হাসান আওরঙ্গজেব
“ওটা আমার কাজ। আমিই খুন করেছিলাম কুড়ুল দিয়ে ওই সুদখোর বুড়ি আর তার বোন লিজাভেতাকে। আমিই লুট করেছিলাম ওদের জিনিস।”
এই রক্ত হিম করা স্বীকারোক্তির মাধ্যমে ঘটে এক দীর্ঘ ও যন্ত্রনাদায়ক অপরাধ-বোধ এবং নির্মম আত্মপীড়নের অবসান। সেই সাথে ঘটে বিশ্ব সাহিত্যের অমর এক মহৎ কীর্তির যবনিকা। যদিও এই আত্ম-স্বীকৃতির শেষে নাতিদীর্ঘ এক উপসংহারের মাধ্যমে সূচিত হয় আরেক নতুন জীবনের পটভুমি। “নব জীবনের পথে একজন মানুষের ক্রমবিকাশের কাহিনী, এক জগত থেকে আরেক জগতে, নবজন্মে তার ধারাবাহিক উত্তরনের কথা”।
রুশ থেকে অরুন সোমের বাংলা অনুবাদে ছয়শ উনিশ পৃষ্ঠার এই উপন্যাস পাঠে একটুও ক্লান্তি আসেনা! কোথাও একবারের জন্যও মনে হয় না যে থেমে যাই। লাইনের পর লাইন পাঠ করে যেতে যেতে মনে হতে থাকে, হায়, এই মহাগ্রন্থ পাঠের আগে কতইনা দরিদ্র ছিলাম! পাঠের ভেতর দিয়ে যেন আমার পুনর্জন্ম ঘটে চলেছে। একটার পর একটা পৃষ্ঠায় উন্মোচিত হতে থাকে মানব জীবনের অন্তর্গত গোপন গহীন সব বিস্ময়। যেন কল্পনাকে ভেঙ্গে চুড়ে গুড়িয়ে দেওয়া ঐশ্বরিক বর্ণনা বিবৃত হতে থাকে মানব জাতির এক মহান লিপিকারের কন্ঠে; আর চেনাজানা পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের অতিপরিচিত বোধ অত্যন্ত বিপন্ন হতে থাকে। এই মহা উপন্যাসে দস্তয়েভস্কি সেই তালাবদ্ধ পৃথিবীর ঢাকনা আমাদের সম্মুখে উন্মোচন করেন, যেই পৃথিবীর খোঁজ পারতপক্ষে আমরা রাখি না। মানব জীবনের সেইসব দগদগে ক্ষত এক নিঃস্পৃহ ঔদাস্যে তিনি আমাদেরকে বের করে দেখান, যেসব ক্ষত আমরা ঢেকে রাখতে বদ্ধ পরিকর। নিদারুণ দারিদ্র্যতা, দুঃখ, কষ্ট ও বেদনার অভিঘাতে মানুষের বিকৃতি ও পতন, অপরাধ ও গ্লানিবোধ, নিষ্ঠুর মানসিক পীড়ন, হিংসা ও কদর্যতা, ঘৃণা ও ভালবাসা, এবং সর্বোপরি, যথার্থই, ঈশ্বরের বিরুদ্ধে মানুষের চিরন্তন বিদ্রোহের এক মহা নাটক এই উপন্যাস।
খুব সম্ভবত দস্তয়েভস্কি তার যুবক বয়সে লেখা ‘সাদারাত’ উপন্যাসে এই পৃথিবীরই ইঙ্গিত করেছিলেন-
“এই সেন্ট পিটার্সবুর্গ শহরে কিছু অদ্ভুত জায়গা আছে। যে সূর্য এই নগরীর অবশিষ্ট সবখানে কিরণ ছড়ায় তা ওইসব অদ্ভুত জায়গাগুলিতে ভুলেও উঁকি মারে না। তবে অন্য একটা সূর্য, একটা নতুন সূর্য আছে সেই দূরবর্তী কোণগুলির জন্য, সেই সূর্য একটু ভিন্ন রকম, একটা অদ্ভুত আলো ফেলে সবকিছুর ওপর। সেই দূরবর্তী কোণগুলিতে জীবন অন্যরকম, মনে হয় এক যোজন দূরের জীবন, আমাদের চারপাশের জীবনের সঙ্গে তা কোনোভাবেই মেলে না”।
উনিশ শতকের ষাটের দশক। জার আমলের রাশিয়ার সেন্ট পিটার্স বুর্গ শহর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র, তেইশ বছরের প্রতিশ্রুতিশীল বুদ্ধিজীবী ও দ্বিধা-বিভক্ত চরিত্রের অধিকারি সংবেদনশীল হৃদয়ের যুবক রাস্কোলনিকভ। রুশ সমাজের নির্যাতিত ও দলিত মানুষের জন্য যার হৃদয় ভালবাসায় পরিপূর্ণ। ভজনেসেন্সকি এভিনিউ এর স্তালিয়ারনি লেনের পাঁচতলা দালানের খুপরি মত এক চিলেকোঠায় সে বাস করে। লেখকের মতে সেটাকে খুপরি না বলে কুলুঙ্গি বলাই ভাল। মাস ছয়েক হতে চলেছে দারিদ্র্যতার কারনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা সে আপাতত বন্ধ রেখেছে। খবরের কাগজে দুয়েকটা কলাম লিখে বা বিদেশি ভাষার নিবন্ধ অনুবাদ করে বা টিউশনি করে কোনোরকমে জীবন ধারন করত। কিন্তু বেশ কিছুকাল হল সে তার প্রাত্যহিক কাজকর্ম একেবারে ছেড়ে দিয়েছে, কোনকিছুতেই উৎসাহ নেই তার। বাড়িউলির কাছে আপাদমস্তক ঋণে জর্জরিত। বিষণ্ণতায় ভুগছে, খিটখিটে হয়ে পড়েছে, উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, সকলের কাছ থেকে সে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। গ্রামে তার বৃদ্ধা বিধবা মা পুলখেরিয়া (পুলখেরিয়া আলেক্সান্দ্রভনা রাস্কোলনিকভা) একা থাকেন। একমাত্র সুন্দরী যুবতি বোন দুনিয়া (আভদোতিয়া রমানোভনা রাস্কোলনিকভা) জোতদার স্যভিদ্রিগাইলভের বাড়ীতে গভর্নেসের কাজ করতেন। জোতদারের হাতে উত্যক্তের শিকার হয়ে সে এখন মায়ের সঙ্গে বসবাস করছে। স্যভিদ্রিগাইলভের স্ত্রী মার্ফা পেত্রোভনার দূর সম্পর্কের আত্মীয় পিওতর পেত্রোভিচ লুজিনের সঙ্গে দুনিয়ার বিবাহের সম্বন্ধ পাকাপাকি হয়ে আছে। বিয়ে সম্পন্ন করার জন্য কিছুদিনের মধ্যেই তারা লুজিনের অনুগ্রহের উপর ভরসা করে স্থায়ী ভাবে পিটার্স বুর্গ চলে আসবেন। এদিকে ক্ষুধা, দারিদ্র্যতা, হতাশা, শতচ্ছিন্ন জামাকাপড়, ঘুপচি ঘরের অপ্রশস্ত দমবন্ধ করা পরিবেশ তাকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে তুলছিল। ইতোমধ্যে সে তার অবশিষ্ট ব্যাক্তিগত সম্পদের একটি সোনার আংটি নিতান্তই আর্থিক দৈন্যতায় পতিত হয়ে, কাছেই, সাত’শ ত্রিশ পা দূরের সেন্নায়া স্কোয়ার সংলগ্ন সাদোভায়া স্ট্রীটের এক বাড়ীর চারতলায় বসবাস করা আলিওনা ইভানোভনা নামের সুদখোর মহাজনী এক বুড়ির কাছে বন্ধক রেখে আসে।
পরবর্তীতে, মুলত, রাস্কোলনিকভের দ্বারা সমাজের অন্বিষ্টকারী ঊকুনরূপী এই সুদখোর মহাজনী বুড়ি আলিওনা ইভানোভনাকে হত্যা ও তার অর্থকড়ি লুট করার পরিকল্পনা এবং তা সঙ্ঘটনের মধ্য দিয়ে এই উপন্যাসের মহা যাত্রা শুরু হয়।
কিন্তু একজন বুদ্ধিজীবী চরিত্রের সংবেদনশীল হৃদয়ের যুবক কেন এই হত্যা ও লুণ্ঠনের মত মোটা দাগের অপরাধ সঙ্ঘটনের পথ গ্রহন করে? সেটা কি নিছকই তার দারিদ্র্যতা এবং তা থেকে মুক্তি লাভের জন্য? কিংবা তাঁর দ্বিধা-বিভক্ত চরিত্রের দুর্বলতার ত্রুটির কারনে? নাকি, রাস্কোলনিকভের বন্ধু রাজুমিখিনের মতে, অপরাধ সম্পর্কে সমাজতন্ত্রের যে সুপরিচিত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে- “অপরাধ হল সমাজব্যবস্থার অস্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিবাদ”, এইরূপ তত্বের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে?
না। বুড়ি আলিওনা ইভানোভনাকে খুন ও লুন্ঠন সম্পর্কে রাস্কোলনিকভের নিজস্ব যুক্তি ও পরিকল্পনা খুবই অকাট্য এবং অভ্রভেদী।
এই হত্যাকান্ড ও লুণ্ঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সে নেপোলিয়ন, সোলন, লাইকারগাস এবং মোহাম্মদের পথ অনুসরন করতে চেয়েছিল। নিজেকে মহত্তর করে তুলতে চেয়েছিল। রক্তপাতের মাধ্যমে তথাকথিত শান্তি বা সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষে মোহাম্মদ বা নেপোলিয়নেরা নিরীহ মানুষ খুন করার যে একচ্ছত্র অধিকার ইতিহাসের কাছ থেকে পেয়েছিল, রাস্কোলনিকভ এই হত্যার মাধ্যমে ইতিহাসের সেই পুনরাবৃত্তিটুকু দাবী করেছিল মাত্র! তাছাড়া সুদখোর বুড়ি আলিওনা ইভানোভনাতো সমাজের অন্বিষ্টকারি রক্তচোষা একটা নিকৃষ্ট ঊকুন। তাকে খুন করে তার অর্থকড়ি লুট করে হাজার তিনেক রুবল পাওয়া যেতে পারে। সেটা দিয়ে সাময়িক দারিদ্র্যতার অবসান ঘটিয়ে অসম্পন্ন পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব। তারপর অবশিষ্ট জীবনে ব্যাপক মানব কল্যানে নিজেকে নিয়োজিত করে অতিমানব রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করাই ছিল রাস্কোলনিকভের উদ্দেশ্য।
পাশের বাড়ির দারোয়ানের ঘর থেকে কুড়ুল নিয়ে সাত শ ত্রিশ পা দূরের সেন্নায়া স্কোয়ারের সেই বাড়িতে গিয়ে রাস্কোলনিকভ বুড়িটাকে খুন করে। বুড়িকে খুনের অব্যাবহিত পরেই সম্পূর্ণ বিপাকে পরে পরিস্থিতি থেকে পরিত্রানের জন্য কোনরূপ পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই সে আরেকটা খুন করে বসে। সুদখোর বুড়ির শান্তশিষ্ট, নিরীহ ও নিরপরাধ বোন লিজাভেতাকে। একসাথে দু’দুটো খুন!
কিন্তু এই মহাপরিকল্পনার প্রথম ধাপটি সম্পন্ন করার সাথে সাথেই রাস্কোলনিকভ পতিত হয় সীমাহীন অপরাধ-বোধ তাড়িত যন্ত্রনা ও আত্মগ্লানিতে। হত্যা-পরবর্তী মুহূর্তগুলোর দৃশ্যমান মানসিক ও পারিপার্শ্বিক সঙ্কট ও চ্যালেঞ্জ সে তার খুন-পূর্ব যুক্তির নিরিখে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়। বিভীষিকাময় এক নিদারুণ নিষ্ঠুর মানসিক পীড়ন ও স্বীকারোক্তি প্রদানের জন্য ভয়ংকর আত্মপীড়নে সে উন্মাদপ্রায় হয়ে পড়ে। খুন করে ঘরে ফেরার প্রথম মুহূর্তে তার মনে হয়েছিল বুঝি পাগল হয়ে যাবে সে। বোধশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ল তার। প্রচণ্ড জ্বরের সাথে শুরু হয়ে গেল চিন্তার অস্বাভাবিক অসংলগ্নতা ও বিকৃতি।
লেখকের ভাষায়, “তাহলে, সত্যিই কি তাহলে শুরু হয়ে গেল অপরাধের দণ্ড?”
অপরাধ ও তার অনুসন্ধানের জটিল, অভিনব ও মনস্তাত্বিক এই উপন্যাস। মানুষের দুর্জ্ঞেয় মনোজগৎ ও তার বিচিত্র অভিসন্ধির উন্মোচনের মাধ্যমে লেখক যে নাটকীয় ও উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করেন, তাতে উপন্যাসকে একসময় রহস্যকাহিনীর মত মনে হয়। কিন্তু দস্তয়েভস্কি যে মানবতার মহান শিল্পী! সেন্ট পিটার্স বুর্গ শহরের কেন্দ্রস্থলে মাত্র দেড় হাজার ফুটের মত জায়গার মধ্যে, মাত্র বিশ পঁচিশ মিনিটের পায়ে হাটার পথ, ইউসুপভ গার্ডেন, স্তালিয়ারনি লেন, মোইকা নদীর কামেনি ব্রীজ ও সেন্নায়া স্কোয়ারের মধ্যভাগের ভজনেসেন্সকি এভিনিউকে কেন্দ্র করে তিনি যেন এক মহা পৃথিবীর গল্প বর্ণনা করেন, যা উনিশ শতকের মধ্যভাগের সেন্ট পিটার্স বুর্গ শহরের সময়কাল ছাপিয়ে হয়ে ওঠে মহা বৈশ্বিক ও মহাকালের এক মহৎ মানবিক আখ্যান।
শুঁড়িখানায় পরিচয় হওয়া ভূতপূর্ব সরকারি কেরানি অসুস্থ ও মাতাল মার্মেলাদভকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়ে রাস্কোলনিকভ আটকা পড়ে যায় জীবনের মায়ায়। হত দরিদ্র্য ও নিঃস্ব এক পরিবারের কর্মহীন, ব্যর্থ ও মাতাল এক গৃহস্বামী মার্মেলাদভ। ঘরে তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কাতেরিনা ইভানোভনা ও তিনটি শিশু সন্তান। অন্তহীন অভাব আর দারিদ্র্যতার সঙ্গে লড়াই করতে করতে ক্ষয় রোগে ভুগে কাতেরিনার মস্তিষ্কে বিকৃতি ধরেছে। প্রথম পক্ষের একমাত্র কন্যা ষোল বছরের সোনিয়া। নিষ্পাপ, ভীতচকিত, স্নিগ্ধ অথচ রাশভারি ভাব গাম্ভীর্যের অধিকারি এই কিশোরী। এই এতটুকু বয়সে সংসারের হাল ধরতে বেশ্যাবৃত্তিকে বেছে নিতে হয়েছে তাকে। ছোট ছোট নিরন্ন ভাই বোন ও অসুস্থ সৎ মায়ের অন্নের সংস্থান আর কখনো কখনো মাতাল পিতার মদের পয়সার যোগান দিত হয় তাকে।
অসুস্থ ও মাতাল মার্মেলাদভ রাস্কোলনিকভের সাহায্যে বাড়ি ফিরতে ফিরতে কন্যার জন্য কাতর হয়ে ঈশ্বরের সহৃদয়তা কামনা করে বলতে থাকেন-
“ আমাদের করুণা করবেন তিনি, যিনি সকলকে করুণা করে থাকেন। সব বুঝতে পারেন। একমাত্র তিনি, তিনিই বিচারক। সে দিন তিনি আবির্ভূত হয়ে শুধোবেনঃ ‘কোথায় রহিয়াছে সেই কন্যা যে তাহার ক্রোধান্ধ ও ক্ষয়রোগগ্রস্ত বিমাতার নিমিত্ত, অপরের শিশু সন্তানদিগের নিমিত্ত আত্মোৎসর্গ করিয়াছে?’ তিনি বলবেন, ‘আমার সন্নিকটে আইস। আমি ইতোমধ্যে তোমায় একবার মার্জনা করিয়াছি। একবার ক্ষমা করিয়াছি- এবং তোমার কৃত পাপসকলও এইক্ষনে মার্জনা করা হইল, যেহেতু তোমার হৃদয় অগাধ প্রেমে পরিপূর্ণ’! তাই আমার সোনিয়াকে তিনি ক্ষমা করবেন। আমি ঠিক জানি যে ক্ষমা করবেন”।
রাস্কোলনিকভের হৃদয়ে তৈরি হয় সোনিয়ার প্রতি প্রেম। ভালবাসার শাশ্বত অনুভব। পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণের আগে একমাত্র সোনিয়ার কাছেই সে খুনের স্বীকারোক্তি দিয়েছিল। তার নিয়তি আর ভবিতব্যের সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিল সোনিয়া। রাস্কোলনিকভের আত্মার মুক্তি, নৈতিক শুদ্ধতা ও পুনর্জন্মের প্রতীক হয়ে উঠেছিল সে। সাজা হয়ে যাবার পরও পাঁচ হাজার মাইল দূরের সাইবেরিয়ার কারাগার পর্যন্ত সোনিয়া তাকে পিছু পিছু অনুসরন করে যায়। আট বছরের কারাদণ্ড থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত সোনিয়া সাইবেরিয়াতে ছিল এবং নিয়মিত রাস্কোলনিকভের দেখা সাক্ষাৎ ও খোঁজ খবর রাখত।
এই উপন্যাসের অন্যতম শক্তিশালী চরিত্র মার্মেলাদভের দ্বিতীয় স্ত্রী কাতেরিনা ইভানোভনা। একই সঙ্গে আশা হতাশা ও দারিদ্র্যতার মূর্ত প্রতীক। দারিদ্র্যতা, অপমান ও বঞ্চনার বিপরীতে মিথ্যে আশা নিয়ে বেঁচে থাকা আর অহংকারই ছিল তার একমাত্র সম্বল। সে আশা করতে এবং স্বপ্ন দেখতে ভালবাসত। মানুষের কাছে সহৃদয়তা কামনা করত। কিন্তু সেটা কখনোই সে পায়নি। এমনকি মৃত্যুর সময়ও সে পায়নি। মার্মেলাদভের মৃত্যুর পর কাতেরিনা মৃত স্বামির আত্মার সদ্গতির জন্য অন্ত্যেষ্টি ভোজের আয়োজন করে। প্রতিবেশিদের নিমন্ত্রন করে। কিন্তু ভোজের টেবিলে সোনিয়াকে চোর সাব্যস্ত করে রাস্কোলনিকভের বোন দুনিয়ার পাণিপ্রার্থী লুজিনের কুটচক্রান্ত, প্রতিবেশিদের তাচ্ছিল্য আর কাতেরিনার মস্তিষ্কের বিকৃতির কারনে অন্ত্যেষ্টি ভোজ সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বাড়িউলি আমালিয়া ইভানোভনার সাথে ঝগড়া চরম আকার ধারন করে। কাতেরিনাকে বাচ্চাকাচ্চা সমেত ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়। আসবাব পত্র গৃহস্থালি সব ভেঙ্গে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। কাতেরিনা বিলাপ করতে করতে সন্তানদের নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়- “ হে প্রভু, আমাদের মত অনাথদেরই যদি তুমি রক্ষা করতে না পার তাহলে আর কাকে রক্ষা করবে তুমি? কিন্তু না, আমিও দেখব। পৃথিবিতে ন্যায়বিচার বলে বস্তু আছে, সত্য আছে, আছে! আমি তাই খুঁজে বের করব”। কাতেরিনা উন্মাদ হয়ে যায়। পিটার্স বুর্গের রাস্তায় নেচে নেচে গান গেয়ে ভিখ মাগতে থাকে। সন্তান গুলোকে নেচে গেয়ে ভিক্ষে করার গান শিখায়। ক্ষয়রোগের প্রকোপে অসুস্থ হয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। মুখ দিয়ে রক্ত নির্গত হতে থাকে। অবশেষে সোনিয়ার ঘরে তার মৃত্যু হয়। বেদনাদায়ক মৃত্যু! তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেন মানবতারই পতন হল।
দীর্ঘ কলেবর ছাড়া এই উপন্যাসের সকল চরিত্র ও ঘটনা প্রবাহ নিয়ে আলোকপাত করা সম্ভব নয়। তাছাড়া এই উপন্যাস নিয়ে এযাবৎ এত বেশি লেখা হয়েছে যে নতুন করে লেখার আর কিছু নেই। যদিও এই সংক্ষিপ্ত পাঠানুভুতি লিখতে বসে নতুন কিছু লেখার সেরকম সম্ভাবনাকে নাকচ করা হচ্ছে, তদুপরি একথা বলতেই হয় যে, এই উপন্যাসে এত নিখুঁত ভাবে চরিত্রগুলোর চিত্র, ব্যাক্তিত্ব ও শারীরিক গঠন-কাঠামো এবং মনোজগতের বর্ণনা করা হয়েছে যে, যে কোন দক্ষ চিত্রকর তার তুলির আঁচড়ে প্রত্যেকটা চরিত্রের রূপ সুচারু ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন।
সাহিত্যের পাঠকের আগ্রহের সব কিছুই রয়েছে এই উপন্যাসের মধ্যে। একটা নগরকে কেন্দ্র করে সময়ের চিত্র, রাস্তার পাশে সস্তার হোটেল, মদের দোকান, বেশ্যা ও বাবুদের ঢলাঢলি, মাতালদের রগড়, কোচোয়ানদের চিৎকার হল্লা, পার্কে বেশ্যাদের খদ্দের খুঁজে বেড়ানো, পুলিশের ছেনালিপনা, সুখ, দুঃখ, ঘৃণা, প্রেম, ভালবাসা, হতাশা, উত্তেজনা, মৃত্যু, আত্মহত্যা, খুন, অপরাধ, শাস্তি ও প্রায়শ্চিত্ত সব, সব আছে- বিশ্ব সাহিত্যের সর্বকালের অন্যতম সেরা সাহিত্যিক কীর্তি এই উপন্যাসে।
০১.১১.২০১৬
“ওটা আমার কাজ। আমিই খুন করেছিলাম কুড়ুল দিয়ে ওই সুদখোর বুড়ি আর তার বোন লিজাভেতাকে। আমিই লুট করেছিলাম ওদের জিনিস।”
এই রক্ত হিম করা স্বীকারোক্তির মাধ্যমে ঘটে এক দীর্ঘ ও যন্ত্রনাদায়ক অপরাধ-বোধ এবং নির্মম আত্মপীড়নের অবসান। সেই সাথে ঘটে বিশ্ব সাহিত্যের অমর এক মহৎ কীর্তির যবনিকা। যদিও এই আত্ম-স্বীকৃতির শেষে নাতিদীর্ঘ এক উপসংহারের মাধ্যমে সূচিত হয় আরেক নতুন জীবনের পটভুমি। “নব জীবনের পথে একজন মানুষের ক্রমবিকাশের কাহিনী, এক জগত থেকে আরেক জগতে, নবজন্মে তার ধারাবাহিক উত্তরনের কথা”।
রুশ থেকে অরুন সোমের বাংলা অনুবাদে ছয়শ উনিশ পৃষ্ঠার এই উপন্যাস পাঠে একটুও ক্লান্তি আসেনা! কোথাও একবারের জন্যও মনে হয় না যে থেমে যাই। লাইনের পর লাইন পাঠ করে যেতে যেতে মনে হতে থাকে, হায়, এই মহাগ্রন্থ পাঠের আগে কতইনা দরিদ্র ছিলাম! পাঠের ভেতর দিয়ে যেন আমার পুনর্জন্ম ঘটে চলেছে। একটার পর একটা পৃষ্ঠায় উন্মোচিত হতে থাকে মানব জীবনের অন্তর্গত গোপন গহীন সব বিস্ময়। যেন কল্পনাকে ভেঙ্গে চুড়ে গুড়িয়ে দেওয়া ঐশ্বরিক বর্ণনা বিবৃত হতে থাকে মানব জাতির এক মহান লিপিকারের কন্ঠে; আর চেনাজানা পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের অতিপরিচিত বোধ অত্যন্ত বিপন্ন হতে থাকে। এই মহা উপন্যাসে দস্তয়েভস্কি সেই তালাবদ্ধ পৃথিবীর ঢাকনা আমাদের সম্মুখে উন্মোচন করেন, যেই পৃথিবীর খোঁজ পারতপক্ষে আমরা রাখি না। মানব জীবনের সেইসব দগদগে ক্ষত এক নিঃস্পৃহ ঔদাস্যে তিনি আমাদেরকে বের করে দেখান, যেসব ক্ষত আমরা ঢেকে রাখতে বদ্ধ পরিকর। নিদারুণ দারিদ্র্যতা, দুঃখ, কষ্ট ও বেদনার অভিঘাতে মানুষের বিকৃতি ও পতন, অপরাধ ও গ্লানিবোধ, নিষ্ঠুর মানসিক পীড়ন, হিংসা ও কদর্যতা, ঘৃণা ও ভালবাসা, এবং সর্বোপরি, যথার্থই, ঈশ্বরের বিরুদ্ধে মানুষের চিরন্তন বিদ্রোহের এক মহা নাটক এই উপন্যাস।
খুব সম্ভবত দস্তয়েভস্কি তার যুবক বয়সে লেখা ‘সাদারাত’ উপন্যাসে এই পৃথিবীরই ইঙ্গিত করেছিলেন-
“এই সেন্ট পিটার্সবুর্গ শহরে কিছু অদ্ভুত জায়গা আছে। যে সূর্য এই নগরীর অবশিষ্ট সবখানে কিরণ ছড়ায় তা ওইসব অদ্ভুত জায়গাগুলিতে ভুলেও উঁকি মারে না। তবে অন্য একটা সূর্য, একটা নতুন সূর্য আছে সেই দূরবর্তী কোণগুলির জন্য, সেই সূর্য একটু ভিন্ন রকম, একটা অদ্ভুত আলো ফেলে সবকিছুর ওপর। সেই দূরবর্তী কোণগুলিতে জীবন অন্যরকম, মনে হয় এক যোজন দূরের জীবন, আমাদের চারপাশের জীবনের সঙ্গে তা কোনোভাবেই মেলে না”।
উনিশ শতকের ষাটের দশক। জার আমলের রাশিয়ার সেন্ট পিটার্স বুর্গ শহর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র, তেইশ বছরের প্রতিশ্রুতিশীল বুদ্ধিজীবী ও দ্বিধা-বিভক্ত চরিত্রের অধিকারি সংবেদনশীল হৃদয়ের যুবক রাস্কোলনিকভ। রুশ সমাজের নির্যাতিত ও দলিত মানুষের জন্য যার হৃদয় ভালবাসায় পরিপূর্ণ। ভজনেসেন্সকি এভিনিউ এর স্তালিয়ারনি লেনের পাঁচতলা দালানের খুপরি মত এক চিলেকোঠায় সে বাস করে। লেখকের মতে সেটাকে খুপরি না বলে কুলুঙ্গি বলাই ভাল। মাস ছয়েক হতে চলেছে দারিদ্র্যতার কারনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা সে আপাতত বন্ধ রেখেছে। খবরের কাগজে দুয়েকটা কলাম লিখে বা বিদেশি ভাষার নিবন্ধ অনুবাদ করে বা টিউশনি করে কোনোরকমে জীবন ধারন করত। কিন্তু বেশ কিছুকাল হল সে তার প্রাত্যহিক কাজকর্ম একেবারে ছেড়ে দিয়েছে, কোনকিছুতেই উৎসাহ নেই তার। বাড়িউলির কাছে আপাদমস্তক ঋণে জর্জরিত। বিষণ্ণতায় ভুগছে, খিটখিটে হয়ে পড়েছে, উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, সকলের কাছ থেকে সে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। গ্রামে তার বৃদ্ধা বিধবা মা পুলখেরিয়া (পুলখেরিয়া আলেক্সান্দ্রভনা রাস্কোলনিকভা) একা থাকেন। একমাত্র সুন্দরী যুবতি বোন দুনিয়া (আভদোতিয়া রমানোভনা রাস্কোলনিকভা) জোতদার স্যভিদ্রিগাইলভের বাড়ীতে গভর্নেসের কাজ করতেন। জোতদারের হাতে উত্যক্তের শিকার হয়ে সে এখন মায়ের সঙ্গে বসবাস করছে। স্যভিদ্রিগাইলভের স্ত্রী মার্ফা পেত্রোভনার দূর সম্পর্কের আত্মীয় পিওতর পেত্রোভিচ লুজিনের সঙ্গে দুনিয়ার বিবাহের সম্বন্ধ পাকাপাকি হয়ে আছে। বিয়ে সম্পন্ন করার জন্য কিছুদিনের মধ্যেই তারা লুজিনের অনুগ্রহের উপর ভরসা করে স্থায়ী ভাবে পিটার্স বুর্গ চলে আসবেন। এদিকে ক্ষুধা, দারিদ্র্যতা, হতাশা, শতচ্ছিন্ন জামাকাপড়, ঘুপচি ঘরের অপ্রশস্ত দমবন্ধ করা পরিবেশ তাকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে তুলছিল। ইতোমধ্যে সে তার অবশিষ্ট ব্যাক্তিগত সম্পদের একটি সোনার আংটি নিতান্তই আর্থিক দৈন্যতায় পতিত হয়ে, কাছেই, সাত’শ ত্রিশ পা দূরের সেন্নায়া স্কোয়ার সংলগ্ন সাদোভায়া স্ট্রীটের এক বাড়ীর চারতলায় বসবাস করা আলিওনা ইভানোভনা নামের সুদখোর মহাজনী এক বুড়ির কাছে বন্ধক রেখে আসে।
পরবর্তীতে, মুলত, রাস্কোলনিকভের দ্বারা সমাজের অন্বিষ্টকারী ঊকুনরূপী এই সুদখোর মহাজনী বুড়ি আলিওনা ইভানোভনাকে হত্যা ও তার অর্থকড়ি লুট করার পরিকল্পনা এবং তা সঙ্ঘটনের মধ্য দিয়ে এই উপন্যাসের মহা যাত্রা শুরু হয়।
কিন্তু একজন বুদ্ধিজীবী চরিত্রের সংবেদনশীল হৃদয়ের যুবক কেন এই হত্যা ও লুণ্ঠনের মত মোটা দাগের অপরাধ সঙ্ঘটনের পথ গ্রহন করে? সেটা কি নিছকই তার দারিদ্র্যতা এবং তা থেকে মুক্তি লাভের জন্য? কিংবা তাঁর দ্বিধা-বিভক্ত চরিত্রের দুর্বলতার ত্রুটির কারনে? নাকি, রাস্কোলনিকভের বন্ধু রাজুমিখিনের মতে, অপরাধ সম্পর্কে সমাজতন্ত্রের যে সুপরিচিত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে- “অপরাধ হল সমাজব্যবস্থার অস্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিবাদ”, এইরূপ তত্বের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে?
না। বুড়ি আলিওনা ইভানোভনাকে খুন ও লুন্ঠন সম্পর্কে রাস্কোলনিকভের নিজস্ব যুক্তি ও পরিকল্পনা খুবই অকাট্য এবং অভ্রভেদী।
এই হত্যাকান্ড ও লুণ্ঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সে নেপোলিয়ন, সোলন, লাইকারগাস এবং মোহাম্মদের পথ অনুসরন করতে চেয়েছিল। নিজেকে মহত্তর করে তুলতে চেয়েছিল। রক্তপাতের মাধ্যমে তথাকথিত শান্তি বা সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষে মোহাম্মদ বা নেপোলিয়নেরা নিরীহ মানুষ খুন করার যে একচ্ছত্র অধিকার ইতিহাসের কাছ থেকে পেয়েছিল, রাস্কোলনিকভ এই হত্যার মাধ্যমে ইতিহাসের সেই পুনরাবৃত্তিটুকু দাবী করেছিল মাত্র! তাছাড়া সুদখোর বুড়ি আলিওনা ইভানোভনাতো সমাজের অন্বিষ্টকারি রক্তচোষা একটা নিকৃষ্ট ঊকুন। তাকে খুন করে তার অর্থকড়ি লুট করে হাজার তিনেক রুবল পাওয়া যেতে পারে। সেটা দিয়ে সাময়িক দারিদ্র্যতার অবসান ঘটিয়ে অসম্পন্ন পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব। তারপর অবশিষ্ট জীবনে ব্যাপক মানব কল্যানে নিজেকে নিয়োজিত করে অতিমানব রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করাই ছিল রাস্কোলনিকভের উদ্দেশ্য।
পাশের বাড়ির দারোয়ানের ঘর থেকে কুড়ুল নিয়ে সাত শ ত্রিশ পা দূরের সেন্নায়া স্কোয়ারের সেই বাড়িতে গিয়ে রাস্কোলনিকভ বুড়িটাকে খুন করে। বুড়িকে খুনের অব্যাবহিত পরেই সম্পূর্ণ বিপাকে পরে পরিস্থিতি থেকে পরিত্রানের জন্য কোনরূপ পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই সে আরেকটা খুন করে বসে। সুদখোর বুড়ির শান্তশিষ্ট, নিরীহ ও নিরপরাধ বোন লিজাভেতাকে। একসাথে দু’দুটো খুন!
কিন্তু এই মহাপরিকল্পনার প্রথম ধাপটি সম্পন্ন করার সাথে সাথেই রাস্কোলনিকভ পতিত হয় সীমাহীন অপরাধ-বোধ তাড়িত যন্ত্রনা ও আত্মগ্লানিতে। হত্যা-পরবর্তী মুহূর্তগুলোর দৃশ্যমান মানসিক ও পারিপার্শ্বিক সঙ্কট ও চ্যালেঞ্জ সে তার খুন-পূর্ব যুক্তির নিরিখে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়। বিভীষিকাময় এক নিদারুণ নিষ্ঠুর মানসিক পীড়ন ও স্বীকারোক্তি প্রদানের জন্য ভয়ংকর আত্মপীড়নে সে উন্মাদপ্রায় হয়ে পড়ে। খুন করে ঘরে ফেরার প্রথম মুহূর্তে তার মনে হয়েছিল বুঝি পাগল হয়ে যাবে সে। বোধশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ল তার। প্রচণ্ড জ্বরের সাথে শুরু হয়ে গেল চিন্তার অস্বাভাবিক অসংলগ্নতা ও বিকৃতি।
লেখকের ভাষায়, “তাহলে, সত্যিই কি তাহলে শুরু হয়ে গেল অপরাধের দণ্ড?”
অপরাধ ও তার অনুসন্ধানের জটিল, অভিনব ও মনস্তাত্বিক এই উপন্যাস। মানুষের দুর্জ্ঞেয় মনোজগৎ ও তার বিচিত্র অভিসন্ধির উন্মোচনের মাধ্যমে লেখক যে নাটকীয় ও উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করেন, তাতে উপন্যাসকে একসময় রহস্যকাহিনীর মত মনে হয়। কিন্তু দস্তয়েভস্কি যে মানবতার মহান শিল্পী! সেন্ট পিটার্স বুর্গ শহরের কেন্দ্রস্থলে মাত্র দেড় হাজার ফুটের মত জায়গার মধ্যে, মাত্র বিশ পঁচিশ মিনিটের পায়ে হাটার পথ, ইউসুপভ গার্ডেন, স্তালিয়ারনি লেন, মোইকা নদীর কামেনি ব্রীজ ও সেন্নায়া স্কোয়ারের মধ্যভাগের ভজনেসেন্সকি এভিনিউকে কেন্দ্র করে তিনি যেন এক মহা পৃথিবীর গল্প বর্ণনা করেন, যা উনিশ শতকের মধ্যভাগের সেন্ট পিটার্স বুর্গ শহরের সময়কাল ছাপিয়ে হয়ে ওঠে মহা বৈশ্বিক ও মহাকালের এক মহৎ মানবিক আখ্যান।
শুঁড়িখানায় পরিচয় হওয়া ভূতপূর্ব সরকারি কেরানি অসুস্থ ও মাতাল মার্মেলাদভকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়ে রাস্কোলনিকভ আটকা পড়ে যায় জীবনের মায়ায়। হত দরিদ্র্য ও নিঃস্ব এক পরিবারের কর্মহীন, ব্যর্থ ও মাতাল এক গৃহস্বামী মার্মেলাদভ। ঘরে তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কাতেরিনা ইভানোভনা ও তিনটি শিশু সন্তান। অন্তহীন অভাব আর দারিদ্র্যতার সঙ্গে লড়াই করতে করতে ক্ষয় রোগে ভুগে কাতেরিনার মস্তিষ্কে বিকৃতি ধরেছে। প্রথম পক্ষের একমাত্র কন্যা ষোল বছরের সোনিয়া। নিষ্পাপ, ভীতচকিত, স্নিগ্ধ অথচ রাশভারি ভাব গাম্ভীর্যের অধিকারি এই কিশোরী। এই এতটুকু বয়সে সংসারের হাল ধরতে বেশ্যাবৃত্তিকে বেছে নিতে হয়েছে তাকে। ছোট ছোট নিরন্ন ভাই বোন ও অসুস্থ সৎ মায়ের অন্নের সংস্থান আর কখনো কখনো মাতাল পিতার মদের পয়সার যোগান দিত হয় তাকে।
অসুস্থ ও মাতাল মার্মেলাদভ রাস্কোলনিকভের সাহায্যে বাড়ি ফিরতে ফিরতে কন্যার জন্য কাতর হয়ে ঈশ্বরের সহৃদয়তা কামনা করে বলতে থাকেন-
“ আমাদের করুণা করবেন তিনি, যিনি সকলকে করুণা করে থাকেন। সব বুঝতে পারেন। একমাত্র তিনি, তিনিই বিচারক। সে দিন তিনি আবির্ভূত হয়ে শুধোবেনঃ ‘কোথায় রহিয়াছে সেই কন্যা যে তাহার ক্রোধান্ধ ও ক্ষয়রোগগ্রস্ত বিমাতার নিমিত্ত, অপরের শিশু সন্তানদিগের নিমিত্ত আত্মোৎসর্গ করিয়াছে?’ তিনি বলবেন, ‘আমার সন্নিকটে আইস। আমি ইতোমধ্যে তোমায় একবার মার্জনা করিয়াছি। একবার ক্ষমা করিয়াছি- এবং তোমার কৃত পাপসকলও এইক্ষনে মার্জনা করা হইল, যেহেতু তোমার হৃদয় অগাধ প্রেমে পরিপূর্ণ’! তাই আমার সোনিয়াকে তিনি ক্ষমা করবেন। আমি ঠিক জানি যে ক্ষমা করবেন”।
রাস্কোলনিকভের হৃদয়ে তৈরি হয় সোনিয়ার প্রতি প্রেম। ভালবাসার শাশ্বত অনুভব। পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণের আগে একমাত্র সোনিয়ার কাছেই সে খুনের স্বীকারোক্তি দিয়েছিল। তার নিয়তি আর ভবিতব্যের সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিল সোনিয়া। রাস্কোলনিকভের আত্মার মুক্তি, নৈতিক শুদ্ধতা ও পুনর্জন্মের প্রতীক হয়ে উঠেছিল সে। সাজা হয়ে যাবার পরও পাঁচ হাজার মাইল দূরের সাইবেরিয়ার কারাগার পর্যন্ত সোনিয়া তাকে পিছু পিছু অনুসরন করে যায়। আট বছরের কারাদণ্ড থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত সোনিয়া সাইবেরিয়াতে ছিল এবং নিয়মিত রাস্কোলনিকভের দেখা সাক্ষাৎ ও খোঁজ খবর রাখত।
এই উপন্যাসের অন্যতম শক্তিশালী চরিত্র মার্মেলাদভের দ্বিতীয় স্ত্রী কাতেরিনা ইভানোভনা। একই সঙ্গে আশা হতাশা ও দারিদ্র্যতার মূর্ত প্রতীক। দারিদ্র্যতা, অপমান ও বঞ্চনার বিপরীতে মিথ্যে আশা নিয়ে বেঁচে থাকা আর অহংকারই ছিল তার একমাত্র সম্বল। সে আশা করতে এবং স্বপ্ন দেখতে ভালবাসত। মানুষের কাছে সহৃদয়তা কামনা করত। কিন্তু সেটা কখনোই সে পায়নি। এমনকি মৃত্যুর সময়ও সে পায়নি। মার্মেলাদভের মৃত্যুর পর কাতেরিনা মৃত স্বামির আত্মার সদ্গতির জন্য অন্ত্যেষ্টি ভোজের আয়োজন করে। প্রতিবেশিদের নিমন্ত্রন করে। কিন্তু ভোজের টেবিলে সোনিয়াকে চোর সাব্যস্ত করে রাস্কোলনিকভের বোন দুনিয়ার পাণিপ্রার্থী লুজিনের কুটচক্রান্ত, প্রতিবেশিদের তাচ্ছিল্য আর কাতেরিনার মস্তিষ্কের বিকৃতির কারনে অন্ত্যেষ্টি ভোজ সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বাড়িউলি আমালিয়া ইভানোভনার সাথে ঝগড়া চরম আকার ধারন করে। কাতেরিনাকে বাচ্চাকাচ্চা সমেত ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়। আসবাব পত্র গৃহস্থালি সব ভেঙ্গে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। কাতেরিনা বিলাপ করতে করতে সন্তানদের নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়- “ হে প্রভু, আমাদের মত অনাথদেরই যদি তুমি রক্ষা করতে না পার তাহলে আর কাকে রক্ষা করবে তুমি? কিন্তু না, আমিও দেখব। পৃথিবিতে ন্যায়বিচার বলে বস্তু আছে, সত্য আছে, আছে! আমি তাই খুঁজে বের করব”। কাতেরিনা উন্মাদ হয়ে যায়। পিটার্স বুর্গের রাস্তায় নেচে নেচে গান গেয়ে ভিখ মাগতে থাকে। সন্তান গুলোকে নেচে গেয়ে ভিক্ষে করার গান শিখায়। ক্ষয়রোগের প্রকোপে অসুস্থ হয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। মুখ দিয়ে রক্ত নির্গত হতে থাকে। অবশেষে সোনিয়ার ঘরে তার মৃত্যু হয়। বেদনাদায়ক মৃত্যু! তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেন মানবতারই পতন হল।
দীর্ঘ কলেবর ছাড়া এই উপন্যাসের সকল চরিত্র ও ঘটনা প্রবাহ নিয়ে আলোকপাত করা সম্ভব নয়। তাছাড়া এই উপন্যাস নিয়ে এযাবৎ এত বেশি লেখা হয়েছে যে নতুন করে লেখার আর কিছু নেই। যদিও এই সংক্ষিপ্ত পাঠানুভুতি লিখতে বসে নতুন কিছু লেখার সেরকম সম্ভাবনাকে নাকচ করা হচ্ছে, তদুপরি একথা বলতেই হয় যে, এই উপন্যাসে এত নিখুঁত ভাবে চরিত্রগুলোর চিত্র, ব্যাক্তিত্ব ও শারীরিক গঠন-কাঠামো এবং মনোজগতের বর্ণনা করা হয়েছে যে, যে কোন দক্ষ চিত্রকর তার তুলির আঁচড়ে প্রত্যেকটা চরিত্রের রূপ সুচারু ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন।
সাহিত্যের পাঠকের আগ্রহের সব কিছুই রয়েছে এই উপন্যাসের মধ্যে। একটা নগরকে কেন্দ্র করে সময়ের চিত্র, রাস্তার পাশে সস্তার হোটেল, মদের দোকান, বেশ্যা ও বাবুদের ঢলাঢলি, মাতালদের রগড়, কোচোয়ানদের চিৎকার হল্লা, পার্কে বেশ্যাদের খদ্দের খুঁজে বেড়ানো, পুলিশের ছেনালিপনা, সুখ, দুঃখ, ঘৃণা, প্রেম, ভালবাসা, হতাশা, উত্তেজনা, মৃত্যু, আত্মহত্যা, খুন, অপরাধ, শাস্তি ও প্রায়শ্চিত্ত সব, সব আছে- বিশ্ব সাহিত্যের সর্বকালের অন্যতম সেরা সাহিত্যিক কীর্তি এই উপন্যাসে।
০১.১১.২০১৬
0 মন্তব্যসমূহ