শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল?
স্বপ্নময় চক্রবর্তী
অভিজ্ঞতা, যা দেখছিলাম ও শুনছিলাম, তার একটা নিজস্ব ভাষ্য নিজের মধ্যে তৈরি হচ্ছিল বাল্যবয়সেই, সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। কবিতায় সেটা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়ে গল্পের আশ্রয় নিয়েছিলাম।
গল্পপাঠ--
শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল?
স্বপ্নময় চক্রবর্তী
শুরুর গল্পগুলি একটু আবেগ মথিত ছিল। তবে স্কুলজীবনেই একটা মোটামুটি রকম জীবনবোধ এবং যুক্তিনিষ্ঠতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কলেজ ম্যাগাজিন, অমৃত পত্রিকা, চতুরঙ্গ ও আরও দুএকটি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত পাঁচ ছটি গল্প কোনও সংকলনে অন্তর্ভূক্ত করিনি। কারণ কাঁচা লেগেছিল। প্রথম ঠিকঠাক গল্প শকুন ১৯৭৫ সালে লেখা।
গল্পপাঠ-
গল্প লেখার জন্য কী প্রস্তুতি নিয়েছেন? নিলে সেগুলো কেমন?
স্বপ্নময় :
গল্প তো চাকরির পরীক্ষা নয় যে প্রস্তুতি নিতে হবে। পৃথিবী থেকে জীবনটা নিংড়ে নেওয়াটাই গল্প লেখার প্রস্তুতি। জীবনের আলোছায়ায় হেঁটে বেড়ানোটাই প্রস্তুতি। জীবনের রস তিক্ত, কষা, বিস্বাদও হতে পারে, কিন্তু পেতে হয়। জীবন ও সমাজকে জানা, এবং তা থেকে উপলব্ধির ভাষ্য রচনা করার নাম গল্প। পাঠ্য বইয়ের গদ্যাংশের গল্প ছাড়া কিছুই পড়িনি।
গল্পপাঠ :
আপনার গল্পলেখার কৌশল বা ক্রাফট কি?
স্বপ্নময় চক্রবর্তী :
গল্প লেখার কৌশল এবং ক্রাফট নানা রকম হতে পারে। একটা কাহিনীকে জড়িয়ে আমি কী বলতে চাই তার উপরই ক্রাফট নির্ভর করে।
গল্পপাঠ :
আপনার নিজের গল্প বিষয়ে আপনার নিজের বিবেচনা কি কি?
স্বপ্নময় চক্রবর্তী :
নিজের গল্প নিয়ে লেখার পরে খুব একটা ভাবিনি। মানুষের মতামত পেয়েছি। পরে শ্রেষ্ঠ গল্প, পঞ্চাশটি গল্প ইত্যাদির প্রুফ দেখার সময় নিজের গল্পগুলির পুনর্পাঠ সম্ভব হয়েছে। বেশ কিছু গল্পের ক্ষেত্রে মনে হয়েছে বেশি বাক্য ব্যবহার হয়েছে, কোনও গল্পের আবেগ বাহুল্য কষ্ট দিয়েছে, কিন্তু নতুন করে লেখার উপায় নেই। কিন্তু গল্প সত্যিই ভালো লেগেছে--একেবারে মেদহীন, যেমন রক্ত, বিদ্যাসাগর, ঝড়ে কাক মরে, অষ্টচরণ ষোল হাঁটু, বাতিল রেকর্ড, ঝড়ের পাতা, উইশ, জেরুজালেম, ধর্ম ইত্যাদি।
গল্পপাঠ :
আপনার আদর্শ গল্পকার কে কে? কেনো তাঁদেরকে আদর্শ মনে করেন?
স্বপ্নময় চক্রবর্তী
আমি আদৌ সাহিত্যের ছাত্র নই। এখনও গল্প উপন্যাসের তুলনায় আমাকে এ্যানথ্রপলজি, সাইকোলজি, ধর্ম ( মানে ধর্মের ইতিহাস এবিং রিচুয়ালগুলির বিবর্তন) বেশি টানে। বাংলা ভাষার বিখ্যাত বহু গল্পই পড়েছি, তুলনায় অন্যভাষার গল্প কম পড়া হয়েছে। আমাদের মহাশ্বেতা দেবী, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, মতি নন্দী, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, হাসান আজিজুল হক এর গল্পগুলি থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। মহাশ্বেতা দেবীর গল্পের ভুবন আমাকে প্রভাবিত করেছে। আর শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাচন ভঙ্গী। সাদত হাসান মাণ্টো, কিষণ চন্দর-- এরাও আমার আদর্শ। হেনরিশ ব্যোল এবং বোর্হেস এর কিছু গল্প পড়ে মনে হয়েছে যদি এমন লিখতে পারতাম, জগদীশ মহান্তি, রবি পট্টনায়ক, মনোজ দাস এদের গল্প খুব ভালো লেগেছে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এর গল্পও। তরুণ লেখকদের মধ্যে অনেকেই খুব শক্তিশালী, এবং মনে হয়েছে এদের মতো লিখতে পারলে ভালো হতো।
সোজা সাপ্টা ভাবে বলতে গেলে মহাশ্বেতা দেবী, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় আর সাদত হাসান মান্টো আমাকে খুব আকর্ষণ করেছেন। কিন্তু ওদের কারোর মতোই আমি লিখিনি।
গল্পপাঠ :
কার জন্য গল্প লেখেন? আপনি কি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লেখেন? লিখলে কেনো লেখেন? আর যদি পাঠকের কথা মনে না রেখে লেখেন তাহলে কেনো পাঠককে মনে রাখেন না লেখার সময়ে?
স্বপ্নময় চক্রবর্তী :
লিখতে শুরু করেছিলাম, তখন নিজের জন্যই লিখতাম। নিজের ভিতরের কিছু বলতে চাওয়া আকুতি লিখতে বাধ্য করেছিল। এখনও যখন লিখি পাঠককে বলব বলেই লিখি, কিন্তু কখনো মনে হয় এটা না লিখলেও চলতো। দুই এক হাজার টাকার জন্য অথবা সম্পাদকের চাপে একটা অদরকারি গল্প লিখেছি এমনও হয়েছে। ১০/১৫ বছর আগে এমন হতো না। অবশ্য এখনও ভিতর থেকে লেখা উঠে আসে, এবং সে সময় কে পড়বে, কোন পত্রিকায় ছাপা হবে ভাবিনা। এমন বহুবার হয়েছে, যে গল্পটি পরিচয়ের জন্য নিয়ে যাচ্ছিলাম, দপ্তর বন্ধ দেখে বর্তমানকে দিয়েছি (ক্যারক্কাস)। কিংবা ‘দেশ’ থেকে উঠিয়ে নিয়ে অনুষ্টুপে দিয়েছি ( মানুষ কিংবা কোল বালিশ)।
কখনও পাঠকের কথাও মনে রাখতে হয় বৈকি। ছোটদের লেখা লেখার সময় তো মনে রাখতেই হয়। রেডিওর গল্পের শৈলি অন্য রকম হয়। কোনও মহিলাদের জন্য পত্রিকার লেখার সময় পাঠকের ব্যাপারটা মাথায় রাখতেই হয়। দু একটা পত্রিকার শব্দের ব্যাপারে শুচি বাই আছে। সেটাও মাথায় রাখতে হয়। সুতরাং আমি বলতে পারি না-- আমি একজন আপোষহীন লেখক, পাঠকের তোয়াক্কা না করে আমি নিজের লেখাটাই লিখি।
কত কী বলার আছে। এখন যেমন এইডস--এইচআইভি নিয়ে, সরোগেট মাদারশিপ নিয়ে, শরিয়তি আইন নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, এরকম আরও কত কী নিয়ে আমার ধারণা বা দ্বন্দ্ব পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই সম্ভাব্য পাঠকের সঙ্গেই তো।
অনেক সময় দেখেছি পাঠক তৈরি থাকেন না। মানুষ ও মেশিনের সম্পর্ক নিয়ে যে গল্পগুলি ২৫/২৬ বছর আগে লিখেছিলাম, এবং ১৯৯৫ সালে ‘সতর্কতামূলক রূপকথা’ নামে এই ধরনের গল্পগুলি নিয়ে সংকলন যে প্রকাশিত হয়, সেই বইটা সাড়া তুলে দেবে ভেবেছিলাম, কিন্তু আদৌ তা হয়নি। হয়তো পাঠক তৈরি হয়নি। হয়তো পাঠক তৈরি ছিল না, কিন্তু পাঠকের কথা ভেবেই তো লেখা হয়েছিল।
তবে এটা বলতে পারি-- পাঠকের নিছক মনোরঞ্জনের জন্য বা ইচ্ছাপূরনের ব্যাপারটা মাথায় রাখি না।
কখনও পাঠকের কথাও মনে রাখতে হয় বৈকি। ছোটদের লেখা লেখার সময় তো মনে রাখতেই হয়। রেডিওর গল্পের শৈলি অন্য রকম হয়। কোনও মহিলাদের জন্য পত্রিকার লেখার সময় পাঠকের ব্যাপারটা মাথায় রাখতেই হয়। দু একটা পত্রিকার শব্দের ব্যাপারে শুচি বাই আছে। সেটাও মাথায় রাখতে হয়। সুতরাং আমি বলতে পারি না-- আমি একজন আপোষহীন লেখক, পাঠকের তোয়াক্কা না করে আমি নিজের লেখাটাই লিখি।
কত কী বলার আছে। এখন যেমন এইডস--এইচআইভি নিয়ে, সরোগেট মাদারশিপ নিয়ে, শরিয়তি আইন নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, এরকম আরও কত কী নিয়ে আমার ধারণা বা দ্বন্দ্ব পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই সম্ভাব্য পাঠকের সঙ্গেই তো।
অনেক সময় দেখেছি পাঠক তৈরি থাকেন না। মানুষ ও মেশিনের সম্পর্ক নিয়ে যে গল্পগুলি ২৫/২৬ বছর আগে লিখেছিলাম, এবং ১৯৯৫ সালে ‘সতর্কতামূলক রূপকথা’ নামে এই ধরনের গল্পগুলি নিয়ে সংকলন যে প্রকাশিত হয়, সেই বইটা সাড়া তুলে দেবে ভেবেছিলাম, কিন্তু আদৌ তা হয়নি। হয়তো পাঠক তৈরি হয়নি। হয়তো পাঠক তৈরি ছিল না, কিন্তু পাঠকের কথা ভেবেই তো লেখা হয়েছিল।
তবে এটা বলতে পারি-- পাঠকের নিছক মনোরঞ্জনের জন্য বা ইচ্ছাপূরনের ব্যাপারটা মাথায় রাখি না।
0 মন্তব্যসমূহ