আলবেয়া ক্যাম্যু
অনুবাদ: রওশন জামিল
দেবতারা চরম দণ্ড দিয়েছিলেন সিসিফাসকে, একটি বিশাল প্রস্তরখণ্ড নিরন্তর ঠেলে তুলতে হবে পর্বতের মাথায়, যেখান থেকে আপন ভারেই পাথরটি গড়িয়ে পড়বে নিচে। খানিক চিন্তাভাবনা করেই তাঁদের মনে হয়েছিল নিষ্ফল ও সম্ভাবনারহিত শ্রমের চেয়ে ভয়ঙ্কর শাস্তি আর কিছুই হয় না।
হোমারকে বিশ্বাস করলে, মরণশীলদের মধ্যে সিসিফাস ছিলেন সবচেয়ে জ্ঞানী ও বিচক্ষণ। অবশ্য, এও বলা হয়ে থাকে, তাঁকে মর্ত্যলোকে পাঠানো হয়েছিল তস্করবৃত্তি অনুশীলনে। কোন বিরোধ দেখি না আমি এতে। কেন তিনি যমপুরীর তুচ্ছ শ্রমিকে পরিণত হয়েছিলেন তা নিয়ে মতভেদ আছে। তাঁর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ, দেবতাদের সাথে বেয়াড়া রসিকতা করেছিলেন। তাঁদের গূঢ় তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন তিনি। ইসোপাসের কন্যা, ইজিনাকে অপহরণ করেন জুপিটার। কন্যার অন্তর্ধানে মুষড়ে পড়েন পিতা, এবং সিসিফাসের কাছে অনুযোগ করেন। সিসিফাস, যিনি অপহরণের বিষয়টি জানতেন, এই শর্তে সত্যপ্রকাশে সম্মত হন যে ইসোপাস করিন্থের পুরদুর্গে জলের ব্যবস্থা করবেন। স্বর্গলোকের বজ্রনিনাদের পরিবর্তে জলের মঙ্গলধ্বনিই পরম মনে হয়েছিল তাঁর কাছে। যমপুরীতে এজন্য শাস্তি বরাদ্দ হয় তাঁর। হোমার থেকেই জানতে পারি, যমকে শেকলে বেঁধে ছিলেন সিসিফাস। নিজের বিরান, স্তব্ধ সাম্রাজ্যের চেহারা সইতে পারেননি প্লুটো। তাই, যুদ্ধের দেবতাকে পাঠিয়েছিলেন, যিনি যমকে মুক্ত করেন তাঁর বিজেতার কবল থেকে।
এমনও কথিত আছে যে, মরণ যখন শিয়রে এক অদ্ভুত খেয়াল চেপেছিল সিসিফাসের, স্ত্রীর ভালবাসা যাচাই করবেন। তাঁর নশ্বর দেহ সমাহিত করবার পরিবর্তে চৌরাস্তার মোড়ে ফেলে রাখতে তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। যমপুরীতে ঘুম ভাঙে সিসিফাসের; এবং সেখানে, মানবীয় ভালবাসার একেবারেই স্ববিরোধী এই আনুগত্যে বিরক্ত হয়ে, মর্ত্যলোকে ফিরে গিয়ে স্ত্রীকে ভর্ৎসনা করে আসার অনুমতি আদায় করে নেন প্লুটোর কাছ থেকে। কিন্তু এই পৃথিবীর মুখ যখন আবার দেখলেন তিনি, এর জল আর সূর্য, উষ্ণ নুড়ি আর সাগরকে উপভোগ করলেন, আর ফিরতে চাইলেন না সেই নারকীয় আঁধারে। প্রত্যাবর্তনের আদেশ, রক্তচক্ষু, সতর্কবার্তা, কোনকিছুতেই ফল হচ্ছিল না। উপসাগরের বাঁক, সফেন সমুদ্র আর বসুন্ধরার হাসি দেখে আরও অনেক বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। আবশ্যক হয়ে পড়েছিল দেবতাদের বিধান । বুধ এলেন, এবং দুর্বিনীত মানুষটিকে ঘাড়ে ধরে, তাঁর সকল আনদন্দযজ্ঞ থেকে একটানে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন যমপুরীতে, যেখানে পাথরটি অপেক্ষা করছিল তাঁর জন্য।
ইতিমধ্যে বুঝে গেছেন আপনি, সিসিফাস হচ্ছেন অ্যাবসার্ড নায়ক। তিনি আসলেই তা-ই, যতখানি তাঁর উদ্দীপনায়, ততখানিই তাঁর লাঞ্ছনাভোগে। দেবতাদের প্রতি তাঁর অবজ্ঞা, মৃত্যুর প্রতি তাঁর ঘৃণা, আর জীবনের প্রতি তাঁর অদম্য ভালবাসা তাঁর জন্য সেই অমোঘ শাস্তি-ই নির্দিষ্ট করেছিল যেখানে সমগ্র সত্তাটিই নিক্ষিপ্ত হয় এক নিষ্ফল অর্জনে। এই মাশুল, মর্ত্যরে প্রতি ভালবাসার অনিবার্য ক্ষতিপূরণ। যমপুরীর সিসিফাস সম্পর্কে আমাদের কিছুই বলা হয়নি। কল্পকথা তৈরি করা হয় কল্পনা দিয়ে তার মধ্যে প্রাণসঞ্চারের জন্য। এই কল্পকথাটির ক্ষেত্রে, একজন শুধু দেখতে পায় চড়াই ভেঙে একটি মানুষের বিশাল একটি প্রস্তরখণ্ড শত-সহস্রবার ঠেলে তুলবার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাটুক; দেখতে পায় কুঞ্চিত একটি মুখ, পাথরে সেঁটে-থাকা শক্ত চোয়াল, কাঁধে কর্দমাক্ত পিণ্ডের ভার, ঠেস-দেয়া পা, প্রসারিত দুবাহুর নতুন উদ্যম, কাদামাখা দুটি হাতের পূর্ণ মানবীয় সুরক্ষা। অবশেষে, নিঃসীম শূন্যতা আর অতলান্তিক সময়ের পরিমাপে নির্ণীত তাঁর দীর্ঘ প্রচেষ্টার অন্তিমক্ষণে, অর্জিত হয় উদ্দেশ্যটি। কিন্তু মুহূর্তমাঝে পাথরটিকে সিসিফাস ছিটকে পড়তে দেখেন পাতালপুরীতে, যেখান থেকে আবার তাঁকে সেটা ঠেলে তুলতে হবে চূড়ায়। তিনি ফিরে যান সমতলে।
ঠিক সেই প্রত্যাবর্তন-মুহূর্তের, সেই দ্বিধাচকিত বিরামের সিসিফাস আকৃষ্ট করেন আমাকে। একটি মুখ, প্রস্তর-ঘনিষ্ঠ পরিশ্রমে নিজেই পাথর হয়ে গেছে! আমি সেই মানুষটিকে শ্রান্ত অথচ সুমিত পদক্ষেপে ফিরে যেতে দেখি এক উৎপীড়নের কাছে যার অবসান তিনি কোনদিনই জানবেন না। মুহূর্ত অবসরের সেই ক্ষণ যা ফিরে ফিরে আসে তাঁর যন্ত্রণার মতই অবধারিতভাবে, তা-ই হচ্ছে চৈতন্যোদয়ের মুহূর্ত। ওই মুহূর্তগুলোর প্রতিটিতে, যখন তিনি শীর্ষদেশ ত্যাগ করে ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকেন দেবতাদের স্তরে, তিনি তাঁর নিয়তির চেয়ে গরীয়ান; তাঁর প্রস্তরের চেয়েও শক্তিমান।
এই কল্পকথাটি যদি ট্র্যাজিক হয়ে থাকে, তা এর নায়ক সচেতন বলে। বস্তুত, কোথায় থাকত তাঁর নিগ্রহ যদি সাফল্যের আশা প্রতি পদক্ষেপে উজ্জীবিত রাখত তাঁকে? আজকের শ্রমজীবী তার জীবনের প্রতিটি দিন পুনরাবৃত্তি করে যান একই কাজের -- এ নিয়তিটিও কম অ্যবাসার্ড নয়। কিন্তু এটি ট্র্যাজিক শুধু সেই বিরল মূহূর্তে যখন তা ফুটে ওঠে নিজের নিবিড় অনুভবে। সিসিফাস, যিনি দেবতাদের মধ্যে সর্বহারা, ক্ষমতাহীন এবং বিদ্রোহী, জানেন নিজের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার সমগ্র চিত্রটি: তাঁর অবতরণের সময়ে ঠিক একথাটিই ভাবেন তিনি। তাঁর লাঞ্ছনার কারণ হয়েছিল যে-সারল্য, তা-ই বিজয়ের মুকুট পরিয়ে দিয়েছে তাঁকে। এমন কোন নিয়তি নেই যা মানুষের অনতিক্রম্য।
এই অবতরণ যদি তাই কখনও করা হয়ে থাকে সন্তাপে, তবে আনন্দচিত্তেও তা ঘটতে পারে বৈকি। এমন কিছু বেশি কথা নয় এটি। আবার কল্পনা করি আমি, সিসিফাস ফিরে যাচ্ছেন তাঁর পাথরটির দিকে, দুঃখের সূচনায়। পৃথিবীর ছবিগুলো যখন খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরে স্মৃতি, যখন জেদি হয়ে ওঠে সুখের আহ্বান, মানুষের হৃদয়ে জেগে ওঠে বিষণ্নতা এটি হচ্ছে সেই পাথরের জয়, বস্তুত এটি ওই পাথরটি নিজেই। ভীষণ দুর্ভর, সীমাহীন এই শোক। এগুলো সেই গেথসেমান এর রজনী। কিন্তু রূঢ় সত্য স্বীকৃত হওয়ার পরিবর্তে লয়প্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাই, সত্য জানবার পরিবর্তে শুরুতেই নিয়তির আজ্ঞাবাহী হন ইডিপাস। কিন্তু ঠিক যে-মুহূর্তে তা জানলেন তিনি, তাঁর ট্র্যাজিডি শুরু হয়ে গেল। আবার একই সময়ে, অন্ধ ও বেপরোয়া, উপলব্ধি করেন তিনি, পৃথিবীর সাথে যে-একটিমাত্র বন্ধন যুক্ত রেখেছে তাঁকে তা একটি মেয়ের কোমল হাত। সেইক্ষণে প্রতিধ্বনিত হয় এক অবিস্মরণীয় উক্তি: “এত সব অগ্নিপরীক্ষা সত্বেও, আমার প্রবীণ বয়স আর আমার আত্মার উৎকর্ষ আমাকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিয়েছে যে সবকিছুই সুন্দর।” সফোক্লিসের ইডিপাস, দস্তয়েফ্স্কির কিরিলভের মতই, এইভাবে উপহার দেন অ্যাবসার্ড বিজয়লাভের কৌশল। পুরাকালের প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত করে আধুনিক শৌর্যের।
সুখের একটি নির্দেশিকা রচনায় প্রলুব্ধ হওয়া ভিন্ন অ্যাবসার্ডকে আবিষ্কার করে না কেউ। “কী! অমন এক সঙ্কীর্ণ পথে----?” একটিমাত্র দুনিয়াই আছে, শত হলেও। সুখ আর অ্যাবসার্ড একই মর্ত্যলোকের দুই পুত্র। তারা অবিচ্ছেদ্য। এটি বলা ভুল হবে যে অ্যাবসার্ড আবিষ্কার থেকেই অবধারিতভাবে অঙ্কুরোদ্গম হয় আনন্দের। এমনটিও ঘটে, আনন্দ থেকে জাগ্রত হয় অ্যাবসার্ডের বোধ । ইডিপাসের মহান, পবিত্র সেই উক্তি “আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে সবকিছুই সুন্দর।” মানুষের আদিম এবং সীমিত জগতে প্রতিধ্বনিত হয় সেটি, এবং তা এ-শিক্ষাই দেয় যে সবকিছু শেষ হয়নি, শেষ হয়ে যায়নি। এটি এই মর্ত্যলোক থেকে একজন দেবতাকে বিতাড়িত করে যিনি এখানে এসেছিলেন অতৃপ্তি আর নিষ্ফল যন্ত্রণাভোগের ইচ্ছা নিয়ে। নিয়তিকে এক মানবীয় বিষয়ে পরিণত করে এই এষণা , যার সমাধান মানুষের মাঝেই করতে হবে।
এর মধ্যেই সংগুপ্ত রয়েছে সিসিফাসের সমস্ত নির্বাক আনন্দ। তিনিই তাঁর নিয়তির প্রভু। তাঁর প্রস্তর তাঁরই গুরুভার। একইভাবে, অ্যাবসার্ড মানুষ, যখন নিজের অপার ক্লেশ নিয়ে ভাবেন, তাঁর সকল উপাস্যকে স্তব্ধ করেন তিনি। আপন স্তব্ধতায় অকস্মাৎ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মাণ্ডে জেগে ওঠে মর্ত্যলোকের বিস্ময়াভিভূত অযুত মৃদ কণ্ঠস্বর । অচেতন, গোপন আহ্বান, সকল কণ্ঠের আমন্ত্রণ, ওরা হচ্ছে বিজয়ের অপরিহার্য প্রতিরূপ এবং তার শর্তপূরণ। ছায়াহীন কোন সূর্য নেই, এবং রাতকে জানবার জন্যই এটা জরুরি। অ্যাবসার্ড মানব বলে, ঠিককথা, এবং তারপর থেকে তার প্রচেষ্টা হয় বিরামহীন। আপন ভাগ্য বলে যদি কিছু থাকে, উচ্চতর অদৃষ্ট বলে কছু নেই, অথবা শুধু একটিই রয়েছে যাকে সে অবশ্যম্ভাবী ও জঘন্য বলেই রায় দেয়। অন্য সবকিছুর জন্য, নিজেকে সে তার জীবনের প্রভু জানে। ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে মানুষ যখন তার জীবনের দিকে ফিরে তাকায়, যেমন সিসিফাস তাঁর পাথর অভিমুখে ফিরে আসছিলেন, ঘুরে দাঁড়াবার ওই লহমায় অসম্বন্ধিত সেইসব কর্মের কথা ভাবছিলেন তিনি, যা তাঁর ভাগ্যে পরিণত হয়েছে, নিজেই সৃষ্টি করেছেন, সম্মিলিত হয়েছে তার স্মৃতিসত্তার গভীরে, এবং অচিরেই যার অবসান ঘটবে তাঁর মৃত্যুতে। এইভাবে, মানবীয় সবকিছু মানবেরই সৃষ্টি এমত প্রত্যয়ে, দেখবার আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল একজন অন্ধ মানুষ যিনি জানেন রাত্রির কোন শেষ নেই, তাঁকে আরও পথ চলতে হবে। পাথরটি এখনও গড়াচ্ছে।
সিসিফাসকে ছেড়ে আসি আমি পর্বতের সানুদেশে! প্রত্যেকেই সর্বদা নিজের দুর্বহ ভার ফিরে পান পুনর্বার। কিন্তু সিসিফাস সেই সমুন্নত পৌরুষের শিক্ষা দেন যা দেবতাদের অগ্রাহ্য করে এবং পাথর ঠেলে তোলে। তিনিও মীমাংসায় পৌঁছেন যে সবকিছুই ঠিক আছে। নিরীশ্বর এই ব্রহ্মা- অতঃপর তাঁর কাছে আর নির্বীজ বা নিষ্ফল কিছুই মনে হয় না। ওই পাথরের প্রতিটি অণু, অমানিশায়-ঘেরা সেই পর্বতের প্রতিটি ক্ষুদ্রকণা, নিজেদের মধ্যেই নির্মাণ করে নেয় একেকটি ভুবন। শীর্ষদেশে পৌঁছুবার সংগ্রামই একজন মানুষের হৃদয়কে পরিপূর্ণ করবার জন্য যথেষ্ট। সিসিফাস সুখী, একথা ভাবতেই হবে।
অনুবাদক পরিচিতি
রওশন জামিল
অনুবাদক। গল্পকার।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।
অনুবাদ: রওশন জামিল
দেবতারা চরম দণ্ড দিয়েছিলেন সিসিফাসকে, একটি বিশাল প্রস্তরখণ্ড নিরন্তর ঠেলে তুলতে হবে পর্বতের মাথায়, যেখান থেকে আপন ভারেই পাথরটি গড়িয়ে পড়বে নিচে। খানিক চিন্তাভাবনা করেই তাঁদের মনে হয়েছিল নিষ্ফল ও সম্ভাবনারহিত শ্রমের চেয়ে ভয়ঙ্কর শাস্তি আর কিছুই হয় না।
হোমারকে বিশ্বাস করলে, মরণশীলদের মধ্যে সিসিফাস ছিলেন সবচেয়ে জ্ঞানী ও বিচক্ষণ। অবশ্য, এও বলা হয়ে থাকে, তাঁকে মর্ত্যলোকে পাঠানো হয়েছিল তস্করবৃত্তি অনুশীলনে। কোন বিরোধ দেখি না আমি এতে। কেন তিনি যমপুরীর তুচ্ছ শ্রমিকে পরিণত হয়েছিলেন তা নিয়ে মতভেদ আছে। তাঁর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ, দেবতাদের সাথে বেয়াড়া রসিকতা করেছিলেন। তাঁদের গূঢ় তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন তিনি। ইসোপাসের কন্যা, ইজিনাকে অপহরণ করেন জুপিটার। কন্যার অন্তর্ধানে মুষড়ে পড়েন পিতা, এবং সিসিফাসের কাছে অনুযোগ করেন। সিসিফাস, যিনি অপহরণের বিষয়টি জানতেন, এই শর্তে সত্যপ্রকাশে সম্মত হন যে ইসোপাস করিন্থের পুরদুর্গে জলের ব্যবস্থা করবেন। স্বর্গলোকের বজ্রনিনাদের পরিবর্তে জলের মঙ্গলধ্বনিই পরম মনে হয়েছিল তাঁর কাছে। যমপুরীতে এজন্য শাস্তি বরাদ্দ হয় তাঁর। হোমার থেকেই জানতে পারি, যমকে শেকলে বেঁধে ছিলেন সিসিফাস। নিজের বিরান, স্তব্ধ সাম্রাজ্যের চেহারা সইতে পারেননি প্লুটো। তাই, যুদ্ধের দেবতাকে পাঠিয়েছিলেন, যিনি যমকে মুক্ত করেন তাঁর বিজেতার কবল থেকে।
এমনও কথিত আছে যে, মরণ যখন শিয়রে এক অদ্ভুত খেয়াল চেপেছিল সিসিফাসের, স্ত্রীর ভালবাসা যাচাই করবেন। তাঁর নশ্বর দেহ সমাহিত করবার পরিবর্তে চৌরাস্তার মোড়ে ফেলে রাখতে তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। যমপুরীতে ঘুম ভাঙে সিসিফাসের; এবং সেখানে, মানবীয় ভালবাসার একেবারেই স্ববিরোধী এই আনুগত্যে বিরক্ত হয়ে, মর্ত্যলোকে ফিরে গিয়ে স্ত্রীকে ভর্ৎসনা করে আসার অনুমতি আদায় করে নেন প্লুটোর কাছ থেকে। কিন্তু এই পৃথিবীর মুখ যখন আবার দেখলেন তিনি, এর জল আর সূর্য, উষ্ণ নুড়ি আর সাগরকে উপভোগ করলেন, আর ফিরতে চাইলেন না সেই নারকীয় আঁধারে। প্রত্যাবর্তনের আদেশ, রক্তচক্ষু, সতর্কবার্তা, কোনকিছুতেই ফল হচ্ছিল না। উপসাগরের বাঁক, সফেন সমুদ্র আর বসুন্ধরার হাসি দেখে আরও অনেক বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। আবশ্যক হয়ে পড়েছিল দেবতাদের বিধান । বুধ এলেন, এবং দুর্বিনীত মানুষটিকে ঘাড়ে ধরে, তাঁর সকল আনদন্দযজ্ঞ থেকে একটানে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন যমপুরীতে, যেখানে পাথরটি অপেক্ষা করছিল তাঁর জন্য।
ইতিমধ্যে বুঝে গেছেন আপনি, সিসিফাস হচ্ছেন অ্যাবসার্ড নায়ক। তিনি আসলেই তা-ই, যতখানি তাঁর উদ্দীপনায়, ততখানিই তাঁর লাঞ্ছনাভোগে। দেবতাদের প্রতি তাঁর অবজ্ঞা, মৃত্যুর প্রতি তাঁর ঘৃণা, আর জীবনের প্রতি তাঁর অদম্য ভালবাসা তাঁর জন্য সেই অমোঘ শাস্তি-ই নির্দিষ্ট করেছিল যেখানে সমগ্র সত্তাটিই নিক্ষিপ্ত হয় এক নিষ্ফল অর্জনে। এই মাশুল, মর্ত্যরে প্রতি ভালবাসার অনিবার্য ক্ষতিপূরণ। যমপুরীর সিসিফাস সম্পর্কে আমাদের কিছুই বলা হয়নি। কল্পকথা তৈরি করা হয় কল্পনা দিয়ে তার মধ্যে প্রাণসঞ্চারের জন্য। এই কল্পকথাটির ক্ষেত্রে, একজন শুধু দেখতে পায় চড়াই ভেঙে একটি মানুষের বিশাল একটি প্রস্তরখণ্ড শত-সহস্রবার ঠেলে তুলবার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাটুক; দেখতে পায় কুঞ্চিত একটি মুখ, পাথরে সেঁটে-থাকা শক্ত চোয়াল, কাঁধে কর্দমাক্ত পিণ্ডের ভার, ঠেস-দেয়া পা, প্রসারিত দুবাহুর নতুন উদ্যম, কাদামাখা দুটি হাতের পূর্ণ মানবীয় সুরক্ষা। অবশেষে, নিঃসীম শূন্যতা আর অতলান্তিক সময়ের পরিমাপে নির্ণীত তাঁর দীর্ঘ প্রচেষ্টার অন্তিমক্ষণে, অর্জিত হয় উদ্দেশ্যটি। কিন্তু মুহূর্তমাঝে পাথরটিকে সিসিফাস ছিটকে পড়তে দেখেন পাতালপুরীতে, যেখান থেকে আবার তাঁকে সেটা ঠেলে তুলতে হবে চূড়ায়। তিনি ফিরে যান সমতলে।
ঠিক সেই প্রত্যাবর্তন-মুহূর্তের, সেই দ্বিধাচকিত বিরামের সিসিফাস আকৃষ্ট করেন আমাকে। একটি মুখ, প্রস্তর-ঘনিষ্ঠ পরিশ্রমে নিজেই পাথর হয়ে গেছে! আমি সেই মানুষটিকে শ্রান্ত অথচ সুমিত পদক্ষেপে ফিরে যেতে দেখি এক উৎপীড়নের কাছে যার অবসান তিনি কোনদিনই জানবেন না। মুহূর্ত অবসরের সেই ক্ষণ যা ফিরে ফিরে আসে তাঁর যন্ত্রণার মতই অবধারিতভাবে, তা-ই হচ্ছে চৈতন্যোদয়ের মুহূর্ত। ওই মুহূর্তগুলোর প্রতিটিতে, যখন তিনি শীর্ষদেশ ত্যাগ করে ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকেন দেবতাদের স্তরে, তিনি তাঁর নিয়তির চেয়ে গরীয়ান; তাঁর প্রস্তরের চেয়েও শক্তিমান।
এই কল্পকথাটি যদি ট্র্যাজিক হয়ে থাকে, তা এর নায়ক সচেতন বলে। বস্তুত, কোথায় থাকত তাঁর নিগ্রহ যদি সাফল্যের আশা প্রতি পদক্ষেপে উজ্জীবিত রাখত তাঁকে? আজকের শ্রমজীবী তার জীবনের প্রতিটি দিন পুনরাবৃত্তি করে যান একই কাজের -- এ নিয়তিটিও কম অ্যবাসার্ড নয়। কিন্তু এটি ট্র্যাজিক শুধু সেই বিরল মূহূর্তে যখন তা ফুটে ওঠে নিজের নিবিড় অনুভবে। সিসিফাস, যিনি দেবতাদের মধ্যে সর্বহারা, ক্ষমতাহীন এবং বিদ্রোহী, জানেন নিজের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার সমগ্র চিত্রটি: তাঁর অবতরণের সময়ে ঠিক একথাটিই ভাবেন তিনি। তাঁর লাঞ্ছনার কারণ হয়েছিল যে-সারল্য, তা-ই বিজয়ের মুকুট পরিয়ে দিয়েছে তাঁকে। এমন কোন নিয়তি নেই যা মানুষের অনতিক্রম্য।
এই অবতরণ যদি তাই কখনও করা হয়ে থাকে সন্তাপে, তবে আনন্দচিত্তেও তা ঘটতে পারে বৈকি। এমন কিছু বেশি কথা নয় এটি। আবার কল্পনা করি আমি, সিসিফাস ফিরে যাচ্ছেন তাঁর পাথরটির দিকে, দুঃখের সূচনায়। পৃথিবীর ছবিগুলো যখন খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরে স্মৃতি, যখন জেদি হয়ে ওঠে সুখের আহ্বান, মানুষের হৃদয়ে জেগে ওঠে বিষণ্নতা এটি হচ্ছে সেই পাথরের জয়, বস্তুত এটি ওই পাথরটি নিজেই। ভীষণ দুর্ভর, সীমাহীন এই শোক। এগুলো সেই গেথসেমান এর রজনী। কিন্তু রূঢ় সত্য স্বীকৃত হওয়ার পরিবর্তে লয়প্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাই, সত্য জানবার পরিবর্তে শুরুতেই নিয়তির আজ্ঞাবাহী হন ইডিপাস। কিন্তু ঠিক যে-মুহূর্তে তা জানলেন তিনি, তাঁর ট্র্যাজিডি শুরু হয়ে গেল। আবার একই সময়ে, অন্ধ ও বেপরোয়া, উপলব্ধি করেন তিনি, পৃথিবীর সাথে যে-একটিমাত্র বন্ধন যুক্ত রেখেছে তাঁকে তা একটি মেয়ের কোমল হাত। সেইক্ষণে প্রতিধ্বনিত হয় এক অবিস্মরণীয় উক্তি: “এত সব অগ্নিপরীক্ষা সত্বেও, আমার প্রবীণ বয়স আর আমার আত্মার উৎকর্ষ আমাকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিয়েছে যে সবকিছুই সুন্দর।” সফোক্লিসের ইডিপাস, দস্তয়েফ্স্কির কিরিলভের মতই, এইভাবে উপহার দেন অ্যাবসার্ড বিজয়লাভের কৌশল। পুরাকালের প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত করে আধুনিক শৌর্যের।
সুখের একটি নির্দেশিকা রচনায় প্রলুব্ধ হওয়া ভিন্ন অ্যাবসার্ডকে আবিষ্কার করে না কেউ। “কী! অমন এক সঙ্কীর্ণ পথে----?” একটিমাত্র দুনিয়াই আছে, শত হলেও। সুখ আর অ্যাবসার্ড একই মর্ত্যলোকের দুই পুত্র। তারা অবিচ্ছেদ্য। এটি বলা ভুল হবে যে অ্যাবসার্ড আবিষ্কার থেকেই অবধারিতভাবে অঙ্কুরোদ্গম হয় আনন্দের। এমনটিও ঘটে, আনন্দ থেকে জাগ্রত হয় অ্যাবসার্ডের বোধ । ইডিপাসের মহান, পবিত্র সেই উক্তি “আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে সবকিছুই সুন্দর।” মানুষের আদিম এবং সীমিত জগতে প্রতিধ্বনিত হয় সেটি, এবং তা এ-শিক্ষাই দেয় যে সবকিছু শেষ হয়নি, শেষ হয়ে যায়নি। এটি এই মর্ত্যলোক থেকে একজন দেবতাকে বিতাড়িত করে যিনি এখানে এসেছিলেন অতৃপ্তি আর নিষ্ফল যন্ত্রণাভোগের ইচ্ছা নিয়ে। নিয়তিকে এক মানবীয় বিষয়ে পরিণত করে এই এষণা , যার সমাধান মানুষের মাঝেই করতে হবে।
এর মধ্যেই সংগুপ্ত রয়েছে সিসিফাসের সমস্ত নির্বাক আনন্দ। তিনিই তাঁর নিয়তির প্রভু। তাঁর প্রস্তর তাঁরই গুরুভার। একইভাবে, অ্যাবসার্ড মানুষ, যখন নিজের অপার ক্লেশ নিয়ে ভাবেন, তাঁর সকল উপাস্যকে স্তব্ধ করেন তিনি। আপন স্তব্ধতায় অকস্মাৎ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মাণ্ডে জেগে ওঠে মর্ত্যলোকের বিস্ময়াভিভূত অযুত মৃদ কণ্ঠস্বর । অচেতন, গোপন আহ্বান, সকল কণ্ঠের আমন্ত্রণ, ওরা হচ্ছে বিজয়ের অপরিহার্য প্রতিরূপ এবং তার শর্তপূরণ। ছায়াহীন কোন সূর্য নেই, এবং রাতকে জানবার জন্যই এটা জরুরি। অ্যাবসার্ড মানব বলে, ঠিককথা, এবং তারপর থেকে তার প্রচেষ্টা হয় বিরামহীন। আপন ভাগ্য বলে যদি কিছু থাকে, উচ্চতর অদৃষ্ট বলে কছু নেই, অথবা শুধু একটিই রয়েছে যাকে সে অবশ্যম্ভাবী ও জঘন্য বলেই রায় দেয়। অন্য সবকিছুর জন্য, নিজেকে সে তার জীবনের প্রভু জানে। ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে মানুষ যখন তার জীবনের দিকে ফিরে তাকায়, যেমন সিসিফাস তাঁর পাথর অভিমুখে ফিরে আসছিলেন, ঘুরে দাঁড়াবার ওই লহমায় অসম্বন্ধিত সেইসব কর্মের কথা ভাবছিলেন তিনি, যা তাঁর ভাগ্যে পরিণত হয়েছে, নিজেই সৃষ্টি করেছেন, সম্মিলিত হয়েছে তার স্মৃতিসত্তার গভীরে, এবং অচিরেই যার অবসান ঘটবে তাঁর মৃত্যুতে। এইভাবে, মানবীয় সবকিছু মানবেরই সৃষ্টি এমত প্রত্যয়ে, দেখবার আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল একজন অন্ধ মানুষ যিনি জানেন রাত্রির কোন শেষ নেই, তাঁকে আরও পথ চলতে হবে। পাথরটি এখনও গড়াচ্ছে।
সিসিফাসকে ছেড়ে আসি আমি পর্বতের সানুদেশে! প্রত্যেকেই সর্বদা নিজের দুর্বহ ভার ফিরে পান পুনর্বার। কিন্তু সিসিফাস সেই সমুন্নত পৌরুষের শিক্ষা দেন যা দেবতাদের অগ্রাহ্য করে এবং পাথর ঠেলে তোলে। তিনিও মীমাংসায় পৌঁছেন যে সবকিছুই ঠিক আছে। নিরীশ্বর এই ব্রহ্মা- অতঃপর তাঁর কাছে আর নির্বীজ বা নিষ্ফল কিছুই মনে হয় না। ওই পাথরের প্রতিটি অণু, অমানিশায়-ঘেরা সেই পর্বতের প্রতিটি ক্ষুদ্রকণা, নিজেদের মধ্যেই নির্মাণ করে নেয় একেকটি ভুবন। শীর্ষদেশে পৌঁছুবার সংগ্রামই একজন মানুষের হৃদয়কে পরিপূর্ণ করবার জন্য যথেষ্ট। সিসিফাস সুখী, একথা ভাবতেই হবে।
অনুবাদক পরিচিতি
রওশন জামিল
অনুবাদক। গল্পকার।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।
2 মন্তব্যসমূহ
আনদন্দযজ্ঞ - এটা কী জিনিস?
উত্তরমুছুনচমৎকার। অভিভূত হয়ে পড়লাম। রওশন জামিলকে অনেক ধন্যবাদ এরকম একটি সম্মোহন-জাগানো ভাষান্তর কাব্য রচনা করার জন্য। দীপেন ভট্টাচার্য
উত্তরমুছুন