উত্তেজনার এ পর্যায়ে পুচ্ছ শুন্যে তুলে পায়ের পাতার সামনের দিকে ভর দিয়ে কিছুটা ঝুকে বসে থাকা অবস্থায় কুদ্দুস স্বীয় স্ত্রী বরাবর পরপর দুবার তার মায়ের সাথে সঙ্গমবাসনার ঘোষণা দিয়ে, তৃতীয় বাক্য আর স্পষ্টস্বরে উচ্চারণ করতে পারবে না। কাশির দমক তার গলা আটকে দেবে। কুদ্দুসের যদিও শ্বাসকষ্টজনিত কেনো রোগ এখনও অব্দি প্রকাশিত হয় নাই; তবে, যেহেতু সে একজন নিয়মিত পর্যায়ের হেরোইনসেবি তাই তার শ্বাস যেকোনো সময় আটকে যাবে এমনটা বিচিত্র নয়।
উপরন্তু মাতৃসম শাশুড়ির সাথে অযাচারি সম্পর্ক স্থাপনের বারংবারের ঘোষণা থেকে তাকে নিবৃত্ত করতে, দৈবও তার গলা চেপে ধরতে পারে। এমনটা ভেবে নেওয়াও অসুবিধার নয়। তৃতীয় দফায় কুদ্দুস নিশ্চয় একই বাক্য আবারও উচ্চারণ করতে চেয়েছিল। তবে কাশির দমক আর মুখ ভর্তি জমে ওঠা থুথুতে জিহ্বার ব্যবহারে অসমর্থ হয়ে অধ:উচ্চারিত ছোট ছোট কয়েকটি গালি দিয়ে তাকে থেমে যেতে হবে।
কুদ্দুস এ গল্পে শুধুই কুদ্দুস। কুদ্দুস কিছুতেই আব্দুল কুদ্দুস, মো: কুদ্দুস আলি, কুদ্দুস মণ্ডল, কুদ্দুস বেপারি-এর কোনোটাই না। কেননা, নিকট অতীতে তার চারপাশের কেউ কখনই তার পুরো নাম জানতে চায় নাই। এমনকি, এই যে অসংখ্যবার পুলিশ তাকে আটক করেছে, জেল-হাজতে পাঠিয়েছে, আবার ছেড়েও দিয়েছে-- এই অসংখ্যবার আটক করা এবং ছেড়ে দেবার পুরো প্রক্রিয়ায় পুলিশের লোকেরা তাদের খাতায় লেখার প্রয়োজনেও কুদ্দুসের পুরো নামটি জানতে চায় নাই। এ কারণেই কুদ্দুস কেবলই কুদ্দুস।
এই মুহূর্তে উপর্যুক্ত ভঙ্গিতে বসে থাকা কুদ্দুস তার গাল ভরে জমে ওঠা সাদা থুথু নিজের দুপায়ের ফাকায় উগরে দেবে। নিয়ন্ত্রণহীন একগাদা থুথুর প্রধান অংশ গিয়ে পড়বে ইটের খোয়া, পাথরের টুকরো আর কালো মাটিতে তৈরি সলিং-এর ওপর ছড়িয়ে থাকা তার পরনের নোংরা লুঙ্গিটার নিচের অংশে। কোলের উপর জমে থাকা লুঙ্গির মাঝের অংশ ঝাকি দিয়ে থুথু ঝরাতে গেলে তার খানিকটা এবার ছিটকে এসে লেগে যাবে তার ডান হাতের পাঞ্জার পেছন পাশে। দু’এক ফোটা গিয়ে লাগবে তার চোয়ালেও। এরই মধ্যে ঝুপড়ির মুখে, অর্ধপোড়া প্রায় ভিজে একখণ্ড লাকড়ি হাতে প্রতিবাদ করে উঠবে তার স্ত্রী, মালেকা। ‘আমারে করার মুরোদ নাই তর, আমার মায়েরে করবি কেমনে? শালা বাইনচোৎ হিরোঞ্চি।’ এতক্ষণ ঝগড়া চলছিল ঘরে ফুরিয়ে যাওয়া তেল-নুন আর কুদ্দুসের অকর্মণ্যতা নিয়ে। শীত কেটে গিয়ে ফাল্গুনের মাঝামাঝি আজকের এই সকালে কুদ্দুস ও মালেকার ঝগড়াটা শুরু হয়েছিল মুলত লবণহীন লালশাক ভাজিকে কেন্দ্র করে।
শেষ রাতে সবজি ভর্তি একের পর এক বিশালাকায় সব ট্রাক এসে দাঁড়ায় তাদের সারিবদ্ধ ঝুপড়িগুলোর দেয়ালের পেছনে। রাতের প্রথম অংশে উপর্যুপরি হেরোইন নিয়ে কুদ্দুস যখন বেঘোরে ঘুমায়, মালেকা তখন অন্যান্য মহিলাদের সাথে ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে কাঁচাবাজার পট্টিতে। ট্রাকের ফাঁকা আর শক্ত করে সেলাই দিয়ে বাঁধা বিরাট সব বস্তার ফুটো দিয়ে ঝরে পড়া যে সকল বেগুন পটল কাঁচামরিচ শসা গাজর ভেঙ্গে-ফেটে সাহেবদের ব্যাগে ওঠার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে সেসব তারা খুটে নেবে। তার থেকে বাছাই করা কিছু সবজি তারা বিক্রি করবে। তাতে কম করে হলেও দুই কেজি, কোনো কোনো দিন তিন কেজি চালও কেনা যায়। বাকিটা তারা তোলে তাদের নিজেদের চুলায়। তবে শুধু চাল আর সবজিতেই তো আর খাওয়া হয় না। খেতে বসলেই, সে যেমনই হোক, কোনো এক প্রকারের মাছ কুদ্দুসের চাই-ই-চাই। সেক্ষত্রে চাল না হয় লাকড়ি আর পানি দিয়ে ফুটিয়ে ভাত তৈরি করে ফেলা সম্ভব। বাকিটা? মাছ-তরকারি সেসব তো রান্না করা চাই! আর রান্নার জন্য চাই তেল-নুন-হলুদ, আরো সব রসনা সামগ্রী, যা কিনতে চাই নগদ টাকা। নগদ কিছু পয়সা যে কুদ্দুস কামায় না ঠিক তা-ও না। মিজানুরের সাথে দুপুর কি বিকেল পর্যন্ত ক্রসিং-এ দাঁড়িয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে কেঁদে-কেটে যা পাওয়া যায় তাতে তার এক-দুই পুরিয়া হেরোইন ঠিকই যোগাড় হয়ে যায়।
প্রতিদিনের মতো আজও বেলা দশটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে খেতে বসেছিল কুদ্দুস। আজকের সকালে সে বসেছিল লালশাকের ভাজি আর গতরাতের এক থাল ভাত নিয়ে। একটু নেড়ে চেড়ে বৃহৎ আকৃতির একটি গ্রাস মুখে পুরতেই মেজাজটা খিচড়ে যায় তার। লাল শাকের ভাজিটা হয়েছে একেবারেই লবণ ছাড়া। মৃদু অভিযোগটা তুলতেই ক্ষেপে যায় মালেকা, ‘লবণ কি আমি আমার হোগা দিয়া বাইর করুম? কয় বস্তা লবণ কিন্যা রাখছেন সোনার চান?’ স্ত্রীর মুখে এমন শ্লেষাত্মক কটাক্ষ শুনে কারই বা মেজাজ ঠিক থাকে। ভাতের থালা ছুড়ে দিয়ে বাইরে এসে, পাছা শূন্যে তুলে বসে, বউয়ের একের পর এক তীর্যক কথার জবাব দিয়ে যাচ্ছিল কুদ্দুস।
উদ্ভূত অবস্থায় মালেকা যখন তার পৌরুষ নিয়ে কথা তুলবে তখন পরিস্থিতি একেবারেই গুলিয়ে যাবে। ঠোঁট-মুখ আর হাতে লেগে যাওয়া থুথু মোছার কথা ভুলে গিয়ে লাফিয়ে ঝুপড়ির দরজায় চলে আসবে কুদ্দুস। মালেকার চুলের মুঠি ধরে হাতের আধপোড়া লাকড়িটা ছিনিয়ে নিয়ে কয়েক ঘা বসিয়ে দেয়ার পরও মালেকা যখন হাউমাউ করে কেঁদে উঠবে না, তখন তার মেজাজ আরো চড়ে যাবে। লাকড়ি ছুড়ে দিয়ে এবার সে হাত চালাবে। কয়েকটা কিল ঘুষি বসাতেই বেচারি এবার কুপোকাত হয়ে বাবাগো-মাগো বলে লুটিয়ে পড়বে। লুটিয়ে পড়ার পর কুদ্দুস সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে লুঙ্গির গিট বাঁধতে-বাঁধতে মালেকার বুকে-পেটে লাথি বসাবে পরপর কয়েকটা। এবারে তার কান্না থেমে যাবে। লাকড়ির পিটুনি, কিল-ঘুষির দুমদাম শব্দ, মালেকার ভূমিতে আছড়ে পড়া আর কান্নার শব্দ শুনে পাশের ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে আসবে অশিতিপর নিঃসঙ্গ ভিক্ষুনি। কাঁপা-কাঁপা গলায় কুদ্দুসকে ধমক দিতেই কুদ্দুস আর কথা বাড়াবে না।
জোর পায়ে রেললাইন ধরে সোজা এগিয়ে যাবে খালার ঝুপড়ির অভিমুখে। যেতে যেতে জামার পকেট-লুঙ্গির খুট হাতড়াবে কয়েকবার, টাকা-কড়ির কোনো নাম-গন্ধও সে খুঁজে পাবে না। উর্ধ্বশ্বাসে হাঁটতে থাকা কুদ্দুসের লুঙ্গির গিটটা তখন আবারো নড়বড়ে হয়ে উঠবে, হাঁটতে হাঁটতেই সে লুঙ্গির গিঁট বাঁধবে পুনরায়, আরো শক্ত করে। গিঁট বাঁধতে গিয়েই তার মনে পড়বে মালেকার কথা। তিন-চার দিন পূর্বের একরাতে, চ্যাপাশুটকির ঝাঁঝাঁলো ভর্তা আর টকবেগুনের গাঢ় ঝোলে ভালোরকম উদরপূর্তির পর সে শুয়ে পড়েছিল। আলো নিবিয়ে মালেকা তার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়তেই নিজের মধ্যে একধরনের উত্তেজনা অনুভব করেছিল কুদ্দুস। এবং সে হাত তুলে দিয়েছিল মালেকার উরুর উপর। হাসি মুখে সে হাত সরিয়ে দিতে দিতে মালেকা তাকে জানিয়েছিল, সে গর্ভিনী। এনজিওর এক আপা তাকে জানিয়ে গেছে, এখন থেকে পরবর্তী দুই-তিন মাস সহবাস করা নিষেধ। সঙ্গমে বাধাপ্রাপ্ত হলেও একটা সুখ-সুখ অনুভূতি নিয়ে কুদ্দুস সেদিন ঘুমিয়ে পড়েছিল। এসব ভাবতে গিয়ে রেল লাইনের মাঝে ছড়িয়ে থাকা একটি অপেক্ষাকৃত বৃহদাকার পাথরে হোঁচট খাবে কুদ্দুস। নিজেকে সামলে নিয়ে ভাববে, হারামজাদিটার পেটে লাথি মারা উচিৎ হয় নাই তার।
খালার ঝুপড়ির সামনে পৌঁছে বার দুয়েক এদিক ওদিক তাকিয়ে, ঝুপড়ির মুখের ছেড়া বস্তার পর্দা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিবে সে। দেখবে চার কী পাঁচ জন যুবক মোমবাতি জ্বালিয়ে গভীর আগ্রহে তাদেরই আর একজনের নখে পিষে রাংতা সোজা করা দেখছে। আর একজন আছে জটলা থেকে কিঞ্চিৎ পেছনে, ঝুপড়ির দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসা। আদুল শরীর তার, বুকের ওপর দিয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে নামছে, ফর্সা বুকে রোমের সংখ্যা তত বেশি নয়। ঝুপড়ির ভেতরটা ততটা আলোকোজ্জ্বল না হলেও কুদ্দুস সে যুবকের বুকের অভ্যন্তরে হৃৎপিণ্ডের ওঠানামা ঠিকই দেখতে পাবে। অন্যদের থেকে কিছুটা দুরত্ব নিয়ে বসে থাকলেও সে যে এদেরই কেউ তা কুদ্দুস ঠিকই বুঝতে পারবে। জলন্ত মোমবাতি ঘিরে বসে থাকা যুবকেরা তার দিকে ভ্রুক্ষেপ করবে না এতটুকু, এমনকি ভ্রুক্ষেপ করবে না সেই যুবকও, যার বুক বেয়ে ঘামের বিন্দু গড়িয়ে নামছে। কুদ্দুস মোমবাতি ঘিরে থাকাদের চোখের দিকে তাকাবার চেষ্টা করবে কয়েক বার। এবং ব্যর্থ হবে। কেউই তার আবেদনময় দৃষ্টিকে এতটুকু গ্রাহ্য করবে না। ‘খালা’, ‘খালা’ বলে মৃদু দুটি ডাক দিতেই বুকের আঁচল ঠিক করতে করতে ঝুপড়ির পেছন দিকের বেড়া কেটে তৈরি করা দরজা চড়চড় শব্দে ঠেলে ফাঁকা করে ‘খালা’ প্রবেশ করবে। এবং কপাল কুচকে কুদ্দুসের দিকে তাকাতেই মনে হবে, সে যেন কুদ্দুসের পকেটের সকল খবর ইতোমধ্যেই পেয়ে গেছে। বিরক্ত মুখে খালা কুদ্দুসকে জানাবে, ‘মাল নাই’। যা ছিল তা এই উপস্থিত যুবকদের দিয়ে দেয়া হয়েছে। এ কথা শুনে কুদ্দুসের শুকিয়ে যাওয়া গাল পুনরায় থুথুতে ভরে উঠবে। কোনো আশা নাই জেনে কুদ্দুস চটের যে দরজা ঠেলে প্রবেশ করেছিল সেই দরজা দিয়েই আবার বেরিয়ে যাবে। রেল লাইনের উপর উঠে কুদ্দুস পরবর্তী করণীয় ঠিক করে উঠতে না পেরে সোজা ক্রসিং-এর দিকে হেঁটে যেতে থাকবে।
একটু হেঁটে এগুতেই তার কানে আসবে রেল গাড়ির দীর্ঘ হুইসেল। আর তার পরপরই টানা রিরি শব্দে ইলেকট্রিক ঘন্টা বেজে চলবে, ঘণ্টা বেজে চলার শুরুতেই দুপাশের রাস্তার মুখে নেমে আসবে লৌহ প্রতিবন্ধক। যা মুলত রেলের উপর দিয়ে দুই বিপরীত দিকে পার হয়ে যাওয়া অগণিত মানুষ আর যানবাহনকে আটকে দেবে, সেখানেই। রেলের আগমন বার্তা শুনে কুদ্দুসের পায়ের গতি বেড়ে যাবে দ্বিগুণ। সে যেতে থাকবে যেদিক দিয়ে রেল আসছে সেদিকেই, অর্থাৎ মুখোমুখি। যা একই সাথে অদূরের ক্রসিং অভিমুখেও। কুদ্দুস ক্রসিং-এ পৌঁছানোর আগেই রেল গাড়িটা হুইসেল অক্ষুণ্ন রেখে মাঝারি গতিতে তাকে অতিক্রম করে যাবে। তাদের বসবাসের ঝুপড়িগুলোকে মনে হবে যেন পদদলিত করে, পায়ের নিচের মাটি কাঁপিয়ে ক্রসিং অভিমুখে জোর পায়ে হেঁটে চলা কুদ্দুসের শরীর ঘেঁষে রেল চলে যাবে সোজা উত্তর দিকে। সারাক্ষণ সরগরম হয়ে থাকা জায়গাটা মুহূর্তের জন্য কিছুটা শান্ত হয়ে আসবে। রেলগাড়িকে চলে যাবার জন্য জায়গা করে দিতে যারা লাইন ছেড়ে দাঁড়িয়েছিল তারা আবার পায়ে-পায়ে উঠে আসবে লাইনের বুকে। কুদ্দুসের দ্বিগুণ গতিতে ক্রসিং অভিমুখে হেঁটে চলা থামবে না।
কুদ্দুস পৌঁছে যাবে ক্রসিং-এর কাছাকাছি। রেল চলে যাবার সাথে সাথে দুপাশে আটকে যাওয়া অজস্র ফিটনেসহীন হর্ণসর্বস্ব গাড়ি আর রিকশা অনবসর হর্ন আর বেল বাঁজাতে থাকবে। লাইনম্যান তার কানের তালা ফেটে যাবার হাত থেকে রক্ষা করতে যত দ্রুত সম্ভব দুপাশের প্রতিবন্ধক লৌহ দণ্ডদুটিকে উঠিয়ে নেবে। ক্রসিং-এর নির্দিষ্ট জায়গাটাতে পৌঁছেই কুদ্দুসের কানে একটি মৃদু শোরগোল এসে ধাক্কা খাবে, ‘একসিডেন্ট!’ ‘একসিডেন্ট!’ কুদ্দুসের ভেতরটা মুহূর্তেই খানিকটা নড়েচড়ে উঠবে। ক্রসিং অতিক্রম করে যেতে থাকা অসংখ্য মানুষ গাড়ি আর রিকশার মাঝখানে এসে দাঁড়াবে কুদ্দুস। পায়ের নিচে ছোপ ছোপ রক্ত দেখতে থাকবে সে। হ্যাঁ, রক্তই! এবং এ রক্ত সদ্য কারো শরীর দ্বিখণ্ডিত অথবা ততধিক খণ্ড পরিণত করে চলে যাওয়া রেলগাড়িটার চাকার নিচ দিয়ে আসা রক্ত। এখনো জমাট বাঁধে নাই। কুদ্দুস গাড়ি আর রিকশার মাঝে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজে ফিরবে। ক্রসিং-এর পশ্চিম পাশে যথেষ্ট নির্বিকারভাবে কয়েকজন নীল পোশাকের পুলিশকে সে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবে। তাদের দুজন আশপাশের অসহ্য শব্দযন্ত্রণাকে তুচ্ছ করে কানে মুঠোফোন লাগিয়ে গভীর আলাপে মগ্ন। বাকিরা হেঁটে যাওয়া নারীদের বুকের ওপর থেকে সরে যাওয়া ওড়নার দিকে তাকিয়ে হাসবে নিরুদ্বেগে। কুদ্দুস তাদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে পুনরায় তাকাবে নিজের পায়ের দিকে তারপর সে চোখ তুলে তাকাবে সমদূরত্বে বয়ে যাওয়া রেলের দুটি পাতের সীমার দিকে। পাটির ওপরে কোনো রক্ত দেখতে পাবে না সে। রক্ত কেবল দুইটি পাটির মাঝে পাথর আর কাঠের রাস্তাটার ওপর। তাহলে? কীভাবে ঘটলো ঘটনাটা। আর লাশটাইবা কই? যা হতে পারে অভুক্ত ও হেরোইন তৃষ্ণিত কুদ্দুসের আজকের অবলম্বন। তাঁর একমাত্র বন্ধু মিজানুর গেল কোথায়? অবধারিতভাবে তারই তো থাকবার কথা ছিল এখানে। ঠায় দাঁড়িয়ে এসব ভাবতে গিয়ে কুদ্দুস লক্ষ করবে পার হয়ে যাওয়া একাধিক গাড়ির দরজা দিয়ে কল্লা বাড়িয়ে হেল্পারগণ কাকে যেন তীব্র স্বরে গালিগালাজ করে যাবে। ক্ষণিকেই সে আবিষ্কার করবে, এই গালিগালাজের ডালি তাকেই নিবেদন করা হচ্ছে। কুদ্দুস বুঝতে পারবে সে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, পায়ে-পায়ে সরে এসে ক্রসিং-এর পুব পাশে দাঁড়াতেই কেউ একজন তার হাত ধরে হেচকা টানে অপেক্ষাকৃত ঢালু জায়গাটার আরো নিচে নামিয়ে নেবে। কুদ্দুস দেখবে লোকটা তার বন্ধু মিজানুর। লুকোনো গলায় মিজানুর তাকে বলবে, ‘এই দিকে আয়, লগে আর কেউ নাই, আমার লগে হাত লাগা! বেলা দুইটায় ওইপাশের পুলিশগুলানের ডিউটি শ্যাষ হইবো। হ্যাগোর লগে কতা হইছে। তার আগ পর্যন্ত যতটা পারা যায় কলেকশন কইরা নিতে হইবো।’ মিজানুরের সাথে কুদ্দুস পানি শুকিয়ে যাওয়া সরকারি ডোবার ঢালে নির্মিত পরিত্যক্ত ঝুপড়িটার দিকে এগিয়ে যাবে। এই ঝুপড়িটা যথেষ্ট আড়ালে অবস্থিত। কেউ এখানে না এসে শুধু চোখ দিয়ে দেখতে পারবে না এখানে কী হচ্ছে!
একটু দূর থেকে কুদ্দুস দেখবে রক্তে বুক থেকে মাথা পর্যন্ত ভেজা একটা নিথর দেহ লম্বালম্বি পড়ে আছে বাশের বেঞ্চের উপর। দুটি অক্ষত পা জিন্সের প্যান্ট জড়ানো অবস্থায় দুদিকের মাটি স্পর্শ করে একই ভঙ্গিমায় পড়ে আছে। রক্ত ছাড়া দেখলে মনে হবে ক্লান্ত কেউ এই আড়ালে বেঞ্চটাকে ফাকা পেয়ে ঘুমিয়ে নিচ্ছে খানিকটা। মিজানুর বলে যাবে, ‘আর কইস না। সক্কাল থেইকা খাড়ায়া আছি, মাগার কোনো লাশের খবর নাই। তিন তিনডা ট্রেন গ্যাছেগা এর মইদ্যে। রাইতে তো গ্যাছে চাইরডা। ওর হাঁটা দেইখ্যা দূর থেইকাই বুঝবার পারছি হালায় শুইবো ট্রেনডার নিচেই। হেই কতা ভাবতেই ভাবতেই হালায় শুইয়া পড়ছে ট্রেনডার সোজাসুজি। ট্রেন যাইতে যেই সুময়ডা। আমি খাড়ায়া আছিলাম পুলিশের লগেই, দুইশ ট্যাকা হ্যাগো একজনের ট্যাকে গুইজা দিয়াই ‘বাই’ ‘বাই’ বইলা লাফায়া পড়ছি। হাত পাও মাতার কিচ্ছু হয় নাই, খালি বুকটা যা চিরছে। বগলের নিচে দুই হাত দিয়া চিল্লাইয়া কানতে কানতে টাইন্যা লইয়া আয়া পড়ছি। চোদনা পাবলিকে যেমনডা ভাবে! মনে করছে সত্যই আমার ভাই-ই হইবো। তুই এক কাম কর! বলতিডা ল! নিচ থেইকা যতদূর পারস পানি লইয়া আয়। রক্তডা ধুইয়া কাফনডা খালি মোড়াইয়া নিয়া খাড়াইতে হইবো এক্ষুনি।’ মিজানুর হাতলবিহীন একটা ভাঙ্গা প্লাষ্টিকের বালতি ছুড়ে দেবে কুদ্দুসের দিকে। কুদ্দুস সেটা নিয়ে পায়ে পায়ে নেমে যাবে ডোবায়। ডোবার পানি শুকিয়ে গেছে। একেবারে ভেতরে শুধু মশার বংশবিস্তারে যতটুকু প্রয়োজন কেবল ততটুকু পানি জমে আছে। পানির কাছাকাছি যেতেই মজা ডোবাটির শেষ পানিটুকু ঘিরে থাকা নরম কালো কাদায় স্যান্ডেলসমেত ভস্ করে দেবে যাবে কুদ্দুসের বাড়িয়ে দেওয়া ডান পা। সেটা তুলে বাম পা’টা এগিয়ে ফেলতেই আরো গভীর কাদায় তলিয়ে যাবে তার বাম পা’টাও। স্যান্ডেল কাদার বুকে রেখে কোনোক্রমে পা দুটি মুক্ত করে রোদে খাবি খাওয়া অজস্র মথযুক্ত খানিকটা কাঁদা-পানি ভাঙা বালতিটাতে পুরে নেবে কুদ্দুস। তারপর ডাঙায় এসে বালতিটাকে রেখে কাদায় ডুবে থাকা স্যান্ডেলযুগলকে মুক্ত করতে সে আবারো নিচে নামবে। স্যান্ডেল ঢেকে থাকা কালো আঠালো কাদা ধোয়ার মতো যথেষ্ট পানি ডোবায় নেই, তবুও কুদ্দুস সেই পানিটুকুর ওপরই একে একে দুটি স্যান্ডেল আছড়ে যতটা সম্ভব কাদামুক্ত করে নিয়ে কর্দমাক্ত পা দুটি ফের স্যান্ডেলে পুরে বালতি নিয়ে ফিরে আসবে আগের জায়গায়।
বালতিটা রাখতেই খেকিয়ে উঠবে মিজানুর, ‘হালায় এইহান দিয়া একটু পানি আনতে তর এতক্ষণ লাগে? যাউক, ঢাইলা দে! শইলের রক্তডা যাউক।’- বলে সাদা একটুকরো কাপড় ঠিক করতে করতে বলে যাবে, ‘দোকানি হালারে কত কই যে আমার কাফনের মতো দেহায় এমন সাদা লম্বা খানিকটা কাপড় হইলেই চলবো। না! হালায় আমারে সুন্নতি মাপেই কাপড় কাইট্টা দিবো! খাড়ায়া আছোস কেন বাইনচোৎ! পানিডা ঢাইলা দে শইলের ওপর। রক্তডা না ধুইলে হালার মাছি আয়া ভিড় করবো আর তাইলেই হালার পাবলিকে করবো সন্দো।’
কুদ্দুস মিজানুরের ধমকে আর দেরি না করে বুক চেরা লাশটার ওপর ঝপাত করে ঢেলে দেবে বালতির পানিটুকু। বেশ খানিকটা রক্ত তাতে ধুয়ে গিয়ে বেরিয়ে পড়বে লাশের চেহারা। স্পষ্ট হবে চিরে যাওয়া বুক। কুদ্দুস সেই বুক আর মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে এসে বলবে, ‘আরে! এই তো হালায় ওই লোকটা। আমি তো হ্যারে চিনি।’ মিজানুরের বিরক্তি আরো বেড়ে যাবে, ‘চিনস মানে? ক্যামনে চিনস? তর আত্মীয় লাগেনি?’ কুদ্দুস সে কথার জবাব দিবে, ‘না’। আইজকাই দেকছি, খালার ড্যারায়! তয় আমি তো হালায় আয়া পড়লাম। হ্যায় তো বইয়া আছিল। আমার আগে আইলো ক্যামনে? কাফন নিয়ে প্রস্তুত মিজানুর খেকিয়ে ওঠা গলায় বলবে, ‘তুই সেইডা কেমনে বুঝবি? হালায় হিরোঞ্চি! মরনের সময় হইছিল, আজরাইলে তার পাখনায় কইরা উড়াইয়া লইয়া আইছে। মুখ আর বুহের রক্তডা মুইচ্ছা দে তর লুঙ্গি দিয়া। কাফনডা জড়ামু। কুদ্দুস বুক আর মুখ মুছতে গিয়ে অধিকতর নিশ্চিত হবে যে, এ-ই সেই লোকটা, বুকে যার স্বল্প পরিমাণ লোম ছিল। আর এখন তা চিরে গেছে সোজাসুজি। মুছতে গিয়ে কুদ্দুস অনুভব করবে লোকটার বুকের ভেতরটা ফাঁকা। মৃত্যুর পর মানুষের বুক ফাঁকা হয়ে যায় কিনা, নাকি আগে থেকেই লোকটার বুকের ভেতরটা ফাঁকা ছিল তা ঠিক বুঝে উঠতে পারবে না কুদ্দুস। নিজের বুকের ওপর তর্জনী ও কনিষ্ঠাসহ চারটি আঙুল দিয়ে কুদ্দুস নিজের বুকের ওপর সজোরে চাপ প্রয়োগ করে বুঝে নেবার চেষ্টা করবে নিজের ভেতরের অবস্থাটা। তারপর আদুল গায়ের জিন্স পরা বুক চেরা মৃত যুবককে দেখে নেবে শেষ বারের মতো।
প্যান্টের পকেটগুলোতে কী আছে? যদি টাকা পয়সা কিছু থেকে যায় তো খুব ভালো। কুদ্দুস এখানে আর দেরি করবে না। সোজা চলে যাবে খালার ঝুপড়িতে। ‘মাল নাই! কইলেই হইলো? ট্যাকা পাইলেই চুতমারানি ব্লাউজের ফাঁক দিয়া পোটলা ঠিকই বাইর কইরা দিবো।’ কাফনের মাথার দিকটায় গিঁট বেঁধে ঠিক করতে থাকা মিজানুরের চোখের আড়ালেই কুদ্দুস বুক চেরা লাশের পরনে থাকা শক্ত জিন্সের পকেটগুলো হাতড়ে নেবে। পেছনের দুটি পকেটের একটিতে সে পাবে চার ভাঁজ দেওয়া একটুকরো কাগজ। বাকি পকেটগুলো একেবারেই ফাঁকা। কুদ্দুস ভিজে লেগে যাওয়া কাগজের ভাঁজগুলো সাবধানী হাতে খুলে ফেলতে সক্ষম হবে। আর কালি ছড়িয়ে পড়া গোটা গোটা অক্ষরগুলো তার স্বাক্ষরজ্ঞান দ্বারা থেমে থেমে পড়ে যাবে--
অন্ধকার উপদ্রƒত শহর এক-
তোমাদের।
ঝিঁ ঝিঁ পোকার অনুপস্থিতিতে প্রেতসঙ্কুল।
ভয়ঙ্কর সব কুঁজেরা চেপে বসেছে যুবতীদের
কাঁধে ও পিঠে, বন্ধ হয়ে গেছে কিশোরীর বেণীর দোল
-অতিক্রান্ত সাইত্রিশ বছর।
অতপর;
ষাড় আর মোরগের দুর্দান্ত লড়াই শেষে
নিঃসঙ্গেরা একে একে জড়ো হয়েছে
স্রোতহীন কালো-রুক্ষ্ম নদীটার দুই পাড়ে,
ডানে ও বায়ে
অপেক্ষায় আছে একটি পূর্ণচাঁদের--
তারা জানে;
একসময় তাদের অভ্যস্ত অপেক্ষা শেষ হবে
এবং তারা
ফিরে যাবে। অরক্ষিতই থেকে যাবে
মৃত্যু’র চৌকাঠ।
‘কীরে হালায় বিড়বিড় করতাছোস? কাফনডা ধর!’ মিজানুরের খেকিয়ে ওঠা গলায় কুদ্দুস সচকিত হয়ে উঠবে। কাগজখানাকে হাতের তালুতে মুড়ে দলা পাকিয়ে লুঙ্গির ট্যাকে গুজে নিয়ে মিজানুরের নির্দেশ অনুযায়ী বুক চেরা লাশটির মাটিতে ঠেকে থাকা নিথর পা দুটো টেনে বেঞ্চের ওপর তুলে দিয়ে আস্তে আস্তে, খানিকটা দরদ নিয়ে লাশটার পরনে থাকা জিন্সের প্যান্টটার বোতাম-চেন খুলে দিগম্বর করে ফেলতে থাকবে। মিজানুর আজ একটু বেশিই উত্তেজিত। সে আবারও খেকিয়ে উঠবে, ‘বাইঞ্চোৎ তর বাপ লাগেনি? এতে আস্তে খুলতাছোস কেন? টান মাইরা নামায়া ফালা! ট্যাকে কী গুঁজলি? ট্যাকা নি?’ কুদ্দুস উত্তর দিবে, ‘ট্যাকা না। মনে হইলো একটা কবিতা। লোকটা মনে হয় কবি আছিল।’
-থাকলে আছিল, তাতে তর কী! মিজানুরের এই কথার সাথেই শেষ হবে তাদের লাশটাকে কাফনে মুড়ে ফেলার কাজ।
লাশ এবার সম্পূর্ণ প্রস্তুত! চেরা বুক আর মাথার দিকটাতে ধরবে মিজানুর, আর পায়ের দিকটাতে কুদ্দুস। ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে ক্রসিং-এর কাছাকাছি আসতে আসতে মিজানুর এবার সশব্দে আহাজারি করে উঠবে, ‘ওরে আমার ভাই, ভাই রে! তুই কেন্ মইরা গেলি?’ কুদ্দুস চেষ্টা করবে তার চোখে-মুখে একটা শোকাচ্ছন্ন ভাব ফুটিয়ে তুলতে। এবং সে খেয়াল করবে, মিজানুরের অভ্যস্ত ক্রন্দনে আজ যেন কী একটা ছন্দের পতন ঘটেছে। ঠিক হচ্ছে না! গতকাল কিংবা গত পরশুর মতো। কুদ্দুস মিজানুরের সাথে লাশটাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ক্রসিং অতিক্রম করে বা’পাশের অধিকতর জনাকীর্ণ জায়গাটাতে নিয়ে রাখবে।
লাশটা রেখে কোমরটা একটু সোজা করে দাঁড়াতেই কুদ্দুস টের পাবে সূর্যের ভয়াবহ তেজ। আর সেই সাথে সাথে নিজের ভেতরের গুলিয়ে ওঠা ভাব। মিজানুরের ক্রন্দন সবে পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা শুরু করবে। কেউ বলবে ‘আহা’ কেউ বলবে ‘উহু’! উৎসাহী একজন দাঁড়িয়ে যাবে লাশের পাশে, কুদ্দুসের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করবে, ‘কার লাশ?, কখন মরলো? কীভাবে মরলো?’ নিজের ভেতরটা গুলিয়ে যেতে থাকা কুদ্দুস কথা বলার জন্য মুখ খুলেই টের পাবে সেই নোংরা থুথুর উপস্থিতি যা ইতোমধ্যে আবারো ভরিয়ে তুলেছে তার ক্ষুধার্ত মুখবিবর। চোখ দিয়ে ইশারা করে কুদ্দুস লোকটার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নামিয়ে দিবে মিজানুরের দিকে। মিজানুরের সতর্ক কান এরই মধ্যে সে সব প্রশ্ন শুনে নিয়েছে। প্রশ্নগুলি মিজানুরের কান্নাকে আরো স্পষ্টতা দান করবে। কান্না এবার তার নিজস্ব স্বর আর ছন্দ দুটোই খুঁজে পাবে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মিজানুর বলে যাবে, ‘লাশটা তার আপন ছোট ভাইয়ের। কাজ খুঁজতে আজ চার-পাঁচ দিন হয় বরিশাল থেকে ঢাকা এসেছে। ‘আহাহা রে আমার ভাই, ভাইরে আমার...।’ মিজানুরের গল্পটা শেষ হবার আগেই জমে ওঠা জটলার সামনের দিকটা ফাঁকা হয়ে যাবে, আর সেখানে প্রকাশ্য হবে এক সুচালো বক্ষের মাঝারি উচ্চতার শ্যামাঙ্গী তরুণী। কুদ্দুস দাঁড়িয়ে দেখবে, হাতাকাটা ছোট কামিজ পরিহিতা তরুণী আরো সামনে চলে আসছে। এবং তার হাতে রক্তে মোড়ানো একটি মানব প্রত্যঙ্গ। দেখেই বোঝা যায়, এ প্রত্যঙ্গের অবস্থান মানুষের বুকের অভ্যন্তরে। কুদ্দুস কিছু একটা বুঝে উঠতে চাইবে। তবে তার আর প্রয়োজন হবে না। রক্তে মোড়ানো প্রত্যঙ্গ হাতে তরুণী তাদের সামনে এসে নিজের পরিচয় দিবে, সে পাশেরই এক বিখ্যাত সংবাদ অফিসের নিয়মিত কর্মী। এবং সে বলবে, তার হতে যেটা প্রদর্শিত হচ্ছে তা হলো মানুষের হৃৎপিণ্ড। এবং এই হৃৎপিণ্ডটা তার অতি পরিচিত। কেননা, এটা যখন সচল ছিল তখন অসংখ্যবার সে এই হৃৎপিণ্ড ওপর কান পেতে এর স্পন্দন শুনেছে। আর তাতেই ক্রসিং-এর অদূরে বুকের ভেতর থেকে উপড়ে বেরিয়ে পড়ে থাকা অচল হৃৎপিণ্ডটাকে সে ঠিকই শনাক্ত করতে পেরেছে।
আর খুব বেশি কথার প্রয়োজন হবে না। সমেবেতদের কেউ কেউ বলে উঠবে, ‘খোলো! উন্মুক্ত করো লাশের মুখ! আমরা দেখব, আর দেখবে এই তরুণী।’ এমন নির্দেশে মিজানুরের ক্রন্দন আরো বিকট রূপ ধারণ করবে। ‘আপনেরা কী কইতাছেন এইসব!’ কিন্তু মিজানুরের সে ক্রন্দন সুচালো বক্ষের তরুণীর হাতে থাকা মৃত হৃৎপিণ্ডের আবেদনের কাছে কিছুই না। দুজন ঝুকে পড়ে লাশের মুখের দিকটা উন্মুক্ত করে ফেলবে। মিজানুর প্রাণপণে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হবে। লাশের মুখ উন্মুক্ত হয়ে পড়ার সাথে সাথেই তরুণীর কালো দুটি চোখ ঘোর বর্ষায় উন্মুক্ত জলাধারের চেয়েও যৌবনময় হয়ে উঠবে।
এ পরিস্থিতিতে সমবেত পথচারীদের মধ্য থেকে কয়েকজন উত্তেজিত হয়ে, ‘শালা বদমাস! লাশের কারবারি!’-বলে তেড়ে আসবে কুদ্দুস আর মিজানুরের দিকে। তাদের কাঁধে-পিঠে কয়েক ঘা বসাতেই অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ সদস্যেরা ক্রিয়াশীল হবে। ‘ছেড়ে দিন! আমাদের হাতে দিয়ে দিন’ বলে টানাটানির এক ফাঁকে মিজানুর এবং কুদ্দুস দুজনেই নিজেদের মুক্ত করে দুদিকে দৌঁড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হবে। সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে মিজানুর কোথায় যাবে তা এখন আর আমরা জানতে পারবো না। তবে কুদ্দুস ক্রসিং-এর আশপাশ সদর রাস্তার দুপাশের বিশাল সব ভবনের নিচে ঘুরে-ফিরে নিজের ঠোঁট কামড়ে হাত-পায়ের বিকট খিচুনি সহ্য করে নাক-মুখ দিয়ে লালা ঝরিয়ে সন্ধ্যায় আরো একবার খালার ঝুপড়ি হয়ে একেবারেই ব্যর্থ মনোরথে রাতের প্রথম প্রহরে নিজের ঝুপড়িতে ফিরে আসবে। ঝুপড়ির মুখের চটের বস্তার পর্দা সরাতেই রান্না করা গরুর গোস্তের সুঘ্রাণ এসে বাড়ি খাবে কুদ্দুসের নাকে-মুখে। প্রথমে সে প্রাণ ভরে কিছুক্ষণ ঘ্রাণ শুকবে। তারপর কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ভাববে, ‘এ ঘ্রাণ পাশের কোনো ঝুপড়ি থেকে আসছে না-তো? টিমটিমে লণ্ঠনের আলোয় চোখ রগড়ে ভেতরের চাটাইয়ের কাছে গিয়ে বসতেই তার সকল সন্দেহ কেটে যাবে। খাবারের আয়োজন দেখে এক মুহূর্তে নিজের ঝুপড়িটাকে তার সপ্তম স্বর্গ বলে মনে হবে। একটাতে বেগুন আর ছোট মাছের চচ্চড়ি, পাশেরটাতে ঘন মুগ ডাল, মাঝেরটাতে গরুর গোশতের ভুনা। ভাত দিয়ে তখনও ধোয়া উড়ে যাচ্ছে। আহ! এতসব ‘পাইলো কই চুতমারানি’। এসব ভাবতে ভাবতে সে মনে করবে বৌটাকে একবার ডেকে কাছে বসিয়ে একসাথে খাবে। এমন ভাবনা থেকে কুদ্দুস ‘মালেকা’, ‘মালেকা’ বলে চিৎকারও দিবে কয়েকটা। তবে মালেকা এই মুহূর্তে আর ফিরবে না।
সারাদিনের অনাহার, উপরন্তু পাবলিকের হাতের উত্তম-মাধ্যম ইত্যাদির তাড়নায় কুদ্দুস আর অপেক্ষা করবে না। পাশ থেকে চকচকে টিনের থালাটি টেনে বের করে তাতে উপর্যপুরি ভাত আর গরুর গোশতের ঝোল ঢেলে নিয়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকবে সে। খাওয়ার মাঝ পর্যায়ে তার আবারো মনে পড়বে মালেকার কথা। সে যা-ই বলুক না কেন, মালেকা কিন্তু রাঁধে বড় চমৎকার, সকালে হয়তো সত্যিই লবণ ছিল না। আর মালেকার হাতে ছিল না লবণ কেনার মতো পয়সা। তা-না হলে লবণ ছাড়া সে লালশাক রাঁধতে যাবে কেন? খাওয়ার শেষ পর্যায়ে একবার তার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে একটা ছোট হাহাকার তৈরি হবে। ‘কই যে গেল হারামজাদিটা!’ ভাতের শুন্য থালাটা ঠেলে সরিয়ে বা’পাশে রাখা এলুমিনিয়ামের ভরা কলসিটার দিকে হাত বাড়াবে কুদ্দুস। কালো ঠাণ্ডা পানি দিয়ে একেবারে ভরা কলসিটা। দুহাত দিয়ে টেনে তুলবার আগে একবার কলসির পানির দিকে তাকাবে সে। কলসিটাও আজ যেন অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল ঠেকবে তার কাছে। হয়তো ঝামা দিয়ে ঘঁষে মালেকা আজ তার ঘরের সকল বাসন-কোসন এমন চকচকে পরিষ্কার করে রেখেছে। লণ্ঠনের আলো আঁধারিতে কলসির কালো জলে কার যেন একটি অস্পষ্ট মুখ দেখা যাবে। কুদ্দুসের মনে হবে মালেকা তার বিড়াল সদৃশ নিঃশব্দ পায়ে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। পেছন ফিরলেই হাসি হাসি মুখ করে বলবে, ‘খাইছো তো পরান ভইরা? এইবার শান্ত হয়া ঘুমাও!’ এই মুহূর্তে কুদ্দুসের ভেতরে আরো একটি অচেনা অনুভূতি দোল খাবে, যা একটি ছোট্ট অভিমান বলে প্রতিভাত হতে পারে। কুদ্দুসের খানিকটা রাগও হবে ভেতরে ভেতরে। পানির কলসিটা তুলে মুখের ওপর উপুড় করে ধরতেই ঝপ করে একগাদা বেয়াড়া পানি তার মুখবিবর ভরে দিয়ে ক্লান্ত শরীরটা বেয়ে নিচে নেমে যাবে। কলসি নামিয়ে পিছন ফিরে কুদ্দুস দেখবে কেউ নাই সেখানে। ক্লান্ত অভিমানাহত ক্ষুব্ধ অবসন্ন আহারপরিতৃপ্ত কুদ্দুসের দুই চোখের পাতায় নেমে আসবে অপ্রতিরোধ্য ঘুমের স্রোত। বিছানায় শুয়ে কুদ্দুস আরো কিছুক্ষণ জেগে থেকে মালেকার জন্য অপেক্ষা করতে চাইবে। কিন্তু বাধ ভেঙ্গে বানের গতিতে ছুটে আসা ঘুম তাকে আর জেগে থাকতে দেবে না।
-হারামজাদি! এই লাল টুকটুকয়্যা শাড়ি পাইলি কই?
-কেন? মনে নাই, তুমিইতো কিইন্যা দিলা।
-আমি? কবে যেন্? আর ঠোঁট ভইরা এত লাল রং কিয়ের? লিপস্টিক দিছসনি?
-না! লিপস্টিক না। চুন আর খয়ের দিয়া একখান পান খাইছি।
-ভালা করছোস! হেই দিন রাইতে যেন্ কী কইলি?
-কী কইলাম!
-কেন? মনে নাই?
-আছে তো! মনে থাকবো না কেন? এক কথা বারাবর মুখে কইতে শরম লাগে।
-আইচ্ছা! তো তুই আবার কই যাইতাছোস্? এই রাইতে।
-কেন তরকারি টোকাইবার যাই।
-যাইছ না। শুন! শুন!
গোঙাতে গোঙতে ঘাম জরজর শরীরে বিছানায় লাফিয়ে উঠে বসবে কুদ্দুস। কোথায় মালেকা? ঘরতো যেমন ছিল তেমনই আছে। তাহলে কি রাতে আর ফেরেনি সে? না-কি ফিরেছিল। ঘুমিয়েওছিল কুদ্দুসের পাশে, তাকে বেঘোরে ঘুমুতে দেখে আর ডাকে নাই হয়তো সারারাত। সকালেই হয়তো বেরিয়ে গেছে কোনো কাজে। এদিক সেদিক তাকিয়ে ঝুপড়ির মুখ থেকে মাথা বের করে কুদ্দুস বুঝতে পারবে, বেলা বেশ খানিকটা হয়ে গেছে। কলসি উপুড় করে খানিকটা পানি গলায় ঢেলে বেরিয়ে আসবে কুদ্দুস। সময় বোঝার জন্য ওপরে তাকালে তার চোখ ঠিকরে আসবে গনগনে সূর্যের তেজদীপ্ত রশ্মির ধাক্কায়। চোখ নামিয়ে খানিকটা সময় সে সামনে কেবল গোল গোল সোনালি রংয়ের ডিম দেখতে পাবে। এ দশা কাটাবার জন্য দুহাতে চোখ চেপে রেল লাইন ছেড়ে পাশে এসে দাঁড়াবে একদণ্ড। তারপর আবার উদ্দেশ্যহীনভাবেই হেঁটে চলবে ক্রসিং-এর দিকে। হাঁটতে হাঁটতে সে ভাববে, এভাবে আর চলে না! যে করেই হোক এই মাসের মধ্যেই সে একখানা ভ্যান কিনে ফেলবে। তারপর অবস্থাটা একটু ফিরলেই এই জায়গাটা ছেড়ে বেড়িবাঁধের দিকে চলে যাবে মালেকাকে নিয়ে।
কাছাকাছি গিয়েই কুদ্দুস দেখবে মিজানুর একটি মাথাবিহীন কিম্ভুত ধড় কাফনে ঢেকে সামনে নিয়ে কেঁদে চলছে অবিরাম। লাশটার কাছাকাছি পৌঁছতেই কুদ্দুসের পায়ের জোর পড়ে যাবে। ধপ করে মিজানুরের পাশে বসে পড়তেই মিজানুর তাকে বলবে, ‘শালা কই থাকস? তর বউ রেলের পাটিতে মাথা দিছে সেই শ্যাষ রাইতে, আর তুই আইছোস অক্ষণ? কুদ্দুসের কাছে সবকিছুই কিছুক্ষণ আগে দেখা স্বপ্নের মতো লাগবে। কুদ্দুস বিশ্বাস করতে চাইবে না মিজানুরকে। গতকালের সেই কিশোরীর মতোই মুখটা শক্ত করে সে মিজানুরকে বলবে, ‘মুখটা খোল! আমি ওর মুখখানা দেখবার চাই।’
মুখ দেখবি কেমনে? মাতাই নাই। ওই যে ওইহানে ছড়াইয়া রইছে।’ বলে মিজানুর অদূরে রেল লাইনের ওপর ছড়িয়ে থাকা রক্ত মগজ আর চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়া মাথার অস্থির ভগ্নাশংগুলোকে নির্দেশ করবে। সেদিকে একনজর তাকিয়েই কুদ্দুস চোখ ফিরিয়ে নিবে। শরীরের সকল শক্তি হারিয়ে পেশিগুলো থরথর করে কাঁপতে থাকবে তার। মাথা নিচু করে মুণ্ডহীন কাফনে মোড়া শরীরটার ওপর হাত রেখে বসে থাকবে কুদ্দুস। গতকাল শত চেষ্টা করেও মুখে এতটুকু শোক সে জমাতে পারেনি। আর আজ, কুদ্দুস টের পাবে তার অজ্ঞাতেই চোখদুটো অবাধ্য হয়ে ভিজে উঠছে। কান্না থামিয়ে মিজানুর আবার বলবে, ‘দুঃখ করিস না কুদ্দুস! যা হবার তা-তো হইয়াই গেছে। ট্যাকা পড়তাছে ভালাই, একটা সুন্দর দেইখা এম্বুলেন্স ভাড়া কইরা ওর লাশটা তুই দ্যাশের বাড়িত লইয়া যাইস। দরকার লাগলে আমি লগে যামুনে। আর আপাপত: এই ট্যাকাগুলো ল! খালার ঝুপড়ি থেইকা ঘুইরা আয়। মাথা ঠাণ্ডা হইবো।’ বলে মিজানুর কয়েকটা একশ টাকার নোট গুঁজে দেবে মিজানুরের হাতের মধ্যে।
কুদ্দুস এটা সেটা ভেবে কিছু ঠাওর করে উঠতে না পেরে টলায়মান পায়ে খালার ঝুপড়ির দিকে এগিয়ে যাবে। ঝুপড়ির মুখের চটের দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে কুদ্দুস দেখবে, গতকাল মরে যাওয়া যুবককবি ও তার বন্ধুদের বসে থাকার জায়গাটা আজ ফাঁকা। পেছনের টিন কড়াৎশব্দে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করবে খালা। কদ্দুস তার মুঠির মধ্যে থাকা একশ টাকার নোটগুলো মেলে ধরবে খালার সামনে। হাত বাড়িয়ে খালা সেগুলো গ্রহণ করে নিজের মুখে একটা শোক শোক ভাব ফুটিয়ে তুলে কুদ্দুসের হাতে কয়েকটি পোটলা দিয়ে রাংতা আগুন ইত্যাদি খুঁজতে খুঁজতে বলে যাবে, ‘তর বউডা বড় ভালা মাইয়া আছিল রে কুদ্দুস। কেডা জানে মনের মইদ্যে কী জমছিল! আহারে বেচারি! খালার হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়ার গতিতে খপ করে প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলো নিয়ে বসে যাবে কুদ্দুস। তিনটি পোটলা একসাথে রাংতার ওপর ঢেলে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে খালা কিংবা খালার বচন কোনোটার দিকে এতটুকু খেয়াল না করে কুদ্দুস একটি পেতলের পয়সা গুঁজে দেবে তার দুইপাটি হলুদ-কালো দাঁতের ফাকে। মুহূর্তেই পোটলাগুলো ধোয়া হয়ে ঢুকে যাবে কুদ্দুসের মুখের পাইপ বেয়ে ফুসফুসের গভীরে। ভেতর থেকে একটা তীব্র বমিভাব বেরিয়ে আসতে চাইবে তার নাড়ি-ভুড়িসহ। মুখ ভরে ওঠা দুর্গন্ধযুক্ত থুথু নিজের শরীর লাগোয়া জায়গাটাতে উগরে দিয়ে পানি ভরা চোখে খালার দিকে চেয়ে বলবে ‘মাল আর নাই খালা?’ -‘
আছে! আছে রে ব্যাটা, তর যত ইচ্ছা খাইতে থাক! ট্যাকার কথা ভাবিস না। খায়্যা মাথাডা ঠান্ডা কর’’ বলে আরো কয়েকটি কাগজের গুটলি তার দিকে ছুড়ে দেবে খালা। আগুনের তা’ বাড়িয়ে দিয়ে টানতে ভুলে যাবে কুদ্দুস। রাংতার ওপর জ্বলে জ্বলে কালো তরল আর ধোঁয়া হয়ে হেরোইনের উড়ে যাওয়া দেখবে সে। হয়তো উড়ে যাওয়া ধোঁয়ার মধ্যে মালেকার চূর্ণ হয়ে যাওয়া মুখটাকে খুঁজে ফিরবে সে তখন। খালা সেটা লক্ষ্য করে কুদ্দুসের কাছে এসে বসবে। পিঠে হাত রেখে বলবে, ‘থাউক ব্যাটা আমার, আর দরকার নাই। অখন বাইরে যা! গিয়া দেখ কেমনে কী করবি। ওরে কী এইহানে কোথাও দাফন করবি? না-কি দ্যাশে নিয়া যাইবি?’ কুদ্দুস সে সবের কোনো উত্তর দিবে না। টলতে টলতে খালার ঝুপড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে সেই একই রেল লাইন ধরে হাঁটতে থাকবে সে। কয়েক পা হেঁটে এগুতেই পায়ের স্যান্ডেল আটকা পড়বে পাতের নিচে শোয়ানো গর্জনের ফাঁকে। পা টেনে তুলতে গিয়ে দুটো পাতের মাঝামাঝি মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে সে। দূর থেকে ধেয়ে আসা রেলের টানা হুইসেল ভেসে আসবে।
লেখক পরিচিতি
খালিদ মারুফ
জন্ম ১৯৮৫ সালের ১০ আগস্ট , বাগেরহাট জেলার বেশরগাতী নামক এক সংঘাতপ্রবণ গ্রামে। পুরো কৈশোর আর যৌবনের কিয়দংশ কেটেছে নড়াইল-গোপালগঞ্জে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিভাগের ছাত্র হিসেবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে বাংলা একাডেমিতে কর্মরত আছেন।
উপরন্তু মাতৃসম শাশুড়ির সাথে অযাচারি সম্পর্ক স্থাপনের বারংবারের ঘোষণা থেকে তাকে নিবৃত্ত করতে, দৈবও তার গলা চেপে ধরতে পারে। এমনটা ভেবে নেওয়াও অসুবিধার নয়। তৃতীয় দফায় কুদ্দুস নিশ্চয় একই বাক্য আবারও উচ্চারণ করতে চেয়েছিল। তবে কাশির দমক আর মুখ ভর্তি জমে ওঠা থুথুতে জিহ্বার ব্যবহারে অসমর্থ হয়ে অধ:উচ্চারিত ছোট ছোট কয়েকটি গালি দিয়ে তাকে থেমে যেতে হবে।
কুদ্দুস এ গল্পে শুধুই কুদ্দুস। কুদ্দুস কিছুতেই আব্দুল কুদ্দুস, মো: কুদ্দুস আলি, কুদ্দুস মণ্ডল, কুদ্দুস বেপারি-এর কোনোটাই না। কেননা, নিকট অতীতে তার চারপাশের কেউ কখনই তার পুরো নাম জানতে চায় নাই। এমনকি, এই যে অসংখ্যবার পুলিশ তাকে আটক করেছে, জেল-হাজতে পাঠিয়েছে, আবার ছেড়েও দিয়েছে-- এই অসংখ্যবার আটক করা এবং ছেড়ে দেবার পুরো প্রক্রিয়ায় পুলিশের লোকেরা তাদের খাতায় লেখার প্রয়োজনেও কুদ্দুসের পুরো নামটি জানতে চায় নাই। এ কারণেই কুদ্দুস কেবলই কুদ্দুস।
এই মুহূর্তে উপর্যুক্ত ভঙ্গিতে বসে থাকা কুদ্দুস তার গাল ভরে জমে ওঠা সাদা থুথু নিজের দুপায়ের ফাকায় উগরে দেবে। নিয়ন্ত্রণহীন একগাদা থুথুর প্রধান অংশ গিয়ে পড়বে ইটের খোয়া, পাথরের টুকরো আর কালো মাটিতে তৈরি সলিং-এর ওপর ছড়িয়ে থাকা তার পরনের নোংরা লুঙ্গিটার নিচের অংশে। কোলের উপর জমে থাকা লুঙ্গির মাঝের অংশ ঝাকি দিয়ে থুথু ঝরাতে গেলে তার খানিকটা এবার ছিটকে এসে লেগে যাবে তার ডান হাতের পাঞ্জার পেছন পাশে। দু’এক ফোটা গিয়ে লাগবে তার চোয়ালেও। এরই মধ্যে ঝুপড়ির মুখে, অর্ধপোড়া প্রায় ভিজে একখণ্ড লাকড়ি হাতে প্রতিবাদ করে উঠবে তার স্ত্রী, মালেকা। ‘আমারে করার মুরোদ নাই তর, আমার মায়েরে করবি কেমনে? শালা বাইনচোৎ হিরোঞ্চি।’ এতক্ষণ ঝগড়া চলছিল ঘরে ফুরিয়ে যাওয়া তেল-নুন আর কুদ্দুসের অকর্মণ্যতা নিয়ে। শীত কেটে গিয়ে ফাল্গুনের মাঝামাঝি আজকের এই সকালে কুদ্দুস ও মালেকার ঝগড়াটা শুরু হয়েছিল মুলত লবণহীন লালশাক ভাজিকে কেন্দ্র করে।
শেষ রাতে সবজি ভর্তি একের পর এক বিশালাকায় সব ট্রাক এসে দাঁড়ায় তাদের সারিবদ্ধ ঝুপড়িগুলোর দেয়ালের পেছনে। রাতের প্রথম অংশে উপর্যুপরি হেরোইন নিয়ে কুদ্দুস যখন বেঘোরে ঘুমায়, মালেকা তখন অন্যান্য মহিলাদের সাথে ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে কাঁচাবাজার পট্টিতে। ট্রাকের ফাঁকা আর শক্ত করে সেলাই দিয়ে বাঁধা বিরাট সব বস্তার ফুটো দিয়ে ঝরে পড়া যে সকল বেগুন পটল কাঁচামরিচ শসা গাজর ভেঙ্গে-ফেটে সাহেবদের ব্যাগে ওঠার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে সেসব তারা খুটে নেবে। তার থেকে বাছাই করা কিছু সবজি তারা বিক্রি করবে। তাতে কম করে হলেও দুই কেজি, কোনো কোনো দিন তিন কেজি চালও কেনা যায়। বাকিটা তারা তোলে তাদের নিজেদের চুলায়। তবে শুধু চাল আর সবজিতেই তো আর খাওয়া হয় না। খেতে বসলেই, সে যেমনই হোক, কোনো এক প্রকারের মাছ কুদ্দুসের চাই-ই-চাই। সেক্ষত্রে চাল না হয় লাকড়ি আর পানি দিয়ে ফুটিয়ে ভাত তৈরি করে ফেলা সম্ভব। বাকিটা? মাছ-তরকারি সেসব তো রান্না করা চাই! আর রান্নার জন্য চাই তেল-নুন-হলুদ, আরো সব রসনা সামগ্রী, যা কিনতে চাই নগদ টাকা। নগদ কিছু পয়সা যে কুদ্দুস কামায় না ঠিক তা-ও না। মিজানুরের সাথে দুপুর কি বিকেল পর্যন্ত ক্রসিং-এ দাঁড়িয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে কেঁদে-কেটে যা পাওয়া যায় তাতে তার এক-দুই পুরিয়া হেরোইন ঠিকই যোগাড় হয়ে যায়।
প্রতিদিনের মতো আজও বেলা দশটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে খেতে বসেছিল কুদ্দুস। আজকের সকালে সে বসেছিল লালশাকের ভাজি আর গতরাতের এক থাল ভাত নিয়ে। একটু নেড়ে চেড়ে বৃহৎ আকৃতির একটি গ্রাস মুখে পুরতেই মেজাজটা খিচড়ে যায় তার। লাল শাকের ভাজিটা হয়েছে একেবারেই লবণ ছাড়া। মৃদু অভিযোগটা তুলতেই ক্ষেপে যায় মালেকা, ‘লবণ কি আমি আমার হোগা দিয়া বাইর করুম? কয় বস্তা লবণ কিন্যা রাখছেন সোনার চান?’ স্ত্রীর মুখে এমন শ্লেষাত্মক কটাক্ষ শুনে কারই বা মেজাজ ঠিক থাকে। ভাতের থালা ছুড়ে দিয়ে বাইরে এসে, পাছা শূন্যে তুলে বসে, বউয়ের একের পর এক তীর্যক কথার জবাব দিয়ে যাচ্ছিল কুদ্দুস।
উদ্ভূত অবস্থায় মালেকা যখন তার পৌরুষ নিয়ে কথা তুলবে তখন পরিস্থিতি একেবারেই গুলিয়ে যাবে। ঠোঁট-মুখ আর হাতে লেগে যাওয়া থুথু মোছার কথা ভুলে গিয়ে লাফিয়ে ঝুপড়ির দরজায় চলে আসবে কুদ্দুস। মালেকার চুলের মুঠি ধরে হাতের আধপোড়া লাকড়িটা ছিনিয়ে নিয়ে কয়েক ঘা বসিয়ে দেয়ার পরও মালেকা যখন হাউমাউ করে কেঁদে উঠবে না, তখন তার মেজাজ আরো চড়ে যাবে। লাকড়ি ছুড়ে দিয়ে এবার সে হাত চালাবে। কয়েকটা কিল ঘুষি বসাতেই বেচারি এবার কুপোকাত হয়ে বাবাগো-মাগো বলে লুটিয়ে পড়বে। লুটিয়ে পড়ার পর কুদ্দুস সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে লুঙ্গির গিট বাঁধতে-বাঁধতে মালেকার বুকে-পেটে লাথি বসাবে পরপর কয়েকটা। এবারে তার কান্না থেমে যাবে। লাকড়ির পিটুনি, কিল-ঘুষির দুমদাম শব্দ, মালেকার ভূমিতে আছড়ে পড়া আর কান্নার শব্দ শুনে পাশের ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে আসবে অশিতিপর নিঃসঙ্গ ভিক্ষুনি। কাঁপা-কাঁপা গলায় কুদ্দুসকে ধমক দিতেই কুদ্দুস আর কথা বাড়াবে না।
জোর পায়ে রেললাইন ধরে সোজা এগিয়ে যাবে খালার ঝুপড়ির অভিমুখে। যেতে যেতে জামার পকেট-লুঙ্গির খুট হাতড়াবে কয়েকবার, টাকা-কড়ির কোনো নাম-গন্ধও সে খুঁজে পাবে না। উর্ধ্বশ্বাসে হাঁটতে থাকা কুদ্দুসের লুঙ্গির গিটটা তখন আবারো নড়বড়ে হয়ে উঠবে, হাঁটতে হাঁটতেই সে লুঙ্গির গিঁট বাঁধবে পুনরায়, আরো শক্ত করে। গিঁট বাঁধতে গিয়েই তার মনে পড়বে মালেকার কথা। তিন-চার দিন পূর্বের একরাতে, চ্যাপাশুটকির ঝাঁঝাঁলো ভর্তা আর টকবেগুনের গাঢ় ঝোলে ভালোরকম উদরপূর্তির পর সে শুয়ে পড়েছিল। আলো নিবিয়ে মালেকা তার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়তেই নিজের মধ্যে একধরনের উত্তেজনা অনুভব করেছিল কুদ্দুস। এবং সে হাত তুলে দিয়েছিল মালেকার উরুর উপর। হাসি মুখে সে হাত সরিয়ে দিতে দিতে মালেকা তাকে জানিয়েছিল, সে গর্ভিনী। এনজিওর এক আপা তাকে জানিয়ে গেছে, এখন থেকে পরবর্তী দুই-তিন মাস সহবাস করা নিষেধ। সঙ্গমে বাধাপ্রাপ্ত হলেও একটা সুখ-সুখ অনুভূতি নিয়ে কুদ্দুস সেদিন ঘুমিয়ে পড়েছিল। এসব ভাবতে গিয়ে রেল লাইনের মাঝে ছড়িয়ে থাকা একটি অপেক্ষাকৃত বৃহদাকার পাথরে হোঁচট খাবে কুদ্দুস। নিজেকে সামলে নিয়ে ভাববে, হারামজাদিটার পেটে লাথি মারা উচিৎ হয় নাই তার।
খালার ঝুপড়ির সামনে পৌঁছে বার দুয়েক এদিক ওদিক তাকিয়ে, ঝুপড়ির মুখের ছেড়া বস্তার পর্দা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিবে সে। দেখবে চার কী পাঁচ জন যুবক মোমবাতি জ্বালিয়ে গভীর আগ্রহে তাদেরই আর একজনের নখে পিষে রাংতা সোজা করা দেখছে। আর একজন আছে জটলা থেকে কিঞ্চিৎ পেছনে, ঝুপড়ির দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসা। আদুল শরীর তার, বুকের ওপর দিয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে নামছে, ফর্সা বুকে রোমের সংখ্যা তত বেশি নয়। ঝুপড়ির ভেতরটা ততটা আলোকোজ্জ্বল না হলেও কুদ্দুস সে যুবকের বুকের অভ্যন্তরে হৃৎপিণ্ডের ওঠানামা ঠিকই দেখতে পাবে। অন্যদের থেকে কিছুটা দুরত্ব নিয়ে বসে থাকলেও সে যে এদেরই কেউ তা কুদ্দুস ঠিকই বুঝতে পারবে। জলন্ত মোমবাতি ঘিরে বসে থাকা যুবকেরা তার দিকে ভ্রুক্ষেপ করবে না এতটুকু, এমনকি ভ্রুক্ষেপ করবে না সেই যুবকও, যার বুক বেয়ে ঘামের বিন্দু গড়িয়ে নামছে। কুদ্দুস মোমবাতি ঘিরে থাকাদের চোখের দিকে তাকাবার চেষ্টা করবে কয়েক বার। এবং ব্যর্থ হবে। কেউই তার আবেদনময় দৃষ্টিকে এতটুকু গ্রাহ্য করবে না। ‘খালা’, ‘খালা’ বলে মৃদু দুটি ডাক দিতেই বুকের আঁচল ঠিক করতে করতে ঝুপড়ির পেছন দিকের বেড়া কেটে তৈরি করা দরজা চড়চড় শব্দে ঠেলে ফাঁকা করে ‘খালা’ প্রবেশ করবে। এবং কপাল কুচকে কুদ্দুসের দিকে তাকাতেই মনে হবে, সে যেন কুদ্দুসের পকেটের সকল খবর ইতোমধ্যেই পেয়ে গেছে। বিরক্ত মুখে খালা কুদ্দুসকে জানাবে, ‘মাল নাই’। যা ছিল তা এই উপস্থিত যুবকদের দিয়ে দেয়া হয়েছে। এ কথা শুনে কুদ্দুসের শুকিয়ে যাওয়া গাল পুনরায় থুথুতে ভরে উঠবে। কোনো আশা নাই জেনে কুদ্দুস চটের যে দরজা ঠেলে প্রবেশ করেছিল সেই দরজা দিয়েই আবার বেরিয়ে যাবে। রেল লাইনের উপর উঠে কুদ্দুস পরবর্তী করণীয় ঠিক করে উঠতে না পেরে সোজা ক্রসিং-এর দিকে হেঁটে যেতে থাকবে।
একটু হেঁটে এগুতেই তার কানে আসবে রেল গাড়ির দীর্ঘ হুইসেল। আর তার পরপরই টানা রিরি শব্দে ইলেকট্রিক ঘন্টা বেজে চলবে, ঘণ্টা বেজে চলার শুরুতেই দুপাশের রাস্তার মুখে নেমে আসবে লৌহ প্রতিবন্ধক। যা মুলত রেলের উপর দিয়ে দুই বিপরীত দিকে পার হয়ে যাওয়া অগণিত মানুষ আর যানবাহনকে আটকে দেবে, সেখানেই। রেলের আগমন বার্তা শুনে কুদ্দুসের পায়ের গতি বেড়ে যাবে দ্বিগুণ। সে যেতে থাকবে যেদিক দিয়ে রেল আসছে সেদিকেই, অর্থাৎ মুখোমুখি। যা একই সাথে অদূরের ক্রসিং অভিমুখেও। কুদ্দুস ক্রসিং-এ পৌঁছানোর আগেই রেল গাড়িটা হুইসেল অক্ষুণ্ন রেখে মাঝারি গতিতে তাকে অতিক্রম করে যাবে। তাদের বসবাসের ঝুপড়িগুলোকে মনে হবে যেন পদদলিত করে, পায়ের নিচের মাটি কাঁপিয়ে ক্রসিং অভিমুখে জোর পায়ে হেঁটে চলা কুদ্দুসের শরীর ঘেঁষে রেল চলে যাবে সোজা উত্তর দিকে। সারাক্ষণ সরগরম হয়ে থাকা জায়গাটা মুহূর্তের জন্য কিছুটা শান্ত হয়ে আসবে। রেলগাড়িকে চলে যাবার জন্য জায়গা করে দিতে যারা লাইন ছেড়ে দাঁড়িয়েছিল তারা আবার পায়ে-পায়ে উঠে আসবে লাইনের বুকে। কুদ্দুসের দ্বিগুণ গতিতে ক্রসিং অভিমুখে হেঁটে চলা থামবে না।
কুদ্দুস পৌঁছে যাবে ক্রসিং-এর কাছাকাছি। রেল চলে যাবার সাথে সাথে দুপাশে আটকে যাওয়া অজস্র ফিটনেসহীন হর্ণসর্বস্ব গাড়ি আর রিকশা অনবসর হর্ন আর বেল বাঁজাতে থাকবে। লাইনম্যান তার কানের তালা ফেটে যাবার হাত থেকে রক্ষা করতে যত দ্রুত সম্ভব দুপাশের প্রতিবন্ধক লৌহ দণ্ডদুটিকে উঠিয়ে নেবে। ক্রসিং-এর নির্দিষ্ট জায়গাটাতে পৌঁছেই কুদ্দুসের কানে একটি মৃদু শোরগোল এসে ধাক্কা খাবে, ‘একসিডেন্ট!’ ‘একসিডেন্ট!’ কুদ্দুসের ভেতরটা মুহূর্তেই খানিকটা নড়েচড়ে উঠবে। ক্রসিং অতিক্রম করে যেতে থাকা অসংখ্য মানুষ গাড়ি আর রিকশার মাঝখানে এসে দাঁড়াবে কুদ্দুস। পায়ের নিচে ছোপ ছোপ রক্ত দেখতে থাকবে সে। হ্যাঁ, রক্তই! এবং এ রক্ত সদ্য কারো শরীর দ্বিখণ্ডিত অথবা ততধিক খণ্ড পরিণত করে চলে যাওয়া রেলগাড়িটার চাকার নিচ দিয়ে আসা রক্ত। এখনো জমাট বাঁধে নাই। কুদ্দুস গাড়ি আর রিকশার মাঝে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজে ফিরবে। ক্রসিং-এর পশ্চিম পাশে যথেষ্ট নির্বিকারভাবে কয়েকজন নীল পোশাকের পুলিশকে সে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবে। তাদের দুজন আশপাশের অসহ্য শব্দযন্ত্রণাকে তুচ্ছ করে কানে মুঠোফোন লাগিয়ে গভীর আলাপে মগ্ন। বাকিরা হেঁটে যাওয়া নারীদের বুকের ওপর থেকে সরে যাওয়া ওড়নার দিকে তাকিয়ে হাসবে নিরুদ্বেগে। কুদ্দুস তাদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে পুনরায় তাকাবে নিজের পায়ের দিকে তারপর সে চোখ তুলে তাকাবে সমদূরত্বে বয়ে যাওয়া রেলের দুটি পাতের সীমার দিকে। পাটির ওপরে কোনো রক্ত দেখতে পাবে না সে। রক্ত কেবল দুইটি পাটির মাঝে পাথর আর কাঠের রাস্তাটার ওপর। তাহলে? কীভাবে ঘটলো ঘটনাটা। আর লাশটাইবা কই? যা হতে পারে অভুক্ত ও হেরোইন তৃষ্ণিত কুদ্দুসের আজকের অবলম্বন। তাঁর একমাত্র বন্ধু মিজানুর গেল কোথায়? অবধারিতভাবে তারই তো থাকবার কথা ছিল এখানে। ঠায় দাঁড়িয়ে এসব ভাবতে গিয়ে কুদ্দুস লক্ষ করবে পার হয়ে যাওয়া একাধিক গাড়ির দরজা দিয়ে কল্লা বাড়িয়ে হেল্পারগণ কাকে যেন তীব্র স্বরে গালিগালাজ করে যাবে। ক্ষণিকেই সে আবিষ্কার করবে, এই গালিগালাজের ডালি তাকেই নিবেদন করা হচ্ছে। কুদ্দুস বুঝতে পারবে সে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, পায়ে-পায়ে সরে এসে ক্রসিং-এর পুব পাশে দাঁড়াতেই কেউ একজন তার হাত ধরে হেচকা টানে অপেক্ষাকৃত ঢালু জায়গাটার আরো নিচে নামিয়ে নেবে। কুদ্দুস দেখবে লোকটা তার বন্ধু মিজানুর। লুকোনো গলায় মিজানুর তাকে বলবে, ‘এই দিকে আয়, লগে আর কেউ নাই, আমার লগে হাত লাগা! বেলা দুইটায় ওইপাশের পুলিশগুলানের ডিউটি শ্যাষ হইবো। হ্যাগোর লগে কতা হইছে। তার আগ পর্যন্ত যতটা পারা যায় কলেকশন কইরা নিতে হইবো।’ মিজানুরের সাথে কুদ্দুস পানি শুকিয়ে যাওয়া সরকারি ডোবার ঢালে নির্মিত পরিত্যক্ত ঝুপড়িটার দিকে এগিয়ে যাবে। এই ঝুপড়িটা যথেষ্ট আড়ালে অবস্থিত। কেউ এখানে না এসে শুধু চোখ দিয়ে দেখতে পারবে না এখানে কী হচ্ছে!
একটু দূর থেকে কুদ্দুস দেখবে রক্তে বুক থেকে মাথা পর্যন্ত ভেজা একটা নিথর দেহ লম্বালম্বি পড়ে আছে বাশের বেঞ্চের উপর। দুটি অক্ষত পা জিন্সের প্যান্ট জড়ানো অবস্থায় দুদিকের মাটি স্পর্শ করে একই ভঙ্গিমায় পড়ে আছে। রক্ত ছাড়া দেখলে মনে হবে ক্লান্ত কেউ এই আড়ালে বেঞ্চটাকে ফাকা পেয়ে ঘুমিয়ে নিচ্ছে খানিকটা। মিজানুর বলে যাবে, ‘আর কইস না। সক্কাল থেইকা খাড়ায়া আছি, মাগার কোনো লাশের খবর নাই। তিন তিনডা ট্রেন গ্যাছেগা এর মইদ্যে। রাইতে তো গ্যাছে চাইরডা। ওর হাঁটা দেইখ্যা দূর থেইকাই বুঝবার পারছি হালায় শুইবো ট্রেনডার নিচেই। হেই কতা ভাবতেই ভাবতেই হালায় শুইয়া পড়ছে ট্রেনডার সোজাসুজি। ট্রেন যাইতে যেই সুময়ডা। আমি খাড়ায়া আছিলাম পুলিশের লগেই, দুইশ ট্যাকা হ্যাগো একজনের ট্যাকে গুইজা দিয়াই ‘বাই’ ‘বাই’ বইলা লাফায়া পড়ছি। হাত পাও মাতার কিচ্ছু হয় নাই, খালি বুকটা যা চিরছে। বগলের নিচে দুই হাত দিয়া চিল্লাইয়া কানতে কানতে টাইন্যা লইয়া আয়া পড়ছি। চোদনা পাবলিকে যেমনডা ভাবে! মনে করছে সত্যই আমার ভাই-ই হইবো। তুই এক কাম কর! বলতিডা ল! নিচ থেইকা যতদূর পারস পানি লইয়া আয়। রক্তডা ধুইয়া কাফনডা খালি মোড়াইয়া নিয়া খাড়াইতে হইবো এক্ষুনি।’ মিজানুর হাতলবিহীন একটা ভাঙ্গা প্লাষ্টিকের বালতি ছুড়ে দেবে কুদ্দুসের দিকে। কুদ্দুস সেটা নিয়ে পায়ে পায়ে নেমে যাবে ডোবায়। ডোবার পানি শুকিয়ে গেছে। একেবারে ভেতরে শুধু মশার বংশবিস্তারে যতটুকু প্রয়োজন কেবল ততটুকু পানি জমে আছে। পানির কাছাকাছি যেতেই মজা ডোবাটির শেষ পানিটুকু ঘিরে থাকা নরম কালো কাদায় স্যান্ডেলসমেত ভস্ করে দেবে যাবে কুদ্দুসের বাড়িয়ে দেওয়া ডান পা। সেটা তুলে বাম পা’টা এগিয়ে ফেলতেই আরো গভীর কাদায় তলিয়ে যাবে তার বাম পা’টাও। স্যান্ডেল কাদার বুকে রেখে কোনোক্রমে পা দুটি মুক্ত করে রোদে খাবি খাওয়া অজস্র মথযুক্ত খানিকটা কাঁদা-পানি ভাঙা বালতিটাতে পুরে নেবে কুদ্দুস। তারপর ডাঙায় এসে বালতিটাকে রেখে কাদায় ডুবে থাকা স্যান্ডেলযুগলকে মুক্ত করতে সে আবারো নিচে নামবে। স্যান্ডেল ঢেকে থাকা কালো আঠালো কাদা ধোয়ার মতো যথেষ্ট পানি ডোবায় নেই, তবুও কুদ্দুস সেই পানিটুকুর ওপরই একে একে দুটি স্যান্ডেল আছড়ে যতটা সম্ভব কাদামুক্ত করে নিয়ে কর্দমাক্ত পা দুটি ফের স্যান্ডেলে পুরে বালতি নিয়ে ফিরে আসবে আগের জায়গায়।
বালতিটা রাখতেই খেকিয়ে উঠবে মিজানুর, ‘হালায় এইহান দিয়া একটু পানি আনতে তর এতক্ষণ লাগে? যাউক, ঢাইলা দে! শইলের রক্তডা যাউক।’- বলে সাদা একটুকরো কাপড় ঠিক করতে করতে বলে যাবে, ‘দোকানি হালারে কত কই যে আমার কাফনের মতো দেহায় এমন সাদা লম্বা খানিকটা কাপড় হইলেই চলবো। না! হালায় আমারে সুন্নতি মাপেই কাপড় কাইট্টা দিবো! খাড়ায়া আছোস কেন বাইনচোৎ! পানিডা ঢাইলা দে শইলের ওপর। রক্তডা না ধুইলে হালার মাছি আয়া ভিড় করবো আর তাইলেই হালার পাবলিকে করবো সন্দো।’
কুদ্দুস মিজানুরের ধমকে আর দেরি না করে বুক চেরা লাশটার ওপর ঝপাত করে ঢেলে দেবে বালতির পানিটুকু। বেশ খানিকটা রক্ত তাতে ধুয়ে গিয়ে বেরিয়ে পড়বে লাশের চেহারা। স্পষ্ট হবে চিরে যাওয়া বুক। কুদ্দুস সেই বুক আর মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে এসে বলবে, ‘আরে! এই তো হালায় ওই লোকটা। আমি তো হ্যারে চিনি।’ মিজানুরের বিরক্তি আরো বেড়ে যাবে, ‘চিনস মানে? ক্যামনে চিনস? তর আত্মীয় লাগেনি?’ কুদ্দুস সে কথার জবাব দিবে, ‘না’। আইজকাই দেকছি, খালার ড্যারায়! তয় আমি তো হালায় আয়া পড়লাম। হ্যায় তো বইয়া আছিল। আমার আগে আইলো ক্যামনে? কাফন নিয়ে প্রস্তুত মিজানুর খেকিয়ে ওঠা গলায় বলবে, ‘তুই সেইডা কেমনে বুঝবি? হালায় হিরোঞ্চি! মরনের সময় হইছিল, আজরাইলে তার পাখনায় কইরা উড়াইয়া লইয়া আইছে। মুখ আর বুহের রক্তডা মুইচ্ছা দে তর লুঙ্গি দিয়া। কাফনডা জড়ামু। কুদ্দুস বুক আর মুখ মুছতে গিয়ে অধিকতর নিশ্চিত হবে যে, এ-ই সেই লোকটা, বুকে যার স্বল্প পরিমাণ লোম ছিল। আর এখন তা চিরে গেছে সোজাসুজি। মুছতে গিয়ে কুদ্দুস অনুভব করবে লোকটার বুকের ভেতরটা ফাঁকা। মৃত্যুর পর মানুষের বুক ফাঁকা হয়ে যায় কিনা, নাকি আগে থেকেই লোকটার বুকের ভেতরটা ফাঁকা ছিল তা ঠিক বুঝে উঠতে পারবে না কুদ্দুস। নিজের বুকের ওপর তর্জনী ও কনিষ্ঠাসহ চারটি আঙুল দিয়ে কুদ্দুস নিজের বুকের ওপর সজোরে চাপ প্রয়োগ করে বুঝে নেবার চেষ্টা করবে নিজের ভেতরের অবস্থাটা। তারপর আদুল গায়ের জিন্স পরা বুক চেরা মৃত যুবককে দেখে নেবে শেষ বারের মতো।
প্যান্টের পকেটগুলোতে কী আছে? যদি টাকা পয়সা কিছু থেকে যায় তো খুব ভালো। কুদ্দুস এখানে আর দেরি করবে না। সোজা চলে যাবে খালার ঝুপড়িতে। ‘মাল নাই! কইলেই হইলো? ট্যাকা পাইলেই চুতমারানি ব্লাউজের ফাঁক দিয়া পোটলা ঠিকই বাইর কইরা দিবো।’ কাফনের মাথার দিকটায় গিঁট বেঁধে ঠিক করতে থাকা মিজানুরের চোখের আড়ালেই কুদ্দুস বুক চেরা লাশের পরনে থাকা শক্ত জিন্সের পকেটগুলো হাতড়ে নেবে। পেছনের দুটি পকেটের একটিতে সে পাবে চার ভাঁজ দেওয়া একটুকরো কাগজ। বাকি পকেটগুলো একেবারেই ফাঁকা। কুদ্দুস ভিজে লেগে যাওয়া কাগজের ভাঁজগুলো সাবধানী হাতে খুলে ফেলতে সক্ষম হবে। আর কালি ছড়িয়ে পড়া গোটা গোটা অক্ষরগুলো তার স্বাক্ষরজ্ঞান দ্বারা থেমে থেমে পড়ে যাবে--
অন্ধকার উপদ্রƒত শহর এক-
তোমাদের।
ঝিঁ ঝিঁ পোকার অনুপস্থিতিতে প্রেতসঙ্কুল।
ভয়ঙ্কর সব কুঁজেরা চেপে বসেছে যুবতীদের
কাঁধে ও পিঠে, বন্ধ হয়ে গেছে কিশোরীর বেণীর দোল
-অতিক্রান্ত সাইত্রিশ বছর।
অতপর;
ষাড় আর মোরগের দুর্দান্ত লড়াই শেষে
নিঃসঙ্গেরা একে একে জড়ো হয়েছে
স্রোতহীন কালো-রুক্ষ্ম নদীটার দুই পাড়ে,
ডানে ও বায়ে
অপেক্ষায় আছে একটি পূর্ণচাঁদের--
তারা জানে;
একসময় তাদের অভ্যস্ত অপেক্ষা শেষ হবে
এবং তারা
ফিরে যাবে। অরক্ষিতই থেকে যাবে
মৃত্যু’র চৌকাঠ।
‘কীরে হালায় বিড়বিড় করতাছোস? কাফনডা ধর!’ মিজানুরের খেকিয়ে ওঠা গলায় কুদ্দুস সচকিত হয়ে উঠবে। কাগজখানাকে হাতের তালুতে মুড়ে দলা পাকিয়ে লুঙ্গির ট্যাকে গুজে নিয়ে মিজানুরের নির্দেশ অনুযায়ী বুক চেরা লাশটির মাটিতে ঠেকে থাকা নিথর পা দুটো টেনে বেঞ্চের ওপর তুলে দিয়ে আস্তে আস্তে, খানিকটা দরদ নিয়ে লাশটার পরনে থাকা জিন্সের প্যান্টটার বোতাম-চেন খুলে দিগম্বর করে ফেলতে থাকবে। মিজানুর আজ একটু বেশিই উত্তেজিত। সে আবারও খেকিয়ে উঠবে, ‘বাইঞ্চোৎ তর বাপ লাগেনি? এতে আস্তে খুলতাছোস কেন? টান মাইরা নামায়া ফালা! ট্যাকে কী গুঁজলি? ট্যাকা নি?’ কুদ্দুস উত্তর দিবে, ‘ট্যাকা না। মনে হইলো একটা কবিতা। লোকটা মনে হয় কবি আছিল।’
-থাকলে আছিল, তাতে তর কী! মিজানুরের এই কথার সাথেই শেষ হবে তাদের লাশটাকে কাফনে মুড়ে ফেলার কাজ।
লাশ এবার সম্পূর্ণ প্রস্তুত! চেরা বুক আর মাথার দিকটাতে ধরবে মিজানুর, আর পায়ের দিকটাতে কুদ্দুস। ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে ক্রসিং-এর কাছাকাছি আসতে আসতে মিজানুর এবার সশব্দে আহাজারি করে উঠবে, ‘ওরে আমার ভাই, ভাই রে! তুই কেন্ মইরা গেলি?’ কুদ্দুস চেষ্টা করবে তার চোখে-মুখে একটা শোকাচ্ছন্ন ভাব ফুটিয়ে তুলতে। এবং সে খেয়াল করবে, মিজানুরের অভ্যস্ত ক্রন্দনে আজ যেন কী একটা ছন্দের পতন ঘটেছে। ঠিক হচ্ছে না! গতকাল কিংবা গত পরশুর মতো। কুদ্দুস মিজানুরের সাথে লাশটাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ক্রসিং অতিক্রম করে বা’পাশের অধিকতর জনাকীর্ণ জায়গাটাতে নিয়ে রাখবে।
লাশটা রেখে কোমরটা একটু সোজা করে দাঁড়াতেই কুদ্দুস টের পাবে সূর্যের ভয়াবহ তেজ। আর সেই সাথে সাথে নিজের ভেতরের গুলিয়ে ওঠা ভাব। মিজানুরের ক্রন্দন সবে পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা শুরু করবে। কেউ বলবে ‘আহা’ কেউ বলবে ‘উহু’! উৎসাহী একজন দাঁড়িয়ে যাবে লাশের পাশে, কুদ্দুসের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করবে, ‘কার লাশ?, কখন মরলো? কীভাবে মরলো?’ নিজের ভেতরটা গুলিয়ে যেতে থাকা কুদ্দুস কথা বলার জন্য মুখ খুলেই টের পাবে সেই নোংরা থুথুর উপস্থিতি যা ইতোমধ্যে আবারো ভরিয়ে তুলেছে তার ক্ষুধার্ত মুখবিবর। চোখ দিয়ে ইশারা করে কুদ্দুস লোকটার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নামিয়ে দিবে মিজানুরের দিকে। মিজানুরের সতর্ক কান এরই মধ্যে সে সব প্রশ্ন শুনে নিয়েছে। প্রশ্নগুলি মিজানুরের কান্নাকে আরো স্পষ্টতা দান করবে। কান্না এবার তার নিজস্ব স্বর আর ছন্দ দুটোই খুঁজে পাবে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মিজানুর বলে যাবে, ‘লাশটা তার আপন ছোট ভাইয়ের। কাজ খুঁজতে আজ চার-পাঁচ দিন হয় বরিশাল থেকে ঢাকা এসেছে। ‘আহাহা রে আমার ভাই, ভাইরে আমার...।’ মিজানুরের গল্পটা শেষ হবার আগেই জমে ওঠা জটলার সামনের দিকটা ফাঁকা হয়ে যাবে, আর সেখানে প্রকাশ্য হবে এক সুচালো বক্ষের মাঝারি উচ্চতার শ্যামাঙ্গী তরুণী। কুদ্দুস দাঁড়িয়ে দেখবে, হাতাকাটা ছোট কামিজ পরিহিতা তরুণী আরো সামনে চলে আসছে। এবং তার হাতে রক্তে মোড়ানো একটি মানব প্রত্যঙ্গ। দেখেই বোঝা যায়, এ প্রত্যঙ্গের অবস্থান মানুষের বুকের অভ্যন্তরে। কুদ্দুস কিছু একটা বুঝে উঠতে চাইবে। তবে তার আর প্রয়োজন হবে না। রক্তে মোড়ানো প্রত্যঙ্গ হাতে তরুণী তাদের সামনে এসে নিজের পরিচয় দিবে, সে পাশেরই এক বিখ্যাত সংবাদ অফিসের নিয়মিত কর্মী। এবং সে বলবে, তার হতে যেটা প্রদর্শিত হচ্ছে তা হলো মানুষের হৃৎপিণ্ড। এবং এই হৃৎপিণ্ডটা তার অতি পরিচিত। কেননা, এটা যখন সচল ছিল তখন অসংখ্যবার সে এই হৃৎপিণ্ড ওপর কান পেতে এর স্পন্দন শুনেছে। আর তাতেই ক্রসিং-এর অদূরে বুকের ভেতর থেকে উপড়ে বেরিয়ে পড়ে থাকা অচল হৃৎপিণ্ডটাকে সে ঠিকই শনাক্ত করতে পেরেছে।
আর খুব বেশি কথার প্রয়োজন হবে না। সমেবেতদের কেউ কেউ বলে উঠবে, ‘খোলো! উন্মুক্ত করো লাশের মুখ! আমরা দেখব, আর দেখবে এই তরুণী।’ এমন নির্দেশে মিজানুরের ক্রন্দন আরো বিকট রূপ ধারণ করবে। ‘আপনেরা কী কইতাছেন এইসব!’ কিন্তু মিজানুরের সে ক্রন্দন সুচালো বক্ষের তরুণীর হাতে থাকা মৃত হৃৎপিণ্ডের আবেদনের কাছে কিছুই না। দুজন ঝুকে পড়ে লাশের মুখের দিকটা উন্মুক্ত করে ফেলবে। মিজানুর প্রাণপণে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হবে। লাশের মুখ উন্মুক্ত হয়ে পড়ার সাথে সাথেই তরুণীর কালো দুটি চোখ ঘোর বর্ষায় উন্মুক্ত জলাধারের চেয়েও যৌবনময় হয়ে উঠবে।
এ পরিস্থিতিতে সমবেত পথচারীদের মধ্য থেকে কয়েকজন উত্তেজিত হয়ে, ‘শালা বদমাস! লাশের কারবারি!’-বলে তেড়ে আসবে কুদ্দুস আর মিজানুরের দিকে। তাদের কাঁধে-পিঠে কয়েক ঘা বসাতেই অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ সদস্যেরা ক্রিয়াশীল হবে। ‘ছেড়ে দিন! আমাদের হাতে দিয়ে দিন’ বলে টানাটানির এক ফাঁকে মিজানুর এবং কুদ্দুস দুজনেই নিজেদের মুক্ত করে দুদিকে দৌঁড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হবে। সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে মিজানুর কোথায় যাবে তা এখন আর আমরা জানতে পারবো না। তবে কুদ্দুস ক্রসিং-এর আশপাশ সদর রাস্তার দুপাশের বিশাল সব ভবনের নিচে ঘুরে-ফিরে নিজের ঠোঁট কামড়ে হাত-পায়ের বিকট খিচুনি সহ্য করে নাক-মুখ দিয়ে লালা ঝরিয়ে সন্ধ্যায় আরো একবার খালার ঝুপড়ি হয়ে একেবারেই ব্যর্থ মনোরথে রাতের প্রথম প্রহরে নিজের ঝুপড়িতে ফিরে আসবে। ঝুপড়ির মুখের চটের বস্তার পর্দা সরাতেই রান্না করা গরুর গোস্তের সুঘ্রাণ এসে বাড়ি খাবে কুদ্দুসের নাকে-মুখে। প্রথমে সে প্রাণ ভরে কিছুক্ষণ ঘ্রাণ শুকবে। তারপর কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ভাববে, ‘এ ঘ্রাণ পাশের কোনো ঝুপড়ি থেকে আসছে না-তো? টিমটিমে লণ্ঠনের আলোয় চোখ রগড়ে ভেতরের চাটাইয়ের কাছে গিয়ে বসতেই তার সকল সন্দেহ কেটে যাবে। খাবারের আয়োজন দেখে এক মুহূর্তে নিজের ঝুপড়িটাকে তার সপ্তম স্বর্গ বলে মনে হবে। একটাতে বেগুন আর ছোট মাছের চচ্চড়ি, পাশেরটাতে ঘন মুগ ডাল, মাঝেরটাতে গরুর গোশতের ভুনা। ভাত দিয়ে তখনও ধোয়া উড়ে যাচ্ছে। আহ! এতসব ‘পাইলো কই চুতমারানি’। এসব ভাবতে ভাবতে সে মনে করবে বৌটাকে একবার ডেকে কাছে বসিয়ে একসাথে খাবে। এমন ভাবনা থেকে কুদ্দুস ‘মালেকা’, ‘মালেকা’ বলে চিৎকারও দিবে কয়েকটা। তবে মালেকা এই মুহূর্তে আর ফিরবে না।
সারাদিনের অনাহার, উপরন্তু পাবলিকের হাতের উত্তম-মাধ্যম ইত্যাদির তাড়নায় কুদ্দুস আর অপেক্ষা করবে না। পাশ থেকে চকচকে টিনের থালাটি টেনে বের করে তাতে উপর্যপুরি ভাত আর গরুর গোশতের ঝোল ঢেলে নিয়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকবে সে। খাওয়ার মাঝ পর্যায়ে তার আবারো মনে পড়বে মালেকার কথা। সে যা-ই বলুক না কেন, মালেকা কিন্তু রাঁধে বড় চমৎকার, সকালে হয়তো সত্যিই লবণ ছিল না। আর মালেকার হাতে ছিল না লবণ কেনার মতো পয়সা। তা-না হলে লবণ ছাড়া সে লালশাক রাঁধতে যাবে কেন? খাওয়ার শেষ পর্যায়ে একবার তার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে একটা ছোট হাহাকার তৈরি হবে। ‘কই যে গেল হারামজাদিটা!’ ভাতের শুন্য থালাটা ঠেলে সরিয়ে বা’পাশে রাখা এলুমিনিয়ামের ভরা কলসিটার দিকে হাত বাড়াবে কুদ্দুস। কালো ঠাণ্ডা পানি দিয়ে একেবারে ভরা কলসিটা। দুহাত দিয়ে টেনে তুলবার আগে একবার কলসির পানির দিকে তাকাবে সে। কলসিটাও আজ যেন অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল ঠেকবে তার কাছে। হয়তো ঝামা দিয়ে ঘঁষে মালেকা আজ তার ঘরের সকল বাসন-কোসন এমন চকচকে পরিষ্কার করে রেখেছে। লণ্ঠনের আলো আঁধারিতে কলসির কালো জলে কার যেন একটি অস্পষ্ট মুখ দেখা যাবে। কুদ্দুসের মনে হবে মালেকা তার বিড়াল সদৃশ নিঃশব্দ পায়ে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। পেছন ফিরলেই হাসি হাসি মুখ করে বলবে, ‘খাইছো তো পরান ভইরা? এইবার শান্ত হয়া ঘুমাও!’ এই মুহূর্তে কুদ্দুসের ভেতরে আরো একটি অচেনা অনুভূতি দোল খাবে, যা একটি ছোট্ট অভিমান বলে প্রতিভাত হতে পারে। কুদ্দুসের খানিকটা রাগও হবে ভেতরে ভেতরে। পানির কলসিটা তুলে মুখের ওপর উপুড় করে ধরতেই ঝপ করে একগাদা বেয়াড়া পানি তার মুখবিবর ভরে দিয়ে ক্লান্ত শরীরটা বেয়ে নিচে নেমে যাবে। কলসি নামিয়ে পিছন ফিরে কুদ্দুস দেখবে কেউ নাই সেখানে। ক্লান্ত অভিমানাহত ক্ষুব্ধ অবসন্ন আহারপরিতৃপ্ত কুদ্দুসের দুই চোখের পাতায় নেমে আসবে অপ্রতিরোধ্য ঘুমের স্রোত। বিছানায় শুয়ে কুদ্দুস আরো কিছুক্ষণ জেগে থেকে মালেকার জন্য অপেক্ষা করতে চাইবে। কিন্তু বাধ ভেঙ্গে বানের গতিতে ছুটে আসা ঘুম তাকে আর জেগে থাকতে দেবে না।
-হারামজাদি! এই লাল টুকটুকয়্যা শাড়ি পাইলি কই?
-কেন? মনে নাই, তুমিইতো কিইন্যা দিলা।
-আমি? কবে যেন্? আর ঠোঁট ভইরা এত লাল রং কিয়ের? লিপস্টিক দিছসনি?
-না! লিপস্টিক না। চুন আর খয়ের দিয়া একখান পান খাইছি।
-ভালা করছোস! হেই দিন রাইতে যেন্ কী কইলি?
-কী কইলাম!
-কেন? মনে নাই?
-আছে তো! মনে থাকবো না কেন? এক কথা বারাবর মুখে কইতে শরম লাগে।
-আইচ্ছা! তো তুই আবার কই যাইতাছোস্? এই রাইতে।
-কেন তরকারি টোকাইবার যাই।
-যাইছ না। শুন! শুন!
গোঙাতে গোঙতে ঘাম জরজর শরীরে বিছানায় লাফিয়ে উঠে বসবে কুদ্দুস। কোথায় মালেকা? ঘরতো যেমন ছিল তেমনই আছে। তাহলে কি রাতে আর ফেরেনি সে? না-কি ফিরেছিল। ঘুমিয়েওছিল কুদ্দুসের পাশে, তাকে বেঘোরে ঘুমুতে দেখে আর ডাকে নাই হয়তো সারারাত। সকালেই হয়তো বেরিয়ে গেছে কোনো কাজে। এদিক সেদিক তাকিয়ে ঝুপড়ির মুখ থেকে মাথা বের করে কুদ্দুস বুঝতে পারবে, বেলা বেশ খানিকটা হয়ে গেছে। কলসি উপুড় করে খানিকটা পানি গলায় ঢেলে বেরিয়ে আসবে কুদ্দুস। সময় বোঝার জন্য ওপরে তাকালে তার চোখ ঠিকরে আসবে গনগনে সূর্যের তেজদীপ্ত রশ্মির ধাক্কায়। চোখ নামিয়ে খানিকটা সময় সে সামনে কেবল গোল গোল সোনালি রংয়ের ডিম দেখতে পাবে। এ দশা কাটাবার জন্য দুহাতে চোখ চেপে রেল লাইন ছেড়ে পাশে এসে দাঁড়াবে একদণ্ড। তারপর আবার উদ্দেশ্যহীনভাবেই হেঁটে চলবে ক্রসিং-এর দিকে। হাঁটতে হাঁটতে সে ভাববে, এভাবে আর চলে না! যে করেই হোক এই মাসের মধ্যেই সে একখানা ভ্যান কিনে ফেলবে। তারপর অবস্থাটা একটু ফিরলেই এই জায়গাটা ছেড়ে বেড়িবাঁধের দিকে চলে যাবে মালেকাকে নিয়ে।
কাছাকাছি গিয়েই কুদ্দুস দেখবে মিজানুর একটি মাথাবিহীন কিম্ভুত ধড় কাফনে ঢেকে সামনে নিয়ে কেঁদে চলছে অবিরাম। লাশটার কাছাকাছি পৌঁছতেই কুদ্দুসের পায়ের জোর পড়ে যাবে। ধপ করে মিজানুরের পাশে বসে পড়তেই মিজানুর তাকে বলবে, ‘শালা কই থাকস? তর বউ রেলের পাটিতে মাথা দিছে সেই শ্যাষ রাইতে, আর তুই আইছোস অক্ষণ? কুদ্দুসের কাছে সবকিছুই কিছুক্ষণ আগে দেখা স্বপ্নের মতো লাগবে। কুদ্দুস বিশ্বাস করতে চাইবে না মিজানুরকে। গতকালের সেই কিশোরীর মতোই মুখটা শক্ত করে সে মিজানুরকে বলবে, ‘মুখটা খোল! আমি ওর মুখখানা দেখবার চাই।’
মুখ দেখবি কেমনে? মাতাই নাই। ওই যে ওইহানে ছড়াইয়া রইছে।’ বলে মিজানুর অদূরে রেল লাইনের ওপর ছড়িয়ে থাকা রক্ত মগজ আর চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়া মাথার অস্থির ভগ্নাশংগুলোকে নির্দেশ করবে। সেদিকে একনজর তাকিয়েই কুদ্দুস চোখ ফিরিয়ে নিবে। শরীরের সকল শক্তি হারিয়ে পেশিগুলো থরথর করে কাঁপতে থাকবে তার। মাথা নিচু করে মুণ্ডহীন কাফনে মোড়া শরীরটার ওপর হাত রেখে বসে থাকবে কুদ্দুস। গতকাল শত চেষ্টা করেও মুখে এতটুকু শোক সে জমাতে পারেনি। আর আজ, কুদ্দুস টের পাবে তার অজ্ঞাতেই চোখদুটো অবাধ্য হয়ে ভিজে উঠছে। কান্না থামিয়ে মিজানুর আবার বলবে, ‘দুঃখ করিস না কুদ্দুস! যা হবার তা-তো হইয়াই গেছে। ট্যাকা পড়তাছে ভালাই, একটা সুন্দর দেইখা এম্বুলেন্স ভাড়া কইরা ওর লাশটা তুই দ্যাশের বাড়িত লইয়া যাইস। দরকার লাগলে আমি লগে যামুনে। আর আপাপত: এই ট্যাকাগুলো ল! খালার ঝুপড়ি থেইকা ঘুইরা আয়। মাথা ঠাণ্ডা হইবো।’ বলে মিজানুর কয়েকটা একশ টাকার নোট গুঁজে দেবে মিজানুরের হাতের মধ্যে।
কুদ্দুস এটা সেটা ভেবে কিছু ঠাওর করে উঠতে না পেরে টলায়মান পায়ে খালার ঝুপড়ির দিকে এগিয়ে যাবে। ঝুপড়ির মুখের চটের দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে কুদ্দুস দেখবে, গতকাল মরে যাওয়া যুবককবি ও তার বন্ধুদের বসে থাকার জায়গাটা আজ ফাঁকা। পেছনের টিন কড়াৎশব্দে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করবে খালা। কদ্দুস তার মুঠির মধ্যে থাকা একশ টাকার নোটগুলো মেলে ধরবে খালার সামনে। হাত বাড়িয়ে খালা সেগুলো গ্রহণ করে নিজের মুখে একটা শোক শোক ভাব ফুটিয়ে তুলে কুদ্দুসের হাতে কয়েকটি পোটলা দিয়ে রাংতা আগুন ইত্যাদি খুঁজতে খুঁজতে বলে যাবে, ‘তর বউডা বড় ভালা মাইয়া আছিল রে কুদ্দুস। কেডা জানে মনের মইদ্যে কী জমছিল! আহারে বেচারি! খালার হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়ার গতিতে খপ করে প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলো নিয়ে বসে যাবে কুদ্দুস। তিনটি পোটলা একসাথে রাংতার ওপর ঢেলে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে খালা কিংবা খালার বচন কোনোটার দিকে এতটুকু খেয়াল না করে কুদ্দুস একটি পেতলের পয়সা গুঁজে দেবে তার দুইপাটি হলুদ-কালো দাঁতের ফাকে। মুহূর্তেই পোটলাগুলো ধোয়া হয়ে ঢুকে যাবে কুদ্দুসের মুখের পাইপ বেয়ে ফুসফুসের গভীরে। ভেতর থেকে একটা তীব্র বমিভাব বেরিয়ে আসতে চাইবে তার নাড়ি-ভুড়িসহ। মুখ ভরে ওঠা দুর্গন্ধযুক্ত থুথু নিজের শরীর লাগোয়া জায়গাটাতে উগরে দিয়ে পানি ভরা চোখে খালার দিকে চেয়ে বলবে ‘মাল আর নাই খালা?’ -‘
আছে! আছে রে ব্যাটা, তর যত ইচ্ছা খাইতে থাক! ট্যাকার কথা ভাবিস না। খায়্যা মাথাডা ঠান্ডা কর’’ বলে আরো কয়েকটি কাগজের গুটলি তার দিকে ছুড়ে দেবে খালা। আগুনের তা’ বাড়িয়ে দিয়ে টানতে ভুলে যাবে কুদ্দুস। রাংতার ওপর জ্বলে জ্বলে কালো তরল আর ধোঁয়া হয়ে হেরোইনের উড়ে যাওয়া দেখবে সে। হয়তো উড়ে যাওয়া ধোঁয়ার মধ্যে মালেকার চূর্ণ হয়ে যাওয়া মুখটাকে খুঁজে ফিরবে সে তখন। খালা সেটা লক্ষ্য করে কুদ্দুসের কাছে এসে বসবে। পিঠে হাত রেখে বলবে, ‘থাউক ব্যাটা আমার, আর দরকার নাই। অখন বাইরে যা! গিয়া দেখ কেমনে কী করবি। ওরে কী এইহানে কোথাও দাফন করবি? না-কি দ্যাশে নিয়া যাইবি?’ কুদ্দুস সে সবের কোনো উত্তর দিবে না। টলতে টলতে খালার ঝুপড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে সেই একই রেল লাইন ধরে হাঁটতে থাকবে সে। কয়েক পা হেঁটে এগুতেই পায়ের স্যান্ডেল আটকা পড়বে পাতের নিচে শোয়ানো গর্জনের ফাঁকে। পা টেনে তুলতে গিয়ে দুটো পাতের মাঝামাঝি মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে সে। দূর থেকে ধেয়ে আসা রেলের টানা হুইসেল ভেসে আসবে।
লেখক পরিচিতি
খালিদ মারুফ
জন্ম ১৯৮৫ সালের ১০ আগস্ট , বাগেরহাট জেলার বেশরগাতী নামক এক সংঘাতপ্রবণ গ্রামে। পুরো কৈশোর আর যৌবনের কিয়দংশ কেটেছে নড়াইল-গোপালগঞ্জে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিভাগের ছাত্র হিসেবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে বাংলা একাডেমিতে কর্মরত আছেন।
0 মন্তব্যসমূহ