নাসরীন জাহান'এর গল্প : একটি দীর্ঘশ্বাসের ডালপালা

গরুর গাড়িটা গ্রামের পথে পা রাখতেই আকাশ অন্ধকার হয়ে আসে। উজ্জ্বল প্রকৃতি তছনছ করে বৃষ্টি আসে। ফলে তিন বন্ধুর প্রকৃতিযাত্রার মজাটাই ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়। আলোকস্তম্ভটিকে আড়াল করে রাখে ঘনকালো ক্ষুদ্র মেঘের স্তূপ। ফলে ছইয়ের বাঁশ চুঁইয়ে পড়া জলের স্রোতে তিন বন্ধুই বিপর্যস্ত অবস্থায় ভিজতে থাকে। ভেজা শার্টের পাতলা আবরণ ফুঁড়ে ঠাণ্ডা বাতাস আত্মাকে স্পর্শ করে। আসন্ন শীতের আচমকা বৃষ্টির মধ্যে পড়ে তিনজনই স্যাঁতসেঁতে একটি অস্বস্তিকর ঠাণ্ডা পরিবেশের মধ্যে নিজেদের এই রাত্রি অভিযানের বোকামির বিষয়টাকে প্রতিষ্ঠিত করে একে অন্যকে দোষারোপ করতে থাকে।


পকেট থেকে ভেজা সিগ্রেট বের করে দেশলাই হাতড়ায় একজন। দেশলাইয়ের কালো মাথা ভিজে গেছে। জ্বালানোর অপারগতায় তার কপাল কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। অন্য একজন সামনের আঁধারময় পথটি হতাশার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে। বাকি জন, এই অভিযানের পেছনে প্রবল উৎসাহ ছিল যার, দু’ঠ্যাং ওপর দিকে তুলে চিৎ হয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে গলায় সুর আনার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে।

প্রভাবিত চালক সেই সুর টেনে নিয়ে যে-ই উচ্চগ্রামে চড়াতে যাবে, অমনি তা ভেঙে নিচ দিকে বুজে আসে। ফলে তিনজনেরই তুমুল হাসি। এর উত্তরে জলে ডুবতে থাকা চালকের মামুলি সলজ্জ উত্তর--হেই গলা আর নাই।

এমনই যখন উত্থান-পতন, হেলেদুলে গরুর গাড়ি চলছে, বৃষ্টিপাতের মধ্য দিয়ে, বাঁশবনের শনশন ঘুটঘুটে আঁধার চুল বিছিয়ে দিয়েছে, এমনই প্রবল শীত, তিন বন্ধুর চোখ বুজে থাকা, দুটি গরুর চালকের হেট হেট-এর মধ্য দিয়ে অবিরাম লাফিয়ে চলা, চালকের ভাঙা কণ্ঠে গানের চেষ্টা, তখন মেঘ তার কোল থেকে ছেড়ে দেয় শিশু চাঁদকে, হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে চাঁদ একসময় মধ্য আকাশে।

নেমে আসে তিন বন্ধু--কায়সার, টুলু, ওমর। বৃষ্টির স্রোত থেকে ভেসে ওঠা চরের মতো প্রকৃতি এখন কাঁসার থালার মতো ঝকঝকে। তিন বন্ধু ঘাসের গালিচা বিছানো মাঠ ধরে হাঁটতে থাকে। পেছনে স্থির গরুর গাড়ির ওপর ঝিমন্ত চালক। একের পর এক নষ্ট হচ্ছে, ভেজা দেশলাই জ্বলছে না, ফলে জমে উঠছে না। দুই বন্ধু যখন সেই নির্জন মাঠের ওপর উবু হয়ে, মুখের উষ্ণ ভাঁপের সাহায্যে একটির পর একটি কাঠি জ্বালানোতে লিপ্ত, তখন প্রকৃতির কী-এক অমোঘ টানে... আমি একটু প্রাকৃতিক কাজ... বলতে বলতে অনেকটা হেঁটে গেছে ওমর।

পেছনে দুজনের খণ্ড হাসি... শালা ওই কাজের জন্য দূরে যেতে হয় ? মেয়েমানুষ আর কী! তারপর দুজনের আরও অস্পষ্ট কণ্ঠ... আহ্, ভেজা কাপড় জুত লাগছে না।

হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। চল সব খুলে ফেলি, প্রকৃতির মধ্যে আদিম হয়ে যাই।

একসময় আরও অনেকটা পথ। তারপরই বিস্তীর্ণ বাঁশবন। ওমর পেছনে তাকিয়ে দেখে, অনেক দূরে দুজন তখনো উবু... বাঁশবনটা অতিক্রম করে বাঁয়ের পথ ধরে সে। প্রাকৃতিক কাজের ব্যাপারটা পুরো গুল... আসলে কী-এক মজা, দুর্নিবার টান, সেই জ্যোৎস্নাময় রাতে একাকী পথের দিকে তাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে। ঝিঁঝি ডাকছে একটানা। দক্ষিণা হাওয়ায় হু হু টান। বাঁশঝাড়ের পথটা নিচ দিকে অনেক গভীরে গিয়ে, পনেরো বিশ ফুট পরেই ওপর দিকে উঠে গেছে। সেখানে কিছুটা জল জমেছে। তার ওপর পড়েছে চাঁদের আলো। ওমর বেমালুম ভুলে যায় রাত্রির পথ ধরে আরও অনেক দূর যেতে হবে তাকে, টুলুদের বাড়িটা বৃহৎ নির্জন গ্রামের একদম শেষ মাথায়, তেমনই শুনেছে সে।

কিন্তু নিজেকে কোনো পিছুটান না রেখে প্রকৃতির মধ্যে ছেড়ে দিয়ে ভীষণ ভালো লাগছে। সে দু’হাতে মাটির শক্ত অংশ চেপে চেপে ঢালু জায়গাটায় নামে। একসময় টাল সামলে, অকস্মাৎ, ঝপাৎ, জলের মধ্যে।

হাঁটু পানি। ভিজে একাকার ওমর এবড়ো-থেবড়ো মাটি আঁকড়ে আঁকড়ে ওই কিনারে গিয়ে ওঠে। আবার পথ চলা। ওমর হাঁটতে থাকে, পুরো পরিবেশটা ঝিম ধরে আছে। দূরের ঘন অন্ধকার গ্রাম, গাছপালা এই প্রকাণ্ড মাঠটিকে প্রদক্ষিণ করে আছে। একসময় ক্লান্ত ওমর দাঁড়ায়। দূরে খণ্ড খণ্ড আলো, গভীর ধূসরতা সেই আলো অলৌকিক করে তুলেছে। ওমর পেছনে তাকায়। বিস্তারিত বাঁশবন ছাড়া কিছু নেই। কেমন ভয় লাগতে থাকে তার। ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে, তখন দেখে অনেক দূর থেকে একজন মানুষ হেঁটে আসছে।

ওমর বিস্মিত চোখে দাঁড়িয়ে থাকে।

ক্রমশ দূরত্ব কমছে। প্রকাশিত হচ্ছে সেই মানুষের আকৃতি। প্রথমেই দীর্ঘতা, তারপর চুল, অবিন্যস্ত পোশাক। ক্রমশ মুখ। সেই আবছায়া ক্রমশ পূর্ণ মানুষ হয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। নির্বাক বিস্মিত ওমর দেখে, বৃহৎ নির্জন মাঠের ওপর দিয়ে একাকী ধুকতে ধুকতে হেঁটে আসা মানুষটি তার মুখোমুখি এসে টানটান মাথা করে দাঁড়িয়েছে। কাঁচা পাকা বড় ভ্রু চোখের ওপর ঝুলে পড়েছে। তার নিচের চোখ দুটি এমন তীব্র অথচ ঘোলাটে! গা ছম ছম করে তার। শরীর থেকে এক অভিনব গন্ধ বেরুচ্ছে, যেন বাঁশপাতার। তোবড়ানো গালের নিচে থুতনি আঁধারের জন্য অস্পষ্ট। মনে হয়, ধবল আলো ফুঁড়ে একটি বৃদ্ধের জন্ম হলো। কী এক মোহগ্রস্ততায় চেয়ে থাকে ওমর। তার স্পষ্ট মনে হয়, এই মুখ তার চেনা, এই দৃষ্টি চেনা, দাঁড়ানোর ভঙ্গিটি চেনা, ভীতির স্থান দখল করে অনুসন্ধান। কিন্তু তখনো সেই নিথর প্রকৃতি ফুঁড়ে একটি ভাঙা অথচ গভীর কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে--পথ হারিয়ে এসেছ ? বৃদ্ধের এই প্রশ্নের বিভিন্ন উত্তর হয়। কিছু-একটা বলতে চায় সে। কিন্তু তাকিয়ে দেখে লোকটি সীমাহীন পথের দিকে চেয়ে হাঁপাচ্ছে। স্পষ্ট মনে হয়, ভেতরের হাড়গোড় ভেঙে গেছে। ইচ্ছাশক্তি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

আপনি এই গ্রামের কেউ ? প্রশ্ন করেই ভীত ওমর রাতের নিবিড় প্রকৃতিকে অবলোকন করে, কী অদ্ভুত! যতটুকু ভয় লাগার কথা, ততটুকু লাগছে না তার। কেননা স্পষ্ট মনে হচ্ছে লোকটি তার চেনা কেউ। আর বৃদ্ধের আগমনের পরই যেন রাতের অচেনা গ্রামটি তার কাছে সহজ হয়ে উঠেছে।

গ্রামের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বৃদ্ধ বহুদিনের চেনা মানুষের মতোই বলে, চলো হাঁটি। বৃদ্ধটিও যেন এই রাতের প্রকৃতিরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার টানকেও যেন উপেক্ষা করা যায় না। তাই সহস্র প্রশ্ন ভেতরে নিয়ে ওমর নিশ্চুপতার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে।

হাঁটতে হাঁটতে দুজন একটি সবুজ টিলার ওপর বসে। বৃদ্ধ ঘনঘন শ্বাস ফেলছে। তার আলখাল্লার মতো শরীর জড়িয়ে থাকা ছেঁড়া কাপড় ফুঁড়ে শীতের হাওয়া প্রবেশ করে। এতক্ষণে ওমরের হুঁশ হয়, তার পরনের কাপড় ভেজা, সে প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে শুরু করে এবং এরপরই হঠাৎ তার বন্ধুদের কথা মনে হয়। সে দ্রুত দাঁড়ায়। ভাবে দৌড় দেবে। কিন্তু পুনরায় সেই কণ্ঠস্বর অদ্ভুতভাবে তাকে স্থবির করে দেয়। আমাকে চিনতে পারো নি তুমি ?

কী আশ্চর্য! তার তো মনেই হচ্ছিল লোকটি তার চেনা কেউ। ধপাস করে সে পুনরায় টিলার ওপর এসে বসে পড়ে। গভীর চোখে বৃদ্ধকে পর্যবেক্ষণ করে--কে আপনি ?

মনে হয় বৃদ্ধের গলার মধ্যে রাজ্যির সর্দি জমে আছে। ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা শিমুলগাছ থেকে অজস্র পাতা ঝরছে। বৃদ্ধের মাথার ওপরও দু-একটি পাতা এসে পড়ে। বৃদ্ধ মাথা নাড়তে থাকে--বলব। অবশ্যই বলব। কতদিন পর একজন কথা বলার মতো মানুষ পেলাম। এই দিনটির জন্য কতদিনের অপেক্ষা আমার। নিশ্চয়ই বলব। ওমর বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে--কেন কথা বলার মতো কেউ নেই আপনার ?

হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে উত্তর দেয় সে--ছিল। বহুকাল আগে। তখন আমি নগরে বাস করতাম। সেখানে আমার একমাত্র কাজ ছিল ক্রমাগত কথা বলে যাওয়া। কেউ শুনত না। শুনলেও অবজ্ঞার সঙ্গে, বোধগম্য হতো না তাদের। তাই লোকালয় ছেড়ে চলে এসেছি। কেননা এখানে বলেও সুখ, শুনেও সুখ। বলছিও আমি, শ্রবণও করছি আমি নিজে। এভাবেই নিজের কাছে আমি নিজে মূল্যবান হয়ে উঠছি।

কী আশ্চর্য! শহরে ছিলেন ? এখানে এই নির্জনে থাকছেন কীভাবে ? ওমরের এমন সরল, মামুলি প্রশ্নকে উপেক্ষা করে বৃদ্ধ শুক্লবর্ণ রাত্রির দিকে ভুতুড়ে চোখে চেয়ে থাকে। চারপাশে মেঘ না থাকায় সাবলম্বী চাঁদ অকৃপণ জ্যোৎস্না ঢালছেই... ঢালছে...। ফলে বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে পাতা চুঁইয়ে হীরক খণ্ডের মতো আলোও গড়িয়ে পড়ছে। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু নিঃশব্দতা ধুধু প্রান্তর। বৃদ্ধকে যেন বলার নেশায় পেয়েছে, ভীষণ কৌতূহলী ওমর স্থানকাল ভুলে চেয়ে থাকে বৃদ্ধের অতিচেনা মুখটির দিকে। ওমরের পৃথিবী এই জায়গায় এসে একটি বিন্দুতে স্থির হয়ে পড়ে। সব জাগতিকতা মুছে প্রবলভাবে জেগে ওঠে এই বৃদ্ধটি, সে সম্মোহিতের মতো শোনে। বৃদ্ধ বলতে শুরু করেছে--জন্মসূত্রেই আমি ছিলাম কুৎসিত এবং বিকলাঙ্গ। বলতে বলতে বৃদ্ধ কাপড়ের আড়াল থেকে কুঁচকানো আঙুলের বাঁকা দুটি হাত বের করে। চাঁদের ধবল আলোর বিপরীতে চামড়া ঝুলে পড়া, কোঁকড়ানো বীভৎস হাত দুটি বাড়িয়ে ধরে সে এবং তার একটি পা-ও নিচদিকে সরু হয়ে বাঁকানো।

ওমর বিস্মিত হয়ে সেই পা-টিকে প্রত্যক্ষ করে। আশ্চর্য! এতটা পথ হেঁটে এল লোকটি, এবড়ো-থেবড়ো জমিনের জন্যই সম্ভবত বোঝা যায় নি। নিস্পন্দ প্রকৃতির মধ্যে বৃদ্ধ তার ভারি ঘন নিঃশ্বাসগুলো নিক্ষেপ করতে থাকে এবং বিশুদ্ধ শীতল হাওয়া গ্রহণ করতে করতে বলে যায়--এই কুৎসিত চেহারার জন্য, আকৃতির জন্য, নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রতিদিন আমাকে অনেক ভান এবং ছলনার আশ্রয় নিতে হতো এবং যাতে অন্যের বিরক্তির কারণ না হই তার জন্য অনেক চটকদার কথা এবং অভিনয়ের আশ্রয় নিতে হতো, যার জন্য প্রচুর বই পড়তে হতো আমাকে। জানো, আমার পেশাটাও ছিল তেমন, চটকদার কথায় বিভিন্ন সামগ্রী বাজারজাতকরণ। কিন্তু চিরদিনই এই পেশার ক্ষেত্রেও আমার আকৃতির ভয়াবহতা আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। ফলে কথার চটক আরও বাড়াও, আরও বেশি সুন্দর মিথ্যাগুলোর প্রদর্শন--এই করে করে হাঁপিয়ে উঠতাম। মেয়েরাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিপন্ন বলেই হয়তো আমারও একটি সুস্থ সুন্দরী স্ত্রী ছিল। যথারীতি আমার প্রতি ছিল না তার বিন্দুমাত্র আকর্ষণ। নিয়ম বলে, সামাজিকতার জন্য, আর্থিক কষ্টের বিষণ্নতার জন্য সে দীর্ঘদিন ওইভাবে আমার সঙ্গে সংসার করেছে। বৃদ্ধের কণ্ঠ কেমন ভেঙে আসতে থাকে। আমি দেখতাম, কোনো সুস্থ সুন্দর পুরুষ দেখলে কীভাবে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সে। তখনই সে তার গোপন করে রাখা মনোরম হাসিটি, নমনীয় ভঙ্গিটি প্রকাশ করত। বিয়ের প্রথম রাতে, স্পষ্ট মনে আছে, আমার তখন উঠতি পড়তি অবস্থা। কাঁপছিলাম একটি অনাস্বাদিত সুখের অপেক্ষায়। কাঠ হয়ে অনেকক্ষণ বসেছিল সে। যখন আমার বাঁকানো কুৎসিত হাতটি তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম, তখন গভীর রাত। সে দ্রুত মেঝেতে দাঁড়াল। তারপর সেই চাউনি, প্রথম দেখাতেই সবাই যা নিক্ষেপ করে, তা ছুড়ে দিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমি খিড়কি তুলে দেখি, উঠোনের মধ্যে স্থির বসে আছে সে। বাইরে কনকনে শীত। তবুও আমি যাই নি, কেননা আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার চেয়ে শীতের কঠোরতা অনেক সহনীয় বলেই তো সে ফিরে আসছে না।


ওভাবেই শুরু। তীব্র ঘৃণার মধ্যেও কী সুন্দর দুটি মানুষ পাশাপাশি দিন অতিবাহিত করে, তার বড় উদাহরণ ছিলাম আমরা। সবচেয়ে আশ্চর্য, এর মধ্যেও আমাদের মধ্যে এমন কিছু সুখকর খণ্ড মুহূর্ত আসত, যার প্রকাশ ছিল আমার স্ত্রীর গর্ভধারণের মধ্য দিয়ে। দুটি দেহের মিলন তা যৎকিঞ্চিত সময়ের হোক, আমার সব দুঃখ মুছে দিত। সব কষ্ট ভুলে গেলাম। কী-এক অপার্থিব সুখ আমাকে সব উপেক্ষার যন্ত্রণা ভুলে যেতে শিখিয়েছিল।

তারপর সন্তানের জন্ম হলো।

বলতে বলতে বৃদ্ধ হঠাৎ থেমে যায়। ওমর এতক্ষণে ভালো করে দেখে, চাঁদের আলোয় স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়, বৃদ্ধের মুখটি বসন্তের দাগে ভরা, কদাকার। ঠোঁট দুটি থুতনি উপচে নিচ দিকে ঝুলে পড়েছে। নাকের ডগাটি বাঁদিকে বাঁকানো। এতক্ষণে এতসব অসামঞ্জস্য তার চোখে পড়ে। কিন্তু তার ঘৃণা হচ্ছে না, ভয় হচ্ছে না। সে যেন টুলুদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য নয়, অন্ধকার পথে গরুর গাড়ি ভ্রমণের জন্য নয় এই মানুষটির সঙ্গে দেখা হবে বলেই বন্ধুদেরকে এ পথে আসার জন্য উস্কেছিল। ফলে তার একান্ত দৃষ্টি মুখের ওপর বিঁধে থাকে।

বৃদ্ধ ভাঙা, অস্পষ্ট কণ্ঠে দম নিতে নিতে পুনরায় শুরু করে--কিন্তু কী ভয়ংকর জানো, আমার সেই সন্তানও হলো বিকলাঙ্গ। তার দুটি পা ছিল হুবহু আমার দুটি হাতের মতো, এবং মুখটি, তুমি শুনে অবাক হবে, যেন আমার মুণ্ডু কেটে তার গলায় বসানো হয়েছে এমন। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল একটি মাংসের স্তূপ। আমার স্ত্রী সন্তানের মুখ দর্শন করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আর আমি, যে জীবন পেরিয়ে এসেছি, সেই ঘৃণ্য জীবনের আরেকটি শুরু প্রত্যক্ষ করে পাগলের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। কিছুদিন জীবনযাপন করি বাইরে। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে প্রাণপণে টিকিয়ে রাখা পেশা থেকে সরে গিয়ে প্রত্যক্ষ করি নিষ্ঠুরতম ক্ষুধাকে। পথ আমাকে সন্ন্যাস দেয়, হাহাকার দেয়, খাদ্য দেয় না। কী-এক অমোঘ টানে একদিন ঘরে ফিরে আসি। খুব আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষ করি, যে আমাকে আমার আকৃতির জন্য ঘৃণা করত সেই আমার সন্তানকে পরম মমতায় কোলে তুলে নিয়েছে। আকৃতির অভিন্নতা সত্ত্বেও। ধীর তালে সংসার চলতে থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমি এক নতুন অনুভূতির ভেতর নিমজ্জিত হই। স্ত্রীর সুন্দর মুখখানির পাশাপাশি যখন সেই কুৎসিত শিশুটিকে শুয়ে থাকতে দেখি, মাথার শিরা দপ্ দপ্ করে। একটা যন্ত্রণাকর অনুভূতি পায়ের পাতা দিয়ে প্রবেশ করে বুকের মধ্যে এসে আটকে থাকে। পুরো শরীর অবশ হয়ে যায়।

একদিন মাঝরাতে উঠে বাতি জ্বালিয়ে তার মুখের দিকে নিষ্ঠুর দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম। স্ত্রীর ঘুম ভেঙে গেলে সে কেমন ভয় পেয়ে যায়। শিশুটিকে বুকের কাছে টেনে আমার দিকে ভীত চোখে তাকায়। সেই প্রথম তার চোখে আমি ভয় প্রত্যক্ষ করি। সেই দৃষ্টি দেখে আমার ভেতর নতুন নির্মমতার জন্ম নেয়। মনে হয়, কেবল এখনই আমি আমাকে হত্যা করতে পারি আমার সন্তানের মধ্য দিয়ে। তবে অন্তত পৃথিবীতে একটি মানুষ শূন্য হয়ে যাবে, কাঁদবে।

কিন্তু সন্তান না হয়ে সে মৃত্যু যদি আমার হয়, তবে পুরো পৃথিবীতে স্বস্তি নেমে আসবে। এ ছাড়া তখন আমাকে আরেকটি অনুভূতি ভীষণভাবে তাড়া শুরু করে, সেটা হলো আজ সব দুর্বলতা উপেক্ষা করে চলতে পারছি বলেই অনেক ঘৃণার মধ্যেও টিকে থাকতে পারছি। কিন্তু কখনো যদি চিৎ হয়ে পড়তে হয় এবং সেই স্থান করে তুলতে হয় রক্ত, ঘাম, মলমূত্রময়, তখন আমার প্রাণময় মূল্যহীন দেহটিকে সবাই নদীর কিনারে, অথবা গভীর গহ্বরে নিক্ষেপ করে আসবে ? কেননা, তখন তা শুধু পরিবেশকে দূষিত করার কাজেই নিয়োজিত থাকবে। অন্যের কাছে নিজের এই উপেক্ষার দৃশ্য ক্রমশ আমাকে ভয়ংকর করে তোলে। তখন থেকেই স্থির সিদ্ধান্ত নিতে থাকি লোকালয় ছেড়ে কোথাও নির্জনে চলে যাব।

জানো, এর মধ্যে একটি সুন্দর ঘটনা ঘটে। আমার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটা বাড়ির একটি কিশোর ছেলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সেই ছেলেটিই প্রথম আমাকে ঘৃণার বদলে একটি মায়াময় অনুভূতির ভেতর বন্দি করে ফেলে। ছেলেটি প্রতিদিন বলত, আপনার দৃষ্টি অসাধারণ। এমন স্নেহময় চোখ আমি কোনোদিন দেখি নি এবং পছন্দ করত আমার কথা। আমার সাজানো গল্পগুলো--যেমন, একটি ভিখিরির ছিন্নঘর হঠাৎ প্রাসাদে পরিণত হলো, একটি মৃত মেয়েকে বাঁশির শব্দ দিয়ে জাগিয়ে তুলল একটি পুরুষ অথবা জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত একজন লোক আত্মহত্যা করতে গিয়ে নদীর কিনারে হঠাৎ একট সোনার মূর্তি পড়ে থাকতে দেখল... সেসব গল্প খুব গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনত। বলত তার বাবা তাকে ফেলে চলে গেছে। মায়ের সঙ্গে ভয়ার্ত অন্ধকার দিনগুলো কাটছে তার। এইসব আশার গল্প শুনে সে বাঁচতে শিখছে। দীর্ঘদিন আমাদের সেই অসম বন্ধুত্ব টিকেছিল। আমার জীবন যেন নতুন গতি পেল। কাজের পরে তাকে নিয়েই মেতে থাকতাম।

একদিন শোনো, কাউকে কিছু না বলে একরাতে তারা কোথায় যেন চলে গেল। আমি রূপান্তরিত হতে থাকি পুনরায় সেই অসুস্থ ঝিমন্ত মানুষে। আমার জীবনে তারপর সীমাহীন অন্ধকার, অসংখ্য ঘটনা, কী বলব তোমাকে, কত খুঁজেছি তাকে, পাই নি। দীর্ঘদিন পর আজ রাতে সেই কিশোরের সঙ্গে দেখা হলো। কিন্তু এখন যুবক সে।

ওমর কাঁপতে থাকে। যেমন করে বৃদ্ধ বলে দেওয়ার পর তার কদর্যতা তার চোখে পড়েছিল; তেমনই বৃদ্ধের বলার পর কী-এক আচ্ছন্নতার মধ্যে তার মনে হয়, সে সেই কিশোর। এই লোকের সব ঘটনা সে জানে। এজন্যই এই চোখ, ওই কণ্ঠস্বর তার বড় চেনা। তার স্ত্রীকে, বিকলাঙ্গ সন্তানকে সে চিনত, কেবল তারপরের ঘটনাগুলো বৃদ্ধ বলে দেওয়ার পরই তার মনে পড়বে।

তার কিছুদিন পর আমি আমার সন্তানকে হত্যা করি... বৃদ্ধের এরকম শীতল উচ্চারণে ঘেমে ওঠে ওমর... হ্যাঁ, তাই তো মনে পড়ছে... শিশুটিকে তার পিতা হত্যা করেছিল, শুধু তার পরের ঘটনাগুলো জানে না সে। কৌতূহলে, উত্তেজনায় শ্বাসবন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় তার। সে বৃদ্ধের মুখের দিকে নিস্তরঙ্গ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

হত্যা করেছি তখনই, বৃদ্ধ বলতে শুরু করে, সেই কিশোরের অন্তর্ধানের পর প্রথম যখন তার প্রতি আমার মায়া জন্মাতে শুরু করে। তার হাসি, হাত নাড়া, দুটি অসহায় পা আমাকে এক বিচিত্র অনুভূতির ভেতর ফেলে দেয়।

ততদিনে আমার চরিত্রে আরও কিছু পরিবর্তন এসেছে। স্ত্রীর দূরত্বের কারণেই সম্ভবত আমি অন্যান্য নারীদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছিলাম। যদিও আমাকে আমল দিত না কেউ। কিন্তু আমার স্ত্রী কিংবা অন্য লোকজন, যাদের ব্যাপারে প্রবল ভয় আমার, কেবল তাদের সামনেই আমি কুণ্ঠিত, সংস্কারাচ্ছন্ন! তাদের সামনে একটি মেয়ের সৌন্দর্য প্রশংসার ব্যাপারেও প্রবল আপত্তি আমার। এ তো সব পুরুষের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে, স্ত্রী এবং পরিচিত মানুষের কাছে সাধু। যা হোক, আড়ালে বেশ উদার আর স্বাধীনচেতা হয়ে পড়ি আমি। যে-কোনো নারীদেহ স্পর্শের ব্যাপারেও আমি বেশ ক্ষিপ্র... কিন্তু তা-ও সম্ভব হতো একমাত্র কুৎসিত রমণীদের রূপের স্তূতির মাধ্যমে। আমি সেই আনন্দের মধ্যে বাঁচতে চাইলাম কিছুদিন। যে আনন্দ আড়ালের, সমাজের কোনোই ক্ষতি হচ্ছিল না যা দ্বারা। কেননা আমার মনে হতো যে কলঙ্ক প্রকাশিত তা দ্বারাই সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধীরে ধীরে বুঝি সেই কৃত্রিমতা সেই ভান আমাকে আরও অসুস্থতার পথে ধাবিত করছে। আরও প্রকটভাবে মনে হয় পৃথিবীর কোনোদিকেই আমার অকৃত্রিমতার দাম নেই। আমার সন্তানের পরিণতি হবে আমার মতো। কেবল জন্মের মায়ায় আমরা তাকে ভালোবাসব কিন্তু তার সামনের জীবন যে দুর্বিষহ, অসহনীয়! ফলে একরাতে, আমার স্ত্রী তেমনই ঘুমে, আমার ওপর যেন একটা পশু ভর করে। অন্ধকারের মধ্যেই প্রবল শক্তিতে চেপে ধরি তার গলা।



পুরো জ্যোৎস্নাময় রাত ওমরের ওপর ভর করে। হু হু হাওয়ায় তার শুকিয়ে ওঠা কাপড় ফরফর পাক খায়। সেই আলোর ফাঁস তার অবস্থা মর্মান্তিক করে তোলে।

... হ্যাঁ হ্যাঁ, গলা টিপেই তো, এমনই তো শুনেছিল সে। এমনই নিথর যখন ওমরের অবস্থা, বৃদ্ধ তখন হাসতে থাকে... সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জানো, শিশুটির মৃত্যুর পর যখন আমার ওপর ভর করা পশুটি পালিয়ে গেছে, যখন স্নেহময় নির্দোষ পিতার গ্লানিময় কান্নার শুরু, তখন সেই যন্ত্রণাকাতর পিতার হাতে পুলিশ হাতকড়া পরাল। তারা জানত এই শিশুটির মৃত্যুতে সমাজ উপকৃত হলো, তারপরও নিয়মের জন্যই শুধু তারা আমাকে টেনে নিয়ে গেল। অবিরাম নির্যাতন করল সেই পিতাকেই, যে তখন সন্তানের মৃত্যুতে কাতর। পশুটিকে কিন্তু তারা খোঁজার কোনো চিন্তাই করল না, কাজ সমাপ্তির পর সে তখন পালিয়ে গেছে।

আমার ওপর তারা অবিরাম নির্যাতন চালিয়েছে কেবল শিশুটিকে আমি হত্যা করেছি... এই স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য। তুমিই বলো, কী করে আমি স্বীকার করব তা ? হত্যা তো আমি করি নি, করলে জেলখানার সেই রুদ্ধদ্বার কক্ষে বসে কি তার স্মৃতি দ্বারা কাতর হয়ে প্রতিদিন কাঁদতে পারতাম ? রাত গভীর হলে আমি যেন স্পষ্ট দেখতাম শিশুটি সুস্থ পায়ে হেঁটে আসছে। আমার পাশে এসে বসেছে। দেখতাম তার চেহারায় এক অদ্ভুত দ্যুতি। কখনোই সে তার হত্যার জন্য আমার দিকে ঘৃণ্য চোখে তাকাত না। কেননা আসল ব্যাপারটা সে-ই কেবল বুঝেছিল। তবুও, একটা ব্যাপার, তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গভীর কষ্ট ছিল আমার ভেতর, তখন পর্যন্ত কোনো অনুতাপ ছিল না।

সেই রুদ্ধদ্বার কক্ষে শুয়ে শুয়ে, শারীরিক যন্ত্রণায় কাতর হয়েও আমি সেই স্বপ্নটি দেখতাম। লোকালয় ছেড়ে দূরে চলে গেছি আমি। দাঁড়িয়ে আছি, পশ্চিমের শেষ আলোর মধ্য থেকে ঈশ্বর বেরিয়ে এলেন। ধাপে ধাপে নামছেন তিনি। সিঁড়ির শেষ ধাপে কুয়াশার সাদা অন্ধকার। সেখানে পা রাখার পর তিনি অন্তর্হিত।

আমি তখনো, অনেক দূরে, ভীষণ ক্ষুদ্র টিলার ওপর দাঁড়িয়ে আছি।

আমার সেই যন্ত্রণাময় সময়ের অধিকাংশই তখন কাটত ঈশ্বর চিন্তায়। কিন্তু কখনোই তাকে আমি স্পর্শের মধ্যে, যাকে বলে আত্মার স্পর্শ... পেতাম না। শুধু আবছা এক ছায়ার মতো দেখতে পেতাম যেন।

এই যে এখন, বৃদ্ধ যেন মন্ত্র পড়ছে, এরকমভাবে বলে যায়, নির্জনে আসার পর আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে চতুর্গুণ। কেননা পশুরা, সবুজ বৃক্ষরাজি, কখনই আমার আকৃতি নিয়ে ভাবিত নয়। মানুষের মতো শ্লেষ, ব্যঙ্গাত্মক, করুণাকাতর দৃষ্টি তারা আয়ত্ত করে নি, যা আমাকে শৈশব থেকে কুণ্ঠিত করে রেখেছিল। ধুধু প্রান্তর ধরে দিনরাত হাঁটি। কথা বলি গাছেদের সঙ্গে, খরগোশ, হরিণ, চিতাবাঘের সঙ্গে। আকাশের দিকে মাথা রেখে খুঁড়িয়ে হাঁটি এবং ক্রমাগত নিজেকে গল্প শোনাই, সেই মিথ্যে গল্পগুলো, একটি অন্ধ যন্ত্রণাকাতর লোকের দরজায় করাঘাত করেন ঈশ্বর। লোকটি জেগে ওঠে কিংবা পাথর ভাঙতে ভাঙতে ক্লান্ত একটি লোক একদিন তার ভেতর একটি মুক্তোর দানা আবিষ্কার করে। হঠাৎ সেই মুক্তোর দানাটি কথা বলে ওঠে, আমিই ঈশ্বরের অন্য এক রূপান্তর। গল্প করতে করতে পাথরের গুহায় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। এখানে ক্ষুধা-তৃষ্ণার জন্য ব্যক্তিত্ব খোয়ানোর কোনো ব্যাপার নেই। এভাবেই দিনগুলো রাতগুলো কাটে। এর মধ্যে নির্জনতার অলৌকিকতা কিন্তু ভয়াবহ। আমি প্রকৃতির ধ্যানে লিপ্ত ছিলাম একদিন, হঠাৎ প্রকৃতি ফুঁড়ে একটি রমণীর আবির্ভাব হয়। সবুজ পাতার আচ্ছাদনে তার শরীর ঢাকা। এমনি জ্যোৎস্নাময় রাত ছিল সেটা। আমি বিস্মিতভাবে তার নমনীয়, অকৃত্রিম দৃষ্টি প্রত্যক্ষ করি। সে হাসছিল বিশাল সবুজ প্রান্তরের ওপর দাঁড়িয়ে। সেই প্রথম আমি অকুণ্ঠচিত্তে আমার দুটি কুৎসিত হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিই।... এই নাও... বলে সেই রমণী দু’হাত বাড়িয়ে আমার দুটি হাতের ওপর কিছু ঢেলে দেয়। তারপর সবুজ অরণ্যের সঙ্গে মিশে যায়।

আমি দেখি, আমার দু’হাতে গভীর শূন্যতা। চারপাশের মানুষের ভেতর প্রবল যত্নের সঙ্গে যে শূন্যতাকে পকেটে লুকিয়ে রাখতে হতো, ঘৃণা করতাম প্রতিদিন যে শূন্যতাকে; আমি সেই শূন্যতার পথ ধরে সেই প্রথম হাঁটতে শিখি, ভালোবাসতে শিখি তাকে।

চাঁদ হেলে পড়েছে। বৃদ্ধ তখন এই পৃথিবীতে নেই। কী গভীর নিমগ্নতার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে। ওমর পাথরের মতো স্থির, অস্পুষ্ট কণ্ঠে উচ্চারণ করে, জেলখানা থেকে বেরুলেন কীভাবে ?

বৃদ্ধ মাথা নাড়ে... বলছি... তোমাকেই তো বলব, তুমিই তো সেই একমাত্র কিশোর, যে একদিন স্বীকৃতি দিয়েছিলে আমার জন্মকে... তোমাকে অবশ্যই বলব।

ওরা যখন সন্তানের হত্যার জন্য ক্রমাগত নির্যাতন চালাচ্ছে, তখন একরাতে আমি আবার নতুন বোধ দ্বারা আক্রান্ত হই। মনে হয়, আমার সন্তানের পা দুটো বিকলাঙ্গ হলেও দুটি সুন্দর হাত ছিল তার। ফলে সে যে শুধুই অন্যের গলগ্রহে পরিণত হতো সেটা হয়তো ঠিক নয়। আমি একটি সুন্দর অট্টালিকার কথা স্মরণ করি, যার ভাঁজে ভাঁজে আছে বালু। খাঁজ মিশ্রিত অনন্ত বালুর সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করি। সব এলোমেলো হয়ে যায়। পাগলের মতো হয়ে যাই আমি। নিজেকে রূঢ় হিংসুটে হত্যাকারী মনে হয়। মনে হয় আমি আমার ব্যর্থতার ভার আরেকটি প্রজন্মের ওপর চাপিয়ে দিয়েছি। অথচ আকৃতির অভিন্নতা সত্ত্বেও তার মাথা কিংবা হাত দুটি থেকে নতুন কিছুর জন্ম হতে পারত। অতদূর হয়তো দৃষ্টি প্রসারিত করার ক্ষমতাই আমার নেই। আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে... নিজের চুল নিজেই ছিঁড়তে থাকি... আমি বুঝতে পারি, তাকে বাঁচিয়ে রাখলে কুণ্ঠিত হয়ে বেঁচে থাকার শাস্তি সে একা পেত না। তার দিকে যাদের চোখ পড়ত, ঘৃণায় যারা সরিয়ে নিত চোখ, শাস্তি তাদেরও কিছু কম হতো না। একটি বিকৃত কিছু চোখের সামনে দুলছে... বোঝো কেমন শাস্তি! যা হোক জেল স্থানান্তরের সময় আচমকা গাড়ি থেকে আমি নিচ দিকে লাফিয়ে পড়ি... পাক খেতে খেতে আমার দেহটা গভীর গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হয়। আমি আত্মহত্যা করি... বলতে বলতে বৃদ্ধ দাঁড়ায়... এবং উচ্চারণ করে... কী হবে এই গল্প শুনে ? একসময় জ্যোৎস্না প্লাবিত রাতের পথ ধরে সে হাঁটতে থাকে। একটা তীব্র ঝাঁকুনি খেয়ে স্থির হয়ে যায় ওমর। তার যেন স্পষ্ট মনে হয়... হ্যাঁ হ্যাঁ তাইতো, আত্মহত্যাই তো করেছিল... ওমর কাঁপতে থাকে। বৃদ্ধ পেছন দিকে তাকিয়ে শেষবারের মতো উচ্চারণ করে... বিশ্বাস করো না, এর কিছুই বিশ্বাস করো না...। তারপর তার দেহটা বিশাল প্রান্তরের সবুজের মধ্যে ডুবে যেতে থাকে। ওমর দেখে একটি ভঙ্গুর মানুষ ধীরে ধীরে জ্যোৎস্নার গহ্বরের মধ্যে মিলে যাচ্ছে। আর দেখা যাচ্ছে না তাকে।

পাগলের মতো দৌড়াতে থাকে সে। ধবল হয়ে আসছে আকাশ। বাঁশবনের শব্দ, এবড়ো-থেবড়ো ঘাসে ছাওয়া মাঠ ধরে উদভ্রান্তের মতো দৌড়ায় সে। চাঁদ আকাশের শেষ কোনায় অস্পষ্ট, রঙ জ্বলে যাওয়া গোল রুমালের মতো। সেই জায়গায় এসে হাঁপ ছাড়ে ওমর, যেখানে টুলু কায়সার... কিন্তু ধুধু প্রান্তর। যথাস্থানে গরুর গাড়িটি নেই। তাকে বিশাল শূন্যতায় ফেলে বন্ধুরা তখন চলে গেছে।



রচনাকাল : ১৯৮৯ সাল

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

8 মন্তব্যসমূহ

  1. Nasreen Jahan ভাষাহীন ধন্যবাদ। এ গল্পের বইয়ের নাম"সারারাত বিড়ালের শব্দ"।
    -------------------
    Rebecca Haque --
    Translation of "Ekti dhirgoshaasher daalpaala" by me in Six Seasons Review, No. 3. Title: ' A Sigh in the Moonlit Mist".

    -----
    Nasreen Jahan ইয়েস আপা,অসাধারণ অনুবাদ।
    ---------------------

    Rebecca Haque ---
    Thank you, dear Nasreen Jahan

    উত্তরমুছুন
  2. Showkat Bangali--
    এক টানে পড়া বই
    নাসরীন,প্রিয় সই।
    ----
    Nasreen Jahan ---
    ওহ,এই বইটা উড়ুক্কু,আগে লেখা।তখনকার পাঠকদের কাছে এর পরিচিতি ছিলো।আর তুমি আমার গভীর বন্ধু, তোমার পড়া।এদ্দিন হারিয়ে ছিলে,এই গল্পটার সূত্রে তো বেরোলে!

    উত্তরমুছুন
  3. Taslima Mondal --
    Khub valo laglo

    Nasima Anis শেয়ার করে রাখলাম, অর্ধেক পড়ে ফেলেছি, খুব ভাল লাগছে, বইটা পেলে খুব ভালো লাগত, কোথায় পাই নাসরীন, প্রিয় লেখক?

    Nasreen Jahan-- ঠিকানা পাঠাও।

    Nasima Anis পাঠালাম প্রিয় মানুষ

    উত্তরমুছুন


  4. Choose File
    Nasreen Jahan
    Nasreen Jahan কে কাকে প্রিয় বলে,তুমি যে আমার ক,,,তো,,,
    Like · Reply · 1 · September 3 at 1:25pm
    Marina Nasrin
    Marina Nasrin একটানে পড়ে ফেলেছি আপু। অসম্ভিব সুন্দর।
    Like · Reply · Yesterday at 10:12am
    Nasreen Jahan
    Nasreen Jahan এরমাঝে পড়েও ফেলেছো?তাজ্জব করলে তো!
    Like · Reply · Yesterday at 11:09am
    ফেরদৌস আলম
    ফেরদৌস আলম · Friends with Humayun Kabir and 46 others
    আমাকে বিনামূল্যে কিছু বই দিবেন আপনার? বই কিনেই দেওলিয়া হয়ে গেছি! কিন্তু আপনার কয়েকটা লেখা পড়েই যে আপনার লেখার ভক্ত হয়ে গেলাম। এখন আপনার বই কেনার নেশা চেপে বসেছে মাথায়। কলম এগিয়ে যাক আপনার।
    Like · Reply · 2 hrs
    Nasreen Jahan
    Nasreen Jahan দেবো। ক,টা দিন যাক?
    Like · Reply · 1 · 1 hr

    ফেরদৌস আলম
    ফেরদৌস আলম · Friends with Humayun Kabir and 46 others
    Nasreen Jahan ততদিনে পাঠকের মৃত্যু আবার না হয়!
    Like · Reply · 28 mins

    Nasreen Jahan
    Nasreen Jahan আরে এ কেমন? রিকোয়েস্ট পাঠিয়েই বই চেয়ে লেখক কে দম নেয়ার সময় না দেয়া?উল্টো আমি একটা ধন্যবাদ আশা করেছিলাম।সব এত সহজলভ্য? জীবন থেকে এই শিখেছো?

    উত্তরমুছুন
  5. Jalal Kobi Prangon
    Jalal Kobi Prangon · 6 mutual friends
    হালুয়াঘাট
    স্বপ্নের মাঠ
    এখানে আসবেন কিন্তু...See More
    Like · Reply · 4 hrs
    Nasreen Jahan
    Nasreen Jahan আমার জন্ম শেকড়, না গিয়ে পারবো?
    Like · Reply · 2 hrs
    Shamima Zaman
    Shamima Zaman · Friends with Amar Mitra and 19 others
    পড়লাম ।এখনও ঘোর কাটেনি । #Kuloda র সাথে এক্মত।নাস রীন জাহান এর খুব আশে পাশে এখনো কাউকে দেখিনা ।
    Like · Reply · 1 hr
    Nasreen Jahan
    Nasreen Jahan আমি মরমে মরে যাচ্ছি,,
    Like · Reply · 1 · 1 hr
    Shamima Zaman
    Shamima Zaman · Friends with Amar Mitra and 19 others
    এটাই সত্যি আপা

    উত্তরমুছুন
  6. নাসরীন,শেয়ার করে রাখকাম, কিছুটা পড়েছি! এত সুক্ষ্ণ গভীর জীবনবোধ, যা পাঠককে আকৃষ্ট করে। অনেক ভালোলাগা!

    উত্তরমুছুন
  7. কী সাবলীল জীবনবোধ!

    উত্তরমুছুন
  8. আজ থেকে আপনাকে পড়া শুরু করলাম। জানিনা কোথায় যেতে চলেছি... কী আছে এই পথের শেষে! আমার অবিরাম কাঁদা নাকি নিরাময়! তবে আপনি আমাকে ইতিমধ্যেই আচ্ছন্ন করে ফেলেছেন

    উত্তরমুছুন