ভেংচি কাটা লোকটা

মাসুদুজ্জামান

জন্ম যদিও পশ্চিমে, তবু প্রাচ্য তাঁকে টেনেছিল গভীরভাবে। দেখেছিলেন দুই অসম পৃথিবীর দ্বৈরথ, যেখানে পশ্চিমের কেন্দ্রিকতার ধারণা আর স্বৈরতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের পৃথিবীটাকে বিষময় করে তুলছে। এ কারণেই প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে তীব্র বিবমিষা থেকে নিপীড়কদের জিব দেখিয়েছিলেন তিনি।

জিব, জবান আর জনতন্ত্রকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে গ্রাসের রচনাসমগ্র। সমকালীন পৃথিবীর প্রতি জিব দিয়ে এভাবে ভেংচি কাটা তারই সাজে, যিনি মানবায়নের ভাষ্য রচনায় আমৃত্যু নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু এই ভাষ্য যে কত বিচিত্র ধারায় প্রকাশিত আর প্রবাহিত হতে পারে, গ্রাসই তার অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। কেননা শুধু কথাশিল্পী নন, তিনি ছিলেন কবি, চিত্রকর, ভাস্কর, স্টেজ ডিজাইনার, চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার, জ্যাজ সংগীতশিল্পী আর রাজনৈতিক বক্তা ও ভাষ্যকার। রাজনীতি আর শিল্পের সীমানাকে ঘুচিয়ে দিয়ে নান্দনিকতার নতুন কাঠামো দাঁড় করেছিলেন গ্রাস। লক্ষ্য ছিল, শিল্পসাহিত্যের প্রতিটি প্রান্তকে ছুঁয়ে-ছেনে জীবনকে দেখা।

টিন ড্রামের (১৯৫৮) সুবাদে গ্রাস ঔপন্যাসিক হিসেবেই সমাদৃত হয়েছেন, পরে জুটেছে নোবেল পুরস্কারও। টিন ড্রামের পিঠাপিঠি ‘বিড়াল ও ইঁদুর’ (১৯৬১) আর ‘কুকুরবছরগুলি’ (১৯৬৩) মিলিয়েই সৃষ্টি করেছেন দানজিগ ট্রিয়োলজি। প্রথম উপন্যাসের মাধ্যমেই অর্জন করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি, তবু জার্মান আত্মপরিচয়ের পরিসরেই গ্রাসকে বিবেচনা করতে হবে। এই পরিচয় নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠার স্রষ্টাও তিনি। লেখক হিসেবে গ্রাসের মহিমা এখানেই। 

গ্রাসের উত্থান তাই বেশ চমকপ্রদ। তত দিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে গেছে। জার্মান জুড়ে চলছে পরাজিত জনজাতির শূন্যপ্রহর। কিন্তু বৌদ্ধিক জাগৃতি তো থেমে থাকে না। অস্ত্রের ভাষাকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের বিবেকী প্রবর্তনায় একদল লেখক গড়ে তুললেন ‘সাতচল্লিশ গোষ্ঠী’। হাইনরিশ বোলের সঙ্গে ওই গোষ্ঠীর পুরোধা পুরুষ হিসেবে সমোচ্চারিত হতে থাকল গ্রাসের নাম। নাৎসিদের নারকীয় কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি পশ্চিমী অর্থনীতির আকস্মিক উত্থানকে কড়া ভাষায় সমালোচনা করলেন তাঁরা। সময়ের সাহসী রূপকারদের অন্যতম প্রবক্তা হয়ে উঠলেন গ্রাস। 

টিন ড্রামের বামন অস্কারের হাতে টিনের ঢোলে যে তীব্র আওয়াজ উঠল, তাতে ভেঙে পড়া কাচের ঝনঝনানি হুড়মুড় করে সময়ের ভাঙনেরই প্রতীক হয়ে দাঁড়াল। শোনা গেল এয়েটসের সেই কথারই প্রতিধ্বনি, ‘সব কিছু ছত্রখান’।
শিল্পে কিছুটা হলেও জীবনের মিথ্যাকে মিশিয়ে দিতে হয়। গ্রাসও ছিলেন অনৃতকথনে দক্ষ। মাকে গল্প বলার বা লেখার ইচ্ছা থেকেই মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন তিনি আর গল্পের এই মিথ্যাকে ভাষারূপ দিতে গিয়ে হয়ে উঠেছেন কাহিনীকার, ঔপন্যাসিক। তাঁর বয়স যখন ১২ বছর, লিখে ফেলতে চাইলেন নিজের প্রথম উপন্যাস। কিন্তু বিভ্রম ঘটল তখনই, প্রথম পরিচ্ছেদের শেষে সব চরিত্রকে যখন তিনি মেরে ফেললেন। উপন্যাসটি তাই আর এগোয়নি। সেই প্রথম ঘটল তাঁর শিল্পশিক্ষা, বিশেষ করে উপন্যাস কেমন করে লিখতে হয় সেই শিক্ষা। আÍপ্রতিষ্ঠার এই শিক্ষা থেকেই পরে গ্রাস গজদন্ত মিনারের অধিবাসী না থেকে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি চলে আসার গরজ অনুভব করেছেন। জড়িয়ে পড়েছেন রাজনীতিতে। 
 
গত শতকের ষাটের দশক থেকে রাজনৈতিক এই অভিপ্রায় থেকেই ওই ট্রিয়োলজির পর লিখলেন, ‘শামুকের দিনপঞ্জি থেকে’ (১৯৭৭), ‘তেলগেতে সাক্ষাৎ’ (১৯৭৯) শীর্ষক কয়েকটি উপন্যাস। এই উপন্যাসগুলোতেই রাজনীতি ও শিল্প পরম্পরিত হয়ে গড়ে তুলেছে গ্রাসের কথনবিশ্ব, বিশেষ করে প্রথম বইটি জীবজগতের প্রতি তাঁর সহমর্মিতার নিদর্শন হয়ে আছে। আগে যে জীবজন্তুকে তিনি কিছুটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছিলেন, তাই দুর্মর মমত্ববোধে সিক্ত হতে থাকে। এরপর তাঁর এই ভাবনা ‘রাঘব বোয়াল’ (১৯৭৭) এবং ‘ইঁদুর’ (১৯৮৭) উপন্যাস অব্দি প্রসারিত হয়েছে। শিল্প ও জীবনের মেলবন্ধনকেই এরপর থেকে সারা জীবন আরাধ্য ভেবেছেন এই জার্মান লেখক।

শুধু শিল্পের সঙ্গে জীবন নয়, শিল্পের সঙ্গে শিল্পেরও যে সংযোগ আছে এবং তা যে অনেক গভীর, একই রচনায় নানা মাধ্যমের বিমিশ্রণ ঘটিয়ে তার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। চিত্রশিল্প, আমরা জানি একটা পৃথক শিল্পমাধ্যম। ছবির ভাষা ও প্রকাশরীতির সঙ্গে কবিতার দুস্তর ব্যবধান। আবার উপন্যাসের মধ্যে কবিতার ব্যবহার অনেকটাই বেমানান। কিন্তু গ্রাস সেই সীমাও ভেঙে দিয়েছেন। আসলে টিন ড্রামের পর তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ বইটি লিখেছেন, সেই ‘রাঘববোয়াল’ উপন্যাসের মধ্যে গুঁজে দিয়েছেন নিজেরই কবিতা, ওই কবিতাগুলো লেখা হয়েছে উপন্যাসেরই ন্যারেটিভের অনিবার্য অংশ হিসেবে। ফিকশন আর নন-ফিকশনের বিভাজন আসলে অর্থহীন, এমনটাই মনে করতেন গ্রাস। ফলে একই রচনায়, হয়তো উপন্যাস, তাতে জড়িয়ে গেছে ইতিহাস, রন্ধনপ্রণালির তথ্য অথবা লিরিক কবিতা। গ্রাস নিজেই বলেছেন, শুধু এ রকম টুকরো কিছু অনুষঙ্গ নয়-ড্রইং, সংলাপ, উদ্ধৃতি, ভাষণ, চিঠিপত্তর এসবও অবলীলায় ব্যবহার করেছেন তিনি। ‘জিব দেখানো’ (১৯৮৮) নামের উপন্যাসটি, কলকাতার পটভূমিতে যেটি লেখা, ড্রইং প্রবলভাবে চেপে বসেছে। ড্রইং ছাড়া বইটি লেখা ছিল তাঁর কাছে অকল্পনীয় ব্যাপার। কলকাতার নিদারুণ দারিদ্র্য, ভাষা দিয়ে অর্থাৎ শুধু শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব হতো না বলে মনে করেছেন গ্রাস। ড্রইং আর শব্দ-একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। ড্রইং করতে করতে গ্রাস খুঁজে পেয়েছেন শব্দ বা বলার ভাষা, আবার ভাষা জুগিয়েছে ড্রইংয়ের মধ্য দিয়ে প্রকাশের অনুপ্ররণা। 

গ্রাসের লেখার ভঙ্গি শুধু নয়, পদ্ধতিটিই ছিল একেবারে আলাদা। শিল্পনিষ্ঠার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে গেছেন তিনি। গ্রাস একবার নয়, যেকোনো উপন্যাস তিনটি খসড়ার পর চূড়ান্ত করতেন। প্রথম খসড়াটা লিখতেন খুব দ্রুত। তাতে থাকত অনেক গর্ত, জানিয়েছেন গ্রাস। দ্বিতীয় খসড়াটা হতো অনেক বিস্তৃত আর দীর্ঘ; অনেকটাই চূড়ান্ত। তৃতীয় খসড়াটায় ফিরিয়ে আনতেন প্রথম খসড়ার স্বতঃস্ফূর্ততা। লিখতেনও দিনের বেলা, রাতে কখনই নয়। এপিক ধরনের উপন্যাস হলে লিখেছেন প্রায় পাঁচ-ছয় বছর ধরে। শিল্পের অবিমিশ্রতা আর মানুষ সমেত তাবত জীবজন্তুর প্রতি তীব্র ভালোবাসাই ছিল গ্রাসের রচনার উৎস। মানুষের প্রতি এই অপার ভালোবাসা থেকেই তিনি বারবার ছুটে এসেছেন কলকাতায়। কলকাতাকে নরকতুল্য মনে করতেন তিনি, কিন্তু মানবিকতার টানে চলে এসেছেন। সেই সুবাদে ঢাকায়ও এসেছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য সেই একই। তৃতীয় বিশ্বের মানুষজনদের কাছে থেকে দেখা। গ্রাস মনে করতেন, কলকাতা বা ঢাকায় আলিশান বিল্ডিংয়ের পাশে যেসব বস্তি গড়ে উঠেছে, সেসব মূলত আগ্রাসী পুঁজিবাদী অর্থনীতির অসম বিন্যাস আর সংকটেরই ফল। পুঁজিবাদী দেশগুলো নগ্নভাবেই তাদের সংকটকে এভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে তৃতীয় বিশ্বে। কলকাতার বাস্তবতাকে ধরার জন্য গদ্য বা পদ্য এককভাবে যথেষ্ট মনে হয়নি গ্রাসের। পদ্যের সাহায্যেই গদ্যকে খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু এই রচনা অর্থাৎ ‘জিব দেখানো’ উপন্যাসে ড্রইং, গদ্য এবং কবিতা ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্যবহার করে ভিন্ন ভিন্ন দ্যোতনা সঞ্চারিত করেছেন। গ্রাসের উপন্যাস বা নন-ফিকশনের ভাষিক বুনট তাই বিচিত্র হয়েও লক্ষ্যচ্যুত হয়নি। 

কবিতা, পরিশেষে কবিতা তাই গ্রাসের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পমাধ্যম বলে বিবেচিত হয়েছে। মানুষের জন্য তাঁর যত ভালোবাসা, তীব্র অনুভব, সবই এসেছে কবিতার হাত ধরে। উপন্যাসের জন্মও হয় কবিতা দিয়ে। নিজেই বলেছেন, ‘আমি বলব না যে কবিতাই সব; কিন্তু এভাবে ছাড়া কোনো উপন্যাসই আমার শুরু করা হয় না। কবিতাই হচ্ছে আমার সূচনাবিন্দু।’ কবি হিসেবেও গ্রাস তুলনাহীন। তাঁর কবিতার বিষয়-আশয়ও অভিনব। বলার ভঙ্গিটিও শুধু যে নিজস্ব তাই নয়, হেন বিষয় নেই যে তিনি কবিতা করে তুলতে পারেন না। সবচেয়ে অবাক লাগে একটা ব্যাপার লক্ষ করে, তাঁর কাছে, যেসব বস্তুকে তিনি কবিতার মধ্যে নিয়ে আসেন, সবই ভীষণ জীবন্ত লাগে। অর্থাৎ বস্তুজগৎটাই তাঁর কাছে চলিষ্ণু, প্রাণবন্ত; অনেকটাই মানবায়িত। মানবসত্তার মতোই বস্তুবিশ্বেরও বুঝি ভিন্ন সত্তা আছে। দুই-একটা পঙ্ক্তি তুলে দিই : ‘নিজের থলিটায় জেগে উঠল বাতাস।/ফুঁ দিয়ে সব বাগান থেকে টিউলিপ আর সুকুমারীদের দিল তাড়িয়ে’ : ‘আমার ঘরটা হাওয়া-চুপ, / ধর্মনিষ্ঠ, একটা সিগারেট, / এতই ধর্মভীরু যে কারুরই সাহস হয় না / ভাড়া বাড়ায়।’

আগেই বলেছি, রাজনীতি তাঁর রচনার কেন্দ্র। কিন্তু কোনো দলীয়তা নয়, মানবমুখিতাই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। ফলে, নাৎসিদের ইহুদি নিধন আর হলোকাস্টের বীভৎসতার যেমন প্রতিবাদ করেছেন, তেমনি ইসরায়েলের দ্বারা ফিলিস্তিনি নিধনের বিরুদ্ধেও ঝলসে উঠেছে তাঁর কলম। পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে পূর্ব জার্মানিকে জুড়ে দেওয়ারও কঠোর সমালোচক ছিলেন তিনি। গ্রাস ভেবেছেন, এভাবে জুড়ে দেওয়ার ফলে পূর্ব জার্মানির নিজস্ব সংস্কৃতি ও জীবনযাপন রীতিকে পশ্চিম জার্মানির ছাঁচে ফেলে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। মানবীয় অভিজ্ঞানের এই যে নির্মোহ, অনপেক্ষ বিভাব, গ্রাস ছাড়া আর কারো কাছেই আমরা, বহির্বিশ্বের মানুষেরা প্রত্যাশা করিনি। সমকালের সাহিত্যবিশ্ব তাই এমন একজনকে হারাল, যাঁর শূন্যতা কখনই পরিপূরণ হবে না। বিশ্বপথিক গুন্টার গ্রাসের মৃত্যুতে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।



লেখক পরিচিতি
মাসুদুজ্জামান
কবি, প্রবন্ধকার ও অনুবাদক

প্রফেসর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ