হাসান আজিজুল হক'এর গল্প : মা-মেয়ের সংসার

মা-মেয়ের সংসার। দুজনেই খুব সুন্দরী। কার গরজে তারা অত সুন্দরী কে জানে। আপনমনে থাকে তারা, কোথাও যায় না। কেউ আসেও না তাদের কাছে। এখানকার নদীখালগুলি জিলিপির প্যাঁচের মতো। কেবলই ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, মাটি কাটে, গাছ কাটে, বাড়ি কাটে। ওদের ঘুরে বেড়ানোটাই আসল। জমি যা বাঁচে তাদের ক্ষিধে মিটিয়ে, তার উপরেই লোকজনের ঘরবাড়ি, চাষাবাদের জায়গা। তাতেও স্বস্তি নেই। জলেরা খালগুলির ভিতরে ঢুকে কেবলই তাদের উস্কাতে থাকে- চল্‌ না একটু ঘুরে আসি, দুটো ঘর, একটা উঠোন হলেও চলে। জলেদের সুবিধাও অনেক, ছ ঘণ্টা পর পর চার-পাঁচ হাত উঁচু হয়ে ফুলে ওঠে। তখন কেবলই ছোঁ মেরে ঘর-দুয়োর চাটতে যায়। জিভ দিয়ে চেটেও দেয় মাঝে মাঝে।


মা-মেয়ে জলের নাগাল থেকে অবশ্য একটু দূরেই আছে। খাল-পাড় ধরে কালো নোনা কাদা পেরিয়ে হেঁতাল গোলপাতার জঙ্গলের আড়ালে আড়ালে, বনবেড়ালের হাত আর থাবার মতো বেত-বনের আঁকশি-কাঁটার ঘা বাঁচিয়ে অনেকটা গেলে একটু উঁচু মতো জায়গায় ওদের কুঁড়েটা পাওয়া যায়। ভিজে সোঁতা আ-চোটা জমির উপর পাটকাঠির দেয়াল দিয়ে ঘেরা। চালটা ছনের। ঘরের মেঝেয় মাটির শানকি, জলের কলস, টিনের গ্লাস, এতটুকু একটা উনুন, আর একপাশে চ্যাটাইয়ের উপর ময়লা চিটচিটে কাঁথা-বালিশের বিছানা। মা-মেয়ে এক বিছানায় থাকে। তাদের আর কিছু দরকার নেই।

ঘরের পেছনেই বেনাঝোপে শিয়াল থাকে। একটা মুরগি পোষার উপায় নেই, ওঁৎ পেতে থাকে চব্বিশ ঘণ্টাই, মুরগি পেলেই হলো, ঝপ্‌ করে মুখে তুলে নেবে। ছ মাস আগে সন্ধের একটু পরে মেয়ে বেরিয়েছিল ঘরের বাইরে। একটু দরকার ছিল, সেটুকু সেরে ফিরে এসে মায়ের সঙ্গে ভাত খাবে। মায়ের চোখে একটু নিদের ঘোর এসেছিল। শব্দ শুনে ঘুমের ঘোরে ভাবল, কি জানি, মুরগি তো নেই বাড়িতে। ওদিকে চার শেয়াল বসেছিল, তাদের একটা এসে ঝটিতি মেয়েটাকে তুলে নিল মুখে। আর একটা শেয়াল এসে ছেঁড়া ঝুরিঝারা একটা গামছা গুঁজে দিল ওর মুখে। মেয়ে এখন শুধু হাত-পা নাড়তে পারে আর গলা থেকে একটু গোঙানিমতো বার কর করতে পারে। হাত-পা নাড়ার তো শব্দ নেই আর গোঙ্গানিটুকু মা শুনেও শুনলো না, একবার শুধু ভাবল, না, মুরগি তো একটিও নেই। গোলপাতার বনে একরকম কাদার মধ্যেই ওরা চিৎ করে শুইয়ে দিলো মেয়েকে। একজন গেল পেচ্ছাপ করতে। কাদার উপর দাঁড়িয়ে সে তলপেট খালি করে খলখল শব্দে পেচ্ছাপ করলো, অন্য তিনজনের একজন মেয়েকে মাটিতে চেপে ধরে রাখলো, একজন তার মুখে গামছাটা আর একটু গুঁজে দিয়ে ধরে রইল আর তৃতীয়জন তৈরি হতে লাগলো। মা মেয়ে এমনি একা যে মেয়ে জ্ঞান হয়ে অব্দি ভালো করে পুরুষমানুষ প্রায় দেখেইনি। কি করে কি হয় সে জানে না, মা-ও কোনোদিন তাকে বলেনি। চোখ দুটি তার খোলা ছিল, আবছা আঁধারে পুরো দস্তুর ন্যাংটো একটা পুরুষমানুষ সে এই প্রথম দেখল। আতঙ্কে হয়তো তখুনি অক্কা পেত। তবে এটা বাঘ-বাঘিনীর এলাকা। ত্রাসে দম আটকে এলেও সে চেয়ে রইল। ছোরা বেঁধানোর তীব্র যন্ত্রণায় একবার কঁকিয়ে উঠল মেয়ে। গলার প্রায় ভিতর পর্যন্ত কাপড় গোঁজা থাকায় আওয়াজটা গোঙানির বেশি কিছু হলো না। চারজনে চারবার দখল করল তাকে। চারজনের শেষ হয়ে যাবার পর প্রথমজন আর একবার। মেয়ের তাতে কিছুই যায় আসে না, তার জ্ঞান ছিলো না। লাল রক্তমাখা ঢলঢলে কাদার বিছানায় সে শুয়ে রইল।

খানিক পরে মা-ও নিজেদের ঘরে মেয়ের মতোই জ্ঞানহারা হয়ে পড়ে রইল। দুজনের ভাত চারজনে ভাগ করে খেয়ে শেয়াল চারটে এইবার হুক্কা-হুয়া আওয়াজ তুলে চলে গেল।

ছয় মাস পরে। মেয়ে এখন একটু একটু খেতে পারে। এতদিন সে খেয়েছে শুধু মাটি। শুকনো কালো মাটি। উঠোনের এককোণে উঁচু মাটির ঢিপিটা সে নিজেই তৈরি করে নিয়েছিল। সকাল-বিকেল-সন্ধেয় ওখান থেকে খাবলা খাবলা মাটি নিয়ে মুখে পুরত আর খাল পেরিয়ে চলে যেত জঙ্গলে। মায়ের বারণ সে শুনতো না। বাঘে নিলি নেবে, তুই অমন করিস কেন মা?

আমার তুই আছিস, তুই মরলি আমি আছি।

আমারো তো কেবল তুই আছিস, তুই মরলি আমি আছি।

আর আমরা দুজনে মরলি আমাদের কেউ নেই।

আমাদের আল্লাও নেই।

কেউ না থাকলি আল্লা থাকপে কোয়ান থে।

আমাদের দোজখ-ও নেই, ব্যাহেস্ত-ও নেই।

থাকলিও আমাদের সেখেনে নেচ্ছে কেডা, আমাদের তো আল্লা নেই। জাগো আছে, তাগো নেবে।

তবে আমারে আটকাস ক্যানো, বাঘের পেটে গেলি যাবো, সাপে কাট্‌লি কাটবে, আটকাস ক্যানো মা?

আমার যে কেবল তুই আছিস। যাগো আল্লা আছে, তারা আল্লা ছাড়ে না। আমি তোরে ছাড়বো কেন? তবে তুই মরলি ভালো, আমি তালি মরতি পারি।

এইভাবে কথাবার্তার পর ওরা পস্পরকে খুব ভালোভাবে বুঝে নিল! উনুনটার পীঠ-পেট থেকে চাকলা চাকলা মাটি উঠে গেল। একদিন মা বলল, উনুনটা ভাঙে আবার তৈরি করতে হবেনে। মাটি তো সব খায়ে ফালাইলি।

খালের ওদিকে একটা বড় তেঁতুল গাছ। চল্লিশটা বাঁদরের একটা দল সেখানে থাকে। তারা টক টক তেঁতুলের পাতা ছিঁড়ে নিচে ফেলে দেয়, কাঁচা তেঁতুলও ফেলে। মেয়ে খালের এপারে, তেঁতুলতলা থেকে পাতা আর ফল সংগ্রহ করে। কখনো কখনো খাল পেরিয়ে ওপারে সুন্দরী, গেঁউয়া, গরান, ক্যাওড়া, হোগলা, গোলপাতা, বেত আর হারগোঁজকাঁটার জঙ্গলে ঢোকে। কাদার মধ্যে বাঘ আর হরিণের পায়ের ছাপ দেখতে পায় কিন্তু কপালে তার বাঘ জোটে না।

ছয় মাস আগে বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু তিন মাসের ভিতরেই মেয়ের অরুচি, বমি আর তারপর থেকে সে মাটি আর টক খেতে শুরু করার পর মা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু মেয়ে কিছুই বোঝে না মায়ের ব্যাপার। মা মেয়ে দুজনকেই লম্বা লম্বা উপোস দিতে হতো। কিন্তু মায়ের অরুচি বা বমি বা মাটি খাওয়া এসব কিছুই ছিল না। একদিন মেয়ে বলে, অমা, পেটের মধ্যে কি জানি নড়তেছে।

কাছে আয় দেখি।

সে কাছে এলে মা মেয়ের ময়লা ছেঁড়া শাড়ীর কসিটা আলগা করে তার পুরো তলপেটটা উদোম করে ফেলে। অত বড়ো তলপেট দেখে চমকে ওঠে মা। পেটে কি দানো বাড়ছে? তাই তো হবে। দানোয় ধরেছিল যখন তখন দানোই জন্মাবে। মেয়ের তলপেটের উপর হাত রাখে মা, ধীরে ধীরে পুরো তলপেটে হাতটা ঘুরিয়ে আনে, মাঝে মাঝে থেমে কি যেন টের পেতে চায়। শেষে এই সকালবেলায় বাসি-বিছানাতেই মেয়েকে ময়লা কাঁথার উপর শুইয়ে দেয়। তারপর নিজেও তার পাশে শুয়ে পড়ে একটানে নিজের শাড়িটাকে আলগা করে মেয়ের হাতটা নিয়ে নিজের তলপেটের উপর রাখে। মায়ের গর্ভ কি বিশাল। মেয়েতো কোনোদিন দেখেনি। কি লুকোতে পারে তার মা, বাপ রে বাপ! অনেকক্ষণ পরে মেয়ে আস্তে আস্তে বলে, মা, আয়, দুজনাই মরি। ক্লান্তিতে মা চোখ দুটো খুলে রাখতে পারে না। চোখের পাতা বন্ধ করে একটু যেন আরাম পেয়ে মা বলে, দুইজন কচ্ছিস কেন? চারজন ক। মেয়ে সে কথার জবাব না করে বলে, আয় মরি।

আমাদের আল্লাও নেই, আজরাইল-ও নেই, যান কবচ করবে কেডা?

তোর যত কথা, আজরাইল লাগতিছে কি জন্যি। চল, গলায় কলসি বাঁধে ডুবে মরি। কামট্‌ হাঙরেই সাবাড় করে দেবেনে। না হলি, চল্‌ জোঙ্গলে যাই রাত্তিরে রাত্তিরে। একটা হাঁড়ি নেবানে, আমি বাঘ ডাকতে পারি।

কি যে কথা কস- শ্যাষে বাঘের গু হতি হবে।

আমরা তো এমনিতেই গু, তার চেয়ে ভালো কিসি!

মা মেয়ে দুজনে দুজনের তলপেটে হাত দিয়ে শুয়ে থাকে। দুজনের দুটি দানো তাদের হাতের মধ্যে খেলা করে, খুদে পায়ে লাথি মারে, কখনো মাথা দিয়ে গোঁত্তা দেয়, চিমটি কাটে, খামচা মারে।

মা, তবে মরবি না- মেয়ে শুধোয়।

না।

তাহলি কি হবে মা?

সময় হলি দেহিস ক্যানও কি হয়।

রাতে বাঘের গর্জন শোনা গেল। আওয়াজ শুনেই মেয়ে বুঝতে পারে বাঘ বাহিনীকে ডাকছে। খালের ওপারেই জঙ্গল- সুন্দরী, ক্যাওড়া, গরান, পশর, বেইন, গোলপাতা, কেয়া, কানড়, হাড়গোঁজকাঁটা আর বেতের এক-একটা খচ্ছর অন্ধকার জায়গা, নরম কাদায় থিক-থিক করছে। পায়ের পাতা পুরো ডুবে যায়। বল্লমের মতো শুলোয় ভরা। গাছগুলোর গোড়ায় কাদা মাটির চিহ্ন। জোয়ারের জল গাছের গায়ে কাদার রেখা এঁকে দিয়েছে। এর মধ্যে লম্বা লম্বা পা ফেলে বাঘ বাঘিনীকে ডাকে।

সকালেই উঠেই মেয়ে জঙ্গলে যায়। অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাঘের পায়ের ছাপ স্পষ্ট দেখা যায়। ইচ্ছে করলেই সে খাল পার হয়ে লোকালয়ে আসতে পারতো। কিন্তু মানুষ, গরু বা ছাগলের চেয়ে তার বাঘিনীকে দরকার বেশি। মেয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। কাঁটায় আটকে তার ছেঁড়া শাড়ি পরন থেকে খুলে গেলে সে ফিরেও তাকায় না। অনেকটা ভিতরে গেলে বনের ভীষণ ঠাণ্ডা ছায়া, তার মধ্যে মেয়ে সারাদিন বাঘ খুঁজে বেড়ায়। সন্ধের আগে আগে সে বাড়িতে আসে, সারা শরীরে রক্ত, পরনে শুধু ছিন্ন ধুরধুরে শায়া, ডাকিনীর মতো লালচে চুল খোলা। মা এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে।

কনে গিয়েছিলি মা আমার?

বাঘডারে পেলাম না মা।

উঠোনে তখনো একটু আলো আছে। সেই আলোটুকু থাকতে থাকতেই গাঁয়ের কিছু লোক মা-মেয়ের বাড়িতে আসে।

এসব কি হতিছে- ওদের একজন প্রথমে মায়ের পেটের দিকে, তারপর আধ ন্যাংটো মেয়ের ফুলে ওঠে তলপেটের দিকে দেখায়। মায়ের চোখ দুটো হঠাৎ কপিশ হয়ে যায়, তুই একটু ভিতরে যা তো মা।

মেয়ে ভীষণ ভারি গর্ভ টানতে টানতে ঘরে ঢোকে। সে ভিতরে গেলে মা গাঁয়ের লোকদের দিকে তাকায়।

তোমার পোলার নাম মহম্মদ না? যে প্রশ্ন করেছিল তার দিকে ফিরে শুধোয় মা।

তোমার পোলার নাম আশেকালি না, তোমার পোলার নাম কামাল না, আর তোমার পোলার নাম চেরাগালি না? মা আর তিন জনের দিকে চোখ রেখে জিগগেস করে।

আমাদের পোলার নাম শুনে তুমি করবা কি? যা কই জবাব দাও। হাঁড়ি খাইয়ে চলে গেলি বেড়াল চিনবা?

কি করতি হবে তাই শুনি- মা শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে।

ওসব ফালায়ে দাও পেটের থে, না হলি সোমাজে থাকতি পারবা না। জেনা করলি সোমাজে থাকা যায় না।

জেনা কেডা করিছে?

তোমরা, তোমরা মা-বেটি।

কার সাথে করিছি?

তার আমরা কি জানি? করিছ তাই জানি। এতদিন লুকায়ে রাখিছিলে, এখন তো পেট বারোয়ে পড়িছে। আগে কি আইচি কোনোদিন বলতি? এখন দেহিচি, এখন আইছি। আল্লার আইন মানতি হবে সগগ্‌লের।

আল্লার সঙ্গে তোমাদের কথা হয়?

হ্যাঁ, হয়।

সে বিটা কি কয়?

খবরদার ছিনাল মাগী, মুখ সামলে কথা কবি। সে বিটা কি কয় জানা নেই না! কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুতি পাথর ছুঁড়ে খতম করতি হবে তোদের।

সেই বেবস্থাই কর গে তোমরা। তোমাদের পোলাগুলারেও নিয়ি আসবা। ওদের মাটিতে পোতবা মাথা থিকে কোমর ইস্তক। আল্লা নেই, তাই আল্লার কথা কচ্ছো। থাকলি এতক্ষণে ঠাঠায় পুড়ে কেলায়া থাকতা।

সোমাজে থাকতি পারবা না কলাম।

সোমাজে নেই আমরা, খালডার ওপারেই জোঙ্গল।

বলতে বলতেই মা জং-ধরা দাখানা হাতে তুলে নিল। এখন আর উঠোনে দিনের আলো নেই। জয়ঢাকের মতো মায়ের বিশাল পেট, বর্তুলাকার কঠিন দুটি স্তন, অপার্থিব মুখশ্রী। দা হাতে উঠোনে নাচতে থাকে মা। মুখের কোন দিয়ে গেঁজলা উঠে যায়।

আর একটু রাত হলে মা মেয়ে পেট পুরে জল খেয়ে শুয়ে পড়ে। পেটের মধ্যে জল খলখল আওয়াজ করছে। মেয়ে আইঢাই করতে করতে উঠে পড়ে। পা ছড়িয়ে পাটকাঠির দেওয়ালে পা ছড়িয়ে বসে। সামনে তার পর্বতউঁচু গর্ভ, কিছুই দেখা যায় না। মা-ও উঠে বসে তার পাশে। ঘরে তেমন অন্ধকার নেই, চাঁদের আলো আসছে। দুজনে দজনের পেটে হাত রাখে। দূরে বাঘ ডাকে, বাঘিনীকে খুঁজে পায়নি বোঝা যায়, চারপাশে কট কট করে ব্যাঙ ডাকে, পোকামাকড় শব্দ করে, ঝিঁঝিঁরা ডানা ঘষে। প্যাঁচা ডাকে, ফেউ ডাকে। চারিদিক থেকে এত শব্দ আসে, মা-মেয়ে অত শব্দের মধ্যে কালা হয়ে বসে থাকে।

মা, আমরা তো খাই নি কিছু, এক পেট পানি খাইছি, ওরা কি খায়?

ওরা তোরে খায়, আমারে খায়।

আমাদের খাইয়ে কি পাবে? রক্ত নেই যে খাবে।

যতোক্ষণ হাড়-মাস আছে, তাই খাবে। জানতিও পারবি নে।

তোর পেটে ছিলাম যখন, তখন হাড়-মাস খাইচি তোর মা?

মা মেয়ের পেটের উপর থেকে হাত সরিয়ে মাথায় রাখে। মেয়ে কাঁদতে শুরু করবে, তখন, যন্ত্রণায় তার গলা আটকে যায়। পেটের মধ্যে দানোটা কষে নেংটি এঁটে নোনা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। অনেক পথ সাঁতরাতে হবে তাকে। কূলহীন দরিয়া, অগুনতি নোনা নীল ঢেউ ছাড়া আর কিছু নেই। মাথা উঁচু রেখে হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতরাতে আরম্ভ করেছে দানোর বাচ্চা। মেয়ের পেটের মধ্যে পানসে রক্ত ফেঁপে ফুলে কলকল ছলছল ডাক ছাড়ে। বাতাসে নৌকার পালের মতো ফুলে ওঠে। সমুদ্রের মধ্যে দ্বীপই বটে! গাছপালা, মাটি, ঘাস, মিষ্টি জল, হালকা লাল রঙের আকাশ- কোনো কিছুরই অভাব নেই। দ্বীপের মধ্যে থেকেই রাক্ষুসে খোকা হাত-পা ছুঁড়ে নোনা সমুদ্রে সাঁতার কাটে। কনুই আর মাথার ধাক্কায় পেট মাঝে মাঝে উঁচু হয়ে ওঠে, দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে মেয়ে। এখুনি যেন সে নাড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে।

কেন নষ্ট করলি নে, কেন নষ্ট করলি নে- মেয়ে এক হাতে নিজের পেট চেপে আর এক হাতে মায়ের চুল খামচে ধরে- নিজিরডাও রাখলি, আমারডাও রাখলি, অ রাক্ষুসী দোজখের সেপাই রাহিছিস?

মা শান্ত গলায় ছনের চালের ফুটো দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে বলে, আল্লা নেই, দোজখ নেই, ব্যাহেস্ত নেই, কি জন্যি চিল্লাচ্ছিস?

মা ঘরেই বসে থাকে, মেয়ে ধামা পেট নিয়ে খাল পার হয়ে জঙ্গলে যায়- হাঁটু পর্যন্ত শাড়ী বাগিয়ে ধরে- শুলোর ফাঁকে ফাঁকে কাদায় পায়ের পাতা ডুবিয়ে ঘুরে বেড়ায়- বাঘ বাঘিনীর খোঁজে দূরে সরে যায়, সর সর শব্দে চিত্র-বিচিত্র মহাসর্প মাথা নামিয়ে আড়ালে চলে যায়। লতায় পাতায় কাঁটায় জড়িয়ে গিয়ে মেয়ে সন্ধে পর্যন্ত আটকে থাকে একদিন। উরু থেকে, বুক থেকে, ঘাড় থেকে অনেকটা করে মাংস যায় তার, দেহ থেকে রক্ত নামার অনেকগুলো মুখ তৈরি হয়। কাদায় জলে রক্তের ছড়া দিতে দিতে , মেয়ে অনেক রাতে বাড়ি ফিরে দেখে মা ঘরের এক কোণে আঁধারের মধ্যে শুয়ে আছে।

মা, কি হয়্যাছে, শুয়ে আছিস কেন? কুপিডা জ্বালাসনি কেন? মেয়ে ভাঙা গলায় কথা বলতে বলতে মায়ের কাছে আসে। মেয়ে ভাঙা গলায় কথা বলতে বলতে মায়ের কাছে আসে। অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে মায়ের গায়ে হাত পড়তেই সে চমকে উঠে। এ যে সাপের গা। মা তার চিরকালই ঠাণ্ডা। জ্বরের কপালে ঠাণ্ডা হাত এমনিই মায়ের গা, কিন্তু সে তো বাঁচা-ঠাণ্ডা, আর এ ঠাণ্ডা যে মরা। মেয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচায়- মা কনে গেলি, অ মা!

আরো মরা ঠাণ্ডা গলায় মা সাড়া দেয়, ভয় পাস নি, আমি বাঁচে আছি, কুপিতি এট্টু তেল এহনো আছে, জ্বালা দেহিনি। মেয়ে বহু কষ্টে অনেকটা সময় নিয়ে কুপিটা জ্বালায়। মা রক্তে ভেসে যাচ্ছে; কি আক্রোশে শাড়ি খুলে ফেলেছে, মা তার ন্যাংটো, কুপি নিয়ে কাছে গেলে মা বলে, দানোটা পেটে থাকলনি, বারোয়ে আইছে।

যা দেখার এখনই দেখে নিতে হবে। কুপিটা দাউ দাউ করে জ্বলছে, একটু পরই নিভে যাবে। মেয়ে দেখতে পায় মায়ের পাশে রক্ত আর জলের মধ্যে একটা খোকা শুয়ে আছে। একবার দেখে আর একবার দেখতে গেলে কুপিটা দপ্‌ করে জ্বলে উঠেই জবাব দেয়। হাতের আন্দাজে মেয়ে ভেজা চপচপে শাড়িটা দিয়ে মাকে ঢাকে। তারপরে আছাড়ি-পাছাড়ি করে মেয়ে, চোখ তার কপাল থেকে বেরিয়ে আসে, সে গড়াগড়ি দেয়, শ্বাস নেবার জন্যে গলা থেকে তার কঠিন আঙুল সরিয়ে দেবার চেষ্টা করে, মা এহন আমরা কি করি! এই বলে মেয়েও মার পাশে শুয়ে পড়ে।

অনেক রাতে চাঁদ পুরোপুরি ঘরে ধুঁকে গেলে মা আস্তে আস্তে মেয়েকে জাগায়, এইবার ওঠ্‌ মা, দানোটারে বাইরে শিয়েলের মুহে দিয়ে আয়। ও বাঁচে থাকলি কাল আমি জাউরা পুরুষজাতটারে দেহাতাম আমরা পারি ফুল ফোটাতি। গু-মুতের মদ্যি যারা গলা পর্যন্ত ডুবোয়ে বসে থাকে, গু-মুতের স্বপ্ন দ্যাখে, তাদের দেহাতাম! যা মা, ওঠ, ওডারে ফেলে দিয়ে আয়, মাটির শরীল, আর এট্টু বাদে গন্দো ছড়াবে, মাটিতে দিয়ে আয়।

জ্যোৎস্নার মধ্যে মেয়ে উঠে দাঁড়ায়, চাঁদে পাওয়া নিশির ঘোরে সে খোকাটাকে দুহাতের উপর শুইয়ে একটু একটু দোলায়। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে জ্যোৎস্নার সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে আকাশপ্রমাণ মেয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। একটু পরেই দেখা যায় সে হোগলার ঝোপের আড়ালে হাঁটু গেড়ে বসে বনবেড়ালের মতো মাটি আঁচড়াচ্ছে। যতবার সে মাটি চাপা দেয়, খোকাটা হি-হি করে হাসতে হাসতে একবার হাত বের করে মাটির উপরে, একবার পা বার করে- এক একবার ঢুঁ মেরে মাটি সরিয়ে মাথা বার করে চাঁদের দিকে চেয়ে ফিকফিকে হাসি হাসে। মেয়ে চোপ চোপ বলে তার হাত বা পা বা মাথা থাবড়ে-থুবড়ে মাটিতে ঢেকে দেয় আর এইসব নখরা চলতে চলতে সকাল হয়ে আসে। মেয়ে এবার খেয়াল করে, সত্যিই মরেছে বটে পিথিমি, চিৎ হয়ে মরে আছে, তা না হলে বাতাসের শব্দ নেই কেন, গোলপাতার জিরিজিরি পাতা দোলে না কেন, বলেশ্বরে ঢেউয়ের শব্দ নেই কেন, হরিণঘাটার যেখান থেকে সমুদ্রের গর্জন ওঠে, শাদা ফেনা আকাশ ছুঁতে যায়, রূপোলী ধোঁয়ায় বোন নদী আকাশ ঢাকা পড়ে- সেসব কিছুই শোনা যায় না, দেখা যায় না কেন।

মেয়ে ঘরে ফিরে এসে দেখতে পায় মা তার মরন-ঘুমে ঘুমিয়ে আছে। দুই ঠোঁটে বজ্র আঁটুনি, মাঝখানে কালো রক্তের সুতো; পিঁপড়েরা মুখে খাবার নিয়ে সুতো পেরিয়ে মায়ের মাথার উপর দিয়ে সিঁথি বেয়ে নেমে যাচ্ছে। এইরকম বোজা চোখ আর খুলবে কি? নাকের দুপাশে জলের দাগের খাঁড়ি দুটি আর কখনো বোজানো যাবে কি? মেয়ে মায়ের দিকে ঝুঁকে আসে, মা, তুই কি আমারে ছেড়ে গেলি, তুই যে আমারে ছাড়বিনে কয়েছিলি? বার দুয়েক নিজের মনে কথাগুলি বলে গলা ফাটিয়ে বাতাস ছিঁড়ে চেঁচাবার তোড়জোড় করছিল মেয়ে, এমন সময় চোখ মেলে মা মেয়েকে দেখতে পায়। দেখতে দেখতে মায়ের চোখের মণি দুটি বড়ো হতে থাকে, কালো মনির মধ্যে দুই বিন্দু আলোর কণা, তার তাপে মণি দুটি গলতে থাকে। নাকের দুপাশের পুরনো খাঁড়ি দুটি বেয়ে দুটি ধারায় জীবন্ত অশ্রু বেরিয়ে আসে।

যে বাতাসে পৃথিবীর বসবাস উঠে যায় একদিন সে বাতাস বইতে শুরু হলে মা মেয়েকে আর কিছুতেই জঙ্গলে যেতে দেয় না, তুই জঙ্গলে গেলে আমি ডুবে মরবানে।

বাঘের গর্জন আর শুনতে পায় না মেয়ে। একদিন শুনেছিল বাঘিনীর আওয়াজ। ততদিনে বাঘ সেখান থেকে চলে গেছে। মেয়েকে সামনে বসিয়ে মা একদৃষ্টে তার দিকে চেয়ে থাকে। মেয়ের হাত-পা সরু হয়ে আসে, কপালের দুপাশ বসে যায়, ডাগর চোখ দুটি ছলছল জ্বলজ্বল করে, চামড়া হলুদ হয়ে আসে আর অন্যদিকে তার গর্ভ দিন দিন প্রকাণ্ড হয়ে উঠতে থাকে। পাছা আর বুক ভারি হয়, স্তনের বোঁটার নিচে খয়েরি বৃত্ত দুটি বড় হয়ে যায়, খয়েরি রঙ ঘন খয়েরি হতে থাকে। মা প্রহরের পর প্রহর ধরে এইসব লক্ষ্য করে। ওদিকে যে বাতাস বইতে শুরু করেছিল, তার জোর বাড়তে থাকে, মুহূর্তগুলিকে আগে-পিছে করে দেয়, বুনো শুয়োরের রোখে মাটি ঘেঁষে জঙ্গলের দিকে যায়। দীর্ঘ ঘাসের বন নদীর স্রোতের মতো টানা বইতে থাকে, গরান ক্যাওড়া সুন্দরী হুটোপাটি করে দোলে, পাখির দঙ্গল গাছের ডালে বাড়ি খেয়ে হলুদ পাতার মতো নিচে পড়ে, বাতাস জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সাঁই-সাঁই করে মা-মেয়ের কুঁড়ের দিকে এগিয়ে আসে, আষাঢ় শ্রাবণ ভাদ্র আশ্বিন বাতাসের ঘূর্ণির মধ্যে ঢুকে তীব্র বেগে ঘুরপাক খেতে খেতে গলে মিশে একাকার হয়ে যায়।

এই বাতাসের কি শেষ নেই- মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মা ভাবে, এত বাতাস কোথা জমা আছে, শ্যাষ হয় না কেন! খালের জল আকূল হয়ে বাতাস ধরার জন্য ফুলে ওঠে; বাতাস আকাশ ঝেঁটিয়ে বেড়ায়, উল্টো ডিগবাজি খেয়ে জলকে জড়িয়ে ধরে। বলেশ্বরের লক্ষ লক্ষ ছোট ছোট ঢেউয়ের প্রত্যেকটিতে একটি করে চোখের মতো শাদা আলো জ্বলে। তারপর হঠাৎ বাতাস থেমে যায়। একদিন বিকেল্বেলায় ঘন কালো মেঘ করে আসে আকাশে। কি আশ্চর্য। এমন করে বাতাস থেমে যায় কেন? তার এত রোষের শোঁসানি আর শোনা যায় না। জলের শব্দ থামে, ঢেউয়ের শব্দ থামে। শুধু পাওয়া যায় বিপুল জলের সমুদ্রে নেমে যাওয়ার আওয়াজ। কালো মেঘ নিচে নেমে আসে। সন্ধের খানিকটা আগে কালো মেঘ, কালো জল আর কালো অরন্য একসঙ্গে মিশে যায়, তবু বাতাস থেমে থাকে। দূরে বাঘ ডাকে। সেই ডাক শুনে মা মেয়ে চমকে ওঠে। তারা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।

সন্ধের একটু পরে সমস্ত কালো আস্তে আস্তে লাল হতে থাকে। মা-মেয়ে কালোর মধ্যেই বসে ছিল, তাদের আজ আলো নেই, তেল নেই, খাবার নেই। মা মেয়ের খুব কাছে এগিয়ে এসে তার বিরাট গর্ভে হাত রেখে আঁধার ফুঁড়ে একদৃষ্টিতে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে তার সমস্ত পৃথিবী মেয়ের মুখে দেখতে পায়- কী বিষণ্ণ মাটি এই পৃথিবীর, আহা মাটির কী বিষণ্ণ রঙ, মাটিতে কী চমৎকার চোখ, জোড়া-জোড়া, ভাসা-ভাসা, কী অসংখ্য নদী-নালা, কী নিঃশব্দে হাঁটে তারা, কী ধীরে কাটে মাটি। মা এইবার বলে, আর কোনোদিন দেখতি পাব না মা তোকে। কি গজব, কি গর্কি আসতিছে আমি জানি। তুই কোন্‌দিকি যাবি, আমি কোন্‌দিকি যাবো, আমরা জানিনে মা। কেউ জানে না। এই নদীতি, আঁধারে, সমুদ্দুরে, জোঙ্গলে মিশে যাবো, জানবো না আমার এমন একটা মেয়ে ছিল।

মা, আমাদের আল্লা নেই?

না, মা দৃঢ় কণ্ঠে বলে, ওদের আছে, মওলানা মৌলবীগো, বড়লোক, ধনীগো আছে; মাতাল, বজ্জাত, জাউরা, পুরুষগো আছে, অগো সব আছে, তারপরে আবার আল্লাও আছে।

মা, অতো রাগিস ক্যানো?

কেডা কইছে রাগিছি। আল্লা ওগো কত কাজ করে দেয় দেহিস নি। তা না হলি সিদিন কি ঠাঠা নামত না?

এইসব কথাবার্তার মধ্যেই সমস্ত আকাশ টকটকে লাল হয়ে ওঠে। বনজঙ্গল মাঠ নদী ফেলে রেখে অন্ধকার গনগনে লাল হয়ে ওঠে। বনজঙ্গল মাঠ নদী ফেলে রেখে অন্ধকার গনগনে লাল আগুনের রঙ নিয়ে আকাশে উঠে যায়। কিছুক্ষণ পর প্রচন্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ আসে। মে-মেয়ে চেয়ে দেখে বিস্ফোরণে আগুনে-লাল আকাশ চৌচির হয়ে গিয়ে খণ্ডে খণ্ডে নেমে আসছে। পাহাড়-প্রমান সব আগুনের গোলা। তখন দ্বিতীয় আরেকটি বিস্ফোরণে পৃথিবীর মাটি ফেটে যায়, রক্ত রঙিন জল আকাশে ওঠে যায়, প্রচণ্ড গরম জলের স্তম্ভ তৈরি করে। একটির পর একটি স্তম্ভ, যেদিকে চোখ যায়, রক্তাক্ত জলস্তম্ভ। সমুদ্র ফুলে ওঠে, হরিণঘাটার মোহনা মাথা-শিং ঝাঁকি দিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়ায়। মা-মেয়ে এতক্ষণ মুখোমুখি বসে ছিল, এখন মা উঠে মেয়ের পাশে বসে প্রাণপণ শক্তিতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে, বার বার চুমু খায় তার গালে, আমি তবে যাই মা, তুই-ও যা- বলতে বলতে মা শুনতে পায় সমুদ্রের ভিতর থেকে বাতাস এসে পৌঁছে গেল, মুষলধারে বৃষ্টিও নেমে গেল। ফোস্কা পড়ে যায় এমন গরম বৃষ্টি! তারপর আর আগে নয়, এখন নয়, তখন নয়, সন্ধেয় নয়, সকালেও নয়- সময়ের সীমানা চুরমার করে দিয়ে স্থির জলস্তম্ভগুলি সচল হয়ে ওঠে। মা-মেয়ে দুজনেই চকিতে দেখতে পায় আকাশপ্রমাণ জলস্তম্ভগুলি এগিয়ে আসছে, তাদের মাথায় কালচে রক্তের আবরণ, হাজার হাজার ঝিকমিকে চোখ, একটু নিচে সুন্দরী, ক্যাওরা, গেউয়া, গরান গাছের চলন্ত জঙ্গল আর দেখা যাচ্ছে বলেশ্বরের তীর ঘেঁষে বাঁধা কালো নৌকাগুলি- জলস্তম্ভগুলির ভিতরে নাগরদোলার মতো দুলছে। মা-মেয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আবার দেখতে পায় বলেশ্বরের তীরের তালগাছগুলি শুকনো ঘাসের মতো উঠছে নামছে- আস্তো নৌকোগুলিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারই মধ্যে একটি জলস্তম্ভ ভেঙে দু হাত উচিয়ে বেরিয়ে আসে কঠিন ধাতব এক অতিকায় প্রাণী। কুঁড়েঘরসুদ্ধু মা-মেয়েকে সে আকাশে তুলে ধরে। তখন তারা চেতনা হারায়।

সকাল হলে মা-মেয়ের জ্ঞান ফেরে বা তাদের ঘুম ভাঙে। মা উঠে বসেছে, মেয়ের পাশে শুয়ে শুয়োর-ছানার মতো চেঁচিয়ে আকাশ ফাটাচ্ছে দু-নম্বর খোকাটা। হরিণঘাটার মোহনায় জলের তলা থেকে বেরিয়ে আসছে আরক্তিম সূর্য, প্রচণ্ড শব্দে জল নেমে যাচ্ছে বলেশ্বরে। বলেশ্বর সেইসব জল সংগ্রহ করে টেনে নিয়ে ফেলছে হরিণঘাটার মোহনায়। আকাশে উঠতে কত সময় নিচ্ছে সূর্য, মোহ্না ফুলে উঠে দিগন্ত ঢেকে দিচ্ছে, সূর্যকে চেপে ধরছে জলের নিচে।

মা দুই হাঁটুতে কনুই রেখে গাল চেপে ধরে জল সরে যাওয়া দেখছে। কাৎ হয়ে শুয়েছে মেয়ে। খোকাটার চিৎকারে তার ভ্রুক্ষেপ নেই, দুই চোখ আধখোলা রেখে হলুদ এই মেয়েও দেখছে জল সরে যাওয়া; সবুজ ডালপালা নিয়ে বিশাল বিশাল গরান, গেউয়া, সুন্দরী, বেইন তীব্রবেগে নিচে বঙ্গোপসাগরের দিকে নেমে যাচ্ছে। কোথাও আটকে গেলে মুহূর্তের জন্য থেমে দুটো পাক খেয়ে গিঁট খুলে বা ছিঁড়ে আবার নামছে নিচে। বলেশ্বরের গা মাথা দেহে এখন দেখা যায় না। সরু বুকচাপা খালগুলিও না, জলের নিচে কতসব মারাত্মক গলিঘুঁজি, বিচিত্র সব আঁকশি। তাতে আটকে যায় ভাঙা নৌকার টুকরো, জলশয্যায় শোয়া তালগাছ, ছেঁড়া ডালপালা লতাগুল্ম। মেয়ে দেখতে পায় এত উঁচুতে তার কাছে ভাসতে ভাসতে চলে এলো একটা ডোরাকাটা পুরুষ বাঘ। মেয়ের সব মনে পড়ে যায়। বাঘিনীকে ডেকে ডেকে হয়রান হচ্ছিল সে, এখন চার হাত পা গুটিয়ে নিশ্চিন্তে নেমে যাচ্ছে।

মেয়ে মাকে ডেকে দেখাতে চায় এই ছবি, তখনই আসে প্রথম মৃতদেহটি। অনেক দূর দিয়ে সেটা চলে যায়। তারপর আর একটি, তারপর আর একটি, তারপরে একটির পর একটি, হাজারে হাজারে তারা আসে, ইলিশের ঝাঁকের মতো, মা-মেয়ের থেকে অনেক তফাৎ দিয়ে তারা চলে যায়, অনেকটা নেচে নেচে মঞ্চ থেকে বিদায় নেবার ভঙ্গিতে। গাছের গুঁড়ির সঙ্গে, পৃথিবীর পাথরের সঙ্গে, মোটা মোটা ডালে থুতনি আটকে কখনো একটু থামে তারা। তারপর ঝাঁক থেকে আলাদা হয়ে যায় এক লাশ, একটু আসছি বলে, ডুবতে ডুবতে, ভাসতে ভাসতে, পাক খেতে খেতে সে এগিয়ে আসছে মা-মেয়ের কুঁড়ের চালের দিকে। কাছাকাছি এসে লম্বা একটা ডুব- সাঁতার দিয়ে সে কুঁড়েঘরের চালাটির একটি প্রান্ত স্পর্শ করে থামে। মা-মেয়ের এক রাতের কথা মনে পড়ে। উদোম, ছোরা ওঁচানো, হিংস্র ডোরাকাটার মতো এক পশু। একটি মুহূর্তই শুধু- লাশ আবার বলেশ্বরের পথ ধরে নিচে নেমে যায়।

বঙ্গোপসাগরের হাঙরেরা অপেক্ষায় থাকে। মা-মেয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমায়। দানোর বাচ্চাটি চিল-চেঁচিয়ে সারা হয়।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ