(এক)
মৃদু জলতরঙ্গের মত বেজে ওঠে কলিংবেলটা । যা ভেবেছে ঠিক তাই । বাবা দরজা বন্ধ করে প্যাকেটগুলো নিয়ে ওর ঘরের দিকেই আসছেন । ধ্রুব চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে । ঘুমের ভানটুকুর বড় প্রয়োজন এখন , নাহলে বাবা তার ঘরেই দুপুরটা কাটিয়ে দেবেন ।
অদম্য কৌতূহলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকবেন প্যাকেট থেকে বেরিয়ে আসা রমণীয় বস্তুগুলোকে । ধ্রুব লক্ষ্য করে দেখেছে , ভ্রমরের জন্য অন লাইন শপিং এ কেনা জিনিসগুলো এলেই বাবার মুখে একটা অন্যরকম আলো জ্বলে ওঠে ।
চোখের তারায় রূপালী স্বপ্নের ঢেউ উথলায় । তোবড়ানো মুখ আর বলিরেখায় হীরক কুঁচি জ্বলে ওঠে । বাবাকে নিয়ে তার সমস্যা নেই । তাদের রমণীবিহীন সংসারে বাবা ছেলে পরস্পর কে আঁকড়েই তো বেঁচে আছে তারা । কিন্তু আজকের প্যাকে্টটা একান্ত গোপনীয় , এ বাবাকে দেখানো যায়না ।
বাবা চলে যেতেই , সে প্যাকেটটা খোলে । পর্দা ঢাকা ছায়াচ্ছন্ন ঘরে একরাশ প্রজাপতি ডানা ঝাপটিয়ে স্বপ্ন বুনতে শুরু করে । ধ্রুব’র মুঠিতে ধরা রংবেরঙের অন্তর্বাস , ভ্রমরের শেপ সাইজ মিলিয়ে অর্ডার করা । কিছুক্ষণ বসে থাকার পর, ঘরের চতুর্দিকে সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকায় সে । টের পায় প্রজাপতিরা কখন কীভাবে যেন স্বপ্নের ডানাটুকু খসিয়ে জানলা গলিয়ে পালিয়ে গেছে ।
রান্নাঘর থেকে টুং টাং আওয়াজ ভেসে আসে । একটু পরেই বাবা , ট্রে তে সাজিয়ে দু কাপ চা নিয়ে আসেন । দুধ চিনি ছাড়া লিকার চা সঙ্গে মেশানো আদার নির্যাস। ভ্রমর একদিন ওদের বাবা ছেলের দুধ চিনি সহ চা খাবার অভ্যাস শুনে হাঁ হাঁ করে উঠেছিল । “ইস তোমরা কী গো ! একটু আদা দিয়ে লিকার খেতে পারতো , কত উপকার জানো !”
প্রত্যেকদিন সকালে বাবা মন দিয়ে ধ্রুব’র কাছে ভ্রমরের কথা শোনেন । ভ্রমরের পছন্দ অপছন্দ শুনতে শুনতে তাদের এই বাড়িটাই আস্তে আস্তে ওর পছন্দের সাজে সেজে ওঠে । আদা মেশানো চা , জানলার পর্দার রঙ এমনকি দুপুরে ভাতের পর শুকনো আমলকী , ঠিক যেমন যেমন ভ্রমর পছন্দ করে ।
এক রবিবার বাবা , ভ্রমরের ছবি দেখতে চাইলেন । যে মেয়ে তার ছেলের সব কথা জেনেও এগিয়ে এসেছে তাকে দেখতে যে বড় সাধ হয় । এই ভয়টাই ধ্রুব করছিল । সে কতবার বলেছে কিন্তু ভ্রমর যে বড্ড একরোখা , কিছুতেই ছবি দেবেনা । অনেক অনুনয় করতে নিজের প্রোফাইলে একটা আবছা ছবি লাগিয়েছে । বাবাকে ল্যাপটপ খুলে সেটাই দেখায় ।
ছবিটা পিছন থেকে তোলা । সরু কোমরের প্রান্তে একটা মোটা বিনুনী ময়াল সাপের মত লুটোচ্ছে । ঘাড়ের কাছে একটা কালো তিল । বাবার কপালে ভাঁজ পরে । মুখ দেখাতে কীসের আপত্তি মেয়ের ?
ধ্রুবই কথা হাতড়ায় , ভ্রমর বলে দিল্লী থেকে ফিরেই একদিন আমাদের বাড়ি এসে চমকে দেবে । হুইলচেয়ারে বসা ছেলের লিকলিকে পা দুটোর দিকে বাবা তাকিয়ে থাকেন আনমনে । একসময় টের পান কখন যেন চশমার কাঁচ বাস্পাচ্ছন্ন হয়ে গেছে ।
(দুই)
“সত্যি আসছ ভ্রমর ?”
“বলেছিলাম তো প্রজেক্টটা শেষ করেই আমি কোলকাতার অফিসে ফিরব’।
“হু , আর ফিরেই আমাদের বাড়ি এসে চমকে দেবে । আমাদের ঠিকানা তো তোমার মুখস্থ’।
“না হয়ে উপায় আছে ! তোমাদের হুলো দুটোর ঝগড়া , ড্রয়িং রূমের যামিনী রায় , জিনিয়াগুলোর ফলন্ত যৌবন সব শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে যে”।
স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে ধ্রুব বোকা বোকা হাসতে থাকে । কীবোর্ডে ঝড় তোলে , “যদি তোমাকে চিনতে না পারি ! একবার কী ওয়েব ক্যাম অন করা যায়না ?”
ভ্রমর অনেকক্ষণ চলে গেছে । এমন আবদারে ও বিরক্ত হয় বরাবর । ধ্রুব জানলার কাছে আসে । ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটায় মনের মেঘ কেটে যায় । একদিন আর পাঁচ জনের মতই স্বাভাবিক ছিল সে । তারুণ্যে ভরপুর , উজ্জ্বল মেধার সুচাকুরে । শখের মধ্যে ছিল ট্রেকিং । ঠিক পাঁচ বছর আগে ট্রেকিং থেকে ফিরে আসে অজানা জ্বর নিয়ে তারপর একদিন ঘুম ভেঙে দেখে পায়ে জোর পাচ্ছেনা । অনেক ট্রিটমেন্ট করেও ফল পাওয়া গেলনা । ধীরে ধীরে পা দুটো সরু লিকলিকে হয়ে গেল ।
মা বহুদিন হল মারা গেছেন । এক বছরের পুরনো বউ স্নিগ্ধাও আস্তে আস্তে গনগনে আগুনের মত হয়ে উঠছিল । একদিন সেও চলে গেল । তাদের বাবা ছেলের নারীবিহীন সংসার শ্রীহীন হয়ে উঠল । আজ এত বছর পর ভ্রমরের আবির্ভাব । তাদের সঙ্গে না থেকেও অদ্ভূত ভাবে জড়িয়ে যেতে লাগল মায়াবী আলোর মত । সারা ঘরে ওর উপস্থিতি । ধ্রুব টের পেল , ভ্রমর একটু একটু করে ওর রক্তে মজ্জায় নরম সোহাগের মত দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছে ।
(তিন)
ধ্রুব গলা তুলল , “মিনু মাসী পনিরের প্রিপারেশনটা নামাবার আগে ভাজা পেঁয়াজ ছড়িয়ে দেবে কিন্তু”।
দেব রে বাবা দেব । আজ যে কী হয়েছে বাবা ছেলের । মিনু মাসী গজগজ করতে করতে খুন্তি নাড়ে । বাবা নিজে আজ রায়তা বানাচ্ছেন । ভ্রমর এই অভ্যাসটা সম্প্রতি ধরিয়েছে ওদের । টেবিলটা মনের মত করে গুছিয়ে ছেলেকে জিগ্যেস করেন , “ দেখ তো ভ্রমরের পছন্দ হয় কিনা ! যা খুঁতখুঁতে মেয়ে ও। ধ্রুব হাসতে থাকে , বাবা এমন করে বলছে যেন কত চেনেন ভ্রমরকে । মিনু মাসী কাজ সেরে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল , “ কে বলবে বাড়িতে মেয়েছেলে নেই ! এমন টিপটপ সব কিছু যে মেয়েমানুষেও হার মেনে যায়’।
ধ্রুব সারা ঘরে হাল্কা চোখ বোলায় । সত্যি তো । কী নিখুঁত , সুন্দর , ছিমছাম তাদের সেই চেনা ঘরটা । সোফার এক কোনে সদ্য কেনা পোড়ামাটির ঘোড়া । পিতলের পটে দুটি ইনডোর প্ল্যান্টে নেমে এসেছে অরণ্যের মাদকতা । হঠাৎ সবকিছু বড় অচেনা লাগে ধ্রুব’র চোখে । খুব শীত করে ওর । মেরুদন্ড বেয়ে একটা হিমেল স্রোত নিচে নেমে যায় ।
অপেক্ষা করতে করতে এক সময় ক্লান্ত দুচোখের পাতা বন্ধ হয় । বাবা ঠায়ে বারান্দায় বসে আছেন । একবার শুধু প্রশ্ন করে গেছেন , “আজকেই আসবে বলেছিল তো ? কোনও কন্ট্যাক্ট নাম্বার ?” ঘুম চোখে ধ্রুব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল একটু ।
ঘুম ভাঙতেই টের পায় , সারা ঘরে চাপ চাপ অন্ধকার । বাবা একভাবে এখন ও রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে আছেন । ধ্রুব নিঃশব্দে নিজের ঘরে এসে ল্যাপটপটা অন করল , কড়া করে দুকথা শোনাবে ভ্রমরকে । কিন্তু কোথায় কী , ওর প্রোফাইলটাই উড়ে গেছে । তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে বারবার ।
ছেলের ঘরে আলো জ্বলতে দেখে বাবা এসে দাঁড়ান । দরজার কাছে এসেই পা দুটো আটকে যায় । একী দেখছেন তিনি !
ধ্রুব হাট করে খুলে ফেলেছে ওয়ার্ডরোবটা । দীর্ঘ পাঁচ মাসে তিলতিল করে ভ্রমরের জন্য কেনা উপহার সামগ্রী ছড়িয়ে ফেলেছে মেঝেতে । অন্তর্বাস , র্যাপার , লিপস্টিক , কস্টিউম জুয়েলারীতে সেজে উঠেছে ধ্রুব । মেঝে থেবড়ে বসে আছে সে। তার লিকলিকে পা দুটিতে কীভাবে স্টিলেটো জোড়া ফিট করবে সেই চিন্তায় খানিক বিষণ্ণ যেন । বাবার চোখে চোখ পড়তে অপ্রস্তুত হাসি হাসে । তারপর চোখের পাতায় আইলাইনারের টান দিতে মহাব্যস্ত হয়ে যায় সে ।
বাবার চোখে ঘোর লেগে যায় । কাকে দেখছেন তিনি ? ধ্রুব নাকি ভ্রমর ? নাকি ওরা মিলেমিশে এক হয়ে গেছে ! তিনি এগিয়ে যান । সজোরে আঘাত করতে উদ্যত হন ছেলেকে , তাঁর বিশ্বাস তীব্র আঘাতে খোলস মুক্ত হয়ে আসল ধ্রুব এখুনি বেরিয়ে আসবে ।
কিন্তু উদ্যত হাত থেমে যায় , জানলা দিয়ে ভেসে আসে প্রতিবেশী টিভির গান , “ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে’। তাই শুনে ধ্রুব খিলখিল করে হেসে ওঠে । বাবার মনে হয় একমাত্র ভ্রমরই এমন করে হাসতে পারে ।
পরিচিতি
মহুয়া মল্লিক.
চুচুড়া, পশ্চিমবঙ্গ।
কবি, গল্পকার।
প্রকাশিত গ্রন্থতালিকা –
মৃদু জলতরঙ্গের মত বেজে ওঠে কলিংবেলটা । যা ভেবেছে ঠিক তাই । বাবা দরজা বন্ধ করে প্যাকেটগুলো নিয়ে ওর ঘরের দিকেই আসছেন । ধ্রুব চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে । ঘুমের ভানটুকুর বড় প্রয়োজন এখন , নাহলে বাবা তার ঘরেই দুপুরটা কাটিয়ে দেবেন ।
অদম্য কৌতূহলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকবেন প্যাকেট থেকে বেরিয়ে আসা রমণীয় বস্তুগুলোকে । ধ্রুব লক্ষ্য করে দেখেছে , ভ্রমরের জন্য অন লাইন শপিং এ কেনা জিনিসগুলো এলেই বাবার মুখে একটা অন্যরকম আলো জ্বলে ওঠে ।
চোখের তারায় রূপালী স্বপ্নের ঢেউ উথলায় । তোবড়ানো মুখ আর বলিরেখায় হীরক কুঁচি জ্বলে ওঠে । বাবাকে নিয়ে তার সমস্যা নেই । তাদের রমণীবিহীন সংসারে বাবা ছেলে পরস্পর কে আঁকড়েই তো বেঁচে আছে তারা । কিন্তু আজকের প্যাকে্টটা একান্ত গোপনীয় , এ বাবাকে দেখানো যায়না ।
বাবা চলে যেতেই , সে প্যাকেটটা খোলে । পর্দা ঢাকা ছায়াচ্ছন্ন ঘরে একরাশ প্রজাপতি ডানা ঝাপটিয়ে স্বপ্ন বুনতে শুরু করে । ধ্রুব’র মুঠিতে ধরা রংবেরঙের অন্তর্বাস , ভ্রমরের শেপ সাইজ মিলিয়ে অর্ডার করা । কিছুক্ষণ বসে থাকার পর, ঘরের চতুর্দিকে সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকায় সে । টের পায় প্রজাপতিরা কখন কীভাবে যেন স্বপ্নের ডানাটুকু খসিয়ে জানলা গলিয়ে পালিয়ে গেছে ।
রান্নাঘর থেকে টুং টাং আওয়াজ ভেসে আসে । একটু পরেই বাবা , ট্রে তে সাজিয়ে দু কাপ চা নিয়ে আসেন । দুধ চিনি ছাড়া লিকার চা সঙ্গে মেশানো আদার নির্যাস। ভ্রমর একদিন ওদের বাবা ছেলের দুধ চিনি সহ চা খাবার অভ্যাস শুনে হাঁ হাঁ করে উঠেছিল । “ইস তোমরা কী গো ! একটু আদা দিয়ে লিকার খেতে পারতো , কত উপকার জানো !”
প্রত্যেকদিন সকালে বাবা মন দিয়ে ধ্রুব’র কাছে ভ্রমরের কথা শোনেন । ভ্রমরের পছন্দ অপছন্দ শুনতে শুনতে তাদের এই বাড়িটাই আস্তে আস্তে ওর পছন্দের সাজে সেজে ওঠে । আদা মেশানো চা , জানলার পর্দার রঙ এমনকি দুপুরে ভাতের পর শুকনো আমলকী , ঠিক যেমন যেমন ভ্রমর পছন্দ করে ।
এক রবিবার বাবা , ভ্রমরের ছবি দেখতে চাইলেন । যে মেয়ে তার ছেলের সব কথা জেনেও এগিয়ে এসেছে তাকে দেখতে যে বড় সাধ হয় । এই ভয়টাই ধ্রুব করছিল । সে কতবার বলেছে কিন্তু ভ্রমর যে বড্ড একরোখা , কিছুতেই ছবি দেবেনা । অনেক অনুনয় করতে নিজের প্রোফাইলে একটা আবছা ছবি লাগিয়েছে । বাবাকে ল্যাপটপ খুলে সেটাই দেখায় ।
ছবিটা পিছন থেকে তোলা । সরু কোমরের প্রান্তে একটা মোটা বিনুনী ময়াল সাপের মত লুটোচ্ছে । ঘাড়ের কাছে একটা কালো তিল । বাবার কপালে ভাঁজ পরে । মুখ দেখাতে কীসের আপত্তি মেয়ের ?
ধ্রুবই কথা হাতড়ায় , ভ্রমর বলে দিল্লী থেকে ফিরেই একদিন আমাদের বাড়ি এসে চমকে দেবে । হুইলচেয়ারে বসা ছেলের লিকলিকে পা দুটোর দিকে বাবা তাকিয়ে থাকেন আনমনে । একসময় টের পান কখন যেন চশমার কাঁচ বাস্পাচ্ছন্ন হয়ে গেছে ।
(দুই)
“সত্যি আসছ ভ্রমর ?”
“বলেছিলাম তো প্রজেক্টটা শেষ করেই আমি কোলকাতার অফিসে ফিরব’।
“হু , আর ফিরেই আমাদের বাড়ি এসে চমকে দেবে । আমাদের ঠিকানা তো তোমার মুখস্থ’।
“না হয়ে উপায় আছে ! তোমাদের হুলো দুটোর ঝগড়া , ড্রয়িং রূমের যামিনী রায় , জিনিয়াগুলোর ফলন্ত যৌবন সব শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে যে”।
স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে ধ্রুব বোকা বোকা হাসতে থাকে । কীবোর্ডে ঝড় তোলে , “যদি তোমাকে চিনতে না পারি ! একবার কী ওয়েব ক্যাম অন করা যায়না ?”
ভ্রমর অনেকক্ষণ চলে গেছে । এমন আবদারে ও বিরক্ত হয় বরাবর । ধ্রুব জানলার কাছে আসে । ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটায় মনের মেঘ কেটে যায় । একদিন আর পাঁচ জনের মতই স্বাভাবিক ছিল সে । তারুণ্যে ভরপুর , উজ্জ্বল মেধার সুচাকুরে । শখের মধ্যে ছিল ট্রেকিং । ঠিক পাঁচ বছর আগে ট্রেকিং থেকে ফিরে আসে অজানা জ্বর নিয়ে তারপর একদিন ঘুম ভেঙে দেখে পায়ে জোর পাচ্ছেনা । অনেক ট্রিটমেন্ট করেও ফল পাওয়া গেলনা । ধীরে ধীরে পা দুটো সরু লিকলিকে হয়ে গেল ।
মা বহুদিন হল মারা গেছেন । এক বছরের পুরনো বউ স্নিগ্ধাও আস্তে আস্তে গনগনে আগুনের মত হয়ে উঠছিল । একদিন সেও চলে গেল । তাদের বাবা ছেলের নারীবিহীন সংসার শ্রীহীন হয়ে উঠল । আজ এত বছর পর ভ্রমরের আবির্ভাব । তাদের সঙ্গে না থেকেও অদ্ভূত ভাবে জড়িয়ে যেতে লাগল মায়াবী আলোর মত । সারা ঘরে ওর উপস্থিতি । ধ্রুব টের পেল , ভ্রমর একটু একটু করে ওর রক্তে মজ্জায় নরম সোহাগের মত দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছে ।
(তিন)
ধ্রুব গলা তুলল , “মিনু মাসী পনিরের প্রিপারেশনটা নামাবার আগে ভাজা পেঁয়াজ ছড়িয়ে দেবে কিন্তু”।
দেব রে বাবা দেব । আজ যে কী হয়েছে বাবা ছেলের । মিনু মাসী গজগজ করতে করতে খুন্তি নাড়ে । বাবা নিজে আজ রায়তা বানাচ্ছেন । ভ্রমর এই অভ্যাসটা সম্প্রতি ধরিয়েছে ওদের । টেবিলটা মনের মত করে গুছিয়ে ছেলেকে জিগ্যেস করেন , “ দেখ তো ভ্রমরের পছন্দ হয় কিনা ! যা খুঁতখুঁতে মেয়ে ও। ধ্রুব হাসতে থাকে , বাবা এমন করে বলছে যেন কত চেনেন ভ্রমরকে । মিনু মাসী কাজ সেরে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল , “ কে বলবে বাড়িতে মেয়েছেলে নেই ! এমন টিপটপ সব কিছু যে মেয়েমানুষেও হার মেনে যায়’।
ধ্রুব সারা ঘরে হাল্কা চোখ বোলায় । সত্যি তো । কী নিখুঁত , সুন্দর , ছিমছাম তাদের সেই চেনা ঘরটা । সোফার এক কোনে সদ্য কেনা পোড়ামাটির ঘোড়া । পিতলের পটে দুটি ইনডোর প্ল্যান্টে নেমে এসেছে অরণ্যের মাদকতা । হঠাৎ সবকিছু বড় অচেনা লাগে ধ্রুব’র চোখে । খুব শীত করে ওর । মেরুদন্ড বেয়ে একটা হিমেল স্রোত নিচে নেমে যায় ।
অপেক্ষা করতে করতে এক সময় ক্লান্ত দুচোখের পাতা বন্ধ হয় । বাবা ঠায়ে বারান্দায় বসে আছেন । একবার শুধু প্রশ্ন করে গেছেন , “আজকেই আসবে বলেছিল তো ? কোনও কন্ট্যাক্ট নাম্বার ?” ঘুম চোখে ধ্রুব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল একটু ।
ঘুম ভাঙতেই টের পায় , সারা ঘরে চাপ চাপ অন্ধকার । বাবা একভাবে এখন ও রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে আছেন । ধ্রুব নিঃশব্দে নিজের ঘরে এসে ল্যাপটপটা অন করল , কড়া করে দুকথা শোনাবে ভ্রমরকে । কিন্তু কোথায় কী , ওর প্রোফাইলটাই উড়ে গেছে । তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে বারবার ।
ছেলের ঘরে আলো জ্বলতে দেখে বাবা এসে দাঁড়ান । দরজার কাছে এসেই পা দুটো আটকে যায় । একী দেখছেন তিনি !
ধ্রুব হাট করে খুলে ফেলেছে ওয়ার্ডরোবটা । দীর্ঘ পাঁচ মাসে তিলতিল করে ভ্রমরের জন্য কেনা উপহার সামগ্রী ছড়িয়ে ফেলেছে মেঝেতে । অন্তর্বাস , র্যাপার , লিপস্টিক , কস্টিউম জুয়েলারীতে সেজে উঠেছে ধ্রুব । মেঝে থেবড়ে বসে আছে সে। তার লিকলিকে পা দুটিতে কীভাবে স্টিলেটো জোড়া ফিট করবে সেই চিন্তায় খানিক বিষণ্ণ যেন । বাবার চোখে চোখ পড়তে অপ্রস্তুত হাসি হাসে । তারপর চোখের পাতায় আইলাইনারের টান দিতে মহাব্যস্ত হয়ে যায় সে ।
বাবার চোখে ঘোর লেগে যায় । কাকে দেখছেন তিনি ? ধ্রুব নাকি ভ্রমর ? নাকি ওরা মিলেমিশে এক হয়ে গেছে ! তিনি এগিয়ে যান । সজোরে আঘাত করতে উদ্যত হন ছেলেকে , তাঁর বিশ্বাস তীব্র আঘাতে খোলস মুক্ত হয়ে আসল ধ্রুব এখুনি বেরিয়ে আসবে ।
কিন্তু উদ্যত হাত থেমে যায় , জানলা দিয়ে ভেসে আসে প্রতিবেশী টিভির গান , “ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে’। তাই শুনে ধ্রুব খিলখিল করে হেসে ওঠে । বাবার মনে হয় একমাত্র ভ্রমরই এমন করে হাসতে পারে ।
পরিচিতি
মহুয়া মল্লিক.
চুচুড়া, পশ্চিমবঙ্গ।
কবি, গল্পকার।
প্রকাশিত গ্রন্থতালিকা –
তিলফুল ( ছোট গল্পের সংকলন ) , শূন্য ক্যানভাস (ছোট গল্পের সংকলন ),
প্রজাপতি করিডোর ( কবিতার সংকলন)।
1 মন্তব্যসমূহ
Ami speechless,tilottoma majumdar er por eto sundor kore manusher koshto ar emotion keu lekhe ni- ami sahityik na- bujhio na- kintu jotodin beche thakbo ei golpo ta bhulbo na.eta sei rokom golpo jeta pore monta onek khun bhaar hoye thaake- onekdin choritro gulo tomar songei ghure beray- ki are bolbo- ashadharon- apurbo- mind blowing- expectation kintu bere gelo :-)
উত্তরমুছুন