মাসুদা ভাট্টির গল্প : গল্পটা আসলে শাহ্ আলমের

সজীবের বাবা হারিয়ে গেছেন, ও যখন বেশ ছোট, তখন। একদিন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে তিনি আর ফিরে আসেননি। এখনও তার কোনো খোঁজ নেই। প্রায় সবাই ওর বাবার কথা ভুলে গেছে, এটা ওর ধারণা নয়, বিশ্বাস। এমনকি ওর মাও, এখন আর বাবাকে মনে করেন কি না সজীব জানে না, বা বুঝতে পারে না। কারণ, তিনি প্রায় কারো সঙ্গেই কোনো কথা বলেন না। সজীব এখন একটি বেসরকারী সংস্থায় কাজ করছে, উঁচু পদই বলতে হবে। বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি।


বাবা হারিয়ে যাবার পর থেকে সজীবের জীবন কেমন কাটছে? সে এক বিরাট গল্প। অতো কথায় আমাদের কাজ নেই। আমরা দু’জন মানুষকে দেখতে চাই, না, আসলে তিনজন মানুষকে দেখতে চাই। সজীবের বাবার হারিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে এই তিনজন মানুষের জীবনে কী কী হলো, তার কিছুটা জানলেই আমাদের চলবে।

আমরা জানতে পারি যে, সজীবের বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। নাম শাহ্ আলম ভূঁইয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলেন তখন। যুদ্ধে যোগ দিতে সময় নেননি এক মাসও। এপ্রিলের মাঝামাঝি চলে গিয়েছিলেন। আর ঢাকায় ফিরেছেন যুদ্ধ শেষে। স্বাধীন দেশে ফিরে লেখাপড়া শেষ করেছেন। চাকুরি নিয়েছেন। বিয়ে করেছেন। সজীবের মা, লতা, ওর বাবার সহপাঠী না হলেও একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করেছে এবং ঢাকার একটি নামকরা মেয়ে স্কুলে পড়ানো শুরু করেছিলেন যখন ওদের বিয়ে হয়। সংসার অসুখের হওয়ার কথা নয়। কিন্তু অসুখটা হলো শাহ্ আলমের, ছিয়াত্তর সালের জানুয়ারি মাসের কোনো এক ভোর রাতে। ঘুম ভেঙে লাইট জ্বালিয়ে স্ত্রীকে জাগিয়ে শাহ্ আলম ফিস ফিস করে বললেন, “শোনো, ওরা এসেছে, বাইরে। আমাকে নিয়ে যেতে। তুমি গিয়ে দরোজা খোলো আর বলো যে, শাহ্ আলম নামে এই বাড়িতে কেউ থাকে না। বলতে পারবে না?”

হঠাৎ ঘুম ভাঙা লতা তখন বিহ্বল হয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছেন। সে সময়ের লাইটগুলোর আলো অত্যন্ত হলুদ হতো, লতার পরে মনে হতো সেকথা। লতা মনে করতে পারেন, সেই গভীর রাতে শাহ্ আলমের দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না একদম। উদ্ভ্রান্ত শব্দটি লতা নিজে একটু লেখালেখির কারণে হোক কিংবা বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে হোক, যেভাবে জানে ঠিক সেরকম নয়, তার চেয়েও অদ্ভূত দৃষ্টি আর কন্ঠস্বর নিয়ে শাহ্ আলম গভীর রাতে লতাকে দরোজা খুলতে বলেন এবং সেই মিথ্যেচারটি করতে বলেন। লতার ঘুম কেটে যায়, উঠে গিয়ে দরোজা খুলে দেখেন, বাইরে কেউ নেই। শীতের সঙ্গে অন্ধকার জড়াজড়ি করে উঠোন জুড়ে বসে আছে। ফিরে এসে শাহ্ আলমকে যখন বলেন যে বাইরেতো কেউ নেই, তখন শাহ্্ আলম খেকিয়ে ওঠেন। লতা বুঝতে পারেন যে, এটা শাহ্ আলম নয়, অন্য কেউ। কারণ, সাড়ে তিন বছরের বিবাহিত জীবনে শাহ্ আলমকে উঁচু গলায় কথা বলাতো দূরের কথা, শাহ্্ আলম যে মাটির মানুষ তা ওর নিজের আত্মীয়-স্বজনরাও অহরহ ওকে শোনায়। লতার মেজাজ চিরদিনই খারাপ, সে তুলনাতেই শাহ্ আলম মাটির মানুষ।

সে রাতে শাহ আলম আর ঘুমাননি। লতারও প্রশ্নই আসে না। লতা তখন অন্তঃস্বত্ত্বা। সজীবের জন্ম সে বছরই সেপ্টেম্বরে। কিন্তু জানুয়ারির সেই ভোর রাতে শাহ্ আলম যে বললেন, যে তিনি এই বাড়িতে আর থাকেন না, সেটা কেবল ঘরের বাইরে যারা তাকে নিতে এসেছে তাদের জানানোর নয়, সেদিনের পর থেকে সকলকেই একথা বলার জন্য নির্দেশ দিলেন তিনি লতাকে। লতা পড়লেন মহা বিপদে। দেশে তখন ঘোর দুর্দিন। জাতীয় অস্থিরতা ঢুকে পড়েছে মানুষের জীবনের গভীরে। ধানমণ্ডি থেকে বঙ্গভবন, নাজিমুদ্দিন রোড, সব জায়গা থেকে কেবল খুনোখুনির খবর। তাও পত্রপত্রিকায় সেসব খবর নেই, খবর ছড়ায় বাতাসে। মানুষের স্বাভাবিক কর্মকা-ের মতো মৃত্যুর দূত তখন ঘোরে রাজধানীতে, হাতে বন্দুক নিয়ে।

সেবার শীতও পড়েছিল জমিয়ে। ঢাকা শহর যেনো জাগতোই দেরি করে। চর দখলের মতো রাষ্ট্র দখলের লড়াইয়ে সাধারণ মানুষের কোনো যোগসূত্র নেই, কেবল তারাও একটু বেশি সময়ই ঘুমিয়ে থাকাটা রপ্ত করেছিল। যেনো যতোক্ষণ ঘুমিয়ে কাটানো যায় ততোটাই বাঁচোয়া। ঘুম থেকে জাগলেইতো কারো না কারো মৃত্যুর খবর পাওয়া যাবে। কী দরকার? কিন্তু ওই সময়ে শাহ্্ আলম যে নিজেকে সম্পূর্ণ লুকিয়ে ফেলতে চাইলেন তাতে লতার জীবন অতীষ্ঠ হয়ে উঠলো খুব দ্রুত। শাহ্ আলম কারো সঙ্গেই দেখা করবেন না, এমনকি তার নিজের পরিবারের কারো সঙ্গেও না। তার এক কথা, লতা তুমি বলে দাও, আমি নেই। আমাকে তুমি চেনো না। লতা যতোই বোঝান, শাহ্ আলমের এক কথা, আমার পরিচয় তুমি দিও না লতা, বিপদে পড়বে তুমি। ভয়ঙ্কর বিপদ। আমাকে ওরা তুলে নিয়ে যাবে আর সেই সঙ্গে তোমাকেও। লতা ওরা যে কোনো সময় আসবে। তুমি ওদেরকে দরোজা থেকেই বিদায় করে দেবে। তবে ওরা জোর করে ঘরে ঢুকতে পারে, আমি তখন দেয়াল টপকে বাইরে বেরিয়ে যাবো, ঘর থেকে আমার সবকিছু সরিয়ে ফেলো লতা। কোনো চিহ্ন রাখবে না, আমি দিনের বেলা থাকবো না, গভীর রাতে দেয়াল টপকে আসবো তোমার কাছে। লতা তুমিও অভ্যস্ত হতে থাকো, আমি যে নেই, সেটা তোমাকেও বিশ্বাস করতে হবে, নাহলে তুমি কাউকেই বিশ্বাস করাতে পারবে না।

লতা তখন কী করবেন, কার সঙ্গে কথা বলবেন কিছুই ভেবে বের করতে পারতেন না। তার নিজের শরীর তখন খুউব খারাপ। কিছুই খেতে পারেন না, গল গল করে বমি করে ভাসিয়ে দেন। কিন্তু শাহ্ আলমের ওরকম আচরণ শুরু হওয়ার দু’একদিনের মধ্যেই লতার বমি করাটা ভালো হয়ে গেলো। লতার মনে হয়েছিল যে, শাহ্ আলমের জন্য চিন্তা করতে করতে তিনি নিজের শরীরের সমস্ত অনুভূতিই ভুলে গিয়েছিলেন। শাহ্ আলম অফিস যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বাড়িতে কেউ আসলেই বাথরুমে নিজেকে বন্দী করে রাখতেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের এক ডাক্তারের সঙ্গে লতা তখন শাহ্ আলমের ব্যাপারে কথা বলেছিলেন। তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, “উনি যা চান আপাতত তাই করে যান। উনার মতের বিরুদ্ধে যাওয়াটা ঠিক হবে না”। গাদা গাদা ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলেন ভদ্রলোক। ওষুধ হিসেবে শাহ্ আলমকে খাওয়ানো যেতো না। ভাতের সঙ্গে মিলিয়ে কিংবা পানিতে গুলে তাকে খাওয়ানো হতো। লতাকে বাধ্য হয়ে তাই ছুটি নিতে হয়েছিল।

লতা সামলাচ্ছিলেন, সবকিছুই, নিজেকে, পেটের মধ্যে বড় হওয়া সন্তানকে এবং শাহ্ আলমকে। নিজেকে শক্তিশালী মনে হতো তখন খুউব। এই অসম্ভব শক্তি নিয়েই ডাক্তারের পরামর্শমতো তিনি শাহ্ আলমের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতেন। জানতে চাইতেন, শাহ্ আলমের ভেতরের কথা। মাথায় হাত বুলোতো বুলোতে তিনি জানতে চাইতেন, শাহ্ আলম অবশ্য কখনোই কিছু বলতেন না। সেই শুধু ভয়ের কথা, তাকে কেউ তুলে নিয়ে যাবে, সেই সঙ্গে লতাকেও, কেবলই এক কথা। মুক্তিযুদ্ধের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন শাহ্ আলম। লতাও কি মনে করতে পারতেন কিছু? পরে অনেক ভেবেছেন লতা, তখন সেই সময়, সেই দুর্দিনে তিনি মনেও করতে পারতেন না যে, মাত্র চার কি পাঁচ বছর আগেই এই দেশটা একটা যুদ্ধের ভেতর দিয়ে গেছে। এই শহরেরই রাস্তায় দিনেদুপুরে লাশ পড়ে থাকতো। লতার মতো মেয়েদের নিয়ে পরিবারের লোকজন সারাক্ষাণ ভয়ে ভয়ে থেকেছে। কখন কী হয়ে যায়। মাইলের পর মাইল পানি-কাঁদা ভেঙে মানুষ গ্রামে গিয়েও বাঁচতে পারেনি। লতারাও প্রায় সাতটা মাস ঢাকা শহরের বাইরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে বেড়িয়েছে। কিন্তু সেসব কথা লতা ভুলতে বসেছে। শাহ্ আলম নিজে যে ভয়ের কথা প্রতিনিয়ত বলছেন, সেই একই ভয় কখন যেনো লতার ভেতরও সেঁধিয়ে গিয়েছিল লতা বুঝতে পারেননি। এমনকি সেই ভয় নিয়ে লতার একটি ছেলে হওয়ার পরও সেই ভয় লতার ভেতর সমানভাবে ছিল, ছেলের বয়স যখন বছর দেড়েক তখন লতা আবার প্রেগনেন্ট হয়েছিল, সেই ভয় নিয়েই লতার মেয়ে জয়ার জন্ম। ততোদিনে অবশ্য শাহ্ আলম সত্যি সত্যিই অদৃশ্য হয়ে গেছেন। তাকে এরপর আর কখনওই পাওয়া যায়নি।

কিন্তু সেই মন এবং শরীরভর্তি ভয় নিয়ে লতা শাহ্ আলমের হারিয়ে যাওয়ার পর স্কুলের চাকরিটিতে ফের যোগ দিয়েছিলেন। লতার বাবা মারা গিয়েছিলেন বলে ভাইয়ের সংসারে মায়েরও অসুবিধে হচ্ছিলো হয়তো, তাই নিজের মাকে যখন ওর কাছে নিয়ে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন ভাই তাতে কোনো অপত্তি করেনি, ভাইয়ের বউও করেনি। ছেলেমেয়েকে মায়ের কাছে রেখে লতা স্কুলের চাকরিটি করেছেন। কলিগদের প্রিয় বিষয় ছিল, “কেন ওর স্বামী হারিয়ে গেছে” সে প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা, যে কোনো ছুঁতোয় লতাকে এই প্রশ্নটি করতে তারা দ্বিধা করেননি। শিক্ষকদের বসার রুমে প্রথম কয়েক বছর লতা খাতা দেখতে দেখতে কিংবা কিছু একটা পড়তে পড়তে বরাবরই এই প্রশ্নটির উত্তর দিয়ে এসেছেন। মানুষের কৌতুহল কখনওই যায় না, সে শিশু হোক কিংবা মৃত্যু পথযাত্রী, লতা এটা জানেন। তাই যে বা যিনিই প্রশ্ন করুন, লতা কিছু নির্দিষ্ট উত্তর ঠিক করে নিয়েছিলেন, সেগুলো দিয়ে চালিয়ে দিতেন। কিন্তু সবচেয়ে অসুবিধে হতো কিছুদিন পর পরই কেউ না কেউ খবর নিয়ে আসতেন যে, অমুক জায়গায় নাকি শাহ্্ আলমকে তিনি দেখেছেন, এরকম খবরে। হয় লতাকে কিংবা শাহ্্ আলমের ভাইকে যেতে হতো সেই কারো দেখে আসা শাহ্ আলমকে দেখে আসতে। দেখে আসাই সার, তাই বছর খানেক পর লতা আর যেতেন না। শাহ্ আলমের ছোট ভাইটা অবশ্য আরো অনেকদিন গিয়েছে ভাইয়ের খোঁজ নিতে। আশির দশক জুড়ে বাংলাদেশের সর্বত্র বহু পাগল দেখা যেতো, আজকাল আর তেমনটি দেখা যায় না। সকলেরই ধারণা যে, শাহ্ আলমও পাগল হয়ে কোথাও না কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেবল, লতাই এই পাগল-তত্ত্বে কখনও বিশ্বাস করতেন না। তিনি জানতেন বা বিশ্বাস করতেন, শাহ্ আলম নামে কেউ নেই, কেউ কখনও ছিলেন না।

কিন্তু শাহ্ আলমের সঙ্গে সঙ্গে শাহ্ আলমের পাওয়া ভয়টাও যদি উধাও হয়ে যেতো তাহলে ভালো হতো। তাতে লতার সুবিধে হতো। লতা যে তার চেয়েও দ্বিগুণ ভয় নিয়ে স্কুলের চাকরি আর সন্তান লালন-পালন শুরু করেছিলেন তা কেবল লতার মা-ই জানতেন। ছেলেমেয়েদের পড়ানো ছাড়া লতার মুখ দিয়ে বাড়তি কোনো কথা বের করতে হলে অনেক কষরত করতে হতো ওর সহকর্মীদের। কেবলমাত্র লতা পড়ানোয় কোনো রকম ফাঁকি দেননি, দায়িত্বে কোনো রকম অবহেলা করেননি। এটুকুতেই চাকরিটা টিকে গিয়েছিল। বাইরে বেরুলেই লতার মনে হতো, ওকে কেউ দেখছে। লক্ষ্য রাখছে, শাহ্ আলমের সঙ্গে ওর কোনো গোপন যোগাযোগ আছে কিনা সেটা জানার জন্য। ও কারো দিকেই চোখ তুলে তাকাতেন না। যদি চোখ মিথ্যে কথা বলে? বাসা থেকে বেরুনোর আগে মাকে পই পই করে বোঝাতেন, যেনো কাউকে না বলেন যে, শাহ্্ আলম নামে কেউ এই বাড়িতে থাকতো, কিংবা শাহ্্ আলমের সঙ্গে ওদের কোনো যোগসূত্র আছে।

শাহ্্ আলম হারিয়ে গেছেন, উধাও হয়ে গেছেন, শাহ্্ আলমের কোনো স্মৃতিও থাকতে পারে না। আত্মীয়-স্বজনদের কেউ যদি শাহ্ আলমের নামও নিতেন লতা রেগে অনর্থ করতেন। ছেলেমেয়েরা এরকমটা দেখেই বড় হয়েছে। সজীব ওর বাবার কোনো ছবিও দেখেনি, বড় হয়ে এই ব্যাপারটাই ওকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিতো। কেন বাবার কোনো ছবিও থাকবে না। মাকে এই প্রশ্ন করা যাবে না, তাহলে মার খেতে হবে। বেদম মার। নানুর কাছে গোপনে এই প্রশ্ন করলে, নানু কাঁদতেন। মিহি সুরে সেই কান্না অনেকক্ষণ ধরে চলতো। মা তখন স্কুলে, সজীব হয়তো স্কুল থেকে ফিরেছে, বোনটা মেঝেতে খেলছে, বেশিরভাগ দিনই এরকম সময়ে বাবার কথা মনে হতো ওর। স্কুলের অনেকেই বাবার গল্প করে, ওর কোনো “বাবার গল্প” নেই, নানুকে এসে প্রশ্ন করতেই হতো ওর। আর তাতেই নানু কাঁদতেন আর রাতে মা মারতেনা। ওর শিশুকালটা কেটেছিল বাবার গল্প খুঁজতে খুঁজতে। একটু বড় হয়ে ও নিজেও বুঝে গিয়েছিল, বাবার গল্প করা যাবে না। সেই গল্পে একটা ভয় আছে, লুকোনো ভয়। মায়ের চেহারা, নানুর চেহারা সব বদলে যায় এই গল্পের শুরুতেই।

ভয়টা ওদের পারিবারিক সম্পত্তির মতো হয়ে গিয়েছিলো - স্কুল পাশ করতে করতে সজীবের মনে এই বিশ্বাস প্রবলভাবে বসে গিয়েছিল। মায়ের স্কুলের চাকরি আর প্রতি মাসের শুরুতে ছোট চাচা দাদা বাড়ির ভাড়া থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে ওদের সংসার চলেছে। খারাপ চলেনি, ভালোই চলেছে। ছোট চাচাও ওদের ঠকাননি। কিন্তু মা কোনো দিনই ওই সংসারের সঙ্গে সজীবকে কখনও বেশি জড়াতে দেননি। দুই ঈদে সালাম করে আসার জন্য যাওয়াটা রুটিনে দাঁড়িয়েছিল, এর বাইরে এতো কম বার ওখানে ওরা গিয়েছে যে, সজীব চাইলে আঙুলের কর গুণে সেকথা বলতে পারে। দাদী যতোদিন বেঁচে ছিলেন ততোদিন এই ঈদের ব্যাপারটা ছিল, তারপর থেকে তাও ছিল না। স্কুল, তারপর কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লাশ থেকে বাসা এবং হাতে গোণা দু’একজন বন্ধু ছাড়া সজীবের জগত ছোট। জয়াকেতো লতা পাঠিয়েই দিয়েছিলেন দার্জিলিং-এ পড়তে। সজীবন শুনে ফেলেছিল একদিন লতা আর ওর নানুর কথাবার্তা। লতা কঠিন স্বরে বলেছিলেন, “জয়াকে আমি এখানে পড়াতে চাই না মা। সজীব পেরেছে, জয়া পারবে না। জয়া বলে দেবে সবাইকে শাহ্্ আলমের কথা। মেয়েদেরকে বাবার নাম বার বার জানাতে হয়। লতাকে আমি এদেশে রাখবো না মা”। এই কথা শোনার পরই সজীবের খেয়াল হয়েছিল, তাইতো, এই শহরে তো খুব বেশিবার ওকে বাবার নাম জিজ্ঞেস করেনি কেউ, স্কুলে ভর্তির সময় আর মুখে বলতে হয়েছিল আর তারপরে ফর্মেই উল্লেখ করতে হয়েছে ওকে। ভাগ্যিস ও গ্রামে বড় হয়নি, তাহলে নিশ্চয়ই ওকে প্রতিদিন শুনতে হতো, “কি মিয়া বাড়ি কই? বাপের নাম কি?” শহরবাসের এই সুবিধে সজীবকে আনন্দ দিয়েছিল সেদিন খুউব।

জয়া এখন অস্ট্রেলিয়ায় পড়ছে। লতাও চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু তারপর থকে আর একদিনও বাড়ি থেকে বেরোননি। কেবল ওরা যেদিন ভাড়া বাড়ি থেকে মণিপুরি পাড়ায় নিজেদের ফ্ল্যাটে উঠে গিয়েছিল সেদিন বেরিয়েছিলেন। নানু মারা গেছেন লতার দেয়া সমস্ত ভয় নিয়েই। লতা এখন আরও চুপচাপ হয়ে গেছেন। ফ্ল্যাটের কোথাও আছেন কিনা বোঝা যায় না। তবে সজীবের জীবনেও খুব সফলভাবে শাহ্ আলম সংক্রান্ত ভয়টা ভরে দিতে পেরেছেন তিনি। ওর বয়েসী আর দশটা সাধারণ ছেলের জীবন ওর নয়। সেটা ওকে যারা জানেন তারাতো জানেনই, যারা ওকে জানেন না, তারাও অল্পক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারেন যে, সজীব আলাদা। ওর অফিস, বাসা আর তার বাইরে একজন কি দু’জন সেই স্কুলকালের বন্ধু ছাড়া আর কিছুই নেই। বাসায় এসেও দু’জন দু’দিকে। খাওয়া-দাওয়া, চলা-ফেরা সবই কেমন নৈঃশব্দের ভেতর সারে ওরা। সজীব জীবনটাকে এরকমই জানে এবং চেনে। কেবল জয়া যখন ফোন করে কিংবা সজীবের সঙ্গে স্কাইপে কথা বলে, তখন অন্যরকম হয়ে যায় সবকিছু। এই বাড়িতে যে মানুষ থাকে সেটা টের পাওয়া যায়। জয়াই অস্ট্রেলিয়া থেকে স্কাইপে চেঁচিয়ে কথা বলে, ওদেরকে কথা বলতে বাধ্য করে। আর জয়াই একদিন ঝনঝন শব্দে চিৎকার করে বলে, “ভাইয়া তোমরা কি মরে গেছো? এতো ভয়ের কী আছে ভাইয়া? মাকে বলো, তুমিও খোঁজ করা শুরু করো, বাবা কোথায়? বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন ভাইয়া? তুমি পেপারে বিজ্ঞাপন দাও, বাবার জন্য। শাহ্ আলমের জন্য, মুক্তিযোদ্ধা শাহ্ আলমের জন্য”।

জয়ার কথা শুনে লতা তার নীরবতা ভেঙে চেঁচিয়ে ওঠেন। বলেন, “চুপ করো, চুপ করো তুমি। শাহ্্ আলম কে? কার কথা বলছো? আমরা কেউ তাকে চিনি না, তুমি আর কোনোদিন এসব কথা বলবে না। বললে, তোমার আর ফোন করার দরকার নেই”। জয়া দমে না, ল্যাপটপের পর্দায় ওর চেহারা জ্বলজ্বল করে, “কেন বলবো না মা? আমাদের বাবার কথা কেন বলবো না বলো? তুমি আমাদের এতো ভয় দেখিয়েছো কেন সারা জীবন? কাকে তোমার ভয় মা? কিসের ভয়?”

“তুমি বুঝবে না। শাহ্ আলম বলে কেউ নেই”- লতা ভাঙা ভাঙা গলায় বলেন।

“তাহলে কি আমরা আকাশ থেকে পড়েছি মা? আর কতো মিথ্যে বলবে? তুমি আমাদের অসুস্থ করে রেখেছো? ভাইয়া, তুমি এরকম মূর্তির মতো হয়ে আছো কেন? কিছু বলো প্লিজ”- জয়া তর্ক করে যায়, ভাইয়ের সাহায্য চায়। সজীব চুপ করে থাকে, ও কী বলবে বুঝতে পারে না ঠিক। ওর মনে হয়, জয়া কখন এতো বড় হয়ে গেলো? এতো কথা কবে শিখলো? দার্জিলিং-এর বোর্ডিং স্কুল থেকে ফিরে বেশিদিনতো দেশেই থাকেনি ও। অস্ট্রেলিয়াতে পড়তে চলে যায়। তখনই জয়া আবারও বলতে থাকে, “মা তোমার কাছে শাহ্ আলম বলে কেউ নেই, ঠিক আছে না থাক। আমার কাছে আছে, আমি ঠিক জেনেছি মা, বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, আমি তালিকা থেকে বাবার নাম বের করেছি। আমি পুরোনো সংবাদপত্রের কাটিং বের করেছি, বাবার হারিয়ে যাওয়ার খবরটাও কেটে রেখেছি। তোমরা আবার বিজ্ঞাপন দাও, পুলিশের কাছে যাও”।

লতা এবার আরো জোরে চিৎকার করে ওঠেন, “তুই থাম জয়া। আর একটা কথাও বলবি না। শাহ্্ আলম বলে গেছে আমাকে, আমরা কেউ না। ওর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। সাতাত্তর সালের পর আমাদের আর কোনো অস্তিত্ব নেই। আমরা ছায়ার মতো মানুষ। ছায়ার বাবা থাকতে হয় না, স্বামী থাকতে হয় না। তোর সঙ্গে আর কোনো কথা নেই আমার। আমি যাচ্ছি”। লতা সজীবের ঘর থেবে বেরিয়ে যেতে থাকেন, ওদিকে জয়া তখনও চিৎকার করছে, “মা তুমি উঠবে না, শুনে যাও, এটা ২০১৩ সাল। মা, মা, তুমি যাবে না, শোনো, আমার কথা শোনো”। লতা বেরিয়ে গেছেন। জয়া তখনও চিৎকার করছে সমানে, “এটা ২০১৩ সাল মা, ভাইয়া মাকে বলো এটা কতো সাল”।

সজীব ল্যাপটপের স্ক্রীনটা নামিয়ে দেয়। যন্ত্রটা যতোক্ষণ সময় নেয় বন্ধ হতে, ততোক্ষণ জয়ার গলা শোনা যায়, চিৎকার করছে মেয়েটা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ