রুমা মোদক
আমি ভরত কুইলা স্যার, রাঙামাটির ভরত,.....নীল রক্তের রোষে মরা ডরত, রংপুরের জুয়াড়ি তালুকদার শায়েস্তা করছে অবাধ্য প্রজাকে, বিদ্রোহ প্রজাকে মেরে দিয়েছে.......। এ আর আস্বাভাবিক কী? সমাজ বিবর্তনের ইতিহাসে দুর্বলের উপর সবলের সক্রুদ্ধ নিষ্ঠুর প্রতিক্রিয়া মোটামুটি স্বতসিদ্ধ। অমর মিত্রের পুনরুত্থান পাঠে তাই ক্রমে বিস্মৃত হই দেশ-কাল। বর্তমান থেকে ক্রমে অতীতগামী হই। পুনরাবৃত্ত ইতিহাসের নির্মমতায় জমিদার দর্পণ, নীল দর্পণের শাসকদের জান্তব রূঢ়তার উত্তরাধিকার এই জনপদে একবিংশকালে ভয় আর সন্ত্রস্ততার হিমশীতল স্পর্শে স্মরণে এনে দেয় তলস্তয়ের রেজারেকশন পড়া কোট প্যান্ট টাই পরিহিত আধুনিক যুবক অনিন্দ্য তালুকদার।
পুনরুত্থান ঘটেছিলো প্রভু যীশুর। পূণ্য শুক্রবারে পাপের অন্ধকার দূরীভূত করে জ্বালিয়েছিলো বিশ্বাসের আলো। পবিত্র পুনরুত্থানের মিথ ইতিহাসের নির্মমতার পথ বেয়ে নবতর ব্যাখ্যায় অমর মিত্রের লেখনীতে ভয়ার্ত এক অভিযাত্রা শেষে পুনজন্ম দিয়েছে এক দুঃসাহসী অভিযাত্রীর, দুর্বল ভীরু নিপীড়িত চিত্তের ক্রমাগত অবনমন থেকে যার চকিত উত্থান, অভাবিত কিন্তু কাক্সিক্ষত।
পুনরুত্থান পাঠে ঘোরগ্রস্ত ছিলাম, পুরো পাঠাভিজ্ঞতার সময় ব্যপ্ত করে প্রবেশ করছিলাম এক ভীষণ চেনা অথচ গভীর থেকে অচেনা এক জগতে। উন্মোচিত হচ্ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের আবশ্যিক অঙ্গ আমলাতন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা ঘোরতর নীতিহীনতার মুখোশ, সাধারণের রক্তমাংসেমজ্জায় জেকে বসা এক দুর্নীতিগ্রস্ত চক্রের চেহারা। অভিজাত থেকে ব্রাত্য, উপরের স্তরের চেয়ার থেকে সর্বনি¤েœর কর্মচারী সবাই অবিচ্ছেদ্য অংশ এর। সবাই অংশীদার, সুবিধাভোগী। গরীব নিঃস্ব আমজনতাকে পদে পদে বঞ্চিত করার অন্যায়ের উপর দাঁড়িয়ে ন্যায়ের শ্লাঘা তার। ন্যায়ের ঝান্ডা তার হাতে। দেশরক্ষা আর দেশশাসনের মহান দায়িত্ব তার হাতে অর্পিত। নিজেদের মেধা দক্ষতা আর যোগ্যতাকে পুজি করে অতপর তাদের সে দায়িত্বের ঝান্ডা হাতে আত্মপ্রেমে, আত্মপ্রতিষ্ঠায় ডুবে যাওয়া, সম্পদের পাহাড় গড়া। ভোগবিলাসে গা ভাসানো, নির্বিকার অনুতাপহীন বৈভবময় জীবন যাপন। আমলাতন্ত্রের এই গভীরতর নগ্ন চেহারা, অমর মিত্রের পুনরুত্থানে যা স্পষ্ট হয়ে পাঠযোগ্য হয়ে উঠে আমাদের কাছে, তা কেবলই ভারতবর্ষের বাস্তবতা নয়। একদম শতভাগ বাস্তবতা আমাদের রাষ্ট্রেরও। ক্ষেত্রবিশেষে সেই নগ্ন রূঢ়তা বেশি বই কম নয়।
তাদের মাঝে দু একজন ব্যতিক্রম থাকে, গোলকবিহারী তাদের একজন। চাতুর্যের, ক্ষমতার, লোভের, দম্ভের মাকড়সার জালে যে অসহায় পতঙ্গের মতো আটকে যায়। আর তারপর শুরু হয় তার ছুটে চলা, ভয়ার্ত ত্রস্ত ছুটে চলা, আর আমরা সাধারণ পাঠক, নিরীহ আমজনতা তার নিষ্ঠ সহযাত্রী কেবল, আমাদের সকল অসহায়ত্ব নিয়ে, সকল অক্ষমতা নিয়ে। যে অক্ষম-অনির্দেশ্য-গন্তব্যহীন উদভ্রান্ত যাত্রাশেষে সেই আমাদের পথ প্রদর্শক শেষপর্যন্ত, গোলকবিহারী। মেরুদন্ডহীন পঁতঙ্গ থেকে দুঃসাহসী মেরুদন্ডী মানুষ হয়ে উঠা তার। ঠিক আমাদের কাক্সক্ষামতো।
অতপর এইসব নিয়ম-কানুন-শৃঙ্খল-আইনতন্ত্র-আমলাতন্ত্র-অভিজাততন্ত্র ইত্যাদি এতোদিন ধরে অসহায় সাধারণের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূত হয়ে জেঁকে বসে থাকা যাবতীয় জুজুর ভয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ানো তার, সে মানে গোলকবিহারী, গোলকবিহারী মানে জি কে, ইন্সপেক্টর ন-পাহাড়ী থানা, জি কে মানে ভরত, ভরত কুইলা। এইচ.এস.সি পাশের পর যে আর পড়েনি, যে একটা ফ্রি স্কুল চালায়, সরকারের এফিলিয়শনের চেষ্টা করছে, পারছে না। ভরতই রাঙামাটির। তার ভিতরে আগুন। যে রাঙামাটির মাটির নীচে আগুন।
এই ভরত কুইলাকে হত্যা করা হয়েছে পুলিশ হেফাজতে। স্বয়ং এএসপি নীল রক্তধারী অনিন্দ্য তালুকদারের তত্ত্বাবধানে করা হয়েছে কাজটি। তিনি নিজ হাতে করেননি। নীল রক্ত বহনকারী শোষক শ্রেণীর প্রতিভূদের নিজ হাতে করতে হয় না কিছু, ইশারামতো পাইক পেয়াদা ঠিক প্রস্তুত থাকে।
ভরত কুইলাকে মেরে ফেলা হয়েছে কারণ সে বেআইনী খাদান নিয়ে লাফালাফি করছিল অবিনাশ সরকারের খাদানে চাপা দিয়ে লুকানো হয়েছে যে মৃত্যু, প্রপার চ্যানেলে নাড়াচাড়া হলে পুনরায় রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে সবার, উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সবার। এই ভাগাভাগির সা¤্রাজ্যে একমাত্র বেমানান গোলকবিহারী। স্কুল মাস্টার বা কেরানীর হওয়াই উচিত ছিল যার, ভাগাভাগির অন্যায় রাজ্যে যার এসিআর ভালো হয় না, প্রমোশন হয় না। ন-পাহাড়ী রাজ্যে কেনো তার পোস্টিং হয়েছে এ মনোযন্ত্রনায় বাঁচে না সে। যে ন-পাহাড়ী এলাকায় রেশন ডিলার থেকে দোকান, ব্যবসা, রাস্তায় সওদা নিয়ে বসা গ্রামের মানুষ থেকে কয়লার খাদান, চিনা মাটির খাদান, পাহাড়ের ভেঙ্গে শহরে পাথর চালান হওয়া ক্রাশার সব। ..........সবই টাকার উৎস। পঞ্চায়েত থেকে থানা। ন-পাহাড়ী একটি টাকার খনি। এই টাকার খনির সাথে মানিয়ে নিতে না পারার যন্ত্রনা যা কিনা তার অন্তর্গত স্বভাবজাত সুকুমারবোধ, তাই শেষ পর্যন্ত তাকে টেনে নেয় অমোঘ ভয়াবহ এক চক্রান্তে। এ যেনো ছক কাটা ঘর, যাতে নির্বিবাদে প্রবেশ করা ছাড়া তার আর কোনো গত্যন্তর ছিল না। কোন হাতিয়ার নেই তার লড়াই করে এর বিরুদ্ধে-যতোই ক্রুদ্ধ হোক হৃদয়। কেউ নেই সাথী তার সঙ্গী হয় এই অন্যায় বিরোধী প্রতিরোধে। অতপর পলায়নই নিয়তি তার। ভাগ্যহত-শোষিত, পর্যুদুস্ত-পরাজিত পলায়ন। যা কিনা এই অসম সামাজিক ব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষমতাহীন বিত্তহীন প্রান্তজনের গন্তব্যই হয়ে উঠে শেষ পর্যন্ত। কী ভীষণ, দৃশ্যমান স্পষ্ট বৈপরীত্য, ন্যায় নতজানু, উদ্ধত অন্যায়। সংশ্লিষ্ট সবাই জানে, জেনেও যুক্তি খুঁজে একেই যুক্তিসিদ্ধ প্রতিষ্ঠিত করতে, যেমন সন্দীপ ঘোষ খোঁজেন, মেয়ে সম্বিতার ক্রমাগত জেরার মুখে, প্রশাসকদের সর্বদা তার সাবঅরডিনেটদের পাশে থাকতে হয় সব সময় না হলে প্রশাসন চলে না। তবু সম্বিতার পীড়াপীড়িতেই বোধকরি ক্ষনিকের জন্য আমলা থেকে মানুষ হয়ে উঠেন তিনি, প্রমোশন প্রত্যাশী লোভী অফিসার সুবল রায়কে ফোন দেন, কিন্তু ততক্ষনে বল ছুটে গেছে কোর্ট থেকে।
থানা থেকে প্রশাসকের কার্যালয় হয়ে হাসপাতালের মর্গ, এই সিস্টেম, বৃটিশ প্রবর্তিত সুচিন্তিত শাসনে-শোষনের শৃঙ্খল। এ পর্যন্ত বর্ণনায় লেখক অমর মিত্রের সহায়ক হয়েছে ঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতা, সিভিল সার্ভিসে কর্মরত থাকায় অভিজ্ঞতায় নিপুন দক্ষতায় বর্ণনা করেছেন এর বাঁক, উপবাঁক। যে কারো পক্ষে তা হয়তো অসম্ভবই বটে।
কিন্তু তারপর গোলকবিহারী যে জার্নি, বাগুইয়াটি ফ্ল্যাট থেকে কোচবিহারে, কোচবিহার থেকে ছিটমহল, নিজের পৈত্রিক ভিটা। সর্বত্রই পলাতক আসামী যে, টিভির পর্দা জুড়ে যার ছবি। নির্দোষ অথচ প্রমাণিত আসামী গোলকবিহারী। ক্রমাগত পলায়ন তার, পলায়ন পলায়ন, যে পলায়নে তার একমাত্র সঙ্গী বিশ্বস্ত ভগবান বর্মণ, স্ত্রী রণিতাও নয় পর্যন্ত। - ও উড়িয়া যাওরে-ওরে বুলবুলি ময়না.....একেলা ঘরে বসিরে- ও ওরে বুলবুলি ময়না....। কী বিচিত্র অভিজ্ঞতা এই পলাতক জীবনের, অহসায়ত্বের সুযোগে যোগেন বর্মণের আটকে ফেলার পায়তারা, পৈত্রিক ভিটার মনীন্দ্র, যে কিনা একদিন জিহবায় জুতা পরিষ্কার করতে এসেছিল গোলকবিহারীর, আত্মজা টিয়াকে একনজর না দেখতে দেয়া স্ত্রী রণিতা সব নির্মম অভিজ্ঞতা তাকে বুঝি একসময় দাঁড় করিয়ে দেয় তার আপন মেরুদন্ডে। ভরত কুইলার পুনরুত্থান ঘটে গোলকবিহারীতে।
আর এতোক্ষণ ভয়াবহ মৃত্যু-যন্ত্রনা-পলায়নের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা থেকে মূহুর্তে পাঠক হৃদয়ও তখন গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে যায় গোলকবিহারীর সাথে। বুঝি প্রতিটি পাঠক হয়ে উঠেন একজন ভরত কুইলা। তাদের জীবনের সব অপ্রিয় অভিজ্ঞতায় তারা একযোগে চোখ রাঙায় পুরো আমলাতন্ত্রকে, সিস্টেমকে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে শেষাবধি। আর মুচকি হেসে আমরা দেখি আপাত কঠোর উর্দির নীচে কী ভীষণ দুর্বল নড়বড়ে ভীত সব কাঠামো......প্রতীত হয়, বুঝি সাজানো এক ধাক্কাতেই ধ্বসে পড়ে যেতে পারে সব।
কথাসাহিত্যিক অমর মিত্রের মুন্সীয়ানা এই যে এক আপাত নিরীহ ইন্সপেক্টর গোলকবিহারীকে তিনি প্রতিস্থাপিত করেন সমগ্র নিপীড়িত জনতার অন্তরাত্মায়। এই অভিনব পুনরুত্থান, যা একান্তই তার নিজস্ব মানসসজ্ঞাত, এক অভিনব উপায়েই পুনরুত্থান ঘটায় পাঠরত পাঠকের। পাঠশেষে বোধ হয় আমিই সেই বিজয়ী গোলকবিহারী, পুনরুত্থান যে কাঁপিয়ে দিতে পেরেছি জগদ্বল পাথর হয়ে চেপে থাকা আমলাতন্ত্রের ভিত। অমর মিত্রের পুনরুত্থান বাংলা সাহিত্যে একটি অমর মাত্রা যোগ করলো।
আমি ভরত কুইলা স্যার, রাঙামাটির ভরত,.....নীল রক্তের রোষে মরা ডরত, রংপুরের জুয়াড়ি তালুকদার শায়েস্তা করছে অবাধ্য প্রজাকে, বিদ্রোহ প্রজাকে মেরে দিয়েছে.......। এ আর আস্বাভাবিক কী? সমাজ বিবর্তনের ইতিহাসে দুর্বলের উপর সবলের সক্রুদ্ধ নিষ্ঠুর প্রতিক্রিয়া মোটামুটি স্বতসিদ্ধ। অমর মিত্রের পুনরুত্থান পাঠে তাই ক্রমে বিস্মৃত হই দেশ-কাল। বর্তমান থেকে ক্রমে অতীতগামী হই। পুনরাবৃত্ত ইতিহাসের নির্মমতায় জমিদার দর্পণ, নীল দর্পণের শাসকদের জান্তব রূঢ়তার উত্তরাধিকার এই জনপদে একবিংশকালে ভয় আর সন্ত্রস্ততার হিমশীতল স্পর্শে স্মরণে এনে দেয় তলস্তয়ের রেজারেকশন পড়া কোট প্যান্ট টাই পরিহিত আধুনিক যুবক অনিন্দ্য তালুকদার।
পুনরুত্থান ঘটেছিলো প্রভু যীশুর। পূণ্য শুক্রবারে পাপের অন্ধকার দূরীভূত করে জ্বালিয়েছিলো বিশ্বাসের আলো। পবিত্র পুনরুত্থানের মিথ ইতিহাসের নির্মমতার পথ বেয়ে নবতর ব্যাখ্যায় অমর মিত্রের লেখনীতে ভয়ার্ত এক অভিযাত্রা শেষে পুনজন্ম দিয়েছে এক দুঃসাহসী অভিযাত্রীর, দুর্বল ভীরু নিপীড়িত চিত্তের ক্রমাগত অবনমন থেকে যার চকিত উত্থান, অভাবিত কিন্তু কাক্সিক্ষত।
পুনরুত্থান পাঠে ঘোরগ্রস্ত ছিলাম, পুরো পাঠাভিজ্ঞতার সময় ব্যপ্ত করে প্রবেশ করছিলাম এক ভীষণ চেনা অথচ গভীর থেকে অচেনা এক জগতে। উন্মোচিত হচ্ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের আবশ্যিক অঙ্গ আমলাতন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা ঘোরতর নীতিহীনতার মুখোশ, সাধারণের রক্তমাংসেমজ্জায় জেকে বসা এক দুর্নীতিগ্রস্ত চক্রের চেহারা। অভিজাত থেকে ব্রাত্য, উপরের স্তরের চেয়ার থেকে সর্বনি¤েœর কর্মচারী সবাই অবিচ্ছেদ্য অংশ এর। সবাই অংশীদার, সুবিধাভোগী। গরীব নিঃস্ব আমজনতাকে পদে পদে বঞ্চিত করার অন্যায়ের উপর দাঁড়িয়ে ন্যায়ের শ্লাঘা তার। ন্যায়ের ঝান্ডা তার হাতে। দেশরক্ষা আর দেশশাসনের মহান দায়িত্ব তার হাতে অর্পিত। নিজেদের মেধা দক্ষতা আর যোগ্যতাকে পুজি করে অতপর তাদের সে দায়িত্বের ঝান্ডা হাতে আত্মপ্রেমে, আত্মপ্রতিষ্ঠায় ডুবে যাওয়া, সম্পদের পাহাড় গড়া। ভোগবিলাসে গা ভাসানো, নির্বিকার অনুতাপহীন বৈভবময় জীবন যাপন। আমলাতন্ত্রের এই গভীরতর নগ্ন চেহারা, অমর মিত্রের পুনরুত্থানে যা স্পষ্ট হয়ে পাঠযোগ্য হয়ে উঠে আমাদের কাছে, তা কেবলই ভারতবর্ষের বাস্তবতা নয়। একদম শতভাগ বাস্তবতা আমাদের রাষ্ট্রেরও। ক্ষেত্রবিশেষে সেই নগ্ন রূঢ়তা বেশি বই কম নয়।
তাদের মাঝে দু একজন ব্যতিক্রম থাকে, গোলকবিহারী তাদের একজন। চাতুর্যের, ক্ষমতার, লোভের, দম্ভের মাকড়সার জালে যে অসহায় পতঙ্গের মতো আটকে যায়। আর তারপর শুরু হয় তার ছুটে চলা, ভয়ার্ত ত্রস্ত ছুটে চলা, আর আমরা সাধারণ পাঠক, নিরীহ আমজনতা তার নিষ্ঠ সহযাত্রী কেবল, আমাদের সকল অসহায়ত্ব নিয়ে, সকল অক্ষমতা নিয়ে। যে অক্ষম-অনির্দেশ্য-গন্তব্যহীন উদভ্রান্ত যাত্রাশেষে সেই আমাদের পথ প্রদর্শক শেষপর্যন্ত, গোলকবিহারী। মেরুদন্ডহীন পঁতঙ্গ থেকে দুঃসাহসী মেরুদন্ডী মানুষ হয়ে উঠা তার। ঠিক আমাদের কাক্সক্ষামতো।
অতপর এইসব নিয়ম-কানুন-শৃঙ্খল-আইনতন্ত্র-আমলাতন্ত্র-অভিজাততন্ত্র ইত্যাদি এতোদিন ধরে অসহায় সাধারণের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূত হয়ে জেঁকে বসে থাকা যাবতীয় জুজুর ভয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ানো তার, সে মানে গোলকবিহারী, গোলকবিহারী মানে জি কে, ইন্সপেক্টর ন-পাহাড়ী থানা, জি কে মানে ভরত, ভরত কুইলা। এইচ.এস.সি পাশের পর যে আর পড়েনি, যে একটা ফ্রি স্কুল চালায়, সরকারের এফিলিয়শনের চেষ্টা করছে, পারছে না। ভরতই রাঙামাটির। তার ভিতরে আগুন। যে রাঙামাটির মাটির নীচে আগুন।
এই ভরত কুইলাকে হত্যা করা হয়েছে পুলিশ হেফাজতে। স্বয়ং এএসপি নীল রক্তধারী অনিন্দ্য তালুকদারের তত্ত্বাবধানে করা হয়েছে কাজটি। তিনি নিজ হাতে করেননি। নীল রক্ত বহনকারী শোষক শ্রেণীর প্রতিভূদের নিজ হাতে করতে হয় না কিছু, ইশারামতো পাইক পেয়াদা ঠিক প্রস্তুত থাকে।
ভরত কুইলাকে মেরে ফেলা হয়েছে কারণ সে বেআইনী খাদান নিয়ে লাফালাফি করছিল অবিনাশ সরকারের খাদানে চাপা দিয়ে লুকানো হয়েছে যে মৃত্যু, প্রপার চ্যানেলে নাড়াচাড়া হলে পুনরায় রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে সবার, উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সবার। এই ভাগাভাগির সা¤্রাজ্যে একমাত্র বেমানান গোলকবিহারী। স্কুল মাস্টার বা কেরানীর হওয়াই উচিত ছিল যার, ভাগাভাগির অন্যায় রাজ্যে যার এসিআর ভালো হয় না, প্রমোশন হয় না। ন-পাহাড়ী রাজ্যে কেনো তার পোস্টিং হয়েছে এ মনোযন্ত্রনায় বাঁচে না সে। যে ন-পাহাড়ী এলাকায় রেশন ডিলার থেকে দোকান, ব্যবসা, রাস্তায় সওদা নিয়ে বসা গ্রামের মানুষ থেকে কয়লার খাদান, চিনা মাটির খাদান, পাহাড়ের ভেঙ্গে শহরে পাথর চালান হওয়া ক্রাশার সব। ..........সবই টাকার উৎস। পঞ্চায়েত থেকে থানা। ন-পাহাড়ী একটি টাকার খনি। এই টাকার খনির সাথে মানিয়ে নিতে না পারার যন্ত্রনা যা কিনা তার অন্তর্গত স্বভাবজাত সুকুমারবোধ, তাই শেষ পর্যন্ত তাকে টেনে নেয় অমোঘ ভয়াবহ এক চক্রান্তে। এ যেনো ছক কাটা ঘর, যাতে নির্বিবাদে প্রবেশ করা ছাড়া তার আর কোনো গত্যন্তর ছিল না। কোন হাতিয়ার নেই তার লড়াই করে এর বিরুদ্ধে-যতোই ক্রুদ্ধ হোক হৃদয়। কেউ নেই সাথী তার সঙ্গী হয় এই অন্যায় বিরোধী প্রতিরোধে। অতপর পলায়নই নিয়তি তার। ভাগ্যহত-শোষিত, পর্যুদুস্ত-পরাজিত পলায়ন। যা কিনা এই অসম সামাজিক ব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষমতাহীন বিত্তহীন প্রান্তজনের গন্তব্যই হয়ে উঠে শেষ পর্যন্ত। কী ভীষণ, দৃশ্যমান স্পষ্ট বৈপরীত্য, ন্যায় নতজানু, উদ্ধত অন্যায়। সংশ্লিষ্ট সবাই জানে, জেনেও যুক্তি খুঁজে একেই যুক্তিসিদ্ধ প্রতিষ্ঠিত করতে, যেমন সন্দীপ ঘোষ খোঁজেন, মেয়ে সম্বিতার ক্রমাগত জেরার মুখে, প্রশাসকদের সর্বদা তার সাবঅরডিনেটদের পাশে থাকতে হয় সব সময় না হলে প্রশাসন চলে না। তবু সম্বিতার পীড়াপীড়িতেই বোধকরি ক্ষনিকের জন্য আমলা থেকে মানুষ হয়ে উঠেন তিনি, প্রমোশন প্রত্যাশী লোভী অফিসার সুবল রায়কে ফোন দেন, কিন্তু ততক্ষনে বল ছুটে গেছে কোর্ট থেকে।
থানা থেকে প্রশাসকের কার্যালয় হয়ে হাসপাতালের মর্গ, এই সিস্টেম, বৃটিশ প্রবর্তিত সুচিন্তিত শাসনে-শোষনের শৃঙ্খল। এ পর্যন্ত বর্ণনায় লেখক অমর মিত্রের সহায়ক হয়েছে ঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতা, সিভিল সার্ভিসে কর্মরত থাকায় অভিজ্ঞতায় নিপুন দক্ষতায় বর্ণনা করেছেন এর বাঁক, উপবাঁক। যে কারো পক্ষে তা হয়তো অসম্ভবই বটে।
কিন্তু তারপর গোলকবিহারী যে জার্নি, বাগুইয়াটি ফ্ল্যাট থেকে কোচবিহারে, কোচবিহার থেকে ছিটমহল, নিজের পৈত্রিক ভিটা। সর্বত্রই পলাতক আসামী যে, টিভির পর্দা জুড়ে যার ছবি। নির্দোষ অথচ প্রমাণিত আসামী গোলকবিহারী। ক্রমাগত পলায়ন তার, পলায়ন পলায়ন, যে পলায়নে তার একমাত্র সঙ্গী বিশ্বস্ত ভগবান বর্মণ, স্ত্রী রণিতাও নয় পর্যন্ত। - ও উড়িয়া যাওরে-ওরে বুলবুলি ময়না.....একেলা ঘরে বসিরে- ও ওরে বুলবুলি ময়না....। কী বিচিত্র অভিজ্ঞতা এই পলাতক জীবনের, অহসায়ত্বের সুযোগে যোগেন বর্মণের আটকে ফেলার পায়তারা, পৈত্রিক ভিটার মনীন্দ্র, যে কিনা একদিন জিহবায় জুতা পরিষ্কার করতে এসেছিল গোলকবিহারীর, আত্মজা টিয়াকে একনজর না দেখতে দেয়া স্ত্রী রণিতা সব নির্মম অভিজ্ঞতা তাকে বুঝি একসময় দাঁড় করিয়ে দেয় তার আপন মেরুদন্ডে। ভরত কুইলার পুনরুত্থান ঘটে গোলকবিহারীতে।
আর এতোক্ষণ ভয়াবহ মৃত্যু-যন্ত্রনা-পলায়নের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা থেকে মূহুর্তে পাঠক হৃদয়ও তখন গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে যায় গোলকবিহারীর সাথে। বুঝি প্রতিটি পাঠক হয়ে উঠেন একজন ভরত কুইলা। তাদের জীবনের সব অপ্রিয় অভিজ্ঞতায় তারা একযোগে চোখ রাঙায় পুরো আমলাতন্ত্রকে, সিস্টেমকে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে শেষাবধি। আর মুচকি হেসে আমরা দেখি আপাত কঠোর উর্দির নীচে কী ভীষণ দুর্বল নড়বড়ে ভীত সব কাঠামো......প্রতীত হয়, বুঝি সাজানো এক ধাক্কাতেই ধ্বসে পড়ে যেতে পারে সব।
কথাসাহিত্যিক অমর মিত্রের মুন্সীয়ানা এই যে এক আপাত নিরীহ ইন্সপেক্টর গোলকবিহারীকে তিনি প্রতিস্থাপিত করেন সমগ্র নিপীড়িত জনতার অন্তরাত্মায়। এই অভিনব পুনরুত্থান, যা একান্তই তার নিজস্ব মানসসজ্ঞাত, এক অভিনব উপায়েই পুনরুত্থান ঘটায় পাঠরত পাঠকের। পাঠশেষে বোধ হয় আমিই সেই বিজয়ী গোলকবিহারী, পুনরুত্থান যে কাঁপিয়ে দিতে পেরেছি জগদ্বল পাথর হয়ে চেপে থাকা আমলাতন্ত্রের ভিত। অমর মিত্রের পুনরুত্থান বাংলা সাহিত্যে একটি অমর মাত্রা যোগ করলো।
0 মন্তব্যসমূহ