সকালে ঘুম থেকে উঠে কিংবা রাতে ঘুমানোর আগে অথবা প্রয়োজন মতো যে কোনো সময় দাঁত ব্রাশ করতে গেলে মন্টির মনে হয় সে একটা সাদা দেয়ালে রং করছে। এজন্য মন্টি নীল রঙের পেস্ট ব্যবহার করে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দুইপাটি দাঁতকে এক করে কোনো ফাঁক না রেখে ওপর-নীচ রং করতে থাকে। দেখে, কতটা রং হয়েছে। রং আর হয় না, হয় ফেনা, সাদা সাদা ফেনা। তাই একটু পর বিরক্ত হয়ে বেসিনে ঢেলে দেয়। তারপর আবার দেখে ঠোঁটজোড়া পিছে নিয়ে, দাঁত সামনে এগিয়ে। রং হয় নি! রং হয় না! রাঙানো সহজ নয়!!!
তবু হাল ছাড়ে না মন্টি। নাশতার টেবিলে গিয়ে বসে। কেন রং হয় না? পাউরুটির মধ্যে জেলি মাখাতে থাকে। পাশের ঘর থেকে বুয়া ডাকে, স্যার, আপনের ফোন বাজে। ‘দিয়ে যান’ বলে মন্টি। মায়ের ফোনটা হঠাৎ বাবার ফোন হয়ে যায়। অর্থাৎ মায়ের ফোন থেকে বাবা ফোন করেছে। বাবা দিলে হয়তো এত তাড়াতাড়ি ধরতো না! তাই বাবা বাংলাদেশি টাইমের সাত-সকালে মাকে কাজে লাগায়। ওপ্রান্ত থেকে মন্টির বাবা জানতে চায়, নাশতা খাইতেছ? মন্টি উত্তর দেয় সংকোচ-উদাসীনতা মিশিয়ে,‘রং চলতেছে, তারপর খামু’। কথার মানে ধরতে পারে না বাবা। এবার কথার শানে নযুল বুঝতে মায়ের হাতে ছেড়ে দেয় ফোনটা বাবা। মা জিজ্ঞেস করে,‘বাবা মন্টি, নাশতা খাইচো?’ মন্টি এবারো ক্লিয়ার করে না। শুধু বলে,‘মা, দেয়ালে রং করতেছি’। মা ধরে ফেলে ছেলের কথা। নিজের মতো অনুবাদ করে নিয়ে আহ্লাদে বলে,‘ও, বুঝতে পারছি বাবা, পাউরুটির দেয়ালে জেলি-রং মাখতেছো বাবা! খুব ভালো, বেশিক্ষণ রাইখা দিয়ো না, খাইয়া ফেলাও।’ তারপর নিজে থেকেই ফোন রেখে দেয় মা অথবা মন্টিÑকে? ঠিক মনে পড়ে না মন্টির। সে খালি রং করতে ব্যস্ত। নিজের রং করা দেখে নিজেই এবার বিহ্বল হয়ে পড়ে। এবার রং ধরছে। পাউরুটিটাকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে? ইচ্ছে করে বুয়াকে ডেকে এনে দেখায়। কিন্তু সাহস পায় না। এই বুয়াই হয়তো পাশের ফ্লাটে গিয়ে কথা লাগাবে, স্যার পাগল হইয়া গেছে। কিন্তু সে তো পাগল হতে চায় না।
আবারও হাল ছাড়ে না মন্টি! ফোনটা কেটে যাওয়ার পর স্মার্ট ফোনটাকে ইচ্ছে মতো বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে ঘষতে থাকে। অ্যাপসগুলোকে এদিক-ওদিক নাড়াচ্ছে। তার মনে হয়, স্ক্রিনের দেয়ালে বৃদ্ধাঙ্গুল নামক তুলি দিয়ে রং করতেছে। স্মার্টফোনটা রং ছড়াতে চায় না। কোত্থেকে যেন একদলা রং এসে ভর করে, আবার উবে যায়, ভর করে ভাসে, উবে যায়। এরকমের দেয়াল রং করা চলে মন্টির সারাদিন। হয়তো সারারাত। পাড়া-পড়শি কেউ দেখে না। মন্টি ইচ্ছে মতো রং করে চলে, একা একা। কেউ দেখে না এই শহরে কে কোথায় রং ছড়াচ্ছে! এমন কি মন্টির বিশতলার বারান্দা থেকে আসমানে কখন-কোন রং ছড়ায় তাও সে দেখে না, সে নিজের রং নিয়েই ব্যস্ত। নানা সময় নানা রং ছড়াতে থাকে দেয়ালে। এটা তার ‘আপনার একান্ত ব্যক্তিগত’ অভ্যাস।
মন্টির বাজার করা লাগে না, চাকরিও করা লাগে না। বুয়া তার জীবন-জীবিকার ম্যানেজার! যা যা লাগে স্লিপে লিখে দিয়ে বাজারে পাঠায়। শোরুম আর সুপারশপের জিনিসপত্র কেনায় কেয়ারটেকারকে দিয়ে। বুয়া গিয়ে কেয়ারটেকারকে রিকোয়েস্ট করে, স্যার পাঠাইছে। এই যেমন, কিছুদিন আগে কেয়ারটেকারই এনে দিল এই স্মার্টফোনটা। মন্টি অসুস্থ হলে ডাক্তার ডেকে আনে বুয়া, মাস গেলে চুল কাটার জন্য ডেকে নিয়ে আসে পাশের গলি থেকে নাপিতকে ইত্যাদি ইত্যাদি। বাবা মাস গেলে টাকা পাঠায় বুয়ার কাছে, মন্টি ধারও ধারে না এসবের। সব রেডি করে রাখে বুয়া। প্রথম প্রথম বুয়ার জন্য মায়া লাগতো তার। সে ভাবতো, একজন স্ত্রী লোক মন্টির সর্বত্র রং ছিটিয়ে যাচ্ছে, দিন-মান মন্টির দেয়াল রং করে যাচ্ছে। এখন ভাবতে ফালতু লাগে। তার মনে হয় রং করা অতো সহজ নয়। বুয়া তার ডিউটি পালন করছে মাত্র। মন্টির বাবা-মা বুয়াকে এজন্যই রেখেছে। রং ছড়াচ্ছে কেবল মন্টি। রং ছড়াতে গেলে জগতে মন্টি হতে হয়। মন্টি ছাড়া আর কয়জন পারে রং করতে। রং করতে আবীর লাগে, আইকা লাগে, পানি লাগে, ব্রাশ লাগে আর লাগে একটা পুরনো দেয়াল। যে সে দেয়াল না, একেবারে এবড়ো-থেবড়ো ইটের দেয়াল। স্থানে স্থানে ইস্টক বিভ্রান্ত দেয়াল, খসে পড়া লাগে রাঙাতে।
মন্টি এতটাই একা এ বাড়িতে তার জš§দিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিনটা এলেও কেউ মনে করিয়ে দেওয়ার নেই। শুধু অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহর থেকে ফোনে আসে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ মন্টি!’ কিছুদিন আগেও মা ফোন করে মনে করিয়ে দিলো তার বয়স এবার পঁয়ত্রিশ হয়েছে। ওরকম করে ভাবলে জীবনের অর্ধেক বয়স শেষ। এ নিয়ে তেমন চিন্তা করে না মন্টি। সে হিসেব করলে বিয়েও তো করা লাগে একটা। তারপর আবার প্রেম-টেম। পাত্তা দেয় না সে একদম। তার খালি একা একা থেকে দেয়াল রং করতেই ভালো লাগে। মাঝে পঁচিশ বছরের সময় মা একবার উদ্যোগ নিয়ে দেখেছে, উল্টো মন্টি বলেছে, আজকের আকাশে অনেক রং, আমি রঙের কাছে চলে যাই মা। ছেলের এইসব সাংকেতিক কথাবার্তা মা-ই শুধু ধরে ফেলতে পারে। মা বুঝে ফেলেছে এই কথার অর্থ হচ্ছে, ছেলেকে জোর-জবরদস্তি করে বিয়ে করালে সে দিন-দুপুরে অথবা জোৎøা রাতে ছাদ থেকে লাফ দেবে। তাই শুভ কাজে অশুভ লক্ষণ দেখে পিছিয়ে গেলেন বাবা-মা দু’জনে। এই দুজন ছাড়া আÍীয়-স্বজনের তো প্রশ্নই ওঠে না! কেউ নাই। মন্টি জানে তাদের কোনো আÍীয়-স্বজন নাই। গ্রামে কারা কারা যেন ছিল একসময়। এখন আর নেই। কেন নেই? সে মাঝে মাঝে ভাবে, এর জন্য কি কোনো ভাবে তার দেয়াল রাঙানোর অভ্যাসটা দায়ী। বাবাকে জিজ্ঞেস করেও ছিল একবার। বাবা বলেছে, না না! তুমি তোমার মতো দেয়াল রাঙাও। ওসব ভেবো না। এটা স্রেফ আমার জন্য হয়েছে। আমিই ইচ্ছে করে কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখি নি।’ হুম বলে ফোনটা রেখে দেবে এমন সময় বাবা আরো বলেছে, শোনো, জীবনে কোনো ক্ষেত্রেই আÍীয়-স্বজন লাগে না, শুধু মরার পর লাগে। তাও আজকের পৃথিবীতে লাগে না। মরলে কান্নার মানুষ ভাড়া পাওয়া যায়।’
একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে একবার ভর্তি হয়েছিল মন্টি। সেখানে গিয়ে দেখেছে, সব ছাই! কেউ রঙ করতে জানে না। একটা মেয়েকে বলেও ছিল কিভাবে দিন-রাত চাইলেই যে কেউ দেয়াল রাঙাতে পারে। মেয়েটা ক্ষেপে গিয়ে বলেছে, ‘আঁতেলদের জন্য তো শুনছি ঢাকায় একটা আলাদা মার্কেট আছে, এইখানে কি!’ তারপর থেকে কেউ রঙ করতে জানে না দেখে ওই ভার্সিটিতে আর যায় নি সে। বাবা-মা কয়েকবার বলেছিল,‘এখানে চলে আয় মন্টি, খুব ভালো লাগবে তোর, কি সুন্দর সবকিছু!’ মন্টি সোজা উত্তর দিয়েছে,‘সেখানে নিশ্চয়ই শ্যাওলা ধরা দেয়াল নাই, আছে? যাবো না।’ বাবা এও বলেছে,‘ওই রকম ক’টা দেয়াল চাস তুই, হাজারটা দেয়াল গড়ে দেবো, মানুষ চাইলে কি-না হয়। দেখিস নি চীনের দেয়াল, যাহ, তোরে কে বোঝাবে, থাক দেশে পড়ে!’ তাই দেশেই বস্তুত পড়ে আছে মন্টি। এখানে দেয়াল আছে তাই। ঢাকায় একটাই দেয়াল আছে তাই! সে রাঙাতো একসময়, এখন পারে না, রাঙাতে মন চায় মাঝেমাঝে, হাত নিশপিশ করে, রাঙাতে পারে না, রাঙাতে পায় না, বর্ণীল দেয়াল এই শহরে একটা, নদ্দায়, ওইসব দেশ নর্দমায়!!!
রাত-বিরাতে বেড়ালটা কার্নিশ দিয়ে ঘরে ঢুকতে চাইলেও পারে না, জানলা বন্ধ করে রাখে সে। এইটা একটা কালো আর হালকা কালো রকমের বিশ্রী বিড়াল তার চোখে। তাই আশপাশে জাগয়া নেই। বিড়াল এমন হবে কেন? বেড়াল তো হবে সাদা-ফকফকা শাদা রঙের। দূর থেকে দেখে মনে হবে তুলতুলে। মিনি দুধ খায় চুকচুক টাইপের! তাই না, তাইলেই তো সে আদার করে বুকের কাছে মানব সন্তানের মতো টেনে নিয়ে ব্রাশ বুলিয়ে রং করতে পারতো ইচ্ছে মতো। আরে! এইটা হয়েছে!!! হাসি পায়। যা শাদা রোম জন্মাতে পারলে আসিস, তবে রাঙিয়ে দেবো। মনে মনে ভাবে মন্টি। বেড়ালটা চলে যায়। অধিকার পায় না ঘরে আসার।
মন্টি একসাথে ডাবল সিগারেট খায় ইদানীং। একটা বেনসেন লাইট আরেকটা ইজি লাইটস। একটা মোটা একটা চিকন। কেন? সে নিজেও জানে না। ইচ্ছে হয় তাই। আগুনরঙ দিয়ে সাদা সিগারেটে রঙ করা যায় একেবারে ফিল্টার পর্যন্ত। একেকটা সিগারেটে একেকটা রং হয়। দুইটায় দুইরকম। টানে আর রঙ আনে! রঙ আনে আর টানে। একা একা। বাইরে থেকে বিড়ালটা হয়তো ভাবে, টান মনা ভালো করে টান, একটা তোর বাপ, একটা মা। টান দুইটারে টান। ভালো করে পোড়া! পোড়া!!! পুড়িয়ে দে!!! অথচ মন্টি ভালো ছেলে। দুধ খায়। দুধ খেতে খেতে তার মনে হয়, পেটের ভেতরে একটা তরল দেয়াল ঢুকিয়ে দিচ্ছে। জল জমে যেমন বরফ হয়ে যায় সাগরগর্ভে, তেমনি পেটগর্ভে দুধেল একটা দেয়াল হবে। অথচ রেডি হচ্ছে বুয়া। রাত নেমেছে বলে যাবে। আবার সকালে ফিরে আসবে বস্তি থেকে। ইচ্ছে করলে এই বাসাতেই সে কোনো একটা কক্ষে ঘুমিয়ে পড়তে পারে ইচ্ছে মতো অথবা চিরতরে, মন্টি তাকে ডাকবে না কখনো, চান্সই নাই কোনো। বুয়া চলে যায়। অথচ কার কাছে যায়? তার তো স্বামীও নাই, সংসারও নাই। ছেলে বলতে মন্টিকে ভাবে। বলতে সাহস পায় না। মন্টি এসব আবেগের ধারে কাছে নেই। যে রং দিয়ে এত সুন্দর সুন্দর দেয়াল বানায় সে এত ফালতু আর পাতানো সম্পর্কের দেয়ালে হেলবে না।
মন্টির বাবার কম করে হলেও দশটা নাম, তাই তাকে মন্টির বাবা অথবা আব্বা ডাকাই ভালো আর মন্টির মা যেহেতু মন্টির বাবার বউ তাই তারও কোনো নাম না দিয়ে তাকেও মন্টির মা বলাই উত্তম। মন্টির বাবা যৌবনে দাবার বোর্ড বা ছকের ব্যবসা করতেন। মহাখালীতে একটা দোকান ছিল তার। বিভিন্ন আইটেমের দাবার বোর্ড বেচতেন তিনি। দোকানের কোনো নাম ছিল না। অদ্ভুত! তবে বক্স কিংবা বিভিন্ন আকার-প্রকারের ও রঙের দাবার বোর্ড পাওয়া যেত দোকানে। নাম দিয়ে কাম কি, বোর্ডে পরিচয় টাইপের দোকান আর কি! সামনে একটা ছেলে বসতো সেলসম্যান কাম ক্যাশিয়ার হিসেবে আর পেছনে একটা খুপরি মতন রুমে তার বাবা বসতো। সারাদিন কি করতেন কেউ জানতো না। একটা রহস্য! কি এক কারণে দোকানের বাইরে গেলেও সেলসম্যানকে বলতে বলতেন ভেতরে ঘুমাচ্ছেন, এখন ডাকা যাবে না! কেউ এলে অন্য সময় আসতে বলতেন, দুপুরে এলে বিকেলে কিংবা বিকেলে কেউ এলে সন্ধ্যার পর, সন্ধ্যায় এলে রাতে, রাতে এলে পরদিন সকালে আসতে বলা হতো। মন্টির বাবার স্বভাব-চরিত্রে একটা সময় দাবা-দাবা ভাব চলে এসেছিল। এই কোনো কাজে জিতলে তিনি সকলকে শুনিয়ে শুনিয়ে বগল বাজাতেন,’কিস্তিমাত’। অথবা টেনশন থেকে মুক্তি পেলে বলতেন ‘যাহ শালা, চেক’। ঘরে ফিরে এসব কথা বলতে থাকলে মন্টি আর মন্টির মা কথার মাথাম-ু কিচ্ছু বুঝতেন না। শুনে থাকতেন। মাঝেমধ্যেই ঘুমের ঘোরে তার বাবা রাজা, মন্ত্রী, হাতি, ঘোড়া, নৌকাÑএসব বলে চেঁচাতো। কেউ অবাক হতো না। বোর্ড আর ঘুঁটি নিয়ে কাজকারবার তার বাবার। দিনে বেচেন আর রাতেও হয়তো বেচেন! কার কি! যার যার ঘুম সে সে যায়।
মন্টির বয়স তখন কত, সাত-আট বছর হবে হয়তো। প্রায়ই বাড়ি ফিরে আদর করে মন্টির থুতনি উঁচু করে ধরে দাবা নিয়ে ভাষণ দিত বাবা। একেকদিন একেকটা। আর কথায় কথায় বিখ্যাত দাবা খেলার উদাহরণ টানতো। এই যেমন, অমর গেম, অমর গেম হইলো গিয়া ১৮৫১ তে, এডল্ফ এনডারসন এবং লিওনেল কিয়েসেরিতস্কির মধ্যে, তারপর চিরসবুজ গেম, এর ঠিক একবছর পর- এডল্ফ এনডারসন এবং জঁ দুফ্রেস্নে, অপেরা গেমঃ পল মর্ফি এবং দুই মিত্র, ব্রানস্উইক-এর ডিউক ও কাউন্ট ইসুয়ার্ডÑ১৮৫৮ তে। বিরক্ত হয়ে যেত তার মা, আর কিচ্ছু বুঝতো বলে মনে হয় না মন্টি। তবুও বলতেই থাকতো বাবা, কি আনন্দ পেত কে জানে! লস্কর এবং বাওয়ার, এমস্টার্ড্যাম, ১৮৮৯, বিখ্যাত জোড়া হস্তি খাওয়ার প্রথম উদাহরণ, শতাব্দীর সেরা গেম, ববি ফিশার এবং ডনাল্ড বায়ার্ন, ১৯৫৬ তে। তারপর তারপর কম্পিউটারে। যুগ বদলাইছে। ডীপ ব্লু এবং কাসপারভ, ১৯৯৬, গেম ১, ইতিহাসের প্রথম গেম যাতে একটি কম্পিউটার বিশ্বসেরা দাবাড়–কে পরাজিত করে... এত কথা কোথা থেকে পান মন্টির আব্বা! তার মা খালি অবাক হয়। হয়তো ভাবতো, দাবার বোর্ডের প্যাকেটের গায়ে বোধ হয় এসব লেখা থাকে আর তার স্বামী মুখস্ত করে এসে তাকে খালি শোনায়। শোনায়, মুখস্ত করে। মন্টির মা খালি বলতো, ‘আহ্, রহস্য করার জায়গা পাও না, ধোৎ।’ মাঝেমধ্যে সে বিরক্ত হয়ে যেতো। তারপর হাসতো আর হাসতো মন্টির বাবা। তাই আপাতপক্ষে মন্টির বাবা ঘরেও রহস্য, বাইরেও রহস্য! এলাকাবাসীর কাছে মন্টির বাবা তো ছিল বিরাট এক রহস্য! অবশ্য এলাকাবাসীকে সে রহস্যের কুল-কিনারা না করতে দিয়েই তিনি দেশত্যাগ করেছেন। সঙ্গে ছিল মন্টির একমাত্র মা। মা তো একমাত্রই হয়? না-কি?
মন্টি ঘরের মধ্যেই বছরের পর বছর ধরে হাঁটিতেছে। সাক্ষী একমাত্র বুয়া। মন্টি মাঝে-মাঝে অনর্থক ড্রয়িং রুম থেকে বেড রুম, বেড রুম থেকে বারান্দা হয়ে খালি পায়চারী করে। তখন ভয় পায় বুয়া। চোখ বন্ধ করে হাঁটে সে। কোথাও যেন যন্ত্রণা রয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে হাঁটার সময় প্রথম দিকে পায়ের বাড়িতে ঘরের জিনিসপত্র পড়ে যেত, বুয়া দৌড় দিয়ে এসে হাজির,একটা পড়ে তো পরের টা ওঠানোর জন্য প্রস্তুত হয়, এভাবে পড়ে আর ওঠায়। সে হাঁটে আর পড়ে। পড়ে আর হাঁটে। বুয়া ঠিক করে থোয়। এখন আর পড়ে না, চোখ বন্ধ করে হাঁটে মন্টি, ইচ্ছে করলেই হাঁটে। বুয়া দৌড়ে এসে হাজির হয়। চোখ বন্ধ রাখা অবস্থাতেই সে বলে দিতে পারে বুয়া এসেছে। এমন কি বুয়া বিড়ালের মতো এসে হাজির হলেও। এখন আর কোনো জিনিস পড়ে যায় না। বুয়ার মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে, স্যার, কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসেন না। ও স্যার, সারাদিন ঘরে! এইডা কি জেলখানা। অপরদিকে মন্টিরও বুয়ার জন্য উত্তর গোছানো, সে ভাবে, বুয়া যদি সত্যিই কোনো দিন সাহস করে জানতে চায় তবে বলবে, স্বেচ্ছানির্বাসন বোঝো তুমি? বোঝো না, এ হচ্ছে নিজে থেকে রং করার জন্য থেকে যাওয়া...। মাঝে মাঝে স্যারের ঘটনাচক্রে হাসি পায় বুয়ার। কিন্তু হাসে না। ভাবে, কখনো একবার হেসে দেখবে, কি বলে মন্টি! যার হাঁটা সে হাঁটতেছে, এই শহর-নগর-বন্দরবাসীর অগোচরে একাকী সে হাঁটতেছে। ঘরে। ঘরে। ঘরে। বছরবছরবছর! বুয়ার ছোট মাথায় খেলে না। বুয়া হয়তো ভাবছে, স্যার দীর্ঘদিন ঘরে হাঁটার অভ্যাস করে মহাহাঁটার প্রস্তুতি নিতেছে। হয়তো একদিন দরজা খুলে বেরিয়ে পড়বে। আসলে কি ভাবে বুয়া। ভাবে কি? কোথায় হাঁটতে যেতে পারে তার এই পৃথিবীর একমাত্র স্যারটি। মাথায় ধরবে না বুয়ার, তাই ভাবেও না।
তবে বুয়া এটা ভাবে, মন্টির বাবা-মার দিলে মহব্বত নাই, থাকলে মন্টিরে দেখতে আসে না কেন! এটা সে ভাবে, কিন্তু মাথায় ঢোকে না। মন্টিতো তাদের ছেলে হয়, না! তাইলে? বছরে এক বার না হোক দুই বছর তিন বছর বাদে তো একবার আসতে পারে। আসে না তো। মন্টি বাবা-মার পথ চেয়ে বসে থাকে না তাই হয়তো বুয়া পথ চেয়ে বসে আছে। সেই কবে তাকে ঠিক করে দিয়ে গেছে ছেলেকে দেখাশোনা করার জন্য! ভাগ্যিস ফোন যন্ত্রটা আসছে, নইলে এদের যেমন রিসতা তাতে করে চিঠি লেখার লোক এরা কেউ না। না মন্টি, না তার বাবা না মা। মন্টি নিজেও জানে না কেন তার বাবা-মা আসে না। এটা একটা বিরাট রহস্য। তবে সে যদি খালি নীল রং দেয়ালে না মাখাতো তবে হয়তো এই রহস্যের একটা সুরাহা করতে পারতো। এখন সময় কোথায় তার? সে আছে রাঙানোর তালে। রাঙাতেরাঙাতেরাঙাতে সে একটা নীল রঙের ডাস্টবিন হয়ে পড়েছে যেন! তার গায়ে লেখা ‘ইউজ মি’। অধিক ময়লার ভেতরে একটা নীল রঙের ময়লার বাকসো দাঁড়িয়ে থাকে তিন-বেলা, তিন সীমানায়। কেউ দেখার নেই, কাউকে দেখানোর নেই। মনে কর, একটা শূন্য উদ্যান, খালিখালিখালি! অনেক তাকানোর পরে হঠাৎ কোথাও কোনে একটা নীল রঙের এমন ডাস্টবিন চোখে পড়েÑতা বাতিঘর, বেঁচে থাকার স্বপ্নের বাতিঘর, তীরে ফেরার অবলম্বন। মন্টির এমন একটা অবলম্বন আছে বিধায় বাবা-মা অজ্ঞাত কারনে দেশে এসে বছর বছর তাকে দেখে যায় না। তাই হতাশ হয় মন্টি। আসলে কি হতাশা হয়? অবশেষে সে ওয়াশরুমে ঢুকে তিব্বতমার্কা নীল রঙের সাবান মাখে সারা গায়। শরীরের দেয়ালে নীলসাবান দিয়ে রাঙায়। রাঙে না, ফেনা হয়! সাদা সাদা ফেনা। কোথায় নীল নেই। তবুও বিড়াল ও বাঘ যেমন অনেকক্ষণ পর হঠাৎ মোলায়েম গতিতে মন্থরেমন্থরে চক্ষুবুঁজে তেমনি মন্টিও দু’চোখ বন্ধ করে খোলার আগে ফেনার ভেতর নীল দেখে। নীলেনীলে স্বপ্নিল! পানিতে নীল ধুয়ে যায়, বাবা-মার না আসার বেদনাও ধুয়ে যায়। এসব নিয়ে ভাববার সময় কোথায় মন্টির! এইতো একটু পরে আবার গভীর আরাম নিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘরময় হাঁটবে, আর পায়ের পাতার তুলিতে ঘরে ঘরে নীল রঙে রাঙাবে। তারপর আর টাইলসে হাঁটবে না, বুয়ারও এদিক দিয়ে হাঁটা নিষেধ, একেবারে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দু’জনের জন্য, যদি না নীল উঠে যায় কারো আলতো পায়ের ছোঁয়ায়।
আবারো মনে পড়ে, শুধু তাকে যেতে বলে তাই সে যায় না। যাওয়ার সময় সঙ্গে নিতে চেয়েছিল, সে যাইনি দেয়াল রঙ করার কাজ আছে তার, দেয়াল দেখার কাজ আছে তার। কিছুদিন পর পর মা ফোন করে বলে,‘বাবা মন্টি আসবি না মাকে দেখতে?’ সে সাফ জানিয়ে দেয় একশব্দে,‘না’। এইকথাও কখনো বলে না,‘তুমরা আসো’। তাই কেউ আর আসে না। বুয়া ও মন্টি শান্তিনগরের বিশতলার ফ্ল্যাটে অজানা শান্তিতে আছে আর বাবা-মা সিডনীতে শান্তি বা অশান্তিতে আছে। কেউ নড়ে না, চড়ে না। অথচ ঘটনা সরেজমিনে তদন্ত করার মতো, আবার কেউ সময়ও পায় না তদন্ত করার, যার যার মতো সে সে ব্যস্ত। যার যার জীবন নিয়ে সে সে যাপতেছে!
মন্টি মায়ের কাছে শুনেছে তার বাবা চৌকস ও ঝানু দাবাড়– ছিলেন যৌবনে। তবে সে কখনো বাবাকে দাবা খেলতে দেখেনি। খালি মায়ের কাছে গল্পই শুনেছে। মন্টি জšে§র পর থেকেই বাবার দাবা খেলার গল্প শুনে বড় হয়েছে, কিন্তু একবারও নিজ চোখে দেখেনি বাবাকে দাবা খেলতে কিংবা এমনও দেখেনি কেউ দাবা খেলছে আর বাবা বোর্ডে চোখ ফেলে বসে আছে। আসলে সে বাবাকেই তেমন দেখেনি। তার মাও যে দেখেছে সে কথা বলা যায় না। তাই হয়তো এই মা সান্ত¡না স্বরূপ বাবার দাবা খেলার কৃতিত্বের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে। কি আজব! এই স্মৃতি ধূসরও হয়ে যায় না। বাবা বাসায় আসতো রাত একটা-দুইটায়। আবার চলে যেত ভোর হওয়ার আগেই। কোথায় কে জানে? মন্টি তো ঘুমে থাকতো। বাবা কেমনে আসে এবং যায় কোনটাই সে দেখতে পেতো না। এটা নিয়ে তার দুঃখ করার সুযোগ নেই, বাবা পুষিয়ে দিতেন অন্যভাবে। মন্টির মনে আছে, সে গুলশানের ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে স্ট্যান্ডার্ড টু-থ্রিতে পড়ার সময় বাবা প্রায়ই তাকে স্কুলের গেট থেকে হাত বাড়িয়ে বাইরে নিয়ে আসতো। তারপর রিকশায় তুলে দিয়ে কোথায় যেন আবার হাওয়া হয়ে যেতো, কোথায়? মন্টির রিকশা সোজা চলে আসতো তাদের নদ্দার বাসায়। বাসায় এলে মা জিজ্ঞেস করতো, বাবা এসেছিল? মন্টি মাথা ঝাঁকিয়েই জবাব দিত এসেছিল। এতে তার কোনো আমোদ ছিল না।
তো, সেই বছরগুলোরই কোনো একটা দিনে, যখন মন্টির বাবার সঙ্গে প্রায়ই তার দেখা হতো স্কুলের গেটে, সেই কালে তখন কি যেন প্রেম-টেম ঘটেছিল স্কুলের বাউন্ডারির বাইরের আশে-পাশে অর্থাৎ স্কুল সংলগ্ন কোনো এক কাঁঠালতলায়।
প্রসন্ন অন্য কারো বউ। কার বউ জানে না আসিফ। কখনও জানতেও চায়নি। সে শুধু জানে অন্যের বউকে ভালোবাসতে হলে বউয়ের স্বামীকে শুরুতে একটা নিরাপদ স্থানে রেখে আসতে হয়। তাই পরিচয়ের প্রথমদিনেই আসিফ বলেছিল প্রসন্নকে,‘হাসব্যা- হইলো গিয়া ‘গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার’, জনগন চাইলেও সরকার আছে, না চাইলেও আছে। তোমার আমার মধ্যে প্রেম হইলেও সে আছে, না হইলেও আছে। এভাবেই আসিফ প্রসন্নের হাসব্যান্ডকে একটা নির্দিষ্ট মর্যাদার আসনে বসিয়ে প্রসন্নের আসন দখল করে নেয়। তারপর আসিফ জানে স্বামীবিদেশ মেয়ে মানুষের প্রেম হওয়ার বেশি চান্স থাকে দুইটা জায়গায়। ১. টেইলার্সের দর্জির লগে ২. স্বর্ণকার বা আপনালয়ের সেলসম্যানের লগে। প্রসন্নের স্বামীও বিদেশে থাকেন, সূদুর চীনে হবে হয়তো। তাই উপরিউক্ত দুই সম্প্রদায়ের হস্তগত হওয়ার আগেই প্রসন্নকে হাত করে আসিফ। তাকে বাড়তি ক্রেডিট দিতেই হয় এজন্য যে, সে নিয়মের ব্যতয় ঘটিয়েছে। সে দর্জিও না, স্বর্ণকারও না, সে ছাত্র। এছাড়া অন্যের বউয়ের সঙ্গে রিসতা করতে হলে আরো কিছু বাড়তি গুণ তো লাগেই। আসিফ জানে গুণগুলো ক্রমে ক্রমেÑ শারীরিক: প্রথম দর্শনের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ছেলেদের শারীরিক বিভিন্ন বিষয় খেয়াল করে দেখে মেয়েরা। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চতা, ফিগার, চুল, চোখ ইত্যাদি। এ কারণে কারো দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এসব ঠিক রাখা জরুরি। এ ছাড়াও রয়েছে দাড়ি-মোচ, নখ ইত্যাদির পরিচ্ছন্নতা। ফ্যাশন ও স্টাইল: এর পরের কয়েক সেকেন্ড ছেলেদের ফ্যাশন ও স্টাইল লক্ষ করে মেয়েরা। তার মানে এই নয় যে, সবাইকে সিনেমার নায়কদের মতো করে পোশাক পরতে হবে। তবে ফ্যাশনে কোনো বেমানান বিষয় থাকলে তখন তা নজরে পড়ে। এর মধ্যে রয়েছে বেমানান জুতা বা এ ধরনের বিষয়। আত্মবিশ্বাস: অন্যের বউয়েরা পছন্দ করে নিজস্ব মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গী আছে এমন সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী ছেলে। যা তার স্বামীর মধ্যে একেবারেই নাই। প্রথম কথাবার্তাতেই তারা কারো আত্মবিশ্বাস ও বিভিন্ন বিষয়ে ইতিবাচক ও নেতিবাচক মতামত জানার চেষ্টা করে। তবে কথাবার্তায় সবসময় নেতৃত্ব দেয়ার চেষ্টা আর অতিরিক্ত স্মার্টের অভিনয় না করাই ভালো। যোগাযোগ দক্ষতা: কথাবার্তা ঠিকঠাক চালিয়ে নিতে না পারলে ছেলেদের বোরিং বলেই মনে হবে। এ কারণে এক লাইনের কথাবার্তা বাদ দিয়ে প্রাণোচ্ছল কথাবার্তার সেশন চালিয়ে নিতে হবে। রসবোধ: যেসব ছেলেদের ভালো সেন্স অফ হিউমার আছে তাদের অন্যের বউয়েরা পছন্দ করে। এজন্য করে যে, দীর্ঘদিন যাবত এক ছাদের নিচে থেকেও রসিক স্বামীর সাক্ষাত পায় নাই তারা। প্রথম কথাবার্তা এজন্য হালকা ও মজার কোনো বিষয় দিয়ে শুরু করাই ভালো। নোংরা কথা ও জোকস এড়িয়ে সুস্থ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে বোনাস পয়েন্ট সংগ্রহ করা সম্ভব।
তবে সবচেয়ে বড় কথা, ঢাকার রাস্তায় এরকম কত প্রেমই হয়ে যায়! ভবিষ্যতেও হবে! তাই প্রসন্ন আর আসিফের পরিচয় ও প্রেম-টেম নিয়ে পথিকের তেমন মাথাব্যাথা নাই, তারা যেভাবে হোক সুখে-শান্তিতে আটটা-পাঁচটা দিন কাটাতে পারলেই হলো। এইটুকু প্রত্যাশার চক্করে ঘুরতে থাকে পথিকরা, আর সেই সুযোগে রিকশার চাকা ঘুরতে থাকে। হুড তুলে দিয়ে গদিতে চড়ে বসে আসিফ-প্রসন্ন। তাদের মধ্যে কত কথা হয়, হাত ধরাধরি হয়, জড়াজড়ি হয়, হয় না এরকম, আরো কত কিছু হয়, যা হওয়ার তাই হয়Ñরিকশাওলার এই নিয়ে ভাবান্তর নাই। রিকশাটা দুপুরের কোনো এক সময়, আজ থেকে বিশ বছর আগের চাকাদুটোকে ঘোরাতে ঘোরাতে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ক্রস করে। বস্তুত প্রেমঘটিত পরিস্থিতিতে একটা ক্রস এঁকে দিয়ে যায়। আসিফ কি যেন দেখেছে! অনেক ভেবে নিয়ে তারপর প্রসন্নকে বলে,‘একটা ব্যাপার দেইখা আমি টাসকিত!’ প্রসন্ন গভীর আগ্রহে জানতে চায়,‘কী?’ ‘খেয়াল কইরা দেখছো, আরে, তোমার সাথে পরিচয় হইয়া তো আমার মাথা খুইলা গেছে! দেখছো, খুইলা গেছে না! এই যে ইশকুলের গেটে বাচ্চা-কাচ্চাদের নিতে আসে বাবা-মারা। আমার এই দৃশ্য দেইখা কি মনে হয় জানো? মনে হয়, স্বর্গ-নরকের দেখা হইতেছে। কি ইনোচেন্ট-কিউট পুতুলের মতো বাচ্চাগুলা ইশকুলের গেইট দিয়া বাইরায় আর তাদের হাত ধইরা নরকে ঢোকায় টাউট-বাটপার বাপ-মাগুলা। দেখছো না, একটু আগে!’ এক নিঃশ্বাসে বলে যায় আসিফ। প্রসন্ন কি খুশি?
কথাটা বলতে না বলতেই রিকশার বেল ক্রিং ক্রিং বাজতে থাকে আর সঙ্গে সঙ্গে আসিফের মাথার মধ্যে ফ্যান ঘোরে একখানা শব্দেরÑবেঢপবেঢপবেঢপবেঢপবেঢপবেঢপবেঢপবেঢপবেঢপবেঢপ! মন্টির বয়স দশম বৎসর অতিক্রান্ত হতে চলেছে! তার নীল দেয়ালের সামনে উপস্থিত হয় আসিফ। অবাক হয়ে ফিরে যায়। আবার দেখা হবে দেয়াল! শুভ বিদায়!
মন্টি একটা বেড়াল দেখতে পেয়েছিল। ধবধবে শাদা রঙের। আর তার সত্যিকারের দুইটা বিড়ালাক্ষি। বেড়ালের ‘বেড়ালের চোখ’ আর কি! মন্টি এক দিন কি যেন মনে করে বেড়ালটাকে হাত দিয়ে ধরে, অবশ্য বেড়ালটার তখন হাত দিয়ে ধরার মতোই বয়স, এক্কেবারে ছোট। দৌড়াতে পারে না, ভয় গজায় নাই মাথায়। এর আগে একবার একটা কুকুরছানাকে লাথি দিয়েছিল বলে মন্টির মা তাকে ধমক দিয়ে বলেছিল,‘খবরদার মন্টি, জীবে দয়া করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’! এরপর থেকে মন্টি কুকুর-বিড়াল যাই দেখে আদর করতে ছুটে যায়। এইবার একটা বেড়াল ছানা পেয়ে বুকে টেনে নেয়, জানে মা মাইন্ড করবে না, তার পারমিশন আছে। কিছুদিন পর একটা ঘটনায় মায়ের কলিজা ধড়পড় করে ওঠে। দুপুর বেলা ঘুম ভাঙলে মন্টির মা দেখে মন্টি সেই বেড়ালছানাটাকে রঙ্গাচ্ছে। কাপড় ধোয়ার নীল পানিতে গুলে আঙুলে মাখিয়ে বুলিয়ে দিচ্ছে বেড়ালের শাদাশাদা পশমের মধ্যে। মন্টির মা ধমক দেয়,‘এই তোর সেবার নমুনা! বেড়ালের সর্দি হবে না!’ মন্টি খালি নীল রং মাখায়। নীল মাখায় আর নীল মাখায়, একটু পর শাদা বেড়ালটা নীল রঙের হয়ে আস্তে আস্তে দৌড়ানো শিখতে শুরু করে। মন্টির মনে হয়, সে রঙ করতে জানে। এভাবে বেড়ালের রং ধূসর হতে থাকলে কিছু দিন পর পর সে রং করে রঙে ফেরায় বেড়ালটাকে। কেন যে সে নীল রং করে সে নিজেও জানে। এই বয়সে জানারও কথা নয়। ভালো লাগে বলে রাঙায়। বেড়ালটারও কোনো অসুবিধা হতে দেখছে না। বেড়ালটা এঘর থেকে ওঘরে ছুটোছুটি করে, বাইরে বেড়াতে যায়। স্কুলে যাওয়ার সময় মন্টি হয়তো তাকে দেখেই যেতে পারে না, কোন ঘরে ঘুমিয়েছে কে জানে অথবা বাইরে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরছে বা কোন ছাদের নীচে ঘুমিয়ে পড়ে আছে, তবে দুপুরে ফেরার পর কিংবা বিকেলে একবারের জন্য সে মন্টির কাছে ঘেঁষে। মন্টি লক্ষ করছে, যতই বেড়ালটা বড় হচ্ছে ততই তাকে নীলের নেশা পেয়েছে। গায়ে নীল মাখানোর জন্য মন্টির পায়ের কাছে ঘোরাঘুরি করে এখন। মন্টি বুঝতে পারে। তাই ধূসর না হতেই নীলের ওপর আবার নীলের প্রলেপ দেয়। ডাবল নীলে একই রকম দেখায় বেড়ালটাকে। কিছুদিন না যেতেই বেড়ালটার নাম দেয় নীলা। তারপর কি এক অজ্ঞাত কারণে মন্টি বেড়ালের গায়ে রং দেওয়া ছেড়ে দেয়। নীলা পালিয়ে যায় হয়তো বুঝতে পেরে। নীলা আর আসে না, এমন কি রাতের আন্ধারেও না! নীলা নীলে নীলে নাই হয়ে গেছে!
অথচ রাঙানোর নেশা ছেড়ে যায় না মন্টিকে। সে আবীর কিনে এনে পানিতে ছড়িয়ে দেয়, ব্রাশ যোগাড় করেÑবসে থাকে কোথায় রাঙাবে ভেবে? পাশের একটা রঙের দোকান থেকে নিয়ে আসে এসব। দোকানে গিয়ে এদিক-ওদিক চায়। দোকানদার বুঝতে পারে, বাচ্চা মানুষ, যেমন খুশি তেমন আঁকতে চায়, তাই রং খুঁজতেছে। দোকানদার তাই শিশুতোষ রং ধরিয়ে দেয়।
এক বিকেলে মন্টি দেয়ালে নীল রং মাখানো শুরু করে। ব্রাশে রং মাখিয়ে শুধু শুধু দেয়ালে ঘষতে ঘষতে থাকে। ঘষতে ঘষতে ক্লান্ত হয়ে বাসায় যায়। তাদের বাসায়। এই বাসাটাই নদ্দায়। পুরো নদ্দায় এরকম বাসা আর একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার বাবা কেমন করে যেন খুঁজে পেয়েছে! কেন খুঁজে পেয়েছে? এই বাসাটা এক চালা টিনের। বাইরের সীমানাপ্রাচীরের দেয়ালটাও ঘরের একটা দেয়াল। সেই দেয়ালটা ইটের, এবড়ো-থেবড়ো, ইট-সুরকি খসে খসে পড়ছে। বহু আগের পুরনো টিনের ঘর আর যুগপৎ রাস্তার দেয়াল ও টিনের ঘরের দেয়াল। মন্টি সেই দেয়ালে নীল রং ঘষে। দেয়ালটা সুন্দর হয়ে ওঠে। মন্টি এমনি এমনি রং ঘষে, অথচ কত সুন্দর হয়! সুন্দর হয়! মন্টির মা ডাক-দোহাই দেয় না, মন্টির বাবা তো বাইরে বাইরেই, তাই সে সুযোগটা কাজে লাগায় আরো বেশি করে। মন্টির মা হয়তো ভাবে, থাক, অনেক পুরনো আর বিশ্রী দেয়াল, মন্টি বরং ওটাকে নীল রং ঘষে ঘষে সুন্দর করে তুলছে। একটু রংই তো! আর তো কিছু না, লাগান না রং, লাগুন না রং, অসুবিধা নেই। তাই নির্বিঘেœ রং লাগতে থাকে। মন্টি ইটের লাল আর চুনের সাদা সব ঢেকে দিতে পেরেছে নীলে! দেয়ালটা তখন থেকে পুরোপুরি নীল! এই নীল দেয়ালটায় চোখ পড়েছিল আসিফের। তার চোখে নীলের রং আর মনে অন্যের বউয়ের প্রেমের রং! প্রথম দর্শনে তাই দুইটা মিলে গুলিয়ে গেছে। হয়তো দেয়ালের নীল আর প্রেমের মেরুন মিলে অন্য কোনো রং তৈরি হওয়ায় যুবক একটা রংও ধরতে পারে নি ঠিক মতো।
মন্টি দেয়াল রাঙানোর মজায় ভুগছে। সুযোগ পেলেই খালি রাঙায়। শুধু নীলে। আশ-পাশের মানুষজনও কিছু বলে না, তারা যে যার মতো বুঝের মানুষ, পোলাপানের কাজে সহজে নজর যায় না, যদি না তাদের কোনো ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। মন্টি তাদের বাসার দেয়াল রাঙাচ্ছে, তাতে কার চোখ পড়ার কি আছে? কেউ কিছু বলে না। নাবালকের কাজ তাই চলছে!
মন্টি এখন বুঝতে পারে সব। সবকিছু। কে তার বাবা। কেন তার বাবা। শৈশবের নীলের মধ্যে বাবাকে অত চিনতে পারে নি। এখন যৌবনের নীলের মধ্যে বাবার আসল চেহারাটা দেখা যায়। সহজ করে বললে, মন্টির বাবা ছিলেন ঢাকার সব ঘাটের দালালদের বাবা। এই যেমন, পাসপোর্ট অফিস, সিটি করপোরেশন অফিস, পানি-বিদ্যুত-গ্যাস-খনিজ ইত্যাদি অফিস। এজন্য অনেক সাধনা করতে হয়েছে তাকে। দিনের পর দিন এসব অফিসের সামনে গিয়ে না খেয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছেন কোন কাজগুলোতে মানুষের ঠেকা বেশি, মানুষ অন্যের সাহায্য ছাড়া করতে পারে না। সেই কাজগুলো তিনি বুঝে নিয়েছেন। গোপনে গোপনে দলে-দলে লোক সাপ্লাই দিয়েছেন, যারা প্রশিক্ষিত। যারা লোকেদের বিপদ দেখলে আঁতকে ওঠে বলে, ও বাবা, এ বিশাল ঝামেলার কাজ, আপনি একা সামলাতে পারবেন না, আমারে কিছু টাকা দেন কইরা দেই। লোকেরা যখন দেখলো এদের সাহায্য ছাড়া কাজ এগুচ্ছে না, ফাইল নড়ছে না, আটকে থাকছে লাইনলাইনলাইনÑতখন এদের হস্ত চুমে ইস্তফা!
সেই দালালদলের প্রধান ছিলেন মন্টির বাবা। মন্টি এখনো জানে না, জানে কি? মন্টির মাও হয়তো জানেন না, টের পান, তার স্বামীর এত টাকার উৎস কী? মন্টির বাবার এত এত টাকা, তবুও এই বাহুল্য নেই, নিুবিত্তের টিনের বাড়িতে থাকারও একটা রহস্য আছে। মন্টি আর তার মা কখনো তা জানে না। জানতে চায় নি। কেন? আসলে এতে সন্দেহ বাড়ে। রাষ্ট্রের সন্দেহ বাড়ে মন্টির বাবার ওপর। তাই তিনি কখনোই দেখাতে চান নি নিজের শৌর্যবীর্য। আড়াল করে রেখেছিলেন প্রকৃত স্বরূপ। অঢেল টাকা ব্যাংকে থাকলেও ছিলেন একচালা টিনের ঘরে, নিজের আইডেন্টিটি দাঁড় করিয়েছিলেন যৌবনে দাবা খোলোয়াড় আর পরবর্তীকালে মন্টি আর মন্টির মায়ের সময়ে দাবা বোর্ডের দোকানদার। তলে তলে একটা সময়ে তিনিই ঠিক করতে থাকলেন এই শহরের বড় বড় চেয়ারগুলোতে কখন কে বসবে। কোন ওয়ার্ডের কে কখন খুন হবে আর কে পথ ক্লিয়ার হয়ে যাওয়ায় কমিশনার হবে, মেয়র হবে। একজন দাবা খোলোয়ার এভাবেই পুরো শহরটাকে একটা দাবার বোর্ড বানিয়ে ফেলে।
মন্টিরা এসব ধরতে পারে নি কখনো। তার আর তার মায়ের জীবন তার বাবার প্রকৃত স্বরূপের বাইরে ছিল, বাবার মুখোশের সমান তারা।
মন্টির বাবার বড় সাধ ছিল একসময় বিদেশে চলে যাবেন। টাকা পয়সা সব নিয়ে। দেশে কিছুই করবেন না তিনি। হয়তো তার এও সাধ ছিল আর কখনো দেশেই না ফেরার। হলোও তাই। মন্টি তাই একা। সে বাবার সঙ্গে যায় নি।
সে পড়ে আছে নীল রঙের দেয়াল জড়িয়ে। দেশে। ঢাকায়। নদ্দায়। শান্তিনগরে।
অবশেষে মন্টির বাবার উত্থানের একেবারে শীর্ষবিন্দুতে একদিন তিনি রাতের বেলা ছেলের পায়ের কাছে এসে বসলেন। তারপর মাথার কাছে গিয়ে কপালে হাত রাখলেন। জেগে গেল মন্টি। পাশের ঘরে থেকে মন্টির মা টের পেলেন না। মন্টির বাবা তাকে বলল,‘বাবা, তোর বিলবোর্ডটা দরকার।’ মন্টি উত্তর দিল,‘এইটা তো বিলবোর্ড না, দেয়াল’। এরমধ্যে দেয়ালটা মন্টির বয়স বাড়িয়ে নিয়েছে। শুষে নিয়েছে অনেকগুলো বছর। মন্টি তখন পনের বছরের কিশোর।
বাবা বলল,‘এখন তো তুই বড় হইছিস, আর কি আঁকবি দেয়ালে, দিয়া দে, তোর দেয়ালে আরো উন্নত একটা ডিজাইন আঁকাইয়া দিতাছি শিল্পী আইন্যা।’ মন্টি শুধু বলল,‘সকালে জানাই?’ আচ্ছা বলে ঘুমাতে গেল বাবা।
পরদিন দেয়াল থেকে নীল রং উধাও। সেখানে কত কত রঙের খেলা! বড় বড় শিল্পীরা একমনে একধ্যানে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা মেট্টো শপিংমলে মাস ব্যাপী মেলা। বাহারি রং-ডিজাইনের পোশাকের মেলা। তারপর আবার ফ্যাশন উইক। সেজন্য মন্টির নীল দেয়াল ছেয়ে গেছে রঙে। প্রচার চলছে মেলার। দেয়ালটার কাছেই শপিংমলটা। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় শপিং মল নাকি এটা। কিন্তু তার প্রচার এই ছোট্ট ক্যানভাসে কেন? সেদিন ছোট মাথায় ধরে নি মন্টির। এখন ধরে। সে সব বুঝতে পারে। বাবা তার নীল দেয়ালটা দখল করেছে কৌশলে। তার শৈশব-কৈশোরটাও চুরি করেছে সে।
মন্টি এক সময় একেকটা আঁকতো দেয়ালে, নীল রঙে। শীত-বর্ষা-গ্রীষ্ম সহ ছয় ঋতুতে ছয় রকমের আঁচড় কাটতো দেয়ালে। দুইমাস পর পর বদলে যেত তার দেয়াল। অনেক সুন্দর সুন্দর দৃশ্য এঁকে রাখতো সে। অথচ একটা দৃশ্যও কেউ দেখে বুঝতে পারতো না ঠিক কী এঁকেছে কিশোর। আর তা শৈশব থেকেই এঁকে যাচ্ছিল মন্টি। তার আঁকাআঁকি দেখার জন্য প্রতিদিন শহরের আনাচ-কানাচ থেকে ছুটে আসতো মানুষেরা। কম করে হলেও পাঁচশ মানুষ। অবিশ্বাস্য! পুরো শহরের একটা বড়োসড়ো আকর্ষণ ছিল এই দেয়াল। অথচ কিছুই টের পায়নি মন্টি। সে রাতে আঁকতো, সকালে স্কুলে চলে যেত। কখন কে আসতো-যেতো জানতো না। তার দেয়াল নিয়ে মানুষের এই যে কৌতূহল তার কিছুই সে টের পায় নি। এই দেয়ালের ছবি ছাপা হয়েছে দেশের সবগুলো পত্রিকায়, বিস্ময়কর নীল দেয়াল। বড় বড় শিল্পীরা এটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করেছে। টিভি-মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। তারা অনেক চেষ্টা করেও মন্টির সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। মন্টির বাবা তা হতে দেন নি। কারণ তিনি ভয়ে আতংকিত ছিলেন কেঁচো খুড়তে না সাপ বেড়িয়ে যায়। মন্টি যদি স্টার হয় তবে সবাই জানতে চাইবে কে তার মা, কে তার বাবা। দিনে দিনে কখনো যদি কোনো ভাবে ফাঁস হয়ে যায় বাবার রহস্য। পুত্রকে চিনতে গিয়ে কেউ যদি চিনতে চায় বাবাকে? তাহলে? তাই তিনি মন্টিকে আড়ালে রাখলেন। বুঝতে দেন নি এসব। অথচ মন্টি ঠিকই নিয়ম করে রাত-বিরাতে দেয়াল রাঙাতো। নীল রঙে।
বিখ্যাত এই দেয়ালে যখন পুরো শহরবাসীর নজর ঠিক তখনই এই দেয়ালে নজর পড়লো তার বাবার। এমন কি এই ছিমছাম সাধারণ বাড়িটাকেও মানুষ চিনতে শুরু করলো এই দেয়ালেরই রঙে। তারা এই বাড়িটার নাম দিলো, কালার হাউজ। মেট্টো শপিংমলে শেয়ার আছে মন্টির বাবার। তাই তিনি এই দেয়ালটার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে সেখানে পোশাকের মেলা আর ফ্যাশন উইকের বিজ্ঞাপন দিলেন! দেয়াল দখলের পর কী ঘটলো মন্টি জানে না। যে দিন দেয়ালে বিজ্ঞাপন আঁকা হলো সেদিন বিকেলেই কি এক অজ্ঞাত কারণে শান্তিনগরের বিশতলার এই ফ্ল্যাটে চলে এলো মন্টি, মন্টির মা আর তার বাবা। এর মাত্র এক সপ্তাহ পরই অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেল বাবা ও মা। মন্টিকে জোর করে নিতে চেয়েছিল। সে যায় নি। কারণ তার আছে এখানে নীল দেয়াল। নীল দেয়ালের ঢাকা। এই শহর ছেড়ে সে কোথাও যেতে চায় না। পরে অবশ্য জানতে পেরেছে মন্টি। তার বাবার নামে প্রতারণা-হত্যা-জমি দখল সহ মোট পনেরটি মামলা হয়েছে। তাই এই পলায়ন! মন্টি কথা শোনে নি। সে যাবে না দেখে এই বুয়াকেই তার দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে গেছে বাবা-মা। তাদের সঙ্গে এই বাড়ির বাড়িওলার যোগাযোগ আছে। বাড়িওলাও বিদেশে থাকে। সে মন্টির গুরুতর খোঁজগুলো নেয় বাড়ির কেয়ারটেকারের কাছ থেকে। তারপর বাবা-মাকে দেয়। এখন আর দেওয়া লাগে না। ফোনে বাবা-মা সরাসরি খোঁজ নেয় মন্টির। কিন্তু মন্টি পাগল হয়ে আছে নীলে।
আজ অনেক অনেক দিন পর, ঠিক কত বছর পর ঘর থেকে বের হতে যাচ্ছে মন্টিÑকেন সে নিজেই জানে না। হবে হয়তো, সেই কবে অনেক বছর আগে, ঠিক মনে নেয় একদিন ভার্সিটি থেকে ফিরে এসেছিল। যাই হোক, সে ঘর থেকে বের হচ্ছে একথা শুনে বুয়া মাথা ঘুরে পড়ে গেল! তার মুখ দিয়ে নীল রঙের ফেনা গড়িয়ে পড়ে গলার দিক হয়ে ফ্লোর ভিজে চলেছে। না তাকিয়ে দরজা মেলে বাইরে চলেছে মন্টি।
নদ্দা আর গুলশান-২ এর মাঝামাঝি একটা কাঁঠাল তলায় সিমেন্টের বেদিতে বসে এক কাপ রং চা খেল। সঙ্গে বেনসন লাইটস। তারপর সে দেখতে গেল তার সেই নীল রঙের দেয়াল। নদ্দায়। দুঃখিত! দেয়ালটা নেই! বাড়িটাও নেই! হয়তো তার বাবা বেচে দিয়েছে অনেক আগেই। বহুতল ভবন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে সেখানে। তাই সে আর সেখানে দাঁড়াতে পারেনি। ফিরে এলো কাঁঠালতলায়। আবার এককাপ চা খেয়ে বাসায় ফিরবে, হয়তো ফিরবে না। হাতে অর্ধ খাওয়া সিগারেটটা নিয়েই হয়তো হাঁটা দেবে।
কেন জানি মনে হচ্ছে মন্টির, কি জানি মনে হচ্ছে তার। একটু সামনেই তার সেই শৈশবের স্কুলটা--ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। তার মনে পড়ে বাবার কথা। বাবার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতো স্কুলের গেটে, তাকে টান দিয়ে বাইরে নিয়ে আসতো ভীড়ের ভেতর থেকে। তারপর রিকশায় তুলে দিয়ে বাসায় পাঠাতো। তার মনে হচ্ছে, এখন ঠিকই মনে হচ্ছে সেই প্রেমিকের মতো করে, যে আসিফÑ মন্টির সঙ্গে তার বাবার দেখা হয় নি কোনো দিন, কখনোই দেখা হয়নি, দেখা হতো স্বর্গ আর নরকের! কেবল নরক আর স্বর্গের স্কুলের গেটে।
সে ভাবছে আর বসে চা খাচ্ছে। ওদিকে সেই প্রেমিক! সে আসিফ। কারো জন্য হয়তো অপেক্ষা করছে। কার জন্য? বছরের পর বছর ধরে যার জন্য অপেক্ষা করছিল তার জন্য হয়তো। সে কি প্রসন্ন? দেখা যাক--
আসিফের সঙ্গে সেইবারই প্রথম ও শেষ দেখা হয়েছিল প্রসন্নের। সেই যে তারা রিকশায় ঘুরেছেÑসেই সময়। শেষে আসিফের সঙ্গে মন্টির নীল দেয়ালের সাক্ষাত হয়েছিল। তারপর! তারপর প্রসন্ন বিদেশ চলে গেছে। তার গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের কাছে! কিন্তু আসিফ প্রায়ই আসতো এই রাস্তায়। স্মৃতি হাতড়াতে। রিকশায় ঘুরতো স্মৃতির পিছুপিছু-আশপাশে। তারপর দেয়ালটা দেখতে যেতো। গিয়ে দেখতো, বাহ! কি সুন্দর দেয়াল। কে আঁকে। মন্টি আঁকে। অথচ জানতো না আসিফ। সে তাকিয়েতাকিয়ে শেষে চলে আসতো। কারো কাছে কিছু জানতেও চাইতো না। এভাবে যখনই যেতো প্রেমের স্মৃতির সন্ধানে তখনই দেয়ালদর্শন করে আসতো। নীল রঙের দেয়াল তো! তাই। আসিফের হৃদয়ের বেদনার সঙ্গে কোথায় যেন মিল আছে এই দেয়ালের! অথচ মন্টির কাছে এখন এই দেয়ালের অর্থ একেবারেই ভিন্ন!
এইতো! এসে গেছে! আরে! এ যে প্রসন্ন! অনেক বছর পর এসেছে দেশে। কেন? বিবেকের কাছে প্রশ্ন পথিকের। হয়তো কোনো ভাবে যোগাযোগ করেছে আসিফের সঙ্গে, তারপর প্রেমের স্মৃতি ঘাঁটতে এসেছে দুজনে। প্রসন্নটা কেমন বুড়িয়ে গেছে। তার বয়স নিশ্চয় হয়েছে পঞ্চাশ-টঞ্চাশ। আর আসিফের? তারও হবে পঁয়তাল্লিশ-টয়তাল্লিশ! প্রসন্নকে দেখে কিছুই বলছে না আসিফ। প্রসন্নও যে খুব কিছু বলছে তাও না। তারা চুপ। একেবারে চুপ। দূরে বসে বসে এই সব দৃশ্য দেখে দেখে মন্টিটা ভাবছে নীল দেয়ালের কথা। নীল সে দেয়াল। অনেক অনেক দিন আগের! এই তো সেদিনের দেয়াল। নীলে রাঙানো, নীলে মেশানো আর নীলে মাখানো দেয়াল। তখন বুঝতে পারে নি সে, কেন দেয়ালে আঁকাতো? কী আঁকাতো? আজ এই সময়ে কেন যেন তার মনে হচ্ছে, সে দেয়ালে স্বর্গ আঁকাতো। বেশি না, একখ- স্বর্গ! বাড়িভর্তি নরক ছিল বলে একখ- স্বর্গ এঁকে রাখতো সে। তাহলে, বেড়ালটার গায়ে কী আঁকতো নীলে? ওটা, ওটাতো ছিল স্বর্গের দরজা!
প্রসন্ন আর আসিফ কি করবে অনেকক্ষণ ধরে বুঝে উঠতে পারছিল না। অবশেষে তারা বুঝতে পারলো তাদের আলিঙ্গন করা উচিত, পারলো বলেই তারা একে অপরকে আলিঙ্গন করলো। মহা আলিঙ্গন! আসিফ কেন জানি বলে ফেলল কথাটা। প্রসন্নকে হালকা শুনিয়ে, হালকা না শুনিয়ে বললো, ‘লাইফ ইজ কালার হাউজ।’
মন্টি কি করবে বুঝতে পারছে না। সেও নিজের অজান্তেই বলে উঠল, ‘লাইফ ইজ কালার হাউজ! ওয়াল ইজ হ্যাভেন!’ তারপর মন্টি ভালো করে খেয়াল করে দেখলো, প্রসন্ন আর আসিফের বুকের মাঝখানে মন্টির বর্ণাঢ্য দেয়াল! নীলদেয়ালÑদেয়ালনীল!!!
তবু হাল ছাড়ে না মন্টি। নাশতার টেবিলে গিয়ে বসে। কেন রং হয় না? পাউরুটির মধ্যে জেলি মাখাতে থাকে। পাশের ঘর থেকে বুয়া ডাকে, স্যার, আপনের ফোন বাজে। ‘দিয়ে যান’ বলে মন্টি। মায়ের ফোনটা হঠাৎ বাবার ফোন হয়ে যায়। অর্থাৎ মায়ের ফোন থেকে বাবা ফোন করেছে। বাবা দিলে হয়তো এত তাড়াতাড়ি ধরতো না! তাই বাবা বাংলাদেশি টাইমের সাত-সকালে মাকে কাজে লাগায়। ওপ্রান্ত থেকে মন্টির বাবা জানতে চায়, নাশতা খাইতেছ? মন্টি উত্তর দেয় সংকোচ-উদাসীনতা মিশিয়ে,‘রং চলতেছে, তারপর খামু’। কথার মানে ধরতে পারে না বাবা। এবার কথার শানে নযুল বুঝতে মায়ের হাতে ছেড়ে দেয় ফোনটা বাবা। মা জিজ্ঞেস করে,‘বাবা মন্টি, নাশতা খাইচো?’ মন্টি এবারো ক্লিয়ার করে না। শুধু বলে,‘মা, দেয়ালে রং করতেছি’। মা ধরে ফেলে ছেলের কথা। নিজের মতো অনুবাদ করে নিয়ে আহ্লাদে বলে,‘ও, বুঝতে পারছি বাবা, পাউরুটির দেয়ালে জেলি-রং মাখতেছো বাবা! খুব ভালো, বেশিক্ষণ রাইখা দিয়ো না, খাইয়া ফেলাও।’ তারপর নিজে থেকেই ফোন রেখে দেয় মা অথবা মন্টিÑকে? ঠিক মনে পড়ে না মন্টির। সে খালি রং করতে ব্যস্ত। নিজের রং করা দেখে নিজেই এবার বিহ্বল হয়ে পড়ে। এবার রং ধরছে। পাউরুটিটাকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে? ইচ্ছে করে বুয়াকে ডেকে এনে দেখায়। কিন্তু সাহস পায় না। এই বুয়াই হয়তো পাশের ফ্লাটে গিয়ে কথা লাগাবে, স্যার পাগল হইয়া গেছে। কিন্তু সে তো পাগল হতে চায় না।
আবারও হাল ছাড়ে না মন্টি! ফোনটা কেটে যাওয়ার পর স্মার্ট ফোনটাকে ইচ্ছে মতো বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে ঘষতে থাকে। অ্যাপসগুলোকে এদিক-ওদিক নাড়াচ্ছে। তার মনে হয়, স্ক্রিনের দেয়ালে বৃদ্ধাঙ্গুল নামক তুলি দিয়ে রং করতেছে। স্মার্টফোনটা রং ছড়াতে চায় না। কোত্থেকে যেন একদলা রং এসে ভর করে, আবার উবে যায়, ভর করে ভাসে, উবে যায়। এরকমের দেয়াল রং করা চলে মন্টির সারাদিন। হয়তো সারারাত। পাড়া-পড়শি কেউ দেখে না। মন্টি ইচ্ছে মতো রং করে চলে, একা একা। কেউ দেখে না এই শহরে কে কোথায় রং ছড়াচ্ছে! এমন কি মন্টির বিশতলার বারান্দা থেকে আসমানে কখন-কোন রং ছড়ায় তাও সে দেখে না, সে নিজের রং নিয়েই ব্যস্ত। নানা সময় নানা রং ছড়াতে থাকে দেয়ালে। এটা তার ‘আপনার একান্ত ব্যক্তিগত’ অভ্যাস।
মন্টির বাজার করা লাগে না, চাকরিও করা লাগে না। বুয়া তার জীবন-জীবিকার ম্যানেজার! যা যা লাগে স্লিপে লিখে দিয়ে বাজারে পাঠায়। শোরুম আর সুপারশপের জিনিসপত্র কেনায় কেয়ারটেকারকে দিয়ে। বুয়া গিয়ে কেয়ারটেকারকে রিকোয়েস্ট করে, স্যার পাঠাইছে। এই যেমন, কিছুদিন আগে কেয়ারটেকারই এনে দিল এই স্মার্টফোনটা। মন্টি অসুস্থ হলে ডাক্তার ডেকে আনে বুয়া, মাস গেলে চুল কাটার জন্য ডেকে নিয়ে আসে পাশের গলি থেকে নাপিতকে ইত্যাদি ইত্যাদি। বাবা মাস গেলে টাকা পাঠায় বুয়ার কাছে, মন্টি ধারও ধারে না এসবের। সব রেডি করে রাখে বুয়া। প্রথম প্রথম বুয়ার জন্য মায়া লাগতো তার। সে ভাবতো, একজন স্ত্রী লোক মন্টির সর্বত্র রং ছিটিয়ে যাচ্ছে, দিন-মান মন্টির দেয়াল রং করে যাচ্ছে। এখন ভাবতে ফালতু লাগে। তার মনে হয় রং করা অতো সহজ নয়। বুয়া তার ডিউটি পালন করছে মাত্র। মন্টির বাবা-মা বুয়াকে এজন্যই রেখেছে। রং ছড়াচ্ছে কেবল মন্টি। রং ছড়াতে গেলে জগতে মন্টি হতে হয়। মন্টি ছাড়া আর কয়জন পারে রং করতে। রং করতে আবীর লাগে, আইকা লাগে, পানি লাগে, ব্রাশ লাগে আর লাগে একটা পুরনো দেয়াল। যে সে দেয়াল না, একেবারে এবড়ো-থেবড়ো ইটের দেয়াল। স্থানে স্থানে ইস্টক বিভ্রান্ত দেয়াল, খসে পড়া লাগে রাঙাতে।
মন্টি এতটাই একা এ বাড়িতে তার জš§দিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিনটা এলেও কেউ মনে করিয়ে দেওয়ার নেই। শুধু অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহর থেকে ফোনে আসে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ মন্টি!’ কিছুদিন আগেও মা ফোন করে মনে করিয়ে দিলো তার বয়স এবার পঁয়ত্রিশ হয়েছে। ওরকম করে ভাবলে জীবনের অর্ধেক বয়স শেষ। এ নিয়ে তেমন চিন্তা করে না মন্টি। সে হিসেব করলে বিয়েও তো করা লাগে একটা। তারপর আবার প্রেম-টেম। পাত্তা দেয় না সে একদম। তার খালি একা একা থেকে দেয়াল রং করতেই ভালো লাগে। মাঝে পঁচিশ বছরের সময় মা একবার উদ্যোগ নিয়ে দেখেছে, উল্টো মন্টি বলেছে, আজকের আকাশে অনেক রং, আমি রঙের কাছে চলে যাই মা। ছেলের এইসব সাংকেতিক কথাবার্তা মা-ই শুধু ধরে ফেলতে পারে। মা বুঝে ফেলেছে এই কথার অর্থ হচ্ছে, ছেলেকে জোর-জবরদস্তি করে বিয়ে করালে সে দিন-দুপুরে অথবা জোৎøা রাতে ছাদ থেকে লাফ দেবে। তাই শুভ কাজে অশুভ লক্ষণ দেখে পিছিয়ে গেলেন বাবা-মা দু’জনে। এই দুজন ছাড়া আÍীয়-স্বজনের তো প্রশ্নই ওঠে না! কেউ নাই। মন্টি জানে তাদের কোনো আÍীয়-স্বজন নাই। গ্রামে কারা কারা যেন ছিল একসময়। এখন আর নেই। কেন নেই? সে মাঝে মাঝে ভাবে, এর জন্য কি কোনো ভাবে তার দেয়াল রাঙানোর অভ্যাসটা দায়ী। বাবাকে জিজ্ঞেস করেও ছিল একবার। বাবা বলেছে, না না! তুমি তোমার মতো দেয়াল রাঙাও। ওসব ভেবো না। এটা স্রেফ আমার জন্য হয়েছে। আমিই ইচ্ছে করে কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখি নি।’ হুম বলে ফোনটা রেখে দেবে এমন সময় বাবা আরো বলেছে, শোনো, জীবনে কোনো ক্ষেত্রেই আÍীয়-স্বজন লাগে না, শুধু মরার পর লাগে। তাও আজকের পৃথিবীতে লাগে না। মরলে কান্নার মানুষ ভাড়া পাওয়া যায়।’
একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে একবার ভর্তি হয়েছিল মন্টি। সেখানে গিয়ে দেখেছে, সব ছাই! কেউ রঙ করতে জানে না। একটা মেয়েকে বলেও ছিল কিভাবে দিন-রাত চাইলেই যে কেউ দেয়াল রাঙাতে পারে। মেয়েটা ক্ষেপে গিয়ে বলেছে, ‘আঁতেলদের জন্য তো শুনছি ঢাকায় একটা আলাদা মার্কেট আছে, এইখানে কি!’ তারপর থেকে কেউ রঙ করতে জানে না দেখে ওই ভার্সিটিতে আর যায় নি সে। বাবা-মা কয়েকবার বলেছিল,‘এখানে চলে আয় মন্টি, খুব ভালো লাগবে তোর, কি সুন্দর সবকিছু!’ মন্টি সোজা উত্তর দিয়েছে,‘সেখানে নিশ্চয়ই শ্যাওলা ধরা দেয়াল নাই, আছে? যাবো না।’ বাবা এও বলেছে,‘ওই রকম ক’টা দেয়াল চাস তুই, হাজারটা দেয়াল গড়ে দেবো, মানুষ চাইলে কি-না হয়। দেখিস নি চীনের দেয়াল, যাহ, তোরে কে বোঝাবে, থাক দেশে পড়ে!’ তাই দেশেই বস্তুত পড়ে আছে মন্টি। এখানে দেয়াল আছে তাই। ঢাকায় একটাই দেয়াল আছে তাই! সে রাঙাতো একসময়, এখন পারে না, রাঙাতে মন চায় মাঝেমাঝে, হাত নিশপিশ করে, রাঙাতে পারে না, রাঙাতে পায় না, বর্ণীল দেয়াল এই শহরে একটা, নদ্দায়, ওইসব দেশ নর্দমায়!!!
রাত-বিরাতে বেড়ালটা কার্নিশ দিয়ে ঘরে ঢুকতে চাইলেও পারে না, জানলা বন্ধ করে রাখে সে। এইটা একটা কালো আর হালকা কালো রকমের বিশ্রী বিড়াল তার চোখে। তাই আশপাশে জাগয়া নেই। বিড়াল এমন হবে কেন? বেড়াল তো হবে সাদা-ফকফকা শাদা রঙের। দূর থেকে দেখে মনে হবে তুলতুলে। মিনি দুধ খায় চুকচুক টাইপের! তাই না, তাইলেই তো সে আদার করে বুকের কাছে মানব সন্তানের মতো টেনে নিয়ে ব্রাশ বুলিয়ে রং করতে পারতো ইচ্ছে মতো। আরে! এইটা হয়েছে!!! হাসি পায়। যা শাদা রোম জন্মাতে পারলে আসিস, তবে রাঙিয়ে দেবো। মনে মনে ভাবে মন্টি। বেড়ালটা চলে যায়। অধিকার পায় না ঘরে আসার।
মন্টি একসাথে ডাবল সিগারেট খায় ইদানীং। একটা বেনসেন লাইট আরেকটা ইজি লাইটস। একটা মোটা একটা চিকন। কেন? সে নিজেও জানে না। ইচ্ছে হয় তাই। আগুনরঙ দিয়ে সাদা সিগারেটে রঙ করা যায় একেবারে ফিল্টার পর্যন্ত। একেকটা সিগারেটে একেকটা রং হয়। দুইটায় দুইরকম। টানে আর রঙ আনে! রঙ আনে আর টানে। একা একা। বাইরে থেকে বিড়ালটা হয়তো ভাবে, টান মনা ভালো করে টান, একটা তোর বাপ, একটা মা। টান দুইটারে টান। ভালো করে পোড়া! পোড়া!!! পুড়িয়ে দে!!! অথচ মন্টি ভালো ছেলে। দুধ খায়। দুধ খেতে খেতে তার মনে হয়, পেটের ভেতরে একটা তরল দেয়াল ঢুকিয়ে দিচ্ছে। জল জমে যেমন বরফ হয়ে যায় সাগরগর্ভে, তেমনি পেটগর্ভে দুধেল একটা দেয়াল হবে। অথচ রেডি হচ্ছে বুয়া। রাত নেমেছে বলে যাবে। আবার সকালে ফিরে আসবে বস্তি থেকে। ইচ্ছে করলে এই বাসাতেই সে কোনো একটা কক্ষে ঘুমিয়ে পড়তে পারে ইচ্ছে মতো অথবা চিরতরে, মন্টি তাকে ডাকবে না কখনো, চান্সই নাই কোনো। বুয়া চলে যায়। অথচ কার কাছে যায়? তার তো স্বামীও নাই, সংসারও নাই। ছেলে বলতে মন্টিকে ভাবে। বলতে সাহস পায় না। মন্টি এসব আবেগের ধারে কাছে নেই। যে রং দিয়ে এত সুন্দর সুন্দর দেয়াল বানায় সে এত ফালতু আর পাতানো সম্পর্কের দেয়ালে হেলবে না।
মন্টির বাবার কম করে হলেও দশটা নাম, তাই তাকে মন্টির বাবা অথবা আব্বা ডাকাই ভালো আর মন্টির মা যেহেতু মন্টির বাবার বউ তাই তারও কোনো নাম না দিয়ে তাকেও মন্টির মা বলাই উত্তম। মন্টির বাবা যৌবনে দাবার বোর্ড বা ছকের ব্যবসা করতেন। মহাখালীতে একটা দোকান ছিল তার। বিভিন্ন আইটেমের দাবার বোর্ড বেচতেন তিনি। দোকানের কোনো নাম ছিল না। অদ্ভুত! তবে বক্স কিংবা বিভিন্ন আকার-প্রকারের ও রঙের দাবার বোর্ড পাওয়া যেত দোকানে। নাম দিয়ে কাম কি, বোর্ডে পরিচয় টাইপের দোকান আর কি! সামনে একটা ছেলে বসতো সেলসম্যান কাম ক্যাশিয়ার হিসেবে আর পেছনে একটা খুপরি মতন রুমে তার বাবা বসতো। সারাদিন কি করতেন কেউ জানতো না। একটা রহস্য! কি এক কারণে দোকানের বাইরে গেলেও সেলসম্যানকে বলতে বলতেন ভেতরে ঘুমাচ্ছেন, এখন ডাকা যাবে না! কেউ এলে অন্য সময় আসতে বলতেন, দুপুরে এলে বিকেলে কিংবা বিকেলে কেউ এলে সন্ধ্যার পর, সন্ধ্যায় এলে রাতে, রাতে এলে পরদিন সকালে আসতে বলা হতো। মন্টির বাবার স্বভাব-চরিত্রে একটা সময় দাবা-দাবা ভাব চলে এসেছিল। এই কোনো কাজে জিতলে তিনি সকলকে শুনিয়ে শুনিয়ে বগল বাজাতেন,’কিস্তিমাত’। অথবা টেনশন থেকে মুক্তি পেলে বলতেন ‘যাহ শালা, চেক’। ঘরে ফিরে এসব কথা বলতে থাকলে মন্টি আর মন্টির মা কথার মাথাম-ু কিচ্ছু বুঝতেন না। শুনে থাকতেন। মাঝেমধ্যেই ঘুমের ঘোরে তার বাবা রাজা, মন্ত্রী, হাতি, ঘোড়া, নৌকাÑএসব বলে চেঁচাতো। কেউ অবাক হতো না। বোর্ড আর ঘুঁটি নিয়ে কাজকারবার তার বাবার। দিনে বেচেন আর রাতেও হয়তো বেচেন! কার কি! যার যার ঘুম সে সে যায়।
মন্টির বয়স তখন কত, সাত-আট বছর হবে হয়তো। প্রায়ই বাড়ি ফিরে আদর করে মন্টির থুতনি উঁচু করে ধরে দাবা নিয়ে ভাষণ দিত বাবা। একেকদিন একেকটা। আর কথায় কথায় বিখ্যাত দাবা খেলার উদাহরণ টানতো। এই যেমন, অমর গেম, অমর গেম হইলো গিয়া ১৮৫১ তে, এডল্ফ এনডারসন এবং লিওনেল কিয়েসেরিতস্কির মধ্যে, তারপর চিরসবুজ গেম, এর ঠিক একবছর পর- এডল্ফ এনডারসন এবং জঁ দুফ্রেস্নে, অপেরা গেমঃ পল মর্ফি এবং দুই মিত্র, ব্রানস্উইক-এর ডিউক ও কাউন্ট ইসুয়ার্ডÑ১৮৫৮ তে। বিরক্ত হয়ে যেত তার মা, আর কিচ্ছু বুঝতো বলে মনে হয় না মন্টি। তবুও বলতেই থাকতো বাবা, কি আনন্দ পেত কে জানে! লস্কর এবং বাওয়ার, এমস্টার্ড্যাম, ১৮৮৯, বিখ্যাত জোড়া হস্তি খাওয়ার প্রথম উদাহরণ, শতাব্দীর সেরা গেম, ববি ফিশার এবং ডনাল্ড বায়ার্ন, ১৯৫৬ তে। তারপর তারপর কম্পিউটারে। যুগ বদলাইছে। ডীপ ব্লু এবং কাসপারভ, ১৯৯৬, গেম ১, ইতিহাসের প্রথম গেম যাতে একটি কম্পিউটার বিশ্বসেরা দাবাড়–কে পরাজিত করে... এত কথা কোথা থেকে পান মন্টির আব্বা! তার মা খালি অবাক হয়। হয়তো ভাবতো, দাবার বোর্ডের প্যাকেটের গায়ে বোধ হয় এসব লেখা থাকে আর তার স্বামী মুখস্ত করে এসে তাকে খালি শোনায়। শোনায়, মুখস্ত করে। মন্টির মা খালি বলতো, ‘আহ্, রহস্য করার জায়গা পাও না, ধোৎ।’ মাঝেমধ্যে সে বিরক্ত হয়ে যেতো। তারপর হাসতো আর হাসতো মন্টির বাবা। তাই আপাতপক্ষে মন্টির বাবা ঘরেও রহস্য, বাইরেও রহস্য! এলাকাবাসীর কাছে মন্টির বাবা তো ছিল বিরাট এক রহস্য! অবশ্য এলাকাবাসীকে সে রহস্যের কুল-কিনারা না করতে দিয়েই তিনি দেশত্যাগ করেছেন। সঙ্গে ছিল মন্টির একমাত্র মা। মা তো একমাত্রই হয়? না-কি?
মন্টি ঘরের মধ্যেই বছরের পর বছর ধরে হাঁটিতেছে। সাক্ষী একমাত্র বুয়া। মন্টি মাঝে-মাঝে অনর্থক ড্রয়িং রুম থেকে বেড রুম, বেড রুম থেকে বারান্দা হয়ে খালি পায়চারী করে। তখন ভয় পায় বুয়া। চোখ বন্ধ করে হাঁটে সে। কোথাও যেন যন্ত্রণা রয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে হাঁটার সময় প্রথম দিকে পায়ের বাড়িতে ঘরের জিনিসপত্র পড়ে যেত, বুয়া দৌড় দিয়ে এসে হাজির,একটা পড়ে তো পরের টা ওঠানোর জন্য প্রস্তুত হয়, এভাবে পড়ে আর ওঠায়। সে হাঁটে আর পড়ে। পড়ে আর হাঁটে। বুয়া ঠিক করে থোয়। এখন আর পড়ে না, চোখ বন্ধ করে হাঁটে মন্টি, ইচ্ছে করলেই হাঁটে। বুয়া দৌড়ে এসে হাজির হয়। চোখ বন্ধ রাখা অবস্থাতেই সে বলে দিতে পারে বুয়া এসেছে। এমন কি বুয়া বিড়ালের মতো এসে হাজির হলেও। এখন আর কোনো জিনিস পড়ে যায় না। বুয়ার মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে, স্যার, কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসেন না। ও স্যার, সারাদিন ঘরে! এইডা কি জেলখানা। অপরদিকে মন্টিরও বুয়ার জন্য উত্তর গোছানো, সে ভাবে, বুয়া যদি সত্যিই কোনো দিন সাহস করে জানতে চায় তবে বলবে, স্বেচ্ছানির্বাসন বোঝো তুমি? বোঝো না, এ হচ্ছে নিজে থেকে রং করার জন্য থেকে যাওয়া...। মাঝে মাঝে স্যারের ঘটনাচক্রে হাসি পায় বুয়ার। কিন্তু হাসে না। ভাবে, কখনো একবার হেসে দেখবে, কি বলে মন্টি! যার হাঁটা সে হাঁটতেছে, এই শহর-নগর-বন্দরবাসীর অগোচরে একাকী সে হাঁটতেছে। ঘরে। ঘরে। ঘরে। বছরবছরবছর! বুয়ার ছোট মাথায় খেলে না। বুয়া হয়তো ভাবছে, স্যার দীর্ঘদিন ঘরে হাঁটার অভ্যাস করে মহাহাঁটার প্রস্তুতি নিতেছে। হয়তো একদিন দরজা খুলে বেরিয়ে পড়বে। আসলে কি ভাবে বুয়া। ভাবে কি? কোথায় হাঁটতে যেতে পারে তার এই পৃথিবীর একমাত্র স্যারটি। মাথায় ধরবে না বুয়ার, তাই ভাবেও না।
তবে বুয়া এটা ভাবে, মন্টির বাবা-মার দিলে মহব্বত নাই, থাকলে মন্টিরে দেখতে আসে না কেন! এটা সে ভাবে, কিন্তু মাথায় ঢোকে না। মন্টিতো তাদের ছেলে হয়, না! তাইলে? বছরে এক বার না হোক দুই বছর তিন বছর বাদে তো একবার আসতে পারে। আসে না তো। মন্টি বাবা-মার পথ চেয়ে বসে থাকে না তাই হয়তো বুয়া পথ চেয়ে বসে আছে। সেই কবে তাকে ঠিক করে দিয়ে গেছে ছেলেকে দেখাশোনা করার জন্য! ভাগ্যিস ফোন যন্ত্রটা আসছে, নইলে এদের যেমন রিসতা তাতে করে চিঠি লেখার লোক এরা কেউ না। না মন্টি, না তার বাবা না মা। মন্টি নিজেও জানে না কেন তার বাবা-মা আসে না। এটা একটা বিরাট রহস্য। তবে সে যদি খালি নীল রং দেয়ালে না মাখাতো তবে হয়তো এই রহস্যের একটা সুরাহা করতে পারতো। এখন সময় কোথায় তার? সে আছে রাঙানোর তালে। রাঙাতেরাঙাতেরাঙাতে সে একটা নীল রঙের ডাস্টবিন হয়ে পড়েছে যেন! তার গায়ে লেখা ‘ইউজ মি’। অধিক ময়লার ভেতরে একটা নীল রঙের ময়লার বাকসো দাঁড়িয়ে থাকে তিন-বেলা, তিন সীমানায়। কেউ দেখার নেই, কাউকে দেখানোর নেই। মনে কর, একটা শূন্য উদ্যান, খালিখালিখালি! অনেক তাকানোর পরে হঠাৎ কোথাও কোনে একটা নীল রঙের এমন ডাস্টবিন চোখে পড়েÑতা বাতিঘর, বেঁচে থাকার স্বপ্নের বাতিঘর, তীরে ফেরার অবলম্বন। মন্টির এমন একটা অবলম্বন আছে বিধায় বাবা-মা অজ্ঞাত কারনে দেশে এসে বছর বছর তাকে দেখে যায় না। তাই হতাশ হয় মন্টি। আসলে কি হতাশা হয়? অবশেষে সে ওয়াশরুমে ঢুকে তিব্বতমার্কা নীল রঙের সাবান মাখে সারা গায়। শরীরের দেয়ালে নীলসাবান দিয়ে রাঙায়। রাঙে না, ফেনা হয়! সাদা সাদা ফেনা। কোথায় নীল নেই। তবুও বিড়াল ও বাঘ যেমন অনেকক্ষণ পর হঠাৎ মোলায়েম গতিতে মন্থরেমন্থরে চক্ষুবুঁজে তেমনি মন্টিও দু’চোখ বন্ধ করে খোলার আগে ফেনার ভেতর নীল দেখে। নীলেনীলে স্বপ্নিল! পানিতে নীল ধুয়ে যায়, বাবা-মার না আসার বেদনাও ধুয়ে যায়। এসব নিয়ে ভাববার সময় কোথায় মন্টির! এইতো একটু পরে আবার গভীর আরাম নিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘরময় হাঁটবে, আর পায়ের পাতার তুলিতে ঘরে ঘরে নীল রঙে রাঙাবে। তারপর আর টাইলসে হাঁটবে না, বুয়ারও এদিক দিয়ে হাঁটা নিষেধ, একেবারে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দু’জনের জন্য, যদি না নীল উঠে যায় কারো আলতো পায়ের ছোঁয়ায়।
আবারো মনে পড়ে, শুধু তাকে যেতে বলে তাই সে যায় না। যাওয়ার সময় সঙ্গে নিতে চেয়েছিল, সে যাইনি দেয়াল রঙ করার কাজ আছে তার, দেয়াল দেখার কাজ আছে তার। কিছুদিন পর পর মা ফোন করে বলে,‘বাবা মন্টি আসবি না মাকে দেখতে?’ সে সাফ জানিয়ে দেয় একশব্দে,‘না’। এইকথাও কখনো বলে না,‘তুমরা আসো’। তাই কেউ আর আসে না। বুয়া ও মন্টি শান্তিনগরের বিশতলার ফ্ল্যাটে অজানা শান্তিতে আছে আর বাবা-মা সিডনীতে শান্তি বা অশান্তিতে আছে। কেউ নড়ে না, চড়ে না। অথচ ঘটনা সরেজমিনে তদন্ত করার মতো, আবার কেউ সময়ও পায় না তদন্ত করার, যার যার মতো সে সে ব্যস্ত। যার যার জীবন নিয়ে সে সে যাপতেছে!
মন্টি মায়ের কাছে শুনেছে তার বাবা চৌকস ও ঝানু দাবাড়– ছিলেন যৌবনে। তবে সে কখনো বাবাকে দাবা খেলতে দেখেনি। খালি মায়ের কাছে গল্পই শুনেছে। মন্টি জšে§র পর থেকেই বাবার দাবা খেলার গল্প শুনে বড় হয়েছে, কিন্তু একবারও নিজ চোখে দেখেনি বাবাকে দাবা খেলতে কিংবা এমনও দেখেনি কেউ দাবা খেলছে আর বাবা বোর্ডে চোখ ফেলে বসে আছে। আসলে সে বাবাকেই তেমন দেখেনি। তার মাও যে দেখেছে সে কথা বলা যায় না। তাই হয়তো এই মা সান্ত¡না স্বরূপ বাবার দাবা খেলার কৃতিত্বের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে। কি আজব! এই স্মৃতি ধূসরও হয়ে যায় না। বাবা বাসায় আসতো রাত একটা-দুইটায়। আবার চলে যেত ভোর হওয়ার আগেই। কোথায় কে জানে? মন্টি তো ঘুমে থাকতো। বাবা কেমনে আসে এবং যায় কোনটাই সে দেখতে পেতো না। এটা নিয়ে তার দুঃখ করার সুযোগ নেই, বাবা পুষিয়ে দিতেন অন্যভাবে। মন্টির মনে আছে, সে গুলশানের ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে স্ট্যান্ডার্ড টু-থ্রিতে পড়ার সময় বাবা প্রায়ই তাকে স্কুলের গেট থেকে হাত বাড়িয়ে বাইরে নিয়ে আসতো। তারপর রিকশায় তুলে দিয়ে কোথায় যেন আবার হাওয়া হয়ে যেতো, কোথায়? মন্টির রিকশা সোজা চলে আসতো তাদের নদ্দার বাসায়। বাসায় এলে মা জিজ্ঞেস করতো, বাবা এসেছিল? মন্টি মাথা ঝাঁকিয়েই জবাব দিত এসেছিল। এতে তার কোনো আমোদ ছিল না।
তো, সেই বছরগুলোরই কোনো একটা দিনে, যখন মন্টির বাবার সঙ্গে প্রায়ই তার দেখা হতো স্কুলের গেটে, সেই কালে তখন কি যেন প্রেম-টেম ঘটেছিল স্কুলের বাউন্ডারির বাইরের আশে-পাশে অর্থাৎ স্কুল সংলগ্ন কোনো এক কাঁঠালতলায়।
প্রসন্ন অন্য কারো বউ। কার বউ জানে না আসিফ। কখনও জানতেও চায়নি। সে শুধু জানে অন্যের বউকে ভালোবাসতে হলে বউয়ের স্বামীকে শুরুতে একটা নিরাপদ স্থানে রেখে আসতে হয়। তাই পরিচয়ের প্রথমদিনেই আসিফ বলেছিল প্রসন্নকে,‘হাসব্যা- হইলো গিয়া ‘গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার’, জনগন চাইলেও সরকার আছে, না চাইলেও আছে। তোমার আমার মধ্যে প্রেম হইলেও সে আছে, না হইলেও আছে। এভাবেই আসিফ প্রসন্নের হাসব্যান্ডকে একটা নির্দিষ্ট মর্যাদার আসনে বসিয়ে প্রসন্নের আসন দখল করে নেয়। তারপর আসিফ জানে স্বামীবিদেশ মেয়ে মানুষের প্রেম হওয়ার বেশি চান্স থাকে দুইটা জায়গায়। ১. টেইলার্সের দর্জির লগে ২. স্বর্ণকার বা আপনালয়ের সেলসম্যানের লগে। প্রসন্নের স্বামীও বিদেশে থাকেন, সূদুর চীনে হবে হয়তো। তাই উপরিউক্ত দুই সম্প্রদায়ের হস্তগত হওয়ার আগেই প্রসন্নকে হাত করে আসিফ। তাকে বাড়তি ক্রেডিট দিতেই হয় এজন্য যে, সে নিয়মের ব্যতয় ঘটিয়েছে। সে দর্জিও না, স্বর্ণকারও না, সে ছাত্র। এছাড়া অন্যের বউয়ের সঙ্গে রিসতা করতে হলে আরো কিছু বাড়তি গুণ তো লাগেই। আসিফ জানে গুণগুলো ক্রমে ক্রমেÑ শারীরিক: প্রথম দর্শনের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ছেলেদের শারীরিক বিভিন্ন বিষয় খেয়াল করে দেখে মেয়েরা। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চতা, ফিগার, চুল, চোখ ইত্যাদি। এ কারণে কারো দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এসব ঠিক রাখা জরুরি। এ ছাড়াও রয়েছে দাড়ি-মোচ, নখ ইত্যাদির পরিচ্ছন্নতা। ফ্যাশন ও স্টাইল: এর পরের কয়েক সেকেন্ড ছেলেদের ফ্যাশন ও স্টাইল লক্ষ করে মেয়েরা। তার মানে এই নয় যে, সবাইকে সিনেমার নায়কদের মতো করে পোশাক পরতে হবে। তবে ফ্যাশনে কোনো বেমানান বিষয় থাকলে তখন তা নজরে পড়ে। এর মধ্যে রয়েছে বেমানান জুতা বা এ ধরনের বিষয়। আত্মবিশ্বাস: অন্যের বউয়েরা পছন্দ করে নিজস্ব মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গী আছে এমন সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী ছেলে। যা তার স্বামীর মধ্যে একেবারেই নাই। প্রথম কথাবার্তাতেই তারা কারো আত্মবিশ্বাস ও বিভিন্ন বিষয়ে ইতিবাচক ও নেতিবাচক মতামত জানার চেষ্টা করে। তবে কথাবার্তায় সবসময় নেতৃত্ব দেয়ার চেষ্টা আর অতিরিক্ত স্মার্টের অভিনয় না করাই ভালো। যোগাযোগ দক্ষতা: কথাবার্তা ঠিকঠাক চালিয়ে নিতে না পারলে ছেলেদের বোরিং বলেই মনে হবে। এ কারণে এক লাইনের কথাবার্তা বাদ দিয়ে প্রাণোচ্ছল কথাবার্তার সেশন চালিয়ে নিতে হবে। রসবোধ: যেসব ছেলেদের ভালো সেন্স অফ হিউমার আছে তাদের অন্যের বউয়েরা পছন্দ করে। এজন্য করে যে, দীর্ঘদিন যাবত এক ছাদের নিচে থেকেও রসিক স্বামীর সাক্ষাত পায় নাই তারা। প্রথম কথাবার্তা এজন্য হালকা ও মজার কোনো বিষয় দিয়ে শুরু করাই ভালো। নোংরা কথা ও জোকস এড়িয়ে সুস্থ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে বোনাস পয়েন্ট সংগ্রহ করা সম্ভব।
তবে সবচেয়ে বড় কথা, ঢাকার রাস্তায় এরকম কত প্রেমই হয়ে যায়! ভবিষ্যতেও হবে! তাই প্রসন্ন আর আসিফের পরিচয় ও প্রেম-টেম নিয়ে পথিকের তেমন মাথাব্যাথা নাই, তারা যেভাবে হোক সুখে-শান্তিতে আটটা-পাঁচটা দিন কাটাতে পারলেই হলো। এইটুকু প্রত্যাশার চক্করে ঘুরতে থাকে পথিকরা, আর সেই সুযোগে রিকশার চাকা ঘুরতে থাকে। হুড তুলে দিয়ে গদিতে চড়ে বসে আসিফ-প্রসন্ন। তাদের মধ্যে কত কথা হয়, হাত ধরাধরি হয়, জড়াজড়ি হয়, হয় না এরকম, আরো কত কিছু হয়, যা হওয়ার তাই হয়Ñরিকশাওলার এই নিয়ে ভাবান্তর নাই। রিকশাটা দুপুরের কোনো এক সময়, আজ থেকে বিশ বছর আগের চাকাদুটোকে ঘোরাতে ঘোরাতে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ক্রস করে। বস্তুত প্রেমঘটিত পরিস্থিতিতে একটা ক্রস এঁকে দিয়ে যায়। আসিফ কি যেন দেখেছে! অনেক ভেবে নিয়ে তারপর প্রসন্নকে বলে,‘একটা ব্যাপার দেইখা আমি টাসকিত!’ প্রসন্ন গভীর আগ্রহে জানতে চায়,‘কী?’ ‘খেয়াল কইরা দেখছো, আরে, তোমার সাথে পরিচয় হইয়া তো আমার মাথা খুইলা গেছে! দেখছো, খুইলা গেছে না! এই যে ইশকুলের গেটে বাচ্চা-কাচ্চাদের নিতে আসে বাবা-মারা। আমার এই দৃশ্য দেইখা কি মনে হয় জানো? মনে হয়, স্বর্গ-নরকের দেখা হইতেছে। কি ইনোচেন্ট-কিউট পুতুলের মতো বাচ্চাগুলা ইশকুলের গেইট দিয়া বাইরায় আর তাদের হাত ধইরা নরকে ঢোকায় টাউট-বাটপার বাপ-মাগুলা। দেখছো না, একটু আগে!’ এক নিঃশ্বাসে বলে যায় আসিফ। প্রসন্ন কি খুশি?
কথাটা বলতে না বলতেই রিকশার বেল ক্রিং ক্রিং বাজতে থাকে আর সঙ্গে সঙ্গে আসিফের মাথার মধ্যে ফ্যান ঘোরে একখানা শব্দেরÑবেঢপবেঢপবেঢপবেঢপবেঢপবেঢপবেঢপবেঢপবেঢপবেঢপ! মন্টির বয়স দশম বৎসর অতিক্রান্ত হতে চলেছে! তার নীল দেয়ালের সামনে উপস্থিত হয় আসিফ। অবাক হয়ে ফিরে যায়। আবার দেখা হবে দেয়াল! শুভ বিদায়!
মন্টি একটা বেড়াল দেখতে পেয়েছিল। ধবধবে শাদা রঙের। আর তার সত্যিকারের দুইটা বিড়ালাক্ষি। বেড়ালের ‘বেড়ালের চোখ’ আর কি! মন্টি এক দিন কি যেন মনে করে বেড়ালটাকে হাত দিয়ে ধরে, অবশ্য বেড়ালটার তখন হাত দিয়ে ধরার মতোই বয়স, এক্কেবারে ছোট। দৌড়াতে পারে না, ভয় গজায় নাই মাথায়। এর আগে একবার একটা কুকুরছানাকে লাথি দিয়েছিল বলে মন্টির মা তাকে ধমক দিয়ে বলেছিল,‘খবরদার মন্টি, জীবে দয়া করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’! এরপর থেকে মন্টি কুকুর-বিড়াল যাই দেখে আদর করতে ছুটে যায়। এইবার একটা বেড়াল ছানা পেয়ে বুকে টেনে নেয়, জানে মা মাইন্ড করবে না, তার পারমিশন আছে। কিছুদিন পর একটা ঘটনায় মায়ের কলিজা ধড়পড় করে ওঠে। দুপুর বেলা ঘুম ভাঙলে মন্টির মা দেখে মন্টি সেই বেড়ালছানাটাকে রঙ্গাচ্ছে। কাপড় ধোয়ার নীল পানিতে গুলে আঙুলে মাখিয়ে বুলিয়ে দিচ্ছে বেড়ালের শাদাশাদা পশমের মধ্যে। মন্টির মা ধমক দেয়,‘এই তোর সেবার নমুনা! বেড়ালের সর্দি হবে না!’ মন্টি খালি নীল রং মাখায়। নীল মাখায় আর নীল মাখায়, একটু পর শাদা বেড়ালটা নীল রঙের হয়ে আস্তে আস্তে দৌড়ানো শিখতে শুরু করে। মন্টির মনে হয়, সে রঙ করতে জানে। এভাবে বেড়ালের রং ধূসর হতে থাকলে কিছু দিন পর পর সে রং করে রঙে ফেরায় বেড়ালটাকে। কেন যে সে নীল রং করে সে নিজেও জানে। এই বয়সে জানারও কথা নয়। ভালো লাগে বলে রাঙায়। বেড়ালটারও কোনো অসুবিধা হতে দেখছে না। বেড়ালটা এঘর থেকে ওঘরে ছুটোছুটি করে, বাইরে বেড়াতে যায়। স্কুলে যাওয়ার সময় মন্টি হয়তো তাকে দেখেই যেতে পারে না, কোন ঘরে ঘুমিয়েছে কে জানে অথবা বাইরে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরছে বা কোন ছাদের নীচে ঘুমিয়ে পড়ে আছে, তবে দুপুরে ফেরার পর কিংবা বিকেলে একবারের জন্য সে মন্টির কাছে ঘেঁষে। মন্টি লক্ষ করছে, যতই বেড়ালটা বড় হচ্ছে ততই তাকে নীলের নেশা পেয়েছে। গায়ে নীল মাখানোর জন্য মন্টির পায়ের কাছে ঘোরাঘুরি করে এখন। মন্টি বুঝতে পারে। তাই ধূসর না হতেই নীলের ওপর আবার নীলের প্রলেপ দেয়। ডাবল নীলে একই রকম দেখায় বেড়ালটাকে। কিছুদিন না যেতেই বেড়ালটার নাম দেয় নীলা। তারপর কি এক অজ্ঞাত কারণে মন্টি বেড়ালের গায়ে রং দেওয়া ছেড়ে দেয়। নীলা পালিয়ে যায় হয়তো বুঝতে পেরে। নীলা আর আসে না, এমন কি রাতের আন্ধারেও না! নীলা নীলে নীলে নাই হয়ে গেছে!
অথচ রাঙানোর নেশা ছেড়ে যায় না মন্টিকে। সে আবীর কিনে এনে পানিতে ছড়িয়ে দেয়, ব্রাশ যোগাড় করেÑবসে থাকে কোথায় রাঙাবে ভেবে? পাশের একটা রঙের দোকান থেকে নিয়ে আসে এসব। দোকানে গিয়ে এদিক-ওদিক চায়। দোকানদার বুঝতে পারে, বাচ্চা মানুষ, যেমন খুশি তেমন আঁকতে চায়, তাই রং খুঁজতেছে। দোকানদার তাই শিশুতোষ রং ধরিয়ে দেয়।
এক বিকেলে মন্টি দেয়ালে নীল রং মাখানো শুরু করে। ব্রাশে রং মাখিয়ে শুধু শুধু দেয়ালে ঘষতে ঘষতে থাকে। ঘষতে ঘষতে ক্লান্ত হয়ে বাসায় যায়। তাদের বাসায়। এই বাসাটাই নদ্দায়। পুরো নদ্দায় এরকম বাসা আর একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার বাবা কেমন করে যেন খুঁজে পেয়েছে! কেন খুঁজে পেয়েছে? এই বাসাটা এক চালা টিনের। বাইরের সীমানাপ্রাচীরের দেয়ালটাও ঘরের একটা দেয়াল। সেই দেয়ালটা ইটের, এবড়ো-থেবড়ো, ইট-সুরকি খসে খসে পড়ছে। বহু আগের পুরনো টিনের ঘর আর যুগপৎ রাস্তার দেয়াল ও টিনের ঘরের দেয়াল। মন্টি সেই দেয়ালে নীল রং ঘষে। দেয়ালটা সুন্দর হয়ে ওঠে। মন্টি এমনি এমনি রং ঘষে, অথচ কত সুন্দর হয়! সুন্দর হয়! মন্টির মা ডাক-দোহাই দেয় না, মন্টির বাবা তো বাইরে বাইরেই, তাই সে সুযোগটা কাজে লাগায় আরো বেশি করে। মন্টির মা হয়তো ভাবে, থাক, অনেক পুরনো আর বিশ্রী দেয়াল, মন্টি বরং ওটাকে নীল রং ঘষে ঘষে সুন্দর করে তুলছে। একটু রংই তো! আর তো কিছু না, লাগান না রং, লাগুন না রং, অসুবিধা নেই। তাই নির্বিঘেœ রং লাগতে থাকে। মন্টি ইটের লাল আর চুনের সাদা সব ঢেকে দিতে পেরেছে নীলে! দেয়ালটা তখন থেকে পুরোপুরি নীল! এই নীল দেয়ালটায় চোখ পড়েছিল আসিফের। তার চোখে নীলের রং আর মনে অন্যের বউয়ের প্রেমের রং! প্রথম দর্শনে তাই দুইটা মিলে গুলিয়ে গেছে। হয়তো দেয়ালের নীল আর প্রেমের মেরুন মিলে অন্য কোনো রং তৈরি হওয়ায় যুবক একটা রংও ধরতে পারে নি ঠিক মতো।
মন্টি দেয়াল রাঙানোর মজায় ভুগছে। সুযোগ পেলেই খালি রাঙায়। শুধু নীলে। আশ-পাশের মানুষজনও কিছু বলে না, তারা যে যার মতো বুঝের মানুষ, পোলাপানের কাজে সহজে নজর যায় না, যদি না তাদের কোনো ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। মন্টি তাদের বাসার দেয়াল রাঙাচ্ছে, তাতে কার চোখ পড়ার কি আছে? কেউ কিছু বলে না। নাবালকের কাজ তাই চলছে!
মন্টি এখন বুঝতে পারে সব। সবকিছু। কে তার বাবা। কেন তার বাবা। শৈশবের নীলের মধ্যে বাবাকে অত চিনতে পারে নি। এখন যৌবনের নীলের মধ্যে বাবার আসল চেহারাটা দেখা যায়। সহজ করে বললে, মন্টির বাবা ছিলেন ঢাকার সব ঘাটের দালালদের বাবা। এই যেমন, পাসপোর্ট অফিস, সিটি করপোরেশন অফিস, পানি-বিদ্যুত-গ্যাস-খনিজ ইত্যাদি অফিস। এজন্য অনেক সাধনা করতে হয়েছে তাকে। দিনের পর দিন এসব অফিসের সামনে গিয়ে না খেয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছেন কোন কাজগুলোতে মানুষের ঠেকা বেশি, মানুষ অন্যের সাহায্য ছাড়া করতে পারে না। সেই কাজগুলো তিনি বুঝে নিয়েছেন। গোপনে গোপনে দলে-দলে লোক সাপ্লাই দিয়েছেন, যারা প্রশিক্ষিত। যারা লোকেদের বিপদ দেখলে আঁতকে ওঠে বলে, ও বাবা, এ বিশাল ঝামেলার কাজ, আপনি একা সামলাতে পারবেন না, আমারে কিছু টাকা দেন কইরা দেই। লোকেরা যখন দেখলো এদের সাহায্য ছাড়া কাজ এগুচ্ছে না, ফাইল নড়ছে না, আটকে থাকছে লাইনলাইনলাইনÑতখন এদের হস্ত চুমে ইস্তফা!
সেই দালালদলের প্রধান ছিলেন মন্টির বাবা। মন্টি এখনো জানে না, জানে কি? মন্টির মাও হয়তো জানেন না, টের পান, তার স্বামীর এত টাকার উৎস কী? মন্টির বাবার এত এত টাকা, তবুও এই বাহুল্য নেই, নিুবিত্তের টিনের বাড়িতে থাকারও একটা রহস্য আছে। মন্টি আর তার মা কখনো তা জানে না। জানতে চায় নি। কেন? আসলে এতে সন্দেহ বাড়ে। রাষ্ট্রের সন্দেহ বাড়ে মন্টির বাবার ওপর। তাই তিনি কখনোই দেখাতে চান নি নিজের শৌর্যবীর্য। আড়াল করে রেখেছিলেন প্রকৃত স্বরূপ। অঢেল টাকা ব্যাংকে থাকলেও ছিলেন একচালা টিনের ঘরে, নিজের আইডেন্টিটি দাঁড় করিয়েছিলেন যৌবনে দাবা খোলোয়াড় আর পরবর্তীকালে মন্টি আর মন্টির মায়ের সময়ে দাবা বোর্ডের দোকানদার। তলে তলে একটা সময়ে তিনিই ঠিক করতে থাকলেন এই শহরের বড় বড় চেয়ারগুলোতে কখন কে বসবে। কোন ওয়ার্ডের কে কখন খুন হবে আর কে পথ ক্লিয়ার হয়ে যাওয়ায় কমিশনার হবে, মেয়র হবে। একজন দাবা খোলোয়ার এভাবেই পুরো শহরটাকে একটা দাবার বোর্ড বানিয়ে ফেলে।
মন্টিরা এসব ধরতে পারে নি কখনো। তার আর তার মায়ের জীবন তার বাবার প্রকৃত স্বরূপের বাইরে ছিল, বাবার মুখোশের সমান তারা।
মন্টির বাবার বড় সাধ ছিল একসময় বিদেশে চলে যাবেন। টাকা পয়সা সব নিয়ে। দেশে কিছুই করবেন না তিনি। হয়তো তার এও সাধ ছিল আর কখনো দেশেই না ফেরার। হলোও তাই। মন্টি তাই একা। সে বাবার সঙ্গে যায় নি।
সে পড়ে আছে নীল রঙের দেয়াল জড়িয়ে। দেশে। ঢাকায়। নদ্দায়। শান্তিনগরে।
অবশেষে মন্টির বাবার উত্থানের একেবারে শীর্ষবিন্দুতে একদিন তিনি রাতের বেলা ছেলের পায়ের কাছে এসে বসলেন। তারপর মাথার কাছে গিয়ে কপালে হাত রাখলেন। জেগে গেল মন্টি। পাশের ঘরে থেকে মন্টির মা টের পেলেন না। মন্টির বাবা তাকে বলল,‘বাবা, তোর বিলবোর্ডটা দরকার।’ মন্টি উত্তর দিল,‘এইটা তো বিলবোর্ড না, দেয়াল’। এরমধ্যে দেয়ালটা মন্টির বয়স বাড়িয়ে নিয়েছে। শুষে নিয়েছে অনেকগুলো বছর। মন্টি তখন পনের বছরের কিশোর।
বাবা বলল,‘এখন তো তুই বড় হইছিস, আর কি আঁকবি দেয়ালে, দিয়া দে, তোর দেয়ালে আরো উন্নত একটা ডিজাইন আঁকাইয়া দিতাছি শিল্পী আইন্যা।’ মন্টি শুধু বলল,‘সকালে জানাই?’ আচ্ছা বলে ঘুমাতে গেল বাবা।
পরদিন দেয়াল থেকে নীল রং উধাও। সেখানে কত কত রঙের খেলা! বড় বড় শিল্পীরা একমনে একধ্যানে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা মেট্টো শপিংমলে মাস ব্যাপী মেলা। বাহারি রং-ডিজাইনের পোশাকের মেলা। তারপর আবার ফ্যাশন উইক। সেজন্য মন্টির নীল দেয়াল ছেয়ে গেছে রঙে। প্রচার চলছে মেলার। দেয়ালটার কাছেই শপিংমলটা। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় শপিং মল নাকি এটা। কিন্তু তার প্রচার এই ছোট্ট ক্যানভাসে কেন? সেদিন ছোট মাথায় ধরে নি মন্টির। এখন ধরে। সে সব বুঝতে পারে। বাবা তার নীল দেয়ালটা দখল করেছে কৌশলে। তার শৈশব-কৈশোরটাও চুরি করেছে সে।
মন্টি এক সময় একেকটা আঁকতো দেয়ালে, নীল রঙে। শীত-বর্ষা-গ্রীষ্ম সহ ছয় ঋতুতে ছয় রকমের আঁচড় কাটতো দেয়ালে। দুইমাস পর পর বদলে যেত তার দেয়াল। অনেক সুন্দর সুন্দর দৃশ্য এঁকে রাখতো সে। অথচ একটা দৃশ্যও কেউ দেখে বুঝতে পারতো না ঠিক কী এঁকেছে কিশোর। আর তা শৈশব থেকেই এঁকে যাচ্ছিল মন্টি। তার আঁকাআঁকি দেখার জন্য প্রতিদিন শহরের আনাচ-কানাচ থেকে ছুটে আসতো মানুষেরা। কম করে হলেও পাঁচশ মানুষ। অবিশ্বাস্য! পুরো শহরের একটা বড়োসড়ো আকর্ষণ ছিল এই দেয়াল। অথচ কিছুই টের পায়নি মন্টি। সে রাতে আঁকতো, সকালে স্কুলে চলে যেত। কখন কে আসতো-যেতো জানতো না। তার দেয়াল নিয়ে মানুষের এই যে কৌতূহল তার কিছুই সে টের পায় নি। এই দেয়ালের ছবি ছাপা হয়েছে দেশের সবগুলো পত্রিকায়, বিস্ময়কর নীল দেয়াল। বড় বড় শিল্পীরা এটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করেছে। টিভি-মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। তারা অনেক চেষ্টা করেও মন্টির সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। মন্টির বাবা তা হতে দেন নি। কারণ তিনি ভয়ে আতংকিত ছিলেন কেঁচো খুড়তে না সাপ বেড়িয়ে যায়। মন্টি যদি স্টার হয় তবে সবাই জানতে চাইবে কে তার মা, কে তার বাবা। দিনে দিনে কখনো যদি কোনো ভাবে ফাঁস হয়ে যায় বাবার রহস্য। পুত্রকে চিনতে গিয়ে কেউ যদি চিনতে চায় বাবাকে? তাহলে? তাই তিনি মন্টিকে আড়ালে রাখলেন। বুঝতে দেন নি এসব। অথচ মন্টি ঠিকই নিয়ম করে রাত-বিরাতে দেয়াল রাঙাতো। নীল রঙে।
বিখ্যাত এই দেয়ালে যখন পুরো শহরবাসীর নজর ঠিক তখনই এই দেয়ালে নজর পড়লো তার বাবার। এমন কি এই ছিমছাম সাধারণ বাড়িটাকেও মানুষ চিনতে শুরু করলো এই দেয়ালেরই রঙে। তারা এই বাড়িটার নাম দিলো, কালার হাউজ। মেট্টো শপিংমলে শেয়ার আছে মন্টির বাবার। তাই তিনি এই দেয়ালটার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে সেখানে পোশাকের মেলা আর ফ্যাশন উইকের বিজ্ঞাপন দিলেন! দেয়াল দখলের পর কী ঘটলো মন্টি জানে না। যে দিন দেয়ালে বিজ্ঞাপন আঁকা হলো সেদিন বিকেলেই কি এক অজ্ঞাত কারণে শান্তিনগরের বিশতলার এই ফ্ল্যাটে চলে এলো মন্টি, মন্টির মা আর তার বাবা। এর মাত্র এক সপ্তাহ পরই অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেল বাবা ও মা। মন্টিকে জোর করে নিতে চেয়েছিল। সে যায় নি। কারণ তার আছে এখানে নীল দেয়াল। নীল দেয়ালের ঢাকা। এই শহর ছেড়ে সে কোথাও যেতে চায় না। পরে অবশ্য জানতে পেরেছে মন্টি। তার বাবার নামে প্রতারণা-হত্যা-জমি দখল সহ মোট পনেরটি মামলা হয়েছে। তাই এই পলায়ন! মন্টি কথা শোনে নি। সে যাবে না দেখে এই বুয়াকেই তার দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে গেছে বাবা-মা। তাদের সঙ্গে এই বাড়ির বাড়িওলার যোগাযোগ আছে। বাড়িওলাও বিদেশে থাকে। সে মন্টির গুরুতর খোঁজগুলো নেয় বাড়ির কেয়ারটেকারের কাছ থেকে। তারপর বাবা-মাকে দেয়। এখন আর দেওয়া লাগে না। ফোনে বাবা-মা সরাসরি খোঁজ নেয় মন্টির। কিন্তু মন্টি পাগল হয়ে আছে নীলে।
আজ অনেক অনেক দিন পর, ঠিক কত বছর পর ঘর থেকে বের হতে যাচ্ছে মন্টিÑকেন সে নিজেই জানে না। হবে হয়তো, সেই কবে অনেক বছর আগে, ঠিক মনে নেয় একদিন ভার্সিটি থেকে ফিরে এসেছিল। যাই হোক, সে ঘর থেকে বের হচ্ছে একথা শুনে বুয়া মাথা ঘুরে পড়ে গেল! তার মুখ দিয়ে নীল রঙের ফেনা গড়িয়ে পড়ে গলার দিক হয়ে ফ্লোর ভিজে চলেছে। না তাকিয়ে দরজা মেলে বাইরে চলেছে মন্টি।
নদ্দা আর গুলশান-২ এর মাঝামাঝি একটা কাঁঠাল তলায় সিমেন্টের বেদিতে বসে এক কাপ রং চা খেল। সঙ্গে বেনসন লাইটস। তারপর সে দেখতে গেল তার সেই নীল রঙের দেয়াল। নদ্দায়। দুঃখিত! দেয়ালটা নেই! বাড়িটাও নেই! হয়তো তার বাবা বেচে দিয়েছে অনেক আগেই। বহুতল ভবন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে সেখানে। তাই সে আর সেখানে দাঁড়াতে পারেনি। ফিরে এলো কাঁঠালতলায়। আবার এককাপ চা খেয়ে বাসায় ফিরবে, হয়তো ফিরবে না। হাতে অর্ধ খাওয়া সিগারেটটা নিয়েই হয়তো হাঁটা দেবে।
কেন জানি মনে হচ্ছে মন্টির, কি জানি মনে হচ্ছে তার। একটু সামনেই তার সেই শৈশবের স্কুলটা--ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। তার মনে পড়ে বাবার কথা। বাবার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতো স্কুলের গেটে, তাকে টান দিয়ে বাইরে নিয়ে আসতো ভীড়ের ভেতর থেকে। তারপর রিকশায় তুলে দিয়ে বাসায় পাঠাতো। তার মনে হচ্ছে, এখন ঠিকই মনে হচ্ছে সেই প্রেমিকের মতো করে, যে আসিফÑ মন্টির সঙ্গে তার বাবার দেখা হয় নি কোনো দিন, কখনোই দেখা হয়নি, দেখা হতো স্বর্গ আর নরকের! কেবল নরক আর স্বর্গের স্কুলের গেটে।
সে ভাবছে আর বসে চা খাচ্ছে। ওদিকে সেই প্রেমিক! সে আসিফ। কারো জন্য হয়তো অপেক্ষা করছে। কার জন্য? বছরের পর বছর ধরে যার জন্য অপেক্ষা করছিল তার জন্য হয়তো। সে কি প্রসন্ন? দেখা যাক--
আসিফের সঙ্গে সেইবারই প্রথম ও শেষ দেখা হয়েছিল প্রসন্নের। সেই যে তারা রিকশায় ঘুরেছেÑসেই সময়। শেষে আসিফের সঙ্গে মন্টির নীল দেয়ালের সাক্ষাত হয়েছিল। তারপর! তারপর প্রসন্ন বিদেশ চলে গেছে। তার গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের কাছে! কিন্তু আসিফ প্রায়ই আসতো এই রাস্তায়। স্মৃতি হাতড়াতে। রিকশায় ঘুরতো স্মৃতির পিছুপিছু-আশপাশে। তারপর দেয়ালটা দেখতে যেতো। গিয়ে দেখতো, বাহ! কি সুন্দর দেয়াল। কে আঁকে। মন্টি আঁকে। অথচ জানতো না আসিফ। সে তাকিয়েতাকিয়ে শেষে চলে আসতো। কারো কাছে কিছু জানতেও চাইতো না। এভাবে যখনই যেতো প্রেমের স্মৃতির সন্ধানে তখনই দেয়ালদর্শন করে আসতো। নীল রঙের দেয়াল তো! তাই। আসিফের হৃদয়ের বেদনার সঙ্গে কোথায় যেন মিল আছে এই দেয়ালের! অথচ মন্টির কাছে এখন এই দেয়ালের অর্থ একেবারেই ভিন্ন!
এইতো! এসে গেছে! আরে! এ যে প্রসন্ন! অনেক বছর পর এসেছে দেশে। কেন? বিবেকের কাছে প্রশ্ন পথিকের। হয়তো কোনো ভাবে যোগাযোগ করেছে আসিফের সঙ্গে, তারপর প্রেমের স্মৃতি ঘাঁটতে এসেছে দুজনে। প্রসন্নটা কেমন বুড়িয়ে গেছে। তার বয়স নিশ্চয় হয়েছে পঞ্চাশ-টঞ্চাশ। আর আসিফের? তারও হবে পঁয়তাল্লিশ-টয়তাল্লিশ! প্রসন্নকে দেখে কিছুই বলছে না আসিফ। প্রসন্নও যে খুব কিছু বলছে তাও না। তারা চুপ। একেবারে চুপ। দূরে বসে বসে এই সব দৃশ্য দেখে দেখে মন্টিটা ভাবছে নীল দেয়ালের কথা। নীল সে দেয়াল। অনেক অনেক দিন আগের! এই তো সেদিনের দেয়াল। নীলে রাঙানো, নীলে মেশানো আর নীলে মাখানো দেয়াল। তখন বুঝতে পারে নি সে, কেন দেয়ালে আঁকাতো? কী আঁকাতো? আজ এই সময়ে কেন যেন তার মনে হচ্ছে, সে দেয়ালে স্বর্গ আঁকাতো। বেশি না, একখ- স্বর্গ! বাড়িভর্তি নরক ছিল বলে একখ- স্বর্গ এঁকে রাখতো সে। তাহলে, বেড়ালটার গায়ে কী আঁকতো নীলে? ওটা, ওটাতো ছিল স্বর্গের দরজা!
প্রসন্ন আর আসিফ কি করবে অনেকক্ষণ ধরে বুঝে উঠতে পারছিল না। অবশেষে তারা বুঝতে পারলো তাদের আলিঙ্গন করা উচিত, পারলো বলেই তারা একে অপরকে আলিঙ্গন করলো। মহা আলিঙ্গন! আসিফ কেন জানি বলে ফেলল কথাটা। প্রসন্নকে হালকা শুনিয়ে, হালকা না শুনিয়ে বললো, ‘লাইফ ইজ কালার হাউজ।’
মন্টি কি করবে বুঝতে পারছে না। সেও নিজের অজান্তেই বলে উঠল, ‘লাইফ ইজ কালার হাউজ! ওয়াল ইজ হ্যাভেন!’ তারপর মন্টি ভালো করে খেয়াল করে দেখলো, প্রসন্ন আর আসিফের বুকের মাঝখানে মন্টির বর্ণাঢ্য দেয়াল! নীলদেয়ালÑদেয়ালনীল!!!
0 মন্তব্যসমূহ