এনিটা ব্রুকনারের-এর সাক্ষাতকার : ‘বড় মাপের লেখকগণ ঈশ্বরহীন বিশ্বে সন্তের মতো’

অনুবাদ: কামাল রাহমান

এনিটা ব্রুকনার: (১৬ জুলাই ১৯২৮ -- ১০ মার্চ ২০১৬) ইংরেজি সাহিত্যে ব্রিটেনের যে-কজন ঔপন্যাসিক আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে বুকারপ্রাপ্ত এনিটা ব্রুকনার অন্যতম। শিল্প-ইতিহাস রচয়িতা ও প্রাবন্ধিক হিসেবে অধিক পরিচিত হলেও ব্রুকনার Watteau (1971), The Genius of the Future (1971), Jacques-Louis David (1980) প্রভৃতি গ্রন্থের সফল লেখিকা। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা Slade Professor  হিসেবে গৌরবজনক অবস্থানে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
A start in life  গ্রন্থটি একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর প্রারম্ভ চিহ্নিত করেছিল। পরবর্তী উপন্যাস Providence প্রশংসিত হয় দুঃখময়তা ও নির্ভরযোগ্য পাণ্ডিত্য এবং উচ্চমানসম্পন্ন বুদ্ধিদীপ্ত রচনাশৈলীর জন্য। Look at Me  উপন্যাসটি অবশ্য কিছুটা বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল।

Hotel du Lac  উপন্যাসের জন্য ১৯৮৪ সনে বুকার ম্যাককোনেল পুরস্কার পাওয়ার সময় বিপুলভাবে নন্দিত হন তিনি। তাঁর প্রতিভা কখনো কখনো ভ্রান্তিমূলক। গভীর নৈপুণ্যের সঙ্গে এক উচ্চাকাঙ্খী ভাবনা ও প্রকৃতাবস্থা এবং শিল্প ও বাস্তবতার অভিনব যোগসূত্র সৃষ্টি করেন তিনি। হৃদয়ের গভীরে এক ধরনের বিদ্রোহ জাগিয়ে রেখে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। আধুনিক জীবনের কৃত্রিমতা নাড়া দেয় পাঠককে। তাঁর উপন্যাসের নায়িকারা রোম্যান্স ও আদর্শিক চেতনাকে লালন করে। অথচ পরিণত ও স্থির কোনো লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। শেষ পর্যন্ত, বর্তমান জীবনের শূন্যতা ও অস্থিরতা যেন অকার্যকর করে দেয় মানুষের সকল ভাবনা ও কার্যক্রম।

ব্রুকনারের বাবা ও মা ছিলেন পোলিশ। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সৎ ও মিতভাষী ছিলেন তিনি। লন্ডনের দক্ষিণ কেনসিংটনে ছোট্ট এক আধুনিক ফ্ল্যাটে বাস করতেন তিনি। জন হ্যাফেনডান তাঁর এ সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেছিলেন ১৯৮৪ সনে। তাঁর ছোটগল্পগুলো প্রকৃতই নিরেট এক বাস্তবতার মধ্যে প্রোথিত। প্রতি বছর একটা করে উপন্যাস জন্ম দেয়ার জন্য অক্লান্তভাবে কাজ করতেন তিনি।

অনূদিত সাক্ষাৎকারটি কিছুটা সংক্ষেপ করা হয়েছে। একজন ঔপন্যাসিকের মনোজগতের প্রেক্ষাপট উন্মোচন করে এ সাক্ষাতকারটি। সাহিত্যের খুঁটিনাটি সম্পর্কে অত্যন্ত খোলামেলা আলোচনা করেছেন তিনি। উপন্যাসের বর্তমান রীতিনীতি, এর প্রবহমানতা ও সময়োপযোগিতা সম্পর্কে একজন আধুনিক ঔপন্যাসিকের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে এখানে।

জন: 
আপনার তৃতীয় উপন্যাস Look at Me-এর নায়িকা কঠোরভাবে চেষ্টা করছে একটা উপন্যাস লিখতে এবং এটাকে বিবেচনা করে সে এক অনুশোচনামূলক প্রতিকার হিসেবে। এটা কি আপনার নিজেরই দৃষ্টিভঙ্গি?

এনিটা: 
হ্যাঁ, শিরঃপীড়া দেয় এটা আমাকে। যে-কারণে উপন্যাস লিখি তা অনুশোচনাজনিত এবং সম্ভবত এটা কার্যকর। লেখা শুরু করি আমি একারণে যে একসময় উপলব্ধি করতে পারি আমার ক্ষমতাশূন্যতা: বুঝতে পারি যে ঘটনাস্রোতে ভেসে যাচ্ছি আমি এবং নিমজ্জিত হতে যাচ্ছি দুর্বোধ্য অন্ধকারে, এবং সেইটের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করি আমি। আমার অবস্থার পরিবর্তনের জন্য কি করতে পারি তা দেখার জন্য অপেক্ষা করি না। নিয়ন্ত্রিত হওয়ার চেয়ে বরং নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছি। আদেশ করতে চেয়েছি আদিষ্ট না হয়ে। নিজে নির্বাসিত হওয়ার চেয়ে অন্যকে নির্বাসন দেয়া ভালো মনে করেছি।


জন: 
Look at Me গব খুব ভাবগম্ভীর এক রচনা আপনার। অথবা আপনার উপন্যাসগুলোর মধ্যে কোমল ও সংযতভাবে নির্মিত ওটা। কিছুটা আশ্চর্য হয়েছি, প্রকৃতপক্ষে ওটা আপনার প্রথম রচনা হতো যদি?

এনিটা: 
না, ওগুলো প্রকাশিত হয়েছিল লেখার ক্রমানুসারেই। Look at Me দুঃখতাপিত দুর্বলহৃদয় এক উপন্যাস। এমন একটা-- যার জন্য এখন আমি দুঃখ করি। এটা প্রকাশ করেছিলাম যখন, আমার মায়ের খুব পুরোনো এক বন্ধু তলব করে আমাকে ও বলে ‘নিঃসঙ্গ এক মহিলা হিসেবে তোমার প্রতি খারাপ ধারণা সৃষ্টি করছো তুমি। অবিলম্বে বন্ধ কর এটা।’ ঠিকই ছিলেন তিনি। লেগে গেছে ও কথাটা।


জন: 
 এমনটা বলা কিন্তু সত্যও হতে পারে যে আপনার উপন্যাসগুলো আপনার কথাই বলে?

এনিটা:
বিষয়গুলো সব উদ্ভাবিত। মনের ঐ স্তরের কথা বলে ওরা যেসব তাড়িত করে আমাকে ওসব বিষয়ে কিছু করার জন্য। ঐ অর্থে ওগুলো অবিশুদ্ধ, ভেজাল উপন্যাস, একটা প্রসারিত অনুভূতি ও অস্বস্তি এনে দেয় তা আমাকে। অতি-সাম্প্রতিক Hotel du Lac-এ বরং ভেজাল কম; এটার উদ্ভাবন সরল ও খাঁটি।


জন: 
Hotel du Lac একজন ঔপন্যাসিক সম্পর্কে উপদেশমূলক কাহিনী বর্ণনা করে, মনের অনুভূতি যাচাই করতে এবং ঐসব বিষয়ে ধারণা পেতে ইচ্ছে করে।

এনিটা: 
কখনোই তা করে না। বরং এটাকে ঠিকঠিকভাবে পায় না সে। ওর নিজস্ব উদ্ভাবনসূত্রগুলোর উপর এজন্য পতিত হতে হয় ওকে।


জন: 
উপন্যাসগুলোকে এমনভাবে নির্মাণ করেন আপনি যে এক ধরনের আত্মচিকিৎসামূলক হয়ে ওঠে ওগুলো।

এনিটা: 
আচ্ছা! যদি চিকিৎসা হয়, তাহলে ধরে নিচ্ছি যে কাজ করছে এটা। অবশ্যই ওভাবে কাজ করি নি আমি, যে-কারণে ওটা করে যেতে হয়েছে। পরিপার্শ্ব ও জীবনের অস্বস্তিকর উত্তেজনায় তাড়িত হয়েছিলাম। যা আমার কাছে মনে হয়েছে খুব খারাপভাবে সাজানো। উপন্যাসগুলোর নৈতিকতা-- যাতে বিচারবুদ্ধি পরিমাপ করা যায়, খুবই সমর্পিত মনে হয় ওটা আমার কাছে। ‘ট্রোলোপ’এর মতো ঔপন্যাসিকের রচনা পড়েছি আমি সব সময়, যার নৈতিক মানদণ্ড উপন্যাসের পরিকাঠামোর মধ্যে খুব স্বচ্ছ: খারাপ দিকগুলো অন্তর্ভেদী রূপে দৃশ্যমান, সাধারণত যা প্রকৃত জীবনে কিংবা নিত্যদিনের ঘটনায় সাধারণত দেখা যায় না। তিক্তভাবে প্রতিক্রিয়া করে এটা আমার উপর-- হতাশ হয়ে পড়ি আমি-- মানুষের দুঃখগুলো উপভোগ করা, অশালীন আচরণকে প্রশ্রয় দেয়া, অন্যায় বিরোধিতাকে হেসে উড়িয়ে দেয়া, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা-- এসব সহ্য করতে পারি না আমি।


জন: 
Providence উপন্যাসে কিটি মল ইচ্ছে করে-- সে তার ছাত্রদের বলে, জীবন-যাপনের জড়িত অনুষঙ্গগুলো আকর্ষিক ও উপভোগ্য কাজগুলো নৈতিক দৃঢ়তা থেকে উৎকৃষ্ট।

এনিটা: 
হ্যাঁ, প্রতিদিনই তা দেখি আমি। যদি চাতুরী-চর্চা না করেন, তা যেমন করা উচিত না আপনার, এবং উপন্যাস অবিচারমূলক ধারণা হতে... অথবা তলিয়ে যান আপনি, আমি মনে করি এই ধারণা সবার জন্যই প্রযোজ্য। যারা সম্ভবত কিছুটা ভীরু প্রকৃতির ও কখনোই কৃতকার্য হয় না বা আশাবাদী নয়।



জন: 
 পেশাগত দিকে অবশ্যই ঈর্ষণীয় সফলতা পেয়েছেন আপনি।

এনিটা: 
এখানে আপত্তি জানাই আমি। সফলতা হচ্ছে অন্যেরা আপনার সম্পর্কে যা বলে... এটা অনুভব করি না আমি।


জন: 
আপনার নিজের ছায়া কি প্রতিফলিত হয় আপনার উপন্যাসের মধ্য দিয়ে? আপনার পিতামাতা কি দ্বিকেন্দ্রী না একই কুলশীল?

এনিটা: 
হ্যাঁ, ওরা পোলিশ ইহুদি। আমার মা জন্মেছেন এখানে, বাবা পোল্যান্ডে। ব্যথাতুরভাবে ওদের ভালোবেসেছিলাম আমি, কিন্তু খুব কোপন-স্বভাব ওরা, এবং অনির্ভরযোগ্য। সন্তান থাকা উচিত ছিল না ওদের কখনোই, ছেলেমেয়েদের বোঝেই না ওরা। এবং এ নিয়ে মাথাও ঘামায় না। বেশ সমৃদ্ধ একটা পারিবারিক ব্যবসা ছিল ওদের, ইউরোপ থেকে সরিয়ে আনা, যা এক সময় নিচের দিকে নেমে আবার উপরে উঠে আসে। আমি চেষ্টা করেছি এ নিয়ে একটা উপন্যাস লিখতে, খুব সন্দেহ হয় যে শেষ করতে পারব না এটা আমি-- মুহূর্তগুলোকে এত হৃদয়হীন মনে হয়! আমার বাবা-মা এখন মৃত। অতএব কারো ‘ঘরে যাওয়া’ কখনো হবে না আর। ভুল জুটি ছিল ওরা। প্রবল ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন, উগ্রমেজাজী, বিশাল এক দুঃখের অবশেষ বাহক, উত্তরাধিকার সূত্রে যা বয়ে চলেছি আমিও। খুব একটা ফুর্তি করা কখনোই হয়ে উঠে নি আমাদের। খুব নিঃসঙ্গ এখন আমি-- যা মনে হয়, নিজেকে ব্যবহার করাই হচ্ছে শুধু, নিজেকে øায়ুশক্তি দিতে হয় প্রতিদিন। এটা প্রকৃতই টিঁকে থাকার জন্য বাঁচা।


জন: 
Providence উপন্যাসটিতে একটা দিক উঠে আসে, এটা ধারণা দেয় যে অস্তিত্ববাদ হচ্ছে, সম্ভবত, রোম্যান্টিসিজমের বিলম্বিত অভিব্যক্তি।

এনিটা: 
এমন বলব আমি যে এটা হচ্ছে বিপরীত রোম্যান্টিসিজম: বিষয়গুলো ভালোভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে-- এরূপ সকল আশা বা বিশ্বাস থেকে মুক্ত রাখে এটা। আমি মনে করি আমার বাবা-মায়ের জীবন ছিল পোকায় কাটা-- কিছু কিছু ধারণায় আমারটাও-- মোটা দাগে এ কারণে যে স্বাভাবিক নিয়মে বহিরাগত হওয়ায়, ইংল্যান্ডে আগন্তুক হওয়ার কারণে, ভালোভাবে না জেনে যে ওদের প্রতি কি ঘটেছে ও কি করা হয়েছে!


জন: 
 আপনি আগাগোড়াই বেড়ে উঠেছেন ইংল্যান্ডে, নিয়মিতভাবে শিক্ষা নিয়ে।

এনিটা
হ্যাঁ। কিন্তু নিজের মতো কখনোই ছিলাম না আমি এখানে। একেবারে কম বয়সে একটা রক্ষণশীল আবরণ তৈরি করতে হয়েছে আমাকে। কিন্তু লেগে থাকে নি ওটা। প্রথমে কিংস কলেজে যাই আমি, এবং পরে কোর্টৌল্ডে। আমার বাবা-মা’র সেবা করতে হয় তাদের মৃত্যু পর্যন্ত। এটা খুব নিরানন্দ, এক ভিক্টোরীয় কাহিনি, তারপর ইংরেজ না হওয়ায় আরো বেশি জটিলতা মেশানো। সবাই বলে যে আমি এত গম্ভীর ও বিমর্ষ, কিন্তু আমার মনে হয়েছে ইংরেজরা কখনোই গম্ভীর নয়। ওরা বাচাল, আত্মপ্রসন্ন, অনির্বচনীয়, কিন্তু কদাচিত গম্ভীর-- এবং এটা পাগলকরা। ইংরেজরা ভাবে যে ওরা অনবদ্য। মনে হয় ওরা তাই: এটা আত্ম-প্রশংসামূলক, সকল সময়েই। অতএব আমি জানি না যে কি করতে হবে, এবং কি হতে হবে: মনে হয় ব্যাখ্যাতীত এটা এবং সমাধান-অযোগ্য।


জন: 
 আপনার In the Psychiatrists Chair  উপন্যাসে এ ধরনের কথোপকথনের . . .

এনিটা: 
হ্যাঁ, পরিপূর্ণভাবে আবিষ্ট আমি ওখানে। অনেক বিষয়ে বলেছি, এবং অনেক শুনেছিও। অন্যদের গল্পগুলো সব সময়ই মনে হয় কারো নিজের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজনীয়, কোনো না কোনোভাবে অতিরিক্ত বাস্তবতা মেশানো।


জন: 
 একজন প্রকৃত ব্যক্তিসত্তা হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করতে পারেন না কখনো?

এনিটা: 
না, চূড়ান্তভাবে সহিষ্ণু আমি, নিষ্ক্রিয়, শোষক কাগজের মতো। আসলে আমি উপলব্ধি করতে পারি না যে আমি-- অপ্রতীয়মান!


জন: 
 মনসমীক্ষণ করিয়েছেন কি কখনো?

এনিটা: 
না, অবশ্যই এটা করব না আমি-- অনেক লম্বা সময় নেবে এটা।


জন: 
Look at Me  লিখতে যেয়ে পরিষ্কারভাবে দায়বদ্ধ দেখিয়েছেন নিজেকে, ভাবপ্রবণ এক নিযুক্তির মধ্য দিয়ে।

এনিটা: 
ওটার মূল্য প্রদান করি নি আমি। ভেতর দিয়ে দেখেছি ওটাকে, এবং পরবর্তীতে অসুস্থ হয়ে পড়ি এ কারণে।

জন: 
 খুব নৈরাশ্যজনক গল্প এটা, প্রকৃতপক্ষে কিছুই ঘটে না ওখানে, জাঁকালো ও ঝলমলে মানুষদের প্রতি ফ্রান্সিস হিন্টনের দেখানো স্নেহপ্রবণতার দিকটা ছাড়া আর কিছু নেই এখানে। মানুষগুলো, সত্যি বলতে কি-- অযত্নশীল, The Great Gatsby-র বুকাননের মতো।

এনিটা: 
তা বটে। অযত্নশীল লোকগুলোর প্রতি খুব ঈর্ষান্বিত আমি। ওদেরকে পছন্দ করতে ব্যর্থ হওয়ার মতো প্রায় এটা। এবং ঐ ধরনের লোকগুলোর প্রাপ্তিই কেমন করে যেন সীমাহীন হয়ে উঠে। ওদের নৈতিক অবস্থান প্রাসঙ্গিকতা ছাড়িয়ে যায়, যা উন্মোচিত করে নৈরাশ্যের দিকগুলো।


জন: 
 আপনার উপন্যাসের বিস্ময়কর দিকগুলো হচ্ছে যে আপনার নায়িকারা কখনোই মানুষের শিল্প-সৌন্দর্য কিংবা সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা বা অবজ্ঞার ছিটেফোঁটাও প্রকাশ করে না, যদিও ওরা বিভিন্নভাবে সম্পর্কায়িত হওয়ার মধ্য দিয়ে এসব আবিষ্কার করে।

এনিটা: 
আমি চেয়েছি ওগুলো থাকুক। বিস্ময়ের চাপে অনবরত পিষ্ট হচ্ছি আমি।


জন: 
 এবং এমন বলা যায় যে অন্যের অহমিকার প্রতি যে অশোভন আচরণ করা হচ্ছে তার চিত্র কখনোই নির্মাণ করেন নি আপনি।

এনিটা: 
না, কীভাবে ওটা বলতে পারেন আপনি তা বুঝতে পারি না। মূলত আমি চাই অন্যেরা কীভাবে আছে-- তা জানতে।

জন: 
The Author এর ক্ষুদ্র এক অংশে লিখেছিলেন ‘‘যেহেতু আমি বিশ্বাস করি, কাহিনি-লেখকগণ ... কোনো দুর্লংঘ্য পথে এমন এক সম্প্রদায় যারাই কেবল সত্য বলে। যেভাবেই হোক ওদেরকে খুব গভীর অসুখী বলে ধরে নেব আমি।” -- সত্যিই কি এত খারাপ সংবাদ ওটা, সব সময়?

এনিটা: 
ওটা হচ্ছে ক্যাসান্দ্রা কমপ্লেক্স। দুঃখজনক সত্যগুলো খুব অল্প বয়সে জেনে যাই আমি, কখনোই ঐ প্যাঁচের ভিতর থেকে ঠিকভাবে বেরিয়ে আসতে পারি নি-- যে জীবন হচ্ছে এক সাংঘাতিক এবং চূড়ান্ত দুঃখজনক পরিণতি। কিছু মুহূর্ত আছে যখন অনুভব করতে পারেন যে আপনি স্বাধীন, কিছু মুহূর্তে বুঝতে পারেন আপনার শক্তিমত্তা, কোনো কোনো মুহূর্ত আশার আলো দেখায় আপনাকে, আপনার মধ্য দিয়ে ঐ জিনিসগুলো দেখবেন, যেন ভরসা করতে পারেন না। পারিপার্শ্বিকতা সম্ভব করে এগুলো।


জন: 
 আমার মনে হয় আপনার নায়িকারা সবাই অদৃষ্টবাদী পথে অগ্রসর হয়, যেমন Providence এর কিটি মল প্রকৃতপক্ষে ঘোষণাই দেয় যে সে একজন অদৃষ্টবাদী। আপনি কি বিশ্বাস করেন না যে সদর্থক কোনো পদক্ষেপ, বা কোনো সংকল্পে নিহিত শক্তি কখনো কখনো ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়?

এনিটা: 
আমি মনে করি ব্যক্তি-চরিত্র অথবা তার প্রবণতাসমূহ নির্ধারণ করে ভাগ্য, ভয় পাচ্ছি এ বিষয়ে বলতে।


জন: 
কোন স্তরে পৌছে এ ধরনের সিদ্ধান্তে এসেছেন আপনি?

এনিটা: 
বিগত পাঁচ বছরে। এর আগে রীতিমতো প্রফুল্লচিত্ত ও অধিকতর প্রাণবন্ত ছিলাম আমি। খুব বিপথগামী উদ্যম এটা, উপন্যাসগুলোর মধ্য দিয়ে যা প্রকাশ পেয়েছে, পরিবর্তিত এক অনিষ্টকারী ভাবাবেগ, আমি বলব, যদি এটা বলা যেত, অবশ্যই বলতাম, যেহেতু এটা বলতে পারি নি, আমাকে লিখতে হয়েছে। এবং আমি এটা বলতে পারি না, কারণ শোনার মতো কেউ নেই; লোকেরা এটা শুনতে চায় না। আমার ইচ্ছে করে যদি কাঁদতে পারতাম, আর্তনাদ করা যেত, মাটিতে পা ঠুকে কিছু বলতে পারতাম, নিজেকে প্রবোধ দিতে পারা যেত, কিন্তু এসবের কিছুই পারি না আমি। অন্য লোকেরা এসব শুনতে চায় না; ওদের কাছে এগুলো বিব্রতকর মনে হয়, সীমার অতিরিক্ত।

জন: 
 অনুমেয়, অধিকসংখ্যক মানুষেরা সঠিকভাবে বুঝতেই পারে না ওটা কি, যার জন্য আপনি জীবনের বিপরীতে চিৎকার করে কাঁদতে চান। দুভাবে কৃতকার্য আপনি: একজন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তিত্ব এবং একজন ঔপন্যাসিক, ছাপাখানার যথেষ্ট আনুকূল্য পেয়েছে যার উপন্যাসগুলো।

এনিটা: 
কেন্দ্রটিকে ধরে রাখতে পারে নি কিন্তু এটা। যে-দুটো কর্মকাণ্ডের উল্লেখ করলেন তা প্রাকৃতিক প্রয়োজনের বাইরে। এ পর্যন্ত শুধু সন্তান চেয়েছি আমি, কম করে হলেও ছ’টি ছেলে।


জন: 
 আপনার নিজের সম্প্রসারণ হিসেবে নয় কি?

এনিটা: 
কোনোভাবেই না। আমি আশা করি এটা আমার স্বভাবের একেবারে ভিন্ন দিক। আমি চেয়েছি আমার পারিবারিক গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যেতে, যারা নিয়মিতভাবে বিন্যাসিত হয়েছে, যাকে আপনি সফলতা বলছেন তা নিয়ে এমন এতিমের মতো বেড়ে ওঠার পরিবর্তে। এ হচ্ছে আমার বিবৃতির এক ধরনের পঙক্তিবিন্যাস, যা আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই তৈরি করি নি আমি, কিন্তু এটাই সত্য। আমার নানা ইংল্যান্ডকে দেখেছিলেন পৃথিবীর উদারতম দেশ হিসেবে। তিনি এটার পূজা করতেন, এবং খুঁজে পাওয়া প্রতিটি ইংরেজ নীতি গ্রহণ করতেন। কিন্তু ইউরোপের চিন্তা-ভাবনা, বিষণœতা, অন্তর্দর্শন প্রভৃতি দৃঢ়লগ্ন ছিল একে অপরের সঙ্গে, এটা একটা বাজে সংমিশ্রণ, ইংরেজ পরিমণ্ডলের চেয়ে এটা ছিল গভীরতর।

জন: 
 আপনার পেশাগত জীবনের প্রেক্ষিতে আঠারো শতকের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হওয়ার কি কারণ ছিল?

এনিটা: 
আলোকসম্পাত। খাঁটি কথা হচ্ছে এই যে সঠিকভাবে বেরিয়ে এসেছিল এটা। রোম্যান্টিক আন্দোলনের উদ্ভব ঘটেছিল এবং সব দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল এটা। অবশ্যই বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন এক পৃথিবী পছন্দ করব আমি-- যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা, সরস হাস্যরস ও ভয়হীনতা সহযোগে। আঠারো শতকের ফ্রান্সের কথা বলছি, চিত্রশিল্পী ও লেখকগণ, আজকের মানদণ্ডে যাঁরা অসাধারণ জনশূন্যতায় নিমজ্জিত ... এবং দোষহীন ...


জন: 
 এবং সর্বদাই হ্যাঁ-বোধক।

এনিটা: 
সর্বদাই। এবং অলজ্জিত।


জন: 
The Genius of the Future  পড়তে যেয়ে মনে হয়েছে যে এই কাহিনিটি নির্মাণ করেছেন আঠারো হতে উনিশ শতকে দুঃখজনকভাবে বোধনগুলোর অবনমিত হওয়ার বিষয়টি বোঝাতে...

এনিটা: 
হ্যাঁ, আমারও মনে হয় এটা সত্য। এটা একটা বিষয় যা এখনো শেখাই আমি। এবং ছাত্ররা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সময়পর্বটার শেষভাগে অধিক পরিমাণে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে: ওরা অপেক্ষাকৃত সহজভাবে নির্ণয় করতে পারে জটিলতাসমূহ, শুরুর দিকের নির্দোষ শক্তিমত্তা ও উৎসাহব্যঞ্জক বিষয়গুলোর চেয়ে। ওদের কোনো দুঃখ নেই যা হারিয়ে গেছে বা যা অবধারিত ছিল সে-সব সম্পর্কে।


জন: 
 বইটা যখন প্রকাশ করেন আপনি, ১৯৭১ সনে, আপনি লিখেছিলেন, শিল্প-সমালোচনা হচ্ছে ‘অনড় তোষামোদী কার্যক্রম’ পর্যায়ভুক্ত। আপনার কি মনে হয়েছিল যে একটা অপ্রকৃত বা ভুল পেশায় নিয়োজিত হয়েছিলেন আপনি?

এনিটা: 
হ্যাঁ, অনেক অমেধাবী ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত দেখেছি আমি। এখন সব কিছুই অতিরিক্ত বাণিজ্য-গন্ধী, যদি কোনো কিছুতে অর্থায়ন করা যেতে পারে তাহলে ওদের মানদণ্ডে এটা অবশ্যই সঠিক ও ইচ্ছানুরূপ হতে হবে-- এমন ধারণা করা যায়।


জন: 
 শিল্প-সমালোচনায় যা অর্জন করা উচিত বলে ভাবেন আপনি তা কি নিজের জন্য কখনো প্রয়োগ করেছেন? এটার কতটুকু সমর্থন করা উচিত, কিংবা এটার বৈধতা কি হতে পারে? এটা কি দার্শনিক হওয়ার গুরুত্ব, যিনি শিল্পের নৈতিকতা সংশ্লিষ্ট একজন ব্যক্তিত্ব?

এনিটা: 
ঠিক তাই। যেমন শেখাই আমি; আমার কাছে এমন মনে হয়, আসলে এটা কোনো বিষয়ের উপর ক্রিয়াই করে না যতক্ষণ না আপনি কোনো পদ্ধতি শেখাচ্ছেন। যারা পরোয়া করে তাদের যে-কারো ব্যবহার করার মতো বস্তু এতে রয়েছে। কিন্তু এটার সঠিক পরিপ্রেক্ষিতটির ভেতরে ঢোকা হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা নৈতিক ও একটা ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত। শিল্প-ইতিহাসের প্রতি যা আকর্ষণ করে আমাকে তা হল চিত্রকল্পের শক্তি; শব্দের চেয়ে যা ভিন্ন রকম। চিত্রকল্প প্রতিস্থাপিত হয় এমনভাবে যা শব্দেরা কখনো করে না। স্বপ্নগুলো সাধারণত শব্দহীন, কিন্তু চিত্রকল্পে ভরা ওগুলো, এবং একটা চিত্ররূপ অসংখ্য রহস্যপথে উত্তীর্ণ হতে পারে এবং বস্তু নির্মাণ করতে পারে। চিত্রকল্প শব্দের চেয়ে শক্তিশালী ও মৌলিক।


জন: 
 আমি মনে করি, কিছুটা ধারণা আছে আমার যে একটা শিল্পকর্মের অন্তর্সংবাদ ও একটা শৈলীর মধ্যে পৃথকীকরন রেখা টেনে দেবেন আপনি।

এনিটা: 
সম্ভবত। বিষয়/বিধেয় হচ্ছে এক জিনিস, উপস্থাপন হচ্ছে অন্যটি। উপস্থাপন হচ্ছে শিল্পীর নিজস্ব ঝোঁক, যার প্রতি তিনি দৃষ্টিপাত করেন, ওভাবে ভাবনাশৈলী ও নৈতিকশৈলী সামঞ্জস্যপূর্ণ। আঠারো শতকের শিল্পীরা তাঁদের চারপাশ ঘিরে থাকা বিশৃঙ্খলার মধ্য থেকে মনকে টেনে এনে পুরোপুরি আবিষ্ট করতেন, অথচ উনিশ শতকে এসে মনে হল এগুলো আরো শক্তিশালী ও সুবিন্যাসিত ... মানব অবস্থানের প্রতি আরো গভীর ও সত্য। বিশৃঙ্খলার বিপরীতে বিন্যাসকে সব সময়ই টিঁকতে হয়েছে প্রতিযোগিতা করে। সাম্প্রদায়িক কোনো উদ্যোগ বর্তমানে নেই আমাদের। এটা দৃষ্টিকটু। কেমন করে? এমনকি আমার পেশায়ও উপর্যুপরি প্রচেষ্টা নেয়া হয় বিশাল বিশ্বকোষের ধারণাটাকে পুনর্জাগরিত করতে, ঐ বিষয়গুলো তুলে আনতে, যা সকল তথ্য প্রক্রিয়াজাত করে রাখে, একটা যাজকীয় কীর্তিস্তম্ভ যা শুধু পাণ্ডিত্যের জন্য নয়, অর্থ বহনের জন্যও। ইচ্ছেটি রয়েছে সেখানে, স্থায়িত্বের ইচ্ছে, এবং আমি একেবারে নির্দোষই দেখি এটাকে। আমাদের যা ঘাটতি আছে তা হল দার্শনিক পরিমিতি, যা এই বিষয়গুলোকে মূল্য প্রদান করে, এবং এটার অনুপস্থিতি বরং আশাহীন, বেদনাদায়ক।


জন: 
 শিক্ষা-সমালোচনামূলক বই লেখা চালিয়ে যাবেন কি আপনি?

এনিটা: 
সন্দেহ আছে আমার। অনেক সময় নেবে এটা। Jackues-Louis David  লিখতে লেগেছে দশ বছর। আমি মনে করি, মূলত আমার যা ছিল তা হারিয়ে ফেলেছি, সম্ভবত শক্তিমত্তা ও বিশ্বাস যে এটা করতে পারি আমি। পাঠকপ্রিয়তা পায় নি, বেশ ভাল একটা বই ছিল ওটা, এবং এর চেয়ে ভালো সম্ভবত হতে পারত না।

জন: 
 আপনার বিচার্য দিক কোনগুলো যা একটা শিল্পকর্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?

এনিটা: 
এটার জবাব খুব কঠিন। আমি মনে করি প্রভা-বিকীরণকারী হতে পারে এটা, চিত্রকল্পের পেছনে নিহিত শক্তি: দূরদৃষ্টি।


জন: 
 একজন শিল্প-ইতিহাস রচয়িতা ও একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে আপনার কাজের মধ্যে কোনো যোগসূত্র লক্ষ্য করেছেন কি? একটির সঙ্গে অপরটির কোনো স্বাভাবিক সম্পর্ক রয়েছে কি?

এনিটা: 
সাংঘাতিক ব্যাপার, এখানে কোনো যোগসূত্রই খুঁজে পাই না আমি। যতদূর সম্পর্কিত আমি, এটা এক ধরনের মাথাখারাপ করা কাজ। একমাত্র যোগসূত্র হচ্ছে, একই জায়গায় সম্পন্ন করি আমি এটা, আমার অফিসে। আমার প্রয়োজন কোলাহল, বাধা-দান ও গাত্রদাহ: গাত্রদাহ এবং অস্বাচ্ছন্দ্য, শুরু করার জন্য এটা খুব ভালোভাবে তৈরি করে আমাকে। অন্য কোনোভাবে এটা করার জন্য, অথবা নির্জনতা, শেষ করে দেবে আমাকে।


জন: 
 আমাকে যা ভাবায়, আপনার নায়িকাদের কেউই অসৎ নয়,এমনকি ওদের নিজেদের সঙ্গেও না।

এনিটা: 
অসততার অর্থ হচ্ছে নিজেরি নীতির প্রতি কারো বা কোনো কিছুর বিদ্রোহ করা, এটা করতে পারেন না আপনি।



জন: 
 নিজের জন্য ভয়ানক উঁচু মান রেখেছেন আপনি।

এনিটা: 
এ সম্পর্কে কিছু জানি না আমি, যেহেতু অন্যদের মান আমার অজানা।


জন: 
 সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে নৈতিকতা আরোপের চেষ্টা করেন আপনি।

এনিটা: 
এগুলো এসেছে উনিশ শতকের উপন্যাস এবং সমাজ-চরিত্রের ভিত্তি হিসেবে। আমার পরিবার এ বিষয়ে ছিল খুব কঠোর; কখনোই এসব শিক্ষা ভুলতে পারি নি আমি, এবং প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারি, এতে আমি দুঃখিত। চূড়ান্ত পর্যায়ে-- আপাতদৃষ্ট ও অতৃপ্তিজনিত অসততাবোধকেও ছেড়ে দেব না আমি: এগুলো হচ্ছে প্রয়োজনীয় অসততা।


জন: 
 এটাকে কেউ চিত্তাকর্ষক ভেবে নিতে পারে, যে এতটা নিষ্ঠাবান হতে পারেন আপনি।

এনিটা: 
না, জনপ্রিয় ধারণায় নয়। আমার বন্ধুরা তখন ভেবে নেয় যে আমি ওদেরকে আমার উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে ব্যবহার করব, যদিও এটা করি না আমি।


জন:
 আমি কল্পনা করতে পারি যে A Start in Life  উপন্যাসে আপনার বাবা-মাকে এবং সম্ভবত চৎড়ারফবহপব উপন্যাসে নানা-নানিকে ব্যবহার করেছেন আপনি।

এনিটা: 
না। কোনোভাবে ওরা অমন ছিল না; ওদের সঙ্গে এ রকম কিছু করতে পারি নি আমি।


জন: 
 খ্রীস্টধর্মের প্রতি আপনার কোনো ক্ষোভ রয়েছে কি?

এনিটা: 
হ্যাঁ, অনেকগুলো কারণ আছে আমার অভিযোগের। আমার ইচ্ছে, যদি সমগ্রটাকেই মেনে নিতে পারতাম ... এটা কাউকে ভয়ানকভাবে আমোদিত করে তুলতে পারে, এবং কাউকে কোনো একটা দেশে খুঁটি হিসেবে ধরে রাখতে পারে, যেমন এটা ছিল-- কিন্তু আমি তা পারি নি। আমি একজন পতিত ইহুদি- এমন একটা বিষয় বোধগম্য হতো যদি, কিন্তু এসব তো তা নয়। ইহুদিবাদ হচ্ছে ভয়ঙ্কর একটা ধর্ম, এটার নির্দয়তা, এর বদমেজাজী ঈশ্বর, মোটের উপর কোনো বিষয়ে জানতে দেয়ায় অসমর্থ, এটার স্ব-আরোপিত ও আবিষ্ট গুনাবলী ...


জন: 
 এটার নির্বাচনী বিচক্ষণতাও?

এনিটা: 
ইহুদিদের মধ্যে এটা দৃশ্যমান নয়; এটা খ্রীস্টীয় অথবা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের মনের ভেতরে থাকা ভীতি। এই বোঝাটি বয়ে বেড়ানোই সবচেয়ে কঠিন: বিত্তবান হওয়ারই কথা আমাদের, একচেটিয়া ও ভ্রান্তিমূলকভাবে। কীভাবে এটাকে দূর করবেন আপনি? আমি জানি এমন লোক আছে যারা ইহুদি ধর্মে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী এবং তাদের পথে তৃপ্তিকরভাবে সহানুভূতিপরায়ণ, এগুলো আমার বোধাতীত ও লোক-দেখানো মনে হয়। মৃতদের প্রতি বিদ্রোহ প্রদর্শন করতে পারেন না আপনি। অতএব সাধারণভাবে আপনি ইহুদি; মৃতেরা সংক্ষেপেও জবাব দিতে পারে না, কিন্তু আমি আছি এখানে। এটা ভাবতে ভালো লাগবে যে যিশু একটা সূর্য-রশ্মির জন্য আমাকে চাইবে, কিন্তু সে তো তা চায় না।



জন: 
 পুরুষদের চেয়ে স্ত্রীলোকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সহজতর মনে হয়েছে কি?

এনিটা: 
না, বন্ধুত্বের জন্য পুরুষদেরই প্রাধান্য দেই আমি, কারণ ওরা ভিন্নতর। মহিলাদেরকে জানি আমি। আমি মনে করি Hotel du Lac-এ যা বলেছি তা সত্য। ঐ মহিলাদের প্রত্যেকে দুঃখময়তার প্রতিই ঘুরে যায়। কিন্তু অকস্মাৎ ঐ বিন্দুটি উপস্থিত হয় যখন ভাগ্য কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসে, এবং ওরা তখন অন্য দিকে সরে যায়, যেখানে সম্পর্কগুলোও ভিন্ন রকম। নিশ্চিত কিছু সহজাত প্রতিযোগিতা রয়েছে মহিলাদের ভেতর যা কিছুটা হলেও অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং এটা পুরুষদের সঙ্গে সফলভাবে সম্পন্ন করতে হয়; এটা এমন এক ক্ষেত্র যেখানে বন্ধুত্ব অস্বাভাবিক পরিণতি পেতে পারে। একজন পুরুষ তার প্রণয়ীদের কাছ থেকে সরে যেতে পারে, কিন্তু একজন মহিলার জন্য ওটা ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।


জন: 
 আপনি কি মনে করেন, আপনার একজন নায়িকাকেও স্বীকার করাতে সক্ষম হবেন যে ওরা মুক্তি চায় জীবন হাতে করে বয়ে বেড়ানো থেকে?

এনিটা: 
যদি ওদের একজনকেও জানি, তাহলে পারব।


জন: 
 আপনি বলেন যে আপনার উপন্যাসগুলো যথেষ্ট জনপ্রিয় নয়, তবুও আপনার সৃষ্ট-চরিত্রগুলো সম্পর্কে অসংখ্য পাঠকের জানা উচিত বলে মনে হয়।

এনিটা: 
এটা এখনও প্রমাণ করতে হবে আমাকে। এমন লোকদের আমি জানি যাদের আত্মসন্দেহ নেই এবং সফলতায় উত্তরণেরও কিছু নেই। এজন্যই আমি বোঝাতে চেয়েছি উপন্যাস হচ্ছে জীবনের সঞ্চয়, নির্বাচন ও পরিত্যাগ করার বিষয়: জীবন হচ্ছে সঞ্চয় ও সুযোগের সমাহার এবং যারা জয়ী হয় তারা সবই গ্রহণ করে।


জন: 
 আপনার উপন্যাসের চরিত্রগুলোর হাস্যরস ও বুদ্ধিমত্তা বা ভাবপ্রবণতাগুলো সত্যকে প্রীতিকর করে তোলার প্রচেষ্টায় সচেতন চাতুর্য কি?

এনিটা: 
না, সচেতনভাবে এ রকম কিছু করা হয় না। প্রচুর পঠনের মধ্য থেকে এর উৎপত্তি। এখানেই হচ্ছে শিল্প-ইতিহাসের যোগসুত্র অথবা শুধুই ইতিহাস, যদি পছন্দ করেন আপনি, এবং কাহিনি: এটা হচ্ছে আঠারো শতকের শক্তি, যার প্রশংসা করে থাকি আমি। আমার কারণটি হচ্ছে, একটা গল্প বলা, অথবা, সম্ভবত একটা নৈতিক প্রহেলিকা সৃষ্টি করা। আমি এসব উপন্যাসগুলোকে দেখি অসাধারণ দুর্ঘটনা হিসেবে, এবং আমি যা করেছি তার বাইরে এগুলোকে নিয়ে আর ভাবি না। অবশ্যই কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর আদর্শ ধরে সৃষ্টি করি নি এসব।


জন: 
 আপনার সব চরিত্র কোথাও সমর্পিত হয়, শেষ পর্যন্ত, যা উচ্চাঙ্গের আদর্শে, এমনকি স্টয়েকবাদকেও বোঝায় না, জীবনের অপরিহার্যতার বিপরীতে এক ধরনের শিক্ষা প্রদান করে এটা, যা হতাশাব্যঞ্জক।

এনিটা: 
হ্যাঁ, এবং ঐ পরিস্থিতির ভয়াবহতা অত্যন্ত নিগূঢ়।


জন: 
 তাহলে কি আপনি মনে করেন আপনার লেখাগুলো অদৃষ্টবাদ দ্বারা গভীরভাবে আচ্ছাদিত ও রাঙানো?

এনিটা: 
এ বিষয়ে ভাবি নি আমি। এটার ন্যায়ানুগ দিকগুলো নিয়ে ভেবে দেখব নাহয়। আমার কাছে উপন্যাস হচ্ছে জীবনের মধ্য দিয়ে দেখা উদ্দেশ্যহীন ও খেয়ালি পরিচ্ছেদসমূহের সমষ্টি। বরং অসফল পরিচ্ছেদগুলোর বর্ণনা।


জন: 
 আপনার গ্রন্থগুলোর বড় পরিচয় হচ্ছে এগুলোর ন্যায়পরায়ণতা ...

এনিটা: 
পারলে এগুলো উপস্থিত করতাম আপনার সামনে। আমার মনে হয় না কাউকে কোনো প্রকার বিশেষ সুবিধে দিচ্ছি আমি। আমার নিজেকে তো একেবারেই না। আমি এখন দুভাবে আক্রান্ত-- জীবনে ও উপন্যাসে।


জন: 
 আমার মনে হয় না আপনার উপন্যাসে কখনো আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিপ্রবণ ও আকর্ষণীয় পুরুষদের প্রতি দোষারোপ করার দিকে অগ্রসর হয়েছেন আপনি। মোটের উপর স্বার্থপর ওরা, পার্থক্য নিরূপণে অপটু, বেদনাদায়কবাবে অনুৎসাহী, কিন্তু আপনি থেমে যান বিশদভাবে ওদের নিন্দা জানাতে যেয়ে।

এনিটা: 
এমন মানুষেরা মনোহারী, এ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। ওরা জানে কীভাবে নির্ভরশীল করে তুলতে হয় ওদের, এবং ভালোবাসার বস্তুরূপে নিবেদন করতে হয়। বলতে পারেন এটা ওদের নীতি, এবং ওখানেই আসে অপ্রকৃত বিষয়গুলো ... এবং অস্বচ্ছতা। কারন এটা পরীক্ষিত। ওরা ভান করতে পারে যে সম্পর্কটা শুধু শুধুই গড়ে উঠতে পারছে না। শুরুতেই যে সম্পর্কবিরোধী ছিল এটা তা বুঝতে চেষ্টা করে না। এবং ভুলটা হচ্ছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা বা বোধের অনুপস্থিতি।


জন: 
 নারীবাদীরা কি আপনাকে ভগ্ন-হৃদয় মনে করে?

এনিটা: 
একজন নারীবাদীর দৃষ্টিতে আমার উপন্যাসগুলো দেখার জন্য আপনাকে গুহার ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হবে। আমি বিশ্বাস করি না সকল পুরুষেরাই শূকরী-সঙ্গমে লিপ্ত।



জন: 
 রোম্যান্টিক আশাবাদ হচ্ছে ক্রমাগত আকর্ষক, যা আপনি লেখেন, পরাজিত ধারণা নিজ গৃহকোনে ধারণ করা সত্ত্বেও।

এনিটা: 
রোম্যান্স জিতে যেতেও পারে, কে জানে? কিন্তু দুটোই সত্য। বিষয়টি হচ্ছে যে আমার নির্বাচিত ব্যক্তিরা যোদ্ধা নয়। এবং আপনার প্রয়োজন শুধু পুষুষই নয়, স্ত্রীলোকও, যদি এটা সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যেতে চায়, আমি দুঃখ প্রকাশ করি এতে, কিন্তু আমি জানি এটা সত্য হতে হবে। পুরুষদের ভুলগুলোর ফর্দ আমরা বানাতে থাকি যদি, স্ত্রীলোকেরা শুধু এই বলেই পার পাবে না, বরং আত্মতোষামোদী হয়ে যাবে যে ওরা খুব বিনয়ী ও বাধ্যগত। স্ত্রীলোকেরা বরং ভ্রান্ত হতে পারে; এটা কিন্তু একই কথা নয়।


জন: 
 নারীবাদী লেখা পড়েন?

এনিটা: 
নামকরাগুলো শুধু।


জন: 
 আপনি কি দুঃখ করেন Look at Me-এর বিষয়ে, বিশেষ করে, কারণ এটা এমন এক উপন্যাস যা আশাহীনতাকেই প্রচার করে, যেখানে আপনার অন্য উপন্যাসগুলো সম্ভাব্য উন্নতি সাধনের ঈঙ্গিত দেয়।

এনিটা: 
সম্ভবত। নিজেকে নিয়ে খুব উত্তেজিত বোধ করি আমি এবং অন্যেরাও তাই করে: এটা অস্বীকার করতে পারেন না আপনি।


জন: আপনার উপন্যাসের গাম্ভীর্য, ইচ্ছাশক্তি, নির্বাচন ও ভাবপ্রবণতার মধ্যে কোনগুলোকে প্রধান বা বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?

এনিটা: ভাবের জন্য আমি ঋণী অষ্টাদশ শতকের রচনাগুলোর কাছে। ভলতেয়ার খুব ভাবায় আমাকে, ওর সরলতা ও শক্তিমত্তার জন্য, দিদেরো পাঠ আমার জন্য আকর্ষক। তিনি অপরাজেয়। জানেন, তেইশটা পিত্ত-পাথরি ছিল ওর পেটের ভেতর? তেইশটা পাথর শরীরে ধারণ করে কে সাহস করে লেখায় শ্রম দিতে? তিনটি সন্তান মারা যায় তাঁর। আমি বোঝাতে চাইছি তাঁর প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি ও সততার দিকটি। বড় মাপের লেখকগণ ঈশ্বরহীন বিশ্বে সন্তের মতো।


জন: 
 কখনো কি ভেবেছেন সবগুলো ডিমকে পেশাধারী যোগ্যতা ও প্রাপ্যতার ঝুড়িতে রাখতে?

এনিটা: 
না। আমি ভেবেছি নিরাপদ রক্ষাব্যুহের বাইরে খাপ খাই না আমি; অতএব শুধু পড়তে ও লিখতে চেয়েছি। নিজেকে যখন আবিষ্কার করি তখন অনিচ্ছার পাহাড়ে চাপা পড়ে পঙ্গু হয়ে গেছি, লেখালেখিকে চিকিৎসা হিসেবে গ্রহণ করেছি, তাৎক্ষণিকভাবে কাজ করেছিল ওটা। খুব নিঃসঙ্গ বোধ করি আমি। পরিত্যক্ত, নৈরাশ্যকর। এবং খুব ভালো এক বিষণœতা ছিল না ওটা। বরং জুয়া খেলার মতো।


জন: 
 আপনার মতে উপন্যাস লেখা কি অনুপযোগিতামূলক কাজ?

এনিটা: 
না, এভাবে বলতে দিচ্ছি না আপনাকে। এটা হচ্ছে অভিজ্ঞতা সম্পাদনা করার বিষয়, এটাকে একটা আঙ্গিক হিসেবে গ্রহণ করা, কারণ আমার মনে হয় এটা এমন এক কাঠামো যা আমাদেরকে রক্ষা করে। যত তাড়াতাড়ি এটা বোঝা যায় তত ভাল। কল্পনাশক্তির অধিকারী হতে পছন্দ করি আমি, যদিও তা নেই আমার। আমি দেখাতে পারি যে একটা বিষয় থেকে আর একটা বিষয় জন্ম নেয়। বিচক্ষণতার ফলশ্র“তি হল উদ্ভাবন, কল্পনাশক্তির উড্ডয়ন নয়। সবারই কিছু না কিছু উদ্ভাবন-শক্তি রয়েছে। কিন্তু কল্পনাশক্তি, খুব কম মানুষেরই আছে। কল্পনাশক্তি, যদি কারো থাকে এটা, তাহলে এই জমকালো পৃথিবীর রহস্যগভীর অনুভুতির অংশ দেয়া উচিত আমাকে। আপনি যদি অন্যদের জীবন নিয়ে কল্পনা করতে পারেন তাহলে দেখতেন জীবন অনেক গতিশীল ও প্রাণ-প্রাচুর্যময়। দিদেরোর কল্পনাশক্তি তাঁকে বৈজ্ঞানিক করে তুলেছিল। তিনি কল্পনা করতে পেরেছিলেন মহাবিশ্বের আণবিক গঠন। এটা সত্য যে কোনো প্রকার বৈজ্ঞানিক পড়াশোনা তাঁর ছিল না।


জন: 
 ঔপন্যাসিক না হয়ে বরং চিত্রশিল্পী হতে পারতেন কি আপনি?

এনিটা: 
হ্যাঁ, আমি মনে করি চিত্রকর হিসেবে পৃথিবীটাকে বেশি ভালোবাসেন আপনি। জীবনের জন্য একটা উন্নত তৃষ্ণা রয়েছে চিত্রশিল্পীর। আমার মনে হয়, আমার সৃষ্টি করা ব্যক্তিচরিত্রগুলোকে আবার ক্রিয়াশীল করা যেতে পরে, যদি সময় সঠিক থাকে, তাই আশা করি আমি।


জন: 
 আপনার নিজস্ব নায়িকাদের মিলিত হতে দেয়া হয় না!

এনিটা: 
ক্ষুদ্র বিষয়, ওদের জন্য দুঃখ জানাই আমি, ওরা দুষ্ট প্রকৃতির। অন্য কোনো পৃথিবী নেই ওদের জন্য। এবং ওরা যা করে তার বাইরে আমি আর কিছু জানি না যে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ