মুজিব ইরম প্রণীত ছুটির লেখা : এইম ইন লাইফ

রচনা
পূর্নমান ১০০। সাধু ও চলিত রীতির সংমিশ্রণ দূষণীয়।

বালক তবে কী হইতে চাহিয়াছিল--এতো দিন পর ভাবিতে বসিলে সেতারের তার কিঞ্চিৎ ঝন করিয়া আব্দুল করিম খা’র অঙ্গুলি হইয়া উঠিল! অ-বুঝদার হেতু সাধু ও চলিত রীতির সংমিশ্রণ করিয়া বহুবার পরীক্ষার খাতায় নাম্বার কাটা যাইবার উপক্রম হইয়াছে, তথাপি শ্রী রনজিৎ দাশ--যিনি বাংলার শিক্ষক ছিলেন, সংস্কৃত জানিতেন--নাম্বার কাটিতেন না। কহিতেন--বাংলায় এই বালকের সমকক্ষ কোনো ছাত্র তিনি এ যাবৎ পান নাই। তবে কি বালক বাংলার রণজিৎ স্যার হইবার খায়েস করিয়াছিল?


সেতারে আরেকবার ঝঙ্কার উঠিল।

না, বালক এমত স্বপ্ন রচনা করে নাই। তাহা হইলে কী স্বপ্ন তাহার ভিতর এমন অঙ্কুরিত হইয়াছিল? তাহা কি মনুজলে উড়াল-পাখিদের ছায়া সন্তরণশীল মাছ হইতে দেখিয়াছিল বলিয়াই তাহার ভিতর স্বপ্ন হইয়া নামিল? তাহাও মনে পড়ে বটে, কিন্তু বালক এই রূপ উড়াল পাখির ছায়া হইতে কখনো চাহিলেও মনে তেমন দাগ কাটিয়া নাই। দাগ কাটিয়া আছে অন্যত্র। আজ রজনী গভীর হইলে উড়াল-পাখির ছায়া মনুর উজান জলে সন্তরণশীল মাছ হইয়া ফিরিবার তাড়না জাগায় বটে, বালক তবু পথ ভুল করিয়া উড়াল-পাখির ছায়াকে মায়া ভাবিয়া ভিনবাসে ফানা হইয়া থাকে। তাহা হইলে কোন সে-স্বপ্ন তাহাকে এমত গৃহহীন করিল?

শীত তাহার ভালো লাগিত। কেননা, শীতে বিবাহ হয়, শীতে উড়াল-পাখির ছায়া বিলে এসে নামে, শীতে মেলাবান্নি হয়, পড়শিদের উঠানে নাইন-ও-ক্লক ফোটে।...শীতে অনেক কিছুই হইয়া থাকে। এক শীতে তরুণী বালার বিবাহ হইয়াছিল। ঢাকা-সিলেট বিরতিহীনের দরজায় দাঁড়াইয়া হাতেপায়ে বাতাস কাটিয়া গেলে, তাহাকে তরুণী বালার যোগ্য বর ভাবিতে হয়। যথাসময়ে বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়াইয়া তরুণী বালার বরের বাতাস কাটিয়া যাইতে দেখিয়া বালকের কি তবে বিরতিহীন বাসের হেলপার হইবার সাধ জাগিয়াছিল?


সেতারে বেজে ওঠে পাখির ওড়াল।

মানুষ মৎস শিকারে যায়। মানুষ কুড়া শিকারে যায়। মানুষ দূর পাহাড়ে ছন কাটিতে যায়। মনুতে গুন টানিতে টানিতে উজান স্রোতে নাই হইয়া যায়। শীত শেষে লাল বর্ণ সুপারির বাকলগুলি ছোবড়া হইয়া পথে পথে জঞ্জাল বাড়ায়। গেন্ডাফুলের হলুদ বর্ণ বিবর্ণ হয়। মনুতে বারকির মাছ উজানে বেঁহুশ হইয়া ফিরিতে থাকে। মাঠে মাঠে চান্দিনা ধানের দুলুনি গালিচা বানায়। জঙ্গলে জঙ্গলে বনুয়া ফুল সুগন্ধী বিলায়। রাস্তায় বিয়ারিং গাড়ির দাগ মেঘ-জলে মিশিয়া কাদা হইয়া ওঠে। এতো এতো বিদায়ের ভিতর বালক কি তবে বড় বড় পাশ দিয়া নগরবাসী হইতে চায়?

না, তাহাও আজ মনে পড়িতেছে না। আমন ধানের পুরুষ্টু হিজা কুয়াশাভোরে বড় রাস্তার পাশে ভিজিয়া থাকে ডাগর নয়নে। বালকের চোখে তাহা বড়ো মনোমুগ্ধকর হয়। বালক এই সব ভুলিয়া কী করিয়া নগরবন্দনা করিতে শিখিবে!

বালকের একবার জ্বর হইয়াছিল। জীর্ণবালক লাঠিতে ভর দিয়া দক্ষিণ-মাঠের রাই ফুলের ক্ষেতে পৃথিবীর সৌন্দর্য অবলোকন করিত। বালকের বড়ো বনরুটি, বাটার বন, ক্রিম রুল ভালো লাগিত হেতু জ্বর কামনা করিয়া সকলের মায়া কাড়িয়া লইলে, একদিন বড় হইয়া পৃথিবীর সব বাটার বনের দোকান কিনিয়া লইবার বাসনা করিয়াছিল। এই বাসনাও তাহার স্থায়ী হইল না। তাহা হইলে বালক কী হইতে চাহিয়াছিল?

ভাদ গাঁওয়ের ঘোষেরা সাদা কাপড়ের গোল গোল ছানার গাঁটরি লইয়া শহরমুখী হয়। সাইকেল-রিক্সার পিছনে ঝুলাইয়া রাখা ছানার গোল গাঁটরি হইতে জলবিন্দু ঝরিয়া পড়ে। শীত নামে দূরের শহরে। ৪ নম্বরি নরম বলের মতো সাদা সাদা মাখনের সেই গোল গাঁটরিগুলি বালকের চোখ হইতে আজও তো হায় উধাও হইল না! তবে কি বালক ভাদ গাঁওয়ের ছানা-বিক্রেতা সেই সব ঘোষ হইতে চাহিয়াছিল?

মানুষ লম্বা চুল রাখে। আমিরী বিচ্ছেদী গায়। করিম হইতে চায়। লক্ষণ ছিরি ছাড়িয়া বন্ধুর জন্য বিবাগী হয়। মালজোড়া গানে শীতরাত কান্না হইয়া ওঠে--‘বাটাতে পান সাজাই রাখলাম বন্ধু এসে খাইল না’। ‘বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ’ এতো সব কান্নার ভিতর কোন সে-সুরের টানে বেপথু বানায়?

উপসংহার: বালক শব্দকে ভালোবাসিয়া বেবুতা হইয়াছে। বালক বাক্যকে ধ্যান করিয়া ফানা হইয়াছে। বালক পদ্যকে জীবন ভাবিয়া ধনহীন/জনহীন হইয়াছে। বালক কি তবে কবি হইয়াছে? তাহা লইয়া এই রচনায় আর কিছু বলা যাইতেছে না। আমেন!



লেখক পরিচিতি

মুজিব ইরম-এর জন্ম মৌলভীবাজার জেলার নালিহুরী গ্রামে, পারিবারিক সূত্র মতে ১৯৬৯, সনদপত্রে ১৯৭১। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান ১৯৯৬, ইরমকথা ১৯৯৯, ইরমকথার পরের কথা ২০০১, ইতা আমি লিখে রাখি ২০০৫, উত্তরবিরহচরিত ২০০৬, সাং নালিহুরী ২০০৭, শ্রী ২০০৮, আদিপুস্তক ২০১০, লালবই ২০১১, নির্ণয় ন জানি ২০১২, কবিবংশ ২০১৪, শ্রীহট্টকীর্তন ২০১৬। উপন্যাস/আউটবই: বারকি ২০১১, মায়াপীর ২০০৯, বাগিচাবাজার ২০১৫। গল্পগ্রন্থ: বাওফোটা ২০১৫। শিশুসাহিত্য: এক যে ছিলো শীত ও অন্যান্য গপ ২০১৬। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে ধ্রুবপদ থেকে মুজিব ইরম প্রণীত কবিতাসংগ্রহ: ইরমসংহিতা ২০১৩, বাংলা একাডেমি থেকে নির্বাচিত কবিতার বই: ভাইবে মুজিব ইরম বলে ২০১৩, Antivirus Publications, Liverpool, England থেকে নির্বাচিত কবিতার বই: চড়বসং Poems of Mujib Erom 2014, ধ্রুবপদ থেকে উপন্যাসসমগ্র: মুজিব ইরম প্রণীত আউটবই সংগ্রহ ২০১৬।

পুরস্কার: মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান-এর জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি তরুণ লেখক প্রকল্প পুরস্কার ১৯৯৬। বাংলা কবিতায় সার্বিক অবদানের জন্য পেয়েছেন সংহতি সাহিত্য পদক ২০০৯, কবি দিলওয়ার সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪। কবিবংশ কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪। শ্রীহট্টকীর্তন কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১৬।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ