হুমায়ূন আহমেদের শীত গল্পটি নিয়ে হরিশঙ্কর জলদাসের আলোচনা


‘শীত’ গল্পটিও মতি মিয়া আর ফুলজান নামের দুটি সর্বস্বান্ত চরিত্রের আর্তনাদের চালচিত্র যেন।

যুদ্ধ লাগল একদিন, স্বাধীনতার যুদ্ধ। কোটি হাত একহাত হয়ে আওয়াজ তুলল—এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শহুরে-গ্রাম্যনির্বিশেষে বাংলার মানুষ ওই বাঁচার মন্ত্রে উদ্বোধিত হলো। কোথায় নীলগঞ্জ গাঁ, নিভৃত-নিস্তরঙ্গ সেই গাঁয়েও স্বাধীনতার ঢেউ এসে লাগল। জেগে উঠল নীলগঞ্জ, সাধারণ প্রান্তজন যে মেছের আলি, সে-ও অস্ত্র তুলে নিল হাতে।
বলে উঠল—আমার রক্তের সরোবরে বিম্বিত হোক মৃত্যুর ছায়া। কোনো পরোয়া নেই। আমার অস্তিত্বের দাবি নিয়ে আমি একাত্তরের পাদদেশে সমবেত হয়েছি। আমি মুক্তির জন্য যুদ্ধ করব। এতে প্রাণ যদি যায় যাক।

মেছের আলি যুদ্ধ করেছে, শহীদ হয়েছে। স্বাধীনতা এসেছে। কিন্তু স্বাধীনতার ফসল এই আত্মত্যাগী মেছের আলিদের গোলায় উঠল না। সব কর্তৃত্ব চলে গেল সুবিধাভোগী কলমবাজদের হাতে। মেছের আলিরা যে একেবারে বঞ্চিত হয়েছে এমন নয়, এবড়োখেবড়ো রাস্তার মোড়ে একটি-দুটি ফলক পেয়েছে। মেছের আলিও ভাগ্যবান। নীলগঞ্জের একটি সড়কের নাম দেওয়া হয়েছে—‘শহীদ মেছের আলি সড়ক।’

শুধু ওইটুকুই প্রাপ্য মেছের আলির পরিবারের? মেছের আলি ছিল পরিবারের একমাত্র আয়-সক্ষম ব্যক্তি। যুদ্ধমন্ত্রে বলীয়ান হয়ে দেশের জন্য সে প্রাণ দিল। বিনিময়ে তার পরিবার পেল দরিদ্রতা। তার পরিবারের দুবেলা খাবার থাকল না, শীত নিবারণের উষ্ণ পোশাক থাকল না। থাকল না পারিবারিক ইজ্জতও। মেছের আলির স্ত্রী ফুলজানকে হতে হলো দারোগাবাড়ির কাজের মেয়ে। এখন মেছের আলির বাপ মতি মিয়া যখন খিদায় পাগলপ্রায়, তখন এক বাটি তো দূরের কথা, একদানা মুড়িও পায় না।

বৃদ্ধ মতি মিয়ার নাতি ফরিদ তার চারদিকে ঘুরে ঘুরে মুড়ি খায়। মতি মিয়া মুড়ির জন্য লোভাতুর হয়ে ওঠে। এই সময়ের চিত্র আঁকতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন—

“ফুলজান ফরিদকে টিনের থালায় মুড়ি দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। এটা একটা ভালো লক্ষণ। এর মানে হচ্ছে ঘরে পান্তা নেই। যেদিন পান্তা থাকে না সেদিন দুপুরে ফরিদের মা গরম ভাতের ব্যবস্থা করে। আজও করবে। দুই-একগাল মুড়ি খেলে হতো। ফরিদ থালা নিয়ে ঘুরছে দূরে দূরে। মুড়ি শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাছে ভিড়বে না। মতি মিয়া ডাকল, ‘ওই ফরিদ, ওই। এদিকে আয় দাদা।’ ফরিদ না শোনার ভান করল। মহা বজ্জাত হয়েছে ছোকরা।”

খিদার আতঙ্ককে কোনো রকমে নিজের মধ্যে দাবিয়ে রাখলেও শৈত্যের অত্যাচার এড়াতে পারে না মতি মিয়া। একে তো বার্ধক্য-জর্জরিত শরীর, তার ওপর মাঘের শীতের কামড়। কথায় বলে—মাঘের শীতে বাঘ ডোঁরে। ডোঁরে মানে হাহাকারময় আর্তনাদ। বাঘের নাকি এক সের বল। সেই এক সেরের মহাবলীও শীতের কাছে কুপোকাত। মতি মিয়া তো সাধারণ একজন জরাগ্রস্ত দেহের মানুষ। মাঘ-শীতের হাতে সে খাবি খায়। হুমায়ূন আহমেদ এই ‘শীত’ গল্পটি যখন লিখেছেন, তখন তাঁর শিরায় শিরায় উষ্ণ উন্মাতাল রক্তের প্রস্রবণ। ওই সময় বার্ধক্যের শরীর-যন্ত্রণার ব্যাপারটি তাঁর তেমন করে বোঝার কথা নয়। কিন্তু তিনি তো জাত শিল্পী। জাত শিল্পীরা জানেন নানা বয়সী শরীরের সুলুকসন্ধান। একজন তরুণ বা তরুণীর চারদিকের বসন্ত বাতাসের সংবাদ যেমন তিনি রাখেন, তেমনি মধ্য বয়সের শরীর-যন্ত্রণার কথাও তাঁর অজানা নয়। আর জীর্ণতাকবলিত মানবদেহের সন্ধান তাঁর জানা না থাকলে মতি মিয়ার শীতাক্রান্ত অবস্থা তিনি তেমন করে লিখতে পারতেন না। পুরু লেন্সের চশমা পরা এই মানুষটির দেখার চোখ ছিল অত্যন্ত তীক্ষ।ব্যক্তিজীবনে তিনি ইনট্রোভার্ট মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাঁর দৃষ্টি ছিল গাঢ় ও মর্মভেদী। তাই মতি মিয়ার শীতজীবনের কথা লিখতে গিয়ে বাংলাদেশের বার্ধক্য-নিপীড়িত সাধারণ বুড়োদেরই কথা লেখেন হুমায়ূন আহমেদ।

‘শীত’ গল্পটি শুরু হয় মতি মিয়াকে দিয়ে। শীতরাতের বর্ণনায় হুমায়ূন লেখেন—

‘মাঝরাতে মতি মিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। বুকে একটা চাপা ব্যথা। দম বন্ধ হয়ে আসছে। শ্বাসের কষ্টটা শুরু হলো বোধ হয়। সে কাঁথার ভেতর থেকে মাথা বের করল। কী অসম্ভব ঠাণ্ডা। বুড়োমারা শীত পড়েছে। দরমার বেড়ার ফাঁক দিয়ে বরফ-শীতল হাওয়া আসছে। হাত-পায়ে কোনো সাড় নেই।’

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মেছের আলির বাপ মতি মিয়া ওমের জন্য হাহাকার করে। তার বিবেচনায় ওম শুধু লেপের তলায় নয়, উষ্ণতা তার জোয়ান ছেলে মেছের আলির মধ্যেও ছিল। এই সময় তার একমাত্র ছেলেটি যদি বেঁচে থাকত, তাহলে গোটা বাড়িটা ওমে ওমে ভরে উঠত। এই ওম কি শুধুই উষ্ণতা? লেখক সাধারণ উষ্ণতা বোঝানোর জন্য এখানে ওমের অবতারণা করেননি। এই ওম পারিবারিক নিরাপত্তার প্রতীক, পরিবার-পরিজনের নির্ভরতার সংকেত।

সেই রাতেই মতি মিয়ার মনে হলো—তার একটা কম্বলের দরকার। সি. ও. রেভিনিউ রশিদ সাহেবের কাছে গেলে কম্বলটা পাওয়া যাবে। যাবেই তো, সে তো আর যেনতেন মানুষ নয়, মুক্তিযোদ্ধা মেছের আলির বাপ সে। তার একটা আলাদা মর্যাদা আছে না। মতি মিয়ার ভাবনায় যা-ই হোক, রশিদ সাহেবদের মতো মানুষদের কাছে ওই সব মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধার মূল্য কানাকড়ি। তাই তো রিলিফের গম এলে দারিদ্র্যে জেরবার মতি মিয়ার পরিবার রিলিফ পায় না। মতি মিয়া তাদের না চিনলেও মেছের আলির বউ ফুলজান যথার্থই চেনে তাদের। তাই মতি মিয়ার কম্বল চাইতে যাওয়ার প্রস্তাবে ফুলজান বলে ওঠে, ‘কম্বলের আমার দরকার নাই। শীত লাগে না আমার।’ ফুলজানের এই কথার মধ্য দিয়ে প্রচণ্ড একটা ঘৃণা প্রকাশ পায়। অভিনিবেশি পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না। সুবিধাবাদী মানুষদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের কথা লুকিয়ে থাকে ফুলজানের উক্ত কথার মধ্যে।

বড় মর্মযাতনাদায়ক হুমায়ূন আহমেদের শীত গল্পটি। একটার পর একটা দৃশ্য থাপ্পড় হয়ে আমাদের গালে এসে লাগে। দেশের জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দেওয়া মেছের আলির বাপকে বেঁচে থাকার তাগিদে শেষ পর্যন্ত ভিক্ষার থালা নিয়ে বাজারে বসতে হয়। মতি মিয়ার কণ্ঠে শোনা যাক—

‘গত বৎসর বড় কষ্ট করেছি জনাব। দানাপানি নাই। শেষে ফরিদের মা কইল, বুধবারের বাজারে একটা থালা লইয়া বসেন। বসলাম গিয়া। নিজ গেরামের বাজারে ভিক্ষা করা শরমের কথা। বড় শরমের মধ্যে ছিলাম জনাব।’

শেষ পর্যন্ত অবশ্য মতি মিয়া রশিদ সাহেবের কাছ থেকে কম্বলটা পায়। কম্বল পেয়ে মতি মিয়ার কী যে আনন্দ! রাতে খাবারের পর গভীর তৃপ্তিতে ঘুমানোর আয়োজন করল মতি মিয়া। ছেলে মেছের আলির প্রতি গাঢ় কৃতজ্ঞতা বোধ করতে লাগল মতি মিয়া। সে শহীদ না হলে যে এ রকম ওমের কম্বলটি পাওয়া যেত না।

গল্পটা মতি মিয়ার তৃপ্তি আর কৃতজ্ঞতার কথা দিয়ে শেষ করতে পারতেন হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু তা তিনি করলেন না। কেন করলেন না? করলেন না এ জন্য, তিনি যে একজন অসাধারণ কথাকার। মতি মিয়ার আনন্দানুভবের মধ্যে আর্তনাদের রেশটা জুড়ে দিলেন হুমায়ূন। মতি মিয়ার চোখে আরামের ঘুম যখন আসি আসি করছে, ফুলজান তখন কাঁদছে। প্রশ্ন উঠতে পারে—কেন ফুলজানের কান্না? তার যে সব গেছে। স্বামী মেছের আলিকে হারিয়ে এখন যে সে দারোগাবাড়ির ঝি। একটি কম্বলের উষ্ণতা সর্বহারা এই নারীর বেদনার শৈত্যকে কিছুতেই দূরীভূত করতে পারছে না।

শেষ অবধি কম্বলটি ‘শীত’ গল্পে শুধু উষ্ণতার প্রতীক হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছে একজন মুক্তিযোদ্ধার পিতার লাঞ্ছনার, একজন নারীর আর্তনাদ-হাহাকারের অভিজ্ঞান।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ