শেখ লুৎফরের গল্পের ভুবন : গল্পের জমিন লোহারচে' কঠিন

গল্পপাঠ : 
গল্প লিখতে শুরু করলেন কেন?

শেখ লুৎফর :
নিজেকে প্রকাশের মাধ্যমেই মানুষের ব্যক্তি হয়ে ওঠা। যেহেতু রাজনৈতিক পশু, ঘুষখোর আমলা, ভূমিদস্যু, ঋণখেলাপি, তস্কর কিছুই হওয়া গেলো না তাই গল্প লেখার চেষ্টা চলছে।



গল্পপাঠ : 
শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল?

শেখ লুৎফর : 
এখনো চোখ বোজে দম টানলে শুরুর লেখাগুলোতে একটু-আধটু মৌলিকত্বের ঘ্রাণ পাই। প্রথম যেদিন কাগজ-কলম নিয়ে গল্প ধরার আশায় টেবিলে বসেছিলাম, মনে একটা পণ ছিল- একদম হাতের কাছ থেকে চেনা চরিত্র নেব। লোকটা যেভাবে বাঁচে, হাসে, যে-ভাষায় গালি দেয়, তার সব...সবটার কার্বন কপির ফাঁকে ফাঁকে আমার চিন্তার পেরেকগুলো টাইট করে গেঁথে দেব।


গল্পপাঠ : 
গল্প লেখার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছেন? নিলে সেগুলো কেমন?

শেখ লুৎফর : 
অনেস্টলি বলছি, অন্তত গল্পের জন্য একটুও না। কবিতা লেখার চেষ্টা ছিল ক্লাস সেভেন থেকে। লিখে মাকে পড়ে শুনাতাম। মাঝে মাঝে মা শোনে খুশি হতেন। তার আগে ক্লাস ফোরে পড়ার সময় মেজো আপার টেবিল থেকে আরব্য উপন্যাস চুরি করে নিয়ে পড়েছি। তারপর থেকে প্রায় বিকালেই আমি ভিটার বড় জামগাছে বসে চুরি করা উপন্যাস পড়তাম। ছিয়া নব্বইয়ের আগে স্বপ্নেও ভাবিনি গল্প লিখব। সে বছর এক বিকালে কবিবন্ধু মোস্তাক আহমাদ দীন জানাল তার সম্পাদিত ছোটকাগজ 'বিকাশ' এবার গল্প সংখ্যা হবে। বিকাশের আগের দুটো সংখ্যায় আমার কবিতা গিয়েছিল। দীন আমার লেখার খাতা উল্টে-পাল্টে পছন্দের কবিতাটা নিয়ে যেতেন। কিন্তু এবার গল্প সংখ্যা হলে তো আমি বাদ পড়ে যাচ্ছি! মনের মধ্যে একটা কষ্ট নিয়ে ঘরে ফিরতে হলো। রাতের খাবার খেয়ে কয়েক তা কাগজ নিয়ে বসে গেলাম। হায় খোদা...গল্পের জমিন লোহারচে' কঠিন! ফজরের আযানের সময় আট-দশ পৃষ্ঠা হয়ে গেল। পরের দিন রাতেও তাই করলাম। হয় হয় ভোরে আরেকখানা হল। নাম দিলাম ‘সতীর পতি বরুনের বিলাপ।' বিকাশের গল্প সংখ্যায় দীন ভাই ওটা ছেপেছিল।

প্রস্তুতি পর্বের কথা হিসেবে শুধু এইটুকু খোঁজে পাই!


গল্পপাঠ : 
আপনার গল্প লেখার কৌশল বা ক্রাফট কী?

শেখ লুৎফর :
কিচ্ছু না। নির্দিষ্ট করে কিছুই বলা সম্ভব না। ওটা আপনাতেই হয়ে যায়। দর্জি যেমন জাগামতো সুতার মাথাটা টেনে ধরে--ঠিক তেমনি মনমতো বিষয় আর চরিত্র ধরতে পারলে সেই চরিত্রই ভাব, ভাষা, আঙ্গিক জোগায়, সে-ই আমাকে টেনে টেনে বন্দরে পৌঁছে দেয়।


গল্পপাঠ : 
নিজের গল্প বিষয়ে আপনার নিজস্ব বিবেচনা কী?

শেখ লুৎফর : 
খুব বাজে। যা চাই তার অর্ধেকও আদায় হয় না। অনেক সময় নিজের কাছেই লজ্জা পাই। সে জন্য লেখা হয়ে যাওয়ার পরও অনেক দিন লুকিয়ে রাখি। একটু ফাঁক পেলেই পড়ি...আবার পড়ি...মনমতো না হওয়া তক হাতুড়ি-বাটাল চলতেই থাকে।


গল্পপাঠ : 
আপনার আদর্শ গল্পকার কে কে? কেন তাদেরকে আদর্শ মনে করেন?

শেখ লুৎফর :
লেখা-লেখিতে আদর্শ বলতে কিছু নেই। ওটা বিশ্বাস করলে জ্যান্ত ডুবতে হবে। আপনার এই আদর্শ শব্দটার জন্য এক তুড়িতে শ'খানেক নাম ছেঁটে ফেলতে হচ্ছে। তাই বলছি, বুড়ো ঠাকুর তো একাই একশ। তারপর ধরেন- চেখভ, তলস্তয়, তারাশঙ্কর, মানিক, হাসান, ইলিয়াস। তাঁরা আদর্শ এই জন্য যে, তাদের চিন্তা জীবন-জগতের প্রায় চিরন্তনের কাছাকাছি।


গল্পপাঠ : 
কার জন্য গল্প লিখেন? লেখার সময় আপনি কী পাঠকের কথা মাথায় রাখেন? কেন রাখেন?

শেখ লুৎফর --
ভুল বুঝবেন না। ঝঞ্জাল থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য লেখার চেষ্টায় আছি। দেখুন এখন তো নয়ই এবং কোনোকালেই সাহিত্যের পাঠক তেমন বেশি ছিল না। আপনার নিশ্চয়ই শুনতে খারাপ লাগবে না যে, আমি গোটা দশেক পাঠকের জন্য গল্প লিখি। পাঠক নয়, আমি চরিত্রের কথা মাথায় নিয়ে লিখি। তার ইমোশন, বাস্তবতা আমাকে এতটা তাড়া করে যে, পাঠকের কথা মনেই থাকে না।



লেখক পরিচিতি
শেখ লুৎফর। জন্মসালঃ ১৯৬৬। জন্ম স্থানঃ ময়মনসিংহ, গফরগাঁও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক। পেশাঃ শিক্ষকতা।

প্রকাশিত গল্পের বই: ১. উল্টারথে-২০০৮, ঐতিহ্য, ঢাকা,
২. ভাতবউ, ২০১৩, ঐতিহ্য, ঢাকা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ