নদী , গাব গাছ, রহমান চাচা ও সাবের’র চারটি গল্প

মুর্তালা রামাত

চোখের আরাম

আমাদের বাড়ির পেছনেই একটা নদী ছিল। নদীর পাড়ে যেখানে একটা গাব গাছ সেখানেই নদীটা একটু বেঁকে আবার সামনে এগিয়ে গেছে। নদীর ধারালো স্রোত গাব গাছের শেকড়ের কাছে এসে একেবারে শান্ত হয়ে যেত। যেন একটু জিরিয়ে নিচ্ছে! তারপর আবার লম্বা দম নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে যেত। নদীর ওই নরম হয়ে যাওয়ার জায়গাটিতে হয়তো ভাসতো শাপলা ফুল, হয়তো পাটের পচা পাতা, হয়তো এক টুকরো ভেসে আসা কাঠ। কখনো কখনো সেই কাঠের উপর এসে বসতো একটা মাঝরাঙা। একটু বসে টুক করে পানিতে মুখ ডুবিয়ে একটা পুঁটি মাছ তুলে এনে সে হয়তো উড়াল দিতো।
কখনো সখনো দু’তিনটে ফড়িং উড়ে এসে ওখানে একটু উঁকি দিয়ে আবার চলে যেত। বাড়ির পেছনের এক চিলতে ওই যায়গায় এতো কিছু ঘটে যাওয়ার ঘটনা আমি কখনো খেয়াল করিনি। খালি দেখতাম একজন বুড়ো মতোন লোক মাঝে সাঝেই ওই গাব গাছের নিচে এসে বসতো। অনেকক্ষণ বসে থেকে সে আবার রওনা হতো। নদীর তীরে এতো এতো যায়গা থাকতে লোকটি কেন প্রতিদিন ওখানেই এসে বসে, আমি অবাক হয়ে ভাবতাম।রবীন্দ্রনাথের “খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন” গল্পের রাইচরণের মতো তারও কী কোন কাহিনী নদীর ঠিক ওই যায়গাটাতেই স্মৃতি হয়ে ভাসে? থাকতে না পেরে একদিন তাকে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম, চাচা-আপনি নদীর এখানটাতেই বারবার কেন এসে বসেন? চাচা (পরে জেনেছিলাম যার নাম মুন্সী রহমান, যার বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে আরো দশ মাইল ভাটিতে) তার ঘোলা দুটি চোখের আনন্দ আমার চারপাশে ছড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, চোখের আরাম হয় বাবা। এইখানে বইলে চোখে কেন জানি আরাম লাগে, কেন জানি মনে হয়- নদী এইখানে আইসা খুউব সোন্দর হয়া গেছে।

চোখ থেকে মনে

“চোখের আরাম” শব্দ দুটো সেই থেকে আমি কেরোটিতে বয়ে বেড়াচ্ছি। এবং আস্তে আস্তে আবিষ্কার করেছি যে চোখের আরামের সাথে মনেরও আরাম জড়িত। চোখের যে আরামে জন্য রহমান চাচা অতদূর হেঁটে গাব গাছের নিচে নদী দেখতে আসতেন, সেই আরাম নিশ্চয়ই তার মনকে আনন্দে ভরে দিতো। সেই আনন্দই তাকে দশ মাইল হাঁটিয়ে আবার বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতো। পরেরদিন আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতো। অর্থাৎ চোখের আরাম আনন্দ হয়ে মনের লাগাম হাতে তুলে নিতো, আর মন রহমান চাচাকে দাবড়িয়ে বেড়াতো। শুধু চোখের আরাম নয়, নিশ্চয় আরো আরাম আছে যার যাদুর কাছে আমাদের এইভাবে বশীভূত হতে হয়। আমার জন্য যেমন, পড়ার আরাম। আমি পড়তে পছন্দ করি। পড়া যদি একটি বহমান নদী হয়, তবে সেই নদীর তীরে কোন এক গল্প বা কোন এক উপন্যাস বা কোন এক কবিতার পাশে আমি হয়তো খানিকটা আরামের জন্য রহমান চাচার মতো বারবার আসতে পারি। ফিরে যেতে পারি, মন ভরা আনন্দ নিয়ে।আজ বহুদিন পর রহমান চাচার কথা মনে করতে গিয়ে তেমন কিছু গল্পের কথা মনে পড়ছে। আমার মন যাদের পাশে আমাকে প্রায়ই টেনে নিয়ে যায়। সেইসব গল্পের ঝাঁপি একটু খুলে দেখা যাক।

গল্পগুলো

মোটমাট চারটি গল্পের কথা এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে। বৃত্ত, ভুল বিকাশ, মৃদু নীল আলো, বিশ্বাসের মুখ। সবগুলোই মঈনুল আহসান সাবের এর লেখা। গল্পগুলো আমি পড়ি তার “বাছাই গল্প” নামের বইতে। এই বইতে আরো বেশ কটি গল্প রয়েছে। প্রতিটি গল্পই নানা মোচড়ে নানা আঙ্গিকে মোহনিয়া।কিন্তু কেন জানি এই চারটি গল্পের কাছেই আমি বারবার ঘুরে ফিরে যাই। নিশ্চয়ই গল্পগুলো আমাকে “পড়ার আরাম” দেয়। কেন দেয়?আমি যতোবার গল্পগুলো পড়ি ততোবারই এই একই জিনিস ভাবি। ভাবতে ভাবতে বরাবরই কিছু উত্তর খুঁজে পাই। কখনো লিখে রাখা হয় না। আজ সেই উত্তরগুলো একটু সাজিয়ে দেখা যাক।

ব্যাতিক্রমী কাহিনী

উপরে উল্লেখিত চারটি গল্পের কাহিনীই প্রচণ্ড রকমের ব্যতিক্রম।

বৃত্ত গল্পে লেখক চাকরিজীবী মধ্যবিত্তের আটপৌর জীবনযাপনের কথা বর্ণনা করতে থাকেন। এক পর্যায়ে দেখা যায় চাকরিজীবী মানুষটি ঘুরে ফিরে বারবার একই রাস্তায় ফিরে যাচ্ছে।তার জীবন যে গোল একটা চাকা; ছাপোষা জীবনের চলমান বৃত্তের ভেতর সে নিষ্ঠুরভাবে বন্দী হয়ে গেছে।

“ভুল বিকাশ” গল্প দানা বেধেছে ১৯৭১ সালকে ঘিরে।একজন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধের তিন বছর পর হানিমুন শেষ করে ফিরছেন। তিনি তার নতুন স্ত্রীর কাছে যুদ্ধের সময়ের গল্প বলেন। সেময় তিনি একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আশ্রয়দাতারা তাকে কীভাবে সমাদর করেছিল সে কথা তিনি তার স্ত্রীর কাছে স্মৃতিচারণ করেন। শেষে এতো বছর পর সেই আশ্রয়দাতাদের বাড়িতে গেলে দেখা যায় একসময় তাকে যারা আশ্রয় দিয়েছিল, ঘটনাচক্রে তারাই সময়ের কষাঘাতে এখন অন্যরকম নিষ্ঠুর।

“ মৃদু নীল আলো” একটি মনস্তাত্বিক গল্প। এই গল্পে আমরা সময়ের সাথে সাথে স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন কীভাবে শীতল হয়ে আসে তা দেখতে পাই। দেখতে পাই, বাস্তবতার যায়গায় কল্পনার নীল আলো কীভাবে বাস্তব এবং সুতীব্র হয়ে ওঠে। একসময় মনে হয়, যা বাস্তব তা না থেকে বরং ওই নীল আলোর বাস্তবতাই বুঝি বেশি ভালো ছিল।

“বিশ্বাসের মুখ” একজন জননেতার ইন্টারভিউ। গতানুগতিক সেই বয়ানই যখন সত্য মিথ্যা স্বপ্ন এবং বিশ্বাসের সাথে এক হয়ে মিশে যায় তখন তা একটি অপরূপ গল্প হয়ে দাঁড়ায়।


কাহিনীর কাঠামো এবং ভাষা

কাহিনী অন্যরকম হলেই কি গল্প আরামদায়ক হয়? কাহিনীর কাঠামো গল্পকে আরামদায়ক করে তোলার্ ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। অনেকটা ইজি চেয়ারের মতো, কাহিনীর কাঠামো যদি মনোরম হয়, তাহলে গল্প ছেড়ে উঠে আসতে আলসেমী লাগে।বরঞ্চ গল্পে বুঁদ হয়ে থাকতে মন চায়। আর কাহিনীর সাজগোজ যেরকম, গল্পের ভাষার পোশাক পরিচ্ছদও যদি সেরকম হয় তবে সেই গল্প “পড়ার আরাম” থেকে কে আর বের হতে পারে? ভাষার কেরামতির ছোট্ট একটা উদাহরণ এখানে দেয়া যেতে পারে। “ভুল বিকাশ” গল্পের কাহিনীর কথা আমি আগেই বলেছি। কাহিনীর একপর্যায়ে গল্পের নায়ক মুনীর ৭১ এর যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল, তিন বছর পর এক সন্ধ্যায় সে বাড়িতে আবার যায়। সাথে তার নববিবাহিত স্ত্রী। ৭১ এর সেই উষ্ণ আতিথিয়তার স্মৃতির আবেশে উত্তেজিত, রোমাঞ্চিত মুনীরকে লেখক বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‍মুনীর সেই বড় বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। টিনের দরোজায় আওয়াজ ক’রে সে পাশে তার হাত ধরে দাঁড়ানো স্বপ্নার দিকে তাকিয়ে বলে- আমার শরীর কাঁপছে, দেখো।..
ভেতর থেকে একজন চেঁচিয়ে ওঠে, কে? মুনীর গলা বাড়িয়ে বলে- করিম চাচা বাড়ি আছেন?
একটা হ্যারিকেন ক্রমশ এগিয়ে আসে, পেছনের মানুষকে পরে দেখা যায়। আধ-ভেজানো দরোজা খুলে দাড়িঅলা বুড়ো মানুষটা জিজ্ঞেস করে- আপনি কে? মুনীর সামান্য ইতস্তত করে, হ্যারিকেনের আলোয় লোকটার মুখ ভালোভাবে দেখে নিয়ে হাসে- আরে আপনিই তো করিম চাচা, দেখেনে তো আমাকে চিনতে পারেন কি না? সে স্বপ্নাকে আরও কাছে টেনে নেয়।

বুড়ো হ্যারিকেন তুলে কাঁপা চোখে তাকে দেখে মাথা নাড়ে- না।

আমি মুনীর- চিনতে পারেন।
কোন মুনীর? বুড়োর গলা খুব ক্লান্ত।

এবার সরাসরি বলে মুনীর- ওই যে একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনদিন ছিলাম, মনে নেই চাচা?
বুড়ো এবার হ্যারিকেন তুলে ধরে- ও চিনছি, শহর থেইক্যা আইছিলেন, তা কী ব্যাপার?......

আমাকে আপনি করে কেন বলছেন, সে সময় তো তুমি করে বলেছিলেন। মাত্র তনি বছরে সব কিছু ভুলে গলেন মুনীর ক্ষুণ্ণ হয়।
বুড়ো হাসে- তিন বছর বড় লম্বা সুময়।...

.....সারা বাড়িতে আর কোনও শব্দ নেই। সামনের খড়ের গাদায় সামান্য খড় অবশিষ্ট। গোয়ালঘর অন্ধকার, একটা গরুই সম্ভবত মশার কামড়ে নড়ছে। ডানপাশে সম্ভবত রান্নাঘর। কুপি জ্বলছে মৃদু। কিন্তু ভেতরে কেউ আছে কি না বোঝা যায় না। ভেতরের ঘরে মৃদু আলো কাঁপছে। স্বপ্না আবার সব দেখে নিয়ে মুনিরের দিকে তাকায়- কই, তুমি না কত বলেছিলে, কিন্তু কেমন করে যেন গা-ছাড়া ভাব।

এর আগে মুনীর তার স্ত্রীর কাছে তার আশ্রয়দাতের যে বর্ণনা দিয়েছিল সেখানে আমরা দেখেছিলাম সুখ শান্তি প্রাচু্র্য্ময় একটি ছবি। মাত্র তিন বছরে কী এমন ঘটলো যে মুনীরের আশ্রয়দাতাদের এমন ছন্নছাড়া অবস্থা, এমন শীতল আচরণ! আমাদের সে খবর খুব করে জানতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু লেখক সেসব কোন কথাই আমাদেরকে বলেন না। বরঞ্চ তিনি শব্দ দিয়ে একটা আবছা রাস্তা তৈরি করে দেন, যে রাস্তার দিকে চোখ পড়া মাত্রই আমরা তিন বছরের দীর্ঘ ছায়া দেখতে পাই। লেখক মুনীরকে দিয়ে বলান, তারপর চাচা আপনাদের খবর বলেন, লোকজন সব কই, কার দাওয়ায় বসে গল্প হচ্ছে?
বুড়ো মাথা নাড়ে- না, দাওয়ায় বইস্যা গল্প করনের সময় নাই।

একদম সাড়াশব্দ নেই গ্রামে, মানুষজন আছে বলেই মনে হয় না।
নাই। বুড়ো ক্লান্ত গলায় বলে- আসলেও মানুষজন নাই, আছে মাত্র পনের বিশ ঘর, আর সব চইল্যা গেল একে একে।

ওমা, কোথায় গেল- মুনীর জিজ্ঞেস করে, স্বপ্নাও চোখ তুলে তাকায়।

আর কই যাইব, তোমাগো শহরে গেল, সব না খাইয়্যা ছিল, কেন, দেহ নাই, শহরে মানুষ গিয়া নাকি ভইর‌্যা ফ্যালাইছে, তোমাগোও নাকি অসুবিধা অয়।

মুনীর দেখেছে বটে, শহরে ক্রমশই ভাঙাচোরা ছিন্নমূল মানুষজন বাড়ছে, কিন্তু তাদের মধ্যে নবীপুরেরও কেউ আছে বলে সে এরকম কখনও ভাবেনি।

সবগুলো গল্পেই ভাষা দিয়ে এমন অদৃশ্য ইমেজারি তৈরির কারিগরি রয়েছে। যা পাঠকের ভাবনা তৈরিতে বেশ বড় একটা অবদান রেখেছে। সেইসাথে যোগ হয়েছে গল্পের নিঁপুণ কাঠামো। বিশেষ করে, গল্পগুলোর ফিনিশিং এতো নিঁখুত যে গল্পে একবার ঢুকে পড়ার পর তা থেকে বেরিয়ে আসার দরজা হাট করে খোলা থাকলেও, বেরোবার কোন ইচ্ছাই কেন জানি আর তৈরি হয় না!

যেমন বৃত্ত গল্পে, মধ্যবিত্তের একঘেয়ে জীবন বর্ণনা করতে করতে শেষে লেখক এমন এক বিষয়ের অবতারণা করেন যে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। আমরা দেখি, আলম তার স্ত্রীকে নিয়ে মোটর সাইকেলে ঘুরতে বেরিয়েছে। প্রতিদিন যে রাস্তা দিয়ে সে অফিসে যায়, বাচ্চাদের স্কুলে দেয়, রেশন তোলে, বাড়িতে আসে- ঘুরেফিরে সেই রাস্তাগুলোতেই বারবার চলে যায়।প্রবল ইচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও অন্য রাস্তায় তার যাওয়া হয় না। “সে চেঁচিয়ে ওঠে, - ফিরোজা আমি চেষ্টা করছি ফিরোজা, কিন্তু বাজার, রেশনশপ, নোটনদের স্কুল, ওয়ার্ক্শপ সুদখোর হান্নানের বাড়ি আমি বের হতে পারছি না, ফিরোজা আমি বের হতে পারছি না।”

ভুল বিকাশ- এ আমরা দেখি নবদম্পত্তি হানিমুনের খুনসুঁটি করছে। খুঁনসুটির ভেতর দিয়ে উঠে আসে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের কথা। আমরা মনোযোগী হই। জানতে পারি, গল্পের নায়ক মুনীর একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। যুদ্ধের সময় সে একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। তিন বছর পর সেখানকার সুখস্মৃতি রোমন্থন করে সে আবার সেখানে যেতে চায়। তার স্ত্রীকে স্বপ্ন দেখিয়ে সে বলে, “ধরো আমরা বিকেলের আগেই পৌঁছে গেলাম-...আমাদের কী কী দিয়ে আপ্যায়ন করবে জানো? দাঁড়াও, তোমাকে একটা রাফ আইডিয়া দিচ্ছি- চিনিচাম্পা কলা, চিঁড়া, পারফেক্ট চিঁড়া- অসম্ভব সরু আর সাদা, খৈ দেবে, সঙ্গে নারকেল কুরে দেবে আর আলাদা বাসনে থাকবে বাতাসা কিংবা পাটালি গুড়, সাদা ধবধবে।” মুনীরের সাথে সাথে আমরাও স্বপ্নাতুর হয়ে পড়ি। সেই বাড়িতে যাওয়ার জন্য উৎসুক হই। তারপর যখন এসবের বদলে আমরা যখন দেখি, তিন বছরের ব্যবধানে সেই আশ্রয়দাতাদের অবস্থা এখন পড়তির দিকে, তাদের সামর্থের দৌড় টোস্ট বিস্কুটে নেমে এসেছে, তারা মুনীরের মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বলে- “ওড ব্যাটা।”, তার স্ত্রীর “পাছায় জোরে চড় কষে”, “ফিকফিক করে হাসে”, তখন আমরা অনেক উঁচু থেকে নিচুতে পড়ে যাই- আর উঠতে পারি না।

নীল আলো- তেও আমরা স্বামী স্ত্রীর শীতল দাম্পত্য জীবন বেয়ে যেতে যেতে ধাক্কা খেয়ে থেমে পড়ি। পাশের ফ্লাটে নতুন ভাড়াটিয়া, রাতের অন্ধকারে তাদের ঘরে শারীরিক কামনার চারপাশে জ্বলে থাকে নীল আলো। যা দেখে হাফেজ স্থির থাকতে পারে না, উত্তেজিত হয়, তার স্ত্রীর কাছে একের পর এক চিঠি লেখে। তার উৎফুল্লতা, চিঠির ভাষাতে রোমান্টিকতার ছোঁয়া আমরা আশাবাদী হয়ে উঠি।ভাবতে থাকি, এইবার হয়তো তার স্ত্রী জাহানারা তার ডাকে সাড়া দেবে, সমস্ত শীতলতার চাদর সরিয়ে উঠে দাঁড়াবে তাদের ঘুমিয়ে থাকা মানবিক সম্পর্ক। পাশের বাড়ি নীল আলো তাদেরকে হিংসায় পোড়াবে, তারা একে অপরের আরো কাছাকাছি এসে নীল আলোকে ছাপিয়ে তৈরি করবে ভালোবাসার গাঢ় এক উজ্জ্বলতা। কিন্তু লেখক আমাদেরকে সব চাওয়ার গায়ে জল ঢেলে হাফিজের স্ত্রী জাহানারার কণ্ঠে জানিয়ে দেন, “দেখো, জানালা দিয়ে দেখো, তাকাও তুমি। কোথায় নীল আলো? মিথ্যুক কোথাকার। পাশের বাসায় লোক এসেছে, না? স্বামী-স্ত্রী, তাদের নাকি আবার খুব চেনা-চেনা লাগে। কী শান্তিতে নাকি ঘুমায় তারা, আবার ওসব করতেও দেখ তাদের; মিথ্যুক, পাগল, চুপ করে আছ কেন, তাকাও তুমি- নীল আলো, না? কোথায় তোমার নীল আলো- ফাঁকা বাড়ি, অন্ধকার ছাড়া কী আছে ওদিকে?” যা বাস্তব তা আসলে কল্পনা, কাহিনীর এই মোচড়ের পর অসীম এক শূন্যতা ছাড়া পাঠকের আর কোথাও কি যাওয়ার যায়গা আছে?

একজন সাংবাদিক একজন জননেতার ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। একের পর এক প্রশ্ন করছেন, নেতা মনের মাধুরী মিশিয়ে তার উত্তর দিচ্ছেন। এমনটাই ঘটেছে, বিশ্বাসের মুখ গল্পে। অনেকের কাছে ব্যাপারটা বোরিং লাগতে পারে, মনে হতে পারে পত্রিকার পাতায় আমরাতো এমন রিপোর্ট হরহামেশাই পড়ি, এখানে গল্প কোথায়? এই যে জিজ্ঞাসার আকুতি তৈরি করা, এটাই এই গল্পের স্টাইল। নেতার ইন্টারভিউ পড়তে পড়তে আমরা যখন তার মিথ্যা কথায় ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে উঠতে শুরু করি, নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি, কেন এসব বস্তাপচা মিথ্যা কথা আমরা শুনছি। ঠিক সেই সময়ই লেখক আমাদের জনান যে, আমরা শুনছি কারণ আমাদের কেউ কেউ এসব কথা বিশ্বাস করে, আর সে কারণেই নেতারা মিথ্যা বলেও পার পেয়ে যান। যদিও তার মনের ভেতর ভয় হামাগুড়ি দেয়। নেতার মনের ভেতরের খোঁজ আমাদের জানিয়ে দিয়ে লেখক আমাদের দেখান, নেতা একটি সমাবেশের স্মৃতি নিয়ে ভাবছেন। সেখানে একজন শ্রোতার কথা তার মনে পড়ে,“ মঞ্চের ঠিক সামনেই বসেছে, বয়স ৪৫/৪৬, গাল ভাঙা কিন্তু জ্বলজ্বলে চোখ;.... জ্বলজ্বলে চোখে লোকটা তার প্রতিটি কথা যেন পরম মমতায় আর বিশ্বাসে গ্রহণ করছিল। লোকটা বিশ্বাস করছে তাকে, তার সব কথা বিশ্বাসে গ্রহণ করছে- এটা বুঝতে পেরে সে বারবার কেঁপে যাচ্ছিল। আর ভয়, কী ভয় তাকে তখন গ্রাস করেছিল! হায়, ওই লোক কি তবে সত্যিই ভাবছে- এরপর ফসলে-ফসলে হেসে উঠবে এ এলাকা, শিক্ষা ও স্বস্তির আলোয় ভরে যাবে প্রতি ঘর, বিনা চিকিৎসায় কেউ মারা যাবে না, কোনো মানুষ বিশ্বাস করেও সব কথা, তার জানা ছিল না।....তারপর অনেকদিন হয়ে গেল, এখনও সে ওই লোকের মুখ দেখতে পায়।...সে মুখ হঠাৎ মনে পড়ে গেলে সে বিব্রত বোধ করে, ভেতরে-ভেতরে ছোট হয়ে যায়, অদ্ভুত এক ভয় তাকে তখন গ্রাস করে নেয়।” আর আমরা মানে পাঠকেরাও খুব দ্রুতই একটা চিন্তার মধ্যে পড়ে যাই। আমাদের মনে হয়, আমরা আমাদের চারপাশের অন্ধকারকে জেঁকে বসতে দেখছি। সেই অন্ধকারে সত্য মিথ্যা স্বপ্ন আর আমাদের চাওয়া পাওয়ার ব্যবধান সব মিলেমিশে এক হয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে পড়ে।আমাদের ভেতরে কোথাও খুব জোরে আর্তনাদ হয়, হতেই থাকে...


গল্পের ভেতরে বসবাস।

আত্মার এই আর্তনাদের জগত থেকে আমরা আর বের হতে পারি না। আলম যেমন বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি। আমরাও তেমন এই গল্পগুলোতে আটকে যাই। কিন্তু আলমের বৃত্ত যেমন শ্বাসরোধ করে ধরেছিল, তেমন নয়, সাবের এর গল্পের বৃত্ত আমাদের ভাবনার নানা পথে হাঁটতে বাধ্য করে। মুনীরের মতো আমরা চিন্তায় পড়ে যাই, ৭১ এর স্বপ্ন কেন তিন বছরের মধ্যেই বিলীন হয়ে গেলো! স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরে এসেও মুনীরের কাহিনী আমাদের চারপাশের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকাতে বলে; আমরা দেখি যা হওয়ার কথা ছিল এখনও তার সাথে আমাদের দুস্তর ব্যবধান। এই ব্যবধান কমাতে আমরা হাফেজের মতো মৃদু নীল আলোর কথা চিন্তা করি। ভাবি, আমাদের পাশেই আমাদের সুসময় হাসছে খেলছে। মনের ভেতর আমরা ক্রমশ আশাবাদী হয়ে উঠি। যদিও আমরা জানি, কাল সকালে উঠেই দেখবো সবকিছু আগের মতোই, তারপরও আমাদের সেই জ্বলজ্বলে চোখের মানুষটার মতো বিশ্বাসের মুখ নিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছা করে। কারণ, সাবের এর এই গল্পগুলো এমনই, হাত ধরে পরম মমতায় দেখিয়ে দেয়, আমার কী আছে কী নাই আর কী থাকা দরকার ছিল।এই বোধটুকু আমাদের জাগিয়ে রাখে।গল্পের ভেতর থেকে বাইরে এসেও তাই আমরা বা আমি আবার ফিরে ফিরে যাই- হয়তো কিছু খুঁজি। রহমান চাচা যেমন গাব গাছের নিচে শ্লথ নদীর দিকে তাকিয়ে এক অপার সৌন্দর্য্ খুঁজে পেতেন, মঈনুল আহসান সাবের এর এই গল্পগুলোও তেমন করে সময়ের জীবনযাপনের হাতে আমাকে টানে, বলে- এ তো তোমরাই আয়না ঘর আধুনিক মানুষ, তুমি তোমাকে ছেড়ে আর কোন দিকে যাবে!


চোখের কাছে ফিরে আসি


যেখান থেকে শুরু করেছিলাম এবার সেখানে ফিরে যাই। সেই নদী, গাব গাছ, রহমান চাচা আর চোখের আরাম।আমাদের বাড়িতে এখন আর কেউ থাকে না। নদী শুকিয়ে গেছে। রহমান চাচাও চলে গেছেন ম্যালা দিন হলো। কিন্তু “গাব গাছের নিচে রহমান চাচা বসে বসে মনোরম চোখে নদীর নরোম নাচের শরীর দেখছেন” এই দৃশ্যটি আমার চোখে এখনও জীবন্ত। চিত্রকর চলে যাবার পরও ছবি যেভাবে দেয়ালে প্রাণের আলো ছড়ায় সেভাবে আমার কাছে ওই দৃশ্য এখনও অমর হয়ে আছে। শহরে অলিতে গলিতে আধুনিকতার ভিড়ে হাঁটাতে হাঁটতে দুদণ্ড শান্তির দরকার হলে এখনও চোখ বন্ধ করে আমি ওই দৃশ্য চিন্তা করি। বা আমার মন আমাকে চিন্তা করতে বাধ্য করে। আমার অজান্তেই মনের সাথে ওই দৃশ্যের একটা অদৃশ্য সেতুবন্ধন তৈরি হয়ে গেছে। একই ভাবে সাবের এর এই গল্পগুলোর সাথেও আমার একটা একাত্মতাবোধ তৈরি হয়েছে। শুধু আমার নয়, বোধ করি, যে কোন চিন্তাশীল মানুষ যারা গল্পগুলো পড়বেন তারা কেউই “পড়ার আরাম” থেকে আর মুক্ত হতে পারবেন না।গল্পগুলোর নারী চরিত্রগুলো তেমন শক্তিশালী নয় কারো কারো এমন অনুযোগ হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু অতৃপ্তি বলতে যা বোঝায়, তা হয়তো হবে না।কেনোনা, প্রতিটি গল্পই আপনার মনের দরজায় এতো জোরে কড়া নাড়বে যে, আপনি আপনার পচা গলা নিঃশব্দের বাস্তবতা থেকে জেগে না উঠে পারবেন না। আর জেগে ওঠা মাত্রই দেখবেন, গল্পের ভেতর আপনিই হেঁটে যাচ্ছেন, দীর্ঘ্ থেকে দীর্ঘ্ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছেন বোধ থেকে বোধে। হয়তো আপনার দিকে মুগ্ধ হয়ে দিনের পর দিন তাকিয়ে আছেন কোন এক রহমান চাচা, হয়তো আমার মতো কোন পাঠক আপনার পিছু পিছু হেঁটে খুঁজে নিচ্ছে তার আপন নিবাসটুকু।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ