জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা
গল্পের নামটি চোখে পড়তেই, সমুখের দৃশ্যপট দ্রুত পেছাতে থাকে। কল্পনা-জগৎ কি কোন একটি সময়ের সাক্ষী হতে চায়? হবে হয়তো বা! ‘১৯৪০ সাল।’ -গল্পটা শুরুও হয়েছে এভাবে, পাঠককে নির্দিষ্ট এক সময়ে আছড়ে ফেলে! লেখক শুধু নামকরণ এবং প্রথম বাক্য দিয়েই পাঠকের সামনে ছোট একটি জানালা খুলে দিয়েছেন। এ জানালা দিয়ে ঠিক কি কি তিনি দেখাবেন তা এখনই বোঝা না গেলেও, পাঠকের কল্পনাকাশ একটি তীব্র যুদ্ধ-লগ্নের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে। গল্পের নাম এবং সূচনাকথা দেখেই মনে হচ্ছে, লেখক রমাপদ চৌধুরী ছোটগল্পের অন্য সব উপাদানগুলোকেও এক ঝলকে দেখে নিতে বলছেন! চেষ্টা করাই যাক তাহলে, নির্নিমেষ দৃষ্টিপাতে গল্পটির অলি-গলি, অবকাঠামো সব দেখে নেবার।
লেখক এ গল্প শুরু করেন তাঁর ছাত্রাবস্থায় দেখা যুদ্ধ-পূর্ব একটি সময়কে উত্তম পুরুষে বর্ণনা’র মাধ্যমে। পরাধীন দেশের স্বাধীনতাকামী উত্তাল সে সময় থেকে শুরু করে, দেশে যুদ্ধাবস্থা এবং যুদ্ধোত্তর সময় পর্যন্ত তিনি ভিখারী একটি মেয়েকে দেখেছেন। আর ‘সে দেখা’ই এই গল্প। ১৯৪০ সাল, ১৯৪২ সাল, ১৯৪৩ সাল, ১৯৪৪ সাল এবং সব শেষে ১৯৫০ সালের উল্লেখ করেই লেখক সে ‘দেখা’কে করেছেন বিবৃত। গল্পের ঘটনা এগিয়েছে - সময়ের সাথে ভিখারী মেয়েটির ভিক্ষাবৃত্তির কৌশল, জীবিকা বদল, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতপূর্ণ জটিলতায় আরোহণ এর মধ্য দিয়ে। ছোটগল্পে সাধারণত একটি মূল ঘটনাকে এগিয়ে নিতে ভিন্ন ভিন্ন টুকরো ঘটনার সমাবেশ ঘটানো হয়। প্রধান চরিত্রের সাথে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রেরও আগমন হয়। এখানে তেমনটি ঘটেনি। লেখক এখানে বিশাল কোন ক্যানভাসের পথেও এগোননি। ছোট ছোট ফুটেজের মাধ্যমে চলচ্চিত্রকার যেমন একটি শর্টফিল্ম বানান, এ গল্প লেখার ধরণটিও যেন অনেকটা তেমন! এই গল্পে নামহীন সে ‘ভিখারী মেয়েটি’র মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ‘সময়’ এবং ‘তৎকালীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি’। মেয়েটিকে বিভিন্ন ভূমিকায় বেশ কিছু ক্লাইমেক্সে আরোহণ এবং অবরোহণ করতেও যে দেখা যায় তা সেই সময় এবং পরিস্থিতির জন্যই। আর লেখক সেই সময়কে সাজিয়েছেন সরল এবং স্পষ্ট সব ধারাক্রমে। গল্পের কাহিনী বিন্যাসে একের পর এক দৃশ্যপট বদলালেও, তাই প্লটটিতে পাঠকের অবিন্যস্ত হবার কোন সুযোগ নেই।
মেয়েটি সম্ভবত বছর তের’র ছিল, যখন লেখক তাকে প্রথম দেখেন। হ্যারিসন রোডের পানের দোকানটার কাছেই প্রথম ভিক্ষা দিয়েছিলেন কিশোরী সে মেয়েটিকে। মেয়েটির ভিক্ষা চাওয়ার কারণটি বানোয়াট বুঝতে পারলেও লেখক ভিক্ষা দিয়েছিলেন; কারণ তার অভাব বা প্রয়োজনটি বানানো মনে হয়নি। আর দশটি ভিখারী’র চেয়ে কিছুটা অন্যরকমও হয়তো সে ছিল, তার ফর্সা পাতলা রুগ্ন মুখখানিতে। লেখক যখন যেখানে তাকে দেখেছেন, চিনতে পেরেছেন। বেশ কিছুদিন পরে মেয়েটির তরুণী অবস্থায় তার ভাগ্যের কিছুটা উন্নতি দেখা যায়। লেখক তা অবাক চোখে দেখেন এবং আমাদেরকেও দেখান। লেখক দেখলেন, মেয়েটিকে আর ভিক্ষা চেয়ে কিছু বলা লাগছে না; মানুষের সামনে গিয়ে হাত পাতলেই সবাই কম,বেশি দু’এক পয়সা দিচ্ছে। নারীত্বের এই অবমাননাটুকু গল্পের এ পর্যায়ে উঁকি দিয়েছে মাত্র, বলা যায় পূর্বাভাস! লেখক গল্পের শেষ পর্যায়ে আরেকবার সেই অবমাননার চূড়ান্ত অবস্থাটি স্পষ্ট করে দেখান, যা সকল যুগের সকল যুদ্ধে নারীর জন্য তীব্রভাবে বিদ্যমান। আকর্ষণীয় গল্পে প্রায়ই বিভিন্ন রকমের বাহ্যিক আঘাত, সংঘাত আসে। এ গল্পে মেয়েটির জীবনে খুব সহজাতভাবে যেই চড়াই-উতরাই এসেছে, সেগুলো আভ্যন্তরীণ। সেসবই গল্পটিকে এগিয়ে নিয়েছে এবং গল্পের কাঠামোকে চারপাশ থেকে জুড়ে গিয়েছে।
পরবর্তীতে দেশের যুদ্ধাসন্ন অবস্থায় দৃশ্যপট কিছুটা পাল্টায়। লেখকও এক পর্যায়ে মেয়েটিকে পয়সা দেওয়া বন্ধ করে দেন, সে সময়টির খুব বেশি ব্যাখ্যায় অবশ্য তিনি যান না! শুধু এভাবে বলেই পুরো চিত্রটি বুঝিয়ে দেন - “মেয়েটিকে অনেকেই নিরাশ করতে শুরু করলো। একটা আনির তখন কোনো দাম নেই বলেই একটা আনিরও তখন অনেক দাম।” এটাই ছোট গল্পের জাদু~ কিছুই তেমন না পড়েও, অনেক কিছুই পড়া হয়ে যায়। যাইহোক, চরম সে অর্থনৈতিক মন্দায় চারপাশ যখন রুক্ষ, মানুষ তখন ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠছে, প্রতিবাদী হচ্ছে। এই বিষয়টিকেও লেখক কোথাও স্পষ্ট করে বলেননি; অথচ দেখা যাচ্ছে। দেখা যায়, একদিন বাসের ভেতরে এক সম্বলহীন যাত্রীর ভাড়া নিজে মিটিয়ে দিয়ে, বাস-কনডাকটরের অন্যায়ের প্রতিবাদে মেয়েটি জোরালো প্রতিবাদ করছে! লেখকের বিশ্ময় আরও বাড়িয়ে, মেয়েটিকে আবারো অন্য রূপে দেখা যায় বেশ কিছুদিন পর। এবার বাসে দাঁতের মাজন, প্যাকেটজাত খাবার ইত্যাদি ফেরি করে চলা এক স্বনির্ভর মানুষরূপে তাকে দেখা গেল। হয়তো এই পর্যায়ে এসে পুনরায় চোখ বুলিয়ে নিতে ইচ্ছে হবে লেখকের বর্ণিত ‘১৯৪২ সাল’ এর দিকে, সময়ের সাথে মেয়েটির এ পরিবর্তনটিকে মিলিয়ে নিতে!
সত্যিকারের সাসপেন্স সেভাবে না থাকলেও, দেখা যায় পাঠকের আগ্রহী মন ধীরে ধীরে আটকে যাচ্ছে, মেয়েটির সাথে। এ গল্পে লেখক অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে করেছেন, মূল চরিত্রের এ সেটিংটি। মেয়েটির চেহারার বর্ণনা এখানে থাকলেও পাঠকের কাছে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাওয়া মেয়েটির একটিভিটি। তাই আরও কিছুদিন পরে যখন কালীঘাটের মন্দীরের কাছে মেয়েটিকে একটি ছেলের সাথে সিঁদুর পরিহিতা অবস্থায় দেখা যায়, পাঠকও লেখকের মতোই মনের অজান্তে খুশি হয়ে ওঠেন। আবার বেদনার্তও হয়ে ওঠেন কিছুদিনের ব্যবধানেই যখন তাকে দেখেন বিধবার বেশে, একটি শিশু কোলে ভিক্ষা সে ভিক্ষা করছে। অনেক দিন আগের পুরনো একটি চরিত্রকে আজকের পাঠক যখন ‘কাছের মানুষ’ ভাবতে পারে, ছোটগল্পের বিশাল একটি কাজ তখন অনেকদূর এগিয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে গল্পটিকে পুরো হৃদয়ঙ্গম করতে, বাকি থাকে শুধু সমাপ্তিটুকু।
যেহেতু গল্পের মূল চরিত্রের এই মেয়েটি সদা পরিবর্তনশীল, তাই শেষাংশে তার আরও কোন পরিবর্তনের মাধ্যমেই সমাপ্তীর দাবী থাকতে পারে পাঠকের মনে। এবং সেটাই দেখা যায় এখানে। লেখক ১৯৪৪ সালের কোন এক সন্ধ্যায় চলতি পথে থমকে দাঁড়ান। “সামনের ব্যারাক থেকে একটি টমি বেরিয়ে এলো, এসে দাঁড়ালো মেয়েটির সামনে। সিগারেট বের করে দিলো মেয়েটিকে। তারপর দুজনই সিগারেট ধরিয়ে এগিয়ে গেল লেকের ঘাস গাছ জলের অন্ধকারে। আর সেই মুহূর্তে, একটা ঠুলি-পরা ল্যাম্প-পোস্টের কাছে গিয়ে ওরা পৌঁছতেই আমি শিউরে উঠলাম।
মেয়েটিকে স্পষ্ট চিনতে পারলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই বিস্মৃত মুহূর্তের ছবিটা নতুন করে চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সেই ক্লান্ত ম্লান বৈধব্যের কোলে একটি ছোট্ট শিশু। একটি পরাজিত মুখে মাতৃত্বের গৌরব।” মেয়েটির সাথে আর দেখা না হলেও, তাকে লেখকের আবার মনে পড়ে। স্বাধীনতার পরে, একদিন পথের ধারে দুই বাচ্চার ঝগড়া থামাতে গিয়ে যখন শোনেন তাদের বাবা ‘সাহেব’ কিংবা ‘তাদের বাবার কোন পরিচয় নেই’! লেখক বিষণ্ণ হন একটু। স্বাধীনতার যুদ্ধ নিশ্চিতভাবেই আমাদের জন্য বয়ে আনে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের সবটুকু, বিনিময়ে নিয়ে যায় বিগত জীবনের সব কিছু!
গল্পকার রমাপদ চৌধুরী স্বল্প পরিসরে এভাবেই লিখেছেন তাঁর ‘গত যুদ্ধের ইতিহাস’। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যবহার করেছেন বাহুল্যবর্জিত সাদামাটা ভাষা। গল্পটি লিখেছিলেন আবেগরোহিত হয়ে, কিন্তু গল্প-শেষে পাঠকের জন্য রেখে গেছেন সম্পূর্ণ আবেগায়িত এক ভাবনাকে। সেই ভাবনাটিই একটি শক্তিশালী মেসেজ। এই মেসেজ এসেছে জীবন থেকে, জীবনের গল্প খুঁড়ে। এমন গল্প কোন কোন গল্পকার আঁকেন বিশাল ক্যানভাসে, ছোট গল্পের পরিসরে। আবার কেউবা আঁকেন ছোট পরিসরের ছোট্ট ক্যানভাসে। সুলেখক রমাপদ চৌধুরী তাঁদের একজন, যিনি নিপুন তুলিতে বিন্দু’র মাঝে সিন্ধু দেখান! যিনি বিন্দুতেই করেন কিছু আলোকপাতের খেলা! সামান্য একটি জীবনে লেখকের নিখুঁত আলোর সে বিচ্ছুরণ, পাঠকের জন্য এনে দেয় আদর্শ এক ছোট গল্প পড়বার বিশ্লেষণাত্বক অন্যভূতি। যদিও শেষে গল্পের মূল চরিত্রটি সম্পর্কে পাঠকের মনে রয়ে যায় একটি অশেষের জিজ্ঞাসা বা অতৃপ্তি। বিজ্ঞজনের মতে অবশ্য ছোটগল্পের সার্থকতা এখানেই!
গল্পের নামটি চোখে পড়তেই, সমুখের দৃশ্যপট দ্রুত পেছাতে থাকে। কল্পনা-জগৎ কি কোন একটি সময়ের সাক্ষী হতে চায়? হবে হয়তো বা! ‘১৯৪০ সাল।’ -গল্পটা শুরুও হয়েছে এভাবে, পাঠককে নির্দিষ্ট এক সময়ে আছড়ে ফেলে! লেখক শুধু নামকরণ এবং প্রথম বাক্য দিয়েই পাঠকের সামনে ছোট একটি জানালা খুলে দিয়েছেন। এ জানালা দিয়ে ঠিক কি কি তিনি দেখাবেন তা এখনই বোঝা না গেলেও, পাঠকের কল্পনাকাশ একটি তীব্র যুদ্ধ-লগ্নের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে। গল্পের নাম এবং সূচনাকথা দেখেই মনে হচ্ছে, লেখক রমাপদ চৌধুরী ছোটগল্পের অন্য সব উপাদানগুলোকেও এক ঝলকে দেখে নিতে বলছেন! চেষ্টা করাই যাক তাহলে, নির্নিমেষ দৃষ্টিপাতে গল্পটির অলি-গলি, অবকাঠামো সব দেখে নেবার।
লেখক এ গল্প শুরু করেন তাঁর ছাত্রাবস্থায় দেখা যুদ্ধ-পূর্ব একটি সময়কে উত্তম পুরুষে বর্ণনা’র মাধ্যমে। পরাধীন দেশের স্বাধীনতাকামী উত্তাল সে সময় থেকে শুরু করে, দেশে যুদ্ধাবস্থা এবং যুদ্ধোত্তর সময় পর্যন্ত তিনি ভিখারী একটি মেয়েকে দেখেছেন। আর ‘সে দেখা’ই এই গল্প। ১৯৪০ সাল, ১৯৪২ সাল, ১৯৪৩ সাল, ১৯৪৪ সাল এবং সব শেষে ১৯৫০ সালের উল্লেখ করেই লেখক সে ‘দেখা’কে করেছেন বিবৃত। গল্পের ঘটনা এগিয়েছে - সময়ের সাথে ভিখারী মেয়েটির ভিক্ষাবৃত্তির কৌশল, জীবিকা বদল, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতপূর্ণ জটিলতায় আরোহণ এর মধ্য দিয়ে। ছোটগল্পে সাধারণত একটি মূল ঘটনাকে এগিয়ে নিতে ভিন্ন ভিন্ন টুকরো ঘটনার সমাবেশ ঘটানো হয়। প্রধান চরিত্রের সাথে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রেরও আগমন হয়। এখানে তেমনটি ঘটেনি। লেখক এখানে বিশাল কোন ক্যানভাসের পথেও এগোননি। ছোট ছোট ফুটেজের মাধ্যমে চলচ্চিত্রকার যেমন একটি শর্টফিল্ম বানান, এ গল্প লেখার ধরণটিও যেন অনেকটা তেমন! এই গল্পে নামহীন সে ‘ভিখারী মেয়েটি’র মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ‘সময়’ এবং ‘তৎকালীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি’। মেয়েটিকে বিভিন্ন ভূমিকায় বেশ কিছু ক্লাইমেক্সে আরোহণ এবং অবরোহণ করতেও যে দেখা যায় তা সেই সময় এবং পরিস্থিতির জন্যই। আর লেখক সেই সময়কে সাজিয়েছেন সরল এবং স্পষ্ট সব ধারাক্রমে। গল্পের কাহিনী বিন্যাসে একের পর এক দৃশ্যপট বদলালেও, তাই প্লটটিতে পাঠকের অবিন্যস্ত হবার কোন সুযোগ নেই।
মেয়েটি সম্ভবত বছর তের’র ছিল, যখন লেখক তাকে প্রথম দেখেন। হ্যারিসন রোডের পানের দোকানটার কাছেই প্রথম ভিক্ষা দিয়েছিলেন কিশোরী সে মেয়েটিকে। মেয়েটির ভিক্ষা চাওয়ার কারণটি বানোয়াট বুঝতে পারলেও লেখক ভিক্ষা দিয়েছিলেন; কারণ তার অভাব বা প্রয়োজনটি বানানো মনে হয়নি। আর দশটি ভিখারী’র চেয়ে কিছুটা অন্যরকমও হয়তো সে ছিল, তার ফর্সা পাতলা রুগ্ন মুখখানিতে। লেখক যখন যেখানে তাকে দেখেছেন, চিনতে পেরেছেন। বেশ কিছুদিন পরে মেয়েটির তরুণী অবস্থায় তার ভাগ্যের কিছুটা উন্নতি দেখা যায়। লেখক তা অবাক চোখে দেখেন এবং আমাদেরকেও দেখান। লেখক দেখলেন, মেয়েটিকে আর ভিক্ষা চেয়ে কিছু বলা লাগছে না; মানুষের সামনে গিয়ে হাত পাতলেই সবাই কম,বেশি দু’এক পয়সা দিচ্ছে। নারীত্বের এই অবমাননাটুকু গল্পের এ পর্যায়ে উঁকি দিয়েছে মাত্র, বলা যায় পূর্বাভাস! লেখক গল্পের শেষ পর্যায়ে আরেকবার সেই অবমাননার চূড়ান্ত অবস্থাটি স্পষ্ট করে দেখান, যা সকল যুগের সকল যুদ্ধে নারীর জন্য তীব্রভাবে বিদ্যমান। আকর্ষণীয় গল্পে প্রায়ই বিভিন্ন রকমের বাহ্যিক আঘাত, সংঘাত আসে। এ গল্পে মেয়েটির জীবনে খুব সহজাতভাবে যেই চড়াই-উতরাই এসেছে, সেগুলো আভ্যন্তরীণ। সেসবই গল্পটিকে এগিয়ে নিয়েছে এবং গল্পের কাঠামোকে চারপাশ থেকে জুড়ে গিয়েছে।
পরবর্তীতে দেশের যুদ্ধাসন্ন অবস্থায় দৃশ্যপট কিছুটা পাল্টায়। লেখকও এক পর্যায়ে মেয়েটিকে পয়সা দেওয়া বন্ধ করে দেন, সে সময়টির খুব বেশি ব্যাখ্যায় অবশ্য তিনি যান না! শুধু এভাবে বলেই পুরো চিত্রটি বুঝিয়ে দেন - “মেয়েটিকে অনেকেই নিরাশ করতে শুরু করলো। একটা আনির তখন কোনো দাম নেই বলেই একটা আনিরও তখন অনেক দাম।” এটাই ছোট গল্পের জাদু~ কিছুই তেমন না পড়েও, অনেক কিছুই পড়া হয়ে যায়। যাইহোক, চরম সে অর্থনৈতিক মন্দায় চারপাশ যখন রুক্ষ, মানুষ তখন ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠছে, প্রতিবাদী হচ্ছে। এই বিষয়টিকেও লেখক কোথাও স্পষ্ট করে বলেননি; অথচ দেখা যাচ্ছে। দেখা যায়, একদিন বাসের ভেতরে এক সম্বলহীন যাত্রীর ভাড়া নিজে মিটিয়ে দিয়ে, বাস-কনডাকটরের অন্যায়ের প্রতিবাদে মেয়েটি জোরালো প্রতিবাদ করছে! লেখকের বিশ্ময় আরও বাড়িয়ে, মেয়েটিকে আবারো অন্য রূপে দেখা যায় বেশ কিছুদিন পর। এবার বাসে দাঁতের মাজন, প্যাকেটজাত খাবার ইত্যাদি ফেরি করে চলা এক স্বনির্ভর মানুষরূপে তাকে দেখা গেল। হয়তো এই পর্যায়ে এসে পুনরায় চোখ বুলিয়ে নিতে ইচ্ছে হবে লেখকের বর্ণিত ‘১৯৪২ সাল’ এর দিকে, সময়ের সাথে মেয়েটির এ পরিবর্তনটিকে মিলিয়ে নিতে!
সত্যিকারের সাসপেন্স সেভাবে না থাকলেও, দেখা যায় পাঠকের আগ্রহী মন ধীরে ধীরে আটকে যাচ্ছে, মেয়েটির সাথে। এ গল্পে লেখক অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে করেছেন, মূল চরিত্রের এ সেটিংটি। মেয়েটির চেহারার বর্ণনা এখানে থাকলেও পাঠকের কাছে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাওয়া মেয়েটির একটিভিটি। তাই আরও কিছুদিন পরে যখন কালীঘাটের মন্দীরের কাছে মেয়েটিকে একটি ছেলের সাথে সিঁদুর পরিহিতা অবস্থায় দেখা যায়, পাঠকও লেখকের মতোই মনের অজান্তে খুশি হয়ে ওঠেন। আবার বেদনার্তও হয়ে ওঠেন কিছুদিনের ব্যবধানেই যখন তাকে দেখেন বিধবার বেশে, একটি শিশু কোলে ভিক্ষা সে ভিক্ষা করছে। অনেক দিন আগের পুরনো একটি চরিত্রকে আজকের পাঠক যখন ‘কাছের মানুষ’ ভাবতে পারে, ছোটগল্পের বিশাল একটি কাজ তখন অনেকদূর এগিয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে গল্পটিকে পুরো হৃদয়ঙ্গম করতে, বাকি থাকে শুধু সমাপ্তিটুকু।
যেহেতু গল্পের মূল চরিত্রের এই মেয়েটি সদা পরিবর্তনশীল, তাই শেষাংশে তার আরও কোন পরিবর্তনের মাধ্যমেই সমাপ্তীর দাবী থাকতে পারে পাঠকের মনে। এবং সেটাই দেখা যায় এখানে। লেখক ১৯৪৪ সালের কোন এক সন্ধ্যায় চলতি পথে থমকে দাঁড়ান। “সামনের ব্যারাক থেকে একটি টমি বেরিয়ে এলো, এসে দাঁড়ালো মেয়েটির সামনে। সিগারেট বের করে দিলো মেয়েটিকে। তারপর দুজনই সিগারেট ধরিয়ে এগিয়ে গেল লেকের ঘাস গাছ জলের অন্ধকারে। আর সেই মুহূর্তে, একটা ঠুলি-পরা ল্যাম্প-পোস্টের কাছে গিয়ে ওরা পৌঁছতেই আমি শিউরে উঠলাম।
মেয়েটিকে স্পষ্ট চিনতে পারলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই বিস্মৃত মুহূর্তের ছবিটা নতুন করে চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সেই ক্লান্ত ম্লান বৈধব্যের কোলে একটি ছোট্ট শিশু। একটি পরাজিত মুখে মাতৃত্বের গৌরব।” মেয়েটির সাথে আর দেখা না হলেও, তাকে লেখকের আবার মনে পড়ে। স্বাধীনতার পরে, একদিন পথের ধারে দুই বাচ্চার ঝগড়া থামাতে গিয়ে যখন শোনেন তাদের বাবা ‘সাহেব’ কিংবা ‘তাদের বাবার কোন পরিচয় নেই’! লেখক বিষণ্ণ হন একটু। স্বাধীনতার যুদ্ধ নিশ্চিতভাবেই আমাদের জন্য বয়ে আনে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের সবটুকু, বিনিময়ে নিয়ে যায় বিগত জীবনের সব কিছু!
গল্পকার রমাপদ চৌধুরী স্বল্প পরিসরে এভাবেই লিখেছেন তাঁর ‘গত যুদ্ধের ইতিহাস’। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যবহার করেছেন বাহুল্যবর্জিত সাদামাটা ভাষা। গল্পটি লিখেছিলেন আবেগরোহিত হয়ে, কিন্তু গল্প-শেষে পাঠকের জন্য রেখে গেছেন সম্পূর্ণ আবেগায়িত এক ভাবনাকে। সেই ভাবনাটিই একটি শক্তিশালী মেসেজ। এই মেসেজ এসেছে জীবন থেকে, জীবনের গল্প খুঁড়ে। এমন গল্প কোন কোন গল্পকার আঁকেন বিশাল ক্যানভাসে, ছোট গল্পের পরিসরে। আবার কেউবা আঁকেন ছোট পরিসরের ছোট্ট ক্যানভাসে। সুলেখক রমাপদ চৌধুরী তাঁদের একজন, যিনি নিপুন তুলিতে বিন্দু’র মাঝে সিন্ধু দেখান! যিনি বিন্দুতেই করেন কিছু আলোকপাতের খেলা! সামান্য একটি জীবনে লেখকের নিখুঁত আলোর সে বিচ্ছুরণ, পাঠকের জন্য এনে দেয় আদর্শ এক ছোট গল্প পড়বার বিশ্লেষণাত্বক অন্যভূতি। যদিও শেষে গল্পের মূল চরিত্রটি সম্পর্কে পাঠকের মনে রয়ে যায় একটি অশেষের জিজ্ঞাসা বা অতৃপ্তি। বিজ্ঞজনের মতে অবশ্য ছোটগল্পের সার্থকতা এখানেই!
0 মন্তব্যসমূহ