ভাষান্তর : দীপেন ভট্টাচার্য
অনুবন্ধ: উরসুলা লে গিন ১৯২৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। খুব অল্প বয়স (এগারো বছর) থেকে লেখা শুরু করলেও ছাপার অক্ষরে নিজের কাজ দেখতে তাঁকে খুব বেগ পেতে হয়েছে। ১৯৬১ সালে তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশ পায় এবং এরপরে এমন কোনো কল্পকাহিনীর পুরস্কার নেই যা তিনি পান নি - হুগো পুরস্কার, নেবুলা পুরস্কার, ওয়ার্ল্ড ফ্যানটাসি এওয়ার্ড, ইত্যাদি।
লে গিন তাঁর ফ্যান্টাসি লেখায় সামাজিক ও জেন্ডার সঙ্কট, মনস্তত্ব, রাজনীতি, পরিবেশ বিপর্যয়, ভিন্ন সাংস্কৃতিক ধারণার সঙ্গে সংঘাত ইত্যাদি ধারণার প্রবর্তন করে মার্কিন বিজ্ঞান কল্পকাহিনীতে এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করেন। তাঁর The Left Hand of Darkness ও The Dispossesed উপন্যাসদুটি গ্রহান্তরের ভিন্ন সমাজে বিপরীত চিন্তাভাবনা প্রয়োগের এক্সপেরিমেন্ট বলা যেতে পারে। লে গিন এর পাশাপাশি কবিতাও লিখেছেন। আর তাঁর ছোট গল্পগুলি (যেমন Orsinian Tales), যেগুলো বিজ্ঞান কল্পকাহিনী নয় কিন্তু খুব সহজেই পাঠককে এক রহস্যময় জগতে নিয়ে যায়, সেগুলো আমাকে খুব প্রভাবিত করেছে। মানুষের জীবনের নানাবিধ paradox (হ্বেতাভাষ) সবসময়ই তার লেখায় বর্তমান। ২০১৪ সনে National Book Foundation মার্কিন সাহিত্যে বিশেষ প্রভাব রাখার জন্য তাঁকে সম্মান জানায়। কানাডার মার্গারেট অ্যাটউড, হ্যারি পটার-খ্যাত জে.কে. রওলিং, সালমান রুশদী এরকম অনেক লেখকই উরসুলা লে গিনের লেখা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
যারা ওমেলাস ছেড়ে চলে যায় (The Ones Who Walk Away from Omelas) গল্পটি morality ও ethics (নীতি ও নৈতিকতা) নিয়ে এক রূপকথা। আমি এখানে লে গিনের গল্পটির আক্ষরিক অনুবাদ করার চেষ্টা করি নি, মাঝে মধ্যে দু-একটি লাইন সংযোজন করেছি বা বাদ দিয়েছি, শুরুতে কয়েকটি প্যারা যোগ করেছি। তবে মূল গল্পের কাহিনী, কাঠামো, উপলক্ষ ও ভাষা প্রায় এক রাখার চেষ্টা করেছি।--দীপেন ভট্টাচার্য
লে গিন তাঁর ফ্যান্টাসি লেখায় সামাজিক ও জেন্ডার সঙ্কট, মনস্তত্ব, রাজনীতি, পরিবেশ বিপর্যয়, ভিন্ন সাংস্কৃতিক ধারণার সঙ্গে সংঘাত ইত্যাদি ধারণার প্রবর্তন করে মার্কিন বিজ্ঞান কল্পকাহিনীতে এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করেন। তাঁর The Left Hand of Darkness ও The Dispossesed উপন্যাসদুটি গ্রহান্তরের ভিন্ন সমাজে বিপরীত চিন্তাভাবনা প্রয়োগের এক্সপেরিমেন্ট বলা যেতে পারে। লে গিন এর পাশাপাশি কবিতাও লিখেছেন। আর তাঁর ছোট গল্পগুলি (যেমন Orsinian Tales), যেগুলো বিজ্ঞান কল্পকাহিনী নয় কিন্তু খুব সহজেই পাঠককে এক রহস্যময় জগতে নিয়ে যায়, সেগুলো আমাকে খুব প্রভাবিত করেছে। মানুষের জীবনের নানাবিধ paradox (হ্বেতাভাষ) সবসময়ই তার লেখায় বর্তমান। ২০১৪ সনে National Book Foundation মার্কিন সাহিত্যে বিশেষ প্রভাব রাখার জন্য তাঁকে সম্মান জানায়। কানাডার মার্গারেট অ্যাটউড, হ্যারি পটার-খ্যাত জে.কে. রওলিং, সালমান রুশদী এরকম অনেক লেখকই উরসুলা লে গিনের লেখা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
যারা ওমেলাস ছেড়ে চলে যায় (The Ones Who Walk Away from Omelas) গল্পটি morality ও ethics (নীতি ও নৈতিকতা) নিয়ে এক রূপকথা। আমি এখানে লে গিনের গল্পটির আক্ষরিক অনুবাদ করার চেষ্টা করি নি, মাঝে মধ্যে দু-একটি লাইন সংযোজন করেছি বা বাদ দিয়েছি, শুরুতে কয়েকটি প্যারা যোগ করেছি। তবে মূল গল্পের কাহিনী, কাঠামো, উপলক্ষ ও ভাষা প্রায় এক রাখার চেষ্টা করেছি।--দীপেন ভট্টাচার্য

উত্তর থেকে পাহাড়ি পথ ধরে আসতে আসতে এক্দম উঁচু জায়গাটাতে হঠাৎ করেই চোখের সামনে ভেসে উঠত মায়াবী এক শহর যার নাম ছিল ওমেলাস। পাহাড়ি অনেক্গুলো স্বচ্ছ ঝরনার জল একসাথে মিশে সমতলে নানান রঙের জংলি ফুলের পাশ দিয়ে সৃষ্টি করেছিল স্বচ্ছ এক নদী, এঁকেবেঁকে সেই স্রোতস্বিনী চলে গিয়েছিল শহরের মধ্যে দিয়ে। ঝক্ঝকে পরিষ্কার বাঁধানো রাস্তা আর ঘন সবুজ ঘাসের জমি দিয়ে ঘেরা ছিল নদীর পাড় দুটি। নদী পারাপার করার জন্য ছিল বেশ কয়েকটি সুন্দর কারুকাজ করা সেতু।
নদী যেখানে সমুদ্রে যেয়ে মিশত সেই মোহনায় ছিল ওমেলাসের বন্দর। সমুদ্র পার হয়ে বহুদূরের দেশ থেকে সেই বন্দরে ভিড়ত জাহাজ- যাত্রী নিয়ে, পণ্য নিয়ে। তাদের মাস্তুলে উড়ত দেশ-বিদেশের রঙিন পতাকা।
ওমেলাসের উত্তরের উঁচু পাহাড়গুলোর কথা আগেই বলেছি। শীতের সময় তাদের তুষারাবৃত সাদা চূড়াগুলো ভোরের সূর্যের সোনালি আলোয় চমকে উঠত, আর গোধূলী বেলায় তাদের ত্রি-মাত্রিকতা মূর্ত হয়ে উঠত লাল-কমলা রঙের এক বিধুর বিষণ্ণতায়।
মাঝে মধ্যে নদী থেকে খাল বেরিয়ে গিয়েছিল দু'দিকে। খালের স্বচ্ছ বহমান জলের উপর দিয়ে ছিল ওক-কাঠের ছিমছাম সাঁকো, রাতে তাদের কাঠামোতে ঝোলানো থাকত কাগজের জাপানি লন্ঠন, সবুজ লাল রঙে উজ্জ্বল হয়ে। সেই খালগুলির ধার দিয়ে ছিল বাগান দিয়ে ঘেরা ছোট ছোট বাড়ি। সেই মানানসই ছোট ছোট বাড়িতে থাকত ওমেলাসের সব ধরণের নাগরিকেরা, জাহাজের কারিগর, সুরম্য অট্টালিকার স্থপতি, চিকিৎসক, নগর-উদ্যানের মালী। সাধারণতঃ বাসিন্দারা থাকত দোতলায়, তাদের জানালার সামনে বড় আয়তাকার পাত্রে ছিল যত্ন করে ফোটানো হলুদ ও বেগুনি রঙের ফুল। আর বাড়ির নিচতলায় ছিল হরেক রকমের বিপণি, খাবারের দোকান, ঘর সাজাবার রকমারি পশরা, বইয়ের দোকান, বাগান করার যাবতীয় জিনিসের মেলা।
ওমেলাসবাসীরা ভালবাসত ফুল, ভালবাসত রঙ, ভালবাসত তাদের বাগান, তাদের চাহিদা ছিল অল্প। তারা থাকত কাজের জায়গার কাছাকাছি, হেঁটে যেত কাজে, আর ছুটির দিনে তাদের অনেকেই পাহাড়ে যেত তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিবাস করতে, চড়াই-উৎরাইয়ে পরিশ্রম করে হাঁটতে, ঝর্ণার জলে স্নান করতে। অথবা অলস দুপুরে নদীতে ভাসাত নৌকা, দাঁড় বেয়ে নদীর মধ্যে ছোট ছোট দ্বীপগুলির সবুজ বড় পাতার গাছের নিচে বসে বনভোজন করত। আর তাদের মধ্যে সাহসী কেউ কেউ সমুদ্রের ঊর্মিতে ডিঙা নামাত সাদা পাল উঠিয়ে।
ওমেলাসের নাগরিকেদের মত অমায়িক মানুষ আমি আর দেখিনি। সকালে উঠে তারা প্রতিবেশীকে বলত- সুপ্রভাত, পথে অচেনা পথিককে বলত- শুভেচ্ছা। তাদের প্রচণ্ড আত্মসম্মান বোধ ছিল, নিজেদের কাজ ও পেশা নিয়ে তারা গর্ববোধ করত। সেই গর্বের সাথে সাথে তারা জীবনকে উপভোগ করতে জানত, কিন্তু সেই উপভোগ ছিল এমনই যা কিনা কখনই মাত্রা ছাড়িয়ে যেত না, সেই উপভোগ প্রতিবেশীর বা পরিবেশের কোনও ক্ষতি করত না।
ওমেলাস নিয়ে এমন সব ভাল ভাল কথা বলছি, পাঠক বোধহয় সেইসব কথা বিশ্বাস করছেন না। পাঠক বলছেন এতো নিতান্তই ইউটোপিয়া, রূপকথা। যদি আমার কথা বিশ্বাস না করতে পারেন তবে তাঁকে বলব এখানেই ক্ষান্ত দিন, এই গল্প আর পড়ার দরকার নেই। আর যদি বিশ্বাস করে থাকেন তবে বলব আর একটু ধৈর্য ধরুন।
শীত শেষ হলে ওমেলাস শহরে আসে বসন্ত উৎসব। শহরের নানান উদ্যানে, নানান চত্বরে বাজে উৎসবের ঘণ্টা। সুদূর উত্তর থেকে আসা অতিথি পাখিরা যেন সেই ঘণ্টাধ্বনিরই অপেক্ষায় ছিল। শীত শেষ হয়েছে, বিশাল পাখা মেলে তারা উড়ে গেল পাহাড় পেরিয়ে উত্তরে তাদের স্থায়ী বাসভূমিতে।
উৎসবের সকালে রঙ-বেরঙের চিত্র-বিচিত্র পোষাকে নারী-পুরুষ বৃদ্ধ-প্রৌঢ়-যুবক-যুবতীর খুশির মিছিল নামল রাস্তায়। তারা গাইল গান, কেউ সুরে, কেউ বা বেসুরে। তালে বা বেতালে বাজাল বাজনা, নাচল আপন আনন্দে। এর মধ্যে আবার তাদের বাচ্চারা মিছিলের মধ্যে লুকোচুরি খেলল, খলখল করে হাসল। তাদের আনন্দের হাসি ভেসে গেল গান-বাজনার উপর দিয়ে শীতের পাখিদের সাথে সাথে উত্তরের পাহাড়ে। মিছিল শেষ হল নদী পেরিয়ে শহরের উত্তরে ঢেউ-খেলানো এক সবুজ নরম ঘাসের বিশাল পার্কে। পার্কের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ছোট ছোট জলাশয়। জলাশয়ের মধ্যে জেগে থাকে ছোট দ্বীপ, তাতে ছোট বনস্পতি।
পার্কের মধ্যে বড় তৃণভূমি, তাতে হবে ঘোড়দৌড়, ওমেলাসের যুবতী যুবকেরা তাদের ঘোড়াদের সেই প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত করছিল। ওমেলাসবাসীরা তাদের ঘোড়াদের খুব ভালবাসত। এই উৎসবের ঘোড়াদের কেশরে জড়ানো ছিল সোনালি, রূপালি ও সবুজ ফিতা। বসন্ত উৎসবের উদ্দীপনার ছোঁয়াচ ঘোড়াদের মনেও যেন লাগছিল, তারা হ্রেষাধ্বনি করে পা ছুঁড়ছিল, তাদের আনন্দ অনুনাদিত হচ্ছিল সম্মিলিত সবার মধ্যে।
আনন্দ? আমার পক্ষে কি পাঠকের কাছে ওমেলাসের আনন্দকে পুরোপুরি তুলে ধরা সম্ভব?
ওমেলাসবাসীরা সুখি ছিল। কিন্তু সুখের সংজ্ঞা কী? আমরা অনেক সময় সুখি মানুষদের ভাবি অগভীর, তারা বেশি চিন্তা-ভাবনা করে না, তাদের জীবনযাত্রা নিতান্তই সরল। বেশিরভাগ সাহিত্যিক আবার এরকম অগভীরতা পছন্দ করেন না, তাঁরা তাদের গভীরতার পরিচয় দিতে গিয়ে তাদের কাহিনীতে খুব কষ্টকর জীবন সংগ্রাম ও দুঃখের বর্ণনা দেন। সেইসব গভীর লেখকদের কাছে ওমেলাসের বসন্ত উৎসব হবে নিতান্তই সাদামাটা, এমন একটা জিনিস যেটা নিয়ে ভেবে তাঁরা বেশি কালক্ষেপ করবেন না।
সেইসব লেখকদের মতামতকে আমি সমালোচনা করতে চাই না, আমার মনে হয় মানুষের অন্তরাত্মার সারাল্যকে চিনতে তাঁরা ভুল করেন। তবুও কিছু পাঠক তাঁদের গভীরতার আদর্শকে হয়তো অনুসরণ করেন, তাঁদেরকে আমি বলব কষ্ট করে এই কাহিনী পড়ার দরকার নেই।
আমি যদি লিখতাম- ওমেলাস শহর শাসন করে এক সর্বশক্তিমান নরপতি, তাহলে এই লেখকেরা বোধহয় খুব খুশি হতেন। যদি বলতাম, বসন্ত উৎসবের সময় সেই নরপতিকে তৃণভূমিতে এক সৌখীন সিংহাসনে বহন করে নিয়ে আসে তার বলশালী দাসেরা, তাহলে আমাদের গুরুগম্ভীর সাহিত্যিকেরা আমাকে বাহবা দিতেন, আর যদি লিখতাম, ওমেলাসের নাগরিকেরা আ-ভূমি নত হয়ে সেই নরপতিকে প্রণতি জানায়, তাহলে আমাদের সাহিত্যিকেরা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়তেন।
কিন্তু তাদেরকে হতাশ করেই আমাকে লিখতে হচ্ছে- ওমেলাসে কোনও নরপতি ছিল না। ওমেলাসবাসীরা তরবারি ব্যবহার করত না, তাদের কোনও দাস ছিল না। তাদের সমাজ চলত মাত্র গুটিকয়েক নীতি ও আইন দিয়ে। তাদের স্বাভাবিক ও সমাজগত বোধ এমনই ছিল যে নিজেদের শাসন করতে তাদের ভুরি ভুরি আইন প্রণয়ন করতে হয় নি। তাদের ইতিহাসে রাজতন্ত্র ও দাসপ্রথা ছিল না, তারা এড়াতে পেরেছিল গোপন পুলিশ বাহিনী ও বোধহীন সন্ত্রাস, সমাজের সর্বস্তরে বিজ্ঞাপনের অবাধ ব্যবহার।
কিন্তু এগুলো এড়াতে পেরেও তাদের জীবন হাল্কা হয়ে যায়নি বরং আমি বলব তাদের মতন সংবেদী, আবেগী লোকজনের দেখা আপনার মিলবে না।
এখন পর্যন্ত ওমেলাসকে মনে হচ্ছে এক রূপকথার নগর, কিংবদন্তী, অনেক দূরের, অন্য এক সময়ের। তাতে কোনও অসুবিধা নেই, ধরে নিন ওমেলাস যেন আপনার মনের এক বাসনার ফল, কোনও এক কল্পনার অংশ। আপনার যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে ওমেলাসকে নিজের মনে গড়ে তুলুন। নিজের মনে ভাবুন তাদের পরিচ্ছদ কী হতে পারে, তারা কী ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে কথা, তারা কী ধরণের বিচারপদ্ধতির আশ্রয় নিতে পারে।
আমার কল্পনায় ওমেলাসের রাস্তায় নেই গাড়ির জট, আকাশে নেই হেলিকপ্টারের ঘটঘট শব্দ। তবে সবকিছু যে একেবারে নিরামিষ তা বলব না। কিছু আরামের বা বিলাসের ব্যবস্থা তো থাকতেই পারে সেই শহরে। তবে সেগুলো পরিবেশ বা মনোজগতের জন্য ধ্বংসাত্মক নয়। মাটির তলায় রেলগাড়ি, কাপড় ধোবার যন্ত্র, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বসবাস। অথবা সেখানে থাকতে পারে বিস্ময়য়কর নতুন সব উদ্ভাবন যা কিনা এখনও আমাদের অপরিচিত- আকাশে ভাসমান বাতি, জ্বালানীবিহীন শক্তি, সাধারণ ঠাণ্ডাজ্বরের নিরাময়। অথবা তাদের এসব নাও থাকতে পারে, এতে আমাদের কাহিনীর কোনও পরিবর্তনই হবে না। আপনাদের যা ইচ্ছে ভেবে নিন। আমি শুধু বলব সুখের ভিত্তি হচ্ছে কোনটা প্রয়োজনীয় আর কোনটা অপ্রয়োজনীয় সেটার প্রভেদ করার বিচারবুদ্ধি, আর ওমেলাসবাসীর সেটা ছিল।
আবার ফিরে যাই সেই বসন্ত উৎসবে। আমার কল্পনা বলে গত কয়েকদিন ধরেই ওমেলাসের উত্তরে আর দক্ষিণের সমুদ্রতটের উপর ছড়ানো শহরতলী থেকে দ্রুতগামী ছোট ছোট ট্রেনে আর দোতলা ট্রামে করে লোকজন আসছিল উৎসবে যোগ দিতে। তাদের গন্তব্য ছিল ওমেলাসের কেন্দ্রীয় রেলস্টেশন যেটা আমার মতে ওমেলাসের সবচেয়ে সুন্দর দালান। আর একটি বাড়ি আমার খুব পছন্দ, সেটা হল কৃষিবাজারের সুরম্য অট্টালিকা।
এসব থাকা সত্ত্বেও ওমেলাসকে আপনাদের হয়ত মনে হচ্ছে খুব বেশি ভোলাভালা, একেবারেই নিরামিষ। হাসি, আনন্দ, ঘণ্টাধ্বনি, মিছিল, গানবাজনা, নাচ, ঘোড়দৌড়, একেবারেই স্বাদহীন ভালমানুষী! এ আর কত নেয়া যায়?
ঠিক আছে, এর সাথে যদি কিছুটা বেলেল্লাপনা যুক্ত করতে হয় তাই সই। তবে তার মানে এই না যে সেখানে ভাবোন্মত্ত অর্ধনগ্ন যাজক ও যাজিকারা থাকবে যাদের কাজই হচ্ছে উপাসনালয়ে যে-কোনও নারী, পুরুষ, বা প্রেমিক/প্রেমিকার সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া। আমি অবশ্য প্রথমে ভেবেছিলাম এটা হলে মন্দ হত না, ঐ সঙ্গম হবে ঈশ্বরের প্রতিভূর সাথে মিশে যেতে চাওয়ার বাসনা।
তার চেয়ে বরং বলি ওমেলাসে কোনও উপাসনালয়েরই থাকার দরকার নেই, অন্ততঃ মানুষ পরিচালিত উপাসনালয়। ধর্ম থাকবে, কিন্তু পুরোহিতদল থাকবে না। তবে সুন্দর মানুষদের নগ্ন হয়ে ঘুরে বেরানোর ব্যাপারে আমার আপত্তি নেই। আরা তারা যদি নিজেদের উৎসর্গ করতে চায় ক্ষুধার্ত ত্বকের তৃপ্তির জন্য, অমৃতের আকাঙ্ক্ষায়, তাতেও আমার অসুবিধা নেই। আমি বলি তারাও এই বসন্ত উৎসবের মিছিলে সামিল হোক। বাজুক খঞ্জনি সেই স্বর্গীয় সঙ্গমের উপর, কামবাসনার ঔজ্জ্বল্য ফুটে উঠুক কাঁসর ধ্বনিতে। সেই সুন্দর বাসনার সন্তানদের সবাই ভালবাসবে, সবাই দেখাশোনা করবে। আমাদের মত ঠুনকো পাপবোধে ওমেলাস আচ্ছন্ন থাকবে না।
আর কী থাকতে পারে সেখানে? আমি প্রথমে ভেবেছিলাম সেখানে কোনও মাদকদ্রব্য থাকবে না, কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম সেটা হবে এক ধরণের গোঁড়ামি। আমি এক ধরণের মাদকের কথা ভাবতে পারি যাকে আমি নাম দেব-- দ্রুজ। দ্রুজের প্রভাব কেমন আমাদের মনের আর শরীরের উপর? প্রথমে সেটা নিয়ে আসে একটা হাল্কা সতেজ ভাব, কয়েক ঘণ্টা কেটে গেলে আসে এক ধরণের স্বপ্নীল অবসন্ন আবেশ তাতে মনে হয় মহাবিশ্বের সমস্ত গোপন রহস্য উন্মোচিত হবে। ওঃ, আর একটা কথা বলা দরকার, সেই দ্রুজ সঙ্গমের আবেগকে অবিশ্বাস্যভাবে শতগুণ বৃদ্ধি করে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা দ্রুজে কেউ আসক্ত হয়ে পড়ে না। মাদকাসক্ত বলে ওমেলাসে কেউ থাকবে না।
তবে আপনি যদি পরিমিত স্বাদের অধিকারী হন তবে আমি বলব সেখানে বিয়ার থাকা উচিত। অথবা দ্রাক্ষাফলের রস- উজ্জ্বল ওয়াইন। সমুদ্রতীরে বারান্দায় বসে বালিতে উত্তাল ফেনিল ঢেউয়ের আঘাতকে উপভোগ করতে এই তরল সাহায্য করবে।
আর কী, আর কী থাকতে পারে সেই আনন্দের শহরে?
জয়ের আস্বাদ, সাহসের উৎসব? সেগুলো কি আমরা রাখব? আসুন, যেভাবে আমরা পুরোহিতদের বিদায় দিয়ে দিয়েছি সেভাবে আমরা সৈনিকদেরও বিদায় জানাই। হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে অর্জিত বিজয়ের আনন্দ আমরা চাই না, সেই আনন্দ হল এক ধরণের ভীতিকর আনন্দ, তাতে কোনও তৃপ্তি নেই। আমরা চাই এক অসীম ঔদার্যের বিজয়, যে উদার বিজয় কোনও বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে অর্জিত হয় নি, বরং শহরের সমস্ত মানুষের অন্তঃকরণের অমলিন ও খাঁটি অংশ নিয়ে তৈরি হয়েছে। আর আজ পার্থিব বসন্তের সমস্ত উজ্জ্বলতা নিয়ে ওমেলাসের নাগরিকদের হৃদয় উদ্বেলিত হচ্ছে, তারা জীবনের বিজয়কে বসন্ত উৎসবের মধ্যে দিয়ে উদযাপন করছে।
প্রায় সব মিছিলই এর মধ্যে পার্কে পৌঁছে গেছে। লাল নীল তাঁবুগুলো থেকে মনমাতান রান্নার গন্ধ ভেসে আসছে, বাচ্চাদের মুখে লেগে আছে মিষ্টির রস, এক সদাশয় বৃদ্ধ লোকের দাঁড়িতে ঝুলে আছে মিষ্টি প্যাস্ট্রির গুঁড়ো। ওদিকে যুবক যুবতীরা তাদের ঘোড়ায় চড়ে দৌড়ের জায়গায় ভিড় করছে। একটি ছোটখাট হাসিখুশি বৃদ্ধা ঝুড়ি থেকে ফুল বিতরণ করছে, হালকা লম্বা সব তরুণেরা সেই ফুল তাদের ঝকঝকে চুলে গুঁজছিল। ওদিকে একটা নয়-দশ বছরের ছেলে ভিড়ের এক কোণায় বসে বাজাচ্ছিল একটা বাঁশের বাঁশি। লোকেরা তার বাজনা শুনতে থামছিল, মৃদু হেসে উপভোগ করছিল তার বাজনা। ছেলেটি তাদের খেয়াল করছিল না, সে তার বাজনায় অভিভূত ছিল, তার কালো চোখ ধরে রেখেছিল একটা মিষ্টি সূক্ষ্ম যাদুর সুর। তার হাতের আঙুল যেন বনস্পতির শাখার মত প্রকৃতির সমস্ত রহস্যকে বাঁশির মধ্যে বন্দি করেছিল, সেই বন্দি উদাস-করা সুর টলটল করছিল তার কালো চোখে। সব কোলাহল ছাপিয়ে সেই বাঁশি শোনা যাচ্ছিল তৃণভূমির প্রতিটি প্রান্তে।
অবশেষে বাঁশুরিয়া তার বাজনা থামায়, বাঁশি ঠোঁট থেকে সরায়। নিস্তব্ধ হয়ে যায় তৃণভূমি, আর সেই নিস্তব্ধতা ছিল যেন এক সংকেত। ঘোড়দৌড়ের জায়গা থেকে ভেসে আসে ভেরীধ্বনি। রাজকীয় ভেরী, তীক্ষ্ম বিষাদের ধ্বনি। ঘোড়ারা হ্রেষাধ্বনি করে পেছনের পায়ে ভর করে ওপরে ওঠায় তাদের দেহ, যেন অভিবাদন জানায় তারা সেই শব্দকে। তরুণ প্রতিযোগীরা ঘোড়াদের ঘাড়ে হাত বুলিয়ে তাদের আশ্বস্ত করে। তারা আদরের গলায় বলে, "সোনামাণিক আমার, শান্ত হও, শান্ত হও।" এই ঘোড়ারা তাদের বন্ধু। তারপর ঘোড়াদের লাগাম ধরে নিয়ে যায় তারা দৌড়ের জায়গায়। ঘাসফুলের মত চারদিকের মানুষ আন্দোলিত হয়, বসন্তের উৎসব শুরু হয় ওমেলাসে।
এই উৎসব, এই শহর, এত অনাবিল আনন্দ এই পৃথিবীতে কি সম্ভব? পাঠক কি এইসব বিশ্বাস করছেন? করেন নি? তাহলে এখন সময় হয়েছে তাঁকে আর একটা কথা বলার।
আগেই বলেছি ওমেলাসে অনেক সুন্দর বাড়ি ছিল। সুরম্য অট্টালিকা সেসব, অভিজাতদের বাড়ি, সাধারণ নাগরিকদের বাড়ি। এরকম একটা বাড়ির বেসমেন্টে একটা ঘর ছিল। সেই ঘরে ঢুকতে একটা মাত্র দরজা, সেটা তালাবদ্ধ থাকত। ঘরে কোনও জানালা ছিল না, যেটুকু আলো তাও ঢুকত দরজার নিচ দিয়ে নইলে কাঠের দেয়ালের পাটাতনের ফাঁক দিয়ে। তারপর রয়েছে মাকড়সার জাল, সেই জাল পেরিয়ে যেটুকু আলো আসত তা খুবই অপ্রতুল।
মেঝেটা বাঁধানো নয়, স্যাঁতসেঁতে, বেসমেন্টের ঘরে যেমন হয়। ঘরটি বড় জোর দৈর্ঘ্যে তিন পা, প্রস্থে দুই পা। ঘরের এক কোণায় মরচে-ধরা পুরোনো বালতি, ন্যাতার ঝাড়ু। ঘরটা হয়ত ভাঁড়ার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত। কিন্তু ঘরটা মানুষশূন্য ছিল না, সেই ঘরে একটি শিশু থাকত।
ঐ ন্যাতার ঝাড়ুগুলোকে সে ভীষণ ভয় করে, সেগুলো থেকে যত দূরে থাকা যায় তত দূরে সে উবু হয়ে বসে থাকে। চোখ বন্ধ করে থাকে, কিন্তু তাতে কি? ঝাড়ুগুলো অদৃশ্য হয়ে যায় না, সে জানে ঝাড়ুগুলি ঠিকই তাদের জায়গায় আছে। দরজাটা প্রায় সব্সময়ই তালাবদ্ধ, কেউ তাকে উদ্ধার করতে আসবে না। তাকে আমি শিশু বলব না, বালক/বালিকা বলব তা বুঝে উঠতে পারছি না। শিশুটি হতে পারে ছেলে, হতে পারে মেয়ে। দেখলে মনে হয় তার ছয় বছর বয়স, আসলে তার বয়স হল দশ। হতে পারে তার মাথা ঠিক মত গড়ে ওঠে নি, হয়তো সেটা জন্মগত, অথবা অবহেলা, অপুষ্টি ও ভয়ে ধীরে ধীরে সে নির্বোধ হয়ে গেছে। সে তার নাক খোঁটায়, অথবা তার শিশ্ন কি যোনী কিংবা পায়ের নোখকে অসহায়ভাবে হাতড়ায়।
বছরের পর বছর বদ্ধ ঘরে থেকে শিশু বা বালিকা বা বালক সময় সম্বন্ধে সব ধারণা হারিয়ে ফেলেছিল। কোনও কোনও সময় দরজাটা কাঁপতে কাঁপতে খুলে যায়, একটা লোক ঘরে ঢুকে তাকে লাথি মেরে উঠিয়ে দেয়। খাবার আর কিছু জল দিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় সেই লোক চলে যায়, দরজার বাইরে আরও কয়েকটি লোক এই কর্মকাণ্ডের নির্বাক সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, ভয়ার্ত আর বিতৃষ্ণ থাকে তাদের চোখ। তারা দেখে শিশুটির গায়ে মাংস বলতে কিছু নেই, পায়ের পেশি চলে গেছে, পেট বেরিয়ে গেছে, পুরোপুরি উদাম দেহ ঘা'য় পরিপূর্ণ, সে তার নিজের মলমূত্রের ওপর বসে আছে। কিন্তু এসব দেখেও সেই দর্শকেরা কিছু বলে না, একটি কথাও উচ্চারণ না করে তারা চলে যায়।
কিন্তু সে সব সময় এই অন্ধকার ঘরে ছিল না, কিছুদিন আগেও সে মনে করতে পারে তার মা'র কন্ঠ্স্বর, মনে করতে পারত সূর্যের আলো। ফিসফিস করে বলত, আমি ভাল হয়ে থাকব, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি দুষ্টুমি করব না। সে এর কোনও উত্তর পায় নি, তার সঙ্গে কেউ কথা বলে না। শিশুটি বহু আগে সাহায্যের জন্য চিৎকার করত, রাতভর কাঁদত, কিন্তু ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে সে তার ভাষা ভুলে যাচ্ছে। এখন তার সমস্ত ইচ্ছা, উদ্বেগ এক ধরণের কুকুরের কুঁইকুঁই শব্দে পরিণত হয়েছে।
আপনারা ভাবছেন কেউ শিশুটিকে লুকিয়ে রেখেছে, তার সঙ্গে অমানবিক আচরণ করছে হয়ত কোনও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে। না, তা নয়, একেবারেই নয়।
তারা সবাই জানত শিশুটি সেখানে আছে, প্রতিটি ওমেলাসবাসীই জানত। কেউ কেউ তাকে দেখতে আসত, কেউ কেউ শিশুটি সেখানে আছে এটা জেনেই সন্তুষ্ট থাকত। তারা সবাই জানত শিশুটিকে সেখানে থাকতে হবে। তাদের মধ্যে কিছু লোক বুঝতে পারত কেন, কিছু লোক বুঝতে পারত না, কিন্তু এই জিনিসটা তারা জানত যে তাদের সুখের জন্য, তাদের শহরের সৌন্দর্যের জন্য, তাদের বন্ধুত্বের কোমলতার জন্য, তাদের শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য, তাদের পণ্ডিতদের বুদ্ধিমত্তার জন্য, তাদের কর্মীদের দক্ষতার জন্য, এমনকি তাদের ফসলের প্রাচুর্য্য আর ওমেলাসের চমৎকার জলবায়ুর জন্য এই শিশুটিকে এরকম একটি অবর্ণনীয় দুর্দশায় থাকতে হবে।
ওমেলাসের শিশুরা যখন আট বছরে পা দিত, বা যখন পৃথিবী সম্পর্কে তাদের বোধোদয় হত তখন তাদের গুরুজনেরা এভাবেই জিনিসটা ব্যাখ্যা করতেন। বেশিরভাগ সময় তরুণরাই শিশুটিকে দেখতে আসত, মাঝেমধ্যে দু-একজন বয়স্ক লোকও আসত, অথবা বলা যায় ফিরে আসত আবার তাকে দেখতে। শিশুটি কেন সেখানে আছে সেটা তারা ভাল করে জানলেও তারা তাকে দেখে বিচলিত হত, অসুস্থ হয়ে পড়ত। আবার এক ধরণের বিতৃষ্ণাও জন্মাত। সমস্ত ব্যাখ্যা সত্ত্বেও, কেন শিশুটিকে সেখানে থাকতে হবে সেটা জেনেও তারা অনুভব করত তাদের অক্ষমতা। তারা শিশুটির জন্য কিছু করতে চাইত, কিন্তু কিছুই করার ছিল না।
শর্তটি ছিল অনমনীয়, নির্দয়। শিশুটিকে করুণা করে একটি দয়ার্দ্র শব্দও উচ্চারণ করা যাবে না।
যদি শিশুটিকে সূর্যালোকে নিয়ে আসা হত সেই কুষ্ঠালয় থেকে, যদি তাকে স্নান করান হত, খাইয়ে দাইয়ে আদর করা হত, সেটা নিশ্চয় একটা ভাল কাজ বলে গণ্য হত। কিন্তু সেটা করা হলে, ওমেলাসের সমস্ত সৌন্দর্য, আনন্দ, সম্পদ ধ্বংস হয়ে যেত। ঐ একটি শিশুর জীবনের বিনিময়ে ওমেলাসবাসীর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে। শিশুটিকে সুন্দর জীবন দিতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষের সুখ, সাচ্ছন্দ বিসর্জন দেওয়া নিশ্চয় আরও বড় দোষের কাজ হত।
সেই তরুণেরা, যারা শিশুটিকে দেখতে যেত, অনেক সময় বাড়ি ফিরত কাঁদতে কাঁদতে, অথবা শুষ্ক চোখে মনে একরাশ ক্রোধ নিয়ে। কিন্তু তারা জানত এই হ্বেতাভাষ থেকে মুক্তি নেই। এই নিয়ে তারা হয়ত ভাবত মাসের পর মাস, কিন্তু যত সময় যেত তত তারা বুঝতে পারত সেই শিশুটিকে রোদে নিয়ে এলেও, সে এই আলোর মূল্য বুঝতে পারবে না, হয়ত পুষ্টিকর সুস্বাদু খাবার আর উষ্ণতা তার কাছে কিছুটা ভাল লাগবে, এর বেশি কিছু নয়। সে এমন জড়বুদ্ধি ও নির্বোধ হয়ে গেছে যে সে আনন্দ কী জিনিস সেটা বুঝতে পারবে না। এতদিন ধরে ভয় পেতে পেতে সে কখনই আর নির্ভয় হতে পারবে না। তার অভ্যাস এমন বিশ্রী হয়েছে যে সেটা আর সারাবার উপায় নেই। সত্যি, এত বছর পরে সেই ঘরের বাইরে আনলে সে হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। ঘরের চার দেয়ালের মাঝে সে নিজেকে নিরাপদ মনে করে, অন্ধকার তার চোখকে আরাম দেয় আর নিজের মল-মূত্রের উপর বসলে সে স্বস্তি পায়। এক নির্মম অন্যায় দেখে তাদের চোখে যে জল এসেছিল সেই জল ধীরে শুকিয়ে যায় যখন তারা বুঝতে শুরু করে বাস্তবতার ভয়াবহ সুবিচার, তারা ধীরে ধীরে বাস্তবকে মেনে নেয়। এই ধরনের যুক্তি আর প্রবোধ সেই তরুণদের সান্ত্বনা দেয়।
তবুও আমি বলব তাদের চোখের জল আর মনের ক্রোধ, তাদের মানসিক দ্বন্দ্ব, তাদের অসহায়ত্বের স্বীকৃতি সবই তাদের জীবনের যে যা কিছু মহান, যা কিছু উজ্জ্বল সেগুলোর উৎস ছিল। তাদের আনন্দ নির্বিকার অস্পৃহ দায়িত্বহীন ছিল না। তারা জানত সেই শিশুটির মতই তারা মুক্ত নয়। তাদের দয়ামায়া ছিল। সেই শিশুটির অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের সচেতনতা তাদের স্থাপত্যকে করে তুলত মহান, তাদের সংগীতকে মর্মভেদী, তাদের বিজ্ঞানকে গভীর। সেই শিশুটির ভাগ্যকে দেখে তারা নিজেদের শিশুদের মূল্য বুঝত, তাদের আগলে রাখত। তারা জানত সেই হতভাগ্য শিশুটি অন্ধকারে না কাঁদলে বসন্তের প্রথম দিনে উজ্জ্বল সূর্যের নিচে আর একটি কিশোর আনন্দের বাঁশি বাজাবে না, ঘোড়সোয়াররা তাদের ঘোড়াকে আরম্ভরেখায় দাঁড় করাতে পারবে না।
এখন কি পাঠক আমার কাহিনীকে বিশ্বাস করছেন? এটা কি এখন আগের থেকে বেশি বিশ্বাসযোগ্য নয়?
শুধু একটা জিনিসই এখন বলার বাকি আছে, যা কিনা- আসলেই অবিশ্বাস্য। কখনও কখনও দু-একজন তরুণ তরুণী শিশুটিকে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে কাঁদত না, তারা আসলে বাড়িই ফিরত না। কখনও কখনও দু-একজন বয়স্ক নারী বা পুরুষ শিশুটিকে দেখে মৌন হয়ে যেত, তারপর একদিন তারা তাদের সুন্দর বাড়ি ছেড়ে চলে যেত। ওমেলাসের সুন্দর প্রবেশদ্বারের মধ্য দিয়ে শহরের বাইরে তারা হাঁটতে হাঁটতে বের হয়ে যেত। তাদের প্রত্যেকে একাই হাঁটত। তাদের কেউ কিশোর কেউ কিশোরী, কেউ তরুণ, কেউ তরুণী, কেউ বয়স্ক নারী, কেউ বয়স্ক পুরুষ। রাত হয়ে গেলেও সেই পথিকেরা দূরের গ্রামের বাড়িগুলির হলদে বাতির মধ্য দিয়ে হেঁটে যেত। সেই গ্রামে না থেমে তাঁরা হাঁটত গ্রাম ছাড়িয়ে অন্ধকার মাঠে। তারা যেত পশ্চিমে, তারা যেত উত্তরে। তারা ওমেলাস ছেড়ে চলে যেতে, তারা আর ফিরে আসত না। তারা যেখানে যেত সেই জায়গাটাকে কল্পনা করা আমার পক্ষে কঠিন, এমনকি সুখের শহর ওমেলাসকে কল্পনা করাও এত কঠিন নয়। আমি সেই জায়গাটাকে একেবারেই বর্ণনা করতে পারব না, হতে পারে সেই জায়গাটার কোনও অস্তিত্বই নেই। কিন্তু তারা- যারা ওমেলাস ছেড়ে চলে যায়- মনে হয় সেই জায়গাটা চিনত, আমার মনে হয়ে তারা জানে কোথায় তারা যাচ্ছে।
অনুবাদক পরিচিতি
দীপেন ভট্টাচার্য
দীপেন ভট্টাচার্য
জন্ম ১৯৫৯। আদি নিবাস এলেঙ্গা, টাঙ্গাইল।
বিজ্ঞানী। গল্পকার।
মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ হ্যাম্পশায়ার থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট ইন্সটিটিউটের গবেষক ছিলেন। পরে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড ক্যাম্পাসে (ইউসিয়ার) গামা রশ্মি জ্যোতির্বিদ হিসেবে যোগ দেন। এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। ১৯৭৫ সালে তিনি বন্ধুদের সহযোগিতায় 'অনুসন্ধিৎসু চক্র' নামে একটি বিজ্ঞান সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর প্রকাশিত বই : দিতার ঘড়ি, নিওলিথ স্বপ্ন, অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো।
0 মন্তব্যসমূহ