাঁচ পাউন্ডের
নোট বের করে মেয়েটির সামনে মেলে ধরে। মেয়েটি পুনরায় আরেকটি বোতামে চাপ দিতেই মেশিনটি
খুচরা টাকা ভর্তি একটি ট্রে বের করে দেয়। মেয়েটি ম্যাডামের দেওয়া নোট দুটি অনত্র সরিয়ে
রেখে বাকি খুচরা টাকা ও লম্বা একটা ফর্দ তার হাতে তুলে দেয়। মিসেস এমেনিকে লম্বা ফর্দটির
নিচের দিকে একনজর তাকাতেই দেখতে পায় সভ্য মেশিনটি তার খরচের মোট পরিমাণের পাশে- 'ধন্যবাদ
আবার আসবেন' কথাটি লিখে দিয়েছে।
প্রথম গোলযোগটা লাগে সেই মুহূর্তেই।
ম্যাডামের বাজারগুলো একটা কার্টনে ভর্তি করে, বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা তার প্রাইভেট কারের
কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য আশপাশে কাউকেই খুঁজে পাওয়া গেল না।
ছেলেগুলো যে কোথায় থাকে? মেয়েটির
কথায় বিষণ্নতার সুর ফুটে ওঠে। মাফ করবেন, ম্যাডাম। আমাদের এখানে কাজ করত এমন অনেক কুলি
ছেলেই বিনা বেতনে প্রাথমিক শিক্ষার কথা শুনে ভেগে গেছে! এখনও টিকে থাকা কয়েকজনের মধ্যকার
একজনকে দেখতে পেয়েই সে হাঁক দিল, এদিকে আসো, ম্যাডামের জিনিসগুলো বাঁধাছাঁদা করে ফেল
তাড়াতাড়ি।
অনেকটাই ন্যুজ হয়ে পড়া চল্লিশ বছর
বয়স্ক জন, এমনকি শীতাতাপনিয়ন্ত্রিত সুপার মার্কেটের আরামদায়ক পরিবেশের মধ্যেও ঘেমেনেয়ে
উঠেছে। জিনিসপত্রগুলোকে একটি খালি কার্টনের মধ্যে ভরার সময় সে জোরে জোরে হাঁপাতে থাকে।
আমি বলি কি, এই ধরনের কাজের জন্য
তোমাদের ম্যানেজারের উচিত আরও বেশি করে লোক নিয়োগ করা।
আপনি কি এখনও শোনেননি যে, সকলেই
বিনা বেতনে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে?- পরচুলা পরা মেয়েটি উৎফুল্লতার
সঙ্গে জিজ্ঞেস করে।
তা ঠিক বলেছ। কিন্তু তাই বলে বিনা
বেতনে প্রাথমিক শিক্ষার খাতিরে তো আর নিজেকে মেরে ফেলতে পারি না।
সে কার্টনটিকে বহন করে বাইরে নিয়ে
এসে গাড়ি পার্কিংয়ে মিসেস এনেমিকার ধূসর রংয়ের মার্সিডিজ ব্রেঞ্জ গাড়িটির পেছনে মাল
রাখার জায়গায় রেখে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত মিসেস এনেমিকা
প্রথমে তার হাতব্যাগ ও পরে ওয়ালেট খুলে খুচরো পয়সাগুলো হাতড়িয়ে তিন পেনির একটা পয়সা
খুঁজে না পায়, দুই আঙুলের চিপায় পয়সাটাকে বের করে সে কুলির হাতে ছুড়ে দেয়। লোকটি কিছুক্ষণ
ইতস্তত করার পর কোনো দ্বিরুক্তি না করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে যায়।
মিসেস এমেনিকে ছোট ছেলেগুলোর বিকল্প
হিসেবে নিযুক্ত এই বুড়ো লোকগুলোকে কখনও তেমন একটা পাত্তা দেয় না। তুমি তাদের যত কিছুই
দাও না কেন তাদের কখনও পরিতৃপ্ত মনে হবে না। দেখো দেখো, খোঁড়াটা ক্ষোভে কেমন বিড়বিড়
করছে। এই ছোটখাটো কার্টনটি সামান্য পথ বহন করে নিয়ে আসতে কত টাকাই যে সে প্রত্যাশা
করে? বিনা বেতনে প্রাথমিক শিক্ষা তো এগুলোই আমদানি করছে! বাসাবাড়ির জন্য তো আরও কাহিল
অবস্থা ডেকে এনেছে। এই শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে মিসেস এমেনিকে তার ছোট বাচ্চাটি
দেখাশোনা করার মেয়েটিসহ তার তিন-তিনটি চাকরকে খুইয়েছে। বাচ্চা দেখাশোনা করার মেয়েটি
না থাকাটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাতমাস বয়সের একটা ছোট বাচ্চাকে নিয়ে একজন
চাকুরিজীবী নারীর কীই-বা করার থাকতে পারে?
যাহোক সমস্যা বেশি দূর গড়াল না।
বিনা বেতনে প্রাথমিক শিক্ষা তার একটি মাত্র টার্ম পার করতে না করতেই সরকার ঋণগ্রস্ত
হয়ে পড়ার ভয়ে পরিকল্পনাটি প্রত্যাহার করে বসল। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়
প্রাথমিকভাবে আট লাখ শিক্ষার্থীর জন্য পরিকল্পনা এঁটেছিল। বাস্তবে পা পড়তেই দেখা গেল,
দেড় মিলিয়ন শিক্ষার্থী উঠে এসেছে স্কুল খোলার প্রথম দিনেই। বাদবাকি এতগুলো শিক্ষার্থী
আসল কোথা থেকে? বিশেষজ্ঞরা কি সরকারকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে?--হিসেবে ভুল হয়েছে?- এমন
কথা বলা আহাম্মকি ছাড়া আর কিছু নয়। মূল সমস্যাটি হল; কিছু ঠগ, জুচ্চোর, বাটপার লোকজন
প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে হাজার হাজার শিশুকে নিয়ে এসে ছলচাতুরির মাধ্যমে তাদের নথিভুক্ত
করেছে, এগুলো স্পষ্টতই অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা।
এই কথাগুলো বলে প্রধান পরিসংখ্যানবিদ
এক বেতার সাক্ষাৎকার দিলেন।
কারণ যাই হোক, সরকার এই পরিকল্পনাটিকে
বাতিল করে দিল।
দৃঢ় বক্তব্য রাখা ও সাহসী পদক্ষেপ
নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করে নবযুগ পত্রিকাটির সম্পাদকীয় লেখা হল ঠিকই,
কিন্তু যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে দেখিয়ে দেওয়া হল যে প্রথমদিকেই যদি জ্ঞানী ও দায়িত্ববান
সুশীলসমাজের সতর্কবার্তায় কর্ণপাত করা হত, তাহলে এই পুরো দুঃখজনক পরিণতিকে এড়িয়ে চলা
যেত। যা যথেষ্ট সত্যই ছিল বলতে হয়, সুশীল সমাজের লোকজন এ জন্যই বিনা বেতনে প্রাথমিক
শিক্ষা সমন্ধে তাদের সন্দেহ ও বিরুদ্ধমনোভাব স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করে আসছিল নবযুগ পত্রিকার
পাতায় পাতায়। পত্রিকাটি, এই বিষয়ে পাঠকদের মুক্তমত প্রকাশের জন্য কয়েকটি পাতা ছেড়ে
দিয়েছিল, বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, এটা করা হচ্ছে জাতীয় স্বার্থের খাতিরে এবং ব্যাপারটিকে
বিবেচনা করেছিল বিশদ আলোচনা সাপেক্ষ বলে, চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল সেই সমস্ত সমালোচকদের
প্রতি, যারা মনে করে বৈদেশিক পুঁজির সমর্থনপুষ্ট একটি পত্রিকার পক্ষে বিষয়টিকে নিয়ে
সামনে আগানো এবং জাতীয় স্বার্থের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ও দেশপ্রেমের প্রতি আনুগত্য দেখানো
কোনো কাজের কথা না, এটা ছিল এমন একটি চ্যালেঞ্জ কোনো সমালোচকই যার মুখোমুখি হওয়ার সাহস
দেখায়নি। মুক্তমত প্রকাশের জন্য জায়গা করে দেওয়া খুব আগ্রহের সঙ্গেই গৃহীত হয়েছিল এবং
টানা দশদিন বিপুল সংখ্যক দায়িত্বশীল নাগরিকদের দিনে দুটি বা তিনটি করে প্রবন্ধ প্রকাশিত
হতে থাকে। এদের মধ্যে ছিল আইনজীবী, চিকিৎসক, শিল্পপতি, বড় ব্যবসায়ী, ছোট ব্যবসায়ী,
প্রকৌশলী, জীবন বীমার দালাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক--এরা সকলেই কিন্তু পরিকল্পনাটির
সমালোচনা করেছিল। শিশুদের জন্য শিক্ষার বিরুদ্ধে কেউ ছিল না যদিও, কিন্তু তারা সকলে
প্রায় সমস্বরে বলে উঠে, বিনা বেতনে প্রাথমিক শিক্ষার পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার মতো উপযুক্ত
সময় এ দেশে এখনও আসেনি। আবার কেউ কেউ বলে বসে, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার এত ধনসম্পদ
ও শক্তি- সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের পরিকল্পনা এখনও হাতে নেয়নি, আর আমরা তো এখনও
কত পিছিয়ে।
মিস্টার এমেনিকে পত্রিকায় এ সমন্ধীয়
বিভিন্ন লেখা বালকসুলভ উত্তেজনা নিয়ে পড়ে যায়--প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও যদি পত্রিকায়
লেখার ব্যাপারে স্বাধীনতা থাকত।
ঐ দশদিনের মধ্যে কম করে হলেও তিনটা
উপলক্ষে এই কথাটি সে তার বউকে শুনিয়েছে।
--এটা মন্দ না, কিন্তু সে যদি উল্লেখ
করতে পারত যে দেশটি স্বাধীনতা পরবর্তীতে বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে গেছে কারণ,
অভিভাবকরা এখন শিক্ষার গুরুত্ব সমন্ধে পুরোমাত্রায় সচেতন। তারা তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার
ব্যয় বহন করতে যে কোনো ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতেও প্রস্তুত। আমরা তো আর অলিভার টুইস্টের
জাতি না।
তার বউ ঐ পর্যায়ে এ ধরনের যুক্তিতর্কে
অংশগ্রহণ করতে মোটেই উৎসাহী ছিল না। কারণ, যে করেই হোক তার মনে হচ্ছিল কোনো কিছুই যেন
নিশ্চিত না, সবকিছুই বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। বিনা বেতনে প্রাথমিক শিক্ষার পরিকল্পনা
সমন্ধে তার ভাসাভাসা, ব্যক্তিগত কিছু সন্দেহ ছিল, এর বেশি কিছু নয়।
--তুমি কি আজকের পত্রিকাটিতে চোখ
বুলিয়েছ? দেখো, মাইক এই বিষয়ের উপর লিখেছে।
অন্য একটি প্রসঙ্গে তার স্বামী
তাকে বলল, -মাইকটা আবার কে?
--মাইক ও গুডু।
--ওঃ আচ্ছা, তা কী লিখেছে সে?
--আমি এখনও লেখাটা পড়িনি। তবে হ্যাঁ,
তুমি মাইককে একজন রূঢ় সত্যবাদী মনে করতে পার। আরে দেখো না, কী বলে সে শুরু করেছে...বিনা
বেতনে প্রাথমিক শিক্ষা নগ্ন সমাজতন্ত্রেরই একধরনের প্রতিফলন?--এই কথাটা যদিও পুরোপুরি
সঠিক নয় কিন্তু মাইকটা বরাবরই এ রকম। সে ভীষণরকম চিন্তিত হয়ে পড়েছে যে তার জাহাজের
ব্যবসাকে জাতীয়করণ করতে কেউ হয়তো এক্ষুনি এসে পড়বে। কমিউনিজমকে তার খুব ভয়।
--কিন্তু এখানে কমিউনিজম আবার প্রতিষ্ঠা
করতে যাচ্ছে কে?
--আরে কেউ না। গত সন্ধায় ক্লাবে
গিয়ে এই কথাটাই তাকে বুঝিয়ে বলেছি। কিন্তু সে খুব ভয় পাচ্ছে। তুমি কি একটা ব্যাপার
জান? টাকা জিনিসটা বেশি থাকা ভালো কোনো ব্যাপার নয়।
তাদের পরিবারের পিচ্চি কাজের ছেলেটা,
বার বছরের সেই উচ্ছল বালকটি যে রান্নার কাজে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করত এবং
বাবুর্চির তত্ত্বাবধানে থাকত, যেদিন এসে জানাল যে তাকে তার অসুস্থ বাবাকে দেখতে যেতেই
হবে, সে দিন থেকেই এনেমিকা পরিবারে আলোচনাটা আর তাত্ত্বিক পর্যায়ে রইল না।
--তুই কীভাবে জানতে পারলি যে তোর
বাবা অসুস্থ?--গৃহকর্ত্রী তাকে জিজ্ঞেস করল।
--আমার ভাই আসছিল বলতে।
--তোর ভাই কখন এসেছিল?
--গতকাল সন্ধ্যায়।
--তো, আমার সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে
আসিস নাই কেন?
--আমি তাকে বলেছিলাম, কিন্তু ও
আসতে চায়নি।
--তাহলে, গতকাল রাত্রেই বলতে কী
হয়েছিল?-- মিস্টার এমেনিকে পত্রিকার পাতা থেকে মুখ তুলে জানতে চায়।
--প্রথমে ভাবছিলাম, যাব না বাড়িতে।
কিন্তু আজকে মনে হল, যাওয়া উচিত; অসুখ মনে হয় অনেক বেশি। তাই বলছি...
--ঠিক আছে। যেতে পারিস। কিন্তু
তোকে কথা দিতে হবে আগামীকাল বিকেলের আগেই ফিরে আসবি, অন্যথা হলে...
--যে করেই হোক কাল সকালের মধ্যেই
চলে আসব।
ছেলেটি সেই যে গেল আর ফিরে আসার
নাম করেনি। মিসেস এনেমিকা বিশেষ করে ছেলেটির মিথ্যা কথা বলার জন্য বেশ রেগে গিয়েছিল।
তার উপর দিয়ে চাকরবাকরদের হাত ঘুরানো সে একদম পছন্দ করে না। দেখো, পিচ্চি বান্দরটা
নিজেকে কেমন চালাক ঠাওরেছে। সে ইদানিং যেমন আচার-আচরণ করতে শুরু করেছিল, এতেই তার সন্দেহ
হওয়া উচিত ছিল। এখন সে পুরো মাসের বেতন পকেটস্থ করে নিয়ে গেছে। তাহলে তো দেখা যাচ্ছে,
এ ধরনের লোকজনের প্রতি দয়া দেখানোর কোনো মানে হয় না।
সপ্তাহ খানেক পর বাগানের মালী তার
চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা আগাম জানিয়ে রাখল। কোনো কিছুই সে লুকানোর চেষ্টা করল না।
তার বড়ভাই তাকে খবর পাঠিয়েছে, বিনা বেতনে প্রাথমিক শিক্ষায় তার নাম লেখাতে সে যেন বাড়িতে
চলে আসে। মালীটির গ্রাম্য নির্বুদ্ধিতা দেখে মিস্টার এমেনিকের হাসি পেল।
--আরে বাবা, বিনা বেতনে প্রাথমিক
শিক্ষা হচ্ছে বাচ্চাদের জন্য। তোর মতো বয়স্ক লোককে সেখানে কেউ ভর্তি করাতে যাচ্ছে না।
আচ্ছা, তোর বয়স কত হল যেন?
--পনের বছর, সাহেব।
--আরে না, তুমি তো তিন বছরের শিশু,--বিদ্রুপাত্মক
ভঙ্গিতে মুখ বেঁকিয়ে মিসেস এমেনিকে বলল, --এখনও মনে হয় স্তন চোষ, যত্তসব।
--তোর বয়স মোটেও পনের বছর নয়, মিস্টার
এমেনিকে বলতে শুরু করল, তোর বয়স কম করে হলেও বিশ বছর হবে, আর কোনো প্রধান শিক্ষকই তোকে
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাবে না। তবে তুই যদি যেতে চাস, যা গিয়ে দেখ, সব রকমভাবেই
চেষ্টা করে দেখ। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসবি। তা হবে না বলে দিচ্ছি, যেতে চাইলে একবারেই
চলে যেতে হবে।
--আমি ব্যর্থ হব না, মালীটি কাচুমাচু
হয়ে বলল, আমার চেয়েও বয়সে বড় আমাদের গ্রামের এক লোক আমার বাবার সঙ্গে গিয়ে ভর্তি হয়ে
গেছে। সে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে গিয়ে তাদের পাঁচ শিলিং দিতেই তারা তাকে বলেছে কোর্ট
তার সঙ্গে কোনো ঝামেলা করবে না। যা হোক, এটা পুরোপুরি তোর ব্যক্তিগত ব্যাপার। তারপরেও
বলি, তুই কিন্তু এখানে ভালোই ছিলি।
--বাদ দাও মার্ক, বেশি কথার দরকার
কী? চলে যেতে চাচ্ছে, সোজা বিদায় করে দাও।
--ম্যাডাম যেন আবার মনে করবেন না
যে আমি এমনিভাবেই চলে যেতে চাই। তবে আমার বড় ভাই।
--আমরা শুনেছি তোর কথা। তুই এক্ষুনি
চলে যেতে পারিস।
--আমি তো আর আজকেই চলে যাচ্ছি না।
অন্তত এক সপ্তাহ আগে জানিয়ে রাখছি শুধু। এবং আমি ম্যাডামের জন্য আরেকটি ভালো মালী খুঁজে
দিয়ে তারপরেই যাব।
--মালী বা এক সপ্তাহ আগে জানানো
সমন্ধে তোকে আর দুঃশ্চিন্তা করতে হবে না। এক্ষুনি চলে যা।
--বেতনের টাকাটা কি এখন দিবেন নাকি
বিকেলের দিকে আসতে হবে।
--কিসের বেতন?
--ম্যাডাম, এই মাসের যে দশদিন আমি
কাজ করলাম সেই কাজের বেতন।
--আমাকে আর বিরক্ত করিস না, ভালোয়
ভালোয় এক্ষুনি বিদেয় হ।
তবে আসল বিরক্তি মিসেস এমেনিকের
সামনে তখনও আসেনি।
আবিগেইল, বাচ্চাটির পরিচারিকা,
দুটি সকাল যেতে না যেতেই সে যখন কাজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন তার কাছে এসে
হয়ে বাচ্চাটিকে তার কোলে ফেলে দিয়েই উড়াল দিল। শেষ পর্যন্ত আবিগেইলও! তার জন্য সে কি
না করেছে। আবিগেইল এসেছিল একেবারে বাচ্চা বয়সে, সে তখন ন্যাংটি পড়ে থাকত, সে এতই নির্বোধ
ছিল যে বাচ্চার কান্না থামাতে পুরো এক বালতি পানি ঢেলে দিত এবং তার নাকের ভেতরেও ফেলত
কয়েক ফোটা। এখন আবিগেইল একজন পরিপূর্ণ যুবতী হয়ে উঠেছে; সেলাই করতে পারে, রুটি বানাতে
পারে, জামার নিচে কাঁচুলি পড়ে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাপড়চোপড় গায়ে চাপায়, গালে পাউডার
মাখে, শরীরে সুগন্ধি লাগায়, চুল আচড়ায়; আর এখন কিনা সে চলে যাওয়ার জন্য এক পায়ে খাঁড়া।
সেদিন থেকেই মিসেস এমেনিকে ‘বিনা
বেতনে প্রাথমিক শিক্ষা’ শব্দটিকে ঘৃণা করতে শুরু করল যা কি না হঠাৎ করে মানুষের নিত্যদিনের
ভাষার একটা অংশে পরিণত হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের লোকজন তো এটাকে এখন আদর করে
“ফিরি শিক্ষা” বলেই ডাকে। লোকজন এটাকে নিয়ে উৎফুল্লতা প্রকাশ করলে সে যারপরনাই রেগে
উঠত এবং তার প্রচণ্ড ইচ্ছা হত বিবেক এবং বিবেচনাবোধের ঘাটতি থাকার অপরাধে তাদের মাথা
ফাটিয়ে দিতে। সে আমেরিকানদের এবং দূতাবাসগুলোকে ঘৃণা করতে শুরু করল (বিশেষ করে আমেরিকানদের),
যারা আশপাশে প্রচুর টাকাপয়সা ঢালছে এবং বাকি থাকা কিছু চাকরবাকরকে আফ্রিকানদের কাছ
থেকে ভাগিয়ে নেওয়ার জন্য নানা ধরনের লোভ-লালসা দেখাচ্ছে। এটা শুরু হল যখন সে জানতে
পারল যে তার বাগানের মালী বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি ঠিকই; কিন্তু চলে গেছে ফোর্ড কোম্পানির
এক কর্মকর্তার বাসায় যে তাকে মাসে সাত পাউন্ড মজুরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি যেমন দিয়েছে,
তেমনি তাকে একটা বাইসাইকেল ও তার বউয়ের জন্য একটা সিঙ্গার সেলাই মেশিন কিনে দিয়েছে।
তারা এমন করেছে কী জন্য? সে জিজ্ঞাসা
করে। যদিও কোনো উত্তর সে চায় না বা কোনো উত্তরে তার প্রয়োজনও নেই, তবে স্বামীটি একটি
উত্তর দেয়, তাতে অবশ্য কারও কিছু যায় আসে না।
--কারণ,--স্বামীটি উত্তর করে,
--আমেরিকাতে ফিরে গিয়ে একজন চাকর রাখার সামর্থ্য খুব সম্ভবত তাদের নেই। সুতরাং তারা
যখন বাইরে এখানে আসে এবং খুব সস্তায় তাদের পেয়ে যায় তখন লোভ সামলাতে পারে না। এ জন্যই
তারা এমন করে।
তিনমাস পর বিনা বেতনে প্রাথমিক
শিক্ষার অবসান হল এবং বেতনভাতা আবার কায়েম হয়ে বসল। সরকার তখন তার --মাথা মোটা বামপন্থী
অংশের ফাঁদে পা দিয়েছিল, নবযুগ পত্রিকাটি সোজাসুজি ঘোষণা দিয়ে বসল, বিনা বেতনে প্রাথমিক
শিক্ষা বর্তমান আফ্রিকান সমাজ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। বামপন্থার প্রতি সমর্থনের
জন্য কুখ্যাত হয়ে ওঠা শিক্ষামন্ত্রীর জন্য এটা একটা উপহাসের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়ে
উঠেছিল এবং বাগ না-মানা অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে তার এই ব্যাপারে সবসময় বাকবিতন্ডা লেগেই
থাকত।
--আমরা এই পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে
যেতে অপারগ, যদি না আমরা নতুন করে কর আরোপ করার প্রস্তুতি গ্রহণ না করি,-- মন্ত্রিসভার
বৈঠকে অর্থমন্ত্রী এভাবেই তার মতামত ব্যক্ত করে।
--ভাল কথা, তাহলে নতুন করে কর আরোপ
করা হোক,--প্রত্যুত্তরে শিক্ষামন্ত্রী জানায়, যা তার সকল সহকর্মীদের জন্য হাসির খোরাক
জোগায় এবং এমনকি মিস্টার এমেনিকের মতো স্থায়ী সচিবও বাদ যায় না, যদিও মন্ত্রিসভার বৈঠকে
এই ধরনের আলোচনায় বা হাসাহাসিতে যোগ দেওয়ার কোনো অধিকার তার নেই।
--আমরা সেটা করতে পারি না। অর্থমন্ত্রীর
মুখে অবজ্ঞার হাসিটি এখনও ঝুলে আছে।
--আমি বেশ বুঝতে পারছি, সরকার তার
পুরো মেয়াদ টিকে থাকতে পারবে কি পারবে না এই বিষয়ে আমার সন্মানীত বন্ধুটির কোনোরকম
দুঃশ্চিন্তা নেই তবে আমাদের আছে। যতদিন পর্যন্ত না আমার নির্বাচনী ব্যয় উঠে আসে, অন্তত
ততদিন আমি টিকে থাকতে চাই।
অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য উল্লসিত
হাসির সঙ্গে সমর্থিত হল এবং চারদিক থেকে সাবাশ, সাবাশ ধ্বনি উঠল। তর্কযুদ্ধে অর্থমন্ত্রীর
সঙ্গে পেরে উঠার ক্ষমতা শিক্ষামন্ত্রীর নেই। সত্যি বলতে পুরো মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর
সমকক্ষ কেউ নেই, এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পেরে উঠবে না।
--এই বিষয়ে আর কোনো ভুল সিদ্ধান্ত
আমরা যেন আর না নেই, সে মুখ ও গলার স্বরকে গাম্ভীর্যপূর্ণ করে তোলে বলতে থাকে, অনেকদিন
ধরে বিভিন্ন রকম দুর্ভোগ পোহানো জনগণের উপর নতুন করে কর আরোপ করার মতো এত বোকা যদি
কেউ হতে পারে...
আমি মনে করি, আমাদের দেশের মানুষের
মধ্যে এখনও পর্যন্ত কোনো গণচরিত্র গড়ে উঠেনি, মাঝখানে বাঁধা দিয়ে অনুচ্চ হাসি হেসে
শিক্ষামন্ত্রী বলে ওঠে, যা দুই একজনের কাছেই কেবল ভালোভাবে সমর্থিত হয়।
আমি আসলে আমার সন্মানিত বন্ধুর
ভাবনার সীমানায় নাক গলানোর জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত; আসলে সমাজতন্ত্রের বাণীগুলো হচ্ছে
সংক্রামক ব্যাধির মতো। কিন্তু আমি বলছি যে, নতুন করে কর আরোপ করার বিষয়টি হালকাভাবে
নেওয়া উচিত নয় যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা কর দাঙ্গা থামানোর জন্য সেনাবাহিনী নামানোর প্রস্তুতি
গ্রহণ না করছি। জীবনের একটা সোজাসাপটা ব্যাপার না চাইতেই আমাদের বেশ মর্মান্তিকভাবে
শিখতে হয়েছে, এমনকি আমি এটাও নিশ্চিত না যে এ সমন্ধে আমরা সবকিছু জানতে পেরেছি, জনগণ
কর আরোপের বিরুদ্ধে দাঙ্গা বাঁধাবে কিন্তু বিদ্যালয়ের বেতনভাতার বিরুদ্ধে কক্ষনও দাঁড়াবে
না। কারণটা খুব সহজ। প্রত্যেকে, এমনকি গাড়ি পার্কিংয়ের দালালও, খুব ভালোভাবেই জানে
বিদ্যালয়ের বেতনভাতা কেন দিতে হয়। সে দেখতে পাবে, তার সন্তান প্রত্যেকদিন সকালে ঘুম
থেকে উঠে স্কুলে যাচ্ছে এবং বিকেল বেলায় ফিরে আসছে। কিন্তু আপনি যান এবং গিয়ে বলে দেখুন
কর আরোপের কথা, সে তৎক্ষণাৎ ভাবতে বসবে সরকার নিশ্চয় তার কাছ থেকে টাকা মেরে দিচ্ছে।
আরেকটি বিষয় হল, কেউ যদি স্কুলের বেতন না দিতে চায় তাহলে তাকে তা দিতে হবে না। যাই
হোক, এটা তো একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সবচেয়ে খারাপ বিষয় যা ঘটতে পারে তা হল, তার
সন্তান বাড়িতেই বসে থাকবে আর এতে সে সম্ভবত তেমন কিছু মনে করবে না। কিন্তু কর আরোপ
করার বিষয়টা পুরোপুরি আলাদা; করের টাকা প্রত্যেককেই শোধ করতে হবে, চাইলে না চাইলেও।
পার্থক্য পুরোপুরি স্পষ্ট। ঠিক এ কারণেই দাঙ্গা লাগে। কয়েকজন 'শাবাশ! শাবাশ!' বলে চিৎকার
করে উঠল, বাকিরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অথবা তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করল। মিস্টার এমেনিকে
প্রথম থেকেই অর্থমন্ত্রীর প্রতি অকল্পনীয় সম্মোহন রেখে আসছিল এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্রুদ্ধ
দৃষ্টির কবলে পড়া সত্ত্বেও অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য চলাকালীন সে উচ্চস্বরে 'শাবাশ! শাবাশ!'
বলে চিৎকার করার সময় বারবার টিকটিকির মতো মাথা নোয়াচ্ছিল।
এরপর কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন বকবকানি
চলল এবং সরকার বিনা বেতনে প্রাথমিক শিক্ষার পরিকল্পনাটির পুরোপুরি বিলোপ সাধন না করে
ঝুলিয়ে রাখল যতক্ষণ পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোর খুটিনাটি পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখা
না হচ্ছে।
ভেরোনিকা নামের একটি দশ বছরের বালিকার
হৃদয় ভেঙে গেল। বাড়ির একঘেয়ে এবং প্রাণান্তকর পরিশ্রমের হাত থেকে রেহাই পেতে সে বিদ্যালয়কে
ভালোবেসে ফেলেছিল। তার মা, হতদরিদ্র একজন বিধবা, যে সারাদিনের জন্য বাচ্চাগুলোর ভার
চাপিয়ে দিয়ে খামারে এবং হাটবারের দিন বাজারে দিনের প্রত্যেকটা মুহূর্ত ব্যয় করে থাকে।
আসলে একবছর বয়সের সবচেয়ে ছোট বাচ্চাটির দেখাশোনা করাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি। অন্য দুইজন,
একজনের বয়স সাত, আরেকজনের চার, নিজেদের ভালোমন্দ নিজেরা বুঝতে পারার মতো যথেষ্ট বড়
হয়েছে, তারা তাল পেড়ে আনে শাঁস খাওয়ার জন্য এবং ঘাসফড়িং ধরে, ভেরোর জন্য মোটেও তেমন
কোনো মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়ায়নি। কিন্তু একবছর বয়স্ক মেরি পুরোপুরি আলাদা। ভেরো তাকে সকালের
নাস্তার সময় বেঁচে যাওয়া স্যুপ (তা আবার গতকাল রাতের খাবারের পর অবশিষ্ট থাকা স্যুপে
পানি ঢেলে পাতলা করা) খাওয়ানোর পরও সে প্রচুর কান্নাকাটি করে। মেরি এখনও নিজ থেকে তালের
শাঁস চিবিয়ে খেতে পারে না; ফলে তার মুখে পুরে দেওয়ার আগে ভেরোকে বেশ খানিকটা চিবিয়ে
দিতে হয়। কিন্তু দেখা যেত খাবার, তালের শাঁস, ঘাসফড়িঙ এবং কয়েক মগ পানির পরেও মেরি
সন্তুষ্ট নয়। এমনকি যদিও তার পেট ড্রামের মতো বড় এবং টানটান হয়ে থাকত ও আয়নার মতো চিকচিক
করত।
তাদের বিধবা মা, মার্থা, ছিল একজন
দুর্ভাগ্য-পীড়িত নারী। অনেক দিন আগে জীবনের শুরুর দিকে সেন্ট মনিকা স্কুলের প্রথম শিক্ষার্থী
হিসেবে সুন্দর ভবিষ্যতের বিশাল সম্ভাবনা তার ছিল। সেই সেন্ট মনিকা পরে অবশ্য দেশীয়
ধর্মপ্রচারকদের হবু বউদের প্রশিক্ষিত করে তুলতে সাদা চামড়ার মিশনারি নারীদের দ্বারা
নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তখনকার দিনে তার অধিকাংশ সহপাঠী তরুণ শিক্ষকদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে
আবদ্ধ হয়েছিল। তাদের অধিকাংশ এখন যাজকদের বউ এবং দু-একজন আবার বিশপের। কিন্তু মার্থা,
তার শিক্ষিকা মিস রবিনসনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বিয়ে করেছিল একজন তরুণ কাঠমিস্ত্রিকে,
যে অনিস্থার ইন্ডাস্ট্রিয়াল মিশনের প্রশিক্ষিত সাদা চামড়ার মিশনারিদের কাছ থেকে শিক্ষা
গ্রহণ করেছিল। এই কারিগরি বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই দৃঢ় বিশ্বাস থেকে যে যদি
কালো চামড়ার মানুষদের পাপ মুক্ত হতে হয়, তাহলে তার কারিগরি বিভিন্ন কাজে দক্ষতা অর্জনের
পাশাপাশি বাইবেল শিক্ষা করারও প্রয়োজন আছে। (মিস রবিনসন কারিগরি বিদ্যালয়ের প্রতি অনেক
উৎসুক ছিল। পরে সেই বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষকে নিজেই বিয়ে করে ফেলেছিল।) কিন্তু প্রথমদিককার
ধর্মপ্রচারণার দিনগুলোতে বেশ আশা-ভরসা থাকা সত্ত্বেও নাজুক শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে
কাঠের কাজে দক্ষতা খুব বেশি বেড়ে উঠতে পারেনি এবং যাজকগিরিও খুব বেশি ডানা মেলতে পারেনি।
সুতরাং মার্থার স্বামী মারা গিয়ে (অথবা মিশনারির প্রশিক্ষিত লোকগুলো অনেকদিন আগে তাকে
যা শিখিয়েছিল তা হয়তো যাচাই করে দেখা হবে-- তখন তাকে স্বর্গীয় উচ্চতর কাজের জন্য তাকে
ডাকা হবে এমন একজনের দ্বারা, যে নিজেও পৃথিবীতে একসময় একজন কাঠমিস্ত্রি ছিল) তাকে খুব
বাজে অবস্থার মধ্যে ফেলে রেখে গেল। শুরু থেকেই এটা ছিল দুর্ভাগ্যজনক বিবাহ। দাম্পত্য
জীবন শুরুর পর থেকে প্রথম সন্তানের জন্মের জন্য তাকে পুরো বিশটি বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে,
এর ফলে এখন সে কার্যত একজন বৃদ্ধা, যাকে তিন তিনটি ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে লালনপালনের ভার
নিতে হয়েছে। এ কাজের জন্য তার সামান্য সামর্থ্যই অবশিষ্ট আছে। তার মানে এই নয় যে, এতে
সে তিতিবিরক্ত। এতে সে স্বাভাবিকভাবেই উল্লসিত যে পরম করুণাময় ঈশ্বর তার প্রতি বন্ধ্যাত্বের
ফলে সবসময় অসন্তোষে বিড়বিড় করার অভিশাপ থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছে। প্রায়ই তাকে যা নিয়ে
বিড়বিড় করে ক্ষোভ প্রকাশ করতে হত, তা হল সেই অসুখ তার স্বামীকে আক্রান্ত করেছিল। তার
ডান হাতকে অবশ করে রেখেছিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পাঁচ বছর ধরে। এই পরীক্ষায় পার হওয়া
খুব কঠিন ও মর্মান্তিক হয়েছিল।
ভেরো স্কুল থেকে বিতারিত হওয়ার
কয়েকদিনের মধ্যেই, তাদের গ্রামের অনেক বড় সরকারি কর্মকর্তা মিস্টার এমেনিকে যে এখন
রাজধানী শহরে বসবাস করে, মার্থার সঙ্গে দেখা করতে আসল। তার ২২০এস মডেলের মার্সিডিস
ব্রেঞ্জ গাড়িটি এসে সদর রাস্তার পাশে ভিড়ল। সে একটি সংকীর্ণ পথ ধরে ৫০০ ফুটের মতো রাস্তা
হেঁটে বিধবার কুড়েঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। এত বড় মাপের একজন মানুষকে তার সামনে দাঁড়িয়ে
থাকতে দেখে মার্থা হতভম্ব হয়ে গেল এবং কোলানাট নিয়ে যেমন ব্যস্ত হয়েছিল তেমনি অবস্থায়
বিস্মিত হয়ে রইল। বড়লোকটি নিজেই আধুনিক মানুষদের মতো দ্রুত কথা বলার কায়দায় সকল রহস্য
খোলাসা করে বলল।
--আমাদের নতুন বাচ্চাটির দেখাশোনা
করার জন্য আমরা আসলে একটি মেয়ের খোঁজে আছি, তো আজকে সকালে একজন আমাকে বলল, আপনার মেয়েটির
ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে, সে কারণেই আসা।
মার্থা প্রথমে রাজি ছিল না। কিন্তু
সেই বড় লোকটি যখন মেয়েটির কাজের জন্য বেতন হিসেবে বছরে পাঁচ ডলার--খাওয়ানো, পড়ানো এবং
আরও নানা ধরনের আনুষঙ্গিক জিনিস দেওয়ার কথা বলল, মার্থা তখন আস্তে আস্তে নরম হতে শুরু
করে।
--টাকার কথা ভাবি না, আমার চিন্তা
হচ্ছে মেয়েটিকে নিয়ে,-- সে বলল, কিন্তু আমার মেয়েটি আদরযত্ন পাবে তো?
--ঐ বিষয় নিয়ে আপনাকে কিচ্ছু ভাবতে
হবে না, চাচি। সে আমাদের একজন সন্তানের মতো করেই বেড়ে উঠবে। আমার স্ত্রী একজন সমাজকল্যাণ
কর্মকর্তা। ছেলেমেয়েদের ভালোভাবে বেড়ে উঠার গুরুত্ব সে জানে। এ ব্যাপারে আমি আপনাকে
কথা দিতে পারি, আপনার মেয়ে আমাদের বাসায় সুখেশান্তিতেই থাকবে। আমার স্ত্রী যখন অফিসে
থাকবে আর অন্যান্য ছেলেমেয়েরা স্কুলে, তখন শুধু ছোট বাচ্চাটিকে কোলে করে রাখবে আর মাঝেমাঝে
বোতল দিয়ে দুধ খাওয়াবে, আর তেমন কাজ নেই।
--ভেরো এবং তার ছোটবোন জয় গত টার্মে
স্কুলে ভর্তি হয়েছিল,-- কেন এ কথা বলছে তা না বুঝেই বলে ফেলে মার্থা।
--হ্যাঁ, আমি সব জানি। সরকারের
এই কাজটি খারাপ হয়েছে, খুব খারাপ। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস একটি শিশু যার বড় কিছু হওয়ার
কথা, তা সে হবেই--স্কুলে গেলেও হবে না গেলেও হবে। সবকিছু এখানে লেখা আছে, আমাদের এই
হাতের রেখায়।
মার্থা স্থির দৃষ্টিতে মেঝের দিকে
তাকিয়ে থাকে এবং চোখ উপরের দিকে না তুলেই কথা বলতে শুরু করে, --যখন আমার বিয়ে হয় তখন
নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করছিলাম, আমি যতটুকু করতে পেরেছি, আমার মেয়েরা তার চেয়ে অনেক
ভালো কিছু করবে। সে আমলে আমি নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমার মেয়েরা অন্তত
কলেজ পর্যন্ত যাবে। আমি ত্রিশ বছর আগে যেটুকু করতে পেরেছিলাম, এখন তারা হয়তো সেটুকুও
পারবে না। যখন আমি এসব ভাবি তখন আমার বুকটা ফেটে যেতে চায়।
--চাচি, এগুলো নিয়ে বেশি মনখারাপ
করবেন না। একটু আগেই তো বললাম, আমাদের মধ্যে কোনো একজন কী হতে যাচ্ছে, সব এখানে লেখা
আছে, যত বাধাবিঘ্নই সামনে আসুক না কেন, কোনো ব্যাপার না।
--হ্যাঁ, আমি ঈশ্বরের কাছে হাত
তুলে প্রার্থনা করি, আমার ও আমার স্বামীর কপালে যা লিখেছিল আমার সন্তানদের কপালে যেন
তার চেয়ে ঢের ভালো কিছু লেখে।
--আমিন! এবং এই মেয়েটি যদি আমাদের
বাসায় ভালোভাবে চলে এবং বাধ্যমতো কাজগুলো সারে তাহলে ছোট বাচ্চাটি যখন বড় হয়ে নিজের
ভালোমন্দ বুঝতে পারবে তখন আমার স্ত্রী ও আমাকে তাকে স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে কে ফিরিয়ে
রাখে? কেউ পারবে না ঠেকিয়ে রাখতে। মেয়েটি তো এখনও তো অনেক ছোট। ওর বয়স কত?
--এ বছর দশে পড়ল।
--দেখেছেন? সে তো এখনও একটি বাচ্চা
মাত্র। তার স্কুলে যাওয়ার এখনও ঢের সময় আছে।
সে নিজেও জানত যে মেয়েটির স্কুলে
পাঠানোর বিষয়ে কথা বলা নিতান্ত ভদ্রতা বজায় রাখার খাতিরেই। মার্থারও এটা অজানা ছিল
না। কিন্তু ভেরো তা মোটেও বুঝতে পারেনি যে, পাশের রুমের অন্ধকার কোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
অগোচরে সবকিছু শুনছিল। সে মনে মনে সেই সময়টার পুরো ছক কেটে ফেলল, যখন বাচ্চাটি নিজেই
নিজের সব দায়িত্ব নিতে পারবে। এই সময়টা বেশ তাড়াতাড়িই আসবে বলেই তার মনে হল। সুতরাং
সে হাসতে হাসতেই রাজধানী শহরে বড়লোকটির বাসায় চলে গেল। সেই বাচ্চা ছেলেটিকে কোলেপিঠে
নিয়ে মানুষ করতে শুরু করল যে, শীঘ্রই নিজেই নিজের দেখাশোনা করার জন্য যথেষ্ট বড় হয়ে
উঠবে। তখন তার স্কুলে যাওয়া কে ঠেকায়।
ভেরো ছিল সুবোধ বালিকা এবং খুব
বুদ্ধিমতী। মিস্টার এনেমিকা এবং তার বউ তাকে পেয়ে খুব খুশি হল। তার ছিল দ্বিগুণ বয়সী
একটি মেয়ের সমান বুদ্ধিমত্তা। খুব দ্রুত সে অনেক কিছু শিখে ফেলতে পারত।
ভালো চাকরবাকর খুঁজে পেতে মিসেস
এমেনিককে ইদানিং যে সমস্ত বাঁধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে, তাতে সে যারপরনাই বিরক্ত
হয়ে উঠছিল। এখন সে পুনরায় আগের স্বস্তি ফিরে পেয়েছে। সে এখন বিনা বেতনে প্রাথমিক শিক্ষার
মুখ থুবড়ে পড়ার ব্যাপার নিয়ে হেসে কুটিকুটি হয়। সে তার বন্ধুবান্ধবদের বলতে শুরু করেছে,
এখন সে তার ছোট্ট সোনামণিকে নিয়ে কোনো রকম দুশ্চিন্তা না করে যেখানে ইচ্ছা ঘুরতে যেতে
পারে। শুধু তাই নয়, যতদিন খুশি থাকতেও পারবে। সে ভেরোর কাজকর্মে ও আচার ব্যাবহারে এতই
সন্তুষ্ট হয়েছিল যে তাকে 'পিচ্চি ম্যাডাম' বলে ডাকতে শুরু করে। আবিগেইলের চলে যাওয়াকে
কেন্দ্র করে মাসব্যাপী দুঃস্বপ্নের অবসান হয় শেষ পর্যন্ত। সে তার ছেলেটিকে দেখাশোনা
করতে ছোটবড় যেমনই হোক, একটি মেয়ে সে খুঁজে বেড়িয়েছে কিন্তু বরাতে তেমন একটিও জোটেনি।
একটি বেশ ইঁচড়েপাকা যুবতী মেয়ে নিজেকে দেখিয়ে প্রতি মাসে বেতন-ভাতা বাবদ সাত পাউন্ড
দাবি করেছিল। কিন্তু এখানে শুধু টাকাটাই তো বড় কথা নয়। ওর ভাবসাবই ভালো ঠেকেনি-- এক
ধরনের শ্রম-বিনিময় আচরণ সে করেছে যা শ্রম আইনে সংরক্ষিত আছে বলে সকলেই জানে, চাকরবাকরদের
বাস করার জন্য নির্দিষ্ট বাসাবাড়িতে তার গর্ভপাত করার অধিকার থাকবে। এমনকি তার স্বামীর
কাছে নিয়মিত যাতায়াতও করতে পারবে--এ রকমটা সে বলেনি যদিও, কিন্তু মেয়েটিকে তার মোটেও
ভালো মনে হয়নি। তার পরে অবশ্য আর কেউ এখন পর্যন্ত আসেনি।
প্রত্যেকদিন সকালবেলায় যখন এমেনিকের
অন্যান্য ছেলেমেয়েরা--তিনটি মেয়ে এবং একটি ছেলে, তাদের বাবার মার্সিডিজ ব্রেঞ্জ অথবা
তার মায়ের ছোটখাটো ফিয়াট গাড়িতে চড়ে স্কুলে রওনা হত, ভেরো তখন ছোট বাচ্চাটিকে কোলে
করে বাইরে নিয়ে আসত সকলের উদ্দেশে টা-টা জানাতে। তাদের পরনের সুন্দর সুন্দর জামাকাপড়
এবং রংবেরংয়ের জুতা খুব পছন্দ করতে সে--তার এই ছোট্ট জীবনে সে কোনোদিন কোনোধরনের জুতাই
পায়ে দেয়নি। কিন্তু প্রত্যেকদিন সকালে তাদের বাইরে চলে যাওয়া; বাড়ি থেকে, সকল ধরনের
পরিচিত জিনিসপত্র এবং একঘেয়ে কাজকর্ম থেকে দূরে চলে যাওয়াকেই সে বেশি ঈর্ষা করত। প্রথম
মাসে তার এই ঈর্ষা খুবই মৃদু অবস্থায় ছিল। তাদের বাড়ি থেকে, তার মায়ের সেই সাদামাটা
কুঁড়ে থেকে, তালশাঁস কুড়িয়ে খাওয়া থেকে যা পেটের ভেতর গিয়ে দুপুর বেলায় ঘোঁট পাকিয়ে
থাকত, নিরামিষ বিস্বাদ পাতার ঝোল থেকে অনেক দূরে সরে আসার আনন্দের নিচে তার এই ঈর্ষা
চাপা পড়ে ছিল। বাড়ি থেকে চলে আসাটা তার কাছে ছিল বিশাল একটা ব্যাপার। কিন্তু এক মাস
যেতে না যেতেই অন্যান্য ছেলেমেয়ের সুন্দর পোশাক-জুতায় সজ্জিত হয়ে স্যান্ডুইচ ও বিস্কুট
মনোরম কাগজে মুড়িয়ে ছোট স্কুলব্যাগে ঢুকিয়ে প্রতিদিনের বাইরে যাওয়ার প্রতি তার আকর্ষণ
বেড়ে উঠল। একদিন সকালবেলা, ফিয়াট গাড়িটি ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলতে শুরু করলে ভেরোর পিঠে
চড়ে ছোট গড্ডি কাঁদতে শুরু করল। তখন তাকে শান্ত করতে একটি গান ভেরোর মনে দানা বেধে
উঠে।
ছোটখাটো ঝকরমকর মটরগাড়ি
তুমি যদি স্কুলে যাও
আমাকেও সঙ্গে নাও
পি-পি-পি!পহ-পহ-পহ!
সারাটা সকাল সে গুনগুনিয়ে তার এই
ছোট গানটি গাইল এবং এটা নিয়ে বেশ মজে ছিল। মিস্টার এমেনিকে অন্যান্য ছেলেমেয়েগুকে বাড়িতে
নিয়ে আসল। তারপর আবার সঙ্গে করে নিয়ে গেল, এই মাঝের সময়টিতে ভেরো নতুন গানটি বেশ ভালো
করে শিখিয়ে দিল তাদের। তারা সকলেই গানটি পছন্দ করল এবং অচিরেই স্কুল থেকে শিখে আসা
--বা বা কালো ভেড়া, সরল সিমন ও অন্য গানগুলোর স্থান দখল করে বসল এই গানটি।
--মেয়েটি আসলেই মেধাবী। গানটি শেষ
পর্যন্ত মিস্টার এমেনিকের কানে গেলে সে বলে উঠল।
তার বউ গানটি প্রথমবার শুনেই হাসতে
হাসতে পেটে খিল ধরে যায় আর কি! সে ভেরোকে ডেকে বলল, --অ্যাঁ, তুমি তো দেখি আমার গাড়ি
নিয়ে বেশ মজা করতে শুরু করেছে, দুষ্টু মেয়ে কোথাকার।
ভেরো আহ্লাদিত হয়ে পড়ল। কারণ সে
ম্যাডামের চোখে রাগের বদলে দেখতে পেয়েছে ঝলমলে হাসি।
--যদিও সে এখন পর্যন্ত স্কুলে যায়নি,
তার স্বামী তাকে বলল, --তবুও সে খুবই মেধাবী।
--শুধু তাই নয়, তোমার যে অতিসত্বর
আমাকে একটি নতুন গাড়ি কিনে দেওয়া উচিত এটাও সে ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে।
--রাগ করো না সোনা, পরের বছর তুমি
সেই স্পোর্টস কারটি পেয়ে যাবে।
--আমার তো তা মনে হয় না।
--তার মানে তুমি আমাকে বিশ্বাস
করছ না? আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করেই দেখো না।
অনেক সপ্তাহ ও মাস কেটে গেল এবং
ছোট্ট গড্ডি কিছু কিছু কথাও বলতে শুরু করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভেরোর স্কুলে যাওয়ার
ব্যাপারে কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করছে না। সে চিন্তা করে দেখল যথেষ্ট দ্রুততার সঙ্গে
বেড়ে না উঠা গড্ডিরই একটা ভুল। এমনকি যদিও সে ভালোভাবে হাঁটতে পারে, তারপরও সে তার
পিঠে চাপার ব্যাপারেই আরও বেশি করে উৎসাহী হয়ে উঠছে দিনদিন। আসলে তার প্রিয় শব্দটি
ছিল--কোলে নাও। ভেরো এ সম্বন্ধেও একটা গান ফেঁদে বসল। এটা তার মধ্যে বেড়ে উঠা অসহিষ্ণুতাকেই
প্রকাশ করল।
কোলে রাখি! কোলে রাখি!
সবসময় তোমাকে কোলে করেই রাখি!
তুমি যদি না চাও বেড়ে উঠতে
আমি তোমাকে ফেলে রেখে যাব চলে স্কুলে
কারণ ভেরো এখন ভয়ানক ক্লান্ত!
ক্লান্ত, ক্লান্ত, ভয়াবহ ক্লান্ত!
অন্যান্য ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে ফিরে
আসার আগ পর্যন্ত সারাটি সকাল সে এই গানটি গেয়ে বেড়াল। যখন সে গড্ডির সঙ্গে একা থাকে,
তখনই কেবল সে এই গানটি গায়।
একদিন বিকেল বেলা মিসেস এমেনিকে
অফিস থেকে ফিরে এসে দেখতে পেল ভেরোর ঠোঁট লাল রংয়ে মাখামাখি।
--এদিকে আয়, সে বলল, দামি লিপস্টিকের
কথাই তার প্রথমে মনে আসল। “এটা কি লাগিয়েছিস ঠোঁটে?
যাহোক সে বুঝতে পারল, এটা মোটেও
তার সেই দামি লিপস্টিক নয়, এটা হচ্ছে তার স্বামীর কলমের লাল কালি। সে তখন হাসি ধরে
রাখতে পারল না।
--দেখো ওর আঙুলের নখের দিকে তাকিয়ে!
আরে পায়ের আঙুলেরও দেখি একই অবস্থা! তাহলে পিচ্চি ম্যাডাম, তোকে ছোট বাচ্চাটাকে দেখাশোনা
করতে বাড়িতে রেখে যাই, আর তুই বসে বসে এই করিস, তাই না? ওকে কোথাও ফেলে রেখে নিজেকে
রাঙাতে শুরু করিস। এই সমস্ত অকাম করার সময় আমার চোখের সামনে পড়িস না কিন্তু; কানে ঢুকছে
আমার কথা?
ভেরোর কাছে মনে হল যে কারণেই হোক
সতর্কবার্তাকে আরও জোরালো করতে, আগের হাসিটাকে মুছে ফেলা হয়েছে।
--তুই জানিস না যে কালি বিষাক্ত
জিনিস? নিজেই নিজেকে মারতে চাস। ভালো কথা, পিচ্চি ম্যাডাম তাহলে আমার বাসা থেকে চলে
যাওয়া ও তোর মায়ের কাছে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত তোকে অপেক্ষা করতে হবে।
কথায় তাহলে ভালোই কাজ হয়েছে, আত্মপরিতৃপ্তির
সঙ্গে সে ভাবল। সে দেখতে পেল যে ভেরো বেশ ভীত হয়ে পড়েছে। সেদিন সারা বিকেল ভেরো নিজেকে
লুকিয়ে লুকিয়ে চলাফেরা করল।
মিস্টার এমেনিকে অফিস থেকে ফিরে
নাস্তা করতে বসলে ঘটনাটা তার কাছে সে খুলে বলল। এবং তাকে দেখানোর জন্য ভেরোকে সে ডেকে
পাঠাল।
--তোর হাতের নখগুলো দেখা উনাকে,
সে বলল, এবং পায়ের আঙুলগুলোও ভাল করে দেখা পিচ্চি ম্যাডামকে!
--বুঝতে পেরেছি, হাতের ইশারায় ভেরোকে
দূরে সরিয়ে দিয়ে সে জানাল। সে বেশ দ্রুতই শিখছে। তুমি কি সেই প্রবাদবাক্যটার কথা জান,
যেখানে বলে, মা-গাভিটা যখন বড় বড় ঘাষ খেতে থাকে তার ছোট বাছুরটিও তখন তাই করে।
--কাকে গাভি বলছ তুমি, হ্যাঁ? তুমি
হচ্ছ আস্ত একটা গণ্ডার!
--আরে রাগ করছ কেন সোনা, এটা তো
শুধু মাত্র একটা প্রবাদের কথা বলছি।
সপ্তাহখানেক পরে মিসেস এমেনিকে
কাজ থেকে বাসায় ফিরেই খেয়াল করল সকালে যে পোশাক সে বাচ্চাটিকে পড়িয়ে রেখে গেছে তা বদলে
ফেলে বেশ গরম কাপড়চোপড় পরিয়ে রাখা হয়েছে।
--আমি তাকে যে পোশাকটি পরিয়ে রেখে
গিয়েছিলাম, সেটার কী হল, শুনি?
--সে মাটিতে পড়ে গিয়ে কাদা লাগিয়েছে।
তাই আমি তাকে সেটা বদলে দিয়েছি। ভেরো উত্তর দিল।
কিন্তু তার কথাবার্তা আচার-আচরণের
মধ্যে কিছু উদ্ভুত ভাব লক্ষ করা গেল। মিসেস এমেনিকের প্রথমেই দুঃশ্চিন্তা হল, বাচ্চাটি
অবশ্যই খুব বাজেভাবে কোথাও পড়ে গিয়ে থাকবে।
--সে কোথায় পড়ে গিয়েছিল? শঙ্কিত
কণ্ঠে সে জিজ্ঞাসা করল। মেঝের ঠিক কোন জায়গায়টায় সে পড়েছে? ওকে এক্ষুনি আমার কাছে নিয়ে
আয়! এগুলো সব কী? রক্ত? না তো? তাহলে কী এটা? আমার সর্বনাশ হয়ে গেল! যা, সেই পোশাকটি
নিয়ে আয়। এক্ষুনি!
--আমি সেটা ধুয়ে ফেলেছি,-- ভেরো
কাঁদতে কাঁদতে বলল, যদিও এর আগে তাকে কখনও কাঁদতে দেখা যায়নি।
মিসেস এমেনিকে আর দ্বিরুক্তি না
করে দৌড়ে গিয়ে নীল পোশাকটি এবং সাদা স্যান্ডো গেঞ্জিটি নিয়ে আসল, দুটোই গাঢ় লাল রংয়ে
মাখামাখি হয়ে আছে!
সে ভেরোর চুলের মুঠি ধরে পাগলের
মতো এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করল। তারপর একটি বেত নিয়ে এসে তার শরীরে ভাঙল যতক্ষণ পর্যন্ত
না তার সমস্ত মুখমণ্ডল ও দুই হাত দিয়ে অঝোরে রক্ত ঝরতে থাকে। তখনই কেবল ভেরো বাচ্চাটিকে
একবোতল লাল কালি খেতে প্ররোচিত করার কথা স্বীকার করল। মিসেস এমেনিকে ধ্বংশস্তূপের মত
চেয়ারে বসে পড়ল এবং কাঁদতে শুরু করল।
মিস্টার এমেনিকে জলখাবার সারার
জন্য আর অপেক্ষা করল না। ভেরোকে মার্সিডিজ ব্রেঞ্জ গাড়িটিতে ঢুকিয়ে চল্লিশ মাইল দূরের
সেই গ্রামটিতে, তার মায়ের কাছে নিয়ে আসল। মিস্টার এমেনিকে অবশ্য একাই যেতে চেয়েছিল।
কিন্তু তার স্ত্রী সঙ্গে আসার জন্য এবং বাচ্চাটিকেও সঙ্গে নেওয়ার জন্য জোরাজুরি আরম্ভ
করল।
অন্যবারের মতো এবারেও সে গাড়িটিকে
সদর রাস্তার পাশে দাঁড় করাল। কিন্তু সে মেয়েটির সঙ্গে ভেতরের দিকে গেল না। সে শুধুমাত্র
গাড়ির দরজাটা খুলে তাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল এবং তার স্ত্রী ভেরোর কাপড়ের পুটলিটাকে
তার পেছনে ছুড়ে মারল। সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল।
ক্লান্ত ও বিষণ্ন অবস্থায় মার্থা
খামার থেকে ফিরে আসল। ভেরো ফিরে এসেছে এবং শোবার ঘরে বসে বসে কাঁদছে--এটা বলতে বলতে
তার অন্যান্য ছেলেমেয়েরা তার কাছে দৌড়ে ছুটে আসল। সে আস্তে করে ঝুড়িটি নামিয়ে রেখে
তার সঙ্গে দেখা করতে গেল; কিন্তু সে যা শুনল, তার কূলকিনারা কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।
--তুই বাচ্চাটিকে লাল কালি দিয়েছিস?
কেন দিতে গেলি? যাতে করে তুই স্কুলে ভর্তি হতে পারিস তাই না? কীভাবে সম্ভব? কথা বল।
চল তাদের কাছে তোকে নিয়ে যাই। তারা সম্ভবত আজ রাত্রে গ্রামেই থেকে যাবে। অথবা আসলে
কী ঘটনা ঘটেছিল তা কাউকে না কাউকে বলবে নিশ্চয়। তাই না?
--তোমার পায়ে পড়ি মা, আমাকে ওদের
কাছে নিয়ে যেও না। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।
--যদি তুই না বলিস কি ঘটেছিল তাহলে
তোকে যেতেই হবে।
সে ভেরোর হাতের কব্জি ধরে টেনেহিঁচড়ে
ঘর থেকে বের করল। বাইরের আলোতে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে তার মুখে, মাথায়, ঘাড়ে, বাহুতে
কালশিরা পড়ে যাওয়া বেতের দাগ দেখতে পেল। অনেক কষ্টে সে একটি ঢোক গিলল।
-কে তোকে এভাবে মেরেছে?
--আমার ম্যাডাম।
--এবং যা বললি তাই তো তুই করেছিস,
তাই না? বলতেই হবে তোকে।
--আমি বাচ্চাটিকে লাল কালি দিয়েছিলাম।
--ঠিক আছে, চল তাহলে আমার সঙ্গে।
ভেরো, ও মাগো ও মাগো-- বলে জোরে
জোরে বিলাপ করে কাঁদতে শুরু করল। মার্থা শক্ত মুঠিতে তার কবজি চেপে ধরে টানতে টানতে
নিয়ে চলল। সে তখনও কাপড় বদলায়নি এমনকি হাতমুখও ধোঁয়া হয়নি। প্রত্যেকটি নারী-- মাঝে
মাঝে পুরুষরাও রাস্তায় পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভেরোর শরীরে বেতের দাগ দেখে চিৎকার করে
উঠল এবং জানতে চাইল কোন বর্বর এই বাচ্চা মেয়েটিকে এমন করে মেরেছে।
মার্থা সকলকে বলতে বলতে আসছিল,
--আমি এখনও জানি না। এটা জানার জন্যই যাচ্ছি।
তার ভাগ্য ভালোই ছিল বলতে হয়। মিস্টার
এমেনিকের বড় গাড়িটি সেখানেই দাঁড় করানো আছে। তার মানে তারা এখনও রাজধানীতে ফিরে যায়নি।
সে সদর দরজায় কড়া নেড়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। মিসেস এমেনিকে বৈঠকখানায় বসে বাচ্চাটিকে বোতলের
দুধ খাওয়াচ্ছিল। কিন্তু সে তাদের পুরোপুরি উপেক্ষা করল, তাদের সঙ্গে একটি কথাও বলল
না। এমনকি তাদের দিকে ফিরে পর্যন্ত তাকাল না। কিছুক্ষণ পর সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে
স্বামীটি ঘটনাটা তাদের কাছে খুলে বলল। শোনামাত্রই ঘটনার গূঢ় অর্থ মার্থার কাছে স্পষ্ট
হয়ে উঠল। বাচ্চা ছেলেটিকে লাল কালি দেওয়া হয়েছিল যাতে সে খেয়ে ফেলে এবং মতলব ছিল তাকে
মেরে ফেলা। সে চিৎকার করে দুই হাতের দুই আঙুল দিয়ে তার কানের ছিদ্র চেপে ধরে। যাতে
এই মর্মান্তিক কাহিনি তাকে আর শুনতে না হয়। তৎক্ষণাৎ সে ছুটে বাইরে চলে আসল, লতানো
ফুলগাছের একটি লতা ছিঁড়ে ফেলে বুড়ো আঙুল ও তর্জনির সাহায্যে একপাশে চেপে ধরে পুরো লতার
পাতাগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলল খুব দ্রুতগতিতে। সেই চাবুকটি হাতে নিয়ে সে বাড়ির ভেতরে ঢুকল
চিৎকার করতে করতে, --এ রকম জঘন্য ঘটনাও আমাকে শুনতে হল!
ভেরো তখন জোরে জোরে কাঁদছে এবং
ঘরের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে।
--এখানে আমার বাড়িতে ওকে মারবেন
না। মিসেস এমেনিকে এই প্রথমবার তাদের দিকে তাকিয়ে সন্ন্যাসিনীর মতো ঠাণ্ডা এবং কঠিন
গলায় বলল। ওকে এক্ষুনি এখান থেকে নিয়ে যান। আপনি আমাকে ক্ষোভ দেখাতে চান। ভাল, ওগুলো
দেখার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। এখান থেকে বের হয়ে যান। বাড়িতে গিয়ে আপনার রাগ প্রকাশ করেন।
আপনার মেয়ে নিশ্চয় আমার বাসায় এসে খুন করতে শিখেনি।
এই কথাটা মার্থার কলিজার ভেতরে
ঘচ করে ঢুকে গেল। চলার মাঝখানে তাকে পাথরের মতো স্থির করে ফেলল। অচল হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে
রইল, যেন পায়ে শিকড় গজিয়েছে, চাবুক ধরা হাতটি নির্জীব হয়ে পাশে ঝুলে রইল। 'মা আমার'
যুবতী নারীটিকে উদ্দেশ্য করে সে অবশেষে উচ্চারণ করল, আমি গরিব ও হতভাগ্য হতে পারি কিন্তু
খুনি নই। ভেরো একজন খুনি হয়ে উঠে থাকলে ঈশ্বরের কসম কেটে বলছি, সে কখনও এটা বলতে পারবে
না যে আমার কাছ থেকে তা শিখেছে।
--তাহলে তো বলতে হয় আমার কাছ থেকে
শিখেছে, তাই তো।” ভয়ানক মেকি হাসি হেসে ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে সে বলল, না হলে এটা তার মাথায়
আকাশ থেকে পড়েছে। ঠিক আছে মেনে নিলাম, আকাশ থেকেই পড়েছে। দেখুন ভালোয় ভালোয় আপনার মেয়েটিকে
নিয়ে আমার বাড়ি থেকে চলে যান বলছি।
--ভেরো, চল এখান থেকে, আয় বলছি,
চল তাড়াতাড়ি।
--হ্যাঁ তাই করুন, দয়া করে বিদেয়
হোন এখান থেকে।
মিস্টার এমেনিকে অনেকক্ষণ ধরে পুরুষ
মানুষের উপযুক্ত কথা বলার ফাঁকফোঁকর খুঁজে পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে আসছিল।
--এটা আসলে শয়তানের কাজ, -সে বলল
অবশেষে,-- আমার সবসময় মনে হয়েছে, এই দেশের মানুষের শিক্ষা লাভের জন্য উন্মত্ত হয়ে যাওয়া
একদিন আমাদের সবাইকে ধ্বংসের খাদে ঠেলে দেবে। আর এখন দেখা যাচ্ছে এমনকি একটা শিশুও
স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য মানুষ পর্যন্ত খুন করতে পারে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সকল দিক সামলাতে
গিয়ে মার্থা ভয়ানকভাবে ভেঙে পড়ল। শক্ত মুঠিতে ভেরোর কব্জি চেপে ধরে টেনেহিঁচড়ে বাড়ির
দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় আরেক হাতে ধরা ছিল সেই অব্যবহৃত চাবুকটি। প্রথমে সে ধারাবর্ষণের
মতো মেয়েটিকে গালগালাজ করল, তাকে আখ্যা দিল একটি শয়তান মেয়ে হিসেবে, যে বাড়ির পিছনের
ঝোপ থেকে উঠে এসে তার মায়ের জরায়ুতে ঠাই নিয়েছিল।
হায় ঈশ্বর, এ আমি কি করলাম? তার
দু'গাল বেয়ে চোখের পানি ঝরতে লাগল। আমার বয়সী অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গেই আমার যদি একটি
বাচ্চা হত তাহলে ঐ মেয়েটি যে আমাকে আজকে একজন খুনি বলল, বয়সে আমার মেয়ের চেয়ে নিশ্চয়
বড় হত না। আর এখন সে আমার মুখে থুথু ছিটায়। এটা দেখাতেই তুই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিস,
ভেরোর মাথার ঝুটি চেপে ধরে সে বলল এবং পাগলের মতো টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসতে লাগল।
--তোকে আজ মেরেই ফেলব। চল আগে বাড়িতে
যাই।
তখন অস্পষ্ট, এলোমেলো, অযাচিত একটি
বিদ্রোহ, এই প্রথম ধীরগতিতে তার ভেতরে প্রবেশ করল। লোকটি নিজেই শিক্ষালাভের জন্য মানুষের
উন্মাদনার কথা বলেছে। তার সকল ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়, এমনকি তার দুই বছরের বাচ্চাটিও
বাদ নেই; তার কিন্তু কোনো উন্মাদনা নেই। ধনী লোকদের কোনো পাগলামি নেই। আমার মতো গরিব
বিধবার সন্তানেরা যখন অন্যদের সঙ্গে স্কুলে যেতে চায় তখনই এটা পাগলামিতে পরিণত হয়।
এর নাম কি জীবন? হে ঈশ্বর, এটা তাহলে কি? আমার সন্তানও এখন ভাবতে বসেছে যাকে লালনপালন
করার জন্য তাকে রাখা হয়েছে দরকার হলে সেই বাচ্চাটিকে খুন করবে, যাতে করে সে স্কুলে
যাওয়ার সুযোগ পায়। কে এ রকম একটা জঘন্য ধারণা তার মাথায় ঢুকিয়েছে? হে ঈশ্বর তুমিই ভালো
জান, আমি কিছু জানি না।
0 মন্তব্যসমূহ