মোহছেনা ঝর্ণা'র গল্প : তখন আমরা ঘুমাইনি

থানাটা খুঁজে পেতে তেমন একটা কষ্ট হয়নি। রিকশাওয়ালাকে বলা মাত্রই নিয়ে গেল। দিঘীর পাশ দিয়ে রিকশাটা যাওয়ার সময় ঠান্ডা একটা বাতাসে গা জুড়িয়ে গেল। জিডি করতেও সময় লাগেনি বেশিক্ষণ। জিডি’র ব্যাপারটা এত সহজে হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। থানায় দায়িত্বরত অফিসার পুরো বিষয়টা শুনে যথারীতি অন্য অনেকের মতো বললেন, তখন নিশ্চয়ই আপনারা ঘুমিয়ে ছিলেন।

আমাদেরকে হেসে বরাবরের মতো জবাব দিতে হলো, জ্বি, না। তখন আমরা ঘুমাই নি।


ডিউটি অফিসার চেহারাটা মায়া মায়া করে বললেন, আহা, কেমন একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেল, তাই না? আসলে দেশটা চোর বাটপারে ভরে গেছে। ডোন্ট ওরি, উই উইল ট্রাই আওয়ার বেস্ট বলে জিডির কপিটা হাতে ধরিয়ে দিলেন। লেডি পুলিশ অফিসারের কথায় বেশ মায়া ছিল। পুলিশের লোকজন এত ভালো ব্যবহার করে জানা ছিল না। কারণ পুলিশ সম্পর্কে সব সময় শুনে এসেছি বাঘে ছূঁলে আঠার ঘা, আর পুলিশে ছূঁলে ছত্রিশ ঘা।

যাক বাবা কোনো রকম ঘা টা ছাড়াই বরং আন্তরিক ব্যবহারের মাধ্যমেই জিডির কাজটা কাজটা সম্পন্ন করা গেল ভেবে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।

জিডির কপিটা হাতে নিয়ে বেশ বিজয়ের একটা হাসি ছড়িয়ে আরেকটা রিকশা নিলাম কদল গাজী রোডের উদ্দেশ্যে। কার্তিকের সকাল বলেই হয়তো রোদের তেজ তখনো বাঘের মতো গর্জে উঠেনি। আমরা দু’ভাই-বোন একটা পিকনিক পিকনিক ভাব নিয়ে চারপাশটা দেখতে দেখতে আসছিলাম।

অফিসে ঢুকে দেখি কৃষ্ণ বাবুর চোখের কোনে সকালের সেই পিঁচুটি এখনো লেগে আছে। কৃষ্ণ বাবু হলেন সেই ব্যক্তি এই অফিসে ঢুকে যার সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয়। এক গাদা ফাইলের মধ্য খানে ডুবে ছিলেন তিনি। বরশিতে মাছ ধরার জন্য ছিপ ফেললে কোনো ভাবে মাছ মাথাটা তুলে বরশিতে আটকে যায় যেরকম, ঠিক সেরকম। চোখের কোনে পিচুটি, চোখ দুটিও ঘুমে ঢুলু ঢুলু হয়েছিল। অফিসের লোকজনের এমন বেহাল দশা দেখে ভেতরে ভেতরে বেশ বিধবস্ত হয়েছিলাম আমি।

কৃষ্ণবাবুকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি এখনো কুয়ার পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছেন। সকালের সেই ফাইলগুলো এখনো তার সামনে ঠিক উচুঁ পাহাড় না হলেও ছোট টিলা সমান উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছে। টেবিলের দিকে ঝুঁকে কি যেন লিখছিলেন। আমদেরকে দেখে বললেন, জিডি করতে পারছেন? জিডির কপি দেন। ফটোকপি করছেন?

একসাথে এতগুলো প্রশ্ন শুনে প্রথমে হাসলাম। তারপর বললাম,না। ফটোকপি তো করিনি। লাগবে? দিন, আমি করে আনছি।

-আচ্ছা আপনি বসেন। দেখি হিরন মিয়াকে পাওয়া যায় কিনা।

আমি চুপচাপ বসে থাকি। ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অফিসের অন্যদেরকে দেখার চেষ্টা করি।

অন্যরাও বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে হেলে দুলে কাজ করছেন। এর মধ্যে কৃষ্ণ বাবুর পাশে বসা একজন আবার মিনমিন করে বললেন, যে কাজের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলেন সেই কাজের কাগজপত্রই সামলাতে পারলেন না আর এত বড় অফিসের একাউন্টসের দায়িত্ব কেমনে সামলাবেন সেটাই ভাবছি। আসলে দেশটার কোনো উন্নতি হলো না কেন জানেন, এই দেশে গুনীর কোনো কদর নাই। দুইদিনের বাচ্চা ছেলে যে নিজেরে সামলাইতে পারে না তার কাছে সারা প্রতিষ্ঠান সামলানোর দায়িত্ব দিয়ে দেয়, বোঝেন অবস্থা।

দেশের অবস্থা বা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা কোনোটার অবস্থাই আমার বুঝতে ইচ্ছে করছিল না। আমি মুখটা পাংশু বর্ণের করে বুঝতে চেষ্টা করি এই টাইপের চিড়িয়াদের সাথেই কি সামনের জীবনের মূল সময়টা কাটাতে হবে? আড়চোখে খেয়াল করি আমার ভাই রাফসানের চেহারাটা কঠিন হয়ে আছে। ওর চেহারাটা অবশ্য ব্যাগ হারানোর পর থেকেই কঠিন হয়ে আছে।

আমরা এখানে বসে থাকা অবস্থায়ই একজন বাইরে থেকে এসে মোবাইলে খুব জোরে জোরে কাকে যেন অশ্লীল সব গালিগালাজ করছিল। গালি গালাজের মাত্রা এত ভয়াবহ ছিল যে আমি আমার ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছিলাম না। কিন্তু অফিসের অন্যরা দেখি নিত্যদিন চটুল গান শোনার মতো অভ্যস্ত ভঙ্গিতে স্বাভাবিক কাজ করে যাচ্ছিল।

রাফসান কিছুক্ষণ পরপর মোবাইলে সময় দেখছিল আর বলছিল আপা তোর চাকরিটা বেশ আরামের হবে রে!

রোজার মাস বলেই হয়তো ক্ষুধা-তৃষ্ণা খুব একটা কাবু করতে পারেনি। তবে এভাবে চলতে থাকলে রাতটা যে কোথায় কাটাব তা নিয়ে কিছুটা শংকিত হচ্ছিলাম আমি। সকাল বেলায় এমন একটা বিশ্রী ঘটনার কারণে এই শহরটার প্রতি বেশ বিতৃষ্ণা অনুভব করছিলাম।

বাশার সাহেব ছুটে এসে বললেন ম্যাডাম আসেন, আসেন, স্যার এসেছেন। বাশার সাহেবের সাথে সকাল বেলা পরিচয় হয়েছিল। অফিসের মধ্যে এই লোকটাকেই একটু সুস্থ এবং স্বাভাবিক মনে হয়েছে আমার।

স্যারের রুমে ঢুকে আমি একটি ধাক্কা খেলাম। গত তিন চার ঘন্টার পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে সমন্বয় করে স্যার সম্পর্কেও আমি মনে মনে একটা চিত্র এঁকে ফেলেছিলাম। কিন্তু ভদ্রলোককে দেখে প্রথমেই সেই ছবিটা ভেঙ্গে গেছে। বেশ সুঠাম গড়নের দীর্ঘাংগী একজন মানুষ। বয়স পঞ্চাশোর্ধ বলেই মনে হয়েছে। মাথা ভর্তি লালচে চুল। গায়ের রংটা শ্যামলা। মুখ ভর্তি লাল দাড়ি। চোখে সোনালি রঙের ফ্রেমের চশমা। চেহারাটায় কিছুটা গাম্ভীর্য আছে । কিন্তু বেশ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন।

রুমটাও বেশ বড়সড়। একটা কর্ণারে একটা বুক শেলফ। অফ হোয়াইট রঙের প্রিন্টের পর্দার পাশে বড় বড় মাটির পটারি। জানালা দিয়ে পর্দা ভেদ করে আলো এসে পুরো ঘরটা বেশ বেশ আলো আলো হয়ে আছে। একটা ছোট টেলিভিশন আছে টেবিলের বিপরীত দিকের দেয়ালের সাথে লাগানো কেবিনেটের উপরে।

আমরা রুমে ঢুকে সালাম দিতেই তাকিয়ে বসতে বললেন।আমার সাথে রাফসান আর বাশার সাহেবও ছিল। কিছুক্ষণ বাশার সাহেবের এগিয়ে দেয়া কাগজপত্রে সাইন করতে করতে স্যার বললেন, শুনলাম আপনার নাকি ব্যাগ চুরি হয়ে গেছে? ব্যাগটা চুরি হলো কিভাবে?

আমি বললাম, ট্রেন থেকে কে যেন নিয়ে গেল দেখিনি।

তিনি হাতের কাগজগুলো বাশার সাহেবের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, এত বড় একটা ব্যাগ কেউ নিয়ে গেল, আর আপনারা দেখলেন না? আপনারা কি তখন ঘুমাচ্ছিলেন?

আমি বললাম, না স্যার, তখন আমরা ঘুমাচ্ছিলাম না।

তিনি বললেন, তাহলে ব্যাগটা নিল কিভা্বে?

আমি মনে মনে বললাম, ব্যাগটা কিভাবে নিল সেটা যদি আমি দেখতাম তাহলে তো ব্যাগটা আর কেউ এভাবে হাপিস করে দিতে পারত না। কিন্তু মুখে বললাম, আমরা স্যার বুঝতে পারিনি। ট্রেনটা ছাড়ার পর আমার ভাই হঠাৎ লাগেজ স্ট্যান্ডের দিকে তাকিয়ে দেখল ব্যাগটা নেই।

-আপনারা ট্রেনে খোঁজ করেন নি?

-খোঁজ করেছি। আমরা আশে পাশের সবাইকে বললাম, আমদের ব্যাগটা পাচ্ছি না, কারো ব্যাগের সাথে মিশে গেল কিনা, তখন আমাদের আশেপাশের সিটে বসে থাকা যাত্রীদের মধ্যে বেশ ক’জন সরব হয়ে বললেন, এই ট্রেনে নাকি এমন ব্যাগ হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রায় সময় ঘটে। ট্রেনে নাকি চোরের খুব উৎপাত।

-তারপরও আপনারা যে আপনাদের ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন না সে বিষয়টা না বলে পারছি না। কারণ ট্রেনে চোরের উৎপাত থাকার পরও সবার ব্যাগ তো আর চুরি হয় না। চোরেরাও বুঝতে পারে কে তার নিজের মালামালের প্রতি সচেতন আর কে সচেতন নয়। আর তাছাড়া ব্যাগে যখন আপনার এত মুল্যবান জিনিস, বলা যায় আপনার সারা জীবনের অর্জন ছিল, তাহলে ব্যাগটার প্রতি আরেকটু সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত ছিল।

আমি রাফসানের দিকে তাকানোর চেষ্টা করি। কারণ এ লোকের কথা বার্তায় আমি গ্রীন সিগন্যালের কোনো লক্ষণ পাচ্ছি না।

মনে মনে অবশ্য আমি দু’জন মানুষের কথা ভেবে অতি মাত্রায় ব্যথিত হচ্ছিলাম। আমার এই চাকরিটা আমার চেয়েও যাদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এক আমার বাবা আর দুই তন্ময়। বাবাকে সকাল বেলাতেই ফোন করে জানিয়েছি ব্যাগ হারানোর ঘটনা। কিন্তু তন্ময়কে এখনো জানাইনি। আমাদের দু’জনের আঁধার জীবনে এই চাকরিটা কিছুটা আলোকছটার ইঙ্গিত দিয়েছিল এখন সেই চাকরিটা যদি অতি আনকোরা এক চোরের সামান্য চুরির ঘটনায় বিনা বিচারে নাকচ হয়ে যায় তাহলে তো এই অসহায়ত্বের বিষয় নিয়ে হতাশ নয়নে নীলিমার নীল দিগন্তে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। তন্ময়ও সেই সকাল থেকে এখন পর্যন্ত একবারও ফোন করেনি। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। তা নাহলে সকাল থেকে এত্তগুলো বাজে বাজে কথা বলতে আমার যথেষ্ট বিরক্তি লাগত।

সবাই যখন কাজের ঘোরে ব্যস্ত তখন আমি সকাল বেলার সেই দুর্ঘটনার দায় কি আমাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয় কিনা সে ভাবনাতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকি। আমাকে আবার খুব স্বাভাবিক থাকার ও ভান করতে হয় রাফসানের কথা ভেবে। বেচারার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ব্যাগ হারানোর সব দায় যেন ওর। অথচ রাত থেকে দু’ভাই-বোন মিলে কত প্ল্যান করছিলাম। চাকরিতে জয়েন করে আমরা কোথায় থাকব সে বিষয়টা ফাইনাল করে দু’ভাই-বোন মিলে ছোট্ট শহরটা ঘুরে ঘুরে দেখব।

কুয়াশা ভেজা ভোরে ‘পাহাড়িকা’ ধরার জন্য দু’ভাই-বোন আগের রাতে গুছিয়ে রাখা ব্যাগটা নিয়ে বের হয়েছিলাম। আমার বান্ধবী লুবনা ঢাকায় চাকরির জয়েনিং এর দিন ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সব সার্টিফিকেট আর এপয়েন্টমেন্ট লেটার সহ কাঁধের ভ্যানিটি ব্যাগটি হারিয়ে ফেলেছিল। ছিনতাইকারী তো আর জানল না সে সামান্য কিছু টাকার পাশাপাশি আরেকটা মানুষের সারা জীবনের স্বপ্ন কেড়ে নিল। বেচারি এখন পর্যন্ত আর কোনো চাকরির পরীক্ষাতেও টিকল না। জীবন তো আর “হঠাৎ বৃষ্টি” সিনেমার মতো না যে নায়িকার ব্যাগ হারিয়ে যাবে আর নায়ক সেই ব্যাগ কুড়িয়ে পেয়ে ঠিকানা দেখে দেখে নায়িকার বাসায় পৌঁছে দেবে!

আর তাই তো অতি সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা হিসেবে আমি আমার সমস্ত কাগজপত্র কাপড়ের ব্যাগে গুছিয়ে নিয়েছি। ভ্যানিটি ব্যাগে শুধু এপয়েন্টমেন্ট লেটারের একটা ফটোকপি রেখেছিলাম। ট্রেনে উঠে বসতেই দেখি মানুষ গিজ গিজ করছে। রাফসানকে জিজ্ঞেস করলাম এই ট্রেনে এত মানুষ কেন রে? ও বলল, এখানে নাকি স্ট্যাণ্ড টিকেটেও যাত্রী যায়,তাই এত ভিড়।

আমরা সিটে বসে কেবল মাত্র বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম। তখনই ট্রেনে হঠাৎ করে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ উঠতে থাকল। অনেকটা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনের মতো। ট্রেনের হুইসেল দেয়ার সাথে সাথে পড়িমড়ি করে দৌড়ে ট্রেন ধরার প্রতিযোগিতা। ঝাঁকের এই যাত্রীরা নাকি স্ট্যান্ড টিকেটের যাত্রী। এর পর পরই ট্রেনটা চলতে শুরু করল। আর ঠিক তখনই রাফসান সিটে হেলান দিয়ে আরাম করে বসতে গিয়ে উপরে লাগেজ স্ট্যান্ডের দিকে তাকিয়ে দেখে আমাদের ব্যাগটা নেই। ও সঙ্গে সঙ্গে বসা থেকে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, আপা আমাদের ব্যাগ কোথায়?

আমি বললাম, ব্যাগ কোথায় মানে? ভালো করে দেখ অন্য কারো ব্যাগের সাথে আগে পরে হয়ে গেল কিনা। ও ট্রেনের পুরো কামরাটা খূঁজে ফেলল। ওর খোঁজাখূঁজি দেখে অন্যরা বলল, ব্যাগ আর পাবেন না। এই ট্রেনগুলা চোরের আস্তানা হয়েছে। সব সময় এখানে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।

ও ট্রেনের টিটিকে খূঁজে বের করার জন্য অন্য কামড়ায় চলে গেল। কিছুক্ষণ পর মলিন চেহারা নিয়ে আমার সামনে এসে বলল, টিটিকে খূঁজে পেলাম না।

আমি বললাম, তুই শান্ত হয়ে বস। একটু পর টিটিই নিজের গরজেই আসবে।

রাফসান কাঁদো কাঁদো চেহারায় বলল, আপা, ব্যাগ ছাড়া আমরা ফেনীতে গিয়ে কি করব। তোর সব কাগজপত্র না ওখানে? আপা তোর চাকরিটা’র কি হবে?

আমিও বুঝতে পারছিলাম না আমার চাকরিটা’র কি হবে? কারণ আমার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অরিজিন্যাল এবং ফটোকপিসহ সব সার্টিফিকেটের পাশাপাশি চাকরির সব ডকুমেন্টও বড় ব্যাগটাতে ছিল। কেন জানি না আমি বাসায় কোনো ফটোকপিও রাখিনি। যখন কোনো বিষয় নিয়ে খুব বেশি দুঃশ্চিন্তা হয়,ঠিক তখন স্নায়ুর অতি চাপে আমার প্রচন্ড ঘুম পায়। রাফসানের দিকে তাকিয়ে আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, টেনশান করিস না। কপালে যা আছে তাই হবে।

আশচর্য, কখন যে আমি ঘুমিয়ে গেলাম আমি টেরই পেলাম না। এবং আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ঘুমের মধ্যে আমি খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। টিটি আসার পর রাফসান আমাকে ডেকে তুলল। ঘুমটা ভাঙ্গার পর বেশ ঝরঝরে লাগছিল নিজেকে। টিটির কথা শুনে যদিও মেজাজটা কিছুটা খিঁচড়ে গেল।টিটি বলল, আপনারা দু’জন মানুষ থাকতে আপনাদের সামনে একটা ব্যাগ নিয়ে গেল আর আপনারা দেখলেন না, আপনারা কি তখন ঘুমাচ্ছিলেন?

সেই থেকে শুরু।আমরা বললাম, না ,তখন আমরা ঘুমাচ্ছিলাম না।

এরপর যে এই একই প্রশ্ন আমাদেরকে কত বার শুনতে হলো এবং আরো কতবার শুনতে হয় এবং এই একই প্রশ্নের উত্তরে একই জবাব কতবার দিতে হয়েছে এবং সামনে কতবার দিতে হবে আমরা নিজেরাও জানি না।

বেচারা রাফসানের জন্য আমার খুব মায়া হচ্ছিল। ওর চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল ও বুঝি এখনই কেঁদে দিবে।

এসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার স্যার আমাদেরকে কিছু ফরম ফিলাপ করানোর জন্য বাশার সাহেবকে দিলেন আর বললেন একটু তাড়াতাড়ি করবেন যেন কাজটা শেষ করে ওনারা বাসায় গিয়ে ইফতার করতে পারে। রোজার মাস থাকায় সারাদিন শেষে সবারই বেশ তাড়াহুড়া ভাব চোখে পড়ল।

হঠাৎ করে স্যারের দরজা ঠেলে সেই লোকটা রুমে ঢুকে স্যারকে সালাম দিয়ে আমার পাশে এসে বললেন, আপা আপনার ব্যাগ হারাই গেছে আমাকে বলবেন না। কোন..…পুতের এত বড় সাহস আমার আপার ব্যাগ চুরি করে! দাঁড়ান আমি এখনই ব্যবস্থা নিতেছি। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আপনি আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বললে তো এতক্ষণেই একটা রেজাল্ট চলে আসত। আপনি নিশ্চিন্তে থাকেন। বিষয়টা আমি দেখতেছি। তবে আপা গাড়ি ঘোড়ার জার্নিতে ঘুমানো ঠিক না, কোথায় কোন দুর্ঘটনা হয়ে যায়!!

স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে আমরা বাশার সাহেবের সাথে বাইরে এসে কাগজ গুলো ফিলাপ করতে করতে বললাম, আমার চাকরিটা কি হচ্ছে?

বাশার সাহেব হো হো হেসে বললেন, ওমা আপনি এতক্ষণে এটা কি প্রশ্ন করলেন? আপনি তো সেই সকাল বেলা যখন আমাদের অফিসে এসে পৌঁছেছেন তখন থেকেই আমাদের পরিবারের সদস্য।

আমার যে কাগজপত্র কিছু নাই!!

বাশার সাহেব বললেন আপনার ইন্টাভিউ এর সময় তো সব ছিল।সেগুলো দেখেই তো আপনার এপয়েন্টমেন্ট লেটার ইস্যু হয়েছে নাকি?

তবে ম্যাডাম এর পরে থেকে কিন্তু ট্রেনের জার্নিতে এমন ব্যাগ ফেলে রেখে অসতর্কভাবে আর ঘুমাবেন না।

আমি বাশার সাহেবের কথা শুনে মুখে একটা হাসি ছড়িয়ে আমার ভাই রাফসানের দিকে তাকাই। সেই সকালে ব্যাগ হারানোর পর থেকে বেচারার চোয়াল এমন শক্ত হয়েছিল যে তাকানোই যাচ্ছিল না। এই প্রথম ও হেসে বলল, আপা অবশেষে তোর চাকরিটা হলো।

আমরা অফিস থেকে বের হয়ে আসার সময় দেখি কৃষ্ণ বাবু খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিল। বললাম, দাদা আসি। তিনি মাথা তুলে তাকিয়ে বললেন, কালকে আসার সময় ট্রেনে আর ঘুমাবেন না। ব্যাগ সাবধানে রাখবেন। তার চোখের পিঁচুটি তখন শুকিয়ে খটখটে হয়ে চোখের কোনে লেগেছিল। আশচর্য এখন আর কৃষ্ণবাবুকে দেখতে একটুও পঁচা লাগছিল না।



লেখক পরিচিতিঃ
নামঃ মোহছেনা ঝর্ণা
জন্মস্থানঃ লক্ষীপুর

বর্তমান আবাসস্থলঃ চট্টগ্রাম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. ছোট্ট একটা দূর্ঘটনা একটা দিনের মূহুর্ত গুলোকে কিভাবে বিভীষিকাময় করে তুলতে পারে তার সুন্দর বয়ান এই গল্পটি। ভাল লাগল।

    উত্তরমুছুন
  2. ছোট্ট একটা দূর্ঘটনা একটা দিনের মূহুর্ত গুলোকে কিভাবে বিভীষিকাময় করে তুলতে পারে তার সুন্দর বয়ান এই গল্পটি। ভাল লাগল।

    উত্তরমুছুন