তুহিন দাস'এর গল্প : শ্রুতিগাঁথা

পাঠক, রামসুন্দর সওদাগরের কথাই প্রথম বলি। তার মত ধর্নাঢ্য এ তল্লাটে আর কেউ নেই। সওদাগর, সওদাগরের বউ সুলতা, একমাত্র সন্তান শ্যামসুন্দর--এই তার সংসার। দাসদাসী-প্রভাব-প্রতিপত্তিতে তাদের দিন ভালোই কাটছিল। সওদাগর বেশিরভাগ সময় ভিনদেশে থাকে। দেশ-বিদেশে সওদা করে বেড়ায়। মশলা-তন্তু--আরো কতো কি! সুলতা শ্যামসুন্দরকে নিয়ে আনন্দে দিন কাটায়। খেলা করে, দু’জনে নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ায়, হাত ধরে হাঁটে। সন্তানের সঙ্গে সুলতাও প্রজাপতির পিছু পিছু ছোটে। সে কী অপরিসীম আনন্দ--তার ভাগ কাউকে দেয়া যায় না।


এক ভোররাতে বিধাতা স্বপ্ন দেখালেন:‘তোর সন্তানের বিয়ে হবে এক জেলেকন্যার সাথে। এখনই গিয়ে দ্যাখ--তোর প্রাসাদ ঘেঁষে নদীর ঘাটে ওই মেয়ে নৌকায় বসে আছে।’ সুলতার ঘুম ভেঙে গেলো। স্বপ্নের কথা ভেবে ঠোঁট উল্টালো। ভাবলো:‘শ্যামসুন্দরের বউ হবে জেলের মেয়ে? ওরা এত বড় সওদাগর! তা কি হয়?’ সুলতা নিজেকে আশ্বস্ত করে। কিন্তু এরপরও মন খারাপ, আদরের পুত্রের সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলে না, আহার গ্রহণ করে না। দাসী-বাঁদীরা চিন্তায় পড়ে--কী হল তাদের রাণীমা’র। সওদাগরও তো ভিনদেশে গেছে বাণিজ্যে।

শ্যামসুন্দরের বয়স কম হলে কি হবে, সে বোঝে তার মা’র কিছু একটা হয়েছে। মা সবসময় চিন্তিত, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আচরণ রুক্ষ। কেন? জানতে চাইলে, সুলতা পুত্রকে স্বপ্নের কথা খুলে বলে। সে বিবরণ শুনে শ্যামসুন্দর তো হেসেই খুন, বলে:‘মাগো, আমি সওদাগরের বেটা, সওদাগরের মেয়ে ছাড়া বিয়ে করবো না।’একই কথা শ্যামসুন্দর বারবার বলে। আর মা’র অহেতুক চিন্তাগ্রস্ততার কথা ভেবে হেসে গড়িয়ে পড়ে।

পুত্রের আশ্বাসে সুলতা কিছুটা স্বস্তি পায়। কিন্তু আবারও সেদিন ভোররাতে একই স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে ভাবে:‘যাই না একবার নদীর ঘাটে? দেখি সেখানে এমন কোনো মেয়ে আছে কিনা?’ সুলতা ধৈর্য্যধারণ করতে পারে না। একবার শ্যামসুন্দরের লাবণ্যময় মুখটা দেখে নিয়ে ভোরের আলো ফুটতেই রওনা দেয়। নদীর ঘাটে পৌঁছলে সত্যিই দেখতে পায় একটি ফুটফুটে মেয়ে নৌকায় একাকী বসে আছে। কৌতুহলভরে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করতে সে জানাল: হ্যাঁ, সে জেলেকন্যা--তার পিতা মাছ বিক্রি করতে গেছে।

অলৌকিক কাণ্ড! তখনই দৈববাণী হল:‘এই মেয়েই তোর পুত্রবধু সুলতা--ইহাই শ্যামসুন্দরের বিধি। মনে রাখিস সুলতা, বিধি কখনো খন্ডান যায় না।’সুলতা অবজ্ঞায়, ‘তো দেখা যাক, বিধি খন্ডান যায় কিনা’--এই বলে, ভারী বৈঠাখানা কোনোমতে তুলে জেলেকন্যার পাঁজরে সজোরে আঘাত করে। আর সেই জেলেকুমারী ছিটকে নদীতে পড়ে তলিয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় সে আত্মচিৎকার করার বিন্দুমাত্র সময় পেলো না।

এবার সুলতা বিজয়ীর হাসি হাসতে হাসতে প্রাসাদে ফিরে এলো। তার চোখে-মুখে খেলা করছে ভোরের নরম আলোরেখা। সেখানে অপরাধের কোনো ছায়া নেই।

এরপর আরো বারো বছর কেটে গেলো। সুখে-দুঃখে-হাসি-আনন্দে। এর মাঝে সওদাগর দীর্ঘ দুই বছর পরে বাড়ি ফিরে এসে শয্যাশায়ী হলেন। কঠিন অসুখে ধরলো তাকে। কি অসুখ, বড় বড় কবিরাজ-বৈদ্যরাও সনাক্ত করতে পারলো না। তিনি ঠিক করলেন, আর নয়--এবার পুত্রের বিয়ে দেবেন, এখন শ্যামসুন্দরই বাণিজ্য সামলাক। চতুর্দিকে দূত পাঠালেন। এ তল্লাটের সবচে’ বড় সওদাগরের সবচে’সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে তার রাজকুমারের মতো পুত্রের বিয়ে দেবেন। এক সময় নিঝুমপুরী হতে খবর এলো, নিঝুমপুরীর সূর্য সওদাগরই সবচে’বড় সওদাগর। আর তার কন্যা চন্দ্রতারা অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের অধিকারিণী। চন্দ্রতারার রূপের জৌলুস নাকি চন্দ্রের ন্যায় শীতল, মায়াময়ী, স্নিগ্ধ ও উজ্জ্বল। এ মেয়েই তার পুত্রবধূ হওয়ার যোগ্য। রামসুন্দর সওদাগর প্রস্তাব পাঠালেন--সঙ্গে রাশি রাশি উপঢৌকন। সূর্য সওদাগর সম্মতি দিলেন। শ্যামসুন্দর আর চন্দ্রতারার মহাধুমধামে বিয়ে হলো। এমন জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে সেকালে কেউ দেখেনি। কয়েকদিন ধরে উৎসব চললো, চললো খানাপিনা, সাজ সাজ রব।

এরপর সবার সুখে-শান্তিতে দিন কাটতে লাগলো। শ্যামসুন্দর এই প্রথম বাণিজ্যে গেছে দূরদেশে। চন্দ্রতারার দিন একাকী কাটে দেখে শাশুড়ি সুলতা পুত্রবধূর কাছাকাছি থাকে, খুনসুটি করে। একদিন চন্দ্রতারা ওর দীঘল চুলে সুগন্ধী তেল মাখছিল। চন্দ্রতারার চুল দেখলে যে কারো হিংসা হবে। কৃষ্ণ মেঘের মতো চুল নয়ন জুড়ানো ঘাড় বেয়ে নেমেছে। চুল আর সোনার পাত মোড়ানো শাড়ির ফাঁক হতে মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসছে চন্দ্রতারার দুধেআলতা রঙের গতর। যেন ধবল মাছের পেট। তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। সেদিকেই লক্ষ্য করছিল রূপার পালঙ্কে আধশোয়া সুলতা। এমন সময় খেয়াল করলো চন্দ্রতারার বাম পাঁজরে শুকনো অথচ গভীর ক্ষতের দাগ। যেন চাঁদের কলঙ্ক! ‘ওই ক্ষত কিভাবে হলো?’ সুলতা জানতে চাইলে চন্দ্রতারা বললো, সূর্য সওদাগর তার পালক পিতা। চন্দ্রতারা সেই জেলের মেয়ে যাকে সুলতা মেরেছিল, সে জলে ডুবে মরেনি, ভাসতে ভাসতে সূর্য সওদাগরের জাহাজের সামনে এসে পড়েছিল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ