ম্যাক্সিম গর্কির গল্প : বেঈমানের মা

অনুবাদ- অসিত সরকার

মায়েদের সম্পর্কে কাহিনীর আর অন্ত নেই।

কয়েক সপ্তাহ ধরেই শত্রুসৈন্য অস্ত্রের কঠিন বেড়াজালে শহরটাকে ঘিরে রেখেছে। রাত্রে আগুন জ্বলে ওঠে, নগর-প্রাচীরের গাঢ় অন্ধকারে অগণন লাল চোখের মতো নেচে ওঠে তার দীপ্ত শিখা–কুৎসিত হিংস্রতায় জ্বলতেই থাকে সে লেলিহান শিখা। তার শঙ্কাতুর ঝলকানিতে গুমরে ওঠে অবরুদ্ধ সারাটা শহর।


নগর-প্রাচীর থেকেই চোখে পডে শক্রর কঠিন বেড়াজাল, আগুনের চারপাশে কালো কালো ছায়ামূর্তিদের নড়াচড়া, বলিষ্ঠ অশ্বের হ্রেষাধ্বনি, অস্ত্ৰের ঝনঝনা, জয় সম্পর্কে সুনিশ্চিন্ত লোকজনের উলোল উল্লাস। কিন্তু শত্রুর হাসি আর গানের চাইতে উৎকট, শ্রুতিকটু আর কি হতে পারে ।

পানীয় জলের প্রতিটি স্রোতধারায় শক্ররা মৃতদেহ ফেলছে, প্রাচীরের চারপাশের আঙ্গুর বাগিচাগুলো পুড়িয়ে ছাই করে দিযেছে, পদদলিত করেছে ফসলের ক্ষেত, ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে ফলের বাগান। সব দিক থেকেই শহর এখন শত্রুপক্ষের কাছে উন্মুক্ত। প্রায় প্রতিদিনই শক্রর গোলাবর্ষণে ঝরে পডে অগ্নিবৃষ্টি।

যুদ্ধক্লান্ত ক্ষুধার্ত সৈন্যবাহিনীর বিচ্ছিন্ন দল বিষণ্ন মনে শহরের সংকীর্ণ পথে টহল দিয়ে ফেরে। ঘরবাডির জানলা দিয়ে ভেসে আসে আহতদের আর্তনাদ, প্ৰলাপ, নারীদের প্রার্থনা, শিশুদের ক্ৰন্দন। লোকে ফিসফিস করে কথা বলে, বলতে বলতে হঠাৎ মাঝপথে উৎকর্ণ হয়ে থমকে যায়—শক্ররা এসে পড়ল নাকি ?

সবচেয়ে জঘন্য এই রাতগুলো। নৈশ-নিস্তব্ধতায় গোঙানি আর আর্তস্বর আরও স্পষ্ট শোনা যেতো। শক্ৰ-ছাউনিকে আড়াল করে দূর পাহাড়ি খাদ থেকে কালো কালো ছায়ামূর্তিগুলো চোরের মতো চুপি চুপি ভাঙা প্রাচীরের দিকে এগিয়ে আসতো। পাহাড়ের কালো চূড়ার ওপর তরোয়ালের ঘা-খাওয়া আধখানা ঢালের মতো চাঁদ উঠতো।

দিন দিন মুক্তির আশায় হতাশ হয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত ক্ষুধার্ত নগরবাসীরা আতঙ্কে তাকিয়ে থাকতো সেই চাঁদের দিকে, তাকাতো দাঁত-বার-করা পাহাডিচুড়া, খাদের অতল গহ্বর আর কোলাহলমুখর শক্ৰ-ছাউনিগুলোর দিকে। সবকিছু থেকেই ভেসে আসতো মৃত্যুর ফিসফিসানি, আকাশে সান্ত্বনার একটাও তারা দেখা দিতো না।


ভয়ে কেউ ঘরের বাতি জ্বালতো না। রাস্তাগুলো গাঢ় অন্ধকারে মোড়া। আর সেই গাঢ় অন্ধকারে কালো বোরখায় সর্বাঙ্গ ঢেকে একজন নারী নদীর গভীরে মাছের মতো নি:শব্দ পায়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতো।

ওকে দেখলেই সবাই কানাকানি করতো, “এ সেই না?’।
'হ্যাঁ, সেই ।”

তারপরেই ওরা মাথা নিচু করে দ্ৰুত ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতো, নয় তো প্রাচীরের আড়ালে কোথাও লুকিয়ে পড়তো। টহলদার প্রহরীরা রুক্ষ স্বরে ওকে সতর্ক করে দিতো : ‘আবার বেরিয়েছেন, মোনা মবিয়ানা ? সাবধান, কোনদিন মারা পড়বেন, আর সেদিন আততায়ীকে খুঁজে বার করার জন্যে কারুর মাথাব্যাথা পড়বে না-

থমকে দাঁডিয়ে মেয়েটা অপেক্ষা করতো। প্রহরীরা হয় সাহস পেতো না, না হয় তো ওর গায়ে হাত তুলতে ঘেন্নাবোধ করতো, তাই ওরা ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতো। স্বশস্ত্র বাহিনীর লোকেরাও ওকে মড়ার মতো এডিয়ে চলতো। অন্ধকারে একা একা মেয়েটা আবার নি:শব্দে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো আর হতভাগ্য শহরের কর্কশ শোক মূর্তিটাও ঘুরে বেড়াতো ওর চারপাশে। বেদনাবিধুর শব্দ উঠতো রাত্রির বুক চিরে, তার সাথে আর্তনাদ, কান্না, প্রার্থনা আর হতোদ্যম পরাজিত সৈন্যদের বিষণ্ন প্ৰলাপ ।

শুধু নাগরিকই নয়, ও একজন মা। তার দেশ, নিজের ছেলের সম্পর্কে ওর ভাবনার অন্ত নেই। কেননা অবরুদ্ধ করে শহরখানাকে যারা ধ্বংস করেছে ওর ছেলে তাদের দলনেতা। যেমন হাসিখুসি সুপুরুষ দেখতে, তেমনি নিষ্ঠুর। অল্প কিছুদিন আগেও ছেলেকে দেখে গর্বে বুক ওর ভরে উঠতো, ভাবতো, দেশকে বুঝি এক মহামূল্য অর্থ উপহার দিয়েছে। যে শহরে ও নিজে জন্মেছে, যে শহরে জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠেছে ওর নিজের ছেলে, সেই শহরবাসীর কাছে মার মনে হতো ও বুঝি এক কল্যাণময় শক্তি। অগণন অদৃশ্য বন্ধনে ওর হৃদয় এই প্রাচীন পাথরগুলোর সঙ্গে বাঁধা—এই পাথর দিয়েই ওর পূর্বপুরুষেবা একদিন সৌধ তুলেছে, নগর-প্রাচীর গেঁথেছে। যে মাটিতে জড়িয়ে রয়েছে ওর আত্নীয়পরিজনের অস্থি, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা গান আর লোকগাথা। আজকাল ওর হৃদয় প্রিয়জনকে হারানো ব্যথায় অশ্রুসজল। মনে মনে হৃদয়ের তুলাদণ্ডে ও যাচাই করে দেখতো কোনটের ওজন বেশি, পুত্রের জন্যে দেশের জন্যে ওর ভালোবাসা। কিন্তু কোনটের ওজন বেশি ও বুঝতে পারতো না।

তাই এমনিভাবে রাতের পর রাত ও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো। যারা চিনতে পারতো না, অনেকেই ওকে মূর্তিমতী মৃত্যুর কালো ছায়া ভেবে ভয়ে ছিটকে সরে আসতো, কেননা মৃত্যু ঘুরতো ওদের ঠিক আশেপাশেই। আর যারা চিনতে পারতো, নিঃশব্দে সরে যেতো বেইমানের মার কাছ থেকে।

কিন্তু একদিন নগর-প্রাচীরের নিভৃত এক কোণে ও দেখলো আর একজন নারী একটি মৃতদেহেব পাশে হাঁটু মুড়ে বসে আছে, এত নিস্তব্ধ যে তাকে মাটির ঢিবির মতোই মনে হচ্ছে। নক্ষত্রের দিকে বেদনাতুল মুখখানা তুলে সে নিঃশব্দে প্রার্থনা করছে। প্রাচীরের ওপর শাস্ত্ৰীরা মৃদু স্বরে কথা কইছে, পাথরের গায়ে শব্দ উঠছে ওদের অস্ত্রের।

বেইমানের মা জিজ্ঞেস করলো, “এ কে, তোমার স্বামী ?

না’

‘ভাই ।”

না আমার ছেলে। স্বামী মারা গেছে তেরো দিন আগে। আজ মারা গেলো আমার ছেলে। শোকাতুর মা নিঃশব্দে উঠে দাঁড়িয়ে নম্র স্বরে বললো, 'ম্যাডোনা সবই দেখেছেন, সবই জানেন, ওঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ !’

"কেন ?" প্রথম নারী জিগেস করলো ।

দ্বিতীয় নারী বললে, ‘আজ ও দেশের জন্যে সসন্মাণে যুদ্ধ করে প্রাণ দিযেছে। একদিন ওর জন্যে আমার শঙ্কার অন্ত ছিলো না, কেননা ও ছিলো বড় হালকা প্রকৃতির। আমোদ-স্ফূর্তি করতে ভালোবাসতো। ভয় হতো ও বুঝি দেশের প্ৰতি বেইমানি করবে, যেমন করেছে মারিয়ানার ছেলে। সে হলে ঈশ্বরের শত্রু, মানুষের শত্রু, আমাদের শত্রুপক্ষের নেতা। অভিশাপ লাগুক তার, আর যে তাকে পেটে ধরেছে সেই মার।’

মুখ ঢেকে মারিয়ানা চলে এলে৷ পরের দিন-দুপুরে নগর-রক্ষকদেব কাছে গিয়ে ও বললো, আমার ছেলে তোমাদের শত্রু। হয় আমাকে মেরে ফ্যালো, না হয় তো ফটক খুলে দাও যাতে আমি ওর কাছে যেতে পারি।’

ওরা জবাব দিলো, ‘তুমি মানুষ, তোমার কাছে তোমার দেশ নিশ্চয়ই অনেক বড়। তোমার ছেলে যেমন আমাদের সবার শক্র, তেমনি তোমারও শক্ৰ ।”

‘আমি ওর মা, ওকে ভালোবাসি। তবু ও যা করেছে তার জন্যে আমিও দোষী।”

ওরা পরস্পরে পরামর্শ করে নিয়ে বললো,'ছেলের পাপের জন্যে তোমাকে হত্যা করা সম্মানের হবে না। আমরা জানি এই জঘন্য অপরাধ করার জন্যে তুমি তোমার ছেলেকে পাঠাওনি, আমরা তোমার যন্ত্রণা বুঝতে পারছি। কিন্তু এ শহরে তোমাকে আর ধরে রেখে লাভ নেই, কেননা তোমার ছেলে তোমার জন্যে আদৌ উদ্বিগ্ন নয়। ওটা একটা আস্ত শয়তান, হয়তো তোমার কথা ও সম্পূর্ণ ভুলেই গ্যাছে। আমাদের ধারণা এইটেই তোমার যোগ্য শাস্তি, মৃত্যুর চাইতে যা আরও ভয়াবহ।

"হ্যাঁ, সত্যি, বিষণ্ন স্বরে মা বললো। ‘মৃত্যুর চাইতে এ আরও ভয়ঙ্কর।’

সুতরাং ফটক খুলে ওরা ওকে নগর ছেডে চলে যেতে দিলো। প্রাকারের ওপর থেকে ওরা দেখলো ওর ছেলেরই রক্তে স্নাত স্বদেশভূমি ছেডে যেতে ওর পা যেন সরছে না, খুব ধীরে ধীরে হাঁটছে। নগর রক্ষা করতে গিয়ে যারা মারা গ্যাছে  সেইসব মৃতদেহ লক্ষ্য করে মাথা ওর নত হয়ে গেলো, ভাঙা একটা হাতিয়ার লাথি মেরে সরিয়ে দিলো দূরে, কেননা জীবন রক্ষা ছাড়া আর সব হাতিয়ারই মায়েদের কাছে ঘৃণ্য।

ও এমন ভাবে হাটছে যেন বোরখার নিচে পবিত্র একটা জলের পাত্র বহন করে নিয়ে চলেছে, যাতে একটা ফোঁটাও না ছলকে পড়ে। নগর-প্রাকার থেকে যারা ওকে লক্ষ্য করছিলো তারা ওর মূর্তিটাকে ছোটাে থেকে আরও ছোটাে হয়ে যেতে দেখলো এবং তাদের হতাশা ও নৈরাশ্যও যেন ক্রমশ মিলিয়ে আসতে লাগলো। তারা দেখলো মাঝ-পথ পর্যন্ত গিয়ে মা থমকে দাড়ালো, তারপর মাথার অবগুণ্ঠনটা পেছনে ঠেলে দিয়ে বহুক্ষণ নগরের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো। আর শত্রুশিবিরের লোকজনরা দেখলো মাঠের মধ্যে ও একা দাঁডিয়ে রয়েছে। নিঃশব্দ পায়ে কয়েকটা ছায়ামূর্তি ওর দিকে এগিয়ে এসে ও কে, কি জন্যে এসেছে, এই সব বৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করলো।

মা বললো, “তোমাদের অধিনায়ক আমার ছেলে ।”

সৈন্যদের কেউ তা অবিশ্বাস করলো না। বরং তারা ওকে ঘিরে ছেলের প্রশংসা করলো, বললো যেমন দুঃসাহসী, তেমনি বুদ্ধিমান তিনি। মা একটুও ৰিস্মিত হলো না, সগর্বে মাথা তুলে সব শুনলো, কেননা ওর ছেলে এ ছাড়া আর অন্য কিছুই হতে পারে না। -

অবশেষে মা গিয়ে দাঁডালো তার ছেলের সামনে, যাকে ও চেনে জন্মের ন মাস আগে থেকে, যাকে ও নিজের হৃদয় থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন করতে পারে নি। রেশম আর মখমলের পোশাক পরে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওর সামনে, দুর্লভ রত্নে শোভিত তার অস্ত্রশস্ত্র। ঠিক যেমনটি মা তাকে বহুবার দেখেছে স্বপ্নে— তেমনি ঐশ্বৰ্ধশালী, গর্বিত আর সুন্দর। -

মায়ের হাত চুম্বন করে সে বললো, 'মা, তুমি এসে গ্যাছো! ব্যাস, আর কোন ভাবনা নেই। কালই আমি ওই অভিশপ্ত শহরটাকে অধিকার করছি।"

মা স্মরণ কৱিয়ে দিলো, 'যে শহরে তুই জন্মেছিস'?

শক্তির দম্ভে মাতাল, গৌরবের আশায় উন্মাদ হয়ে সে যৌবনের উদ্ধত স্পর্ধায় জবাব দিলো, “আমি জন্মেছি দুনিয়ার বুকে, এই দুনিয়ারই জন্যে, আর আমি চাই আমাকে দেখে তামাম দুনিয়া বিস্ময়ে কাঁপুক! এতদিন এ শহরটাকে আমি কিছু করতে পারিনি, সে শুধু তোমার জন্যেই। এ যেন আমার বুকে কাঁটার মত বিঁধে রয়েছে, মনে করে দিয়েছে আমার গৌরবের দীপ্তি। কিন্তু কালই আমি তাকে ধুলোয় গুড়িয়ে দেবো।

"সেখানের প্রতিটা পাথর তোকে ছেলেবেলা থেকে জানে, তোকে চেনে ৷”

‘পাথর তো বোবা মা, মানুষই তাদের কথা বলায় ! পাহাড়েরাও আমার কথা বলুক, আমি শুধু তাই চাই।'

“আর মানুষের কি হবে " মা জিজ্ঞেস করলো।

‘নিশ্চয়ই, তাদের কথাও ভুলিনি। মানুষের স্মৃতিতেই তো বীরেরা অমর হয়ে থাকে।” ‘

'বীর সেই, মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবনকে যে সৃষ্টি করে, মৃত্যুকে যে জয় করে।’

'না '? সে প্রতিবাদ করে উঠলো। ‘নগর-স্রষ্টার মতো নগর-বিধ্বংসীরাও সমান গৌরবদীপ্ত। রোম কে গড়েছে—আয়েনিয়াস না রোমুলাস, তা আমরা জানি না। কিন্তু রোমকে যারা ধ্বংস করেছে সেই আলারিক আর অন্যান্য বীরদের নাম আমরা খুব ভালো করেই জানি।'

'তবু সব নামকে ছাপিয়ে বেঁচে আছে শুধু রোম'।

এইভাবে সূর্যাস্ত পর্যন্ত চললো দুজনের কথা কাটাকাটি। ছেলের উদ্ধত যুক্তির প্রতিবাদে ক্রমশই নত হয়ে এলো মায়ের মাথা। মার কাজ সৃষ্টি করা, তাকে রক্ষা করা। ধ্বংসের কথা বলা মানেই মায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা । কিন্তু ছেলে সে কথা জানে না, জানে না যে এতে মায়ের অস্তিত্বকেই সে অস্বীকার করছে।

মা চিরদিনই মৃত্যুর প্রতিবাদী। যে হাত মানুষের মৃত্যুকে টেনে আনে মা তাকে ঘৃণা করে। কিন্তু ছেলে সেটা বুঝলো না, কেননা হৃদয়কে যা নিম্প্রাণ করে দেয় তারই হিমেল গৌরব  দীপ্তিতে সে তখন অন্ধ।

সে জানতো না মা্র সৃষ্ট জীবন বিপন্ন হলে সেই মা-ই কি ভীষণ চতুর, নির্মম, আর নিভীক হয়ে উঠতে পারে।

মাথা নত করে মা বসে রইলো, আর সুসজ্জিত তাবুর ফাঁক দিয়ে দেখলো সেই শহরটাকে,যেখানে ও তার বুকের মধ্যে প্রথম অনুভব করেছিলো জীবনের মধুর স্পন্দন, অনুভব করেছিলো সেই সন্তানের প্রসব যন্ত্রণ, যে কিনা আজ ধ্বংসের নেশায় মাতাল ।

সূর্যাস্তের রাঙা আলোয় রঙিন হয়ে উঠেছে শহরের যত ভগ্ন প্রাচীর আর মিনারগুলো, জানলার সার্শিগুলো জলছে ক্রুদ্ধ দীপ্তিতে, যেন প্রতিটা ক্ষতমুখ থেকে ঝরে পড়ছে রক্তিম জীবনরস। দেখতে দেখতে সারাটি শহর মৃতদেহের মতো কালো হয়ে গেলো, সমাধি-দ্বীপের মতো আকাশে জলে উঠলো টপটপ কয়েকটা তারা।

মা দেখতে পেলো সেই অন্ধকার বাডিগুলো, সেখানে শত্ৰুর দৃষ্টির আকর্ষণের ভয়ে লোকে বাতি জ্বলতে সাহস পায় না। শবদেহেব দুর্গন্ধে ভরা রাস্তাগুলো গভীর অন্ধকারে মোডা। শোনা গেলো মৃত্যুর প্রতীক্ষান্মুখ মানুষের মৃদু গুঞ্জরণ। এ সবকিছুই মার কাছে অত্যন্ত প্রিয় আর পরিচিত মনে হলো, মনে হলো ও যেন এ শহরে সবার মা, আর সবকিছুই যেন ওর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় নির্বাক হয়ে প্রতীক্ষা করছে।

অন্ধকার পাহাডি চূড়া থেকে নেমে মেঘগুলো ছড়িয়ে পড়ছে উপত্যকার বুকে, যেন একপাল পক্ষীরাজ ঘোড়া পদদলিত করছে অভিশপ্ত শহরটাকে।

‘রাতটা গাঢ় আঁধারে ঢাকা থাকলে আজ রাতেও আমরা আক্রমণ করতে পারি ! চোখে রোদ পড়লে অস্ত্ৰের ঝলকানিতে অনেক সময় হত্যা করতে খুব অসুবিধে হয়'। তবে তলোয়ারটা পরীক্ষা করতে করতে ছেলে মন্তব্য করলো।

মা বললো, “আয় সোনা, আমাৰ বুকে মাথা রেখে একটু শো। মনে পডে ছেলেবেলায় তুই কি উচ্ছ্বল আর সুন্দর ছিলিস, সবাই তোকে কেমন ভালেবাসতো-

‘আমি ভালোবাসি শুধু গৌবর।" মা্র কোলে মাথা রেখে চোখ বুজিয়ে সে বললো, ‘আর ভালোবাসি তোমাকে,কেননা আমি যা হয়েছি সে শুধু তোমার জন্যেI"

‘আর মেয়েদের ভালোবাসিস না তুই'? ছেলের ওপর ঝুঁকে পড়ে মা জিজ্ঞেস করলো ।

'ওরা সংখ্যায় অনেক, বড্ড বেশি ক্লান্তি লাগে, মা ।”

‘আর সন্তান চাস না তুই'?

“কি হবে সন্তান দিয়ে? শেষ পর্যন্ত আমারই মতো কেউ এসে তাদের খুন করবে। তাতে আমার ব্যথা লাগবে। হয়তো তখন এমন বৃদ্ধ আর ভঙ্গুর হয়ে পডবো যে প্রতিশোধও নিতে পাৱবো না।”

মা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

‘সুন্দর দেখতে হলেও তুই বিদ্যুত চমকের মতোই ব্যর্থ।”

‘হ্যা, আমি ঠিক বিদ্যুত চমকেরই মতো...”

ছেলে মৃদ্ধ হেসে জবাব দিলো, তারপর মার কোলে ছোট্ট শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়লো।

নিজের কালো পোশাক দিয়ে ছেলেকে ঢেকে দিয়ে মা তার বুকে ছোরাখান বসিয়ে দিলো। দু একবার ধবধব করে কেঁপে উঠে ছেলে মারা গেলো। ছেলের বুকের কোথায় ধুকপুক করেছিলো মার চাইতে বেশি আর কেউ জানে না। তারপর স্তম্ভিত প্রহরীদের পায়ের কাছে মৃত দেহখানা ফেলে দিয়ে নগরের দিকে তাকিয়ে মা বললো,"মানুষ হিসেবে দেশের জন্যে যা করার ছিলো আমি তা করেছি, কিন্তু মা হিসেবে আমার সত্ত্বা ছেলের সঙ্গে জডিত। আর একটি সন্তানের মা হবার বয়স যখন আর নেই তখন কারুর কাছে আমার জীবনের আর কোন মূল্যও নেই।"

ছেলের রক্তে তখনও উষ্ণ ছোরাখানা মা দৃঢ় হাতে বসিয়ে দিলো নিজের বুকে। এবারেও লক্ষ্য ভ্ৰষ্ট হলো না, কেননা ব্যথিত হৃদয়টা ও খুব সহজেই খুঁজে পেয়েছিলো।

১৯০৬-১৩

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ