‘মানব-মানবীর সম্পর্ক, নারী-পুরুষ তথা মা-মেয়ে, মা-বাবা, বাবা-ছেলে প্রভৃতি সম্পর্কের বিশ্লেষণ এবং অভিজ্ঞতা বিচিত্র প্রভাব রেখেছে আমার লেখাজোকায়, আর এসব সম্পর্ক বিশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন নতুন গল্প লিখেছি আমি।’[১]
নিজের লেখালেখির বলতে গিয়ে সেলিনা হোসেনে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। পৃথিবীর আদিম সাহিত্যেও এই সম্পর্কের বিস্তার দেখা যায়।
অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে তথা প্রয়োজন সাপেক্ষ আর্ট (এক্ষেত্রে এক প্রকার কৌশলই বলা যাবে তা) সৃষ্টি সময়টা বাদ দিলে, মুটোমুটি দলগত ভাবে বসবাসের সময়ে মানুষের মনোবৃত্তিক শিল্পের উৎস হিসেবে মানবিক এই সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। এটা মানুষের অস্তিত্ব অনুভবের প্রাথমিক উপায়ও। তবে সাহিত্যের আধুনিক যাত্রার সূচনায় মানুষের এই সামাজিক, মানবিক সম্পর্ককে উৎস হিসেবে বিচার করা যেতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাবৎ পৃথিবীতে রচিত সাহিত্যের বিষয়বস্তু হিসেবে এটাই সর্বধিক বৃহৃত একটি দিক। এবং এও বলা যায়, মহাকাশ গবেষণার ‘ব্ল্যাক হোল’-এর মতো এটি সবচেয়ে রহস্যময় একটি জায়গা। প্রত্যেক লেখকই এই অন্ধকারে নিত্য নতুন আলো ফেলে আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। লেখিকা সেলিনা হোসেন যখন তার নতুন গল্পের উৎস হিসেবে এই মানবিক আঁধারকে বেছে নেন, বলা যায়, তিনি উৎকেই বেছে নিয়েছেন। তার লেখালেখির সাহিত্যে প্রায়স মানুষ ও প্রকৃতির সহ অবস্থা দেখা যায়।
জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যে সংকটের মুখোমুখি হলো তা হচ্ছে, তার সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব। পৃথিবীতে যোগাযোগ ব্যবস্থা সূচনা থেকেই মানুষ ঔপনিবেশিকতার মুখোমুখি শুরু করে নতুন ও প্রবল ভাবে। তাই অবসম্ভাবি ভাবেই সাহিত্য ইতিহাসের সন্নিবেশ ঘটে। সেলিনা হোসেন যে আলো ফেলে এই সম্পর্ক দেখতে ও দেখাতে চান, তা হলো সময়। এ কারণেই তার সাহিত্যে মানবিক সম্পর্কে সঙ্গে ঘুরে ফিরে এসেছে ইতিহাস। রাষ্ট্র বিভাজনের সূচনায় বাঙালি জাতির যে উৎস, সেই ’৪৭, ’৫২, ’৭১ ঘুরে ফিরে এসেছে। এদিকে দিয়ে বিবেচনা করলেও সেলিনা হোসেনের সাহিত্য উৎস থেকেই উৎসারিত।
এই ১৪ই জুন, তিনি ৬৯ বছরে পা দিলেন তিনি। এই অতিক্রান্ত আটষট্টি বছরের মধ্যে ৫১ বছর যাবতই তিনি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছেন। এই দীর্ঘ সময় ধরে তার লেখা সংখ্যা অনেক। বিষয় বৈচিত্র্যেও তা অনন্য। মূলত বাংলা সাহিত্যে এখন অবধি যে ক’জন লেখকও বিপুল স্মৃদ্ধিতে টিকে আছেন, তার মধ্য সেলিনা হোসেন অত্যন্ত সম্মানীয়দের একজন। লেখিকার ভাষায়, ‘আমার এক হাতে লেখালেখি আরেক হাতে আমার সমস্ত জীবন।’
এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, হাজার হাজার বছরের লেখালেখির ইতিহাসে নারী লেখকের আগমন খুব বেশি দিনের না। তাছাড়া বিভিন্ন প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়েছে শুধু নারী লেখক হিসেবেই। যে কারণে তাদের সংখ্যাও অত্যন্ত কম। এমনি আধুনিক সমাজে তাদের উপেক্ষার মাত্রা এতটাই যে, দেশে ‘লেখিকা সংঘ’ বলে একটি পরিষদও দেখা যায়। সেখানে ‘নারী’ হয়েও তিনি ‘লেখক’ এ হিসেবে যেমন মূল্যায়ন চাওয়া হয়, তেমন অনেক সময় করুণা বা সুবিধা প্রার্থনাও করা হয়। তাদের অনেকের লেখাই আবার ‘নারীবাদী’ ফেনমেনা দ্বারা আক্রান্ত। সেলিনা হোসেনকে আমরা কোনো ভাবেই এই পেরিফেরি ভেতরে ফেলতে পারি না। পারি না তার লেখনির কারণে। তিনি অনেক আগেই তা লেখনির বিষয় বস্তু, বিপুল সৃষ্টি ও শক্তি দিয়েই জানান দিয়েছেন, ‘লেখক’ মানে শুধুই লেখক, তার কোনো লিঙ্গ হয় না। বরং লেখক তার উচ্চ মানবিকতার জন্যই সাহিত্যে পিছিয়ে পড়া মানুষকে তুলে আনেন। যে কারণে আমরা সেলিনা হোসেনে সাহিত্যে নানা ভাবেই নারী চরিত্রের উপস্থিতি দেখি। তবে তারা সংগ্রামী ও আত্মপ্রত্যয়ী। সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতার মতো গুরুত্ব কাজ সে প্রজ্ঞার সঙ্গেই করে।[২]
সেলিনা হোসেন লেখনির মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যে তার স্থান পাকাপাকি করে নিয়েছেন। তিনি একজন কথা-সাহিত্যিক, লেখক ও ঔপন্যাসিক। সংগ্রামী আলেখ্য তার উপন্যাসের মৌলিক উপাদান। তার সৃষ্ট অধিকাংশ চরিত্রই সংগ্রামী ও সংবেদনশীল। ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও আন্দোলন তার ঔপন্যাসিক সত্তাকে দারুন ভাবে আলোড়িত করেছে। তার উপন্যাসে রয়েছে একদিকে শ্রেণি সংগ্রামের উদ্দীপনা অপরদিকে শোষণ মুক্ত সমাজের স্বপ্ন।
এইসবের একটা সূত্র সেলিনা হোসেনের জন্ম ও লেখক হিসেবে বেড়ে ওঠার মধ্যেই পাওয়া যাবে। সেলিনা হোসেনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন। তার পৈত্রিক নিবাস বৃহত্তর নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুর জেলার হাজিরপাড়া গ্রামে। তার জন্ম সময়ের দিকে তাকালে দেখায়, পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়াবহতম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন অত্যুঙ্গ পর্য়ায়। তার জন্মের দুই বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসের ৬ ও ৯ তারিখে জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে পৃথিবীতে প্রথম আনবিক বোমা বিষ্ফোরণ ঘটানো নয়। তাৎক্ষণিক ভাবেই প্রায় আড়াই লক্ষাধিক মানুষ মারা যায় তাতে। যুদ্ধের কারণে বিশ্বেজুড়ে অনেক দেশেই তখন হতাহতের স্বীকার হয়। ভারত বর্ষে এই যু্দ্ধ বোমা বিষ্ফোরণের সারাসরি ভয়াবহতার স্বীকার না হলেও দূর্ভিক্ষের কবল পতিত করে। ইতিহাসে ‘পঞ্চাশের মনন্বতর’ খ্যাত ১৯৪৩ সালের মনন্বতর এই ভারতবর্ষেই ঘটে লেখিকা জন্মের চার বছর আগে। যাতে পারমানবিক বোমা বিষ্ফোরণে তাৎক্ষণিক নিহতের তুলনায় ২০ গুণ বেশি মানুষ মারা যায়। এই রেশ সেলিনা হোসেন জন্মমাত্রই লাভ করেন। সবচেয়ে বড় যে দিক, তার জন্মের তিন মাসের মধ্যেই ভারতবর্ষ সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভাগ হয়। আবার ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ঘটনা ঘটে তার জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যেই। আরো একটি দিক হলো, তার যে জন্মস্থান, রাজশাহী, তখন তেভাগা আন্দোলনের জন্য উত্তাল ছিল। একজন ভবিষ্যৎ সংবেদনশীল লেখক হিসেবে সেলিনা হোসেন যে এই সব ঘটনার আঁচ গায়ে মেখে বেড়ে উঠবেন তা খুবই স্বাভাবিক ছিল।
সেলিনা হোসেনের লেখালেখি শুরু সেই স্কুলবেলাতেই। গত শতকের ষাটের দশকরে মাঝামাঝি, তিনি যখন রাজশাহী উইমেন্স কলেজের ছাত্রী তখন বিভাগীয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নশিপ স্বর্ণপদক পান। পরবর্তীতে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ’৬৭ সালে বি.এ (অনার্স) ও ’৬৮ সালে এম.এ সম্পন্ন করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই তিনি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চর্চায় নিবিড় ভাবে যুক্ত হন। সে সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তাকন ছাত্র ইউনিয়ন (বর্তমান বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন) রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকে তিনি সমাজ দর্শন হিসেবে সমাজতান্ত্রকে গ্রহণ করেন। প্রসঙ্গত, ১৯৬৭ সালে বিতর্ক প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে পাঞ্জাব যাওয়ার কথা থাকলেও অস্থির রাজনৈতিক অবস্থার কারণে যাওয়া হয়নি। একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করার মতো যে, সে সময় এই রাজনৈতিক আদর্শ ও সমাজ দর্শন দ্বারা অনেকে অনুপ্রাণিত হলেও পরবর্তীতে তাদের অনেকের বোল-চাল আমূল বদলে যায়, মৌখিক স্বীকারটুকু ব্যতিরেকেই। এমনকি কেউ কেউ প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানও গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি তা পরিহার করেননি। বরং ক্রমাগত পড়াশুনা, জীবন দেখা ও বোঝার দিতে তার সত্যতা যাচাই করেছেন। লিখনীর মাধ্যমে তার বিস্তার ও দিক অন্বেষণ করেছন।
আমাদের মনে রাখতে হয়, মোটা দাগে উল্লেখ করলেও, ’৫২, ’৫৪, ’৬২, ’৬৫ এবং ’৬৯ সময় পর্ব তিনি অতিক্রম করছেন এবং শিক্ষার্থী জীবনে অত্যন্ত স্বক্রীয় ভাবে অংশ গ্রহণ করছে। মনে রাখা দরকার, ’৬৯ সালেই পাকিস্তানিতের হাতে খুন হওয়া বুদ্ধিজীবী শামসুজ্জোহা বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপক ছিলেন। সুতরাং এই সব কালপর্ব ও ঐতিহাসিক ঘটনা মনে রাখলে বলা যায়, সেলিনা হোসেনের কোনো সুযোগই ছিল না, ইতিহাস থেকে বিচ্যুত হওয়ার। বরং এও বলা যায়, সেলিনা হোসেন তার প্রজ্ঞা ও মননের মাধ্যমে তার সময় ও ইতিহাসের প্রতি যথার্থই সাড়া দিয়েছেন।
প্রথম জীবনে তিনি কবিতা দিয়েই সাহিত্য চর্চা শুরু করেছিলেন। মধ্য ষাট দশকে তিনি গল্প লেখা শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় গল্পগন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’। অর্থাৎ স্বাধীনতা পূর্ব এক সান্ধ্য ও নিয়ন্ত্রিত সময়ে একজন নারী সাহিত্য মাধ্যমে স্বক্রীয় থাকছেন, গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করছেন—এটা সত্যিই একটি উল্লেখ যোগ্য ঘটনা। সে বছর প্রবন্ধের জন্য তিনি ডক্টর এনামুল হক স্বর্ণপদ পান।
তার প্রথম গল্পগ্রন্থের নামের ভেতর যে দ্যোতনা ছিল, তা পরবর্তী সময়ের লেখা দিয়ে প্রমাণ করেছেন। তিনি এখনো বাঙালির যে উৎস তা নানা ভাবে উন্মোচর করে যাচ্ছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে যে বিপুল ও সমৃদ্ধ লিখনী দিয়ে সাহিত্যকেই পুষ্ট করেছে। ইতোমধ্যে ৩১টি উপন্যাস, ১১টি গল্পগ্রন্থ এবং ৯ প্রবন্ধের গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। এছাড়াও তার ৩০টি শিশুতোষ গ্রন্থ আছে। তিনি নারী অধিকার বিষয়ক বেশ কিছু প্রামাণিক ও গবেষণা গ্রন্থও রচনা এবং সম্পাদনা করেছেন। যা তার লেখনির সমাজ মনস্কতা ও বৈচিত্র্যকেই নির্দেশ করে।
লেখালেখির দর্শনের ব্যাপারে তিনি বরাবরই স্বচ্ছ। ‘তখন সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলাম। ভেবেছিলাম এই রাজনীতি মানুষকে ভাত, আশ্রয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের সুব্যবস্থা দেবে। মানুষের জীবন হবে স্বস্তি ও শান্তির। কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষের পরেই রাজনীতির পাঠ শেষ করে দেই, লেখালেখির জগত ধরে রাখব বলে। রাজনীতির যে আদর্শগত দিক শিক্ষাজীবনে গ্রহণ করেছিলাম তার প্রয়োগ ঘটিয়েছি লেখায়। তবে সরাসরি নয়। সৃষ্টি কাহিনী, চরিত্র, ঘটনা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে। মানবিক মূল্যবোধের জায়গা সমুন্নত রেখে। বেঁচে থাকার মাত্রার সমতার বিন্যাস ঘটিয়ে। মানুষের ভালোমন্দের বোধকে রাষ্ট্র সম্পর্কের জায়গায় রেখে আমি রাজনীতির নানাদিকের প্রতিফলন ঘটাতে চাই। সবচেয়ে বড় কথা জনসাধারণের জীবন রাজনীতি বিচ্ছিন্ন নয়। রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করে মানুষ–এটাই আমার গভীর বিশ্বাস।’ অপর সাক্ষাৎকারে তিনি এ বলেন।[৩]
১৯৭৩ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘জলোচ্ছ্বাস’। উপন্যাসটিতে তার শৈশবে প্রকৃতি, বঙ্গোপসাগর এবং অসংখ্য নদী-নালা দেখে চিত্রকল্প খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন। এখানে বাবার চাকুরির সুবাদে তার শৈশবের বেড়ে বগুড়া শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদী ও জলার দৃশ্যের ছায়া দেখা যা।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ও রাজনীতির স্বক্রীয় অংশগ্রহণ কেটে স্বৈরশাসকের যাতাকলের প্রতিবাদ করে। স্বাধীনতার পরেও বাংলাদেশে স্বৈরশাসন ফিরে এসেছে। তিনি কখনোই স্বৈরশাসন মেনে নিতে পারেন নি। তাই ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ উপন্যাসে সামরিক শাসনের প্রসঙ্গ নানা এসেছে।
সাম্প্রতিক সময় ছিটমহল প্রসঙ্গটি নানা ভাবেই আমাদের দেশে আলোচিত। লেখিকা নিজে দহগ্রাম আঙ্গরপোতা এবং পঞ্চগড় এলাকার অনেকগুলো ছিটমহল ঘুরে দেখেছেন তার ভ্রমণের নেশা থেকে। সেখানে জীবনের সংকট ও নিয়ন্ত্রিত জীবনের অভিজ্ঞতার নিরিখে লিখেন ‘ভূমি ও কুসুম’ উপন্যাসটি।
সেলিনা হোসেন জীবনে বিরূপ অভিজ্ঞতাকেও নান্দনিক উপন্যাসে রূপান্তর করেছেন। এক বিমান দূর্ঘটনায় মারা যান তার প্রিয় কন্যা বৈমানিক ফারিহা লারা। তার স্মৃতি ও লেখকি যন্ত্রণা থেকে লিখে উপন্যাস ‘লারা’। উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত স্মৃতিজাত হলেও তাতে মা-মেয়ের সম্পর্কের চিরন্তন জায়গাটিই মূখ্য করে তুলেছেন।
‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ সেলিনা হোসেনের একমাত্র ট্রিওলজি(উপন্যাস ত্রয়ী)। ১৯৯৪ সাল থেকে যথাক্রমে পরপর এর খণ্ডগুলো প্রকাশ হয়। এতে তিনি ’৪৭ থেকে ’৭৫ কালপর্বের সবগুলো রাজনৈতিক ঘটনার অভিঘাত চিত্রিত করতে চেয়েছেন। উপন্যাসটির জন্য তিনি ফোর্ড ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ পেয়েছিলেন।[৪]
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত তার গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস ‘যাপিত জীবন।’ ১৯৮১ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি পরবর্তীতে তিনি পরিবর্জন করে বৃহৎ কলেবর দিয়েছেন। এটি এখন পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিভূক্ত। এছাড়া শিলচরের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ৫টি উপন্যাস এম.ফিল গবেষণা ভূক্ত হয়েছে।
তবে তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস বলা যায় ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। ১৯৭৬ সালে এটি প্রকাশের পরই বোদ্ধাজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রক্ষাপটে রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে এটি প্রাতস্মরণীয়। লেখিকার এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, উপন্যাসটি নিয়ে উপমহাদেশের বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ’৭৫-এর পটপরিবর্তন, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু ও তার নিরাপত্তার অভাব জনিত কারণে তা আর করা হয়নি। যদিও আশির দশকে বাংলাদেশ থেকে এর চলচ্চিত্রায়ন হয়। উপন্যাসটি তাতে আন্তর্জাতিক পরিচিতিও এনেদিয়েছে। সে সময় সত্যজিৎ রায় এক চিঠিতে তাকে লেখেন, ‘‘ট্যারোড্যাকটিল’ পত্রিকায় প্রকাশিত আপনার ছোটগল্পটি পড়ে আমার যে খুব ভালো লেগেছিল তা আমি অনেককেই বলেছিলাম। গল্পটি থেকে ভালো চলচ্চিত্র হয় এ বিশ্বাসও আমার ছিল। কিন্তু তখন আমার হাতে অন্য ছবি থাকায় ওটার কথা চিন্তা করতে পারিনি। পরে বাংলাদেশে গিয়ে ছবি করার প্রশ্নে ওঠে আরেকবার; তখন শুনেছিলাম ওখানকার অবস্থা ভালো নয়, কাজে নানারকম অন্তরায়ের সম্ভাবনা আছে। সুতরাং,পরিকল্পনাটি স্থগিত থাকে।”[৫]
১৯৮৭ সালে ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশ হয়। প্যারিসের দ্য গল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান লিটারেচার-এর অধ্যাপক পাস্কেল জিন্ক (Pascal Zink) নেট থেকে বইটির ইংরেজি সংস্করণ সংগ্রহ করে অধুনিক অনুবাদের উদ্যোগ নেন। যা ভারতের রূপা প্রকাশনী সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়। তাছাড়া শিকাগোর ওকটন কমিউনিটি কলেজে এই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ চারটি সেমিস্টারে পড়ান হয়। ২০০১ সালে উপন্যাসটি ভারতের কেরালা থেকে মালয়ালাম ভাষায় অনুদিত হয়।
বরাবরই লেখালেখির পেশাকে সেলিনা হোসেন গ্রহণ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পেরুনোর পর তিনি বিভিন্ন পত্রিকার উপ-সম্পাদকীয়তে নিয়মিত লিখতেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমীর গবেষণা সহকারী হিসেবে তার প্রাতিষ্ঠানিক কর্মজীবন শুরু হয়। তিনি ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমীর প্রথম মহিলা পরিচালক হন। ২০০৪ সালের জন্ম দিনের তিনি এ পদ থেকে চাকুরী থেকে অবসর নেন। ৩৪ বছরের কর্ম সময়ে তিনি বাংলা একাডেমীর অভিধান ও বিখ্যাত লেখকদের রচনাবলী প্রকাশের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদন করেন। উল্লেখ্য, এ ছাড়াও ২০ বছরেরও বেশি সময় ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন।
তবে বাংলা একাডেমিতে গবেষণা সুবাদে ইতিহাসের বহু মানুষ সম্পর্কে সম্পর্কে জানা সুযোগ হয়। যার সাহিত্যকে জীবনী ভিত্তিক কাজে প্রবাহিত করে। তিনি বিভিন্ন সময়ে ঐতিহাসিক বিষয় ও চরিত্রের সমকালীন প্যারালালধর্মী উপন্যাস লিখেছেন। যা লেখিকার ভাষায় ‘ঐতিহ্যের নবায়ন’। তিনি মোগল আমলের বিখ্যাত কবি মির্জা গালিবের জীবনী নিয়ে লিখেন ‘যমুনা নদীর মুশায়েরা’। এতে গালিবের জীবনের একধরনে ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়। অগ্নিযুগের বিপ্লবী প্রতিলতাকে নিয়ে লিখেন ‘ভালবাসা প্রীতিলতা’।
‘নীল ময়ূরের যৌবন’ তার ইতিহাস ভিত্তিক সাহিত্য। ১৯৮৩ সালে উপন্যাসটি ইংরেজি অনুবাদ হয়। ২০০০ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ হয় তার ‘টানাপোড়েন’ উপন্যাসটি।
‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ উপন্যাসে দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকুলের মানুষের জীবনের খুবই বাস্তব এবং জটিল একটি অধ্যায় তুলে ধরেছেন সেলিনা হোসেন। শোষিত শ্রেণির উত্থানে শাসক শ্রেণির মধ্যে যে হিংসা, আতংক দেখা দেয় এবং এ থেকে উদ্ভুত ক্রোধ তাদেরকে নিকৃষ্ট কাজ করতেও বাধা দেয় না সে ব্যাপারটা সেলিনা হোসেন বেশ কৃতিত্বের সঙ্গেই দেখিয়েছেন।
১৯৪৭ এ দেশ ভাগ, রাজনৈতিক দেশি বিভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সাথে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের(যা পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত) ভয়াবহতায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া কিছু পরিবারের চিত্র নিয়ে লিখেন ‘নিরস্তার ঘন্টা ধ্বনি’। উপন্যাসটি ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিভূক্ত।
সেলিনা হোসেনের সাহিত্যে অনুপ্রেরণা অন্যতম জায়গা বলা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তার পঠন-পাঠন কত গভীর তা তার ‘পূর্ণছবির মগ্নতা’ উপন্যাসে পাওয়া যায়। উপন্যাসটিতে তিনি রবীন্দ্রনাথকে অনেকটা এদেশিয় নির্মাণ দিয়েছেন। এটা করতে গিয়ে তিনি আখ্যানের ভেতরে ‘পোস্ট মাস্টার’ গল্পের রতন, ‘শাস্তি’র চন্দনা, ‘ছুটি’ গল্পের ফটিককে পুনর্নির্মাণ করেছেন।[৬] লেখিকার ভাষায়,‘আমার সব সময়ই মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ এ ভূখণ্ডে না এলে, যাদের আমরা সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ বলি—কবির অদেখায় থেকে যেত এই জনগোষ্ঠী। তাতে হয়তো তাঁর জীবনদর্শনও অপূর্ণ থাকত খানিকটা। আমার পূর্ণ বিশ্বাস, আমাদের এই বাংলাই ভিন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে রবিঠাকুরকে।’
গল্পের ক্ষেত্রেও তিনি সাফল্য ও প্রাচুর্য় দেখিয়েছেন সমান ভাবে। ১৯৭৫ সালে প্রকাশ হয় তার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘জলবতী মেঘের বাতাস’। নানা কারণেই এটি বাংলা সাহিত্যে উল্লেখ যোগ্য সংযোজন। সবগুলোই পত্রগল্প। এতে তিনি সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, হাসান আজিজুল হক, বদরুদ্দীন উমর আবদুল গাফফার চৌধুরী, কবীর চৌধুরী সহ দশজনকে সম্বোধন করে পত্র ভাষায় গল্প লিখেন।[৭]
সাহিত্যে সমাজ নিষ্ঠতা থেকেই সেলিনা হোসেন নারীর ক্ষমতায়নে সচেষ্ট। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে তিনি নারীর ক্ষমতায়নের প্রাথমিক ধাপ বলে মনে করেন। এজন্য ‘লারা ফাউন্ডেশন’ নামক একটি সামাজিক উন্নয়ন সংগঠনও গড়ে তুলোছেন তিনি। ২০১৪ সালে দুই বছরের জন্য তিনি বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।
সাহিত্যের পরিচিতি অনেক আগেই দেশের গণ্ডি ছাড়িয়েছে। সেলিনা হোসেনের গল্প-উপন্যাস ইংরেজি, হিন্দি, মারাঠি, কানাড়ি, রুশ, মালে, মালয়ালাম, ফরসি, জাপানি, কোরিয়ান, উর্দু, ফিনিস(ফিনল্যান্ড), আরবিসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েটি ভাষায় অনুদিত হয়।
ঔপন্যাসিক হিসেবে সেলিনা হোসেন বহুবিধ দ্বন্দ্বকে নানা ভাবে অনুসন্ধান চালান। দ্বন্দ্বের পূর্ণ চরিত্রটিকে উপস্থাপন করেন আমাদের সামনে। এই অনুপুঙ্খতার কারণে ঘটনার সঙ্গে লেখিকার দূরত্ব ঘুঁচে একাকার হয়ে যায়। যা তার কাহিনীকে হৃদঙ্গম করার জন্য পাঠকে অনুপ্রাণিত করে। কাহিনী মগ্নতার ভেতরে ডুবে থাকা পাঠক অজ্ঞতাবসরে বুঝতেও পারেন না। তার অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে—মগ্ন চৈতন্যে শিস(১৯৭৯, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার ১৯৮১ লাভ), পোকা মাকড়ের ঘরবসতি(১৯৮৬, কমর মুশতারী পুরস্কার ১৯৮৭ লাভ), কাঁটাতারে প্রজাপতি(১৯৮৯), যুদ্ধ(১৯৯৮), কাঠ কয়লার ছবি(২০০১), মোহিনীর বিয়ে(২০০২), আণবিক আঁধার(২০০৩), ঘুমকাতুরে ঈশ্বর(২০০৪), মর্গের নীল পাখি(২০০৫), গেরিলা ও বীরাঙ্গনা(২০১৪), দিনকালের কাঠখড়(২০১৫)। তার একটি কবিতার বইও রয়েছে, নাম ‘বর্ণমালার গল্প’। [৯]
আশির দশকের প্রথম থেকেই সেলিনা হোসেন বহির্বিশ্বে আমাদের সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে অংশগ্রহণ করছেন। এছাড়া অনেক সাহিত্য-সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ও উদ্বোধকের আসনও অলংকৃত করেছেন। সাহিত্যে তার অন্যন্য কৃর্তির জন্য দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে আছে—বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার(১৯৮০), ফিলিপস্ সাহিত্য পুরস্কার(১৯৯৪), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার(১৯৯৪), একুশে পদক(২০০৯)। ভারত থেকেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছেন। এ গুলোর মধ্যে রয়েছে—রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা থেকে ডিলিট উপাধি(১৯১০), রামকৃষ্ণ জয়দয়াল এওয়ার্ড, দিল্লি(২০০৮), রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার, কলকাতা(২০১৩), আইআইপিএম (IIPM) কর্তৃক আন্তর্জাতিক সুরমা চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার, দিল্লি (২০১২)। দক্ষিণ এশিয়ার লেখকদের জন্য প্রবর্তিত সাহিত্য আকাদেমি, দিল্লি থেকে ২০১১ সালে তিনি প্রেমচাঁদ ফেলোশিপ লাভ করেন।
কাহিনীর অভিনবত্ব, জীবন নিষ্ঠা, দৃশ্যকল্প, বিস্তৃত বয়ান সেলিনা হোসেনের গল্প-উপন্যাসের সার্থক চলচ্চিত্র রূপায়নে বাধিত করেছে। তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস-গল্প পরবর্তীতে চলচ্চিত্র ও নাটকে রূপান্তরিত হয়েছে। এর স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কা লাভ করেন।[৮]
অনেক ক্ষেত্রে বাংলাসাহিত্যের অভিভাবকের দায়িত্বও পালন করছেন তিনি। নবীন সাহিত্যিকদের সাহিত্যের সঙ্গে এখানো তার স্বতোষ্ফূর্ত অংশ গ্রহণ। এতসব সাহিত্য সৃষ্টি ও স্বীকৃতির ব্যাপারে নিজেকে রাখেন নৈব্যার্তিকের ভূমিকায়। নতুনদের সাহিত্য পাঠ ও স্বীকৃতি দানেও তিনি অকুণ্ঠ। যেমন প্রায় বিশ বছর আগে শহীদুল জহিরের ‘রাজনৈতিক জীবন ও বাস্তবতা’ উপন্যাসটি প্রথম পড়ার এর ওপর একটা বিশাল রিভিউও লিখেছিলেন। অথচ তখন অবধি শহীদুল জহিরকে চোখেও দেখেননি। তার অপরাপর কাজ সম্পর্কেও জানতেন না।
প্রতিনিয়ত সাহিত্যর ক্রম উন্নতিকেই তিনি স্বাগত জানান উদার্ত ভাবে। তার ভাষায়,‘পঞ্চাশের দশকে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ যা লিখেছেন, একবিংশ শতাব্দীতে এসে একজন নবীন লেখক তা লিখবেন আবার সেটা প্রত্যাশা করব না। তিনি হয়তো এই সময়কে ধরবেন, এই সময়ে গল্প নাও থাকতে পারে। কিন্তু এমন কিছু অত্যাশ্চর্য জিনিস থাকবে যা সময়কে বিম্বিত করে, মানুষের জীবনকে নতুনভাবে বিম্বিত করে, আধুনিক বিশ্বকে বিম্বিত করে।’ প্রসঙ্গত একথা বলা যায়, এক সময় পর্যন্ত তিনি সাহিত্যের অনেক পরিক্ষা-নিরিক্ষা করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে প্রতিনিয়ত লেখনির মাধ্যমে তিনি সাহিত্য সম্ভার সমৃদ্ধ করে গিয়ে তিনি সাহিত্যের যথাযথ যত্ন নিতে পারেন নি। অর্থাৎ একটি পোষমানা ভাষা ও ধারা সাহিত্যই তিনি সাহিত্য রচনা করে গেছেন। তবে তার সাহিত্য কখনোই ‘জনপ্রিয় ধারা’র মতো সংকীর্ণতায় আকীর্ণ হয়েছে বলে মনে হয় না।
সাহিত্যের স্বীকৃতি হিসেবে এতসব অর্জনের পরও সময়কেই তিনি সাহিত্যের বড় সমালোচক মনে করেন। তার ভাষায়,‘মানসম্মত রচনার মূল্যায়ন করবেন সমালোচক। সবার উপরে বড় সমালোচক সময়। কালের বিচার বড় নির্মম। কাউকে ক্ষমা করে না। যা বাতিল হওয়ার যোগ্য তা স্বাভাবিক নিয়মে বাতিল হবে। বাংলাদেশের সাহিত্য মানের দিক থেকে বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে তুলনীয়।’
সেলিনা হোসেনের সাহিত্যে অনন্য দিক হলো ইতিহাসে মানুষের প্রভাব ও অংশগ্রহণ। যে কারণে তার সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষেপটে রচিত সাহিত্যের পরিমাণ অনেক। তাছাড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নানা ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। অর্থাৎ তার সাহিত্যের চরিত্ররা নানা ভাবে পীড়িত হলেও উন্মুল হয় না। তাদের জীবনে ইতিহাস, সমাজ, সময়, সংগ্রাম সমান ভাবে স্বক্রীয় থাকে। তাদের সংগ্রামের উৎস খুঁজে পাওয়া দেশের সংগ্রামের ইতিহাসে সঙ্গে। উৎস থেকে উৎসারিত, সতত বহমান এই সব জীবন যেন নিরন্তর ঘন্টা ধ্বনির মতোই তাদের সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করে যাচ্ছেন। একই ভাবে উৎস থেকে উৎসারিত নিরন্তর ঘণ্টা ধ্বনির মতো লেখিকা এখানো এক-একটি সাহিত্য দিয়ে যাচ্ছেন। আশা করা যায় এই ধ্বনি আরো অনেক দিন, বিচিত্র দ্যোতনায় অনুরণিত হবে।
তথ্যসূত্র :
১. সাহিত্য সাময়িকী, দৈনিক প্রথম আলো, ১২ জুন ২০১৫
২. সাক্ষাৎকার, বাংলামেইল২৪.কম, ২৯ জুন ২০১৪
৩. সাক্ষাৎকার, কালের খেয়া, ১২ জুন ২০১৫
৪. বাংলা কথাসাহিত্যে যাদুবাস্তবতা এবং অন্যান্য, সুব্রত কুমার দাস, ঐতিহ্য, ২০০২
৫. শুক্রবার, আলোকিত বাংলাদেশ, ৩০ মে ২০১৪
৬. পূর্ণছবির মগ্নতা, অন্য প্রকাশ, ঢাকা
৭. গল্পসমগ্র, সেলিনা হোসেন, সময় প্রকাশন, ঢাকা, ২০০২
৮. বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আর্থসামাজিক পটভূমি(১৯৭০-১৯৮০ দশক), আহমেদ আমিনুল ইসলাম, বাংলা একাডেমী, ২০০৮
৯. ইউকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ
লেখক পরিচিত:
অলাত এহ্সান
মূলত গল্পকার। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্যচর্চা শুরু ও অব্যহত। নিয়মিত প্রবন্ধ ও ফিচার লিখছেন। অনুবাদেও হাত আছে। সাংবাদিকতায় যুক্ত। ভ্রমন ও পাঠে অভ্যস্ত। পড়াশুনা ঢাকা কলেজে। ব্যবস্থাপনা বিভাগে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার বারুয়াখালী গ্রামে। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ব ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে।
+৮৮ ০১৭১৪ ৭৮৪ ৩৮৫; alatehasan@yahoo.com
0 মন্তব্যসমূহ