গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর যে-বছর জন্ম, ১৯২৭, তার ধারে-কাছের সময়কালে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পথের পাঁচালী' 'বিচিত্রা' কাগজে ধারাবাহিক বেরচ্ছিল। আর মার্কে স-এর 'দেল আ মোর ই অত্রস দেমোনিয়স'--এক বছর পর ইংরেজি অনুবাদে যার নাম দাঁড়ায় 'অফ লাভ অ্যান্ড আদার ডেমনস'--যখন বেরয় ১৯৯৪-এ, তখন বিভূতিভূষণের মরণোত্তর বয়স ৪৪। এই সব সন-তারিখ ও লেখকদের মধ্যে বাইরের বা ভিতরের কোনও সম্পর্ক নেই। কোনও সাহিত্যিক তত্ত্ব তৈরি করতেও এসব উল্লেখ নয়। একেবারেই আমার নিজের মনে পড়া। খুব বড় শিল্পকর্ম এমন 'অ-সম্বন্ধ' মনে-পড়া ঘটায়।
আরও কিছু মনে পড়ল।
থিয়েটার দেখতে গিয়েছিলাম আকাদেমি-তে। বেরিয়ে মোবাইলে দেখি 'রোববার'-এর তরফে বার্তা। মার্কে স-এর ওপর বিশেষ সংখ্যা করা হবে। আমি কি...ইত্যাদি।
আমি তৎক্ষণাৎ জবাব দিলাম-- নিশ্চয়ই। কবে?
যিনি যোগাযোগ করেছিলেন, তক্ষুনি জবাব দিলেন কবে, আর জানতে চাইলেন কোন বই নিয়ে লিখব। আমি শ্বাস ফেলার আগে লিখে দিলাম--'লাভ অ্যান্ড আদার ডেমনস।'
সন্দেহ হল, নামটা বোধহয় ভুল লিখলাম। তবু বাকি রাস্তাটা বেশ ফুর্তিতে ভাবতে লাগলাম--কত কী লেখা যাবে!
আমার এ-ব্যাধি বোধ হয় আর এ-জীবনে সারবে না।
কোনও তেমন লেখার কথা শোনামাত্র ফুর্তি এসে যায় ও সেই মুহূর্ত থেকে মনে-মনে লেখাটা শুরু হয়ে যায়। বাড়ি ফেরার পথটাতেই 'পথের পাঁচালী' মনে পড়ল আর বইয়ের নামটা নিয়ে খুঁতখুঁত করতে লাগলাম।
আমার লেখার প্রধান সমস্যা এখন, বই খুঁজে না-পাওয়া। পুস্তকভাণ্ডারী আমার বউঠান নিজের একই পা তিনবার ভেঙে উত্থানশক্তিরহিত হয়ে বছরখানেক শুয়ে আছেন। যা হোক, ছোট মেয়ে তীর্ণা বাড়ি আছে। ও নিশ্চয়ই খুঁজে দেবে।
ও খুঁজল, কিন্তু রাত দেড়টার মধ্যে পেল না। গভীরতর রাতে কাকা-ভাইজির পরামর্শ হল--কাল বেরিয়ে কিনে নিয়ে আয়।
আমার ছোট ভাই সমরেশ থাকে এ-বাড়িরই দোতলায়। রাত দেড়টা এমন কী রাত যে সমরেশের কাছে খোঁজ করা যাবে না। কিন্তু মেয়ের কাণ্ডজ্ঞান আমার চেয়ে বেশি। শান্তিভঙ্গের ভয়ে মেয়ে আশ্বস্ত করল--'কাল তুমি সকালে চা খাওয়ার আগে পেয়ে যাবে--হল তো?'
ও কথা রেখেছিল। দেখি, ইংরেজি নামটা 'অফ লাভ অ্যান্ড আদার ডেমনস'। আমি 'অফ'-টা বাদ দিয়ে ভাবছিলাম। 'অফ'-টা না-থাকলে 'আদার ডেমনস' জুড়ে যায় 'লাভ'-এর সঙ্গে। 'অফ'-টা থাকলে, 'লাভ'-টাও একটা 'ডেমন' হয়ে যায়। নামকরণ থেকেই উপন্যাসটা শুরু হয়ে গেল। অনেকটা 'ডেমন'-এরই গল্প এবং প্রেম-দানোরও।
আবারও 'পথের পাঁচালী' মনে এল।
'পথের পাঁচালী'-র তৃতীয় পরিচ্ছেদে অপুর জন্ম। চতুর্থ পরিচ্ছেদের শুরুতেই অপুর বয়স দশ মাস। প্রথম ছ'টি পরিচ্ছেদ মিলে 'বল্লালী বালাই'। এই অংশেই ১৮৩১, ১৮৩৩, ১৮৫৩--এই সব সময়চিহ্ন দেওয়া আছে। আর ঘটনার কী উদ্ভট বিন্যাস! ইন্দির ঠাকরুনের সঙ্গে হরিহরের আত্মীয়তার জটিল অবাস্তব, হরিহরের পূর্বপুরুষদের বিয়ে-থাওয়ার সূত্র ধরে বসবাসের ও পেশার জায়গা-বদল, ডাকাতি পেশা, কুমিরের ছেলে- খাওয়া, তা থেকে বংশদোষ, এর ভিতর ইন্দির ঠাকরুনের মৃত মেয়ের দুর্গা হয়ে পুনর্জন্ম, সেই মরে-যাওয়া মেয়ের সঙ্গে যার বিয়ে হয়েছিল সেই বুড়ো জামাইয়ের কাছে গিয়ে ইন্দির ঠাকরুনের আশ্রয় খোঁজা। এমন গল্পে অপু যখন প্রথম হাঁটে তার বাবার সঙ্গে সরস্বতী পুজোর পর দিন কুঠির মাঠে নীলকণ্ঠ পাখি দেখতে, তখন কিন্তু অপু জীবনে প্রথম জ্যান্ত খরগোশ দেখেছিল, তার বইয়ের ছবির খরগোশ। 'পথের পাঁচালী' অপুর পথের পাঁচালী, কিন্তু পথটা অপুর কাছে এসে পৌঁছেছে এক উদ্ভট কার্যকারণহীন প্রাচীন থেকে। সেই প্রাচীন যখন অপুর 'আধুনিক' পথ হয়, তখন সেই আধুনিক-ও 'প্রাচীন' হয়ে ওঠে। আধুনিকের সেই প্রাচীনতা 'পথের পাঁচালী'-কে বাঙালি জীবনের পুরাণ করে তোলে।
গল্প কী, উপন্যাস কী, কল্পনা কী, অভিজ্ঞতা কী--এসব প্রশ্নের কোনও এক নিষ্পত্তি না- করে গল্প-উপন্যাস লেখা যায় না। যিনি গল্প-উপন্যাস লেখেন তাঁকে তাঁর সময়টাকেই জানতে হয়। আর, তাঁর জানার একমাত্র উপায় তাঁর সময় তাঁর কাছে কোন গল্পের আকারে আসছে। এমনটা নয়, কখনওই নয়, যে, সময়ের একটা আকার দেওয়ার জন্য তিনি একটা যোগ্য ও যথাযথ গল্প তৈরি করেন। গল্পটাই তাঁর সময়ের আকার হয়ে আসে। একজন কবির কাছে তাঁর সময়ের আকার হয়ে আসে একটি বা কয়েকটি চরণ বা একটি ও একটিমাত্র উপমা। উস্তাদ হাফিজ আলির কাছে তাঁর সময়ের আকার হয়ে আসে দরবারি কানাড়ার কোমল গান্ধার।
কোনও শিল্প-ই আরোহী বা অবরোহী পদ্ধতিতে নিষ্কাশিত হয় না। শিল্প একটা আকার নিয়ে জন্মায়। সেই আকারটিকে স্পষ্ট করে তুলতেই গল্প লেখা, কবিতা রচনা, ভাস্কর্যে শূন্যতাকে ধরা, দরবারি কানাড়ায় কোমল গান্ধার লাগানো।
তার বারো বছরের জন্মদিনেই ডিসেম্বরের প্রথম রবিবারে, যে-কুকুরটা তিনজনকে কামড়ানোর পর মারিয়ার হাঁটু-গোড়ালির মাঝখানে একটুখানি দাঁত বসায় কি বসায় না, সে-কুকুরটা ছিল ছাইরঙা আর তার কপালে ছিল জ্বলজ্বলে সাদা পোঁচ। যে-বাঁদির সঙ্গে মারিয়া বাজারে গিয়েছিল, পরের রবিবারে সে একা-একা বাজারে গিয়ে দ্যাখে--একটা কুকুরের শব ঝোলানো আছে এক বাদাম গাছের ডাল থেকে সবাইকে জানাতে যে কুকুরটা র্যাবিসে মারা গিয়েছে। সেই কুকুরটা ছাইরঙা, তার কপালে একপোঁচ জ্বলজ্বলে সাদা। রংটা আর সাদা পোঁচটা যদি অমন স্পষ্ট না-দেখা যেত আগের রবিবারে, তবে কুকুরটাকে চিনতে না-পারা চলত। বাঁদিটা এসে বাড়ির কর্ত্রীকে জানায়। কর্ত্রী পাত্তা দেন না। কালদের গুজব খ্রিস্টান সত্যের চাইতে দ্রুতগামী।
অদ্ভুত টাইট মার্কেস-এর এই পঞ্চাশ হাজার মতো শব্দের ছোট উপন্যাসটি। কতবার তো পড়া, কখনও গোটা, কখনও ছেঁড়া-ছেঁড়া। এবারও যখন এই লেখাটির জন্য পড়ছিলাম, প্রথম অধ্যায়টি শেষ করার পর একটু থমকে ভাবলাম, আরে, এ-বইটা কি এমন অংশে-অংশে ভাগ করা? এবারই প্রথম দেখি মোটামুটি প্রতিটি দশ হাজার শব্দের পাঁচটি ভাগে তৈরি এই উপন্যাস। অথচ প্রতিটি অংশই এত বিবিধ ও বিচিত্র ঘটনায়, কথাবার্তায় ও খবরে ঠাসা যে--এমন একটা মায়া তৈরি হয় যেন লেখাটি এমন নির্বন্ধন প্রবাহেই বয়ে চলবে। কিন্তু মানুষ তো একজন লিখছেন, তাঁর নির্বন্ধন কি প্রাকৃতিক হতে পারে? বাঁধা আর খোলার নিয়ন্ত্রণ গল্পের হাতে আর পাঠকের মেজাজের ওপর ছেড়ে দেয়া যায়?
'এক' অধ্যায়ে কুকুরের কামড়, মারিয়ার র্যাবিস নিয়ে সন্দেহ, একইসঙ্গে লাতিনজানা ডাক্তারের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ আর বান্দা ও বাঁদিদের মহলের গোপন- চিকিৎসা। অজস্র সম্পর্কের ইতিহাস এক-একটা প্যারাতেই বলা হয়ে যায়, সেগুলো কোনও কাহিনি হয়ে ওঠে না। শুধু লোকজনের সম্পর্কের ইতিহাসের যুক্তিটা বলেই ছেড়ে দেয়।
'দুই' অধ্যায় শুরু হয়ে যায়--মারিয়ার বাবা মারকুইসের জীবন নিয়ে, সেই জীবনের কাহিনি এসে ঠেকে বর্তমানে। তার একসঙ্গে থাকার সঙ্গিনী বারনার্দা-র স্বেচ্ছানির্বাসনে আর তার মেয়েকে নিয়ে মারকুইসের নতুন জীবনে। 'দুই' অধ্যায়ের সে-জীবন শেষ। মারকুইস তাঁর মেয়েকে চিকিৎসকের হাত থেকে গির্জার হাতে তুলে দেন। কোনও বিদ্রোহ নেই, জিজ্ঞাসা নেই। শুধুই আত্মসমর্পণ। কারণ খ্রিস্টান ধর্মের বিধান অনুযায়ী র্যাবিস মানুষের শরীরের ওপরে এক দানোর দখল। বিশপ তাঁর নির্দেশ দিয়েছেন, 'ওকে আমাদের হাতে দাও। বাকিটা ঈশ্বর করবেন।' এ-ও এক ইতিহাসের আনুগত্য।
'তিন' অধ্যায়ে সান্তা ক্লারা-র কনভেন্টে মারিয়া-র প্রবেশ ও শাস্ত্রানুযায়ী তার নিবাস। আর, এই অধ্যায়েই গির্জার এক নবীন পুরোহিত কায়োতানো দিলোরা নিয়োজিত হন মারিয়া'কে দানো-মুক্ত করার কাজে। দিলোরা গির্জার বুদ্ধিজীবী। ভাটিকানের কোনও গবেষণার কাজে তাঁকে নিয়োগ করার কথা চলছে। পৌরোহিত্য বা দানব-গড়ার কাজ সে জানেও না। কিন্তু বিশপ তাকেই নিয়োগ করলেন। কারণ, তিনি বিশপের কাছে বলেছেন তিনি এই মেয়েটিকে স্বপ্নে দেখেছেন। গল্পটির শেষে এসে আমরা আন্দাজ করতে পারি, বিশপ এই তরুণ পুরোহিতকে তাঁর প্রেমের দানো থেকে মুক্ত করতেই তাঁকে মেয়েটির ওঝাগিরির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। শুরু হল ধর্মীয় এই বুদ্ধিজীবীর এক নতুন সম্পর্ক এক দানোয়-পাওয়া কিশোরীর সঙ্গে।
'চার' অধ্যায়ে একই সঙ্গে শুরু হয়ে গেল দুই উল্টো ঘটনা। গির্জার কনভেন্টের স্থায়ী ও পুরনো সব সন্ন্যাসিনী দিলোরা-র ব্যবহার ও পদ্ধতি নিয়ে বিশপের কাছে আপত্তি জানালেন। আর ঠিক একই সময়ে রাষ্ট্র প্রধান তাঁর দলবল নিয়ে গির্জায় এসে পড়বেন--জানালেন। রাষ্ট্রপ্রধানের স্ত্রী ওই কনভেন্টেই থাকবেন, যে-ক'দিন থাকেন। এই অধ্যায়েই বিশপের সঙ্গে দিলোরা-র এক তাত্ত্বিক তর্ক। কাউকে দানো ছাড়াতে হলে কি দানোকে সর্বশক্তিমান ভাবা উচিত, না কি, তার, অধিকৃতের, মুক্তির অধিকারকে ও আকাঙ্ক্ষাকেই শক্তিমত্তর করে তোলা উচিত। এই বিতর্কেই এমন একটি সংলাপ ঘটল--বিশপের সঙ্গে তরুণ পুরোহিতের।
'আমরা কত দূর এসেছি?' তিনি দীর্ঘশ্বাস ফ্যালেন।
'কোথা থেকে?'
'নিজেদের থেকে', বিশপ বললেন।...
'আমরা পৃথিবীর আবর্তন ঠেকাতে পারিনা'--দিলোরা বললেন।
'কিন্তু আমরা তো সেটা না-জেনেও থাকতে পারি যাতে সেই জ্ঞান আমাদের দুঃখ না-দেয়'--বিশপ বললেন, 'গ্যালিলিও-র শুধু বিশ্বাসের অভাব ছিল তা-ই নয়, তার কোনও হৃদয়ও ছিল না।'
এই অধ্যায়টিতে রাষ্ট্রপ্রধানের অনুরোধে, যা বস্তুত আদেশই, বিশপ সন্ন্যাসিনীদের নালিশ অনুযায়ী মারিয়াকে অন্যত্র শিকল বেঁধে আটকে রাখার নির্দেশ দিলেন ও দিলোরা-কে রেহাই দিলেন। শুরু হয়ে গেল আরেক সংঘাত। মার্টিনা নামের সন্ন্যাসিনী গির্জা-প্রোক্ত চিকিৎসা করতে লাগলেন মারিয়া-র। আর সেই তরুণ বুদ্ধিজীবী পুরোহিত, দিলোরা, সেই বন্দিশালার হাজত ভেঙে মারিয়ার কাছে গিয়ে গোপনে তাঁকে ভালবাসার কবিতা শোনাতে লাগলেন। সেই সব কবিতাই খ্রিস্টধর্ম অনুমোদিত কিন্তু হয়তো গির্জার মন্ত্রপদ্ধতির অন্তর্গত নয়।
'পাঁচ' অধ্যায়টিতে গল্পটি এক মহিমায় মণ্ডিত হয়ে ওঠে, বদলে যেতে থাকে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের নিগড়গুলি এবং এক কিশোরী ও এক যুবক মৃত্যুর নিশ্চয়তায় ভালবাসায় অমর হয়ে উঠতে থাকে। 'উনমত শবর, উনমত শবরী'।
এই অধ্যায় অনুযায়ী পাঠের কোনও প্রয়োজনই ছিল না। উপন্যাসের আলোচনায় গল্পের সংক্ষেপণ বা সমাজের বিশ্লেষণ শিল্পের সমগ্রতার হানি ঘটায়। ইতিহাস বা সমাজবিজ্ঞানে ওই সংক্ষেপণ ও বিশ্লেষণ কাজে লাগতে পারে। সাহিত্যের কোনও কাজে আসে না।
তবু এই সংক্ষেপণটুকু করলাম শুধু একটি শিল্পপ্রক্রিয়ার গতি বুঝতে। মার্কেস কী অলঙ্ঘ্য সংগঠনে প্রতিটি অধ্যায়কে এক আয়তনে রেখেছেন। সেই সম-আয়তনগুলি কী সন্নিবেশ কুশলতায়, একের-পর-এক স্থাপিত হয়ে, একটা উপন্যাসের হর্ম্য তৈরি করে তোলে। সম-আয়তনিক না-হলে নির্মাণ স্বাভাবিক হয় না। অথচ সেই সম-আয়তনিক অধ্যায়গুলি তাদের নিজস্ব অভ্যন্তরতায় বিশদে সম্পূর্ণ ও স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। একটু বাড়িয়ে বলা যায়, অধ্যায়গুলির অভ্যন্তরের সেই সম্পূর্ণতা ও স্বাতন্ত্র এত দূর পর্যন্ত স্বাধীন যে গল্পের প্রায় কোনও লোকজনই বা কোনও সম্পর্কই বড়জোর দুটি অধ্যায় জুড়ে থাকতে পারে, তার বেশি প্রায় থাকেই না। এই নাটকীয় বিন্যাসের মধ্যে অনুস্যুত ধারাবাহিকতা ছাড়া কোনও ধারাবাহিকতা থাকে না। শুধুই ছিঁড়ে যায়, শুধু ছিঁড়ে যায়। সেই ছিঁড়ে-যাওয়ার দাগ দেখে-দেখে আমরা সমগ্রতা আবার তৈরি করে তুলি।
এই বইটিই যে আমার বেশি ভাল লাগে, বেশি আপন-প্রিয়, তার দু'টো কারণ আমি বুঝতে পারি।
প্রথম কারণ--এমন একটি গল্প লিখতে কী পরিমাণ অধ্যয়ন ও জ্ঞান, সংগ্রহ ও গোপন করতে হয়েছে তার আন্দাজ। শিল্পচর্চা কোনও বুদ্ধিজীবিতার কাজ নয়। কোনও কবি কবিতা লেখেন বলে 'বুদ্ধিজীবী' হন না। অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষও যে কত বড় কবি হতে পারেন, সেটা আমাদের দেশেও কি বলে বোঝাতে হয়? কিন্তু আধুনিক কালে, মননচর্চা ছাড়া আধুনিক শিল্প তৈরি হয় না। সেই চর্চার পর সেই চর্চার বিস্মরণ ঘটাতে হয়। কতটা চর্চার পর হাফিজ আলি খাঁ সাহেব দরবারি কানাড়ার কোমলগান্ধার শুনতে পেয়েছিলেন! কতটা চর্চার পর মার্কেস 'লাভ অ্যান্ড আদার ডেমনস'-এর আগে ওই ছোট একটি 'অফ' বসাতে পেরেছিলেন! মধ্যযুগের ইউরোপীয় খ্রিস্ট ধর্মের কী বিশাল অধ্যয়ন এই গল্পটিতে গোপন করতে পেরেছেন মার্কেস! এই শিল্প-সর্বস্বতার ধ্যানকে আপনপ্রিয় না-করে পারা যায়?
এই বইটি আমার এমন নিভৃতপ্রিয় হওয়ার দ্বিতীয় কারণটি হল--এই বইটি আমাকে আমারই ভাষার দু'টো উপন্যাসের কাছে নিয়ে যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের 'কপালকুণ্ডলা', আর, কমলকুমার মজুমদারের 'অন্তর্জলী যাত্রা'। এই দু'টো উপন্যাসেই প্রাচীনতার যে-ব্যবহার, তাকে প্রতীচ্যের অলংকার শাস্ত্রে 'বারোক' বলে। এই দু'টো উপন্যাসেই প্রত্যেকটি মানুষ প্রত্যেকের সঙ্গে বাঁধা, কিন্তু প্রত্যেকের কাছেই সেটা বন্ধন। প্রত্যেকেই সে-বন্ধন থেকে মুক্তি চাইছে অথচ বন্ধন এড়াতে পারছে না।
মনে হয় 'অফ লাভ অ্যান্ড আদার ডেমনস' আমাদের বাংলা ভাষাতে লেখা একটি গল্প, 'পথের পাঁচালী', 'কপালকুণ্ডলা' 'অন্তর্জলী যাত্রা'-র মতো।
বড় চেনা প্রাচীন, বড় অনুভবের বর্তমান।
মার্কেস আমাদের বাংলা ভাষার লেখক।
0 মন্তব্যসমূহ