হুমায়ুন আহমেদ'এর গল্প : নন্দিনী



মজিদ বলল, ‘ চল তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই।‘

বেশ রাত হয়েছে। চারিদিকে ফিনফিনে কুয়াশা। দোকানপাঠ বন্ধ। হু-হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। পাড়াগাঁর শহরগুলিতে আগে আগে শীত নামে। মজিদ বল, ‘পা চালিয়ে চল। শীত কম লাগবে। ‘

‘কোথায় যাবি?’

‘চল না দেখি। জরুরি কোনো কাজ তো নেই। নাকি আছে?’


‘ না নেই।‘

কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় রাস্তা ছেড়ে ইট বিছানো সরু রাস্তায় এসে পড়লাম। শহর অনেক বদলে গেছে। আগে এখানে ডালের কারিবারিরা বসত। এখন জায়গাটা ফাঁকা। পিছনেই ছিল কার্তিকের ‘মডার্ন সেলুন’। সেখানে দেখি একটা চায়ের স্টল। শীতে গুটিসুটি মেরে লোকজন চা খাচ্ছে। আমি বললাম, ‘ একদফা চা খেয়ে নিবি নাকি মজিদ?’

‘উহু, দেরি হয়ে যাবে।‘

‘শহরটা বদলে গেছে একেবারে। মহারাজের চায়ের দোকানটা এখনো আছে?’

‘আছে।‘

হাঁটতে হাঁটতে ধর্মতলা পর্যন্ত চলে এলাম। ধর্মতলায় গা ঘেসে গিয়েছে হাড়গিলা নদী। আমি আর মজিদ গোপনে সিগারেট টানবার জন্যে কতবার হাড়িখালের পাড়ে এসে বসেছি। কিন্তু এখন নদী-নদী কিছু চোখে পড়ছে না।

‘নদীটা কোথায় রে মজিদ? হাড়িখাল এদিকেই ছিল না?’

‘ঐ তো নদী। সাবধানে আয়।‘

একটা নর্দমার মতো আছে এখানে। পা পিছলে পড়েই গিয়েছিলাম। সামলে উঠে দেখি নদী দেখা যাচ্ছে। আমরা নদীর বাধের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। সরু ফিতের মতো নদী অন্ধকারেও চিকমিক করছে। আগে এখানে এরকম উঁচু বাধ ছিল না। নদীর ঢালুপাড়ে সরিষার চাষ হতো। মজিদ চুপচাপ হাটছিল।

আমি বললাম, ‘ আর দূর কত?’

‘ঐ দেখা যাচ্ছে।‘

‘কার বাড়ি?’

‘আয় না চুপচাপ। খুব সারপ্রাইজড হবি।‘

একটি পুরনো ভাঙা দালানের সামনে দুজন থমকে দাড়ালাম। বাড়ি চারপাশ ঝোপঝাড়ে অন্ধকার হয়ে আছে। সামনের অপরিচ্ছন্ন উঠোনে চার-পাঁচটা বড় বড় কাগজি লেবুর গাছ। লেবুর গন্ধের সঙ্গে পুরনো গন্ধ এসে মিশেছে। অসংখ্য মশার পিনপিনে আওয়াজ।মজিদ খট খট করে কড়া নাড়তে লাগল। ভেতর থেকে মেয়েলি গলায় কেউ একজন বলল, ‘ কে?’

মজিদ আরো জোরে কড়া নাড়তে কাগল। হারিকেন হাতে একটি লম্বা রোগামতো শ্যামলা মেয়ে দরজা খুঁজে দিল। মজিদ বলল, ‘ কাকে নিয়ে এসেছি দেখ।‘

আমি কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। মেয়েটি হাসিমুখে বলল, ‘ আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন তো? আমি নন্দিনী। ‘

আমি মাথা নাড়লাম।

‘আপনি কবে দেশে ফিরেছেন?’

‘দুমাস হবে। এতদিন ঢাকায় ছিলাম। এখানে এসেছি গতকাল।‘

মজিদ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ ভিতরে আয় না। ভিতরে এসে বস।‘

ঘরের ভিতরটা বেশ গরম। একট কাচের ফুলদানিতে গন্ধরাজ ফুল সাজানো। চৌকিতে ধবধবে সাদা চাদর বিছানো। ঘরের অন্য প্রান্তে প্রকাণ্ড একটি ইজি চেয়ার। মজিদ গা এলিয়ে ইজি চেয়ারে শুয়ে পড়ল। হালকা গলায় বল, ‘ চিনি এনেছি। একটু চা বানাও।‘

নন্দিনী হারিকেন দুলিয়ে চলে গেল। আমিরা দুজন অন্ধকারে বসে রইলাম। মজিদ ফস করে বলল, ‘ সারপ্রাইজড হয়েছিস নাকি?’

‘হু'।

‘কেমন দেখলি নন্দিনীকে?’

‘ভালো।‘

‘শুধু ভালো? ইজ নট সি ওয়ান্ডারফুল?’

আমি সে-কথার জবাব না দিয়ে বললাম, ‘ এই বাড়িতে আর কে থাকে?’

‘সবাই থাকে।‘

‘সবাই মানে?’

মজিদ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ঠাণ্ডা গলায় বলল,’তুই একবার নন্দিনীকে প্রেমপত্র লিখেছিলি না? অনেক কবিতা-টবিতা ছিল সেখানে। তাই না?’

আমি শুকনো গলায় বললাম, ‘ বাদ দে ওসব পুরনো কথা।‘

মজিদ টেনে টেনে হাসতে লাগল।

পরের দশ মিনিট দুজনেই চুপ করে রইলাম। মজিদ একটার পর একটা সিগারেট টানতে লাগল। মাঝে মাঝে হাসতে লাগল আপন মনে।

‘অনেকক্ষণ আপনাদের অন্ধকারে বসিয়ে রাখলাম। ঘরে একটা মোটে হারিকেন। কী যে করি!’ নন্দিনী চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল।

‘চিনি হয়েছে চা'য়ে?’

কাপে চুমুক দিয়ে মজিদ বিষম খেয়ে কাশতে লাগল। আমি বললাম, ‘ আপনাদের এখানে খুব হাওয়া তো।‘

‘নদীর উপরে বাড়ি। হাওয়ার জন্য কুপি জ্বালানোই মুশকিল।‘

ভেতর থেকে কে একজন ডাকল, ‘ বউ, ও বউ।‘

নন্দিনী নি:শব্দে উঠে গেল। আমি বললাম, ‘তুই প্রায়ই আসিস এখানে?’

‘আসি।‘

‘ব্যাপার কিছু বুঝতে পারছি না।‘

আমি চুপ করে রইলাম। মজিদ বলল, ‘রাত হয়ে যাচ্ছে। এইবার ফিরব। নন্দিনীকে কেমন দেখলি বল না শুনি।‘

‘ভালো।আগের মতোই, একটুও বদলায়নি।‘

নন্দিনী আমাদের ঘাট পর্যন্ত গিয়ে দিল। ততক্ষণে চাঁদ উঠে গেছে।ম্লান জ্যোৎস্নায় চারদিক কেমন ভুতুড়ে মনে হচ্ছে। মজিদ বলল, ‘যাই নদিনী।‘

নন্দিনী কিছু বলল না। হারিকেন উঁচু করে বাধের উপর দাঁড়িয়ে রইল।

আমরা ধর্মতলা পর্যন্ত নি:শব্দে হাঁটলাম। একসময় মজিদ বলল, ‘ কলেজের ফেয়ারওয়েলে নন্দিনী কোন গানটা গেয়েছিল মনে আছে?’

‘না মনে নেই।‘

‘আমার আছে।‘

মজিদ গুনগুন করে একটা গানের সুর ভাজতে লাগল। হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল,’ জানিস, নন্দিনীকে আমিই এ বাড়িতে এনে তুলেছিলাম।‘

‘তাই নাকি?’

‘ওর বাবাকে তখন মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে।‘

‘সুরেশ্বর বাবুকে মেরে ফেলেছে নাকি?’

‘মারবে নাতো কি আদর করবে? তুই কী যে কথা বলিস! মেরে তো সাফ করে ফেলেছে এদিকে!’

আমি বললাম, ‘ সুরেশ্বর বাবু তো একটা গাধা ছিলেন। কত বললাম—মিলিটারি আসবার আগেই পালান। না পালাবেন না, একটা মাত্র মেয়ে সঙ্গে নিয়ে হুস করে চলে যাবে, তা না…’

মজিদ তখন একদলা থুথু ফেলে বলল,’ নন্দিনী তখন এসে উঠেছে হারুনদের বাসায়। হিন্দু মেয়েদের সে সময় কে জায়গা দেবে বল? কী যে মুসিবত হলো! কতজনের বাসায় গিয়ে হাত জোড় করে বলেছি, মেয়েটিকে একটু জায়গা দেবেন। এর বড় বিপদ। কেউ রাজি হিয় না। শেষকালে আজিজ মাস্টার রাজি।‘

‘আজিজ মাস্টার কে?’

‘এখানকার মিউনিসিপালিটি স্কুলের টিচার।‘

মজিদ একটা সিগারেট ধরাল। ঘনঘন ধোয়া টেনে কাশতে লাগল। আমি বললাম, ‘ পা চালিয়ে চল, বেশ রাত হয়েছে।’

মজিদ ঠাণ্ডা সুরে বলল, ‘নন্দিনী আজিজ মাস্টারের কাছে কিছুতেই থাকতে চায়নি। বারবার বলেছে--আপনি তো ইন্ডিয়ায় যাবেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যান। পায়ে পড়ি আপনার।

আমি ধমক দিয়ে বলেছি, ‘তুমি হিন্দু মেয়ে মুসলমান মেয়ের সঙ্গে যাবে, পথেঘাটে গিজিফিজ করছে মিলিটারি। নন্দিনী কী বলেছিল জানিস?’

‘কী?’

‘আন্দাজ করতে পারিস কিছু?’

আমি কথা বলার আগেই মজিদ চাপা গলায় বলল, ‘নন্দিনী বলেছে, বেশ। তাহলে আপনার বউ সেজে যাই। না হয় আপনি আমাকে বিয়ে করুন।’

মজিদ একদলা থুথু ফেলল। আমি বললাম, ‘আজিজ খাঁ বুঝি বিয়ে করেছে একে?’

‘হ্যাঁ।’

‘আজিজ খাঁ কোথায়? তাঁকে তো দেখলাম না।’

‘ ও শালাকে দেখবি কী করে? ও মুক্তিবাহিনীর হাতে মরেছে। দালাল ছিল শালা। হিন্দু মেয়েকে মুসলমান বানিয়ে বিয়ে করেছে। বুঝতে পারছিস না? আর নন্দিনী কীনা তার বাড়িতে মাটি কামড়ে পড়ে রইওল। হারামজাদী।’

আমি চুপ করে রইলাম। মজিদ দাঁড়িয়ে পড়ল। অকারণে গলা উঁচিয়ে বলল, ‘ মেয়ে মানুষের মুখে থুথু দেই। তুই হারামজাদী ঐ বাড়িতে পড়ে আছিস কী জন্যে? কী আছে ঐ বাড়িতে? জোর করে তোকে বিয়ে করেছে, আর তুই কিনা ছিঃ ছিঃ!’

দু’জনে বাঁধ ছেড়ে শহরের প্রশস্ত পথে উঠে এলাম। বড় রাস্তাটা বটগাছ পর্যন্ত গিয়ে বেঁকে গেছে ডানদিকে। এদিকেই সুরেশ্বর বাবুর বাড়ি ছিল। আমি আর মজিদ সেই বাড়ির সামনে শুধুমাত্র নন্দিনীকে একনজর দেখবার জন্যে ঘুরঘুর করতাম। কোনো কোনো দিন সুরেশ্বর বাবু দেখে ফেললে অমায়িক ভঙ্গিতে ডাকতেন, ‘আরে আরে তোমরা যে এসো, এসো চা খাবে।’ মজিদ হাতের সিগারেট কায়দা করে লুকিয়ে ফেলে বলতো, ‘আরেক দিন আসব কাকা।’

মজিদ নিঃশব্দে হাঁটছিল। আমি ডাকলাম, ‘এই মজিদ।’

‘কী?’

‘চুপচাপ যে?’

‘শীত করছে।’

সে কান পর্যন্ত চাদর তুলে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘জানিস, আমি আর নন্দিনী একটা গোটা রাত নৌকায় ছিলাম। রাতের অন্ধকারে আজিজ খাঁর বাড়িতে নৌকা করে ওকে রেখে এসেছিলাম।’ খুব কাঁদছিল সে। আমি ওর ঘাড়ে একটা চুমু খেয়েছিলাম।’ মজিদ হঠাৎ কথা থামিয়ে কাশতে লাগল। আমি চারদিকের গাঢ় কুয়াশা দেখতে লাগলাম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ