রুমা মোদক'এর গল্প : সাত বোন চম্পা

সচারপাশে ভেঙে ভেঙে পড়া বেতের বেড়া আর মাথার উপরে তালির পর তালি দেয়া চালাটা মাঝে মাঝেই অক্ষম হয়ে পড়ে আব্রু ঢাকতে। এই চলতি শ্রাবণের অঝোর বর্ষণের পানি যেমন অবাধ্য নিয়ন্ত্রণহীন, বেড়া আর চালার এবড়ো থেবড়ো পলিথিনের তালি ফুঁড়ে ঘরে ঢুকে পড়তে উদগ্রীব, ঠিক তেমনই নিত্য বাজারে আসা হাটুরে মানুষগুলো। প্রয়োজন অপ্রয়োজনে নানা অজুহাতে বেড়ার ফাঁক গলে উঁকি মারা ব্যাপারে কোনো ক্লান্তি নেই। কামলা-কাজলা, রিক্সাওয়ালা সবজিঅলা-মাছঅলাদের দূর দূর করলে লোকলজ্জা আর নিজেদেরই উল্টো সম্ভ্রম হারানোর ভয়ে দ্রুত সটকে পড়ে বেড়ার ফাঁক থেকে চোখ সরিয়ে। কিন্তু হাজেরা অসহায় হয়ে পড়ে যখন বাজার কমিটির সভাপতি মনাই মিয়া মাথার টুপিখানা পকেটে রেখে কাকের মতো চোখ বন্ধ করে ঘরে ঢুকে পড়ে। আর যখন মনাই মিয়াকে দেখেই তার নিজের ষোল বছর বয়সের ধিঙ্গি মেয়েটা পাল্লার আড়ালে পাউডার আর চিরুনি নিয়ে বসে যায় তখন হাজেরা বিবির অসহায়তা গভীর খাদের দিকে যেতে যেতে বিপন্নতায় পৌঁছে যায়।


যখন তখন এসে বকর বকর জুড়া লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটা সেদিন দ্রুত পায়ে পালিয়ে গেলেই, হাজেরা মুখ ফিরিয়ে দরজার সামনে মনাই মিয়াকে আবিষ্কার করে ঘাবড়ে যায়। মেয়েটাকে মনে মনে গাল দেয়, মানুষ দেখলেই পালায় কেন মেয়েটা, কাছে থাকলেও খানিক ভরসা থাকে ভেতরে। এসেই যখন পড়েছে আর উপায় কি, ঘাবড়ে যাওয়া অসহায়তা বিপন্নতা ইত্যাদি সবকিছু প্রাণপনে আড়াল করে মনাই মিয়াকে বসতে বলে হাজেরা। একচালা ঘরটার একপাশে রান্নার আয়োজন। চুলার আগুনের আঁচ গুমোট গরমটাকে আরো উত্তপ্ত করে ঘরময় ঘুরে বেড়ার অস্বস্তি নিয়ে। বিছানার পাশে পায়ার জায়গায় ইটের পর ইট বসিয়ে খাড়া রাখা ভাঙা সোফাটায় গা এলিয়ে বসে মনাই মিয়া। বাজার লাগোয়া সরকারি কোয়ার্টার ছেড়ে যাবার সময় মেজিস্ট্রেট স্যার এটা দিয়েছিল হাজেরাকে। অতিক্রান্ত সন্ধ্যাটির রাতের গভীরতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার এই থমকে থাকা সময়টাতে বাজারটা চুপচাপ। মেয়েগুলো কেউ ঘরে নেই, ছোট চারটা বাজার কমিটির অফিসে ঝাড়ুদার পাহারাদারদের সাথে চাটাইয়ে বসে জি-সিনেমায় দেব-শুভশ্রীর সিনেমা দেখে। ফুলী আর মোমেনা, বড় দুটো মেয়ে ঘরে ঢুকতেই হাজেরা অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে মনাই মিয়ার বিড়াল কটা চোখের শিকারী ভাষা পড়ে। ছার পান খাইন--বলে হাজেরা কৌশলে মেয়ে দুটোকে পুনরায় জয়তুন বিবির ঘরে পাঠায় পান আনতে। মনাই মিয়া নিজেকে লুকাতে ব্যর্থ হয়ে খানিকটা নির্লজ্জের মতো গলা উচুঁ করে--মাইয়াগুলারে বেটাইমে বাইরে পাডাইলায় ক্যারে? গরীবের আবার গর-বাইর, হাইঞ্জারাইত ত জয়তুন বিবির ঘরঅই থাকে-- বলে গোপনে স্বস্তিটা আড়াল করে। ক্যান যে পাঠালো, তা তো খুব ভালো করেই জানে দুজনে, একজন জানে আক্ষেপে অন্যজন অভিজ্ঞতায়। হাজেরার আপাত স্বস্তিতে যে আক্ষেপ আরো বাড়ে ঘুচে না মনাই মিয়ার, বিড়াল কটা চোখের দৃষ্টিতে তা স্পষ্টই পড়তে অসুবিধা হয় না হাজেরার। হাজেরার অসহায়ত্বই তার প্রধান সুযোগ, হাজেরার কিচ্ছু করার নেই, বলারও। এই বাজারে ছয়-ছয়টা মেয়ে নিয়ে বাজার কমিটির দেয়া এই ডেরাখানা ছেড়ে যাবার সামর্থ্য ক্ষমতা বা সাহস কোনটাই হাজেরার নেই। হাজেরা যেমন জানে মনাই মিয়াও জানে।

গর্জনে গর্জনে আকাশে মেঘ ঘনায়, ধেয়ে আসা বাতাস শ্রাবণের বার্তা নিয়ে আসলে ধপ করে নিভে যায় মাথার উপর ঝুলতে থাকা একমাত্র এনার্জি বাল্বটি। এটার লাইনটারও বাজারের লাইনের সাথে সংযুক্ত। বিল একসাথে যায়। হাজেরার হাত-পা কি কেবল একদিকে বাঁধা? বাইরে তখন আকাশ আরো গর্জে উঠে আসন্ন প্রসবের আর্তনাদে। ঘন-ঘন গর্জাতে গর্জাতে মেঘ নেমেই আসে অঝোর ধারায়, হাজেরা বিবি মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে সোফা লাগোয়া ঘরের পাল্লায় স্বস্তির আয়েশে হেলান দিয়ে। যা বৃষ্টি নেমেছে, মেয়ে দুটো সহসা ঘরে ফিরবার সুযোগ বা সম্ভাবনা নেই। কমিটির অফিসে সিনেমা দেখা মেয়ে চারটার জন্য খুব উৎকন্ঠা জাগে না, দিনমান এগুলো বাইরে বাইরেই ঘুরে। এসময় মনাই মিয়ার সাথে দুচারটা কথা বলা ভদ্রতা, বেচারা ঘরখানায় থাকতে দেয়া ছাড়াও চাল-নুন কেনার জন্য হাত-পাতলে তার কাছে যে কিছু পাওয়া যায়, এটাতো কম নয়। মনাই মিয়ার দৃষ্টি কিংবা মনোযোগ কিছুই ভদ্রতার ধার ধারে না। বয়সের ভারে ফুলে উঠা মাংসের কোলে ছোট হয়ে আসা চোখের বিড়াল কটা দৃষ্টি থেকে শিকারের নেশা ছুটে না। হাজেরা জানে না কদিন এই শিকারী চিলের নজর থেকে মেয়েগুলোরে আগলে রাখা যাবে। মেয়েগুলোই যেখানে বেয়াড়া মাছ, নিষেধ-শাসন না মেনে হাতে দু দশ টাকা গুঁজে দেয়ার বিনিময়েই ভেসে বেড়ায় জলের উপরে উপরে। আল্লাতালা কতোদিন যে এই ঈগলের চোখের সামনে ইঁদুর ছানা করে রাখে....... ভাবতে ভাবতে মনাই মিয়ার পা ঘেঁষে সরে বসে হাজেরা। ব্লাউজহীন হাতখানা লেগে থাকে মনাই মিয়ার হাঁটুতে। মোমবাতির অস্পষ্ট আলোর জন্য কী না কে জানে মনাই মিয়ার খেই থাকে না। ভরা জ্যৈষ্ঠের মধুফলের সন্ধান তার শ্রাবণের গাছে ঝুলা অন্তিম ফলের স্বাদে পথ হারায়। বড় মেয়ের সাথে বছর ১৫ ফারাক, কতো আর বয়স হাজেরার। কূলবধূর যত্নে থাকলে দেখার মতোই হতো বটে।

বর্ষণ থেমে গেলে থমকে থমকে গর্জাতে থাকে আকাশ, থামায় শেষ নয়। আবার যখন তখন নেমে আসতে পারে অশ্রান্ত ধারায়। একটুখানি ফাঁক পেয়ে ঘর ছাড়ে মনাই মিয়া। ইলেকট্রিসিটি না আসার কারণে সিনেমা দেখা অসমাপ্ত রেখে ঘরে ফিরে ছোট মেয়েগুলো। এদের পাতে ভাত আর শাকপাতার শুটকি সালুন তুলে দিতে দিতে হাজেরা বিবি ক্লান্ত হাই তোলে, বড় দুটো আর ঘরেই ফিরেনি, বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে জয়তুন বিবির ঘরে। বুঝি স্বস্তিও কিছুটা সাথ দেয় ক্লান্তির--মেয়েদুটোকে বোধ হয় বাঁচাতে পারলো এ যাত্রা।


২.

আসলেই লক্ষ্মীমন্ত চেহারা মেয়েটার। ঠিক যেমন একটি সন্তানের আকাঙ্ক্ষা জেগে থাকে মাতৃত্বের গোপনে। স্বল্প সামর্থ্য আর সসীম সাধ্যে বেড়ে উঠা সন্তানগুলো মোটেই তেমন হয় না একদম। যতোই নিজের জীবনের ভুলভাল ছায়া থেকে আগলে রাখতে চায়, কী এক অদৃশ্য অনিবার্য চৌম্বকত্বে তারা সেদিকেই ধায়। এই মেয়েটাকে দেখলে, তার তেলমাখানো চুপচাপ বসে থাকা চুলের গোছা, সেই তেলের মুখ বেয়ে নেমে আসার মায়াবী রাতে কী যে ভিতরে জাগে হাজেরার, কী যে আছে চেহারাটায়! শান্ত-স্নিগ্ধতা....... হাজেরা শব্দগুলো খুঁজে পায় না, না পাক তাতে কি, মনটা তার ভরে থাকে। একটু বেশি বকর বকর করে মেয়েটা, মাঝে মাঝে বিরক্তি ধরে যায়। ঘরটা খালি পেলেই কথা নেই, একখানা পায়ের উপর আরেকখানা পা তুলে শুরু করে বকর বকর। জানেও বটে মেয়েটা, কিভাবে যে এই সংসারটার বৃত্তান্ত নখদর্পণে নিয়ে ঘোরে আল্লা মালুম। ফুলির খোসপ্যাঁচড়া, মোমেনার পেটবেদনা নিয়ে কথা বলে ঠিকাছে, কেমনে জানলো ভেবে হাজেরা অবাক হয়ে শোনে, কিন্তু যখন কোনো কারণ ছাড়াই হাজেরার কষ্টের বৃত্তান্ত খুঁচিয়ে দরদ দেখাতে আসে তখন বিরক্তির সীমা থাকে না।

হাজেরা অস্বীকার করে না, মেয়েটি যা বলে তার একবিন্দু মিথ্যা, তবু নিজের যে কতোখানি কষ্ট একেবারে নিজের, চাইলেও এড়ানো সম্ভব নয়, মেনে নেওয়াই নিয়তি, তা মেনে নিয়েই তো চলছে দিন। হাজেরা তো কারো কাছে সেই কষ্টের ঝাঁপি খুলে বসে না, তবু কেউ গায়ে পড়ে খোঁচাতে এলে ভালো লাগে না হাজেরার। দরদ, আহারে দরদ। মেয়েটার দরদ কী কমাতে পারবে তার সামান্যতম দুর্গতিও? এই মেয়ে কেন দুনিয়াতে কারো সে ক্ষমতা নেই। তবে কেন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পুন:পুন: রক্তাক্ত করা দগদগে ঘা, বারবার জানানো সে কষ্টে আছে, কষ্টে আছে। হাজেরা বিবির স্ফীত হয়ে উঠতে থাকা পেটের দিকে অভ্যাসের চোখে তাকিয়ে দরদে গলে পড়ে মেয়েটি--আবার পেড বান্ধাইছ? হাজেরা জানে, খুব ভালো করে জানে ঘরে তার ছয়-ছয়খানা মেয়ে, আবার পোয়াতী সে। পঞ্চম মাসে পড়া স্ফীত পেটখানা হাড়গিলে শরীরের কারণে স্পষ্টই চোখে পড়ে। তা আবার জিজ্ঞেস করে জানতে হয় নাকি? হাজেরা বিবি ঠোঁট উল্টায় বিব্রত বিরক্তে-- দেহস না? এই নিয়া সাতবার.......। মেয়েটা মুখের কথা কেড়ে নেয়- সাতবার না গ, সাতবার না, আটবার। হাজেরা বিবি চুপ করে যায়, কথা বাড়ায় না। সর্বনাশ, এই মেয়ের জানার অতীত বোধহয় কিছুই নাই, হাজেরা বিবির সন্দেহ হয়। কোন কথার জের ধরে কোন কথা বের হয়ে পড়ে। কিন্তু ঐদিকে আগায় না মেয়েটা-- ভাবছ কিতা একখান পোলা অইলেই মাইয়াগুলার বাপে ঘরমুখী অইবো? মিছা আশা। মুখের কথা ফুরায় না, দূর থেকে জয়তুনবুরে আসতে দেখে সটকে পড়ে মেয়েটা। ভালোই হয়। হাজেরার পিত্তিটা জ্বলে গিয়েছিল মেয়েটার কথায়। মনে যে ক্ষীণ আশা ছেলের মুখ দেখলে ঘরে মন ফিরবে মিয়াধন মিয়ার, মেয়েটির ইঁচড়ে পাকা কথা যেন দমকা হাওয়ার মত দপ করে নিবিয়ে দিতে চায় তেলহীন নিবু নিবু সলতেটা। ছেলে হলেই মিয়াধন মিয়া বউকে নিয়ে বাপের ভিটায় যাবে অধিকার প্রতিষ্ঠায়, হাজেরা মেয়েগুলোকে নিয়ে শকুন-চিলের দৃষ্টির আড়ালে একটু হাঁফ ছাড়বে, বড় অপেক্ষা তার। ছেলে হলেই শাশুড়ি ভিটায় উঠতে দেবে, মিয়াধন মিয়ার কথাখানি কতটা সত্য কতটা মিথ্যে কে জানে, হাজেরার অপেক্ষায় মিথ্যে নেই। মেয়েটার ঠাস ঠাস মুখের উপর বলে দেয়া কথাগুলোতে মেজাজ উত্তপ্ত হলেও মেয়েটার দেয়া আটবারের হিসাবটা মাথায় মৃদু আনন্দের ঢেউ তুলে। হ্যাঁ, আটবার, আটবারই তো।

জয়তুন বিবি পানের ডিব্বাটা পাশে রেখে পা ছড়িয়ে বসে প্লাস্টিকের মোড়ায়। মোড়ার মাঝখানটায় বিশাল ছিদ্র, বসার উপযোগী করার জন্য একটু করা হার্ডবোর্ড রাখা হয়েছে উপরে। তাতে পাছা লাগিয়ে পানের গায়ে চুন-খয়ের-জর্দার নকশা আঁকতে আঁকতে জয়তুন আব্দার করে-- অ বউ ফ্যানডা একবার ছাড়সনে, একটুখান শীতল অইবার লাগি আইছিনু। প্লাস্টিক স্ট্যান্ডের ফ্যানটা পাশের ভাংগারি দোকান থেকে দুইশো টাকায় কেনা হয়েছিল মেয়েগুলোর বাপ গরমে ঘুমাতে পারে না বলে। সে কালেভদ্রে ঘরে আসে কিন্তু ঘটর-ঘটর শব্দে ফ্যানটা অন্যদেরও ভালোই বাতাস দেয়। সুইচ টিপে হাজেরা পাশে বসে ঘ্যান ঘ্যান করে-- অ বু ইবারঅ যদি পোলা না অয়, তে বুঝঅ আটখান মাইয়া! জয়তুন বিবির কপালে একটুখানি ভাঁজ পড়ে। উঠে জানালা দিয়ে পানের পিক ফেলে আবার ফ্যান বরাবর মোড়াটা সোজা করে বসে, যেন বাতাস একটুও এদিক সেদিক পালাতে না পারে। ভাবে হাজেরা কি মেয়ের হিসাবে ইচ্ছে করেই ভুলটা করছে? জয়তুনই তাকে বলেছিল সাত ভাই চম্পার ধাতের কথা। গ্রামের গোটা কয় দৃষ্টান্তও দেখিয়েছিলো হাতে কলমে যেমন আব্দুল গনি আর আসিয়ার ঘরে সাত ছেলের পর একটা মেয়ে, আবার শ্রীদাম-সুলেখার ঘরে সাত মেয়ের পরে একখান ছেলে। ছয় নম্বর মেয়েটার জন্মের পর জয়তুন মোটামুটি নিশ্চিত হয়েই সান্তনা দিয়েছিল হাজেরাকে। হিসাবে আরো একটা গর্ভের পরই ছেলে হবার কথা হাজেরার। কিন্তু হাজেরা এবারই একটা বেশি গুনছে। সে কী ভুল করে না খেই হারিয়ে হাজেরার মুখের নিষ্পাপ ভাঁজে তা ঠিকঠাক আবিষ্কার করতে পারে না জয়তুন। মনে মনে মুচকি হাসে আক্ষেপে আর বেদনায়, আহারে বেচারী, আল্লার হিসাবে কী আর ভুল হয় রে, তুই যতোই ভুল হিসাবে নিজেকে ভুলিয়ে রাখ.......।


৩.

ভর দুপুরে ফুলীর পাউডার ঘষা চেহারাটা দেখেই পিত্তি জ্বলে যায় হাজেরার। বিয়ের বয়স হয়েছে এটা ঠিক, এই বয়সেই ফুলিকে গর্ভে ধরেছিল সে। বিয়ে দিলে ফুলীও ঠিক সন্তানের মা হবে। সামর্থ্যের অভাবেই না কাজটা সময়মতো করা যাচ্ছে না। এই বয়সের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক জোয়ার শরীর মনকে উতলা করবে অবাক হবার কিছু নেই, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টাটা তো নিজেরই থাকতে হয়। কিন্তু এই ধিঙ্গি মেয়েটার চাল-চলন দেখলেই হাজেরার পিত্তি জ্বলে। লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটা না মাত্রই উঠে গেল। কই এই মেয়েটাতো চামড়ায় পাউডার ঘঁষায় না। শ্যাম্পু ধুয়া উড়ানো চুল ফ্যাসাং করে ঢংও ধরায় না। কী সুন্দর এসেই হাজেরার কাজে হাত লাগায়। অর্ধেক কাজ শেষ করে দিয়ে যায়, কই তার মনটাতো ফুলীর মতো উড়ু উড়ু নয়। কিসের মায়ের কাজে সাহায্য করা কিসের সংসারের টানাপোড়েনের খবর রাখা, দিনমান ফুলীর কাজ পেখম ধরা, মুখে পাউডার ঘঁষা আর চুলগুলায় নানা কিসিমের ফ্যাসাং ধরানো, পিছনে অপু-শাকিবের ছবি সাটা আয়নাটা হাত থেকে রাখেই না। কী না চেহারা, রং খানা তো বাপের, নিত্য খাবারের অনটনে, তেল সাবানের স্পর্শহীন অযত্নে স্বাস্থ্য চেহারা তো ঐ বাজারে ঘুরে বেড়ানো কুত্তাগুলোর মতো চেহারা যাই থাক কিন্তু বাপের তদারকিহীন গরীব ঘরের মেয়ে অনেকটা রাস্তার পাশের বেওয়ারিশ গাছের আমের মতো, স্বাদ টক মিষ্টি যাই হোক, আসতে-যেতে বালকের দল ঢিল ছুঁড়বেই। আর সেখানে মেয়েগুলো হয়েছে আরেক কাঠি বাড়া, সাধ করে ঢিল গায়ে পেতে নিতে জুড়ি নেই। যৌবনের ঢল নামা বড় মেয়ে দুটোর ভাবসাব হাজেরাকে স্বস্তি দেয় না, বয়সটা নিজেও পার হয়ে এসেছে কি না। নিজের জীবনের পুনরাবৃত্তি না ঘটুক মেয়ের জীবনে এই দুরাশায়ই নিষ্ঠুর সংগ্রামের হাল ধরে আছে মরতে মরতেও। নইলে একের পর এক ক্রমশ সোমত্ত হয়ে উঠা মেয়েগুলোরে নিয়ে বাজার কমিটির তৈরি করা বস্তিঘরে জীবন কাটানো কি সহজ যুদ্ধ? কিন্তু মেয়েগুলো এই যুদ্ধের ধারেকাছে নেই। যে হাজেরার ঢোল হয়ে উঠা পেট, তা বোধহয় চোখেই পড়েনি ফুলী-মোমেনার। অথচ আরো মাসখানেক আগেই লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটা দরদে জড়িয়ে ধরে বলেছে-- ক্যান যে আবার পেড বান্ধাইতে গ্যালা, কী কষ্ট গো তোমার। মেয়েটার না হয় হাজেরার জন্য অসীম দরদ। কিন্তু যে দেখে সেই তো বলে ধমকে বলে, কৌতুকে বলে। এমনকী পুরানবাজার জামে মসজিদের ইমাম ও ‘মুখ দিয়াছেন যিনি, আহার দিবেন তিনি’ আপ্তবাক্য ভুলে মুখ কালো করে বলেন--এই জমানায় এমুন কাম!! অথচ ধিঙ্গি ফুলী-মোমেনার তা চোখেই পড়ে না যেন। সারাদিন ধেই ধেই। তাদের টিকির নাগালও পায় না সে। দুর্বল শরীরে সারাদিন ঘানি টানতে টানতে নিজের উপরই ঘিন্না ধরে যায় হাজেরার।

সবাই ভাবে ভুল কিংবা অসচেতন মূর্খতা। হাজেরা লজ্জায় মুখ ঢাকে। কারে বলে, কেমনে বলে সে প্রতিবার সে টের পায় সময়মতো। প্রথমটায় মাসিকের নির্ধারিত তারিখটা পার হয়ে গেলে ঘন ঘন বস্তির শেষমাথায় পরপর ঘা ঘেষাঘেষি করে দাঁড়ানো দরজায় ছালা ঝুলানো লেট্রিনে বারবার গিয়ে যখন রক্তের দেখা না পেয়ে নিশ্চিত হয়, তখন মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় জয়তুন বিবিকে ধরে যেভাবেই হোক টাকা কয়টা জোগাড় করে টাউনের সেন্ট্রাল পলি ক্লিনিকে যাবেই যাবে। প্রতিবারই এমন হয়। জয়তুন বুর জেনে আসা টাকার অংকটা অবশ্য একটু বেশি, ছয় হাজার, কোনদিন একসঙ্গে চোখে দেখেছে কী না মনে করতে পারে না। জোগাড়ের আয়োজনে সময় পেরিয়ে যায়। ততোদিনে স্ফীত পেট দৃশ্যমান হতে থাকে। আর মনে মনে সান্ত¦না কিংবা আশা জিইয়ে বাকী মাসগুলো পার করে হাজেরা, এবার ছেলে না হয়ে যায়ই না।

পোলাই বিয়ান লাগবো, নিজে মরতে মরতে পোলাই বিয়ান লাগবো--শিয়রের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটার দরদটুকু মোটেই আলগা লাগে না। পুরো সংসারের বৃত্তান্ত যে নখদর্পণে নিয়ে ঘুরে, সে কী আর না জানে কেন পোলাই জন্ম দেয়া লাগবে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় হাড়-মাংস কুঁকড়ে যায় হাজেরার। আটবার, হ্যাঁ এই নিয়ে আটবারই। জয়তুন বিবি যতোই সাত ভাই চম্পার কাহিনী শোনানোর বাহানায় হাজেরার ভুল ধরিয়ে দিক, হাজেরা তো নিশ্চিত করেই জানে আটবার। প্রতিবারই যন্ত্রণা তার এমন অসহ্য বোধ হয়, রক্তে পানিতে কাতরাতে কাতরাতে সে আল্লাকে ডাকে, আল্লা মুক্তি দিক, আল্লা মরণ দিক। কিন্তু না মরণ হয় না। বরং সবগুলো বাচ্চা ঠিকঠাক খালাস হয়ে যাবার পর যখন প্রসব যন্ত্রণার চেয়েও ভয়াবহ যন্ত্রণা সামনে এসে পথ আগলে দাঁড়ায় তখন তার পুনরায় মরবার সাধই জাগে। প্রতিবারই মিয়াধন মিয়া ছেলের মুখ দেখবার আশায় ঘরে আসে আর পুনরায় ফিরবে না হুমকি দিয়ে চলে যায়। এই আসাযাওয়া অবশ্য বিরতি দিয়ে চলতেই থাকে, কিন্তু কোনটাই সুখের হয় না। ঘরে ঢুকেই সে রুক্ষ মেজাজ দেখায়, বড় মেয়েগুলোরে ধমকাধমকি করে, ছোটগুলোরে তেড়ে মারতে যায়। খুব সামান্য কারণেই যায়। হাজেরা জানে কারণ না থাকলেও যেতো। নিজের জ্বালা তো হাজেরা পাওনাই মনে করে। সংসারের খরচা-পাতি কিছু দেয় বটে, সেও মেয়েগুলো ছেঁড়া জামা আর ছেঁড়া প্যান্ট পরে দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে বারবার হাত পাতে বলে আর আশেপাশের মাছুয়ারা ধমকাধমকি করে বলে। এই জোর-জবরদস্তি করে সংসারে তবে মিয়াধন মিয়াকে আটকে রাখার দরকারটাই বা কি।

হাজেরা অসহ্য ব্যাথায় হাঁফাতে হাঁফাতে ভাবে আসলেই কি ছেলেসন্তান জন্ম দিলে মিয়াধন মিয়া তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে শাশুড়ির হাতে সমঝে দিয়ে আসবে? ভবিষ্যত স্বস্তির জন্য আর কিছুই দরকার নেই তার। হাজেরার কষ্টে লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটা চঞ্চল হয়, বারবার দরজায় যায়, আবার শিয়রে বসে, বিড়বিড় করে-- আহারে কী যে কষ্ট! জয়তুন খালাও এতোক্ষণ ধইরা আসে না ক্যান! একবার মাইয়াগুলার বাপরে খবর দিমু নি? না, না-প্রচণ্ড ব্যাথার হাতুড়ি পিটানোতে হাজেরা পাঁজর আঁকড়ে লেগে থাকা বুকটা উঠা-নামা করে কামারের দোকানের হাঁপড়ের মতো। হাজেরা কষ্ট গিলে খেতে চায় ‘না-না’ বলে। যদি মিয়াধন মিয়া এবারো ঘরে ফিরে মেয়ে সন্তানেরই খবর পায়, নিশ্চিত দরজার বাইরে থেকে তালাক দিয়ে চলে যাবে। লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটার মুখ থেকে কোমল দরদ সরে গিয়ে কষ্ট আর ক্ষোভ মাখামাখি করে--আমিঅ যেমুন, খবর দিলেঅই য্যান ব্যাটা দৌড়াইয়া আসবে আর কি? না আসবে না, এই সত্যিটা যতো রূঢ়ই হোক, সত্যই। বাজারের যেখানটাতে বসে মাছ বেচে সে, তার পাশে বসেই মাছ কাটে কালো কুচকুচে মাছুনি। বাজারের ছোট বড় সক্কলে তার ব্লাউজ আর শাড়ির ফাঁকে ঘামাচি-অলা কালো কুচকুচে পেট দেখে। তাতে তার কিচ্ছু যায় আসে না। দিব্যি দিনভর সে গলা বাড়িয়ে ঝগড়া করে খরিদ্দারদের সাথে মাছ কাটার টাকা নিয়ে। রাতের পর রাত তার ঘরেই রাত কাটায় মিয়াধন মিয়া। বয়সের কারণেই তার পেটে তেমন তাগিদ নেই যে চটকদার চাটনি রেখে লবণভাতের কাছে ফিরবে। তাগিদটা হাজেরার বেশি, মাথার উপর মানুষটা এখনো ঝুলে আছে বলেই ভরা বাজারে মেয়েগুলোকে শেয়াল-কুকুরে টানাটানি করে না। মানুষটা গাঁয়ে চেয়ারম্যানের লাঠিয়াল ছিল আর খুনের আসামী হয়ে যে এ বাজারে গা-ঢাকা দিয়ে আছে সেই কিচ্ছা বাজারের ডালেপাতায় ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। তার উপর দিনভর-রাতভর অত্যাচার অনাচারের পরও তার কালো তাগড়া পেশিতে যে জোর, সবাইকে সমীহ করতে হয়। আর গ্রামে ফিরে বর্তমান জীবনের সব অসহ্য অস্বস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার উচ্চাশার তাগাদাটা তো আছেই, বিয়ের আগে পোয়াতী হওয়ার কানকথা শুনে সেই যে শাশুড়ি ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলো, আর ঘরে উঠতে পারে নি হাজেরা। টাউনের বাজারের এই অসহ্য নিষ্ঠুর জীবনটাকে এতো বছর টেনে নিয়ে নিয়ে আরো পোক্ত করে দিয়েছে পরপর জন্ম নেয়া মেয়েগুলো।

জয়তুন বিবি চিৎকার করে--কইরে ফুলি, কইরে মোমেনা, বাপরে খবর দে, তোগো ভাই অইছে। জয়তুনের আনন্দ আর ধরে না। আল্লাতালার দয়ার শরীর, হাজেরার ভুলভাল গুনার হিসাবটা ঠিক আমলে নিয়েছেন। আল্লা অর্ন্তযামী, কী দয়াই না দেখিয়েছেন হাজেরাকে। ‘মাইয়া-বিয়াইন্না’ বলে কী মারটাই না মারতো বউটারে, পাশের ঘর থেকে সহ্য হতো না জয়তুনের। এবার যদি সংসারটার দিকে একটুখানি মন ফিরে মেয়েগুলোর বাপটার। বউটার কপালে একটু স্বস্তি জোটে। বউটার যে বড় স্বস্তির খোঁজ। জয়তুন বিবি নিজেই দৌড়ায় বাজারের দিকে মেয়েগুলোর বাপের খোঁজে।


৪.

মনাই মিয়া চলে যাবার পরপরই লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটা আসে। আকাশ-পাতাল, সমুদ্র উত্তাল ভাবনায় আধমরা হাজেরা। শরীরের প্রসবোত্তর ক্লান্তি তুচ্ছ এর কাছে। মনাই মিয়া ছেলের মুখ দেখে পাঁচশত টাকার কড়কড়ে নোটখানা হাতে গুঁজে দিয়ে জানিয়ে গেছে, ছেলের চোখগুলো যে তার মতো বিড়াল-কটা এটা সে আপাতত কাউকেই বলবে না। এই না বলা যে বলার চেয়েও কতোটা ভয়ংকার হয়ে উঠে তা হাজেরা ভীষণভাবে বুঝতে পারে, যখন মনাই মিয়া কটা চোখের শিকারী দৃষ্টিতে কেবল মোমেনা ফুলিকে খুঁজে বেড়ায় পাল্লার পিছনে, ঘরের আনাচে কানাচে। আসন্ন বিপদাশংকায় সদ্যপ্রসবা পরিশ্রান্ত হাজেরা গভীর দুশ্চিন্তায় মুষড়ে পড়ে ভিতরে বাইরে। কী গভীর সংকট!! কোথায় সাতকন্যা জন্মের পর পুত্রজন্মের আনন্দ। এই কটা চোখের বৃত্তান্ত ফাঁস হলে? হাজেরা যখন সাঁতরে মাঝনদীতে গিয়ে আর ফিরে আসবার দম পায় না, তখনই লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটা এক পোটলা লবণ হাতে গুঁজে দেয় হাজেরার-- একবার আমার মুখঅ দিয়ো নিজেরে বাঁচাইছিলা, ইবার পোলার মুখঅ দিয়া বাকী মাইয়াগুলারে বাঁচাও।


-----------------------------------------------
রুমা মোদক'এর গল্প 'সাত বোন চম্পা' নিয়ে আলোচনা পড়ুন--
আলোচক : দীপেন ভট্টাচার্য



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ