অনুবাদ: মনোজিৎকুমার দাস
[পল জাকারিয়া ( জন্ম: ১৯৪৫) মালয়ালম ভাষার ছোটগল্পকার ,ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। কেরালার কোট্টায়াম জেলার উরুলিক্কুন্নামে তাঁর জন্ম। তিনি ভারতীয় সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত একজন লেখক। তিনি মালয়ালম ও ইরেজি ভাষায় লিখে থাকেন। মালয়ালম ভাষায় লেখা তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘ সালাম আমেরিকা কথাকই (১৯৯৮)’,‘আরকারলিয়াম কথাকই ( ১৯৯৮)’, ‘কান্নাড়ি কানমোলাভুম কথাকই ( ২০০০)’,‘ জাকারিয়াযুড়ে কথাকই (২০০২)’ ইত্যাদি।
অন্যদিকে ইংরেজি ভাষায় লেখা গ্রন্থগুলো হল ‘ভাস্কর এ পোট্টেলার এন্ড স্টোরিস( ১৯৯২)’, ‘রিফ্লেকশন অব এ হেন ইন হার লাস্ট আওয়ার এন্ড আদার স্টোরিস’,‘ প্রেইজ দি লর্ড এন্ড হোয়াটস নিউজ পিলাটে( ২০০২)’ ইত্যাদি। তিনি তার সাহিত্যকর্মের জন্য নানা পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৯৭ সালে কেরালা সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার, ২০০৪ সালে ‘জাকারিয়াযুড়ে কথাকই’ এর জন্য ভারতীয় সাহিত্য একডেমী পুরস্কার, মুত্তাথু ভারকি ইত্যাদি পুরস্কার লাভ করেন। পল জাকারিয়ার মালয়ালম ভাষায় লেখা ‘পাথিরায়েথুমপোল’ গল্পের এ,জে.থোমাস এর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত ‘ নাইট ডেক্স’ গল্পের বঙ্গানুবাদ করা হলো ]
নাইট ডেক্স-- ১
সময় গড়িয়ে গড়িয়ে নিউজ ব্যুরোতে মাঝরাত। মাটিতে উঁই পোকার ডানা মেলার মতো সিলিং ফ্যানগুলোর ছায়া খালি টেবিলগুলোর উপর। ফ্যানের বাতাসে কাগজের ছড়ানো ছিটানো টুকরোগুলো ছায়ার উপর আছড়ে পড়ছে। খবর লেখা কাগজের টুকরোগুলো উদ্দেশ্যহীন ভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে। কাগজের এক একটা টুকরো টেবিলের পায়াগুলোকে ছুঁয়ে দেওয়ালগুলোর উপর পড়ছে। কাগজের টুকরোগুলো এখনো এখানে ওখানে ছড়ানো ছিটান। কাগজগুলোর মধ্যে একটা মৃত্যুঞ্জায়ানের পায়ে সাথে জড়িয়ে গেলে সে পা দিয়ে কাগজটাকে সরিয়ে দেয়। সে টেলিপ্রিন্টরে নিউজ ক্রল করতে দেখে বলে,“ এটা টেলিপ্রিন্টার থেকে এসেছিল আবার টেলিপ্রিন্টারেই ফিরে যাচ্ছে। এটা আর জন্ম নেবে না, দয়াময় ঈশ্বর!”
চেয়ারে স্থিতু হয়ে বসে মৃত্যুঞ্জায়ান হাত পা ছাড়িয়ে আরাম করার চেষ্টা করে। একটু দূরে, কোথায়ও ঘড়িতে বারটা বাজার শব্দ শোনা যায়। বন্ধ জানালার অন্ধকার পথে ভেসে আসা ঘন্টা ধ্বনি তার কানে এসে লাগে। বেশক্ষণই টেলিপ্রিন্টার নীরব আছে। নিউজ আসতে শুরু করে, টেলিপ্রিন্টারে আবার শব্দ শোনা যায়। মেশিনগানের গুলির শব্দের মতো শব্দ! মৃত্যুঞ্জয়ান কান পাতে। ঘড়ির ঘন্টা ধ্বনি ম্লান হয়ে যায় নিউজ আসা টেলিপ্রিন্টারের শব্দের চিৎকারে, মৃত্যুঞ্জায়ান ভাবে ওটা খবর জন্ম দেবার আত্মচিৎকার। মানবজাতিকে খবর জানাতেই তার নিজ জন্মের এ আয়োজন। সময়ের কোমল ছন্দগুলো খবরের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে।
টেবিলের উপর খবর লেখা টুকরোগুলো গড়াগড়ি যেতে দেখা যায়। তারা মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে রিফুজীদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। “ আজকাল খবরগুলো অদ্ভুত ভাবে অস্থির,” মৃত্যুঞ্জয়ান মনে মনে ভাবে। সিলিং ফ্যানের বাতাস খবর লেখা এক এক টুকরোকে উপরের দিকে টেনে তুলছে। কাগজগুলো জানালা দিয়ে বের হয়ে যাবার আগে ফ্যানের পাখনায় আঘাত করছে। “ তোমরা কোথায় যাচ্ছ?” মৃত্যুঞ্জায়ান কাগজগুলোকে জিজ্ঞেস করে। “ ওখানে কোথায়ও বিলিবন্দোবস্তের জায়গা নেই।” তারপরই খোলা জানালার পেছনের অন্ধকার থেকে ক্যান্টিনের বিড়ালটি ডেকে উঠে,“ ম্যাও” শব্দে।
সমস্ত সময় নাইট ডেক্সে থেকেও মৃত্যুঞ্জায়ান কখনোই খবরকে এভাবে অস্থির হতে দেখেনি । প্রত্যেক রাতে সে লক্ষ করতো খবরের গল্পের ছোট ছোট জীবন্ত রূপকে। সে তাদের গল্পকে বড় কিংবা ছোট করে। চাপ ও বোধ পরিবর্তীত হয় কিংবা একত্রে অনেকগুলো বাদ পড়ে।
রাতব্যাপী টেলিপ্রিন্টারটা একজন বাচাল পাগললোকের মতো পেপারের রোলগুলোতে পৃথিবীর নানা খবরের জন্ম দেয়। কিছু দয়ামায়াহীন শক্তির বিশ্বস্ত অনুচরের মতো মৃত্যুঞ্জায়ান কেটেছেঁটে নিউজ স্টোরিসের আকার দেয়। তারপর সে লক্ষ্য করে, সেই কাগজগুলো রুমের মেঝেতে উড়ে বেড়াচ্ছে।
অবশিষ্ট সময়টা, সে তার পূর্বজন্ম সম্বন্ধে ভেবে অবাক হয়। সে ধ্যানস্থ হয়ে অসংখ্যক সফরের কথা জানতে পারে। সে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পেরিয়ে এসেছে সাপ,কীট, গাছ, হরিণী, মহিলা আর জীবানু রূপে। সে ধ্বংসপ্রাপ্ত স্মৃতিসৌধ দেখে আশ্চর্য হয়েছিল। এবং তার এ সব সফরগুলোর পেছনে ফেলে রেখে এসেছিল পোকায় কাটা গাছ। সে হতাশা ও বিস্ময়ে ভেবেছিল তার অসংখ্যক কঙ্কাল ও ফসিল নানা আকৃতি ও আকারের কথা; সেগুলো পৃথিবীর গর্ভে বরফের মতো জমে গিয়েছিল।
ইতিমধ্যে টেলিপ্রিন্টারে সাম্প্রতিক সময়ে খবর আসতে শুরু করে। কাগজগুলো থেকে মৃত্যুঞ্জায়ান নিউজ আইটেম প্রথমে নির্বাচন করে, তারপর সেগুলোকে পুননির্বাচনান্তে কাটছাঁট করে সে পুনরায় লেখে । তারপর কাগজগুলো ছুড়ে ফেলে দেয়। কাজ শেষ করার পর সে ঘুমানোর চেষ্টা করে--কিন্তু ঘুমাতে পারে না। প্রত্যেকবারই সে তার চোখ দুটো বন্ধ করে, রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়ার কালে দেখা ছেলেমেয়েদের দু:খভারাক্রান্ত ছবি তার চোখের পাতায় ফিরে ফিরে আসে । ছেলেমেয়েরা রাস্তায় ঘোরাফেরা করছে খিদে আর তেষ্টা নিয়ে। তার চোখদুটো তিতো আর নোনা চোখের জলে ভরে যায়। তারপর তার চোখে নেমে আসে ঘুম ঘুম ভাব। - ওহ ঈশ্বর, দুস্থ ছেলেমেয়েদের জগত থেকে আমাকে ঘমের জগতে নিয়ে যাও, মৃত্যুঞ্জায়ান ফিসফিস করে বলে। সময়ের নিষ্ঠুর চাকাগুলোকে থামাও যাতে ছোট্ট ছোট্ট জীবনগুলো নি:শেষ হয়ে যেন না যায়। ছেলেমেয়েদের চোখের জলের সমুদ্রকে শুকিয়ে দাও। এ পৃথিবীর উপরের সৌধগুলোর সীমাহীন আকাশচুম্বী বৃদ্ধি বন্ধ কর।
কয়েকটি খবর তৈরির উদ্দেশে টেলিপ্রিন্টার আবার গর্জন করে উঠে। খবরগুলোর মধ্যে একটা ছিল মহাশূন্যে বাসস্থান তৈরির খবর। মৃত্যুঞ্জায়ান ভাবে, সে যেন পৃথিবীর শেষ দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।
মৃত্যুঞ্জায়ান ক্যান্টিনের বিড়ালটাকে খোঁজার জন্য চেয়ার থেকে উঠে পড়ে। হঠাৎ করে টিউব লাইট নিভে যায়। ফ্যানগুলোও ধীরে ধীরে চলতে চলতে এক সময় থেমে যায়। খবরের কাগজের টুকরোগুলোর উড়াওড়িও থামে। টেলিপ্রিন্টার নীরব হয়। জানালার বাইরের দিক থেকে বিড়ালটা “মিঁউ” করে ডেকে উঠে।
“এদিকে এগিয়ে এস, তুমি তো আমার সাথে জেগে আছ,” আঁধারের মধ্যে থেকে মৃত্যুঞ্জায়ান বলে উঠে। “ এস আমরা একসঙ্গে জেগে থাকি।” একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে টেবিলের উপর রেখে আবার সে নিজের চেয়ারে বসে। বাইরে দিকে মোমবাতির নিষ্প্রভ আলো ছড়িয়ে পড়ে। আঁধার কিছুটা দূর হয়।
মোমবাতির আলোর সীমারেখায় সে উঁকি মারে। মৃত্যুঞ্জায়ান চিন্তা ভাবনার যেন শক্তি হারিয়ে ফেলছে। আমি পৃথিবীর শেষটাকে বেঁকিয়ে দিয়ে ছেলেমেয়েদের দু:খকষ্টের সমাপ্তি ঘটাবো এবং জন্ম নেওয়াটাকে থামিয়ে দেবো। জন্ম না নেওয়া শিশুগুলা ফুঁপিয়ে কেদে উঠছে কেন? মৃত্যুঞ্জায়ান হতবাক হল!
নাইট ডেক্স- ২
আমার স্ত্রীর অ্যাবোরসনের দিন আমি কেঁদেছিলাম। জন্ম না নেওয়া করা শিশুটার জন্য আমি কেঁদে ছিলাম। এ শিশুটা যাত্রা করেও কখনোই গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি। ওহ আমার না জন্মানো শিশু, আমার জীবনের কুঁড়ি, তোমার ফেরত যাত্রা শুভ হোক, আমি প্রার্থনা করেছিলাম। জন্ম কিংবা মৃত্যু কোনটাই সমাপ্ত না করে জীবনের বসন্ত লগ্নে তুমি চুঁয়ে পড়লে একটা শান্ত লেগুনে। তুমি কে ছিলে? তুমি তোমার যাত্রা শেষ না করে আমাকে বিদায়ের বাণী কি শুনিয়ে গেলে? ওহ আগন্তুক, তুমি আমার সাথে বাস করার জন্য যাত্রা করেছিলে, কত বড় দু:খ,আনন্দ, ভালবাসা ও বিস্ময় তোমার কচি শরীরে ধারণ করেছিলে, আর সেই তুমি হাসপাতালের ওয়েস্টবিনে পঁচে গলে ধুলোয় মিশে গেলে?
চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ায় মৃত্যুঞ্জয়ের ঠোঁটদুটো ভিজে গেল। শিশুটা যাত্রা সমাপ্ত না করায় তার মনের ভালবাসা আর একবারের জন্য বেদনাদীর্ণ হল।
মোমবাতির আলো পেছনে জানালার ওদিকে ক্যান্টিন বিড়াল হাজির। সে লাফ দিয়ে জানালা গলিয়ে নিউজের কাগজগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে মৃত্যুঞ্জায়ানের টেবিলের কাছে এসে বসে পড়েছে। তার দুটো জ্বলন্ত চোখ তার দিকে চেয়ে আছে। সে ডেকে উঠে “ মিঁউ, মিঁউ ”বলে। মৃত্যুঞ্জায়ান তার ঠান্ডা নাকে আঙুল ছোঁয়ায়ে জিজ্ঞেস করে,“ তুমি কী বললে? সময় শেষ হয়ে গেছে?
মৃত্যুঞ্জায়ান চেয়ার থেকে উঠে জানালা পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকায়। বাইরে কিছুই দেখা যায় না শুধু অন্ধকার ছাড়া। কে যেন কালো হাত দিয়ে তার চোখদুটো ঢেকে দেয়। সে টেবিলের উপরের মোমবাতির ছোট্ট বৃত্তের দিকে তাকায়। মোমবাতির আলো সামান্য হলেও আঁধারকে দূর হয়। ভেতর দিক থেকে দুটো চোখ জ্বলে উঠে। হঠাৎ করে টেলিপ্রিন্টার গর্জন করতে থাকে। মৃত্যুঞ্জায়ান দাঁড়িয়ে টেলিপ্রিন্টারের আগুনের মতো আলোটাকে নির্দয় দৃষ্টিতে অবলোকন করতে থাকে। আঁধারের মাঝে তা যেন তাকে বিদ্রুপ করছে।
মৃত্যুঞ্জায়ান যেন তার হার্টবিট শুনতে পারছে। সে সেদিকে কিছুটা সচেতন ভাবে চেয়ে থাকে। তারপর একটা জাদুকরী দমকা হাওয়া এসে তার মুখে লাগে। শব্দগুলো ছাপা হল তার মুখে, একই শব্দমালা বার বার লেখা হল। ধাতব মেশিনের টেলিপ্রিন্টার গর্জন করেই চলেছে। পৃথিবী শেষ হয়ে গেল! পৃথিবী -----
আঁধার ঘন হয়ে এল।
মৃত্যুঞ্জায়ান আঁধারের ভেতর দিয়ে জানালার দিকে হেঁটে যায়, যেন একটা পর্দার ভেতর দিয়ে। সে চারদিক হাতড়িয়ে হতাশার দৃষ্টিতে সে শেষবারের মতো তাকায়। কিন্তু আঁধার জানালাটিকে যেন মুছে ফেলে । সে আবার ফিরে আসে।
কালো শব আচ্ছাদন বস্ত্র যেন সব কিছুকে আবৃত করে ফেলছে। টেলিপ্রিন্টারের গর্জন ম্লান হয়ে যায় আঁধারের করাল গ্রাসে। টেবিল ও তার উপরের মোমবাতির আলো আঁধারের সাথে মিশে যাচ্ছে।
মৃত্যুঞ্জায়ান দৌড়ে যায় চোখদুটো দিকে, যা আঁধারের মাঝেও জ্বল জ্বল করছে। চোখের আলো যেন তার বুকে এসে লাগছে। সে তার নিজের চোখের নিষ্প্রভ আলোয় কথা ভেবে হেসে উঠে। বিড়ালটার মুখে চুমু দিয়ে সে বলে ,“ সময় বেড়ে গেছে।” আঁধার সব কিছুকে গ্রাস করল। দূর থেকে একটা কোমল , শোকার্ত কন্ঠস্বর অনেক অনেক দূরের মিলিয়ন মিলিয়ন অনন্তকাল থেকে ভেসে আসছে আঁধারের অন্তস্থল থেকে: “ মিঁউ ” সে বিড়ালটিকে কাছে আনে। সে বিড়ালটা কন্ঠ থেকে একটা সুললিত সুর শুনতে পায়।
সাংবাদিক মৃত্যুঞ্জায়ান জন্ম ও মৃত্যুর পানে দৃষ্টিপাত করে রোমাঞ্চিত ও হতবাক হয়!
[পল জাকারিয়া ( জন্ম: ১৯৪৫) মালয়ালম ভাষার ছোটগল্পকার ,ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। কেরালার কোট্টায়াম জেলার উরুলিক্কুন্নামে তাঁর জন্ম। তিনি ভারতীয় সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত একজন লেখক। তিনি মালয়ালম ও ইরেজি ভাষায় লিখে থাকেন। মালয়ালম ভাষায় লেখা তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘ সালাম আমেরিকা কথাকই (১৯৯৮)’,‘আরকারলিয়াম কথাকই ( ১৯৯৮)’, ‘কান্নাড়ি কানমোলাভুম কথাকই ( ২০০০)’,‘ জাকারিয়াযুড়ে কথাকই (২০০২)’ ইত্যাদি।
অন্যদিকে ইংরেজি ভাষায় লেখা গ্রন্থগুলো হল ‘ভাস্কর এ পোট্টেলার এন্ড স্টোরিস( ১৯৯২)’, ‘রিফ্লেকশন অব এ হেন ইন হার লাস্ট আওয়ার এন্ড আদার স্টোরিস’,‘ প্রেইজ দি লর্ড এন্ড হোয়াটস নিউজ পিলাটে( ২০০২)’ ইত্যাদি। তিনি তার সাহিত্যকর্মের জন্য নানা পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৯৭ সালে কেরালা সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার, ২০০৪ সালে ‘জাকারিয়াযুড়ে কথাকই’ এর জন্য ভারতীয় সাহিত্য একডেমী পুরস্কার, মুত্তাথু ভারকি ইত্যাদি পুরস্কার লাভ করেন। পল জাকারিয়ার মালয়ালম ভাষায় লেখা ‘পাথিরায়েথুমপোল’ গল্পের এ,জে.থোমাস এর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত ‘ নাইট ডেক্স’ গল্পের বঙ্গানুবাদ করা হলো ]
নাইট ডেক্স-- ১
সময় গড়িয়ে গড়িয়ে নিউজ ব্যুরোতে মাঝরাত। মাটিতে উঁই পোকার ডানা মেলার মতো সিলিং ফ্যানগুলোর ছায়া খালি টেবিলগুলোর উপর। ফ্যানের বাতাসে কাগজের ছড়ানো ছিটানো টুকরোগুলো ছায়ার উপর আছড়ে পড়ছে। খবর লেখা কাগজের টুকরোগুলো উদ্দেশ্যহীন ভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে। কাগজের এক একটা টুকরো টেবিলের পায়াগুলোকে ছুঁয়ে দেওয়ালগুলোর উপর পড়ছে। কাগজের টুকরোগুলো এখনো এখানে ওখানে ছড়ানো ছিটান। কাগজগুলোর মধ্যে একটা মৃত্যুঞ্জায়ানের পায়ে সাথে জড়িয়ে গেলে সে পা দিয়ে কাগজটাকে সরিয়ে দেয়। সে টেলিপ্রিন্টরে নিউজ ক্রল করতে দেখে বলে,“ এটা টেলিপ্রিন্টার থেকে এসেছিল আবার টেলিপ্রিন্টারেই ফিরে যাচ্ছে। এটা আর জন্ম নেবে না, দয়াময় ঈশ্বর!”
চেয়ারে স্থিতু হয়ে বসে মৃত্যুঞ্জায়ান হাত পা ছাড়িয়ে আরাম করার চেষ্টা করে। একটু দূরে, কোথায়ও ঘড়িতে বারটা বাজার শব্দ শোনা যায়। বন্ধ জানালার অন্ধকার পথে ভেসে আসা ঘন্টা ধ্বনি তার কানে এসে লাগে। বেশক্ষণই টেলিপ্রিন্টার নীরব আছে। নিউজ আসতে শুরু করে, টেলিপ্রিন্টারে আবার শব্দ শোনা যায়। মেশিনগানের গুলির শব্দের মতো শব্দ! মৃত্যুঞ্জয়ান কান পাতে। ঘড়ির ঘন্টা ধ্বনি ম্লান হয়ে যায় নিউজ আসা টেলিপ্রিন্টারের শব্দের চিৎকারে, মৃত্যুঞ্জায়ান ভাবে ওটা খবর জন্ম দেবার আত্মচিৎকার। মানবজাতিকে খবর জানাতেই তার নিজ জন্মের এ আয়োজন। সময়ের কোমল ছন্দগুলো খবরের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে।
টেবিলের উপর খবর লেখা টুকরোগুলো গড়াগড়ি যেতে দেখা যায়। তারা মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে রিফুজীদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। “ আজকাল খবরগুলো অদ্ভুত ভাবে অস্থির,” মৃত্যুঞ্জয়ান মনে মনে ভাবে। সিলিং ফ্যানের বাতাস খবর লেখা এক এক টুকরোকে উপরের দিকে টেনে তুলছে। কাগজগুলো জানালা দিয়ে বের হয়ে যাবার আগে ফ্যানের পাখনায় আঘাত করছে। “ তোমরা কোথায় যাচ্ছ?” মৃত্যুঞ্জায়ান কাগজগুলোকে জিজ্ঞেস করে। “ ওখানে কোথায়ও বিলিবন্দোবস্তের জায়গা নেই।” তারপরই খোলা জানালার পেছনের অন্ধকার থেকে ক্যান্টিনের বিড়ালটি ডেকে উঠে,“ ম্যাও” শব্দে।
সমস্ত সময় নাইট ডেক্সে থেকেও মৃত্যুঞ্জায়ান কখনোই খবরকে এভাবে অস্থির হতে দেখেনি । প্রত্যেক রাতে সে লক্ষ করতো খবরের গল্পের ছোট ছোট জীবন্ত রূপকে। সে তাদের গল্পকে বড় কিংবা ছোট করে। চাপ ও বোধ পরিবর্তীত হয় কিংবা একত্রে অনেকগুলো বাদ পড়ে।
রাতব্যাপী টেলিপ্রিন্টারটা একজন বাচাল পাগললোকের মতো পেপারের রোলগুলোতে পৃথিবীর নানা খবরের জন্ম দেয়। কিছু দয়ামায়াহীন শক্তির বিশ্বস্ত অনুচরের মতো মৃত্যুঞ্জায়ান কেটেছেঁটে নিউজ স্টোরিসের আকার দেয়। তারপর সে লক্ষ্য করে, সেই কাগজগুলো রুমের মেঝেতে উড়ে বেড়াচ্ছে।
অবশিষ্ট সময়টা, সে তার পূর্বজন্ম সম্বন্ধে ভেবে অবাক হয়। সে ধ্যানস্থ হয়ে অসংখ্যক সফরের কথা জানতে পারে। সে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পেরিয়ে এসেছে সাপ,কীট, গাছ, হরিণী, মহিলা আর জীবানু রূপে। সে ধ্বংসপ্রাপ্ত স্মৃতিসৌধ দেখে আশ্চর্য হয়েছিল। এবং তার এ সব সফরগুলোর পেছনে ফেলে রেখে এসেছিল পোকায় কাটা গাছ। সে হতাশা ও বিস্ময়ে ভেবেছিল তার অসংখ্যক কঙ্কাল ও ফসিল নানা আকৃতি ও আকারের কথা; সেগুলো পৃথিবীর গর্ভে বরফের মতো জমে গিয়েছিল।
ইতিমধ্যে টেলিপ্রিন্টারে সাম্প্রতিক সময়ে খবর আসতে শুরু করে। কাগজগুলো থেকে মৃত্যুঞ্জায়ান নিউজ আইটেম প্রথমে নির্বাচন করে, তারপর সেগুলোকে পুননির্বাচনান্তে কাটছাঁট করে সে পুনরায় লেখে । তারপর কাগজগুলো ছুড়ে ফেলে দেয়। কাজ শেষ করার পর সে ঘুমানোর চেষ্টা করে--কিন্তু ঘুমাতে পারে না। প্রত্যেকবারই সে তার চোখ দুটো বন্ধ করে, রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়ার কালে দেখা ছেলেমেয়েদের দু:খভারাক্রান্ত ছবি তার চোখের পাতায় ফিরে ফিরে আসে । ছেলেমেয়েরা রাস্তায় ঘোরাফেরা করছে খিদে আর তেষ্টা নিয়ে। তার চোখদুটো তিতো আর নোনা চোখের জলে ভরে যায়। তারপর তার চোখে নেমে আসে ঘুম ঘুম ভাব। - ওহ ঈশ্বর, দুস্থ ছেলেমেয়েদের জগত থেকে আমাকে ঘমের জগতে নিয়ে যাও, মৃত্যুঞ্জায়ান ফিসফিস করে বলে। সময়ের নিষ্ঠুর চাকাগুলোকে থামাও যাতে ছোট্ট ছোট্ট জীবনগুলো নি:শেষ হয়ে যেন না যায়। ছেলেমেয়েদের চোখের জলের সমুদ্রকে শুকিয়ে দাও। এ পৃথিবীর উপরের সৌধগুলোর সীমাহীন আকাশচুম্বী বৃদ্ধি বন্ধ কর।
কয়েকটি খবর তৈরির উদ্দেশে টেলিপ্রিন্টার আবার গর্জন করে উঠে। খবরগুলোর মধ্যে একটা ছিল মহাশূন্যে বাসস্থান তৈরির খবর। মৃত্যুঞ্জায়ান ভাবে, সে যেন পৃথিবীর শেষ দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।
মৃত্যুঞ্জায়ান ক্যান্টিনের বিড়ালটাকে খোঁজার জন্য চেয়ার থেকে উঠে পড়ে। হঠাৎ করে টিউব লাইট নিভে যায়। ফ্যানগুলোও ধীরে ধীরে চলতে চলতে এক সময় থেমে যায়। খবরের কাগজের টুকরোগুলোর উড়াওড়িও থামে। টেলিপ্রিন্টার নীরব হয়। জানালার বাইরের দিক থেকে বিড়ালটা “মিঁউ” করে ডেকে উঠে।
“এদিকে এগিয়ে এস, তুমি তো আমার সাথে জেগে আছ,” আঁধারের মধ্যে থেকে মৃত্যুঞ্জায়ান বলে উঠে। “ এস আমরা একসঙ্গে জেগে থাকি।” একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে টেবিলের উপর রেখে আবার সে নিজের চেয়ারে বসে। বাইরে দিকে মোমবাতির নিষ্প্রভ আলো ছড়িয়ে পড়ে। আঁধার কিছুটা দূর হয়।
মোমবাতির আলোর সীমারেখায় সে উঁকি মারে। মৃত্যুঞ্জায়ান চিন্তা ভাবনার যেন শক্তি হারিয়ে ফেলছে। আমি পৃথিবীর শেষটাকে বেঁকিয়ে দিয়ে ছেলেমেয়েদের দু:খকষ্টের সমাপ্তি ঘটাবো এবং জন্ম নেওয়াটাকে থামিয়ে দেবো। জন্ম না নেওয়া শিশুগুলা ফুঁপিয়ে কেদে উঠছে কেন? মৃত্যুঞ্জায়ান হতবাক হল!
নাইট ডেক্স- ২
আমার স্ত্রীর অ্যাবোরসনের দিন আমি কেঁদেছিলাম। জন্ম না নেওয়া করা শিশুটার জন্য আমি কেঁদে ছিলাম। এ শিশুটা যাত্রা করেও কখনোই গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি। ওহ আমার না জন্মানো শিশু, আমার জীবনের কুঁড়ি, তোমার ফেরত যাত্রা শুভ হোক, আমি প্রার্থনা করেছিলাম। জন্ম কিংবা মৃত্যু কোনটাই সমাপ্ত না করে জীবনের বসন্ত লগ্নে তুমি চুঁয়ে পড়লে একটা শান্ত লেগুনে। তুমি কে ছিলে? তুমি তোমার যাত্রা শেষ না করে আমাকে বিদায়ের বাণী কি শুনিয়ে গেলে? ওহ আগন্তুক, তুমি আমার সাথে বাস করার জন্য যাত্রা করেছিলে, কত বড় দু:খ,আনন্দ, ভালবাসা ও বিস্ময় তোমার কচি শরীরে ধারণ করেছিলে, আর সেই তুমি হাসপাতালের ওয়েস্টবিনে পঁচে গলে ধুলোয় মিশে গেলে?
চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ায় মৃত্যুঞ্জয়ের ঠোঁটদুটো ভিজে গেল। শিশুটা যাত্রা সমাপ্ত না করায় তার মনের ভালবাসা আর একবারের জন্য বেদনাদীর্ণ হল।
মোমবাতির আলো পেছনে জানালার ওদিকে ক্যান্টিন বিড়াল হাজির। সে লাফ দিয়ে জানালা গলিয়ে নিউজের কাগজগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে মৃত্যুঞ্জায়ানের টেবিলের কাছে এসে বসে পড়েছে। তার দুটো জ্বলন্ত চোখ তার দিকে চেয়ে আছে। সে ডেকে উঠে “ মিঁউ, মিঁউ ”বলে। মৃত্যুঞ্জায়ান তার ঠান্ডা নাকে আঙুল ছোঁয়ায়ে জিজ্ঞেস করে,“ তুমি কী বললে? সময় শেষ হয়ে গেছে?
মৃত্যুঞ্জায়ান চেয়ার থেকে উঠে জানালা পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকায়। বাইরে কিছুই দেখা যায় না শুধু অন্ধকার ছাড়া। কে যেন কালো হাত দিয়ে তার চোখদুটো ঢেকে দেয়। সে টেবিলের উপরের মোমবাতির ছোট্ট বৃত্তের দিকে তাকায়। মোমবাতির আলো সামান্য হলেও আঁধারকে দূর হয়। ভেতর দিক থেকে দুটো চোখ জ্বলে উঠে। হঠাৎ করে টেলিপ্রিন্টার গর্জন করতে থাকে। মৃত্যুঞ্জায়ান দাঁড়িয়ে টেলিপ্রিন্টারের আগুনের মতো আলোটাকে নির্দয় দৃষ্টিতে অবলোকন করতে থাকে। আঁধারের মাঝে তা যেন তাকে বিদ্রুপ করছে।
মৃত্যুঞ্জায়ান যেন তার হার্টবিট শুনতে পারছে। সে সেদিকে কিছুটা সচেতন ভাবে চেয়ে থাকে। তারপর একটা জাদুকরী দমকা হাওয়া এসে তার মুখে লাগে। শব্দগুলো ছাপা হল তার মুখে, একই শব্দমালা বার বার লেখা হল। ধাতব মেশিনের টেলিপ্রিন্টার গর্জন করেই চলেছে। পৃথিবী শেষ হয়ে গেল! পৃথিবী -----
আঁধার ঘন হয়ে এল।
মৃত্যুঞ্জায়ান আঁধারের ভেতর দিয়ে জানালার দিকে হেঁটে যায়, যেন একটা পর্দার ভেতর দিয়ে। সে চারদিক হাতড়িয়ে হতাশার দৃষ্টিতে সে শেষবারের মতো তাকায়। কিন্তু আঁধার জানালাটিকে যেন মুছে ফেলে । সে আবার ফিরে আসে।
কালো শব আচ্ছাদন বস্ত্র যেন সব কিছুকে আবৃত করে ফেলছে। টেলিপ্রিন্টারের গর্জন ম্লান হয়ে যায় আঁধারের করাল গ্রাসে। টেবিল ও তার উপরের মোমবাতির আলো আঁধারের সাথে মিশে যাচ্ছে।
মৃত্যুঞ্জায়ান দৌড়ে যায় চোখদুটো দিকে, যা আঁধারের মাঝেও জ্বল জ্বল করছে। চোখের আলো যেন তার বুকে এসে লাগছে। সে তার নিজের চোখের নিষ্প্রভ আলোয় কথা ভেবে হেসে উঠে। বিড়ালটার মুখে চুমু দিয়ে সে বলে ,“ সময় বেড়ে গেছে।” আঁধার সব কিছুকে গ্রাস করল। দূর থেকে একটা কোমল , শোকার্ত কন্ঠস্বর অনেক অনেক দূরের মিলিয়ন মিলিয়ন অনন্তকাল থেকে ভেসে আসছে আঁধারের অন্তস্থল থেকে: “ মিঁউ ” সে বিড়ালটিকে কাছে আনে। সে বিড়ালটা কন্ঠ থেকে একটা সুললিত সুর শুনতে পায়।
সাংবাদিক মৃত্যুঞ্জায়ান জন্ম ও মৃত্যুর পানে দৃষ্টিপাত করে রোমাঞ্চিত ও হতবাক হয়!
0 মন্তব্যসমূহ