অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায়
অক্টোবর মাস জুড়ে সারা আইসল্যান্ডে হাল-চাল মেচেছে।
আইসল্যান্ডের নারীরা দেশের ১৪ শতাংশ পে-গ্যাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ১৪ শতাংশ কম কাজ করবেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শপিংমলের, দোকানের, অফিসের কাউন্টারে ও ডেস্কে দুটো' আটত্রিশের পর থাকবেন না। দুটো' আটত্রিশের পর কোন নারীই আর কোথাওই কাজ করবেন না।
পারিশ্রমিকের অসম বণ্টনের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন পোল্যান্ডের নারীরা।এই বৈষম্য যা কোন খণ্ড চিত্র না। বিচ্ছিন্ন ঘটনাও না সারা পৃথিবী ভেদে। কিন্তু বদলাচ্ছে প্রতিবাদের ধরন। ফেমিনিস্ট তকমায় অবস্কিওর রাংতায় মিডিয়া মুড়ছে প্রতিবেদন।
গবেষণা ও আকাদেমিক মতে ফেমিনিজমের তৃতীয় ধাপ পেরোচ্ছে শতবর্ষত্তোর ফেমিনিস্ট আন্দোলন। হালচাল মেচে চলেছে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। যদি আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপে জ্ঞাতব্য হয়ে উঠেছিল- ফেমিনিজম খায় না মাখে, শাদা ইংরেজিতে 'হোয়াট ইজ ফেমিনিজম', তবে তার তৃতীয় ধাপে অবশ্যই এ আন্দোলন মাথা ঘামাতে বাধ্য হচ্ছে এনিয়ে যে- 'খায় যদি তবে কি করে খায়' অর্থাৎ ' হাউ উই কনজিউম ইট'। আর এ প্রশ্নের মোকাবিলায় ট্রাফিক চিহ্নের মত দিক নির্দেশ করছে একটি লেবেল, যাতে প্রায় ঝালরের মত ঝুলে আছে সেলাই করা 'গিল্ট' সমূহ। লজ্জা-প্রবণতা। অর্থাৎ যেভাবে আপনি " আমি লিবেরাল" এই ঘোষণা আপনার ফেবুতে দিতে পারেন, ঠিক একিভাবে "আমি ফেমিনিস্ট" এই ইনফো জাহির করতে পারেননা। এর পরিসংখ্যান আরও বাড়ে নারীদের বেলায়; অর্থাৎ একজন লিবেরাল পুরুষ নিজেকে যত স্বচ্ছন্দে নারীবাদী ঘোষণা দিচ্ছেন, একজন নারী তার তুলনায় অনেক কম দিচ্ছেন। আশ্চর্যজনক ভাবে কম দিচ্ছেন। অনেক লিবেরাল নারীদের ক্ষেত্রে প্রায়শই অবস্থা দাঁড়ায়- খেতে চাইছেন কিন্তু গিলতে পারছেন না টাইপ । যা আম-মানসিকতায়, সোশাল মিডিয়ায় ক্রমে গুলিয়ে যাওয়া থেকে গুলিয়ে যাওয়া-তর সন্দর্ভের মিথ হয়ে উঠছে ঃ এফ ফর ফেমিনিজম না এফ ওয়ার্ড !
সোশ্যাল মিডিয়া একটু ঘাঁটলেই এই 'এফ ফর ফেমনিজম' আর এফ ওয়ার্ডের মিথ গুলির সংকলন তৈরী হয়ে যাবে। তাদের হাওয়া-বাতাসের মত দাঁড় করানো যায় অনায়াসে। যেমন ঃ
নারীবাদীরা পুরুষ বিদ্বেষী
কেবল মাত্র নারীরাই ফেমিনিস্ট
ফেমিনিস্টরা কেবল নারীদের সুবিধার কথা ভাবেন
ফেমিনিস্টরা রাগী ও ইরর্যাশান্যাল
ফেমিনিস্টরা বেরসিক
ফেমিনিস্টরা বসি
যার শেষোক্ত টি হোল ঃ ফেমিনিস্টরা বগল ও পা কামান না
'ফেমিনিজম কি' তা এই গদ্যের আলোচনার বিষয় যদিও না।
তাও যদি বলি ফেমিনিজমের ধারণা বাক-স্বাধীনতার চর্চাকে প্রাথমিক স্তরে বলবত করার প্রথম ধাপ আর সে বাক স্বাধীনতা যদি হাসতে হাসতেও প্রয়োগ করি, যেমন করেছিলাম একবার ( আমার এক এভানজেলিস্ট সহকর্মীর সাথে কথোপকথনে), আর তা হয়েওছিল প্রায় শেষমেশ পায়েস শেষে চিরতা পরিবেশনের মতই।
আমি তখন এক মিডিয়া হাউসে কাজ করি।
এক ভিডিও ক্যাম্পেইনের প্রজেক্টের কাজে, কিছু কাল্পনিক চরিত্র তৈরি করতে হবে। তাদের নামকরণ করতে হবে। আমার সহকর্মী রায়ান আমায় বলে- তুমি আরও বেশী কিছু নাম রাখ মেয়েদের।
আমি বলি- কেন ? আধা আধা রাখলেও তো হয়।
রায়ান বলে- আমরা মেয়েদের এম্পাওয়ার্ড করতে চাইছি, তাই না ? তার নীল চোখ তৃপ্তির আলোয় আরো নীল হয়ে ওঠে।
তার প্রতিফলন পড়ে আমার ব্রাউন চোখেও। আর আমি বলে ফেলি, নেহাতই বাক-স্বাধীনতা, তাই বলেই ফেলি- 'বাট হাউ ডু ইউ নো যে এই কনি, জেন যেসব নাম নিচ্ছ তারা ফিকশনাল হলেও, তারা ফিকশনালিও তোমার থেকে এম্পাওয়ার্ড নয়, আর তুমি-আমিই বা এম্পাওয়ার্ড করার কে ?'
রায়ানের নীল চোখ ঘোলাটে হয়। গুলিয়ে যাওয়া মাথায়, খিঁচড়ানো মুখে আমায় দেখে নেয় সে। এমনিতেই কোনোকালে আমাকে পছন্দ না তার। এরপর মেইন-স্ট্রিম হলিউড আখ্যানের মত, আগামী যে কয়মাস সে কোম্পানিতে আমি আর টিকে থাকব, সেখানে রায়ান হয়ে উঠবে আমার এনিমি-তম দের একজন, তা আর বলতে কি। অবশ্য, তার তরফ থেকে। অবশ্যই। মা কসম। একজন অফিসিয়াল ফেমিনিস্ট হিসেবে আমি তাকে ভুলেও আমার শত্রু ভাবিনি।
তো, এই হল আমজনতার সারাৎসার, বোদা-মাথার, ফেমিনিস্ট-চিন্তা। ঢুলু চোখে-- 'মেয়েরাও কাজ পারে', 'তারা এগিয়ে আসুন' এবং সর্বোপরি 'আমরা সেভিয়ার' বলার একটা অপমানজনক, আফিংগ্রস্ত ফেক প্রয়াস।
এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে আমার প্রথমেই মনে আসে আমার ছাত্রী রেবেকার কথা। তিনি আমাকে একটি প্রশ্ন করেছিলেন। সেই প্রশ্ন আমাকে সন্দর্ভের তলায় গিয়ে, আকাদেমিক উচ্চারণের অতীতে গিয়ে নারী আন্দোলনের স্বরূপটিকে চিনতে সাহায্য করেছিল।
আমার আন্ডার গ্রাডের সফোমোর-ছাত্রী ছিলেন রেবেকা। ক্লাসে এমনিতে সে চুপচাপই থাকে। প্রশ্ন করতে হাত তোলেনা। জিজ্ঞেস করলে নীচুস্বরে উত্তর দেয়।
একবার তার জমা দেওয়া প্রবন্ধ পড়ে দেখি বারবার লিখছে ঃ I'm not a Feminist though...। প্রায় রেফ্রেইনের পর্যায়ে গিয়ে ব্যবহার করেছে সে এই ফ্রেজ টিকে। অর্থাৎ সেই একই- নিজেকে ফেমিনিস্ট বলতে ভীত। অথচ ইন্টারেস্টিংলি, ফেমিনিজমের ধারণা গুলিকে সে কিন্তু অস্বীকার করছেনা একবারও। আমি রাইটিং অ্যাসাইন্মেন্ট চলাকালীন এমনিতেই ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে কফি ডিসকাশনে যেতে ভালবাসি। রেবেকাকে ডাকলাম একদিন। কফি নিয়ে বসা হোল উপত্যকার ঢালে।
বল রেবেকা, শুরু করি আমি ( এক প্রকার ভনিতাহীন ভাবেই )- কেন তুমি নিজেকে ফেমিনিস্ট বলনা?
উত্তর প্রায় তৈরিই ছিল তার। রেবেকা বলেঃ
-একজন মানুষ হিসেবে আমার পক্ষে এটি গুরুত্বপূর্ণ যে ইম্পেরিয়ালিষ্ট যুদ্ধ, কলোনিয়াল হিংসা, বর্ণবাদ, নারীদের সাথে বা যে কোন জেন্ডারের সাথে বঞ্চনার বিপ্রতীপে কথা বলা। যেকোনো অপ্রেসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। কিন্তু তার জন্যে নিজেকে ফেমিনিস্ট বলতে হবে কেন ?
- বেশ। কিন্তু বল,ফেমিনিজম কি এগুলিকে অ্যাড্রেস করে বলে তুমি মনে কর?
জানতে চাই আমি।
রেবেকা বেশ জোরের সাথেই বলে ওঠে- নিশ্চয়ই করে। কিন্তু নিজেকে ফেমিনিস্ট ঘোষণা করতে হবে কেন ?
-করলে তোমার কি কোন ক্ষতি হতে পারে বলে মনে করছ ?
আবারো জানতে চাই আমি।
-হ্যাঁ, আমার বন্ধুরা ভাবতেই পারে আমি অ্যাগ্রেসিভ। তারা আমায় এড়িয়ে যেতে পারে। আমার এক্স বয়ফ্রেন্ড নারীবাদী দের কথা শুনলেই রেগে উঠত। নখের রং খুঁটে-খুঁটে বলে সে ?
আর তুমি ? তোমার মা ? তোমার বেস্ট ফ্রেইন্ড আছেন, রেবেকা ?
জানতে চাই আমি।
আমার মায়ের সাথে আমার অনেকটাই মেলে। আমার মায়েরও অনেক অভিযোগ পুরুষ-তন্ত্রের বিরুদ্ধে, সমাজের বিরুদ্ধে। কিন্তু তিনি কখনো নারীবাদী হওয়ার কথা ভাবতেই পারেননা। তবে আমার মা নিয়মিত চার্চে যান। আমি যাইনা । তার মতে অভিযোগ তুললে সংসারের শান্তি নষ্ট হয়। ঈশ্বর তা চান না। তিনি ফ্যামিলিকে ভালবাসতে বলেন। আমার তেমন কোন বিশেষ বন্ধু নেই। যারা আছেন, তারা এইসব বাদ-টাদ নিয়ে প্রশ্ন করতে ইচ্ছুক নন। মা বলেন, ফেমিনিস্টদের পুরুষরা এড়িয়ে চলেন। অনেক পুরুষরা মেয়েদের ভয় পেতে শুরু করেছেন।
মনে পড়ে যায় মুহূর্তেই। সুপ্রীম কোর্টের লেজেন্ডারি প্রাক্তন জাস্টিস Ruth Bader Ginsburg একবার বলেছিলেন,পঞ্চাশের দশকে, কলম্বিয়া ইউনিভারসিটিতে 'ল ডিপার্টমেন্টের' বিল্ডিঙ্গে মেয়েদের জন্যে বরাদ্দ কোনো বাথরুম ছিলনা। প্রয়োজনে ছুটতে হত পাশের আর্টস বিল্ডিঙ্গে'।
নেহাতই এই তথ্য দিতে এ প্রসঙ্গ টানিনি। যা বলতে টানছি, তা আছে এই পরবর্তী বাক্যে। বাথরুম ছিলনা, এই তথ্য দিয়ে তিনি জানাচ্ছেন ঃ উই নেভার কমপ্লেইন্ড; ইট নেভার অকারড টু আস টু কমপ্লেইন।
আমি উপত্যকার দিকে তাকাই, ছোটো ছোটো মেঘের ছায়া পড়েছে পাহাড়ের ঢাল ঘেঁষে।
আমি ভাবি, আমরা যারা হোয়াইট-সুপ্রিমেসির বিরোধিতা করতে নারীবাদ কে বুঝতে চাই, একজন 'উওম্যান অফ কালার' হিসেবে, তখন প্রায়ই ভুলে যাই, তার ওপরেও খেলা করছে আরও গভীর প্যাট্রিয়ার্কি । যার জনপ্রিয়তা আকাশ ব্যাপী। খোদ স্বর্গের সাথেই যার সরাসরি কানেকশন। সে মহান বস্তুটি হোলো এই খুলে-আম সহজলভ্য ধর্ম-ধারণা।
'চার্চ কোনদিনই একে প্রশ্রয় দেবেনা। কারণ ধর্ম জিনিশটা চিরকালই মেল-সেন্ট্রিক'। বলি আমি রেবেকাকে। আমাদের পৃথিবীও তাই। মেল-সেন্ট্রিক। এরা বৈষম্য তৈরি করেন। পুরুষের প্রভুত্ব বজায় রাখার জন্যেই এদের সব নিয়ম কানুন।
পশ্চিমের নানা সভ্য দেশে তাই এখনো রিচার্ড ডকিন্সের মত পৃথিবী-খ্যাত বিজ্ঞানীকে ইশকুল পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের কাছে গিয়ে প্রাণপাত করে বুঝিয়ে আসতে হয় ইভোলিউশনের কথা। 'রিলিজিয়াস স্টাডিস' এর ছেলে-মেয়েদের মাথার ভূত তাড়ানোর কাজ করে চলেছেন তিনি নিরন্তর।
রেবেকাকে বলছিলাম আমি-- 'আমার মনে হয়না, ফেমিনিজমের অ্যাজেন্ডায় সব পুরুষরা মেয়েদের ভয় পেতে শুরু করেছেন, বরং আমি মনে করি ফেমিনিজমের অ্যাজেন্ডা তাদের রাগিয়ে দিয়েছে। যারা ফেমিনিজমের বিরুদ্ধে, তারা আসলে ভয় পেতে শুরু করেছেন ঘটে চলা এক পরিবর্তনকে। তারা ভয় পেতে শুরু করেছেন এই ধারণাকে যে এক লিঙ্গের অন্য লিঙ্গের ওপর খবরদারি তে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। তারা ভয় করছেন, লিঙ্গ-ভেদে সমানাধিকারের জায়গাটিকে । এইরকম পুরুষরা সমাজে এখনো সংখ্যায় বেশী যাদের আত্মপরিচয়টি জোঁকের মত এক আউটডেটেড মাস্কুলিনিটির গায়ে এখনো আঁকড়ে রয়েছে। যা তাদের বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়াটা পুরুষদের পক্ষে অক্সিজেন ইনহেলের মতই স্বাভাবিক। সার্বিক ভাবে এই ধারণায় আঘাতের ফলে তারা চটে উঠছেন। আর সেখান থেকেই এই এফ-ওয়ার্ডের এর মিথ নির্মাণ। যাতে প্যাট্রিয়ার্কি আর সেক্সিজম টিকে থাকতে পারে, তাই নারীবাদকে পুরুষ-খেকো বলে অনুবাদ করা হয়।
এই মিথের সবচে ক্ষতিকর দিক হল, যখন একজন নারী এই মিথগুলি ব্যবহার করতে থাকেন । তখনই টক্সিক মাস্কুলিনিটির সাফল্য সবথেকে বেশী হয়।'
'ফেমিনিস্টস হ্যাভ মেল পার্টনার্স দে লাভ। ডোন্ট ইউ ওয়ন্ট দিস টু চেঞ্জ?'
আমি জানতে চাই রেবেকাকে।
রেবেকার সাথে কথোপকথন শেষে সে নিজেকে ফেমিনিস্ট বলতে চেয়েছিল কিনা তা আমার আর পরে জানা হয়নি।
তবে দীর্ঘদিন ধরেই, নারীবাদ নিয়ে এইরকম সব কথোপকথনে অনিবার্য ভাবে উঠে এসেছে, কাঁটার ফাঁকে নুডলসের সমারোহের মত এই এফ-ওয়ার্ড গুচ্ছ ঃ
যার প্রথমেই থাকবে অতি চেনা ঃ 'আমি উওম্যাননিস্ট, ফেমিনিস্ট না' এই বাক্যবন্ধ
হিজাবী নারীরা বলবেন ঃ ফেমিনিজম ঠিক আমার জন্যে না
ট্রান্সজেন্ডারের মানুষরা অভিযোগ করবেন ঃ ফেমিনিস্টরা আমাদের কথা ভুলে যান
নন-বাইনারি মানুষরা বলে উঠবেন ঃ আমি ঠিক জানিনা ফেমিনিজম নিয়ে ঠিক কি ফিল করি
অ্যাবরজিনাল নারীরা বলবেন ঃ আমার অন্যের সভ্যতা থকে ধার করা ফেমিনিজমের প্রয়োজন নেই।
আর অনেক লিবেরালরাই বলে থাকেন ঃ আই অ্যাম মাচ মোর অফ অ্যান ইগালিটারিয়ান দ্যান এ ফেমিনিস্ট।
কন্সারভেটিভদের খুব পরিশ্রমের ফসল এই ডার্টি-ওয়ার্ডস গুচ্ছ। লজ্জা ও ভয় উৎপাদনের প্রাচীন কলা-কৌশল।
এভাঞ্জেলিস্ট প্যাট রবারটসন একবার টেলিভিশনে মন্তব্য রেখেছিলেন ঃ "Feminist agenda encourages women to leave their husbands, kill their children, practice witchcraft, destroy capitalism and become lesbians”
রুশ লিম্ব নামের এক রেডিও হোস্ট একবার জানিয়েছিলেন ঃ
"Feminism was established to allow unattractive women easier access to the mainstream.”
*******
আজ দোসরা নভেম্বর। সাবওয়ে ধরব বলে হাঁটছি।
রোদ পড়ে আসছে তাড়াতাড়ি। দিন খুব ছোট হতে শুরু করেছে। আর কোটের মাপ দীর্ঘতর হচ্ছে ক্রমশ। ম্যানহাটানের উঁচু থেকে উঁচু তলাগুলোর কাঁচে হলদে আভা মেরুন হয়ে আসছে দ্রুত। 'টিশে'র পাশে, পার্কে বেহালা বাজিয়ে পয়সা অর্জন করছেন বৃদ্ধ বাদক। তার ছরে উপত্যকার ঘ্রাণ। রেবেকার কথা মনে হল আমার। এরকমই কোন পড়ন্ত বিকেলে ক্যাম্পাসের হলুদ পাতা ঠেলে উপত্যকার দিকে হাঁটতে হাঁটতে সে আমায় জানতে চেয়েছিল- আমার মনে আছে কিনা ঠিক কিভাবে প্রথমবার আমি জানলাম আমি ফেমিনিস্ট। কঠিন প্রশ্ন । এক মুহূর্তে মনে আসেনি আমার। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে মাথা ভারশুন্য হয়। তখন তাকে ছেড়ে দিতে হয় আনকন্সাসের অলিন্দে। স্মৃতিরা কার্যকর হয়। মুহূর্তে মুখ ভাসে স্মৃতিতে। দৃশ্যের জলছবি শুরু হয়। তার অডিও এখন নির্ভুল। আমি দেখছি নিজেকে। কতটা বয়েস আমার? আট বা নয়। উত্তর কোলকাতার অ্যান্টেনা দেওয়া বাড়ী, ছাদ। পাশের বাড়িতে পায়রা বসার জালের মাচা। ছাদে রোদ পোয়ানো হচ্ছে। বয়ামে বয়ামে তেঁতুল,কুল,জলপাইয়ের আচার। এমন সময় আমাদের রান্নাঘরের কর্ত্রী টুলুপিসি এসে ঠাম্মা কে বল্লেন ঃ সম্পাদকজী কিছু বলবেন, আপনাকে আলাদা করে খুঁজছেন। গ্রাম থেকে ওনার বউ মেয়ে এসেছেন।
এই সম্পাদকজী ছিলেন আমার দেখা প্রথম মাইক্রো উদ্যোগপতি। আমাদের গ্যারাজে ছিল তার কারখানা। বিহার থেকে এসে পরিশ্রমী, দরিদ্র মানুষটি এক ফালি জায়গা খুঁজছিলেন, যেখানে তিনি থাকবেন ও পা-ফাটার মলম, আলতা, এসবের কারবার করবেন। আমার ঠাকুরদা তাকে গ্যারাজটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই গ্যারাজে খুলে ফেললেন তিনি 'মালতী-আলতা' ও 'মালতী-মলম' এর ব্র্যান্ড। বরফের চাঁইরের মত থান-থান মোম জড় হত বাগানে গ্যারাজের ধারে। ইইয়া বড় বড় অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচিতে চলত তা গলানোর প্রক্রিয়া। তবে মালতীতে তিনি আর কিকি মেশান তা তিনি প্রকাশ্যে আনতেন না। রাতের বেলা গ্যারাজের ভেতর শুরু হত তার মলমের পাক। ভুরভুরে গন্ধে শুধু টের পেতাম-- সম্পাদকজীর মালতী হচ্ছে। এই গন্ধ ছিল বেশ একটু চড়া। আমার মা প্রায়শই নাকে ওডিকোলোনের রুমাল দিয়ে রাখতেন। সম্পাদকজীর গন্ধ নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিলনা। বরং তিনি কাঠের মস্ত হাতাটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মোম আর গ্লিসারিনের চাঙ্গড় তুলে তুলে গন্ধ মাপতেন। সুঘ্রাণে তার চোখে মুখে প্রশান্তি খেলে যেত। তার গোল,কালো, গান্ধী-চশমা ঝাপ্সা হয়ে আসত। অনেক রাতে, মালতী ঠাণ্ডা করতে দিয়ে, তিনি ডাল-রোটি পাকাতে বসতেন। গ্যারাজের ভেতরেই ছিল তার কাঠের মাচা। পুরোপুরি বাঙ্কবেড। ডাল-রোটি খেয়ে তার ওপর তাকিয়া নিয়ে শুয়ে সুখনিদ্রায় যেতেন। ঠাকুরদা পয়সা নিতেন না বলে বাড়ীর নানা দেখভাল ও নিঃসঙ্কোচে করে দিতেন। মিস্ত্রি ধরে আনা, এটা ওটা সারানো। কেরোসিন তুলে রাখা। ড্রেনে চাবি পড়ে গেলে, তা ঠ্যাঙ্গা দিয়ে টেনে তোলা। আরও নানা রকম। আর হ্যাঁ, রোজ বাগান আর উঠোন পরিষ্কার রাখা।
তখন তার বয়েস পঞ্চাশ মত। তিনি ছিলেন অকৃতদার মানুষ। অন্তত আমার ঠাকুরদাকে তাই বলেছিলেন। এমন এক মানুষের এতো বছর বাদে হঠাৎ বউ-বাচ্চা এলো কোথা থেকে, এই ভেবে ঠাম্মার হাত লেগে কাঁচের বয়াম ভেঙ্গে যায় আর কি।
যাই হোক। তিনি টুলুপিসির সাথে গ্যারাজে চল্লেন।
হ্রস্বাকারে সেই ঘটনা ছিল ( যা একটু বড় হতে মায়ের কাছে ভালো করে শুনেছি ) এই উল্কা-আগত বউ বা মেয়ে কেউই সম্পাদকজীর আইনানুগ বউ-মেয়ে না। এই মেয়ের বাবা অন্য কেউ। আর এই পায়ে ভারী রুপার মল, কানে রুপার টানা-পাশা পরা, কপালে কাচপোকার টিপ দেওয়া, এক হাত কাঁচের চুড়ির এই মানুষটি হলেন এই লম্বা চুড়িদার পরা মেয়ে- মধু'র মাসী।
যাকে দেখিয়ে, হাতে খৈনী ডলতে ডলতে আধো বদনে মাথা নুইয়ে- 'এই আমার মালতী' - ঠাম্মা কে বলেছিলেন সম্পাদকজী।
মালতীর বিয়ে হয়েছিল ন'বছর বয়েসে বিহারের এক বর্ডার-গ্রামে। মালতীর বোনকে গ্রামের অবস্থাপন্ন ছেলেরা ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যায়। মালতী তা নিয়ে থানা পুলিশ করতে জল অনেক দূর গড়ায়। শেষমেশ তাকে শ্বশুর বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। গ্রাম ছেড়ে বাপের বাড়ির গ্রামে আসেন মালতি, সেখানেও থাকার জায়গা হয়না। তবে সেই গ্রামেরই মানুষ সম্পাদকজী। গ্রামের বাইরের দিকে ছিল তার জমিসহ ঘর। মালতী তার এই গ্রামের বাইরের বাড়িতেই থেকে এসেছেন এতকাল মধুকে নিয়ে। 'সম্পাদকজীই বিটিয়ার আসলি বাপ আছে মাইজী। আমার নিজের বাপ যা করেনি মধুর পাতানো বাপ তাই করেছে।'
সেই ধর্ষিতা বোনের মেয়ে এই মধু। সম্পাদকজী একে দত্তক নিয়েছেন। মালতীর বোন একে জন্ম দিয়েই কয়েকমাস বাদ নিরুদ্দেশ হয়ে যান। বাবা-মার পরিচয় নেই তাই ইসকুলে টিকতে পারেনি মধু। বাড়িতে মাস্টার রেখে পড়েছে। সে অঙ্ক, ভূগোল দারুণ পারে। চোখ বন্ধ করে নাকি এঁকে দিতে পারে ভারতের ম্যাপ। হাত-পা নেড়ে অপ্রত্যাশিত উঁচু গলায় বলে ওঠেন শান্ত, অর্ধ-ন্যুব্জ মানুষটি। তার পড়ার সুবিধার জন্যে তাদের উঠোনেই মালতী খুলে ছিলেন মেয়েদের পড়ার ইশকুল। বৃদ্ধ মাস্টার 'সিনিয়ার কেম্ব্রিজ' পাস গ্রামতুতো-চাচা। সে ইশকুলে মালতী বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়ে উঠিয়ে আনেন। খেত-খামারির মজুরের মেয়েরা। তারা নাম লিখতে,পড়তে শেখে। কেউ কেউ আরও পড়ে। তখন তার আশেপাশে অঙ্গনবাড়ি বা মিড-ডে-মিল ইশকুল চালু হয়নি নিশ্চয়ই। মধু সেখানেই লেখাপড়া করেছে এতদিন। সম্পাদকজীর মালতী বিক্রির টাকায় সে ইশকুল চলে। সামান্য লাউ-কুমড়ো লাগিয়ে বছরে তিনবার চাষ করে সেই মেয়েদের একবার ডাল-রোটি ও জুটে যেত সে ইশকুলে। " তবে বেশীর ভাগই পড়া ছেড়ে দেয়, বিয়ে হয়, বাচ্চা ভি করে নেয়, তো আর পারেনা। দো ঠো এবার পাস করেছে টেন ক্লাস' এবার। আধা-হাসিমুখ নিয়ে ভাঙ্গা মৈথিলিতে বলে ওঠেন মালতী।
মেয়ে মধু টেন ক্লাসের পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে প্রাইভেটে।
'মেয়ের বিয়ে দেবেনা ?', ঠাম্মা জিজ্ঞেস করেন।
'হাত মেহেন্দি করার সময় এসেছে, তো সম্পাদকজী শাদী করওয়াতে চায়, কোন লেড়কা তো পাচ্ছিনা মাইজী, কেউ আমার বিটীয়ার হাত নিবেনা, আমি বিটীয়া কো শিখওছি আপনা পেট আপনি চালাবে। বিটিয়া টিচার ট্রেনিং করবে। ইশকুলে পড়ালে ওর পরিচয় হবে, মাষ্টারনি কেহ্লাইবে। সো তখন চাহে তো শাদী করবে আচ্ছা লেড়কা সে। টিচার ট্রেনিং কে লিইয়ে বিটিয়া কো কুছু দিন ঠেহেরনা হ্যাঁই ইহা মাইজী।'
ডাল-রোটি পাকিয়ে, মাঝে মাঝে স্টিলের বাটিতে আমার মা'র জন্যে রেখে আসতেন বিশাল বিশাল লাল লঙ্কার আচার। আমার মা বলেছিলেন- 'আমি ভাবলাম-- সেসব তবে এরই হাতে তৈরি।'
মধু'র থাকা নিয়ে পাড়া প্রতিবেশীর নানা উৎসাহ অচিরেই দেখা গিয়েছিল। তা দু'চার দিনেই অতি উৎসাহ হয়ে দাঁড়াল।
সম্পাদকজীর মালতী বিপ্লব, আমার ঠাম্মা, মাকে প্রতিবেশীদের মুখে বর্ম এঁটে দিতে শিখিয়েছিল। 'বিহারী, উড়ে শালপাতা, নোংরা করল কোলকাতা ' 'র কুৎসিত ছড়া-বাঁধা গঞ্জের নাম কোলকাতা। তা বিহার বর্ডার থেকে বহুদূর। এই এক ঘটনায় পুরো বিহার-কোলকাতা আমাদের গ্যারেজ-বাড়ি এক পরিবার হয়ে গেলো।সরল মুখের মধুর নিরাপত্তা ভেবে এমনকি মাতাল ড্রাইভার কিশোরী কেও ঠাম্মা বিদায় করেছিলনে। সম্পাদকজীর সাথে এই আত্মীয়তা আগে কখনো কল্পনা করিনি।
মালতীর মেয়ে মধু পাশ করেছিলেন। তার কিছুদিন পরই সম্পাদকজী দেশে ফিরে যান। তারপর এক দু'বার পোস্ট কার্ড এসেছিল। সে বাড়িও ভাঙ্গা পড়েছে। তাদের আর কোন খোঁজ কখনো পাইনি।
সম্পাদকজির মালতী-বিপ্লব আমায় ফেমিনিস্ট বানিয়েছিল, রেবেকা। বলে উঠি আমি। আমার মাকেও। ঠাম্মাকেও। ওনাকে পরে মেয়েদের জন্যে অনেক কিছু করতে দেখেছি। বহুপরে, ফেমিনিস্ট ভোকাবুলারি জেনে আমি বুঝতে শিখি আসলে তা ছিল- ডমিন্যান্ট হেজিমনিকে ভেঙ্গে প্রথম রেটিনাল চোখের সামনে ঘটতে দেখা 'ইন্টারসেকশনালিটী'।
অক্টোবর মাস জুড়ে সারা আইসল্যান্ডে হাল-চাল মেচেছে।
আইসল্যান্ডের নারীরা দেশের ১৪ শতাংশ পে-গ্যাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ১৪ শতাংশ কম কাজ করবেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শপিংমলের, দোকানের, অফিসের কাউন্টারে ও ডেস্কে দুটো' আটত্রিশের পর থাকবেন না। দুটো' আটত্রিশের পর কোন নারীই আর কোথাওই কাজ করবেন না।
পারিশ্রমিকের অসম বণ্টনের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন পোল্যান্ডের নারীরা।এই বৈষম্য যা কোন খণ্ড চিত্র না। বিচ্ছিন্ন ঘটনাও না সারা পৃথিবী ভেদে। কিন্তু বদলাচ্ছে প্রতিবাদের ধরন। ফেমিনিস্ট তকমায় অবস্কিওর রাংতায় মিডিয়া মুড়ছে প্রতিবেদন।
গবেষণা ও আকাদেমিক মতে ফেমিনিজমের তৃতীয় ধাপ পেরোচ্ছে শতবর্ষত্তোর ফেমিনিস্ট আন্দোলন। হালচাল মেচে চলেছে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। যদি আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপে জ্ঞাতব্য হয়ে উঠেছিল- ফেমিনিজম খায় না মাখে, শাদা ইংরেজিতে 'হোয়াট ইজ ফেমিনিজম', তবে তার তৃতীয় ধাপে অবশ্যই এ আন্দোলন মাথা ঘামাতে বাধ্য হচ্ছে এনিয়ে যে- 'খায় যদি তবে কি করে খায়' অর্থাৎ ' হাউ উই কনজিউম ইট'। আর এ প্রশ্নের মোকাবিলায় ট্রাফিক চিহ্নের মত দিক নির্দেশ করছে একটি লেবেল, যাতে প্রায় ঝালরের মত ঝুলে আছে সেলাই করা 'গিল্ট' সমূহ। লজ্জা-প্রবণতা। অর্থাৎ যেভাবে আপনি " আমি লিবেরাল" এই ঘোষণা আপনার ফেবুতে দিতে পারেন, ঠিক একিভাবে "আমি ফেমিনিস্ট" এই ইনফো জাহির করতে পারেননা। এর পরিসংখ্যান আরও বাড়ে নারীদের বেলায়; অর্থাৎ একজন লিবেরাল পুরুষ নিজেকে যত স্বচ্ছন্দে নারীবাদী ঘোষণা দিচ্ছেন, একজন নারী তার তুলনায় অনেক কম দিচ্ছেন। আশ্চর্যজনক ভাবে কম দিচ্ছেন। অনেক লিবেরাল নারীদের ক্ষেত্রে প্রায়শই অবস্থা দাঁড়ায়- খেতে চাইছেন কিন্তু গিলতে পারছেন না টাইপ । যা আম-মানসিকতায়, সোশাল মিডিয়ায় ক্রমে গুলিয়ে যাওয়া থেকে গুলিয়ে যাওয়া-তর সন্দর্ভের মিথ হয়ে উঠছে ঃ এফ ফর ফেমিনিজম না এফ ওয়ার্ড !
সোশ্যাল মিডিয়া একটু ঘাঁটলেই এই 'এফ ফর ফেমনিজম' আর এফ ওয়ার্ডের মিথ গুলির সংকলন তৈরী হয়ে যাবে। তাদের হাওয়া-বাতাসের মত দাঁড় করানো যায় অনায়াসে। যেমন ঃ
নারীবাদীরা পুরুষ বিদ্বেষী
কেবল মাত্র নারীরাই ফেমিনিস্ট
ফেমিনিস্টরা কেবল নারীদের সুবিধার কথা ভাবেন
ফেমিনিস্টরা রাগী ও ইরর্যাশান্যাল
ফেমিনিস্টরা বেরসিক
ফেমিনিস্টরা বসি
যার শেষোক্ত টি হোল ঃ ফেমিনিস্টরা বগল ও পা কামান না
'ফেমিনিজম কি' তা এই গদ্যের আলোচনার বিষয় যদিও না।
তাও যদি বলি ফেমিনিজমের ধারণা বাক-স্বাধীনতার চর্চাকে প্রাথমিক স্তরে বলবত করার প্রথম ধাপ আর সে বাক স্বাধীনতা যদি হাসতে হাসতেও প্রয়োগ করি, যেমন করেছিলাম একবার ( আমার এক এভানজেলিস্ট সহকর্মীর সাথে কথোপকথনে), আর তা হয়েওছিল প্রায় শেষমেশ পায়েস শেষে চিরতা পরিবেশনের মতই।
আমি তখন এক মিডিয়া হাউসে কাজ করি।
এক ভিডিও ক্যাম্পেইনের প্রজেক্টের কাজে, কিছু কাল্পনিক চরিত্র তৈরি করতে হবে। তাদের নামকরণ করতে হবে। আমার সহকর্মী রায়ান আমায় বলে- তুমি আরও বেশী কিছু নাম রাখ মেয়েদের।
আমি বলি- কেন ? আধা আধা রাখলেও তো হয়।
রায়ান বলে- আমরা মেয়েদের এম্পাওয়ার্ড করতে চাইছি, তাই না ? তার নীল চোখ তৃপ্তির আলোয় আরো নীল হয়ে ওঠে।
তার প্রতিফলন পড়ে আমার ব্রাউন চোখেও। আর আমি বলে ফেলি, নেহাতই বাক-স্বাধীনতা, তাই বলেই ফেলি- 'বাট হাউ ডু ইউ নো যে এই কনি, জেন যেসব নাম নিচ্ছ তারা ফিকশনাল হলেও, তারা ফিকশনালিও তোমার থেকে এম্পাওয়ার্ড নয়, আর তুমি-আমিই বা এম্পাওয়ার্ড করার কে ?'
রায়ানের নীল চোখ ঘোলাটে হয়। গুলিয়ে যাওয়া মাথায়, খিঁচড়ানো মুখে আমায় দেখে নেয় সে। এমনিতেই কোনোকালে আমাকে পছন্দ না তার। এরপর মেইন-স্ট্রিম হলিউড আখ্যানের মত, আগামী যে কয়মাস সে কোম্পানিতে আমি আর টিকে থাকব, সেখানে রায়ান হয়ে উঠবে আমার এনিমি-তম দের একজন, তা আর বলতে কি। অবশ্য, তার তরফ থেকে। অবশ্যই। মা কসম। একজন অফিসিয়াল ফেমিনিস্ট হিসেবে আমি তাকে ভুলেও আমার শত্রু ভাবিনি।
তো, এই হল আমজনতার সারাৎসার, বোদা-মাথার, ফেমিনিস্ট-চিন্তা। ঢুলু চোখে-- 'মেয়েরাও কাজ পারে', 'তারা এগিয়ে আসুন' এবং সর্বোপরি 'আমরা সেভিয়ার' বলার একটা অপমানজনক, আফিংগ্রস্ত ফেক প্রয়াস।
এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে আমার প্রথমেই মনে আসে আমার ছাত্রী রেবেকার কথা। তিনি আমাকে একটি প্রশ্ন করেছিলেন। সেই প্রশ্ন আমাকে সন্দর্ভের তলায় গিয়ে, আকাদেমিক উচ্চারণের অতীতে গিয়ে নারী আন্দোলনের স্বরূপটিকে চিনতে সাহায্য করেছিল।
আমার আন্ডার গ্রাডের সফোমোর-ছাত্রী ছিলেন রেবেকা। ক্লাসে এমনিতে সে চুপচাপই থাকে। প্রশ্ন করতে হাত তোলেনা। জিজ্ঞেস করলে নীচুস্বরে উত্তর দেয়।
একবার তার জমা দেওয়া প্রবন্ধ পড়ে দেখি বারবার লিখছে ঃ I'm not a Feminist though...। প্রায় রেফ্রেইনের পর্যায়ে গিয়ে ব্যবহার করেছে সে এই ফ্রেজ টিকে। অর্থাৎ সেই একই- নিজেকে ফেমিনিস্ট বলতে ভীত। অথচ ইন্টারেস্টিংলি, ফেমিনিজমের ধারণা গুলিকে সে কিন্তু অস্বীকার করছেনা একবারও। আমি রাইটিং অ্যাসাইন্মেন্ট চলাকালীন এমনিতেই ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে কফি ডিসকাশনে যেতে ভালবাসি। রেবেকাকে ডাকলাম একদিন। কফি নিয়ে বসা হোল উপত্যকার ঢালে।
বল রেবেকা, শুরু করি আমি ( এক প্রকার ভনিতাহীন ভাবেই )- কেন তুমি নিজেকে ফেমিনিস্ট বলনা?
উত্তর প্রায় তৈরিই ছিল তার। রেবেকা বলেঃ
-একজন মানুষ হিসেবে আমার পক্ষে এটি গুরুত্বপূর্ণ যে ইম্পেরিয়ালিষ্ট যুদ্ধ, কলোনিয়াল হিংসা, বর্ণবাদ, নারীদের সাথে বা যে কোন জেন্ডারের সাথে বঞ্চনার বিপ্রতীপে কথা বলা। যেকোনো অপ্রেসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। কিন্তু তার জন্যে নিজেকে ফেমিনিস্ট বলতে হবে কেন ?
- বেশ। কিন্তু বল,ফেমিনিজম কি এগুলিকে অ্যাড্রেস করে বলে তুমি মনে কর?
জানতে চাই আমি।
রেবেকা বেশ জোরের সাথেই বলে ওঠে- নিশ্চয়ই করে। কিন্তু নিজেকে ফেমিনিস্ট ঘোষণা করতে হবে কেন ?
-করলে তোমার কি কোন ক্ষতি হতে পারে বলে মনে করছ ?
আবারো জানতে চাই আমি।
-হ্যাঁ, আমার বন্ধুরা ভাবতেই পারে আমি অ্যাগ্রেসিভ। তারা আমায় এড়িয়ে যেতে পারে। আমার এক্স বয়ফ্রেন্ড নারীবাদী দের কথা শুনলেই রেগে উঠত। নখের রং খুঁটে-খুঁটে বলে সে ?
আর তুমি ? তোমার মা ? তোমার বেস্ট ফ্রেইন্ড আছেন, রেবেকা ?
জানতে চাই আমি।
আমার মায়ের সাথে আমার অনেকটাই মেলে। আমার মায়েরও অনেক অভিযোগ পুরুষ-তন্ত্রের বিরুদ্ধে, সমাজের বিরুদ্ধে। কিন্তু তিনি কখনো নারীবাদী হওয়ার কথা ভাবতেই পারেননা। তবে আমার মা নিয়মিত চার্চে যান। আমি যাইনা । তার মতে অভিযোগ তুললে সংসারের শান্তি নষ্ট হয়। ঈশ্বর তা চান না। তিনি ফ্যামিলিকে ভালবাসতে বলেন। আমার তেমন কোন বিশেষ বন্ধু নেই। যারা আছেন, তারা এইসব বাদ-টাদ নিয়ে প্রশ্ন করতে ইচ্ছুক নন। মা বলেন, ফেমিনিস্টদের পুরুষরা এড়িয়ে চলেন। অনেক পুরুষরা মেয়েদের ভয় পেতে শুরু করেছেন।
মনে পড়ে যায় মুহূর্তেই। সুপ্রীম কোর্টের লেজেন্ডারি প্রাক্তন জাস্টিস Ruth Bader Ginsburg একবার বলেছিলেন,পঞ্চাশের দশকে, কলম্বিয়া ইউনিভারসিটিতে 'ল ডিপার্টমেন্টের' বিল্ডিঙ্গে মেয়েদের জন্যে বরাদ্দ কোনো বাথরুম ছিলনা। প্রয়োজনে ছুটতে হত পাশের আর্টস বিল্ডিঙ্গে'।
নেহাতই এই তথ্য দিতে এ প্রসঙ্গ টানিনি। যা বলতে টানছি, তা আছে এই পরবর্তী বাক্যে। বাথরুম ছিলনা, এই তথ্য দিয়ে তিনি জানাচ্ছেন ঃ উই নেভার কমপ্লেইন্ড; ইট নেভার অকারড টু আস টু কমপ্লেইন।
আমি উপত্যকার দিকে তাকাই, ছোটো ছোটো মেঘের ছায়া পড়েছে পাহাড়ের ঢাল ঘেঁষে।
আমি ভাবি, আমরা যারা হোয়াইট-সুপ্রিমেসির বিরোধিতা করতে নারীবাদ কে বুঝতে চাই, একজন 'উওম্যান অফ কালার' হিসেবে, তখন প্রায়ই ভুলে যাই, তার ওপরেও খেলা করছে আরও গভীর প্যাট্রিয়ার্কি । যার জনপ্রিয়তা আকাশ ব্যাপী। খোদ স্বর্গের সাথেই যার সরাসরি কানেকশন। সে মহান বস্তুটি হোলো এই খুলে-আম সহজলভ্য ধর্ম-ধারণা।
'চার্চ কোনদিনই একে প্রশ্রয় দেবেনা। কারণ ধর্ম জিনিশটা চিরকালই মেল-সেন্ট্রিক'। বলি আমি রেবেকাকে। আমাদের পৃথিবীও তাই। মেল-সেন্ট্রিক। এরা বৈষম্য তৈরি করেন। পুরুষের প্রভুত্ব বজায় রাখার জন্যেই এদের সব নিয়ম কানুন।
পশ্চিমের নানা সভ্য দেশে তাই এখনো রিচার্ড ডকিন্সের মত পৃথিবী-খ্যাত বিজ্ঞানীকে ইশকুল পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের কাছে গিয়ে প্রাণপাত করে বুঝিয়ে আসতে হয় ইভোলিউশনের কথা। 'রিলিজিয়াস স্টাডিস' এর ছেলে-মেয়েদের মাথার ভূত তাড়ানোর কাজ করে চলেছেন তিনি নিরন্তর।
রেবেকাকে বলছিলাম আমি-- 'আমার মনে হয়না, ফেমিনিজমের অ্যাজেন্ডায় সব পুরুষরা মেয়েদের ভয় পেতে শুরু করেছেন, বরং আমি মনে করি ফেমিনিজমের অ্যাজেন্ডা তাদের রাগিয়ে দিয়েছে। যারা ফেমিনিজমের বিরুদ্ধে, তারা আসলে ভয় পেতে শুরু করেছেন ঘটে চলা এক পরিবর্তনকে। তারা ভয় পেতে শুরু করেছেন এই ধারণাকে যে এক লিঙ্গের অন্য লিঙ্গের ওপর খবরদারি তে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। তারা ভয় করছেন, লিঙ্গ-ভেদে সমানাধিকারের জায়গাটিকে । এইরকম পুরুষরা সমাজে এখনো সংখ্যায় বেশী যাদের আত্মপরিচয়টি জোঁকের মত এক আউটডেটেড মাস্কুলিনিটির গায়ে এখনো আঁকড়ে রয়েছে। যা তাদের বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়াটা পুরুষদের পক্ষে অক্সিজেন ইনহেলের মতই স্বাভাবিক। সার্বিক ভাবে এই ধারণায় আঘাতের ফলে তারা চটে উঠছেন। আর সেখান থেকেই এই এফ-ওয়ার্ডের এর মিথ নির্মাণ। যাতে প্যাট্রিয়ার্কি আর সেক্সিজম টিকে থাকতে পারে, তাই নারীবাদকে পুরুষ-খেকো বলে অনুবাদ করা হয়।
এই মিথের সবচে ক্ষতিকর দিক হল, যখন একজন নারী এই মিথগুলি ব্যবহার করতে থাকেন । তখনই টক্সিক মাস্কুলিনিটির সাফল্য সবথেকে বেশী হয়।'
'ফেমিনিস্টস হ্যাভ মেল পার্টনার্স দে লাভ। ডোন্ট ইউ ওয়ন্ট দিস টু চেঞ্জ?'
আমি জানতে চাই রেবেকাকে।
রেবেকার সাথে কথোপকথন শেষে সে নিজেকে ফেমিনিস্ট বলতে চেয়েছিল কিনা তা আমার আর পরে জানা হয়নি।
তবে দীর্ঘদিন ধরেই, নারীবাদ নিয়ে এইরকম সব কথোপকথনে অনিবার্য ভাবে উঠে এসেছে, কাঁটার ফাঁকে নুডলসের সমারোহের মত এই এফ-ওয়ার্ড গুচ্ছ ঃ
যার প্রথমেই থাকবে অতি চেনা ঃ 'আমি উওম্যাননিস্ট, ফেমিনিস্ট না' এই বাক্যবন্ধ
হিজাবী নারীরা বলবেন ঃ ফেমিনিজম ঠিক আমার জন্যে না
ট্রান্সজেন্ডারের মানুষরা অভিযোগ করবেন ঃ ফেমিনিস্টরা আমাদের কথা ভুলে যান
নন-বাইনারি মানুষরা বলে উঠবেন ঃ আমি ঠিক জানিনা ফেমিনিজম নিয়ে ঠিক কি ফিল করি
অ্যাবরজিনাল নারীরা বলবেন ঃ আমার অন্যের সভ্যতা থকে ধার করা ফেমিনিজমের প্রয়োজন নেই।
আর অনেক লিবেরালরাই বলে থাকেন ঃ আই অ্যাম মাচ মোর অফ অ্যান ইগালিটারিয়ান দ্যান এ ফেমিনিস্ট।
কন্সারভেটিভদের খুব পরিশ্রমের ফসল এই ডার্টি-ওয়ার্ডস গুচ্ছ। লজ্জা ও ভয় উৎপাদনের প্রাচীন কলা-কৌশল।
এভাঞ্জেলিস্ট প্যাট রবারটসন একবার টেলিভিশনে মন্তব্য রেখেছিলেন ঃ "Feminist agenda encourages women to leave their husbands, kill their children, practice witchcraft, destroy capitalism and become lesbians”
রুশ লিম্ব নামের এক রেডিও হোস্ট একবার জানিয়েছিলেন ঃ
"Feminism was established to allow unattractive women easier access to the mainstream.”
*******
আজ দোসরা নভেম্বর। সাবওয়ে ধরব বলে হাঁটছি।
রোদ পড়ে আসছে তাড়াতাড়ি। দিন খুব ছোট হতে শুরু করেছে। আর কোটের মাপ দীর্ঘতর হচ্ছে ক্রমশ। ম্যানহাটানের উঁচু থেকে উঁচু তলাগুলোর কাঁচে হলদে আভা মেরুন হয়ে আসছে দ্রুত। 'টিশে'র পাশে, পার্কে বেহালা বাজিয়ে পয়সা অর্জন করছেন বৃদ্ধ বাদক। তার ছরে উপত্যকার ঘ্রাণ। রেবেকার কথা মনে হল আমার। এরকমই কোন পড়ন্ত বিকেলে ক্যাম্পাসের হলুদ পাতা ঠেলে উপত্যকার দিকে হাঁটতে হাঁটতে সে আমায় জানতে চেয়েছিল- আমার মনে আছে কিনা ঠিক কিভাবে প্রথমবার আমি জানলাম আমি ফেমিনিস্ট। কঠিন প্রশ্ন । এক মুহূর্তে মনে আসেনি আমার। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে মাথা ভারশুন্য হয়। তখন তাকে ছেড়ে দিতে হয় আনকন্সাসের অলিন্দে। স্মৃতিরা কার্যকর হয়। মুহূর্তে মুখ ভাসে স্মৃতিতে। দৃশ্যের জলছবি শুরু হয়। তার অডিও এখন নির্ভুল। আমি দেখছি নিজেকে। কতটা বয়েস আমার? আট বা নয়। উত্তর কোলকাতার অ্যান্টেনা দেওয়া বাড়ী, ছাদ। পাশের বাড়িতে পায়রা বসার জালের মাচা। ছাদে রোদ পোয়ানো হচ্ছে। বয়ামে বয়ামে তেঁতুল,কুল,জলপাইয়ের আচার। এমন সময় আমাদের রান্নাঘরের কর্ত্রী টুলুপিসি এসে ঠাম্মা কে বল্লেন ঃ সম্পাদকজী কিছু বলবেন, আপনাকে আলাদা করে খুঁজছেন। গ্রাম থেকে ওনার বউ মেয়ে এসেছেন।
এই সম্পাদকজী ছিলেন আমার দেখা প্রথম মাইক্রো উদ্যোগপতি। আমাদের গ্যারাজে ছিল তার কারখানা। বিহার থেকে এসে পরিশ্রমী, দরিদ্র মানুষটি এক ফালি জায়গা খুঁজছিলেন, যেখানে তিনি থাকবেন ও পা-ফাটার মলম, আলতা, এসবের কারবার করবেন। আমার ঠাকুরদা তাকে গ্যারাজটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই গ্যারাজে খুলে ফেললেন তিনি 'মালতী-আলতা' ও 'মালতী-মলম' এর ব্র্যান্ড। বরফের চাঁইরের মত থান-থান মোম জড় হত বাগানে গ্যারাজের ধারে। ইইয়া বড় বড় অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচিতে চলত তা গলানোর প্রক্রিয়া। তবে মালতীতে তিনি আর কিকি মেশান তা তিনি প্রকাশ্যে আনতেন না। রাতের বেলা গ্যারাজের ভেতর শুরু হত তার মলমের পাক। ভুরভুরে গন্ধে শুধু টের পেতাম-- সম্পাদকজীর মালতী হচ্ছে। এই গন্ধ ছিল বেশ একটু চড়া। আমার মা প্রায়শই নাকে ওডিকোলোনের রুমাল দিয়ে রাখতেন। সম্পাদকজীর গন্ধ নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিলনা। বরং তিনি কাঠের মস্ত হাতাটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মোম আর গ্লিসারিনের চাঙ্গড় তুলে তুলে গন্ধ মাপতেন। সুঘ্রাণে তার চোখে মুখে প্রশান্তি খেলে যেত। তার গোল,কালো, গান্ধী-চশমা ঝাপ্সা হয়ে আসত। অনেক রাতে, মালতী ঠাণ্ডা করতে দিয়ে, তিনি ডাল-রোটি পাকাতে বসতেন। গ্যারাজের ভেতরেই ছিল তার কাঠের মাচা। পুরোপুরি বাঙ্কবেড। ডাল-রোটি খেয়ে তার ওপর তাকিয়া নিয়ে শুয়ে সুখনিদ্রায় যেতেন। ঠাকুরদা পয়সা নিতেন না বলে বাড়ীর নানা দেখভাল ও নিঃসঙ্কোচে করে দিতেন। মিস্ত্রি ধরে আনা, এটা ওটা সারানো। কেরোসিন তুলে রাখা। ড্রেনে চাবি পড়ে গেলে, তা ঠ্যাঙ্গা দিয়ে টেনে তোলা। আরও নানা রকম। আর হ্যাঁ, রোজ বাগান আর উঠোন পরিষ্কার রাখা।
তখন তার বয়েস পঞ্চাশ মত। তিনি ছিলেন অকৃতদার মানুষ। অন্তত আমার ঠাকুরদাকে তাই বলেছিলেন। এমন এক মানুষের এতো বছর বাদে হঠাৎ বউ-বাচ্চা এলো কোথা থেকে, এই ভেবে ঠাম্মার হাত লেগে কাঁচের বয়াম ভেঙ্গে যায় আর কি।
যাই হোক। তিনি টুলুপিসির সাথে গ্যারাজে চল্লেন।
হ্রস্বাকারে সেই ঘটনা ছিল ( যা একটু বড় হতে মায়ের কাছে ভালো করে শুনেছি ) এই উল্কা-আগত বউ বা মেয়ে কেউই সম্পাদকজীর আইনানুগ বউ-মেয়ে না। এই মেয়ের বাবা অন্য কেউ। আর এই পায়ে ভারী রুপার মল, কানে রুপার টানা-পাশা পরা, কপালে কাচপোকার টিপ দেওয়া, এক হাত কাঁচের চুড়ির এই মানুষটি হলেন এই লম্বা চুড়িদার পরা মেয়ে- মধু'র মাসী।
যাকে দেখিয়ে, হাতে খৈনী ডলতে ডলতে আধো বদনে মাথা নুইয়ে- 'এই আমার মালতী' - ঠাম্মা কে বলেছিলেন সম্পাদকজী।
মালতীর বিয়ে হয়েছিল ন'বছর বয়েসে বিহারের এক বর্ডার-গ্রামে। মালতীর বোনকে গ্রামের অবস্থাপন্ন ছেলেরা ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যায়। মালতী তা নিয়ে থানা পুলিশ করতে জল অনেক দূর গড়ায়। শেষমেশ তাকে শ্বশুর বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। গ্রাম ছেড়ে বাপের বাড়ির গ্রামে আসেন মালতি, সেখানেও থাকার জায়গা হয়না। তবে সেই গ্রামেরই মানুষ সম্পাদকজী। গ্রামের বাইরের দিকে ছিল তার জমিসহ ঘর। মালতী তার এই গ্রামের বাইরের বাড়িতেই থেকে এসেছেন এতকাল মধুকে নিয়ে। 'সম্পাদকজীই বিটিয়ার আসলি বাপ আছে মাইজী। আমার নিজের বাপ যা করেনি মধুর পাতানো বাপ তাই করেছে।'
সেই ধর্ষিতা বোনের মেয়ে এই মধু। সম্পাদকজী একে দত্তক নিয়েছেন। মালতীর বোন একে জন্ম দিয়েই কয়েকমাস বাদ নিরুদ্দেশ হয়ে যান। বাবা-মার পরিচয় নেই তাই ইসকুলে টিকতে পারেনি মধু। বাড়িতে মাস্টার রেখে পড়েছে। সে অঙ্ক, ভূগোল দারুণ পারে। চোখ বন্ধ করে নাকি এঁকে দিতে পারে ভারতের ম্যাপ। হাত-পা নেড়ে অপ্রত্যাশিত উঁচু গলায় বলে ওঠেন শান্ত, অর্ধ-ন্যুব্জ মানুষটি। তার পড়ার সুবিধার জন্যে তাদের উঠোনেই মালতী খুলে ছিলেন মেয়েদের পড়ার ইশকুল। বৃদ্ধ মাস্টার 'সিনিয়ার কেম্ব্রিজ' পাস গ্রামতুতো-চাচা। সে ইশকুলে মালতী বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়ে উঠিয়ে আনেন। খেত-খামারির মজুরের মেয়েরা। তারা নাম লিখতে,পড়তে শেখে। কেউ কেউ আরও পড়ে। তখন তার আশেপাশে অঙ্গনবাড়ি বা মিড-ডে-মিল ইশকুল চালু হয়নি নিশ্চয়ই। মধু সেখানেই লেখাপড়া করেছে এতদিন। সম্পাদকজীর মালতী বিক্রির টাকায় সে ইশকুল চলে। সামান্য লাউ-কুমড়ো লাগিয়ে বছরে তিনবার চাষ করে সেই মেয়েদের একবার ডাল-রোটি ও জুটে যেত সে ইশকুলে। " তবে বেশীর ভাগই পড়া ছেড়ে দেয়, বিয়ে হয়, বাচ্চা ভি করে নেয়, তো আর পারেনা। দো ঠো এবার পাস করেছে টেন ক্লাস' এবার। আধা-হাসিমুখ নিয়ে ভাঙ্গা মৈথিলিতে বলে ওঠেন মালতী।
মেয়ে মধু টেন ক্লাসের পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে প্রাইভেটে।
'মেয়ের বিয়ে দেবেনা ?', ঠাম্মা জিজ্ঞেস করেন।
'হাত মেহেন্দি করার সময় এসেছে, তো সম্পাদকজী শাদী করওয়াতে চায়, কোন লেড়কা তো পাচ্ছিনা মাইজী, কেউ আমার বিটীয়ার হাত নিবেনা, আমি বিটীয়া কো শিখওছি আপনা পেট আপনি চালাবে। বিটিয়া টিচার ট্রেনিং করবে। ইশকুলে পড়ালে ওর পরিচয় হবে, মাষ্টারনি কেহ্লাইবে। সো তখন চাহে তো শাদী করবে আচ্ছা লেড়কা সে। টিচার ট্রেনিং কে লিইয়ে বিটিয়া কো কুছু দিন ঠেহেরনা হ্যাঁই ইহা মাইজী।'
ডাল-রোটি পাকিয়ে, মাঝে মাঝে স্টিলের বাটিতে আমার মা'র জন্যে রেখে আসতেন বিশাল বিশাল লাল লঙ্কার আচার। আমার মা বলেছিলেন- 'আমি ভাবলাম-- সেসব তবে এরই হাতে তৈরি।'
মধু'র থাকা নিয়ে পাড়া প্রতিবেশীর নানা উৎসাহ অচিরেই দেখা গিয়েছিল। তা দু'চার দিনেই অতি উৎসাহ হয়ে দাঁড়াল।
সম্পাদকজীর মালতী বিপ্লব, আমার ঠাম্মা, মাকে প্রতিবেশীদের মুখে বর্ম এঁটে দিতে শিখিয়েছিল। 'বিহারী, উড়ে শালপাতা, নোংরা করল কোলকাতা ' 'র কুৎসিত ছড়া-বাঁধা গঞ্জের নাম কোলকাতা। তা বিহার বর্ডার থেকে বহুদূর। এই এক ঘটনায় পুরো বিহার-কোলকাতা আমাদের গ্যারেজ-বাড়ি এক পরিবার হয়ে গেলো।সরল মুখের মধুর নিরাপত্তা ভেবে এমনকি মাতাল ড্রাইভার কিশোরী কেও ঠাম্মা বিদায় করেছিলনে। সম্পাদকজীর সাথে এই আত্মীয়তা আগে কখনো কল্পনা করিনি।
মালতীর মেয়ে মধু পাশ করেছিলেন। তার কিছুদিন পরই সম্পাদকজী দেশে ফিরে যান। তারপর এক দু'বার পোস্ট কার্ড এসেছিল। সে বাড়িও ভাঙ্গা পড়েছে। তাদের আর কোন খোঁজ কখনো পাইনি।
সম্পাদকজির মালতী-বিপ্লব আমায় ফেমিনিস্ট বানিয়েছিল, রেবেকা। বলে উঠি আমি। আমার মাকেও। ঠাম্মাকেও। ওনাকে পরে মেয়েদের জন্যে অনেক কিছু করতে দেখেছি। বহুপরে, ফেমিনিস্ট ভোকাবুলারি জেনে আমি বুঝতে শিখি আসলে তা ছিল- ডমিন্যান্ট হেজিমনিকে ভেঙ্গে প্রথম রেটিনাল চোখের সামনে ঘটতে দেখা 'ইন্টারসেকশনালিটী'।
0 মন্তব্যসমূহ