মৌসুমী কাদের
গল্প সংক্ষেপ
মি. এবং মিসেস দাস ছেলেবেলার বন্ধু, অনেক অল্প বয়সে পারিবারিকভাবেই ওদের বিয়ে হয়। পরিবারের সকলে মিলে যখন ওরা আমেরিকা থেকে ভারতে বেড়াতে যায় সেই সময়ের গল্প এটি। কোনারকের সূর্যমন্দির দেখতে গিয়ে দাস দম্পতির সাথে পরিচয় হয় ট্যুর গাইড মি.কাপাসি’র।
মূলত দাস-দম্পতি এবং মি.কাপাসি, এই তিনজনকে ঘিরেই গল্পটির নির্মাণ। গল্পের শুরুতেই বোঝা যায় . এবং মিসেস দাস জীবনের এমন একটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন যেখানে নিজেদের ছাড়া অন্য কারও দায়িত্ব নিতে তাদের অসুবিধে হয়। ট্যুর গাইড মি.কাপাসির সাথে পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে নানাধরনের কথাবিনিময় হয় এবং একপর্যায়ে কাপাসি বলেন যে তার পার্ট-টাইম জব হচ্ছে স্থানীয় এক ডাক্তারের সহকারী হিসেবে কাজ করা। ডাক্তার লোকাল ভাষা বোঝে না, রোগীরা তাই এসে তার কাছে রোগের বর্ণনা দেয়,আর তিনি সেটাকে ইন্টারপ্রেট করে বলেন ডাক্তারকে।
এধরনের কাজের কথা এই দম্পতি আগে কখনও শোনেনি। ট্যুর গাইড মি.কাপাসি’র বড় ছেলে যখন সাত বছর বয়সে টাইফয়েডে মারা যায়, ছেলের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য তখন তাঁর টাকার প্রয়োজন ছিল। সেই সময় তিনি এই দোভাষীর কাজটা নিয়েছিলেন। এই কাজটি কাপাসির স্ত্রী’কে মৃত ছেলের কথা মনে করিয়ে দেয় এবং এ কারণেই অন্যদের প্রাণ বাঁচাতে স্বামীর এই ক্ষুদ্র চেষ্টাকে সে বিদ্বেষের চোখে দেখে। কাপাসিও এ কাজটিকে তার ব্যার্থতার চিহ্ন বলেই মনে হয়। যদিও যৌবনে তিনি ছিলেন বিদেশী ভাষা বিশারদ। কিন্তু, দীর্ঘদিন স্ত্রীর বিরূপ আচরণের পর হঠাৎই মিসেস দাস তার এই দোভাষী কাজের প্রশংসা করাতে তিনি আপ্লুত হয়ে যান এবং কাজটিকে তার বেশ রোমান্টিক বলেই মনে হতে থাকে। শ
এক পর্যায়ে কাপাসি অনুধাবন করেন যে দাস দম্পতির মধ্যে কোন রকম রোমান্টিক আচরণ নেই। সে এবং তাঁর স্ত্রীর মতো এই দম্পতিও পরষ্পরের পক্ষে অনুপযুক্ত। হয়ত সে কারনেই মিসেস দাস তার প্রতি আচমকা আগ্রহ প্রকাশ করায় কাপাসি মৃদুভাবে আচ্ছন্নতায় পড়ে যান। মিসেস দাসের সাথে তার সার্বিক যুক্ততা একধরনের সফলতার তৃপ্তি দিচ্ছিল তাঁকে। কাপাসি এর আগে অসংখ্যবার মন্দিরে এসেছেন, কিন্তু মিসেস দাসের সাথে এবার এই আসাটি তার অভিজ্ঞতায় ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়। মন্দিরে আঁকা নগ্ন নারীমুর্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি প্রথমবারের মতন অনুভব করলেন, তাঁর স্ত্রীকেও কখনও তিনি ঘনিষ্ঠ মুহুর্তে সম্পূর্ণভাবে নগ্ন অবস্থায় দেখেননি। ব্যক্তিগত জীবনের ব্যর্থতা আর তীব্র প্রেমবোধ থেকে তাঁর আকাংখা হয় তাঁর মিসেস দাসকে জড়িয়ে ধরার। গল্পের এ পর্যায়ে এসে মনে হয়, গল্পকার নির্ঘাত একটি প্রেম কাহিনীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং পাঠক অপেক্ষা করতে থাকেন ক্লাইমেক্সের দিকে; কখন তাঁরা প্রেমদৃশ্যটির মুখোমুখি হবেন।
কিন্তু ভ্রমণের দিক পরিবর্তনের সাথে সাথে গল্পের মোড় ঘুরে যায়। টুইস্ট এসে যায় গল্পে। মিসেস দাস গল্পের ফাঁকে একসময় তাঁকে জীবনের এমন এক মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা করেন যা কাপাসির সমস্ত প্রেম অনুভুতিকে ফিকে করে দেয়। এমন একটি ঘটনা যা মিসেস দাস কখনও কোনদিন কাউকে বলবেন বলে ভাবেননি। বিবাহিত জীবনে কিভাবে তিনি মি.দাসের এক বন্ধুর সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং যার ফলশ্রুতিতে জন্ম হয় সন্তান ববি’র । পৃথিবীতে একথা মি.কাপাসি ছাড়া আর কেউ শোনেনি আগে। এমনকি মি.দাসও না। একটু চিন্তা করলেই পাঠক ধরতে পারবেন গল্পকার আসলে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতগুলোকে কিভাবে দেখছেন। ঝুম্পা পাঠকের কাছে ধীরে ধীরে জট খুলছেন আবার এমন একটি ঘটনার মুখোমুখি করছেন পাঠক যার জন্যে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগে, কেন কাপাসিকেই এই গোপন কথাগুলো বললেন মিসেস দাস? কষ্টটা কোথায় আটকে ছিল তার?
একজন বাবা,তার একটি সন্তানকে নিজের বলে বড় করছেন অথচ সন্তানটি তার নয়, এই বোধটি কাপাসিকে বিষণ্ন করে। একই সংগে তাঁর নিজের রুগিদের কথা মনে হয়, যারা নিজেদের বেদনাকে কথায় প্রকাশ করতে পারেনা। নিজের মনকে প্রশ্ন করে সে,‘সমস্যাটা কি সত্যিই মিসেস দাসের বেদনা, নাকি এটা তাঁর অপরাধবোধ? গল্পের শেষে একটা ক্লাইমেক্স দিয়ে ঘটনার শেষ হয়। গিরিসংকটে গুহা দেখতে গিয়ে ববি যখন হনুমানের আক্রমণে পড়ে তখন সূর্যমন্দিরের রতিপাথরের নকশা আর কাপাসির জীবনবোধ, দুইয়ের পরষ্পর সংঘাত বাঁচতে শেখায় সম্পর্ককে। কাপাসি ববিকে বাঁচিয়ে মি.দাসের কোলে তুলে দেয়। রক্তদিয়ে সম্পর্ক মাপা যায়না আর। মিসেস দাসের ব্যাগ থেকে উড়ে যায় কাপাসির সাময়িক প্রেমের ঠিকানা।
গল্পের কাঠামো, বিষয় ও সার্বিক আঙ্গিক
‘বেদনার ভাষ্যকার’ গল্পটি বর্ণনামূলক, তবে বুনোট বাঁধা। লেখক তাঁর নিজস্ব ঢংএ একের পর এক খুঁটিনাটি দৃশ্যের বর্ণনা করেছেন। দৈনন্দিন অনুভূতি, সরল বোধ, ভাষার স্বচ্ছতা, সাবলিল সংলাপ, সবকিছু মিলিয়ে পাঠক তরলভাবে গল্পের ভেতর ডুবে যেতে পারেন। কিন্তু তার চেয়েও গল্পটিকে যা আরো বেশী আকর্ষণীয় করে তুলেছে, তা হল ব্যক্তি সংঘাত, হৃদয়স্পর্শী গভীর অনুভূতি, সুক্ষ্মবোধ, এবং না বলা গোপন কথা, যা সচরাচর উচ্চারিত হয়না, উদ্বেগ বাড়ে, ভয় হয়, সেইরকম একটি ঘটনা, যা সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন দেশে এসে অপরিচিত একটি মানুষের কাছে মুক্তি পায়। এ বড় আশ্চর্য্য বিষয়। মানুষ কখন কোন পরিবেশে কি আচরণ করবে সে নিজেও জানেনা। তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে মানুষ বেদনাকে ভালোবাসেনা, অপমানকে আটকে রাখতে চায়না। যে সমাজে বা পরিবারে আমরা বাস করি, সেখানে গড়ে তুলতে চাই পরিচ্ছন্ন সংযোগ এবং গভীর আত্মীয়তা। এই গল্পে ঝুম্পা সেই রকম একজন নারীর (মিসেস দাস) অপমানবোধ ও কষ্টগুলোর মুক্তি দিয়েছেন কোনরকম সম্পর্কের লেনদেন বা আদানপ্রদান ছাড়াই। এবং এটি একটি সাংঘাতিক পাওয়াফুল ম্যাসেজ এই গল্পের। কাপাসির নিজেকে চেনা, মিসেস দাসের বোধকে চেনা, বিষয়গুলো খুব সুক্ষভাবে এবং বুদ্ধিমত্ত্বার সাথে লিখেছেন ঝুম্পা। মাত্র তিনটি প্রধান চরিত্র। কিন্তু তা নিয়েই পাঠককে ভাবতে হবে। গল্পটি নিঃসন্দেহে সকলের ভাল লাগবে। ২০০০ সালে তাঁর ছোট গল্পের সংকলন `ইন্টারপ্রেটার অফ ম্যালাডিস` জয় করেছিল পুলিৎজার পুরস্কার।
.
নীলাঞ্জনা সুদেষ্ণা লাহিড়ী এবং লেখক জীবননীলাঞ্জনা সুদেষ্ণা লাহিড়ী (ঝুম্পা লাহিড়ী)’র জন্ম জুলাই ১১,১৯৬৭ তে। লন্ডনে জন্মানো এবং আমেরিকায় বেড়েওঠা। হাই স্কুলে পড়াকালীন সময়েই ঝুম্পা ‘সাহিত্য’ পড়তে চেয়েছিলেন এবং ইংরেজী সাহিত্য ছিল তার প্রিয় বিষয়। রচনা লিখতে পছন্দ করতেন, গল্প তেমন একটা নয়। কিন্তু শব্দ নিয়ে খেলাটা তার প্রিয় বিষয় ছিল। কিন্তু কলেজে পড়ার সময় বিভিন্ন ‘প্রাচীন-সাহিত্য’ কৌতুহল বাড়িয়ে তোলে তাঁর। তিনি যখন ল্যাটিন ভাষা নিয়ে পড়া শুরু করেন ক্রমশ সেটি তাঁকে নিয়ে যায় প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যে। এবং অর্ধেক পড়া শেষ না হতেই আকাঙ্ক্ষা তৈরী হয় ‘ক্লাসিক সাহিত্যে’। যদিও শেষ পর্যন্ত গৌণ বিষয় হিসেবে ‘ল্যাটিন’টাই পড়েন তিনি। কিন্তু মনের একটি অংশ জুড়ে থেকে যায় ‘প্রাচীন ভাষা ও সাহিত্য’। চসার, স্পেন্সার এবং শেক্সপীয়ার নিয়ে তার প্রচুর পড়া হয়। প্রথম বছরে অস্নাতক থাকাকালীন সময়েই দুটি বড় পেপার লিখে ফেলেছিলেন তিনি। ‘দি ফেইরী কুইন’ এবং ‘দি ক্যান্টারবেরি টেলস’। মধ্যযুগীয় এবং রেনেসাঁ সাহিত্য একধরনের তৃপ্তি দেয় তাকে কারণ এদুটোই গ্রিক ও ল্যাটিন দ্বারা প্রভাবিত। আধুনিক সাহিত্য নিয়েও তিনি পড়েছেন, তবে সেটা অনেক বেশী নয়।
ল্যাটিন এবং গ্রীক অধ্যয়ন করতে করতেই তিনি অনুভব করেন যে আগের শতাব্দীর লেখাগুলো থেকে তিনি অনেক শিখেছিলেন। এসব পড়তে পড়তেই গোপনে তাঁর নিজের লেখা নিয়ে কিছু কাজ করতে ইচ্ছে হয়। যদিও তাঁর সহপাঠীরা সমকালীন ঔপন্যাসিকেদের নিয়ে পড়তে বেশী আগ্রহী ছিলেন। অনেক অল্প বয়েসে গল্প লিখতে শুরু করেছিলেন ঝুম্পা, এবং একই্সঙ্গে তখন তিনি ‘জয়েস’ পড়ছিলেন। ঝুম্পা মনে করেন চট করে কন্টেমপোরারী রাইটিং এর দিকে ঝুঁকে না পড়াটা ওর জন্যে ভাল ছিল এবং সে কারণেই হয়ত নিজের লেখার প্রতি বেশী মনযোগী হতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে অবশ্য তিনি সমকালীন লেখার সংগে একটা সম্পর্ক তৈরী করতে পেরেছিলেন; যেমন প্রাউস্ট, জয়েস, নাবকভ প্রমুখকে নিয়ে লেখা। কিন্তু এগুলো ততটা গভীর হচ্ছিল না যতটা ‘প্রাচীন সাহিত্য’ নিয়ে হচ্ছিল। ‘ভার্জিনিয়া উলফ’কে আবিষ্কার করা এবং তার কাজ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ঝুম্পা বলেনঃ ‘একজন মায়ের দুটো বাচ্চা নিয়ে লেখক হতে চেষ্টা করা -এখন আমি.তার অর্থ প্রতিদিন বুঝতে পারি। বুঝতে পারি কেন অতীতেও নারী লেখকের সংখ্যা এত কম ছিল; কেন কলাম্বিয়ার বাটলার গ্রন্থাগারের বইয়ের বেশীরভাগ খোদাই করা নামগুলোই ছিল পুরুষের--নাকি গ্রীক কবি স্যাফো সেখানে ছিলেন? বোধহয় ছিলেন না।’
গত দুবছর ধরে ঝুম্পার পড়বার তালিকাটা ছিল বেশ মজার। গ্রীষ্ম এলেই তিনি ‘ইন্টারেস্টিং কন্টেম্পরারি মিক্সড’ বই পড়েন, আইরিশ, ইটালিয়ান ইত্যাদি। আর শীত এলেই তিনি ফিরে যান প্রাচীন সাহিত্যে, তবে গ্রীক বা রোম এতদূর নয়, বিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত। তিনি যা লেখেন তাঁর কাছে সবই ‘এক্সপেরিমেন্টাল’, নিজেও জানেননা এটি সফল বা ব্যর্থ হবে। গল্প লেখার প্রক্রিয়া নিয়ে বলেন, ‘আমি একটা কিছুর প্রান্তে আছি। আমি.স্বীকার করি যে ‘শৈলীগত’ বা ‘বিষয়ের ক্ষেত্রে’ আমি.তত জোর দিচ্ছিনা। বা এটি নিয়ে আমি তত আগ্রহ বোধ করছিনা বা লেখার জন্যে তেমন একটা তৈরী আছি-‘আমি ঠিক জানিনা; তবে আমি.জানি আমার সংগ্রহে অনেক কিছু আছে যা দিয়ে একটা গল্প গুছিয়ে লেখা যায় এবং যতটুকু দরকার তার বাইরে জটিল করার কোন প্রয়োজন দেখিনা। আমি মনে করি প্রতিটি লেখাই নতুন এবং সহজাত ভাবেই তা আসতে হবে।’ ‘পুরনো লেখার দিকে ফিরে তাকাবার অভ্যাস আমার ততটা নেই, সেগুলো আমার কাছে ‘পুরনো’ বা ‘নতুন’ উভয়ই । পুরনো স্কার্ট পরা ছবি দেখে যেমন প্রশ্ন হয়, কেন ‘ঐ স্কার্টটা পরেছিলাম’? পুরনো বোধ অথচ নতুনও । তবে এটা আমার জন্য বিব্রতকর হবে বলা যে, আমার লেখা এত সফল হয়েছে, কিন্তু আমি.সত্যিই বুঝতে পারিনা কেন এগুলো এত সফল হলো। আবার বলা যায় এ নিয়ে আদৌ পরোয়া করিনা। কিন্তু যেভাবেই হোক আমাকে ‘পাঠকের মনোযোগ’ বিষয়টি গ্রহণ করতে হয়েছে এবং এটা আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। আমার বইয়ের মলাট বা ডিজাইন দেখে বা নাম পড়ে অনেক পাঠকই মনে মনে কিছু ধারণা করে নেয়। প্রথমত, ‘আমি ভারতীয়’ বা তাঁরা আমাকে ইন্ডিয়ান ভাবতেই পছন্দ করে, অথচ আমি ঐদেশে একজন ‘বিদেশী’।
লেখার প্রেরণা কোথায় পান ঝুম্পা? এটা তাঁর কাছে একবার জানতে চেয়েছিলেন একজন। কোনকিছু প্রকাশের জন্য ‘নিজের মধ্যে থেকে নিজের জন্য’ লেখেন তিনি। এটা এমন একটা প্রক্রিয়া যা লেখার জন্য বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন। অনেকেই প্রশ্ন করেন, ‘ঝুম্পা লাহিড়ী’র গল্পে অভিবাসীরা কেন এত ধনী’? এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘আসলে তারা ধনী নন। ‘শিক্ষাই’ উদ্দেশ্য সাধনের উপায় হয়ে দাঁড়ায়’।
ব্যক্তিজীবনে তার বাবা-মা দুজনেই কলকাতার খুবই সাধারণমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছেন। কিন্তু তার বাবা প্রবাসে একজন একাডেমিক হয়ে আসেন এবং একাডেমিক ওয়ার্ল্ডের সাথেই তিনি যুক্ত ছিলেন। ঝুম্পারা যেখানে-যেভাবে থাকতেন সেটা বাবার বেতনের উপরই নির্ভরশীল ছিল। বিলাসীতো নয়ই, কিন্তু হ্যাঁ, তাদের গাড়ি ছিল, বাড়ি ছিল, এক টুকরো উঠোন ছিল যা খুবই বেসিক চাওয়া এসব দেশে-এবং একই সঙ্গে তারা কোন সোয়েটশপে কাজ করেননি। ঝুম্পার জন্য এর উত্তর দেয়াটা তাই কষ্টকর যে, কেন তিনি কর্মজীবি শ্রমিকদের নিয়ে লেখেননি। তার মতে, ‘এই চরিত্রগুলো তার ভাল চেনা বা জানা নেই’। অভিবাসন বিতর্কে এই প্রশ্নটি একটি হট পয়েন্ট হয়ে থাকে সবসময়। তার বাবা-মা মার্কিন দেশে সাবওয়ে খোঁড়ার জন্য আসেননি। আবার তাদের যা কিছু সমস্যা ছিল সেগুলোও বর্ণনা করলে শেষ হবেনা। তিনি যেভাবে বড় হয়েছেন, সেটা নিয়ে তার কোন আক্ষেপ নেই। যদিও একসময় এটা মনে হতো, কারন নতুন দেশ, বাবা-মাও সবকিছু নিয়ে সংগ্রাম করছিলেন এবং তাঁদের ভাষাতেও স্ট্রং এক্সেন্ট ছিল। মোটকথা এই অভিবাসী পরিবারটি আর সবার মতন ছিল না। কিন্তু বয়সের সাথে সাথে পুরো চিত্রটা বদলে যায়, যেটা থার্ড গ্রেডে শেখানো হয়, সেই সত্যটি স্বীকার করতে বাধ্য হয় সবাই; ‘আমেরিকা ইজ এ ল্যান্ড অব ইমিগ্র্যন্টস’।
ঝুম্পার নানা বাড়ি টালিগঞ্জ, কলকাতায়। বিবেকানন্দ রোডে মামার বাড়ির কথা তিনি পরিষ্কার বাংলায় বলেন। যুক্তরাষ্ট্রের রোড আইল্যান্ডের বাড়িতে বাধ্যতামূলক বাংলা বলতে বলতে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। ইতালীয় স্বামী আলবার্তো, ছেলে অক্টাভিও এবং মেয়ে নুরকে নিয়ে তার পরিবার। ‘দ্য লোল্যান্ড’-এর সুভাষ, উদয়ন; ‘দ্য নেমসেক’-এর অসীমা, কিংবা ‘ইন্টারপ্রেটার অব ম্যালাডিজ’-এর বিবি হালদার এসব চরিত্র সৃষ্টির পেছনে রয়েছে তার সাহিত্য বিষয়ে তার পড়াশুনা, পূর্বসুরীদের কাছ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা এবং নিজের দেখবার দৃষ্টি। ঝুম্পা জীবনের সাথে তার লেখাকে মিশিয়ে নিয়েছেন এমন করে যে, কোথা থেকে যেন তৈরী হয় একটা মায়ার টান আর গভীর বিষণ্নতা। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘুরে নিজের মানসিক অবস্থান তার ভাসমান এখন। তাই তার গল্পগুলোও ভাসতে থাকে, পুঁথির মত মালা গাঁথতে থাকে। অধিকাংশ গল্পতেই তিনি তৈরী করেন দুই সংস্কৃতির মধ্যে যূথবদ্ধতা। তিনি আগে থেকে কোন ধারণা বা বার্তা ভেবে লিখতে বসেননা, শুধুই গল্পই লেখেন।
কলকাতা তার জীবনে অনুপস্থিত,তবু কি ভীষণভাবেই না উপস্থিত! তিনি এখনও হাত দিয়ে ভাত মাখিয়ে খেতে পারেন। অথচ একসময় ছোটবেলাতে মনে করতেন, তার কোনো দেশ নেই। কিন্তু যত দিন যায়, সব দেশই যেন তার নিজের হতে থাকে। যেখানে খুশি, যেতে পারেন তিনি। কলকাতা, লন্ডন এবং রোড আইল্যান্ডের পর এখন আরও একটি শহর ঝুম্পার নিজের। রোম! সেখানেই স্বামী, পুত্র কন্যাদের নিয়ে তার সংসার। ইতালির পুরনো সভ্যতা, বাবা-মা, পারিবারিক যূথবদ্ধতা তাকে ভেতরে কাতর করে।
এ পর্যন্ত পুরস্কার পেয়েছেন অনেক। পুলিৎজার পুরস্কার, হেমিংওয়ে অ্যাওয়ার্ড, ফ্রাংক ও’কনর আন্তর্জাতিক ছোটগল্প অ্যাওয়ার্ড ইত্যাদি। ইন্টারপ্রেটা(র) অব ম্যালাডিজ, দ্য নেইমসেইক, আনঅ্যাকাস্টম্বড্ অ্যার্থ, দ্য লোল্যান্ড,তাঁর বিখ্যাত সব উপন্যাস ও গল্পসংকলন।
0 মন্তব্যসমূহ