সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম
বনফুলের ‘দাঙ্গার সময়’ গল্পটা পড়েছেন ? সেই যে রহিমের মা যে পাটনা থেকে পালিয়ে এসেছিল হিন্দু পরিবারের কাছে আশ্রয় নিতে অথচ তখন ঐ হিন্দু পুরো মহল্লাটি কাঁপছে মুসলমানদের আক্রমণের ভয়ে। রহিমের মা যে হিন্দু মানুষটির কাছে প্রাণে বাঁচতে এসেছিলেন তাকে তিনি ছোটবেলায় স্তন পান করিয়েছিলেন সেই অর্থে দুধ মা।
কিছু মানুষের কথা গড়পরতা জীবনে আসলে বলা হয়ে উঠেনা কখনোই। এসব যেন জন্মগত প্রাপ্তি। যদিও ব্যক্তিগত তবুও বলি। শিলাইদহ থেকে ফেরার পথে গড়াই নদী পার হচ্ছি ১৯৯১ এর ২৮ বা ২৯ এপ্রিল, সেই ঐতিহাসিক ঘূর্ণিঝড়ের রাত। এমন তুমুল ঝড় মানুষ, গাছপালা সব কিছু উড়ে যায় বাতাসে। সাঁতার জানিনা, সাথে বাবা-মা কেউ নেই। আমার তখন ৯, ভয়ে এক নারীর শাড়ির আঁচল ধরে রেখেছি। তিনিও তাল সামলাতে পারছেন না। কখন যেন হাতছাড়া হয়ে গেলাম। ভয়ে নাক মুখ চোখ ফুলিয়ে কাঁদছি, ভেবেছিলাম আর কোনদিন বাড়ি ফেরা হবেনা। পেছন থেকে খুব দীর্ঘ লম্বা কে যেন এসে একটানে কাধে তুলে নিলো। বাতাসে বালির প্রকোপে চারপাশের সব অন্ধকার। কোনভাবে আমাকে নিয়ে দৌড়ে বাঁশের সাঁকো দিয়ে গড়াই নদী পার হয়ে এলো। এ পাশে আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকা পিকনিকের বাসে উঠলো, তখনো আমি তাঁর দুই হাতের ভেতর ভয়ে কাঁপছি। তখন কিছুটা রয়েসয়ে এসেছে সব। ওমা এতো আমার অরুন কাকু। তাইতো বলি কে দেখবে আমি নদীর ভেতর ভয়ে পরেই যাচ্ছিলাম ? অরুন বোস প্রথম আলোর সাংবাদিক, ভাষা প্রতিযোগ করেন। তখন শুধু আমার অরুন কাকুই ছিলেন।
আমার মায়ের অসুস্থতার সময়ে টানা ছয় বছর যে বাড়িতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত থাকতাম সেই বাড়িতে ছিলো কলতলায় বিশাল এক নিম গাছ। ঘরের সামনে লাল বাঁধানো সিঁড়ি সাথে বাধানো তুলসীর গাছ। ভদ্রমহিলাকে আমার বাবা মা ডাকতেন মাসিমা। অতএব আমার হলেন ‘মাসিমা দাদু’। যেমন হয়েছিলো বকুল দি পিসি ( কানু কাকার মা) , গোপাল দা মামা ( সত্য নারায়ণ বস্ত্রালয়ের)। এই মধ্য বয়সে এসেও তাকে মাসিমা দাদুই ডাকি। অঞ্জলী বালা নামের এই ভদ্র মহিলার পরিচয়ের শেষ নেই। তিনি সেরা নারী পুরস্কার পেয়েছেন, ট্রাস্টি মিনিস্টার গৌড় চন্দ্র বালার স্ত্রী অঞ্জলী বালা নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বিপ্লব বালা বা প্রথম আলোর সাংবাদিক পান্না বালার মা যতটুকু ঠিক অতোটাই আমার মাসিমা দাদু....... এখনো। তখন ক্লাশ থ্রি, ১৯৮৯। মথুরাপুর দেউরের সামনে পিকনিক হচ্ছে। আমি রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ওয়াহিদুল হকের হাতের ভেতর দিয়ে মাথা গলিয়ে হারমোনিয়ামে ভুল রিড চাপছি, হটাত দেখি মাসিমা দাদুর গা ঘেঁষে বসে আছে নিষাদ। পরের দৃশ্য হচ্ছে কে ওয়াহিদুল হক? থাকুক তাঁর কাছে হারমোনিয়াম আমার অঞ্জলী বালা ভাগ হয়ে যাচ্ছে....অসম্ভব। ওয়াহিদুল হক কে সেটা আসলে তখনো বোঝার বয়স হয়নি আমার। এই গল্প মাসিমা দাদু যখন করেন তখন তিনি বলেন আমি হিংসুটে। ঠিক তাই ওয়াহিদুল হক শ্রদ্ধেয়, নমস্য। তিনি তাঁর স্থানে আমার মাসিমা দাদুই সই। আর বিভা পিসি যিনি সাদা থান পরে আহ্নিকে বসতেন এই যে আমি পান খাই কে শেখালো। সব বিভা পিসির দোষ। এবার আর দুজন মানুষের কথা বলি অনুমতি পেলে, আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক পুঁটি পিসি। পুঁটি পিসি আমাকে কাগজে কলমে প্রথম লিখতে শিখিয়েছেন। সাঁতার শেখাতে পুকুড়ের জলে বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে আমাকে হাত দিয়ে যখন ধরে রাখতেন তখন তিনি মুহূর্তে আমার মা হয়ে যেতেন। উপল যেদিন পানিতে ডুবতে বসেছিল সেদিন কে টেনে তুলেছিল? আমার পুঁটি পিসি। আমাদের বাড়ির আজীবন ফার্স্ট ডোর নেইবার গোপী কাকু (বাংলার বাণীর সাংবাদিক মন্টু দাস গোপী)। গোপী কাকু কঠোর টাইপ মানুষ ছিলেন কিছুটা। তাদের রান্নার ঘরে আমার প্রবেশ নিষেধ ছিলো ( খুব স্বাভাবিক) কিন্তু সত্যি বলতে কি মনে পড়েনা ওই বাড়িতে কোনদিন এমন কোন ভালো খাবার রান্না হয়েছে যা উপল বা মঞ্জরীর জন্য আসেনি তা হয়নি।
বহু কথা বলেছি একজনের নাম দিয়ে শেষ করছি। মধুসুদন চক্রবর্তী। ক্লাশ এইট থেকে এসএসসি পর্যন্ত আমার অংকের শিক্ষক ছিলেন। আমি তাকে নিয়ে কিছু লিখতে পারিনা , হাত কাঁপে। শুধু এটুকু বলি মধুসুদন স্যার আমার জীবনে পাওয়া অন্যতম বিশেষ উপহার। এক যুগেরও বেশি স্যারের সাথে দেখা হয়না কিন্তু বাজি রেখে বলতে পারি, পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বসেও যদি সেই একবার ডাকেন মাইঠরেন ( মা ঠাকুরনের সংক্ষিপ্ত রুপ) আমি অন্য প্রান্তে বসেও নিশ্চিত জানবো.... স্যার ডাকছেন। এই লাইনটা লেখার সময় আমার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছে। আমি খুব অযোগ্য সন্তান আপনাদের। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে কয়েক বছর গবেষণা থেকে সামান্য যেটুকু বুঝি এই সাম্প্রদায়িকতা যতোটা না সাধারণ মানুষের তৈরি তার চেয়ে বেশি তৈরি আমাদের অর্থনীতির, রাজনীতির। এটা হাতিয়ার। কাশ্মীরের হযরত বাল মসজিদে মহানবীর চুল চুরি যাবার মিথ্যে খবর রটিয়ে যে সাম্প্রদায়িকতা তৈরি হয়েছিল ১৯৬৪তে সেটা ছিল মুনায়েম খাঁর রাজনীতি। পঞ্চাশের যে দাঙ্গা হয়েছে সেও ভাষা আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার ইচ্ছে। বাবরী মসজিদ বা নির্বাচনের পর ? একই কথা সেই রাজনীতিই । বিশ্বাস করিনা এ দেশের সাধারণ মানুষ কোন ইন্ধন ছাড়া এমন সাম্প্রদায়িক আচরণ করতে পারে বা সম্ভব সেটা।
পাঁচ বছর বয়সের একটা জামার কথা মনে আছে, সেবার মা পুরো বিছানায় শয্যাশায়ী কারণ তার মা মারা গেছেন। বেশ মন খারাপ, ঈদ চলে এলো আমার জামা কেনা হয়নি। ঈদের কয়েকদিন আগে ঠিকঠাক নতুন জামা পেলাম। আর কে দেবে? মাসিমা দাদু..............আচ্ছা তাতে কি তাঁর ধর্ম বিশ্বাসে কোন ক্ষতি হয়েছিল নাকি আমি যে ওই বয়সে প্রতিদিন বসে তাঁর সাথে পূজা করতাম, প্রসাদ নিতাম তাতে আমার ধর্ম চলে গেছে ? মাসিমা দাদু, পুঁটি পিসি, মধু স্যার আপনাদের কাছে আমার আসলে ক্ষমা চাইবার ইচ্ছে নেই। কেন ক্ষমা চাইব আমি মুসলমান বলে ? সম্প্রীতির কোন ধর্ম নেই কারণ আমার আজীবন ধরে পাওয়া এই মানুষদের ভালোবাসার কোন ধর্ম ছিলনা শুধু ভালবাসা ছাড়া । যারা নাসিরাবাদসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমার অযোগ্য অন্যায় করেছেন তারা যতোটা না ধর্মের জন্য করেছেন তার চেয়ে বেশি তারা প্রলুব্ধ হয়েছেন অন্য কারণে । মুসলমান হিসেবে ক্ষমা চাওয়া মানে তাদের একই কাতারে আনা । এটা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয় । আমাদের কারোই উচিৎ নয় ক্ষমা করা। রহিমের মা’র ঘটনাটা মনে রাখুন মন্দিরে হামলাকারি ভাই সকল। দু একজন বলেন, আমাদের দেশে সংখ্যালঘুরা যথেষ্ট আয়েশে থাকে পাশের দেশের তুলনায়। আচ্ছা পৃথিবীর একটা দেশও কি আছে যে দেশে শুধুই এক ধর্মের মানুষ বাস করে? সংখ্যালঘু শব্দটাই সবচেয়ে জঘন্য শব্দ। ভারতের মুসলমানদের জন্য যেমন বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্যও সমান অর্থে । রহিমের মায়ের মতো গল্প যে কারোই তৈরি হতে পারে কথাটা মনে রেখেন।
** কাঙ্গাল হরিনাথের বাড়ির দরজার ছবিটা তুলেছিলাম গতবছর। কেন যেন দিতে ইচ্ছে করলো । লালনের সেই তিন পাগলের এক পাগল ছিলেন হরিনাথ। যখন জমিদারের নানা অনাচারের বিরুদ্ধে তিন পাগল এক হতেন তখন তাদের আলাদা করে কোন ধর্ম থাকতো কিনা আমার জানা নেই।
বনফুলের ‘দাঙ্গার সময়’ গল্পটা পড়েছেন ? সেই যে রহিমের মা যে পাটনা থেকে পালিয়ে এসেছিল হিন্দু পরিবারের কাছে আশ্রয় নিতে অথচ তখন ঐ হিন্দু পুরো মহল্লাটি কাঁপছে মুসলমানদের আক্রমণের ভয়ে। রহিমের মা যে হিন্দু মানুষটির কাছে প্রাণে বাঁচতে এসেছিলেন তাকে তিনি ছোটবেলায় স্তন পান করিয়েছিলেন সেই অর্থে দুধ মা।
কিছু মানুষের কথা গড়পরতা জীবনে আসলে বলা হয়ে উঠেনা কখনোই। এসব যেন জন্মগত প্রাপ্তি। যদিও ব্যক্তিগত তবুও বলি। শিলাইদহ থেকে ফেরার পথে গড়াই নদী পার হচ্ছি ১৯৯১ এর ২৮ বা ২৯ এপ্রিল, সেই ঐতিহাসিক ঘূর্ণিঝড়ের রাত। এমন তুমুল ঝড় মানুষ, গাছপালা সব কিছু উড়ে যায় বাতাসে। সাঁতার জানিনা, সাথে বাবা-মা কেউ নেই। আমার তখন ৯, ভয়ে এক নারীর শাড়ির আঁচল ধরে রেখেছি। তিনিও তাল সামলাতে পারছেন না। কখন যেন হাতছাড়া হয়ে গেলাম। ভয়ে নাক মুখ চোখ ফুলিয়ে কাঁদছি, ভেবেছিলাম আর কোনদিন বাড়ি ফেরা হবেনা। পেছন থেকে খুব দীর্ঘ লম্বা কে যেন এসে একটানে কাধে তুলে নিলো। বাতাসে বালির প্রকোপে চারপাশের সব অন্ধকার। কোনভাবে আমাকে নিয়ে দৌড়ে বাঁশের সাঁকো দিয়ে গড়াই নদী পার হয়ে এলো। এ পাশে আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকা পিকনিকের বাসে উঠলো, তখনো আমি তাঁর দুই হাতের ভেতর ভয়ে কাঁপছি। তখন কিছুটা রয়েসয়ে এসেছে সব। ওমা এতো আমার অরুন কাকু। তাইতো বলি কে দেখবে আমি নদীর ভেতর ভয়ে পরেই যাচ্ছিলাম ? অরুন বোস প্রথম আলোর সাংবাদিক, ভাষা প্রতিযোগ করেন। তখন শুধু আমার অরুন কাকুই ছিলেন।
আমার মায়ের অসুস্থতার সময়ে টানা ছয় বছর যে বাড়িতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত থাকতাম সেই বাড়িতে ছিলো কলতলায় বিশাল এক নিম গাছ। ঘরের সামনে লাল বাঁধানো সিঁড়ি সাথে বাধানো তুলসীর গাছ। ভদ্রমহিলাকে আমার বাবা মা ডাকতেন মাসিমা। অতএব আমার হলেন ‘মাসিমা দাদু’। যেমন হয়েছিলো বকুল দি পিসি ( কানু কাকার মা) , গোপাল দা মামা ( সত্য নারায়ণ বস্ত্রালয়ের)। এই মধ্য বয়সে এসেও তাকে মাসিমা দাদুই ডাকি। অঞ্জলী বালা নামের এই ভদ্র মহিলার পরিচয়ের শেষ নেই। তিনি সেরা নারী পুরস্কার পেয়েছেন, ট্রাস্টি মিনিস্টার গৌড় চন্দ্র বালার স্ত্রী অঞ্জলী বালা নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বিপ্লব বালা বা প্রথম আলোর সাংবাদিক পান্না বালার মা যতটুকু ঠিক অতোটাই আমার মাসিমা দাদু....... এখনো। তখন ক্লাশ থ্রি, ১৯৮৯। মথুরাপুর দেউরের সামনে পিকনিক হচ্ছে। আমি রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ওয়াহিদুল হকের হাতের ভেতর দিয়ে মাথা গলিয়ে হারমোনিয়ামে ভুল রিড চাপছি, হটাত দেখি মাসিমা দাদুর গা ঘেঁষে বসে আছে নিষাদ। পরের দৃশ্য হচ্ছে কে ওয়াহিদুল হক? থাকুক তাঁর কাছে হারমোনিয়াম আমার অঞ্জলী বালা ভাগ হয়ে যাচ্ছে....অসম্ভব। ওয়াহিদুল হক কে সেটা আসলে তখনো বোঝার বয়স হয়নি আমার। এই গল্প মাসিমা দাদু যখন করেন তখন তিনি বলেন আমি হিংসুটে। ঠিক তাই ওয়াহিদুল হক শ্রদ্ধেয়, নমস্য। তিনি তাঁর স্থানে আমার মাসিমা দাদুই সই। আর বিভা পিসি যিনি সাদা থান পরে আহ্নিকে বসতেন এই যে আমি পান খাই কে শেখালো। সব বিভা পিসির দোষ। এবার আর দুজন মানুষের কথা বলি অনুমতি পেলে, আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক পুঁটি পিসি। পুঁটি পিসি আমাকে কাগজে কলমে প্রথম লিখতে শিখিয়েছেন। সাঁতার শেখাতে পুকুড়ের জলে বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে আমাকে হাত দিয়ে যখন ধরে রাখতেন তখন তিনি মুহূর্তে আমার মা হয়ে যেতেন। উপল যেদিন পানিতে ডুবতে বসেছিল সেদিন কে টেনে তুলেছিল? আমার পুঁটি পিসি। আমাদের বাড়ির আজীবন ফার্স্ট ডোর নেইবার গোপী কাকু (বাংলার বাণীর সাংবাদিক মন্টু দাস গোপী)। গোপী কাকু কঠোর টাইপ মানুষ ছিলেন কিছুটা। তাদের রান্নার ঘরে আমার প্রবেশ নিষেধ ছিলো ( খুব স্বাভাবিক) কিন্তু সত্যি বলতে কি মনে পড়েনা ওই বাড়িতে কোনদিন এমন কোন ভালো খাবার রান্না হয়েছে যা উপল বা মঞ্জরীর জন্য আসেনি তা হয়নি।
বহু কথা বলেছি একজনের নাম দিয়ে শেষ করছি। মধুসুদন চক্রবর্তী। ক্লাশ এইট থেকে এসএসসি পর্যন্ত আমার অংকের শিক্ষক ছিলেন। আমি তাকে নিয়ে কিছু লিখতে পারিনা , হাত কাঁপে। শুধু এটুকু বলি মধুসুদন স্যার আমার জীবনে পাওয়া অন্যতম বিশেষ উপহার। এক যুগেরও বেশি স্যারের সাথে দেখা হয়না কিন্তু বাজি রেখে বলতে পারি, পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বসেও যদি সেই একবার ডাকেন মাইঠরেন ( মা ঠাকুরনের সংক্ষিপ্ত রুপ) আমি অন্য প্রান্তে বসেও নিশ্চিত জানবো.... স্যার ডাকছেন। এই লাইনটা লেখার সময় আমার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছে। আমি খুব অযোগ্য সন্তান আপনাদের। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে কয়েক বছর গবেষণা থেকে সামান্য যেটুকু বুঝি এই সাম্প্রদায়িকতা যতোটা না সাধারণ মানুষের তৈরি তার চেয়ে বেশি তৈরি আমাদের অর্থনীতির, রাজনীতির। এটা হাতিয়ার। কাশ্মীরের হযরত বাল মসজিদে মহানবীর চুল চুরি যাবার মিথ্যে খবর রটিয়ে যে সাম্প্রদায়িকতা তৈরি হয়েছিল ১৯৬৪তে সেটা ছিল মুনায়েম খাঁর রাজনীতি। পঞ্চাশের যে দাঙ্গা হয়েছে সেও ভাষা আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার ইচ্ছে। বাবরী মসজিদ বা নির্বাচনের পর ? একই কথা সেই রাজনীতিই । বিশ্বাস করিনা এ দেশের সাধারণ মানুষ কোন ইন্ধন ছাড়া এমন সাম্প্রদায়িক আচরণ করতে পারে বা সম্ভব সেটা।
পাঁচ বছর বয়সের একটা জামার কথা মনে আছে, সেবার মা পুরো বিছানায় শয্যাশায়ী কারণ তার মা মারা গেছেন। বেশ মন খারাপ, ঈদ চলে এলো আমার জামা কেনা হয়নি। ঈদের কয়েকদিন আগে ঠিকঠাক নতুন জামা পেলাম। আর কে দেবে? মাসিমা দাদু..............আচ্ছা তাতে কি তাঁর ধর্ম বিশ্বাসে কোন ক্ষতি হয়েছিল নাকি আমি যে ওই বয়সে প্রতিদিন বসে তাঁর সাথে পূজা করতাম, প্রসাদ নিতাম তাতে আমার ধর্ম চলে গেছে ? মাসিমা দাদু, পুঁটি পিসি, মধু স্যার আপনাদের কাছে আমার আসলে ক্ষমা চাইবার ইচ্ছে নেই। কেন ক্ষমা চাইব আমি মুসলমান বলে ? সম্প্রীতির কোন ধর্ম নেই কারণ আমার আজীবন ধরে পাওয়া এই মানুষদের ভালোবাসার কোন ধর্ম ছিলনা শুধু ভালবাসা ছাড়া । যারা নাসিরাবাদসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমার অযোগ্য অন্যায় করেছেন তারা যতোটা না ধর্মের জন্য করেছেন তার চেয়ে বেশি তারা প্রলুব্ধ হয়েছেন অন্য কারণে । মুসলমান হিসেবে ক্ষমা চাওয়া মানে তাদের একই কাতারে আনা । এটা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয় । আমাদের কারোই উচিৎ নয় ক্ষমা করা। রহিমের মা’র ঘটনাটা মনে রাখুন মন্দিরে হামলাকারি ভাই সকল। দু একজন বলেন, আমাদের দেশে সংখ্যালঘুরা যথেষ্ট আয়েশে থাকে পাশের দেশের তুলনায়। আচ্ছা পৃথিবীর একটা দেশও কি আছে যে দেশে শুধুই এক ধর্মের মানুষ বাস করে? সংখ্যালঘু শব্দটাই সবচেয়ে জঘন্য শব্দ। ভারতের মুসলমানদের জন্য যেমন বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্যও সমান অর্থে । রহিমের মায়ের মতো গল্প যে কারোই তৈরি হতে পারে কথাটা মনে রেখেন।
** কাঙ্গাল হরিনাথের বাড়ির দরজার ছবিটা তুলেছিলাম গতবছর। কেন যেন দিতে ইচ্ছে করলো । লালনের সেই তিন পাগলের এক পাগল ছিলেন হরিনাথ। যখন জমিদারের নানা অনাচারের বিরুদ্ধে তিন পাগল এক হতেন তখন তাদের আলাদা করে কোন ধর্ম থাকতো কিনা আমার জানা নেই।
0 মন্তব্যসমূহ