এক যন্ত্রণাময় দুঃখ-সুরের গল্প, তীব্রভাবে বিঁধে থাকবারও গল্প
জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা
জীবনে-বৃক্ষের শাখা-প্রশাখায় থাকে অনেক রকমের সম্ভাবনা--সফলতা কিংবা ব্যর্থতার। কার জীবনে কোন সে সম্ভাবনা ছুঁয়ে যাবে, কেউ তা জানে না! একই ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও একেকজনের জীবনের সার্থকতা বা ব্যর্থতা একেক রকমের হয় আর সেটাই স্বাভাবিক ঘটনা।
তারপরও না পারার বা ব্যর্থতায় ভরা জীবনটা যে কতখানি হাহাকারের, কী এক দম বন্ধ করা কষ্টের, তা কি আমরা আদৌ জানি কিংবা বুঝি? আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এমন কোনও জীবন নিয়মিত দেখে থাকলেও, আসলেই কি তা দেখতে পাই? আর দেখলেও, কতখানিই বা তার দেখি! সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত-এর 'আবির্ভাব' গল্পটি ঠিক তেমনই; দেখেও না দেখা, জেনেও না জানা, সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় বিপর্যস্ত এক জীবনের গল্প। ব্যর্থতায় ভরা আখ্যানেও স্বপ্ন কিংবা আশা নিয়েই চলতে থাকে মানুষের জীবনে চিরন্তন এক যুদ্ধ। আর তারই অসাধারণ প্রকাশ, দিব্যেন্দু পালিত-এর অনবদ্য এ গল্প।
গল্পের মূল চরিত্র প্রিয়নাথ এবং তার পরিবারকে লেখক যেভাবে এঁকেছেন, তাতে পাঠকের নিশ্চিতভাবেই মনে হবে যে এদেরকে তিনি চেনেন। জীবনের কোনও-না-কোনও পর্যায়ে বন্ধু বা প্রতিবেশী হিসেবে নিশ্চয়ই কোথাও প্রিয়নাথদেরকে দেখেছেন। লেখকের লেখায় নতুন করে দেখতে গিয়ে পাঠকের বুকটা তাই একটু বেশিই হু হু করে ওঠে। শুধুমাত্র গল্পের বিষয়বস্তু জীবন থেকে সরাসরি তুলে নিলেই বুঝি এমনটা হতে পারে! গল্পের মূল ঘটনাটি প্রিয়নাথ এবং তার পরিবারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও, আমাদের পুরো সমাজটিই এখানে দেখা গিয়েছে। কীভাবে-- খুব অল্প করে, ঠিক যেমনভাবে মঞ্চ নাটকের থিম বুঝে নেয়া যায়--পর্দার আড়াল থেকে করা আলো-আঁধারির অপূর্ব নিয়ন্ত্রণে! গল্পে দেখা যায়, প্রিয়নাথ এম-এ পাশ, দারুন শিক্ষিত-সজ্জন হওয়া সত্ত্বেও জীবন যুদ্ধে একজন পরাজিত মানুষ। জ্ঞানে-গুণে যথেষ্ট যোগ্যতা থাকার পরও, নিম্নবিত্তের জটিল এক জীবন বেছে নিতে বাধ্য এমন এক মানুষ! স্ত্রী শ্যামা এবং তিন সন্তান- ভুনি, টাকু, বিনি-কে নিয়ে সে যে পাড়ায় থাকত, সেই পাড়ার মানুষের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ অবশ্য মন্দ নয়। আর কে না জানে, নিম্নবিত্ত হয়েও মধ্য বা উচ্চবিত্তের মানুষের সাথে 'কোনও রকমের টিকে থাকা'টিও যে ভয়ানক কঠিন! যদিও সে-পাড়ার লোকজন মোটেও কুজন নয়; তারা তাদের পালা-পার্বণে নিয়মিত তাকে নিমন্ত্রণ করে, বরঞ্চ প্রিয়নাথের পরিবারকে একবেলা বেশিই খেতে বলে। বাড়িতে গণ্যমান্য অতিথি এলে, তারা প্রিয়নাথকে তাদের সঙ্গে কথা বলতে ডাকে। পাড়ার লোকজন এটাও মানে যে, জ্ঞানে-গুণে প্রিয়নাথ সমৃদ্ধ। তবু, তবু কী যে এক ভয়ানক আত্মগ্লানিতে প্রতিনিয়ত সে জ্বলতে থাকে! প্রিয়নাথের অন্তরের সে জ্বালা সাদা কাগজের কালো অক্ষরেও এমনভাবে চলে এসেছে যে পাঠকও কম-বেশি পুড়তে থাকেন।
ক্ষুধা, দারিদ্র এবং তৎসংলগ্ন পরিস্থিতি থেকে উদ্ভুত জীবনবোধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এ গল্পজুড়ে। গল্পে দেখা যায়, প্রিয়নাথরা কখনওই তাদের গরিব বাসায় আমন্ত্রণ জানাতে পারে না তাদের বন্ধু-প্রতিবেশীদেরকে। কিন্তু সন্তানদের অন্যের নিমন্ত্রণে যাবার লোভাতুর বা ছেলেমানুষি আগ্রহকে সে বাঁধা দিতে পারে না, সম্ভবত নিজের অক্ষমতার কথা ভেবেই। তাই সে আর তার স্ত্রী একটা আপস করে নেয়। কোন বারের দাওয়াতে সে, আবার কোন বারের দাওয়াতে তার স্ত্রী তাদের সন্তানদের সঙ্গী হয়। ছেলেমেয়েদের ক্ষুধা নিবৃত্তিতে বাঁধা দিতে না পারলেও, অসুস্থতার ভাণ করে নিজেরা যুগ্মভাবে নিমন্ত্রণে যাওয়া থেকে বিরত থাকত। আর, 'এইভাবে লোকের চোখে না হলেও নিজেদেরই চোখে তারা পুরোপুরি কাঙাল হওয়া ঠেকিয়ে রাখত'। এভাবেই দিন কাটছিল, কেটেও যেতে পারত প্রিয়নাথের বাকি দিনগুলোও। কিন্তু স্ত্রী শ্যামা এবং কন্যা ভুনি'র হঠাৎ খুব ইচ্ছে হয়, তাদের বাড়িতেও কেউ আসুক। নিমন্ত্রণ করার সামর্থ্য নেই তো কী হয়েছে, কোন একজন 'বড় মানুষে'র পদধূলি তো বাড়িতে পড়তেই পারে, পাড়ার লোক না হয় শুধু এটুকুই দেখুক! প্রিয়নাথের অনাগ্রহ সত্ত্বেও শেষে সিদ্ধান্ত হয় যে তারা তাদের একমাত্র চেনা 'বড় মানুষ'টিকে অনুরোধ করবে, তাদের বাসায় পদধূলি দিতে। প্রিয়নাথ তার বহুদিন আগের বন্ধুস্থানীয় (মেসে একসঙ্গে থাকা বড়ভাই), এখনকার একজন 'বড়-মানুষ হ-বাবু'র সঙ্গে দেখা করতে যায়, ঠিকানা খুঁজে বের করে। 'হ-বাবু'-এমন নাম শুনে কি অবাক লাগছে? হ্যাঁ, 'হ-বাবু' নামেই পরিচয় করান লেখক আলোচ্য এই 'বড় মানুষ'টিকে। আচ্ছা এমন অদ্ভুত নাম দিয়ে কি লেখক আগেই কোন ব্যাঙ্গাত্বক বিষয়ের ধারণা দিতে চেয়েছিলেন? সে যাই হোক, বিশাল বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই প্রিয়নাথের হঠাৎ মনে পড়ে যায়, এই ইমারতে কোনও একটি সামান্য ইটের সমান হলেও তার অবদান আছে, 'হ-বাবু'র এমন বিরাটকায় 'বড় মানুষ' হয়ে উঠবার পিছনে। অবশ্য আবার মুহূর্তেই বুঝে নেয়, বড় মানুষ হয়ে উঠতে গেলে ওসব ছোটখাটো ইটের অবদান মনে রাখতে নেই।
প্রিয়নাথের মনে বেশ একটু দ্বিধা থাকে- এভাবে এতদিন বাদে পুরনো পরিচয় খুঁড়ে কেউ কি শুধুই বড় মানুষের পদধূলির জন্য অনুরোধ করতে চলে আসে? স্ত্রী শ্যামা'র মনে দৃঢ় বিশ্বাস, যে বড় মানুষের পদধূলিতে 'মঙ্গল' থাকে। স্ত্রীর ইচ্ছেয়, সন্তানদের আগ্রহে এভাবে বড়মানুষকে বাসায় যাবার জন্য অনুরোধ করতে ছুটে আসা--সে কি নিজের জীবনভর ব্যর্থতারই কিছুটা পূরণের উদ্দেশ্যে? কে জানে! অন্য দর্শনার্থীদের সঙ্গে অপেক্ষা করতে করতে এক পর্যায়ে প্রিয়নাথের ডাক আসে। প্রথমে হ-বাবু তাকে চিনতে পারেন না। মনে করিয়ে দিলে পরে মনে পড়ে যায়। হ-বাবু জানতে চান, সে কী করছে। দু'তিনটে টিউশনি, পোস্টাপিসে মানি অর্ডার আর চিঠি লিখে দিনাতিপাত করছে শুনে হ-বাবু ভাবেন প্রিয়নাথ চাকরির খোঁজেই এসেছে। 'কুঁজো-হওয়া ঘাড়ে ছোট্ট একটা ঘা লাগল প্রিয়নাথের'। যদিও সে পরক্ষণেই বোঝে এ পরিস্থিতিতে এমন ধারণা অমূলক নয়। প্রিয়নাথ গুছিয়েই বলে তার আগমনের কারণ। হ-বাবু শুনে বলেন, 'ছেলেমেয়েদের শখ! নাকি ইমেজ বাড়াতে চাও?' থতমত খেয়ে প্রিয়নাথ জানায়, গরিবের ইমেজ কিছুতে বদলায় না। হ-বাবু হেসে জানান, 'ঠিক। ঠিকই বলেছ। তবে এসব শখ মেটানোর সময় কোথায় বলো! পৃথিবীর মজাই হল যারা শখ মেটাতে চায় তাদের চেয়ে যারা শখ মেটাবে তাদের সংখ্যা অনেক কম। সময় কোথায়!' কী নিদারুন বাক্যবাণ! গল্পের ছত্রে ছত্রে রয়েছে এমন সব তির্যক বাস্তবতা। প্রচলিত জীবনে গা-ভাসানো পাঠককেও লেখক এ গল্পে না ভাবিয়ে ছাড়েন না।
প্রিয়নাথের কাছ থেকে যেহেতু হ-বাবু তাদের ঠিকানাটি নিয়ে রেখেছেন; তারা ভেবে নেয়, তিনি আসবেন। আর তাই স্ত্রী শ্যামা এবং সন্তানেরা উঠে পড়ে লাগে ঘরদোর গুছিয়ে-নিকিয়ে, কোনো রকম করে হলেও সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে। পাড়ার লোকেরা কেউ কেউ বিশ্বাস করে। কেউ বা ভেবে নেয় এ নিশ্চয়ই এমনি দেয়া আশ্বাস; বড় মানুষ কি আর সত্যি সত্যি আসে? প্রিয়নাথের স্ত্রী এবং সন্তানেরা স্বপ্ন দেখতে থাকে, নিজেদের দারুন কোনও এক মঙ্গল-কামনায় বিভোর হতে থাকে। অস্তিত্ব প্রমাণের মরণ-পণ সে আশায় পরিবারের লক্ষ্মী-ঝাঁপি'র শেষ সম্বলটুকুও উপুড় করে দেয় ভাঙাচোরা ঘরটি পরিপাটি করতে। তারপর এক ভয়ঙ্কর বৃষ্টির বিকেলে, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, এমন কি প্রিয়নাথকেও অবাক করে দিয়ে হ-বাবু এলেন। গাড়ি থেকে নেমে বৃষ্টি কাদায় মাখামাখি হয়ে ঘরে ঢুকলেন। স্ত্রী শ্যামা দেখল, নিকোনো মেঝে জুতোর কাদায় মাখামাখি। প্রিয়নাথ বলল, ওসব পরে পরিষ্কার করাই ভাল হবে, এখন বরং কিছু চা-জল খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে হুট করে অতিথি আসলে কিছুই থাকে না তাদের ঘরে। শ্যামা সে ব্যবস্থা করতে চলে যায় রান্নাঘরে। আর মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকে, পাড়া প্রতিবেশীর উপচে পড়া ভিড় উঠোনে। হ-বাবু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, 'এরা কারা, প্রিয়নাথ?' প্রিয়নাথ জানায়, পাড়ার লোক, তাদের প্রিয়জন, তাঁকে দেখতেই এসেছেন। হ-বাবু বলে ওঠেন, 'এই ভয়ই পাচ্ছিলাম। ভিড়, যেখানে যাই সেখানেই ভিড়। লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবে, পৃথিবীর জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশের কোনও পজিটিভ কন্ট্রিবিউশন নেই। এরা শুধুই ভিড়।' কথা সত্যি, কিন্তু তবু কেমন যেন ধাক্কার মতো লাগে! তীব্র এ আঘাতগুলো কেউ না কেউ তো, কাউকে না কাউকেই দেই! আবার কতজন কতভাবেই না প্রিয়নাথ হয়ে যাই, আঘাতগুলো বুকে গেঁথে নেই। গল্পের হ-বাবু শ্যামার আতিথিয়তার জন্য আর অপেক্ষা করেন না। ছেলেমেয়েদের মাথায় হাত রেখে, অল্প কিছুক্ষণ বসেই চলে যান। গল্পের শেষ পর্যায়ে এসেই পাঠক পৌঁছে যান দারুন এক নাটকীয় অংশে। হ-বাবু'র জুতোর কাদা-দাগ শ্যামারা কিছুতেই ওঠাতে পারে না। ঘষে, মুছে, হাজার চেষ্টা করেও পারে না। পাড়া-প্রতিবেশী'র বিভিন্ন পরামর্শ ব্যর্থ হয়। যখন আর কিছুতেই কিছু হল না, তখন সবাই ধরে নিল ব্যাপারটা মোটেই মঙ্গলসূচক নয়। এই অদ্ভুত এবং অলৌকিক ঘটনার পর থেকে প্রিয়নাথের জীবন ক্রমশ অন্যরকম হতে লাগল। পাড়ার কোন উৎসব বা কোন কিছুতেই তাদেরকে কেউ আর ডাকত না। তারা যেন সবার চোখে ভীষণ এক অমঙ্গলের চিহ্ন হয়ে উঠল। অল্প দু'এক জন যারা শেষ পর্যন্ত আসতো, তারাও শুধু ওই দাগ দেখতেই আসত। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনলেই তারা বুঝতে পারত আর নিঃশব্দে দরজা খুলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকত।
প্রখ্যাত গদ্যসাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত-এর 'আবির্ভাব' গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারত। একজন পাঠকের অসাধারণ গল্পপাঠের সীমাহীন পরিতৃপ্তিটুকু বোধহয় সেক্ষেত্রেও থাকত। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে গল্পের শেষ প্রান্তের চূড়ান্ত নাটকীয় পরিণতির পরও সেই তৃপ্তি পাঠকের থাকে। গল্পটি শেষ হতে দেখা যায় এভাবে--
'একদিন দরজা খুলল না। তখন পুলিশ এল। এবং দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দেখল, বড় মানুষের পায়ের দাগগুলোকে সামনে রেখে পর পর শুয়ে আছে প্রিয়নাথের পরিবারের শীর্ণ, কঙ্কালসার পাঁচটি মানুষ। কেউই জানতে চাইল না কেন এমন হল।
তবে, অনেকেই বলল, কোনও বড় মানুষের আবির্ভাবের পর অনেক সময়েই এমন হয়।'
প্রথম থেকেই ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল, তবু শেষপ্রান্তেই যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে 'আবির্ভাব' নামটির আসল সার্থকতা। গল্পের এই নাটকীয় পরিসমাপ্তি কতখানি বাস্তবসম্মত হল--সে ভাবনার ঘুর-পথে, সাহিত্যের অতি বড় সমালোচকও বোধহয় হাঁটতে চাইবেন না। কেননা, গল্পের মূল বক্তব্য যে বাস্তবতার নিরিখে পুরোটাই গদ্যময়! আনন্দ-সুখকে ছন্দে ছন্দে এঁকে দেখানো সহজ, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণাকে নয়। শুধুমাত্র একজন শক্তিশালী গল্পকারই পারেন স্বপ্ন, আশা, আনন্দর সঙ্গে দুঃখ, হতাশা আর বেদনাকেও এক সুরে, এক তালে বেঁধে রাখতে। সুলেখক দিব্যেন্দু পালিত-এর 'আবির্ভাব' তেমনই এক যন্ত্রণাময় দুঃখ-সুরের গল্প, যা পাঠককূল অনেক অনেক কাল মনে রাখবেন। এবং পাঠক গল্পটি শুধু ভাববেনই না; তীব্রভাবে গল্পটিতে বিঁধেও থাকবেন!
-----------------------------
...........................আবির্ভাব গল্পটি পড়ুন--লিঙ্ক
লেখক পরিচিতি
জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা গল্পকার। প্রবন্ধকার।
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী।
জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা
জীবনে-বৃক্ষের শাখা-প্রশাখায় থাকে অনেক রকমের সম্ভাবনা--সফলতা কিংবা ব্যর্থতার। কার জীবনে কোন সে সম্ভাবনা ছুঁয়ে যাবে, কেউ তা জানে না! একই ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও একেকজনের জীবনের সার্থকতা বা ব্যর্থতা একেক রকমের হয় আর সেটাই স্বাভাবিক ঘটনা।
তারপরও না পারার বা ব্যর্থতায় ভরা জীবনটা যে কতখানি হাহাকারের, কী এক দম বন্ধ করা কষ্টের, তা কি আমরা আদৌ জানি কিংবা বুঝি? আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এমন কোনও জীবন নিয়মিত দেখে থাকলেও, আসলেই কি তা দেখতে পাই? আর দেখলেও, কতখানিই বা তার দেখি! সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত-এর 'আবির্ভাব' গল্পটি ঠিক তেমনই; দেখেও না দেখা, জেনেও না জানা, সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় বিপর্যস্ত এক জীবনের গল্প। ব্যর্থতায় ভরা আখ্যানেও স্বপ্ন কিংবা আশা নিয়েই চলতে থাকে মানুষের জীবনে চিরন্তন এক যুদ্ধ। আর তারই অসাধারণ প্রকাশ, দিব্যেন্দু পালিত-এর অনবদ্য এ গল্প।
গল্পের মূল চরিত্র প্রিয়নাথ এবং তার পরিবারকে লেখক যেভাবে এঁকেছেন, তাতে পাঠকের নিশ্চিতভাবেই মনে হবে যে এদেরকে তিনি চেনেন। জীবনের কোনও-না-কোনও পর্যায়ে বন্ধু বা প্রতিবেশী হিসেবে নিশ্চয়ই কোথাও প্রিয়নাথদেরকে দেখেছেন। লেখকের লেখায় নতুন করে দেখতে গিয়ে পাঠকের বুকটা তাই একটু বেশিই হু হু করে ওঠে। শুধুমাত্র গল্পের বিষয়বস্তু জীবন থেকে সরাসরি তুলে নিলেই বুঝি এমনটা হতে পারে! গল্পের মূল ঘটনাটি প্রিয়নাথ এবং তার পরিবারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও, আমাদের পুরো সমাজটিই এখানে দেখা গিয়েছে। কীভাবে-- খুব অল্প করে, ঠিক যেমনভাবে মঞ্চ নাটকের থিম বুঝে নেয়া যায়--পর্দার আড়াল থেকে করা আলো-আঁধারির অপূর্ব নিয়ন্ত্রণে! গল্পে দেখা যায়, প্রিয়নাথ এম-এ পাশ, দারুন শিক্ষিত-সজ্জন হওয়া সত্ত্বেও জীবন যুদ্ধে একজন পরাজিত মানুষ। জ্ঞানে-গুণে যথেষ্ট যোগ্যতা থাকার পরও, নিম্নবিত্তের জটিল এক জীবন বেছে নিতে বাধ্য এমন এক মানুষ! স্ত্রী শ্যামা এবং তিন সন্তান- ভুনি, টাকু, বিনি-কে নিয়ে সে যে পাড়ায় থাকত, সেই পাড়ার মানুষের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ অবশ্য মন্দ নয়। আর কে না জানে, নিম্নবিত্ত হয়েও মধ্য বা উচ্চবিত্তের মানুষের সাথে 'কোনও রকমের টিকে থাকা'টিও যে ভয়ানক কঠিন! যদিও সে-পাড়ার লোকজন মোটেও কুজন নয়; তারা তাদের পালা-পার্বণে নিয়মিত তাকে নিমন্ত্রণ করে, বরঞ্চ প্রিয়নাথের পরিবারকে একবেলা বেশিই খেতে বলে। বাড়িতে গণ্যমান্য অতিথি এলে, তারা প্রিয়নাথকে তাদের সঙ্গে কথা বলতে ডাকে। পাড়ার লোকজন এটাও মানে যে, জ্ঞানে-গুণে প্রিয়নাথ সমৃদ্ধ। তবু, তবু কী যে এক ভয়ানক আত্মগ্লানিতে প্রতিনিয়ত সে জ্বলতে থাকে! প্রিয়নাথের অন্তরের সে জ্বালা সাদা কাগজের কালো অক্ষরেও এমনভাবে চলে এসেছে যে পাঠকও কম-বেশি পুড়তে থাকেন।
ক্ষুধা, দারিদ্র এবং তৎসংলগ্ন পরিস্থিতি থেকে উদ্ভুত জীবনবোধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এ গল্পজুড়ে। গল্পে দেখা যায়, প্রিয়নাথরা কখনওই তাদের গরিব বাসায় আমন্ত্রণ জানাতে পারে না তাদের বন্ধু-প্রতিবেশীদেরকে। কিন্তু সন্তানদের অন্যের নিমন্ত্রণে যাবার লোভাতুর বা ছেলেমানুষি আগ্রহকে সে বাঁধা দিতে পারে না, সম্ভবত নিজের অক্ষমতার কথা ভেবেই। তাই সে আর তার স্ত্রী একটা আপস করে নেয়। কোন বারের দাওয়াতে সে, আবার কোন বারের দাওয়াতে তার স্ত্রী তাদের সন্তানদের সঙ্গী হয়। ছেলেমেয়েদের ক্ষুধা নিবৃত্তিতে বাঁধা দিতে না পারলেও, অসুস্থতার ভাণ করে নিজেরা যুগ্মভাবে নিমন্ত্রণে যাওয়া থেকে বিরত থাকত। আর, 'এইভাবে লোকের চোখে না হলেও নিজেদেরই চোখে তারা পুরোপুরি কাঙাল হওয়া ঠেকিয়ে রাখত'। এভাবেই দিন কাটছিল, কেটেও যেতে পারত প্রিয়নাথের বাকি দিনগুলোও। কিন্তু স্ত্রী শ্যামা এবং কন্যা ভুনি'র হঠাৎ খুব ইচ্ছে হয়, তাদের বাড়িতেও কেউ আসুক। নিমন্ত্রণ করার সামর্থ্য নেই তো কী হয়েছে, কোন একজন 'বড় মানুষে'র পদধূলি তো বাড়িতে পড়তেই পারে, পাড়ার লোক না হয় শুধু এটুকুই দেখুক! প্রিয়নাথের অনাগ্রহ সত্ত্বেও শেষে সিদ্ধান্ত হয় যে তারা তাদের একমাত্র চেনা 'বড় মানুষ'টিকে অনুরোধ করবে, তাদের বাসায় পদধূলি দিতে। প্রিয়নাথ তার বহুদিন আগের বন্ধুস্থানীয় (মেসে একসঙ্গে থাকা বড়ভাই), এখনকার একজন 'বড়-মানুষ হ-বাবু'র সঙ্গে দেখা করতে যায়, ঠিকানা খুঁজে বের করে। 'হ-বাবু'-এমন নাম শুনে কি অবাক লাগছে? হ্যাঁ, 'হ-বাবু' নামেই পরিচয় করান লেখক আলোচ্য এই 'বড় মানুষ'টিকে। আচ্ছা এমন অদ্ভুত নাম দিয়ে কি লেখক আগেই কোন ব্যাঙ্গাত্বক বিষয়ের ধারণা দিতে চেয়েছিলেন? সে যাই হোক, বিশাল বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই প্রিয়নাথের হঠাৎ মনে পড়ে যায়, এই ইমারতে কোনও একটি সামান্য ইটের সমান হলেও তার অবদান আছে, 'হ-বাবু'র এমন বিরাটকায় 'বড় মানুষ' হয়ে উঠবার পিছনে। অবশ্য আবার মুহূর্তেই বুঝে নেয়, বড় মানুষ হয়ে উঠতে গেলে ওসব ছোটখাটো ইটের অবদান মনে রাখতে নেই।
প্রিয়নাথের মনে বেশ একটু দ্বিধা থাকে- এভাবে এতদিন বাদে পুরনো পরিচয় খুঁড়ে কেউ কি শুধুই বড় মানুষের পদধূলির জন্য অনুরোধ করতে চলে আসে? স্ত্রী শ্যামা'র মনে দৃঢ় বিশ্বাস, যে বড় মানুষের পদধূলিতে 'মঙ্গল' থাকে। স্ত্রীর ইচ্ছেয়, সন্তানদের আগ্রহে এভাবে বড়মানুষকে বাসায় যাবার জন্য অনুরোধ করতে ছুটে আসা--সে কি নিজের জীবনভর ব্যর্থতারই কিছুটা পূরণের উদ্দেশ্যে? কে জানে! অন্য দর্শনার্থীদের সঙ্গে অপেক্ষা করতে করতে এক পর্যায়ে প্রিয়নাথের ডাক আসে। প্রথমে হ-বাবু তাকে চিনতে পারেন না। মনে করিয়ে দিলে পরে মনে পড়ে যায়। হ-বাবু জানতে চান, সে কী করছে। দু'তিনটে টিউশনি, পোস্টাপিসে মানি অর্ডার আর চিঠি লিখে দিনাতিপাত করছে শুনে হ-বাবু ভাবেন প্রিয়নাথ চাকরির খোঁজেই এসেছে। 'কুঁজো-হওয়া ঘাড়ে ছোট্ট একটা ঘা লাগল প্রিয়নাথের'। যদিও সে পরক্ষণেই বোঝে এ পরিস্থিতিতে এমন ধারণা অমূলক নয়। প্রিয়নাথ গুছিয়েই বলে তার আগমনের কারণ। হ-বাবু শুনে বলেন, 'ছেলেমেয়েদের শখ! নাকি ইমেজ বাড়াতে চাও?' থতমত খেয়ে প্রিয়নাথ জানায়, গরিবের ইমেজ কিছুতে বদলায় না। হ-বাবু হেসে জানান, 'ঠিক। ঠিকই বলেছ। তবে এসব শখ মেটানোর সময় কোথায় বলো! পৃথিবীর মজাই হল যারা শখ মেটাতে চায় তাদের চেয়ে যারা শখ মেটাবে তাদের সংখ্যা অনেক কম। সময় কোথায়!' কী নিদারুন বাক্যবাণ! গল্পের ছত্রে ছত্রে রয়েছে এমন সব তির্যক বাস্তবতা। প্রচলিত জীবনে গা-ভাসানো পাঠককেও লেখক এ গল্পে না ভাবিয়ে ছাড়েন না।
প্রিয়নাথের কাছ থেকে যেহেতু হ-বাবু তাদের ঠিকানাটি নিয়ে রেখেছেন; তারা ভেবে নেয়, তিনি আসবেন। আর তাই স্ত্রী শ্যামা এবং সন্তানেরা উঠে পড়ে লাগে ঘরদোর গুছিয়ে-নিকিয়ে, কোনো রকম করে হলেও সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে। পাড়ার লোকেরা কেউ কেউ বিশ্বাস করে। কেউ বা ভেবে নেয় এ নিশ্চয়ই এমনি দেয়া আশ্বাস; বড় মানুষ কি আর সত্যি সত্যি আসে? প্রিয়নাথের স্ত্রী এবং সন্তানেরা স্বপ্ন দেখতে থাকে, নিজেদের দারুন কোনও এক মঙ্গল-কামনায় বিভোর হতে থাকে। অস্তিত্ব প্রমাণের মরণ-পণ সে আশায় পরিবারের লক্ষ্মী-ঝাঁপি'র শেষ সম্বলটুকুও উপুড় করে দেয় ভাঙাচোরা ঘরটি পরিপাটি করতে। তারপর এক ভয়ঙ্কর বৃষ্টির বিকেলে, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, এমন কি প্রিয়নাথকেও অবাক করে দিয়ে হ-বাবু এলেন। গাড়ি থেকে নেমে বৃষ্টি কাদায় মাখামাখি হয়ে ঘরে ঢুকলেন। স্ত্রী শ্যামা দেখল, নিকোনো মেঝে জুতোর কাদায় মাখামাখি। প্রিয়নাথ বলল, ওসব পরে পরিষ্কার করাই ভাল হবে, এখন বরং কিছু চা-জল খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে হুট করে অতিথি আসলে কিছুই থাকে না তাদের ঘরে। শ্যামা সে ব্যবস্থা করতে চলে যায় রান্নাঘরে। আর মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকে, পাড়া প্রতিবেশীর উপচে পড়া ভিড় উঠোনে। হ-বাবু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, 'এরা কারা, প্রিয়নাথ?' প্রিয়নাথ জানায়, পাড়ার লোক, তাদের প্রিয়জন, তাঁকে দেখতেই এসেছেন। হ-বাবু বলে ওঠেন, 'এই ভয়ই পাচ্ছিলাম। ভিড়, যেখানে যাই সেখানেই ভিড়। লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবে, পৃথিবীর জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশের কোনও পজিটিভ কন্ট্রিবিউশন নেই। এরা শুধুই ভিড়।' কথা সত্যি, কিন্তু তবু কেমন যেন ধাক্কার মতো লাগে! তীব্র এ আঘাতগুলো কেউ না কেউ তো, কাউকে না কাউকেই দেই! আবার কতজন কতভাবেই না প্রিয়নাথ হয়ে যাই, আঘাতগুলো বুকে গেঁথে নেই। গল্পের হ-বাবু শ্যামার আতিথিয়তার জন্য আর অপেক্ষা করেন না। ছেলেমেয়েদের মাথায় হাত রেখে, অল্প কিছুক্ষণ বসেই চলে যান। গল্পের শেষ পর্যায়ে এসেই পাঠক পৌঁছে যান দারুন এক নাটকীয় অংশে। হ-বাবু'র জুতোর কাদা-দাগ শ্যামারা কিছুতেই ওঠাতে পারে না। ঘষে, মুছে, হাজার চেষ্টা করেও পারে না। পাড়া-প্রতিবেশী'র বিভিন্ন পরামর্শ ব্যর্থ হয়। যখন আর কিছুতেই কিছু হল না, তখন সবাই ধরে নিল ব্যাপারটা মোটেই মঙ্গলসূচক নয়। এই অদ্ভুত এবং অলৌকিক ঘটনার পর থেকে প্রিয়নাথের জীবন ক্রমশ অন্যরকম হতে লাগল। পাড়ার কোন উৎসব বা কোন কিছুতেই তাদেরকে কেউ আর ডাকত না। তারা যেন সবার চোখে ভীষণ এক অমঙ্গলের চিহ্ন হয়ে উঠল। অল্প দু'এক জন যারা শেষ পর্যন্ত আসতো, তারাও শুধু ওই দাগ দেখতেই আসত। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনলেই তারা বুঝতে পারত আর নিঃশব্দে দরজা খুলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকত।
প্রখ্যাত গদ্যসাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত-এর 'আবির্ভাব' গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারত। একজন পাঠকের অসাধারণ গল্পপাঠের সীমাহীন পরিতৃপ্তিটুকু বোধহয় সেক্ষেত্রেও থাকত। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে গল্পের শেষ প্রান্তের চূড়ান্ত নাটকীয় পরিণতির পরও সেই তৃপ্তি পাঠকের থাকে। গল্পটি শেষ হতে দেখা যায় এভাবে--
'একদিন দরজা খুলল না। তখন পুলিশ এল। এবং দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দেখল, বড় মানুষের পায়ের দাগগুলোকে সামনে রেখে পর পর শুয়ে আছে প্রিয়নাথের পরিবারের শীর্ণ, কঙ্কালসার পাঁচটি মানুষ। কেউই জানতে চাইল না কেন এমন হল।
তবে, অনেকেই বলল, কোনও বড় মানুষের আবির্ভাবের পর অনেক সময়েই এমন হয়।'
প্রথম থেকেই ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল, তবু শেষপ্রান্তেই যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে 'আবির্ভাব' নামটির আসল সার্থকতা। গল্পের এই নাটকীয় পরিসমাপ্তি কতখানি বাস্তবসম্মত হল--সে ভাবনার ঘুর-পথে, সাহিত্যের অতি বড় সমালোচকও বোধহয় হাঁটতে চাইবেন না। কেননা, গল্পের মূল বক্তব্য যে বাস্তবতার নিরিখে পুরোটাই গদ্যময়! আনন্দ-সুখকে ছন্দে ছন্দে এঁকে দেখানো সহজ, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণাকে নয়। শুধুমাত্র একজন শক্তিশালী গল্পকারই পারেন স্বপ্ন, আশা, আনন্দর সঙ্গে দুঃখ, হতাশা আর বেদনাকেও এক সুরে, এক তালে বেঁধে রাখতে। সুলেখক দিব্যেন্দু পালিত-এর 'আবির্ভাব' তেমনই এক যন্ত্রণাময় দুঃখ-সুরের গল্প, যা পাঠককূল অনেক অনেক কাল মনে রাখবেন। এবং পাঠক গল্পটি শুধু ভাববেনই না; তীব্রভাবে গল্পটিতে বিঁধেও থাকবেন!
-----------------------------
...........................আবির্ভাব গল্পটি পড়ুন--লিঙ্ক
লেখক পরিচিতি
জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা গল্পকার। প্রবন্ধকার।
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী।
0 মন্তব্যসমূহ