বয়স কম হয় নি। ঘন চুলগুলো একটা-দুইটা করে উঠতে উঠতে এখন প্রায় চাঁদি দেখা যায়। হঠাৎ দু-একটা পাকা চুল শিকল ছেড়া বানরের মতো গাছের মগ ডালে বসে দাঁত খেচিয়ে হাসে। অশ্লীল রকম হাসে। আমি আঁতকে উঠি। সেলুনে বিস্তর সময় চলে যায়।
এমন অনেক কিছুই আছে, যা আমি সত্যিই মনে প্রাণে চাই—যেন না হয়। তবুও হয়। যেমন মায়ের সাথে কথা বলার সময় তাঁর কণ্ঠের উষ্মা। আমি আশা করি তা যেন শূণ্যের কোঠায় নেমে না আসে। তিনি যেন আমার অবস্থার কথা জিজ্ঞেস না করেন।
তাহলেই খুব ভ্যাগাচ্যাগা খেয়ে যাই। তারপরও আজকাল ফোন করলে মা কী যেন অযাচিত ভয় জড়ানো কণ্ঠে কথা বলেন, বাড়ি যেতে বলেন এবং বিয়ের তাড়া দেন। আমি জানি বিয়ের বয়স আমার অনেক আগেই হয়েছে। কিন্তু ছোট বোনটার একটা ব্যবস্থা না করে নিজে বিয়ে করি কী করে—এ দায়িত্ব বোধ আমার আছে। তার আগে ঘর-দোর কিছুটা হলেও ঠিক করার ব্যাপার আছে।
কিন্তু আমার যা বেতন, তা দিয়ে ঘরে কাজে হাত দেয়া তো ছাড়, ষোলটা খুঁটির গোড়ায় মাটি দেয়াও সম্ভব হবে না। হয়তো এ কারণেই ইদানিং আমার বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহের ভাটা পড়েছে। মা কার কাছে যেন কী শুনেন, হয়তো শুনেছেন—ছেলেকে বিয়ে করান হয় না বলেই হয়তো বাড়ির প্রতি টান নেই। তিনি প্রায়ই বলেন,‘তুই বাড়ি আহোস না ক্যা, বাড়ি আয়, আমরা তো বুঝি।’ আগেই বলেছি বাড়ি গিয়ে ওই রকম একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে খুব অস্বস্থি লাগে। আর যেতেও তো টাকা কম লাগে না! পথে ঝক্কি ঝামেলা তো আছেই। তাই মাসে মাসে বাড়ি যাওয়ার চেয়ে কোনোভাবে টাকাটা পাঠিয়ে দিলেই হয়। কখনো কখনো এর পেছনে অদ্ভূত যুক্তিও খুঁজে পাই। আর যে পর্যন্ত বোনটার বিয়ে না দিচ্ছি সে পর্যন্ত ওকে স্কুলে রাখতেই হচ্ছে। এনজিও’র কিস্তি দেয়ার মতো বাড়ি খরচ বাদেও বোনের পড়ার খরচ দিতে হয়, আলাদা করে। নয়তো বাব-মা অন্য কাজে লাগিয়ে ফেলবেন। তারপরও মায়ের কাতর কণ্ঠে এমন অনুরোধে আমি সত্যি অস্বস্থিতে ভুগি, অস্তিত্বে টান পড়ে, চাকুরি নিয়ে উদ্বিগ্ন হই। আমি কি করে বোঝাই যে, চাকুরিতে একটা ভাল অবস্থা না হলে বিয়ে করা যায় না। তাতে অশান্তি বাড়ে। এমন তো কতই দেখছি চারপাশে। তাছাড়া পরিবারের সবাইকে আপন করে নেবে, বিয়ের আগে এই ভারমুক্ত করবে কে? এসব কথা ভাবতে ভাবতে আবার ডুব মেরে যাই। আশা করি, তারা তা ভুলে যাবেন এবং দ্রুতই প্রমোশনটা হয়ে যাবে। তাহলে অনেক প্রশ্নের উত্তর এমনিতেই হয়ে যাবে।
আমি যেখানে কাজ করি, তা একটা কোম্পানির সিস্টার কনসার্ন। আগে ছিলাম ব্রাঞ্চ অফিসে, এখন সাব-অফিসে আছি, তাও প্রায় বছর খানেক। সব মিলিয়ে একই প্রতিষ্ঠানে প্রায় পাঁচ বছর। সে হিসেবে আমার প্রমোশনের কথা আরো তিন বছর আগে। প্রথম দুই বছর ‘ইয়ার ইন্ডিং’ সেলারি সামান্য ইনক্রিমেন্ট হত, এখন তাও বন্ধ। প্রমোশনের কোনো নামই নেই। আগামীতেও যে হবে, তার কোনো লক্ষ্মণ দেখছি না। ইদানিং এসব নিয়ে বসের সাথে চাপা রেশারেশি চলছে। তার একটা ভাল রিকমেন্ডেশন পেলেই তো হেড অফিসে চলে যেতে পারি। সাব-অফিস লাগোয়া কাঁচ বহুল এগার তলা ভবনটাই হেড অফিস। প্রতিদিন অফিসে ঢুকতে হেড অফিসের কফি কালার কাঁচে প্রতিফলিত আলো আমার পথের দিশা ঝাপসা করে দেয়। তার মধ্যে কোনো প্রশ্রয় নেই, নিপাট তাচ্ছিল্য ছাড়া। আমি খুঁজে পেয়েছি, প্রমোশন না হওয়ারও একটা কারণ আছে। ইতালিয় গোয়েন্দা বিভাগ একটা কথা বলে, ‘শে সে লেফা’; অর্থাৎ খুঁজে দেখ পাবে। মানে খুঁজে দেখ, সব কিছুতেই কোনো না কোনো নারী জড়িত। এখানেও তাই মনে হয়।
আজকাল অযাচিতভাবে নানা দিকে চোখ যায়। বিশেষত যুবতীদের দিকে। এজন্য বার-কয়েক নিজে নিজে লজ্জাও পেয়েছি। রাস্তার মেয়ে থেকে শুরু করে গাড়ির আধ-উঠা রঙিন কাঁচে আড়ে উঁকি দেয়া দুলালী, ময়লার বালতি হতে নামা উপর তলার নারী, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছাত্রী, বাসে নির্ধারিত আসনের নারী, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারতে থাকা স্কিন পোশাক পরা মেয়ে, মার্কেট পাড়ায় মহিলাদের ভিড়—সব, সবখানে আমার চোখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। এমন কি রিকশায় চুম্বন বিগলিত যুবক-যুবতী দেখলে প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়ি। হয়তো তখন নচ্ছার ছোকরাটা একটা হাত পেছন দিয়ে এনে মেয়েটির স্তন যা-ইচ্ছে-তাই কচলে যাচ্ছে, তবুও। আমার শরীর কটকট করে ওঠে। যেন মেহগুনির পাকা ফল চরচর করে ফেঁটে যাচ্ছে চৈত্রের টানে। তারপর তাপোদ্দীপ্ত বাতাসে শুনশান দুপুরে একটা একটা করে খসে পড়ছে নিচে। বাতাসে ঘুরে ঘুরে পড়ছে বৃন্ত খসা বীজগুলো। দীর্ঘ সময় ধরে পড়ছে। তাকে দমনের করতে হয়। এমন কি অফিসের কোনো পুরুষ কলিগের সাথে কোনো নারী কলিগের অতিমাত্রায় মেলা মেশা দেখলেও মেজাজ একদম তাঁতিয়ে উঠে। মনে মনে খিস্তি আওড়াই।
অফিসের রিসেপশনিস্ট মেয়ের বিষয়টাও আমার চোখে পড়ছে। নাম নিতা। প্রতিদিনের কাজ শেষে বের হওয়ার সময় দেখি, সে ডেস্কে বসে আছে। নিঃশ্চল ভাবে পেপার ওয়েট, কলম বা মোবাইলটা কাঁচের উপর অহেতুক ঘোরাচ্ছে। অফিসে এখন জুন ক্লোজিং। কাগজপত্র রেডি করতে একটু দেরি হয়েই যায়। অফিস তখন একদম ফাঁকা। ‘কি, তুমি এখনো আছো!’ বললে সে যেন চমকে উঠে। থরবরিয়ে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে—‘না স্যার, মানে স্যার’, সে তখন আরো কিছুক্ষণ ধরে আমতা আমতা করে। ‘যাবো স্যার, জিএম স্যার গেলেই যাবো।’ অস্বচ্ছ কাঁচে ঘেরা জিএম কাদের সাহেবের রুম। রুমের ভেতরে আলোটা ম্লান, টেবিলের উপর খ খ করে একটা ল্যাম্প জ্বলছে। ধূর্ত আলোর সুরম্য রুম দেখে আমার পিত্ত পর্যন্ত জ্বলে উঠে। আমি দ্রুত সেখান থেকে চলে আসি। তারপর সে আর কত ক্ষণ থাকে তা জানি না।
একদিন দেখি সে ডেস্কে মাথা ঠেকিয়ে ফোঁস ফোঁস করে কাঁদছে। তখনো অফিসে কেউ নেই। আমার ভেতরে সন্দেহ কাজ করলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম—‘কি হয়েছে নিতা?’ নিতা এমনিতে চাপা স্বভাবের মেয়ে। সারক্ষণ চুপচাপ, মন মরা মতো। সেদিন রাখ-ঢাক না করে বলল—“স্যার, আমার মা অসুস্থ, জি এম স্যারকে বললাম, আজ একটু আগে ছুটি দিতে। স্যার বলল—‘আমি ব্রাঞ্চ অফিস থেকে এসে নিই।’ স্যার এখনো ব্রাঞ্চ অফিসে। প্রতিদিন এইভাবে দেরি করতে ভাল লাগে?”
জিএম স্যারের স্বভাব আমি জানি। বদমাশটার নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলব আছে। ও ব্যাটা ইতর বিশেষ কিছু নয়। ফস্টি-নস্টি করতে তার বাঁধে না। ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’—আমি দূরাজ্ঞেয় ভাবে ওকে চলে যেতে বললাম। কিন্তু ও গেল না। পরদিন কাদের সাহেবের সাথে নানা বিষয়ে কথা বলার সময় নিতার কথা তুললাম। কাদের সাহেব খুব ঝানু মানুষ। তিনি বিষয়টা একটু কৌশলে এড়িয়ে গেলেন।
তারপর আমি বিষয়টা ভুলেই গিয়ে ছিলাম। একদিন নিতা এসে আমার টেবিলের পাশে দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই রইল। ওর দিকে জিজ্ঞাসু চোখ ফেরাতেই আগবাড়ানো লাউয়ের ডগার মতো দুলতে দুলতে বলল—‘স্যার, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার।’ আমার চোখে তখন খানিক বিস্ময়। ও বলে যায়—‘আপনি স্যার, জিএম স্যারের কাছে বলেছিলেন। আমি স্যার, আপনার প্রতি স্যার, অনেক অনেক কৃতজ্ঞ স্যার।’ আন্তরিকতার সামান্য ফাঁকফোঁকরটুকুও যেন ও ‘স্যার স্যার’ শব্দের ভেতর দিয়ে ভরে তুলতে চাইছিল। তখনো আমার মাথায় বিষয়টা ছিল না। আমি ওর দিকে আন্তরিক ভাবে তাকালাম। হঠাৎ সেদিনের ঘটনা মনে পড়ল। ‘না না, এতে কৃতজ্ঞতার কী আছে। আমি তো শুধু বলেছি। তা তোমার মা এখন কেমন আছেন?’—আমি ততোধিক আন্তরিকতা ও লাজুক তৃপ্তির সাথে কথাটা বললাম। ও আমার আন্তরিকতায় একেবারে বিগলিত। মনে হল, চোখে কৃতজ্ঞতা আর তৃপ্তির জল। যেন এই জগৎ সংসারে হিতৈষি ও ভাল মানুষ সে আমাকেই পেয়েছে।
‘মা?’ প্রশ্ন বোধক ভাবেই শুরু করলো, ‘স্যার, ভাল আছে, স্যার।’ শেষের কথাটুকু মিইয়ে যাওয়া স্বরে বললো। ‘আপনাকে কি স্যার কফি দিতে বলবো?’ তাৎক্ষণাৎ নিজেকে গুছিয়ে নিল সে। আমি সম্মতির লাজুক হাসি হাসলাম। আর মেয়েটার অবস্থার কথা ভাবতে লাগলাম। কখনো তেমন আলাপ হয় নি। তবে শিক্ষিতা মনে হয়। তারচেয়েও বড় কথা সে চাকুরি করে বাবা-মা’কে চালায়। ওর মতো সবটা আমিও পারি না। নিজের দীনতা মনে পড়ে। আন্তরিকতায় আমার মনটা ঝুঁকে পড়তে লাগলো।
দারুণ শীতল স্বভাবের মেয়ে নিতা। খুব শালীন, আজকালকার উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়ে মতো নয়। কিন্তু শরীরে উচ্চকিত যৌবন সে কোনো ভাবেই সবটা আড়াল করতে পারে না। এ জন্য ওকে নিয়ে জুনিয়রদের মধ্যে একধরনের মাতামাতি আছে। সামান্য কাজেও সবাই ওকে ডেকে পাঠায়। কী সব ইঙ্গিত করে করে কথা বলে। মেয়েটা চুপচাপ শুনে যায়। কিচ্ছুটি বলে না। আমি অস্বস্থি বোধ করি। ইন হাউজ—কখনো গলায় শব্দ করে খাকনি দেই। কখনো খেপে গিয়ে নিতাকে বলি—‘তোমাকে ওরা যে সব মন্তব্য করে, তুমি কিছু বল না কেন?’
তার কণ্ঠে স্পষ্টত অসহায় ভাব—‘কি করবো স্যার, অফিস তো এরকমই। গায়ে না মাখলেই হয়।’ ওর কথা শুনে, গোস্বায় আমার গায়ে জ্বালা ধরে যায়।
নিতা আজকাল আমার ডেস্কেও আসে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, অপেক্ষা করে কখন আমার হাতের কাজ শেষ হয়। তারপর ঘাড় ও কণ্ঠ দুই-ই একটু নামিয়ে বলবে—স্যার, হেড অফিস থেকে আপনার নামে এই ফাইল এসেছে। কিংবা বলবে—স্যার, এক কাপ কফি দেব? আমি মনে মনে যখন সত্যি কফি আশা করছিলাম। এমন অনেক কিছুই সে কি করে যেন বুঝে ফেলে। ইদানিং আমার প্রতি সামান্য টেক-কেয়ার চোখে পড়ে। আমি দারুন উৎফুল্ল বোধ করি, কিন্তু সতর্কভাবে। কারণ এটা অফিস, তা কখনোই ভুলে যাই না। আমার মনে হয় মেয়েটার যোগ্যতা আছে আরো বড় পোস্টে কাজ করার, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না।
আমি তো আর অন্যদের মতো না। গায়ে পড়ে কথা বলবো। তাই নিতার সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার পথ খুঁজি। একদিন হাতে পাঁচশ’ টাকা দিয়ে বলি—‘তোমার মা’কে ফল কিনে দিও।’ ও নিতে চায় না। আমিই জোর করি। একধরনের দায়িত্ব জ্ঞান দেখাই। এভাবে একদিন ওর সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার সুযোগ পেয়েও যাই।
এমনিতেই শহরে পাবলিক বাসের সংকট। তার উপর হরতাল বা একটু বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। সেদিন বৃষ্টিই একরকম হরতাল ডেকে বসে ছিল। সারা দিন ভর বৃষ্টি। আমাদের অফিসের সামনের গলি দিয়ে নৌকা চলার উপক্রম। তার সাথে মিশেছে ম্যান হোল থেকে উঠা নর্দমার পানি। একেবারে যা-তা অবস্থা। আমি অপেক্ষা করছিলাম বৃষ্টিটা পুরোপুরি থামুক। রাস্তার পানিটাও সরে যাক। অফিসের অন্যান্যরা যে যার মতো গলিতে আসা রিক্সায় করে পার হচ্ছিল। মেয়েটাকে দেখলাম অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। জুনিয়রদের কেউ কেউ দেখলাম ওকে তাদের রিক্সায় তুলতে চাইছিল। কিন্তু মেয়েটা ভীতুর মতো দাঁড়িয়েই রইল। আমি এসে কোনো রিক্সা পেলাম না। এটা মালটানা ভ্যান কোথায় থেকে যেন ফিরছিল। আমি অনুরোধ করায় রাজি হলো। আমি ভ্যানের উঠে চলতে শুরু করার মুহুর্তেও দেখলাম, মেয়েটা অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে—কী করে এই অকূল সাগর পাড়ি দিবে। আমি তাকে ভ্যানে উঠতে বললাম। কি যেন সাত-পাঁচ ভেবে উঠল। কিন্তু পানিতে ডোবা খানাখন্দর রাস্তায় ভ্যানের পৃষ্টে দাঁড়িয়ে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। ওর অবস্থা বেগতিক দেখে আমি হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। ও আমার হাত ধরল, আলতো আর নির্ভরতার সাথে। রাস্তার ঝাকুনিতে গা ঠুকাঠুকি হচ্ছিল আমাদের। আমি নিজেকে আরেকটু উদার করে দেই। মেয়েটাকে সামলাতে সামলাতে নিজেই বেসামাল হয়ে পড়ছিলাম। মেইন রাস্তায় তেমন যান-বাহন ছিল না। যাও ছিল তিন—চারগুণ ভাড়া হাকিয়ে যাচ্ছে। বুঝছিলাম, নিতার পক্ষে এত ভাড়া বহন করা সহজ নয়। তারপরও সে উপর্যুপরি ভাড়ায় অটো নিতে চেষ্টা করে মান বাঁচানো আর অনন্যোপায় হয়েই। শেষে আমরা একই অটোতে উঠলাম। ওর বাসা আমার বাসা ছাড়িয়ে, অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ার এলাকা। সেদিনের এক সাথে আসা, পথের কথাবার্তা, ঝাকুনি, গায়ে গায়ে ঠেস-আমাকে ঘুমাতে দিল না। আমি এক অদ্ভুত উত্তেজনায় ভুগলাম সারা রাত। তারপর থেকেই ওর প্রতি আমার দৃষ্টি ভঙ্গি পাল্টে গেল।
ইদানিং আমরা একসাথে বের হই। আসি এক অটোতে। ও যেহেতু রিসিপশনে কাজ করে তাই একটু আগেই যেতে হয়। একটু কষ্ট হলেও যাওয়ার সময়টা মিলিয়ে নিয়েছি। অটোতে আকাশ-পাতাল কথা-বার্তা, হাতাহাতি, ওর একটু আদর আমাকে পৃথিবীর সেরা আনন্দটি দেয়। চারপাশের সব গুমোট অবস্থা ভুলিয়ে রাখে। একটু প্রশ্রয় পেলেই আমি ওকে এলোমেলো করে দেই। কখনো ওর ঠোঁটে দীর্ঘ চুম্বন এঁকে সেই সুধার সন্ধানই করি, যা পান করে স্বর্গে মানুষ সুদীর্ঘকাল জ্ঞান শূণ্য পড়ে থাকবে। ঠোঁট লম্বা করে ছেড়ে দেই। কখনো নিতা কামোদ্দীপ্ত ভাবে কঁকিয়ে উঠে। প্রতিদিনের এই যাওয়া আসা রীতিমত অভ্যাসে পারিণত হয়েছে আমার। এখন একদিন একসাথে না গেলে উত্তেজনায় ভুগি, বুকটা ভা ভা করে। এমন দিনে হঠাৎ একদিন দেখলাম নিতা উধাও। অফিসে নেই। মুঠোফোনটাও বন্ধ। আমি খুব একাকিত্ব অনুভব করছিলাম। বুঝতে পারছিলাম নিতা প্রতি আমার নির্ভরতা কত গভীর। ওকে আমার কতটা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে আমি মনে মনে ওকে নিয়ে অনেক কিছু ভেবে ফেলেছি। অস্থিরতায় আমার বুক ফেটে যাওয়ার উপক্রম।
পরের দিন জানাল ওর মা খুব অসুস্থ। আমি উদ্বেগ দেখিয়ে ওদের বাড়ি যাওয়ার কথা বললাম,‘আগে বলো নি কেন? আমি তোমার বাসায় যাব।’ কিন্তু সে নিল না। ওর মাতৃভক্তি আমাকে মায়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। যাই হোক, ক্রমেই নিতাকে আমার পরিবার, একান্ত ব্যক্তিগত চাওয়া, ভাললাগা-মন্দলাগা বিষয়ে সচেতন করে তুলছি। ও এসবের মানে বুঝত কি না জানি না। তবে কেমন উদাস আর চিন্তিত থাকত। যেন রাষ্ট্র পরিচালনার ভার বর্তেছে আর কি।
ইতিমধ্যে অফিসেও আমাদের বিষয়টা দৃষ্টি গোচর হয়েছে। একদিন লাঞ্চ আওয়ারে দেখলাম, কাদের সাহেব তার রুমে ডেকে নিয়ে নিতাকে শাসাচ্ছে, প্রতিদিনের কাগজপত্র অফিস শেষে সম্পন্ন না করার জন্য, যেমনটা ও আগে করত। তারপর একদিন নিতা-ই আমার কথায় সায় দিল। ও গাটছাট বাঁধতে চায়। আমি যেন জীবনে নোঙ্গর খুঁজে পেলাম। তারপর থেকে ওর সাথে আমি অনেক কিছুই করতাম একধরনের অধিকার বোধ থেকে। কখনো ওর মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা দিতাম। তারপরও ওকে প্রায়শ বিহবল দেখাত।
কিছুদিন যাবৎ নিতা কেমন যেন অস্থিরতার ভুগছে। অফিসে আসা-যাওয়ার টাইম-টেবল ঠিক থাকে না। মাঝে মাঝে অফিসেও আসে না। এদিকে কাদের সাহেব দেখি আমাদের রুমে কয়েক চক্কর ঘুরে যায়। এর কারণ কী?—নিতা শুধু বলে ফ্যামিলি ক্রাইসিস চলছে। গুরুত্ব দিয়ে বলি—তার সাথে আমার কথা আছে। সে এড়াতে চায়। আমি তাকে আমার ফ্ল্যাটে যেতে বলি। সে অফিস বন্ধের দিনে দেখা করতে বলে। আমি ভাবি, সে আর বিশেষ কি? তারপর দিনও ঠিক হলো।
কিন্তু লেক পাড়ে বসে নিতার কথায় আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। ‘আমি একজন পরিত্যক্তা’ একটু দম নিয়ে আবার শুরু করে, ‘আসলে আমার তিন বছরের একটা মেয়ে আছে, জন্মের পর থেকেই ও অসুস্থ। অফিসের সবাই তা জানে। তাই সবাই আমার সাথে অমন করে। শুধু তুমি জানো না।’ একটু থামে নিতা। ও কাঁদছে। এক হাতে আরেক হাতের তালু ঘষে আর বলে, ‘জীবনে আমি অনেক ঠকেছি, কিন্তু তোমাকে ঠকাতে পারবো না। তাই....’ আমি বাকি কথাগুলো আর শুনি নি। ঘর পোড়া খুঁটির মতো অসাড় পড়ে আছি। সারা রাত ঘুম হলো না আমার। নিতার বিষয়ে যে আমি সন্দেহাতীত ছিলাম না, সে প্রসঙ্গটা আর মনে এলো না। মনে হলো সত্যি ও আমাকে ঠকিয়েছে। এই শহরটাই দারুন প্রতারক আর ঠক। নিজের সাথে দ্বন্দ্ব করে আর পারছিলাম না। পরদিন অফিসে গিয়ে প্রথমেই একটা মেডিকেল লিভের এ্যাপ্লিকেশন জিএম কাদের সাহেবের টেবিলে জমা দিয়ে সাত দিনের জন্য গ্রামে চলে এলাম।
কিন্তু গ্রামে এসেও আমি এক মুহুর্তের জন্য স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। সারাক্ষণ শূন্য মাঠের দিকে তাকিয়ে সময় কাটে। মনের ভেতরেও তেমন শূন্যতা আর কষ্ট অনুভব করি। বিশেষ করে সন্ধ্যায়, যখন আমরা অফিস থেকে ফিরতাম, এ মুহুর্তটা মর্মে মর্মে বাজে। অমবশ্যা-পূর্ণিমায় বহু দিনের পুরনো ব্যাথা জেগে উঠার মতো। চৈত্রের দুপুরে ঘাস শূন্য মাঠে বাধা ষাড়টা জলের তৃষ্ণায় করুণ হাম্বা বলে উঠে। আর দূরে বাড়ির দিকে, গৃহস্থের দিকে নজর করে। নিজের ভেতরে তেমন একটা গোঁঙরানি অনুভব করি। অসহ্য যন্ত্রণায় হয় উন্মাদ নয় নিস্তব্ধ হয়ে যাবো। বিষয়টা অবধারিতভাবেই বাবা-মা’র চোখে পড়ে। বাবা-মা’র সাথে বিষয়টা খুলে বলি। তাঁরা কয়েক দিন যাবত আমার অবস্থা তো দেখেছেন। কথাটা শোনার পর হতভম্বের মতো তাঁরা একবার পরস্পরের মুখ চাওয়া-চায়ি করেন। বিষয়টা শুনে বাবা-মা’র মনের অবস্থা কি হবে ভেবে এই কয়দিন অস্থির ছিলাম। ‘দেখ,তুই যা ভাল মনে করস’, খানিক ক্ষণ পর অনপেক্ষ ভাবে বলেন তাঁরা। দুঃশ্চিন্তার পারদ আরেকটু নামিয়ে বলেন, ‘তয় আরেকবার ভাইব্যা নিস।’ মনে একটু জোর পেলাম। কিন্তু মাথার ভেতরে একটা চাপ রয়েই গেল। এবার একটা প্রমোশন না হলেই নয়। নয়তো অন্য কোথাও চেষ্টা করতে হবে।
শহরে ফিরতে ফিরতে ভাবি, প্রথমেই নিতাকে বলতে হবে, এখন আর কোনো আপত্তি নেই। শুধু প্রমোশনের জন্য অপেক্ষা। আমি তখনও বুঝি নি, শহরে আমার জন্য আরো বড় চমক অপেক্ষা করছে। ছুটি শেষে অফিসে জয়েন করার পরই দেখলাম, সবাই কেমনভাবে যেন তাকাচ্ছে আমার দিকে। হঠাৎ কাদের সাহেব ডেকে পাঠালেন। হাতে একটা খাম, মুখে বিরক্তি, অবজ্ঞা আর বিজয়ের ছাপ। খামটা ধরিয়ে দিয়ে কালকেই হেড অফিসে জয়েন করতে বললেন। আমার তখন আনন্দে লাফিয়ে উঠার উপক্রম, যাকে বলে—ভাবে সপ্তমী। এক দৌড়ে রিসেপশনে গেলাম। মনে কেমন যেন একটা ফুরফুড়ে ভাব। নিতাকে বলতে, আমাদের আর কোনো সমস্যা নেই, খোদা আমাদের উপর প্রশন্ন হয়েছেন। কিন্তু নিতা সেখানে নেই। একজন সাপোর্ট স্টাফ বসে টেলিফোন অপারেট করছে। মুহুর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে গেলাম, কিন্তু হুল ফোটানো বেলুনের মতো চুপসে গেলাম না।
হেড অফিসে যোগ দেয়ার কয়েক দিনের মধ্যে পুরনো ফ্ল্যাট ছেড়ে দিলাম। নতুন ফ্ল্যাটটা একটু উন্নত এলাকায়। নিতার কথা মাথায় রেখেই ছোট পরিবার থাকার মতো একরুম নিলাম। মনে দারুণ আত্মবিশ্বাস। কিন্তু নিতারই কোনো খোঁজ নেই। এখন আমাকে অফিসের বাসে যাতায়াত করতে হয়। ইচ্ছে করলেই সাব-অফিসে ঢু দেয়া যায় না। তারপরও কয়েক দিন তক্কেতক্কে রইলাম। রিসেপশনে ফোন করেও নিতার সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হলাম। উড়ো খবর শুনলাম, সে এখন কাদের সাহেবের পাইভেট এ্যাসিসটেন্ট। আমি চমকে উঠলাম। কাদের সাহেবদের মতো লোকদের কাছে মহিলা পিএ বলতে শেষ পর্যন্ত কি বোঝায়, তা আর বুঝতে বাকি নেই। ক্রমেই মনের মধ্যে নানা চিন্তা ঘনীভূত হতে শুরু করল। একদিন অফিস শেষে নিতাকে কাদের সাহেবের গাড়িতে বেশ অন্তরঙ্গ ভাবে দেখলাম। আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। ও আমার সাথে এতো বড় প্রতারণা করল! নটি কোথাকার, ওই সন্তানটাও কি তবে? এর জন্য ওকে জবাব দিহিতা করতেই হবে।
আমার সমস্ত ভালবাসা এক নিমিষেই উবে গেল। প্রতিশোধ স্পৃহায় একদম উন্মত্ত হয়ে উঠলাম। চোখের সামনে এখন নিতার শরীর ছাড়া আর কিছুই আসে না। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে একদিন নিতাকে পেয়েও গেলাম, একটা অভিজাত শপিং মলের সামনে। আমাকে দেখেও অপ্রতিভ হলো না ও। নচ্ছার হলে এমনই, কোনো অপরাধবোধ নেই। ও ধীরে আত্মসমর্পণের মতো এগিয়ে এলো। আমি আর এক মুহুর্ত সময় দিতে রাজি নই। ওকে সোজা আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে এলাম। ট্যাক্সিতে বিয়ের প্রসঙ্গ তুললাম। ‘সে আর সম্ভব নয়।’ ম্লান আর ক্লান্তি জড়োনো কণ্ঠে বলল নিতা। ‘তোমার সন্তান নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। এই ফ্ল্যাটটা সে চিন্তা করেই ভাড়া নিয়েছি।’ ক্ষিপ্র ভাষায় আমি বলি। কথাটা শোনার পর নিতা একদম থম ধরে গেল। কি এক অস্বস্থি বোধ থেকে হঠাৎ সে ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু তা কপটতার আশ্রয় ছাড়া কিছুই মনে হলো না। ওর সবকিছুই আমার চোখে অশ্লীল। আমি প্রথমে ওকে দেয়ালের সাথে সেঁটে ধরলাম। সেখান থেকে টানতে টানতে ফ্লোরে পাতা বেডে নিয়ে ফেললাম। এক লহমায় গলায় আটকে থাকা ওড়নার সামান্য প্রান্তটুকু কোথায় ছুড়ে দিলাম তা দেখার অবকাশ ছিল না। হালের বেলাল্লা মেয়েদের মতো জামায় পিঠের দীর্ঘ চেইন করেছে। চেইন টেনে জামাটা খুলতে আমার মুহুর্তটুকুও লাগেনি। নিতা আমার বুকের নিচে নড়াচড়া করছে। ভাবলাম আমার স্পর্শে সে আর নিজেকে স্থির রাখতে পাড়ছে না। বীরত্ব অনুভব করছি। আমার কোনো হিতাহিত জ্ঞান নেই। সবটুকু শক্তি দিয়ে, দুই হাতে, দশ আঙ্গুলে সব কিছু দুমড়ে মুচড়ে দিতে চাইছি। নিতা নিচ থেকে কঁকিয়ে উঠে। বলে, ‘আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি আনন্দ পাচ্ছ?’ এখনো তার ভনিতা যায় না! আমি খেয়াল করে দেখলাম, নিতা কোনো বাধাই দিচ্ছে না। ওর মাথার চুলের কাটা পিঠের নিচে পড়ে মটমট করে ভেঙে যাচ্ছে। নিতার নিথর শরীর, মুখটা ম্লান, বামদিকে কাত হয়ে আছে। চোখের কোটর ছাপিয়ে জল কানের লতিকায় সরোবর করে তুলছে। আমার যেন হঠাৎ মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়। ‘তোমার মেয়ের কিছু হয়েছে?’ ও ধীরে মুখ তুলে। ‘ও গত সপ্তায় মারা গেছে।’ বলতে বলতে ঘাড় আরেকটু কাত করে কানে জমা অশ্রু বালিশে ঢেলে দিল। উত্তেজনার পারদ তখন চরমে। আমি অনুভব করলাম, আমার সবল শরীরটা যেন ওর ওপর ভেঙে পড়ছে। ‘আমাকে আগে বলনি কেন?’ তবুও না দমে গিয়ে বলি, ‘তুমি কাদেরের পিএ হতে গেছ কেন ?’ ক্ষোভ আর অনুযোগ আমার কণ্ঠে। ‘আমার কিছু করার ছিল না। তাহলে তোমার.....’ নিতার শরীরের ওপরে থাকার কোনো অবস্থাই আমার অবশিষ্ট নেই। অপরাধীর মতো এলিয়ে পড়ি একপাশে। ও কে পাওয়ার জন্যই কী তাহলে আমার প্রমোশন দেয়া হয়েছে? লজ্জায় ওর দিকে তাকাতেও পারছিলাম না। কি অবস্থা করে রেখেছি ওর।
লেখক পরিচিতি
অলাত এহ্সান
মূলত গল্পকার। জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার বারুয়াখালী গ্রামে। ঢাকা কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিভাগে স্নাতক(সম্মান)ও স্নাতকোত্তর। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। কবিতা, প্রবন্ধ ও ফিচার লিখেন। একটি দৈনিকে কর্মরত। সখ ভ্রমণ, সিনেমা দেখা, গান শোনা ও পড়া।
প্রকাশিত বই ‘হেঁটে যাতায়াত ও আমরা’ (অনুবাদ)। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ত ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে। alatehasan@yahoo.com,
এমন অনেক কিছুই আছে, যা আমি সত্যিই মনে প্রাণে চাই—যেন না হয়। তবুও হয়। যেমন মায়ের সাথে কথা বলার সময় তাঁর কণ্ঠের উষ্মা। আমি আশা করি তা যেন শূণ্যের কোঠায় নেমে না আসে। তিনি যেন আমার অবস্থার কথা জিজ্ঞেস না করেন।
তাহলেই খুব ভ্যাগাচ্যাগা খেয়ে যাই। তারপরও আজকাল ফোন করলে মা কী যেন অযাচিত ভয় জড়ানো কণ্ঠে কথা বলেন, বাড়ি যেতে বলেন এবং বিয়ের তাড়া দেন। আমি জানি বিয়ের বয়স আমার অনেক আগেই হয়েছে। কিন্তু ছোট বোনটার একটা ব্যবস্থা না করে নিজে বিয়ে করি কী করে—এ দায়িত্ব বোধ আমার আছে। তার আগে ঘর-দোর কিছুটা হলেও ঠিক করার ব্যাপার আছে।
কিন্তু আমার যা বেতন, তা দিয়ে ঘরে কাজে হাত দেয়া তো ছাড়, ষোলটা খুঁটির গোড়ায় মাটি দেয়াও সম্ভব হবে না। হয়তো এ কারণেই ইদানিং আমার বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহের ভাটা পড়েছে। মা কার কাছে যেন কী শুনেন, হয়তো শুনেছেন—ছেলেকে বিয়ে করান হয় না বলেই হয়তো বাড়ির প্রতি টান নেই। তিনি প্রায়ই বলেন,‘তুই বাড়ি আহোস না ক্যা, বাড়ি আয়, আমরা তো বুঝি।’ আগেই বলেছি বাড়ি গিয়ে ওই রকম একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে খুব অস্বস্থি লাগে। আর যেতেও তো টাকা কম লাগে না! পথে ঝক্কি ঝামেলা তো আছেই। তাই মাসে মাসে বাড়ি যাওয়ার চেয়ে কোনোভাবে টাকাটা পাঠিয়ে দিলেই হয়। কখনো কখনো এর পেছনে অদ্ভূত যুক্তিও খুঁজে পাই। আর যে পর্যন্ত বোনটার বিয়ে না দিচ্ছি সে পর্যন্ত ওকে স্কুলে রাখতেই হচ্ছে। এনজিও’র কিস্তি দেয়ার মতো বাড়ি খরচ বাদেও বোনের পড়ার খরচ দিতে হয়, আলাদা করে। নয়তো বাব-মা অন্য কাজে লাগিয়ে ফেলবেন। তারপরও মায়ের কাতর কণ্ঠে এমন অনুরোধে আমি সত্যি অস্বস্থিতে ভুগি, অস্তিত্বে টান পড়ে, চাকুরি নিয়ে উদ্বিগ্ন হই। আমি কি করে বোঝাই যে, চাকুরিতে একটা ভাল অবস্থা না হলে বিয়ে করা যায় না। তাতে অশান্তি বাড়ে। এমন তো কতই দেখছি চারপাশে। তাছাড়া পরিবারের সবাইকে আপন করে নেবে, বিয়ের আগে এই ভারমুক্ত করবে কে? এসব কথা ভাবতে ভাবতে আবার ডুব মেরে যাই। আশা করি, তারা তা ভুলে যাবেন এবং দ্রুতই প্রমোশনটা হয়ে যাবে। তাহলে অনেক প্রশ্নের উত্তর এমনিতেই হয়ে যাবে।
আমি যেখানে কাজ করি, তা একটা কোম্পানির সিস্টার কনসার্ন। আগে ছিলাম ব্রাঞ্চ অফিসে, এখন সাব-অফিসে আছি, তাও প্রায় বছর খানেক। সব মিলিয়ে একই প্রতিষ্ঠানে প্রায় পাঁচ বছর। সে হিসেবে আমার প্রমোশনের কথা আরো তিন বছর আগে। প্রথম দুই বছর ‘ইয়ার ইন্ডিং’ সেলারি সামান্য ইনক্রিমেন্ট হত, এখন তাও বন্ধ। প্রমোশনের কোনো নামই নেই। আগামীতেও যে হবে, তার কোনো লক্ষ্মণ দেখছি না। ইদানিং এসব নিয়ে বসের সাথে চাপা রেশারেশি চলছে। তার একটা ভাল রিকমেন্ডেশন পেলেই তো হেড অফিসে চলে যেতে পারি। সাব-অফিস লাগোয়া কাঁচ বহুল এগার তলা ভবনটাই হেড অফিস। প্রতিদিন অফিসে ঢুকতে হেড অফিসের কফি কালার কাঁচে প্রতিফলিত আলো আমার পথের দিশা ঝাপসা করে দেয়। তার মধ্যে কোনো প্রশ্রয় নেই, নিপাট তাচ্ছিল্য ছাড়া। আমি খুঁজে পেয়েছি, প্রমোশন না হওয়ারও একটা কারণ আছে। ইতালিয় গোয়েন্দা বিভাগ একটা কথা বলে, ‘শে সে লেফা’; অর্থাৎ খুঁজে দেখ পাবে। মানে খুঁজে দেখ, সব কিছুতেই কোনো না কোনো নারী জড়িত। এখানেও তাই মনে হয়।
আজকাল অযাচিতভাবে নানা দিকে চোখ যায়। বিশেষত যুবতীদের দিকে। এজন্য বার-কয়েক নিজে নিজে লজ্জাও পেয়েছি। রাস্তার মেয়ে থেকে শুরু করে গাড়ির আধ-উঠা রঙিন কাঁচে আড়ে উঁকি দেয়া দুলালী, ময়লার বালতি হতে নামা উপর তলার নারী, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছাত্রী, বাসে নির্ধারিত আসনের নারী, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারতে থাকা স্কিন পোশাক পরা মেয়ে, মার্কেট পাড়ায় মহিলাদের ভিড়—সব, সবখানে আমার চোখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। এমন কি রিকশায় চুম্বন বিগলিত যুবক-যুবতী দেখলে প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়ি। হয়তো তখন নচ্ছার ছোকরাটা একটা হাত পেছন দিয়ে এনে মেয়েটির স্তন যা-ইচ্ছে-তাই কচলে যাচ্ছে, তবুও। আমার শরীর কটকট করে ওঠে। যেন মেহগুনির পাকা ফল চরচর করে ফেঁটে যাচ্ছে চৈত্রের টানে। তারপর তাপোদ্দীপ্ত বাতাসে শুনশান দুপুরে একটা একটা করে খসে পড়ছে নিচে। বাতাসে ঘুরে ঘুরে পড়ছে বৃন্ত খসা বীজগুলো। দীর্ঘ সময় ধরে পড়ছে। তাকে দমনের করতে হয়। এমন কি অফিসের কোনো পুরুষ কলিগের সাথে কোনো নারী কলিগের অতিমাত্রায় মেলা মেশা দেখলেও মেজাজ একদম তাঁতিয়ে উঠে। মনে মনে খিস্তি আওড়াই।
অফিসের রিসেপশনিস্ট মেয়ের বিষয়টাও আমার চোখে পড়ছে। নাম নিতা। প্রতিদিনের কাজ শেষে বের হওয়ার সময় দেখি, সে ডেস্কে বসে আছে। নিঃশ্চল ভাবে পেপার ওয়েট, কলম বা মোবাইলটা কাঁচের উপর অহেতুক ঘোরাচ্ছে। অফিসে এখন জুন ক্লোজিং। কাগজপত্র রেডি করতে একটু দেরি হয়েই যায়। অফিস তখন একদম ফাঁকা। ‘কি, তুমি এখনো আছো!’ বললে সে যেন চমকে উঠে। থরবরিয়ে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে—‘না স্যার, মানে স্যার’, সে তখন আরো কিছুক্ষণ ধরে আমতা আমতা করে। ‘যাবো স্যার, জিএম স্যার গেলেই যাবো।’ অস্বচ্ছ কাঁচে ঘেরা জিএম কাদের সাহেবের রুম। রুমের ভেতরে আলোটা ম্লান, টেবিলের উপর খ খ করে একটা ল্যাম্প জ্বলছে। ধূর্ত আলোর সুরম্য রুম দেখে আমার পিত্ত পর্যন্ত জ্বলে উঠে। আমি দ্রুত সেখান থেকে চলে আসি। তারপর সে আর কত ক্ষণ থাকে তা জানি না।
একদিন দেখি সে ডেস্কে মাথা ঠেকিয়ে ফোঁস ফোঁস করে কাঁদছে। তখনো অফিসে কেউ নেই। আমার ভেতরে সন্দেহ কাজ করলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম—‘কি হয়েছে নিতা?’ নিতা এমনিতে চাপা স্বভাবের মেয়ে। সারক্ষণ চুপচাপ, মন মরা মতো। সেদিন রাখ-ঢাক না করে বলল—“স্যার, আমার মা অসুস্থ, জি এম স্যারকে বললাম, আজ একটু আগে ছুটি দিতে। স্যার বলল—‘আমি ব্রাঞ্চ অফিস থেকে এসে নিই।’ স্যার এখনো ব্রাঞ্চ অফিসে। প্রতিদিন এইভাবে দেরি করতে ভাল লাগে?”
জিএম স্যারের স্বভাব আমি জানি। বদমাশটার নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলব আছে। ও ব্যাটা ইতর বিশেষ কিছু নয়। ফস্টি-নস্টি করতে তার বাঁধে না। ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’—আমি দূরাজ্ঞেয় ভাবে ওকে চলে যেতে বললাম। কিন্তু ও গেল না। পরদিন কাদের সাহেবের সাথে নানা বিষয়ে কথা বলার সময় নিতার কথা তুললাম। কাদের সাহেব খুব ঝানু মানুষ। তিনি বিষয়টা একটু কৌশলে এড়িয়ে গেলেন।
তারপর আমি বিষয়টা ভুলেই গিয়ে ছিলাম। একদিন নিতা এসে আমার টেবিলের পাশে দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই রইল। ওর দিকে জিজ্ঞাসু চোখ ফেরাতেই আগবাড়ানো লাউয়ের ডগার মতো দুলতে দুলতে বলল—‘স্যার, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার।’ আমার চোখে তখন খানিক বিস্ময়। ও বলে যায়—‘আপনি স্যার, জিএম স্যারের কাছে বলেছিলেন। আমি স্যার, আপনার প্রতি স্যার, অনেক অনেক কৃতজ্ঞ স্যার।’ আন্তরিকতার সামান্য ফাঁকফোঁকরটুকুও যেন ও ‘স্যার স্যার’ শব্দের ভেতর দিয়ে ভরে তুলতে চাইছিল। তখনো আমার মাথায় বিষয়টা ছিল না। আমি ওর দিকে আন্তরিক ভাবে তাকালাম। হঠাৎ সেদিনের ঘটনা মনে পড়ল। ‘না না, এতে কৃতজ্ঞতার কী আছে। আমি তো শুধু বলেছি। তা তোমার মা এখন কেমন আছেন?’—আমি ততোধিক আন্তরিকতা ও লাজুক তৃপ্তির সাথে কথাটা বললাম। ও আমার আন্তরিকতায় একেবারে বিগলিত। মনে হল, চোখে কৃতজ্ঞতা আর তৃপ্তির জল। যেন এই জগৎ সংসারে হিতৈষি ও ভাল মানুষ সে আমাকেই পেয়েছে।
‘মা?’ প্রশ্ন বোধক ভাবেই শুরু করলো, ‘স্যার, ভাল আছে, স্যার।’ শেষের কথাটুকু মিইয়ে যাওয়া স্বরে বললো। ‘আপনাকে কি স্যার কফি দিতে বলবো?’ তাৎক্ষণাৎ নিজেকে গুছিয়ে নিল সে। আমি সম্মতির লাজুক হাসি হাসলাম। আর মেয়েটার অবস্থার কথা ভাবতে লাগলাম। কখনো তেমন আলাপ হয় নি। তবে শিক্ষিতা মনে হয়। তারচেয়েও বড় কথা সে চাকুরি করে বাবা-মা’কে চালায়। ওর মতো সবটা আমিও পারি না। নিজের দীনতা মনে পড়ে। আন্তরিকতায় আমার মনটা ঝুঁকে পড়তে লাগলো।
দারুণ শীতল স্বভাবের মেয়ে নিতা। খুব শালীন, আজকালকার উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়ে মতো নয়। কিন্তু শরীরে উচ্চকিত যৌবন সে কোনো ভাবেই সবটা আড়াল করতে পারে না। এ জন্য ওকে নিয়ে জুনিয়রদের মধ্যে একধরনের মাতামাতি আছে। সামান্য কাজেও সবাই ওকে ডেকে পাঠায়। কী সব ইঙ্গিত করে করে কথা বলে। মেয়েটা চুপচাপ শুনে যায়। কিচ্ছুটি বলে না। আমি অস্বস্থি বোধ করি। ইন হাউজ—কখনো গলায় শব্দ করে খাকনি দেই। কখনো খেপে গিয়ে নিতাকে বলি—‘তোমাকে ওরা যে সব মন্তব্য করে, তুমি কিছু বল না কেন?’
তার কণ্ঠে স্পষ্টত অসহায় ভাব—‘কি করবো স্যার, অফিস তো এরকমই। গায়ে না মাখলেই হয়।’ ওর কথা শুনে, গোস্বায় আমার গায়ে জ্বালা ধরে যায়।
নিতা আজকাল আমার ডেস্কেও আসে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, অপেক্ষা করে কখন আমার হাতের কাজ শেষ হয়। তারপর ঘাড় ও কণ্ঠ দুই-ই একটু নামিয়ে বলবে—স্যার, হেড অফিস থেকে আপনার নামে এই ফাইল এসেছে। কিংবা বলবে—স্যার, এক কাপ কফি দেব? আমি মনে মনে যখন সত্যি কফি আশা করছিলাম। এমন অনেক কিছুই সে কি করে যেন বুঝে ফেলে। ইদানিং আমার প্রতি সামান্য টেক-কেয়ার চোখে পড়ে। আমি দারুন উৎফুল্ল বোধ করি, কিন্তু সতর্কভাবে। কারণ এটা অফিস, তা কখনোই ভুলে যাই না। আমার মনে হয় মেয়েটার যোগ্যতা আছে আরো বড় পোস্টে কাজ করার, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না।
আমি তো আর অন্যদের মতো না। গায়ে পড়ে কথা বলবো। তাই নিতার সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার পথ খুঁজি। একদিন হাতে পাঁচশ’ টাকা দিয়ে বলি—‘তোমার মা’কে ফল কিনে দিও।’ ও নিতে চায় না। আমিই জোর করি। একধরনের দায়িত্ব জ্ঞান দেখাই। এভাবে একদিন ওর সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার সুযোগ পেয়েও যাই।
এমনিতেই শহরে পাবলিক বাসের সংকট। তার উপর হরতাল বা একটু বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। সেদিন বৃষ্টিই একরকম হরতাল ডেকে বসে ছিল। সারা দিন ভর বৃষ্টি। আমাদের অফিসের সামনের গলি দিয়ে নৌকা চলার উপক্রম। তার সাথে মিশেছে ম্যান হোল থেকে উঠা নর্দমার পানি। একেবারে যা-তা অবস্থা। আমি অপেক্ষা করছিলাম বৃষ্টিটা পুরোপুরি থামুক। রাস্তার পানিটাও সরে যাক। অফিসের অন্যান্যরা যে যার মতো গলিতে আসা রিক্সায় করে পার হচ্ছিল। মেয়েটাকে দেখলাম অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। জুনিয়রদের কেউ কেউ দেখলাম ওকে তাদের রিক্সায় তুলতে চাইছিল। কিন্তু মেয়েটা ভীতুর মতো দাঁড়িয়েই রইল। আমি এসে কোনো রিক্সা পেলাম না। এটা মালটানা ভ্যান কোথায় থেকে যেন ফিরছিল। আমি অনুরোধ করায় রাজি হলো। আমি ভ্যানের উঠে চলতে শুরু করার মুহুর্তেও দেখলাম, মেয়েটা অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে—কী করে এই অকূল সাগর পাড়ি দিবে। আমি তাকে ভ্যানে উঠতে বললাম। কি যেন সাত-পাঁচ ভেবে উঠল। কিন্তু পানিতে ডোবা খানাখন্দর রাস্তায় ভ্যানের পৃষ্টে দাঁড়িয়ে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। ওর অবস্থা বেগতিক দেখে আমি হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। ও আমার হাত ধরল, আলতো আর নির্ভরতার সাথে। রাস্তার ঝাকুনিতে গা ঠুকাঠুকি হচ্ছিল আমাদের। আমি নিজেকে আরেকটু উদার করে দেই। মেয়েটাকে সামলাতে সামলাতে নিজেই বেসামাল হয়ে পড়ছিলাম। মেইন রাস্তায় তেমন যান-বাহন ছিল না। যাও ছিল তিন—চারগুণ ভাড়া হাকিয়ে যাচ্ছে। বুঝছিলাম, নিতার পক্ষে এত ভাড়া বহন করা সহজ নয়। তারপরও সে উপর্যুপরি ভাড়ায় অটো নিতে চেষ্টা করে মান বাঁচানো আর অনন্যোপায় হয়েই। শেষে আমরা একই অটোতে উঠলাম। ওর বাসা আমার বাসা ছাড়িয়ে, অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ার এলাকা। সেদিনের এক সাথে আসা, পথের কথাবার্তা, ঝাকুনি, গায়ে গায়ে ঠেস-আমাকে ঘুমাতে দিল না। আমি এক অদ্ভুত উত্তেজনায় ভুগলাম সারা রাত। তারপর থেকেই ওর প্রতি আমার দৃষ্টি ভঙ্গি পাল্টে গেল।
ইদানিং আমরা একসাথে বের হই। আসি এক অটোতে। ও যেহেতু রিসিপশনে কাজ করে তাই একটু আগেই যেতে হয়। একটু কষ্ট হলেও যাওয়ার সময়টা মিলিয়ে নিয়েছি। অটোতে আকাশ-পাতাল কথা-বার্তা, হাতাহাতি, ওর একটু আদর আমাকে পৃথিবীর সেরা আনন্দটি দেয়। চারপাশের সব গুমোট অবস্থা ভুলিয়ে রাখে। একটু প্রশ্রয় পেলেই আমি ওকে এলোমেলো করে দেই। কখনো ওর ঠোঁটে দীর্ঘ চুম্বন এঁকে সেই সুধার সন্ধানই করি, যা পান করে স্বর্গে মানুষ সুদীর্ঘকাল জ্ঞান শূণ্য পড়ে থাকবে। ঠোঁট লম্বা করে ছেড়ে দেই। কখনো নিতা কামোদ্দীপ্ত ভাবে কঁকিয়ে উঠে। প্রতিদিনের এই যাওয়া আসা রীতিমত অভ্যাসে পারিণত হয়েছে আমার। এখন একদিন একসাথে না গেলে উত্তেজনায় ভুগি, বুকটা ভা ভা করে। এমন দিনে হঠাৎ একদিন দেখলাম নিতা উধাও। অফিসে নেই। মুঠোফোনটাও বন্ধ। আমি খুব একাকিত্ব অনুভব করছিলাম। বুঝতে পারছিলাম নিতা প্রতি আমার নির্ভরতা কত গভীর। ওকে আমার কতটা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে আমি মনে মনে ওকে নিয়ে অনেক কিছু ভেবে ফেলেছি। অস্থিরতায় আমার বুক ফেটে যাওয়ার উপক্রম।
পরের দিন জানাল ওর মা খুব অসুস্থ। আমি উদ্বেগ দেখিয়ে ওদের বাড়ি যাওয়ার কথা বললাম,‘আগে বলো নি কেন? আমি তোমার বাসায় যাব।’ কিন্তু সে নিল না। ওর মাতৃভক্তি আমাকে মায়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। যাই হোক, ক্রমেই নিতাকে আমার পরিবার, একান্ত ব্যক্তিগত চাওয়া, ভাললাগা-মন্দলাগা বিষয়ে সচেতন করে তুলছি। ও এসবের মানে বুঝত কি না জানি না। তবে কেমন উদাস আর চিন্তিত থাকত। যেন রাষ্ট্র পরিচালনার ভার বর্তেছে আর কি।
ইতিমধ্যে অফিসেও আমাদের বিষয়টা দৃষ্টি গোচর হয়েছে। একদিন লাঞ্চ আওয়ারে দেখলাম, কাদের সাহেব তার রুমে ডেকে নিয়ে নিতাকে শাসাচ্ছে, প্রতিদিনের কাগজপত্র অফিস শেষে সম্পন্ন না করার জন্য, যেমনটা ও আগে করত। তারপর একদিন নিতা-ই আমার কথায় সায় দিল। ও গাটছাট বাঁধতে চায়। আমি যেন জীবনে নোঙ্গর খুঁজে পেলাম। তারপর থেকে ওর সাথে আমি অনেক কিছুই করতাম একধরনের অধিকার বোধ থেকে। কখনো ওর মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা দিতাম। তারপরও ওকে প্রায়শ বিহবল দেখাত।
কিছুদিন যাবৎ নিতা কেমন যেন অস্থিরতার ভুগছে। অফিসে আসা-যাওয়ার টাইম-টেবল ঠিক থাকে না। মাঝে মাঝে অফিসেও আসে না। এদিকে কাদের সাহেব দেখি আমাদের রুমে কয়েক চক্কর ঘুরে যায়। এর কারণ কী?—নিতা শুধু বলে ফ্যামিলি ক্রাইসিস চলছে। গুরুত্ব দিয়ে বলি—তার সাথে আমার কথা আছে। সে এড়াতে চায়। আমি তাকে আমার ফ্ল্যাটে যেতে বলি। সে অফিস বন্ধের দিনে দেখা করতে বলে। আমি ভাবি, সে আর বিশেষ কি? তারপর দিনও ঠিক হলো।
কিন্তু লেক পাড়ে বসে নিতার কথায় আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। ‘আমি একজন পরিত্যক্তা’ একটু দম নিয়ে আবার শুরু করে, ‘আসলে আমার তিন বছরের একটা মেয়ে আছে, জন্মের পর থেকেই ও অসুস্থ। অফিসের সবাই তা জানে। তাই সবাই আমার সাথে অমন করে। শুধু তুমি জানো না।’ একটু থামে নিতা। ও কাঁদছে। এক হাতে আরেক হাতের তালু ঘষে আর বলে, ‘জীবনে আমি অনেক ঠকেছি, কিন্তু তোমাকে ঠকাতে পারবো না। তাই....’ আমি বাকি কথাগুলো আর শুনি নি। ঘর পোড়া খুঁটির মতো অসাড় পড়ে আছি। সারা রাত ঘুম হলো না আমার। নিতার বিষয়ে যে আমি সন্দেহাতীত ছিলাম না, সে প্রসঙ্গটা আর মনে এলো না। মনে হলো সত্যি ও আমাকে ঠকিয়েছে। এই শহরটাই দারুন প্রতারক আর ঠক। নিজের সাথে দ্বন্দ্ব করে আর পারছিলাম না। পরদিন অফিসে গিয়ে প্রথমেই একটা মেডিকেল লিভের এ্যাপ্লিকেশন জিএম কাদের সাহেবের টেবিলে জমা দিয়ে সাত দিনের জন্য গ্রামে চলে এলাম।
কিন্তু গ্রামে এসেও আমি এক মুহুর্তের জন্য স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। সারাক্ষণ শূন্য মাঠের দিকে তাকিয়ে সময় কাটে। মনের ভেতরেও তেমন শূন্যতা আর কষ্ট অনুভব করি। বিশেষ করে সন্ধ্যায়, যখন আমরা অফিস থেকে ফিরতাম, এ মুহুর্তটা মর্মে মর্মে বাজে। অমবশ্যা-পূর্ণিমায় বহু দিনের পুরনো ব্যাথা জেগে উঠার মতো। চৈত্রের দুপুরে ঘাস শূন্য মাঠে বাধা ষাড়টা জলের তৃষ্ণায় করুণ হাম্বা বলে উঠে। আর দূরে বাড়ির দিকে, গৃহস্থের দিকে নজর করে। নিজের ভেতরে তেমন একটা গোঁঙরানি অনুভব করি। অসহ্য যন্ত্রণায় হয় উন্মাদ নয় নিস্তব্ধ হয়ে যাবো। বিষয়টা অবধারিতভাবেই বাবা-মা’র চোখে পড়ে। বাবা-মা’র সাথে বিষয়টা খুলে বলি। তাঁরা কয়েক দিন যাবত আমার অবস্থা তো দেখেছেন। কথাটা শোনার পর হতভম্বের মতো তাঁরা একবার পরস্পরের মুখ চাওয়া-চায়ি করেন। বিষয়টা শুনে বাবা-মা’র মনের অবস্থা কি হবে ভেবে এই কয়দিন অস্থির ছিলাম। ‘দেখ,তুই যা ভাল মনে করস’, খানিক ক্ষণ পর অনপেক্ষ ভাবে বলেন তাঁরা। দুঃশ্চিন্তার পারদ আরেকটু নামিয়ে বলেন, ‘তয় আরেকবার ভাইব্যা নিস।’ মনে একটু জোর পেলাম। কিন্তু মাথার ভেতরে একটা চাপ রয়েই গেল। এবার একটা প্রমোশন না হলেই নয়। নয়তো অন্য কোথাও চেষ্টা করতে হবে।
শহরে ফিরতে ফিরতে ভাবি, প্রথমেই নিতাকে বলতে হবে, এখন আর কোনো আপত্তি নেই। শুধু প্রমোশনের জন্য অপেক্ষা। আমি তখনও বুঝি নি, শহরে আমার জন্য আরো বড় চমক অপেক্ষা করছে। ছুটি শেষে অফিসে জয়েন করার পরই দেখলাম, সবাই কেমনভাবে যেন তাকাচ্ছে আমার দিকে। হঠাৎ কাদের সাহেব ডেকে পাঠালেন। হাতে একটা খাম, মুখে বিরক্তি, অবজ্ঞা আর বিজয়ের ছাপ। খামটা ধরিয়ে দিয়ে কালকেই হেড অফিসে জয়েন করতে বললেন। আমার তখন আনন্দে লাফিয়ে উঠার উপক্রম, যাকে বলে—ভাবে সপ্তমী। এক দৌড়ে রিসেপশনে গেলাম। মনে কেমন যেন একটা ফুরফুড়ে ভাব। নিতাকে বলতে, আমাদের আর কোনো সমস্যা নেই, খোদা আমাদের উপর প্রশন্ন হয়েছেন। কিন্তু নিতা সেখানে নেই। একজন সাপোর্ট স্টাফ বসে টেলিফোন অপারেট করছে। মুহুর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে গেলাম, কিন্তু হুল ফোটানো বেলুনের মতো চুপসে গেলাম না।
হেড অফিসে যোগ দেয়ার কয়েক দিনের মধ্যে পুরনো ফ্ল্যাট ছেড়ে দিলাম। নতুন ফ্ল্যাটটা একটু উন্নত এলাকায়। নিতার কথা মাথায় রেখেই ছোট পরিবার থাকার মতো একরুম নিলাম। মনে দারুণ আত্মবিশ্বাস। কিন্তু নিতারই কোনো খোঁজ নেই। এখন আমাকে অফিসের বাসে যাতায়াত করতে হয়। ইচ্ছে করলেই সাব-অফিসে ঢু দেয়া যায় না। তারপরও কয়েক দিন তক্কেতক্কে রইলাম। রিসেপশনে ফোন করেও নিতার সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হলাম। উড়ো খবর শুনলাম, সে এখন কাদের সাহেবের পাইভেট এ্যাসিসটেন্ট। আমি চমকে উঠলাম। কাদের সাহেবদের মতো লোকদের কাছে মহিলা পিএ বলতে শেষ পর্যন্ত কি বোঝায়, তা আর বুঝতে বাকি নেই। ক্রমেই মনের মধ্যে নানা চিন্তা ঘনীভূত হতে শুরু করল। একদিন অফিস শেষে নিতাকে কাদের সাহেবের গাড়িতে বেশ অন্তরঙ্গ ভাবে দেখলাম। আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। ও আমার সাথে এতো বড় প্রতারণা করল! নটি কোথাকার, ওই সন্তানটাও কি তবে? এর জন্য ওকে জবাব দিহিতা করতেই হবে।
আমার সমস্ত ভালবাসা এক নিমিষেই উবে গেল। প্রতিশোধ স্পৃহায় একদম উন্মত্ত হয়ে উঠলাম। চোখের সামনে এখন নিতার শরীর ছাড়া আর কিছুই আসে না। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে একদিন নিতাকে পেয়েও গেলাম, একটা অভিজাত শপিং মলের সামনে। আমাকে দেখেও অপ্রতিভ হলো না ও। নচ্ছার হলে এমনই, কোনো অপরাধবোধ নেই। ও ধীরে আত্মসমর্পণের মতো এগিয়ে এলো। আমি আর এক মুহুর্ত সময় দিতে রাজি নই। ওকে সোজা আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে এলাম। ট্যাক্সিতে বিয়ের প্রসঙ্গ তুললাম। ‘সে আর সম্ভব নয়।’ ম্লান আর ক্লান্তি জড়োনো কণ্ঠে বলল নিতা। ‘তোমার সন্তান নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। এই ফ্ল্যাটটা সে চিন্তা করেই ভাড়া নিয়েছি।’ ক্ষিপ্র ভাষায় আমি বলি। কথাটা শোনার পর নিতা একদম থম ধরে গেল। কি এক অস্বস্থি বোধ থেকে হঠাৎ সে ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু তা কপটতার আশ্রয় ছাড়া কিছুই মনে হলো না। ওর সবকিছুই আমার চোখে অশ্লীল। আমি প্রথমে ওকে দেয়ালের সাথে সেঁটে ধরলাম। সেখান থেকে টানতে টানতে ফ্লোরে পাতা বেডে নিয়ে ফেললাম। এক লহমায় গলায় আটকে থাকা ওড়নার সামান্য প্রান্তটুকু কোথায় ছুড়ে দিলাম তা দেখার অবকাশ ছিল না। হালের বেলাল্লা মেয়েদের মতো জামায় পিঠের দীর্ঘ চেইন করেছে। চেইন টেনে জামাটা খুলতে আমার মুহুর্তটুকুও লাগেনি। নিতা আমার বুকের নিচে নড়াচড়া করছে। ভাবলাম আমার স্পর্শে সে আর নিজেকে স্থির রাখতে পাড়ছে না। বীরত্ব অনুভব করছি। আমার কোনো হিতাহিত জ্ঞান নেই। সবটুকু শক্তি দিয়ে, দুই হাতে, দশ আঙ্গুলে সব কিছু দুমড়ে মুচড়ে দিতে চাইছি। নিতা নিচ থেকে কঁকিয়ে উঠে। বলে, ‘আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি আনন্দ পাচ্ছ?’ এখনো তার ভনিতা যায় না! আমি খেয়াল করে দেখলাম, নিতা কোনো বাধাই দিচ্ছে না। ওর মাথার চুলের কাটা পিঠের নিচে পড়ে মটমট করে ভেঙে যাচ্ছে। নিতার নিথর শরীর, মুখটা ম্লান, বামদিকে কাত হয়ে আছে। চোখের কোটর ছাপিয়ে জল কানের লতিকায় সরোবর করে তুলছে। আমার যেন হঠাৎ মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়। ‘তোমার মেয়ের কিছু হয়েছে?’ ও ধীরে মুখ তুলে। ‘ও গত সপ্তায় মারা গেছে।’ বলতে বলতে ঘাড় আরেকটু কাত করে কানে জমা অশ্রু বালিশে ঢেলে দিল। উত্তেজনার পারদ তখন চরমে। আমি অনুভব করলাম, আমার সবল শরীরটা যেন ওর ওপর ভেঙে পড়ছে। ‘আমাকে আগে বলনি কেন?’ তবুও না দমে গিয়ে বলি, ‘তুমি কাদেরের পিএ হতে গেছ কেন ?’ ক্ষোভ আর অনুযোগ আমার কণ্ঠে। ‘আমার কিছু করার ছিল না। তাহলে তোমার.....’ নিতার শরীরের ওপরে থাকার কোনো অবস্থাই আমার অবশিষ্ট নেই। অপরাধীর মতো এলিয়ে পড়ি একপাশে। ও কে পাওয়ার জন্যই কী তাহলে আমার প্রমোশন দেয়া হয়েছে? লজ্জায় ওর দিকে তাকাতেও পারছিলাম না। কি অবস্থা করে রেখেছি ওর।
লেখক পরিচিতি
অলাত এহ্সান
মূলত গল্পকার। জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার বারুয়াখালী গ্রামে। ঢাকা কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিভাগে স্নাতক(সম্মান)ও স্নাতকোত্তর। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। কবিতা, প্রবন্ধ ও ফিচার লিখেন। একটি দৈনিকে কর্মরত। সখ ভ্রমণ, সিনেমা দেখা, গান শোনা ও পড়া।
প্রকাশিত বই ‘হেঁটে যাতায়াত ও আমরা’ (অনুবাদ)। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ত ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে। alatehasan@yahoo.com,
0 মন্তব্যসমূহ