মাঝ রাতে মতি মিয়ার ঘুম ভেঙে গেল।
বুকে একটা চাপা ব্যথা, দম বন্ধ হয়ে আসছে। শ্বাসের কষ্টটা শুরু হলো বোধহয়। সে কাঁথার ভেতর থেকে মাথা বের করল। কী অসম্ভব ঠান্ডা! বুড়োমারা শীত পড়েছে। দরমার বেড়ার ফাঁক দিয়ে বরফ-শীতল হওয়া আসছে। হাতে পায়ে কোনো সাড় নেই। ঠাণ্ডায় জমে গেছে নাকি?
মতি মিয়া বড় বড় নিশ্বাস নিতে শুরু করল। শ্বাসকষ্ট হলে কিছুতেই ফুসফুস ভরানো যায় না। কেউ একটু হাওয়া করলে আরাম হতো। ডাকবে নাকি ফরিদের মাকে? মতি মিয়া উঠে বসবার চেষ্টা করলো। আশ্চর্যের ব্যাপার ব্যথাটা কমে গেল। নিশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এলে ঠিক তখনই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল । মতি মিয়ার মনে হলো কেউ যেন তার কাঁথার ভেতর ঢুঁকে যাচ্ছে। অশরীরী কেউ। সে হাত রাখল মতি মিয়ার পেটে। অসম্ভব শীতল হাত। সেই হাতে বড় বড় আঙ্গুল। একবার হাত রেখেই সে হাত সরিয়ে নিল। মতি মিয়া ভয় পেয়ে ডাকল, “বৌমা, ও ফরিদের মা?
ফুলজান ফরিদকে নিয়ে রান্নাঘরে ঘুমায়। শ্বশুরেব বেশিরভাগ কথারই সে কোনো জবাব দেয় না। আজ দিলো বিরক্ত স্বরে। বলল, কী হইছে?”
কুপিটা জ্বালাও তো মা, বড় ভয় লাগতাছে।
“ফরিদরে একটু দিয়া যাও আমার সাথে। দিয়া যাও গো মা। ও ময়না।"
‘খামাখা চিল্লাইয়েন না, ঘুমান।”
‘ও ফরিদের মা, ও বেটি।
ফুলজান সাড়া দিল না। মতি মিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। জমাট অন্ধকার চারদিকে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে একবিন্দু আলোও আসছে না। বোধহয় কৃষ্ণপক্ষ। তার ভয়টা কিছুতেই কাটছে না। বুড়োকালে মানুষের ভয় বেড়ে যায়। অকারণেই গা ছমছম করে। বুড়োকাল বড় অদ্ভুত কাল।
রান্নাঘরে খচমচ শব্দ হচ্ছে। ফুলজান কি জেগে আছে? নাকি ইদুর? ইদুরের বড় উৎপাত হয়েছে। ফুলজান বিড়বিড় করে কথা বলছে। কে জানে হয়তো বা কুপি জ্বালাবে। দেখতে আসবে তাকে । যতটা খারাপ মনে হয় মেয়েটা তত খারাপ না । মায়া-মহব্বত আছে। মতি মিয়া ক্যাঁথার ভেতর থেকে মাথা বের করল। কী ভয়ানক ঠাণ্ডা পড়েছে! এই শীতটা বোধহয় কাটানো যাবে না। ভালোমন্দ কিছু এবারই হবে।
“বৌমা ঘুমাইলা নাহি, ও ফরিদের মা।”
"কিতা?'
"দুই কেঁথায় শীত মানে না।”
“না মানলে আমি কী করুম কন?”
“বুড়াকালে শীতটা বেশি লাগে। ফরিদরে দিয়া যাও আমার কাছে। ও ফরিদের মা ।”
ফুলজান জবাব দেয় না।
‘ও ফরিদের মা, ও ময়না।”
লাভ হয় না কোনো। মতি মিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ঘুমুতে চেষ্টা করে। ঘুম আসে না। বুড়ো-কালের এই এক যন্ত্রণা, একবার ঘুম ছুটে গেলে এ ঘুম আর
আসে না। শীতের রাত জেগে পার করা বড় কষ্ট। ফুলজানের দু'টাে বাচ্চা থাকলে ভালো হতো। একটাকে রাখতেন নিজের কাছে। পুলাপানের গায়ে জবর ওম। লেপের চেয়ে বেশি ওম। মেছের আলী বেঁচে থাকলেও হতো। একটা জোয়ান ছেলে আশেপাশে থাকলেই ঘরবাড়ি গরম থাকে। মতি মিয়ার বুক হু-হু করতে লাগলো। বুডোকালে আশপাশে একটা জোয়ান ছেলে দরকার। মেছের আলির কথা তার বেশিক্ষণ মনে থাকলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ক্ষিদে লেগে গেল অথচ ক্ষিদে লাগার কোনই কারণ নেই । শীতের শুরুতেই ভাতের কষ্ট দূর হয়েছে। ফুলজান রোজ দারোগা বাড়ি থেকে ভাত নিয়ে আসছে। একজনের ভাত কিন্তু তিনজনের ভারপেট হচ্ছে।
আজ খাওয়া হয়েছে টেংরা মাছের তরকারি ও ডাল দিয়ে। এইসব ছোটখাট জিনিস তাব মনে থাকে না। কিন্তু আজকেরটা মনে আছে। কারণ, টেংরা মাছের কাঁটা বিঁধে গিয়েছিল। বড় কষ্ট হয়েছে। শরীরের কষ্টটা এখন বেড়ে গেছে, অল্পতেই কষ্ট হয় ।
বান্নাঘরে আবার শব্দ হচ্ছে। ব্যাপারটা কী? ঘুম ভাঙল নাকি ফরিদের? মাঝে মাঝে ফরিদ চুপি চুপি চলে আসে তার কাছে। বুকের কাছে গুটিগুটি মেরে ঘুমায়। বড় আরাম লাগে। মতি মিয়া উৎকৰ্ণ হয়ে অপেক্ষা করে। এবং একসময় অবাক হয়ে লক্ষ করে রান্নাঘরে কুপি জ্বালানো হয়েছে। বিজবিজ শব্দ শোনা যায়। ফরিদের মা নিজের মনেই কথা বলছে নাকি?
“বৌমা কী হইছে?”
“কিছু অয় নাই।’
‘বাত্তি জ্বালাইলা বিষয়ডা কী?'
“ফরিদ বিছানা ভিজাইতেছে।”
“কও কি ! শীতের মইধ্যে কামডা কি করল?”
একটা চড়ের শব্দ শোনা যায়। ফরিদ অবিশ্যি কাঁদে না । মতি মিয়া উল্লসিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠে, এরে দিয়া যাও আমার কাছে। মাইর ধুইর করার কাম নাই। পুলাপান মানুষ।
ফুলজানের তরফ থেকে কোনাে সাড়া পাওয়া যায় না। এখানে আনবে না নিশ্চয়ই।
‘ও বৌমা, ও ফরিদের মা।’
‘কী’
"ভিজা কেঁথার মইধ্যে রাখন ঠিক না। বুকে কফ জমলে মুশকিলে পড়বা। দিয়া যাও আমার কাছে।’
ফুলজানের দিক থেকে কোনো সাড়া নেই। ফরিদ খুনখুন করে কাঁদতে শুরু করেছে। মতি মিয়া একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। আর তখনই ফুলজান ফরিদকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকল। এক হাত দূরে থাকা কুপির সবটা আলো পড়েছে তার মুখে। মুখ থমথম করছে তার। বোধহয় কেঁদেছে খানিকক্ষণ আগে। ফুলজান মাঝে মাঝে রাত জেগে কাঁদে । মতি মিয়া সরে নাতির জন্যে জায়গা করে দিল । ফরিদ চোখ বন্ধ করে আছে। ঘুমের ভান। এমন বজ্জাত হয়েছে। ফুলজান দাঁড়িয়ে আছে কুঁপি হাতে। কিছু বলবে বোধ হয়।
“কিছু বলবা নাকি মা?
'ना।'
“শীতটা পড়ছে মারাত্মক। রশিদ সাহেবের কাছে একবার যাইবা নাকি? কম্বল যদি দেয় একটি।
ফুলজান কিছু বললো না। কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে রইল। মতি মিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস গোপন করল। ফরিদের মা যাবে না। যে-কোনো কারণেই হােক রশিদ সাহেবের কাছে সে যেতে চায় না। রিলিফের গম এল একবার। সবাই গেল, ফুলজান গেল না। পা টেনে টেনে যেতে হলো মতি মিয়াকেই।
‘ও ফরিদের মা ।” ‘
কী কইবেন কেন?’
“যাইবা নাকি কাইল একবার রশিদ সাবের কাছে?”
“কম্বলের আমার দরকার নাই। শীত লাগে না আমার ।”
“তোমার না লাগলে কি, আমার তো লাগে।”
‘আপনের লাগলে আপনে যান’
' মতি মিয়া উঠে বসার চেষ্টা করে। ফরিদ শুয়ে আছে তার গা ঘেঁষে। সে অন্য রকম একটা উত্তেজনা অনুভব করে।
‘বুঝলা ফরিদের মা, আমার হক আছে। আমার ছেলে মরে নাই যুদ্ধে? কও তুমি, যুদ্ধে মরে নাই?"
“হেতো কতই মরছে।”
“সবের হক আছে। বুঝলা? কম্বল আমার হকের জিনিস।”
ফুলজান হাই তুলে কুপি হাতে রান্নাঘরে ঢুকল। বাতি নিভে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। রাত কতটা বাকি কে জানে? মতি মিয়ার প্রস্রাবের চাপ হয়েছে। শীতের মধ্যে উঠতে ইচ্ছা হচ্ছে না। প্রস্রাবের চাপ এমন এক জিনিস যা ক্ষিধের মতো হু-হু করে বাড়তে থাকে।
“ফরিদ ঘুমাইছস?”
'হুঁ।"
“ঘুমাইলে কথা কস ক্যামনেরে ছাগল?”
ফরিদ খুকখুক করে হাসে। মতি মিয়াও হাসে। বড় ভাল লাগে তার। বড় মায়া লাগে।
‘কাইল কম্বল আনতে যামু বুঝলি ফরিদ?'
‘আইচ্ছা।’
‘তুইও যাবি আমার সাথে। হকের কম্বল ঠিক না?’
‘‘হুঁ’
‘ফরিদ ঘুমাইছস?’
‘ঘুমাইছি।’
পেসাব করন দরকার।
মতি মিয়া চিন্তিত হয়ে পড়ে। এই প্রচন্ড শীতে উঠা সম্ভব নয়। কিন্তু ইতিমধ্যে তলপেটে ব্যথা শুরু হয়েছে। মাবুদে এলাহী, বুড়ো হওয়ার বড় কষ্ট।
‘ফরিদ ঘুমাইছস’
ফরিদ জবাব দেয় না। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয় । মতি মিয়া ঘুমন্ত ফরিদের সঙ্গেই কথাবার্তা চালাতে থাকে। কথাবার্তায় ব্যস্ত থাকলে মনটা অন্য দিকে থাকে । তলপেটের চাপের কথাটা মনে থাকে না ।
‘বুঝলি ফরিদ, ‘কাইল যামু রশিদ সাবের কাছে। তোর বাপের নাম কইলে না দিয়া উপায় নাই। বুঝছস? তুইও যাবি আমার সাথে। চুপ কইরা বইসা থাকবি ফাইজলামি বাদরামি করলে চড় খাইবি। বুঝছস?”
মতি মিয়া অনবরত কথা বলতে থাকে। কথা বলতে বড় ভালো লাগে তার।
সকালটা শুরু হয়েছে খুব চমৎকারভাবে। চনমনে রোদ উঠেছে। কুয়াশার চিহ্নমাত্র নেই। কে বলবে মাঘ মাসের সকাল । মতি মিয়া আয়েশ করে রোদে বসে আছে। বড় আরাম লাগছে।
ফুলজান ফরিদকে টিনের থালায় মুড়ি দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। এটা একটা ভালো লক্ষণ । এর মানে হচ্ছে ঘরে পান্তা নেই। যেদিন পান্তা থাকে না সেদিন দুপুরে ফরিদের মা গরম ভাতের ব্যবস্থা করে। আজও করবে। দুই-একগাল মুড়ি খেলে হতো। ফরিদ থালা নিয়ে ঘুরছে দূরে দূরে। মুড়ি শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাছে ভিড়বে না। মতি মিয়া ডাকল, “ওই ফরিদ, ওই। এদিকে আয় দাদা।” ফরিদ না শোনার ভান করল। মহা বজাত হয়েছে ছোকরা ।
ফুলজান দারোগা বাড়ি যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। দুপুরবেলা মনে করে এলে হয়। আসবে ঠিকই। মায়া-মহব্বত আছে মেয়েটার। ভালো মেয়ে।
“দারোগা বাড়ি যাও নাকি গো মা?”
হুঁ ।
“আইচ্ছা ঠিক আছে। যাও। রইদটা একটু তেজি আমিও যাইতাছি রশিদ সাবের কাছে।”
ফুলজান কোনো জবাব দিল না। মতি মিয়া ইতস্তত করে বলেই ফেলল, "চিড়া-মুড়ি কিছু আছে? শইলডা জানি কেমন কেমন লাগে।
চিড়া -মুডি কিছু নাই।
“ঠিক আছে। অসুবিধা নাই। তুমি যাও”
রোদটা এত আরামের যে উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত ইচ্ছা হয় না। তবু মতি মিয়া উঠল। রশিদ সাহেবের কাছে যাওয়া দরকার । মতি মিয়ার মন বলছে আজ গেলে কিছু-একটা হবে। না হয়েই পারে না।
‘আয়রে ফরিদ ।”
ফরিদ তার থালার মুড়ির শেষ দানাটি মুখে ফেলে দাদার হাত ধরল। চিকন গলায় বলল, “কোলে নাও’ কোলে নেবার বয়স কি আছে মতি মিয়ার? তবু সে ফরিদকে কোলে নিল। কিছুদূর নিয়ে নামিয়ে দিলেই হবে। পুলাপান মানুষ, একটা শখ হয়েছে।
রশিদ সাহেব সোহাগীর সি.ও. রেভিন্যু ।
লোকটি ছোটখাট । তাঁকে দেখেই মনে হয় সবার উপর বিরক্ত হয়ে আছেন। ভুরু না কুঁচকে তিনি কারো দিকে তাকাতে পারেন না। কম্বলের প্রসঙ্গে তাঁর কোনাে ভাবান্তর হলো না।
তিনি অফিসের উঠোনে একটা চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিলেন। চায়ের কাপ থেকে দৃষ্টি সরালেন না। মতি মিয়া দ্বিতীয়বার বলল, “শীতে বড় কষ্ট পাইতেছি।”
রশিদ সাহেব সে কথারও কোনো জবাব দিলেন না। শুকনো চোখে তাকিয়ে রইলেন। মতি মিয়া ভেবে পেল না কথাগুলি কীভাবে বললে শীতের কষ্টটা পরিস্কার বুঝা যাবে। রশিদ সাহেব কম্বলের প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে এলেন, নিরাসক্ত গলায় বললেন, “এই ছেলে কে?”
'জি, আমার নাতি। মেছের আলির ছেলে।”
'কার ছেলে ?”
“মেছের আলির। মেছের আলিরে চিনলেন না, যুদ্ধ করল যে মেছের আলি।”
রশিদ সাহেব বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। তিনি চিনেছেন। মতি মিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল। এই লোকটা বিরক্ত হচ্ছে কেন? তার ছেলের কথায় বিরক্ত হওয়ার কি আছে?
গত বছর রিলিফের গম এল। মতি মিয়া গম আনতে গিয়ে বলল, “চিনছেন তো আমারে? আমি মেছের আলির বাপ । যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গেল যে মেছের আলি।”
চ্যাংড়া মতো একটি অপরিচিত ছেলে গম দিচ্ছিল। সে চােখ-মুখ শক্ত করে বলল, “মেছের আলির জন্যেও গম দেয়া লাগবে? সেও রুটি খাবে?” লাইনে দাড়িয়ে থাকা সবাই হেসে উঠল। যেন এ রকম মজার কথা ওরা বহুদিন শুনে নাই।
রশিদ সাহেব বিরক্ত হচ্ছেন। কিংবা কে জানে হয়তো রেগেও যাচ্ছেন। অফিসার মানুষ। রেগে গেলে প্রথম দিকে বোঝা যায় না। তারা রাগ চেপে রাখে। চোঁচামেচি হইচই শুরু করে ছোট লোকেরা। মতি মিয়ার মতো মানুষরা।
মতি মিয়া গলা পরিস্কার করে বললো ‘জবর যুদ্ধ করেছিলো মেছের আলী। নীলগঞ্জে একটা সড়কের তারা নামে দিছে ’মেছের আলি সড়ক।” নীলগঞ্জ হইল গিয়া আপনার এইখান থাইক্যা।
“চিনি, নীলগঞ্জ কোথায় চিনি।
রশিদ সাহেবের ভূরু কুচকানো। মতি মিয়া চুপ করে গেল। বেলা অনেক হয়েছে। পেটের ক্ষিদে জানান দিচ্ছে। মুখ ভর্তি করে থুথু জমা হচ্ছে। রশিদ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন নির্লিপ্ত গলায় বললেন, ‘দাঁড়ান আপনি, একটা কম্বলের ব্যবস্থা করছি। চা খাবেন?”
মতি মিয়ার চোখে পানি এসে গেল। বলে কি এই লোক? মতি মিয়া চোখ মুছল। ধরা গলায় বলল, 'গত বৎসর বড় কষ্ট করেছি জনাব। দানাপানি নাই। শেষে ফরিদের মা কইল, বুধবারের বাজারে একটা থালা লইয়া বসেন। বসলাম গিয়া। নিজ গেরামের বাজারে ভিক্ষা করা শরমের কথা। বড় শরমের মধ্যে ছিলাম জনাব।'
মতি মিয়া ক্রমাগত চোখ মুছতে লাগল। ফরিদ তাকিয়ে আছে। সে বড়ই অবাক হয়েছে।
রশিদ সাহেব শুধু যে কম্বল দিয়েছেন তাই না, পঞ্চাশটি টাকাও দিয়েছেন। সেই টাকার খানিকটা ভাঙিয়ে মতি মিয়া চা ও চিনি কিনে ফেলল। ফরিদকে বলল, “বুড়াকালে চা-টা খুব দরকার। বুকে কফ জমে না। ভালো ঘুম হয়।
বুঝলিরে বেকুব । বুড়াকালে চা হইল গিয়া অষুধ ।”
তারা দু'জন সাড়া দুপুর বাজারে ঘুরল। মতি মিয়া পরিচিত সবাইকেই নতুন কম্বল দেখাল। তার গাল ভর্তি হাসি, ‘মেছের আলির কারণে পাইলাম, বুঝলা না? মেছেরের নাম কইতেই মন্ত্রের মতো কাম হইল। বিলাতি জিনিস, হাত দিয়া দেখ । জবর ওম । চাইর পাঁচ শ” টেকা দাম হইব, কি কও?’
মতি মিয়ার মনে ক্ষীণ আশঙ্কা ছিল ফরিদের মা কম্বলটা হয়তো নিজের জন্যে দাবি করবে। মেছের আলির কম্বলে ওদের দাবিই তো বেশি। কিন্তু তা সে করল না। চকচকে নতুন কম্বলের প্রতি তার কোনো রকম আগ্রহ দেখা গেল না। যথারীতি ফরিদকে নিয়ে রান্নাঘরে ঘুমুতে গেল। দীর্ঘদিন পর আরাম করে ঘুমুতে গেল মতি মিয়া। এত আরাম যে চট করে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে না। জেগে গল্প করতে ইচ্ছা করে।
“ফরিদের মা, ঘুমাইলা নাকি?’
না।
জবর ওম কম্বলটার মইধ্যে। বিলাতী জিনিস তো। বিলাতী জিনিসের ওম অন্য রকম। ভালো ঘুম হইব।”
‘ঘুমান ভালো কইরা।’
“ফরিদের মা ।”
“কন কি!”
মেছেরের কথা কইতেই রশিদ সাব খুব ইজ্জত করল । চা খাওয়াইল । শরিফ আদমী ।
ফুলজান জবাব দিল না। মতি মিয়া বলল, “ফরিদরে দিয়া যাও, আমার সাথে বাপের কম্বলের নীচে ঘুমাউক।” ফুলজান সে কথারও জবাব দিল না। ঘুমিয়ে পডেছে নাকি।
গভীর তৃপ্তিতে ঘুমাবার আয়োজন করল মতি মিয়া। ছেলের প্রতি গাঢ় কৃতজ্ঞতায় তার মন ভরে যাচ্ছে। বড় শান্তি লাগছে। ঘুমের মধ্যেই সে শুনল, ফুলজান কাঁদছে। সে প্রায়ই কান্দে। তার কান্না শুনতে মতি মিয়ার কোনো কালেই ভালো লাগে না। কিন্তু আজ ভালো লাগছে। কেমন যেন গানের সুরের মতো সুর।
আরাম করে ঘুমায় মতি মিয়া। বাইরে প্রচণ্ড শীত। ঘন হয়ে কুয়াশা পড়ছে। উত্তর দিক থেকে বইছে ঠাণ্ডা হিমেল হাওয়া। -
বুকে একটা চাপা ব্যথা, দম বন্ধ হয়ে আসছে। শ্বাসের কষ্টটা শুরু হলো বোধহয়। সে কাঁথার ভেতর থেকে মাথা বের করল। কী অসম্ভব ঠান্ডা! বুড়োমারা শীত পড়েছে। দরমার বেড়ার ফাঁক দিয়ে বরফ-শীতল হওয়া আসছে। হাতে পায়ে কোনো সাড় নেই। ঠাণ্ডায় জমে গেছে নাকি?
মতি মিয়া বড় বড় নিশ্বাস নিতে শুরু করল। শ্বাসকষ্ট হলে কিছুতেই ফুসফুস ভরানো যায় না। কেউ একটু হাওয়া করলে আরাম হতো। ডাকবে নাকি ফরিদের মাকে? মতি মিয়া উঠে বসবার চেষ্টা করলো। আশ্চর্যের ব্যাপার ব্যথাটা কমে গেল। নিশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এলে ঠিক তখনই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল । মতি মিয়ার মনে হলো কেউ যেন তার কাঁথার ভেতর ঢুঁকে যাচ্ছে। অশরীরী কেউ। সে হাত রাখল মতি মিয়ার পেটে। অসম্ভব শীতল হাত। সেই হাতে বড় বড় আঙ্গুল। একবার হাত রেখেই সে হাত সরিয়ে নিল। মতি মিয়া ভয় পেয়ে ডাকল, “বৌমা, ও ফরিদের মা?
ফুলজান ফরিদকে নিয়ে রান্নাঘরে ঘুমায়। শ্বশুরেব বেশিরভাগ কথারই সে কোনো জবাব দেয় না। আজ দিলো বিরক্ত স্বরে। বলল, কী হইছে?”
কুপিটা জ্বালাও তো মা, বড় ভয় লাগতাছে।
“ফরিদরে একটু দিয়া যাও আমার সাথে। দিয়া যাও গো মা। ও ময়না।"
‘খামাখা চিল্লাইয়েন না, ঘুমান।”
‘ও ফরিদের মা, ও বেটি।
ফুলজান সাড়া দিল না। মতি মিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। জমাট অন্ধকার চারদিকে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে একবিন্দু আলোও আসছে না। বোধহয় কৃষ্ণপক্ষ। তার ভয়টা কিছুতেই কাটছে না। বুড়োকালে মানুষের ভয় বেড়ে যায়। অকারণেই গা ছমছম করে। বুড়োকাল বড় অদ্ভুত কাল।
রান্নাঘরে খচমচ শব্দ হচ্ছে। ফুলজান কি জেগে আছে? নাকি ইদুর? ইদুরের বড় উৎপাত হয়েছে। ফুলজান বিড়বিড় করে কথা বলছে। কে জানে হয়তো বা কুপি জ্বালাবে। দেখতে আসবে তাকে । যতটা খারাপ মনে হয় মেয়েটা তত খারাপ না । মায়া-মহব্বত আছে। মতি মিয়া ক্যাঁথার ভেতর থেকে মাথা বের করল। কী ভয়ানক ঠাণ্ডা পড়েছে! এই শীতটা বোধহয় কাটানো যাবে না। ভালোমন্দ কিছু এবারই হবে।
“বৌমা ঘুমাইলা নাহি, ও ফরিদের মা।”
"কিতা?'
"দুই কেঁথায় শীত মানে না।”
“না মানলে আমি কী করুম কন?”
“বুড়াকালে শীতটা বেশি লাগে। ফরিদরে দিয়া যাও আমার কাছে। ও ফরিদের মা ।”
ফুলজান জবাব দেয় না।
‘ও ফরিদের মা, ও ময়না।”
লাভ হয় না কোনো। মতি মিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ঘুমুতে চেষ্টা করে। ঘুম আসে না। বুড়ো-কালের এই এক যন্ত্রণা, একবার ঘুম ছুটে গেলে এ ঘুম আর
আসে না। শীতের রাত জেগে পার করা বড় কষ্ট। ফুলজানের দু'টাে বাচ্চা থাকলে ভালো হতো। একটাকে রাখতেন নিজের কাছে। পুলাপানের গায়ে জবর ওম। লেপের চেয়ে বেশি ওম। মেছের আলী বেঁচে থাকলেও হতো। একটা জোয়ান ছেলে আশেপাশে থাকলেই ঘরবাড়ি গরম থাকে। মতি মিয়ার বুক হু-হু করতে লাগলো। বুডোকালে আশপাশে একটা জোয়ান ছেলে দরকার। মেছের আলির কথা তার বেশিক্ষণ মনে থাকলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ক্ষিদে লেগে গেল অথচ ক্ষিদে লাগার কোনই কারণ নেই । শীতের শুরুতেই ভাতের কষ্ট দূর হয়েছে। ফুলজান রোজ দারোগা বাড়ি থেকে ভাত নিয়ে আসছে। একজনের ভাত কিন্তু তিনজনের ভারপেট হচ্ছে।
আজ খাওয়া হয়েছে টেংরা মাছের তরকারি ও ডাল দিয়ে। এইসব ছোটখাট জিনিস তাব মনে থাকে না। কিন্তু আজকেরটা মনে আছে। কারণ, টেংরা মাছের কাঁটা বিঁধে গিয়েছিল। বড় কষ্ট হয়েছে। শরীরের কষ্টটা এখন বেড়ে গেছে, অল্পতেই কষ্ট হয় ।
বান্নাঘরে আবার শব্দ হচ্ছে। ব্যাপারটা কী? ঘুম ভাঙল নাকি ফরিদের? মাঝে মাঝে ফরিদ চুপি চুপি চলে আসে তার কাছে। বুকের কাছে গুটিগুটি মেরে ঘুমায়। বড় আরাম লাগে। মতি মিয়া উৎকৰ্ণ হয়ে অপেক্ষা করে। এবং একসময় অবাক হয়ে লক্ষ করে রান্নাঘরে কুপি জ্বালানো হয়েছে। বিজবিজ শব্দ শোনা যায়। ফরিদের মা নিজের মনেই কথা বলছে নাকি?
“বৌমা কী হইছে?”
“কিছু অয় নাই।’
‘বাত্তি জ্বালাইলা বিষয়ডা কী?'
“ফরিদ বিছানা ভিজাইতেছে।”
“কও কি ! শীতের মইধ্যে কামডা কি করল?”
একটা চড়ের শব্দ শোনা যায়। ফরিদ অবিশ্যি কাঁদে না । মতি মিয়া উল্লসিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠে, এরে দিয়া যাও আমার কাছে। মাইর ধুইর করার কাম নাই। পুলাপান মানুষ।
ফুলজানের তরফ থেকে কোনাে সাড়া পাওয়া যায় না। এখানে আনবে না নিশ্চয়ই।
‘ও বৌমা, ও ফরিদের মা।’
‘কী’
"ভিজা কেঁথার মইধ্যে রাখন ঠিক না। বুকে কফ জমলে মুশকিলে পড়বা। দিয়া যাও আমার কাছে।’
ফুলজানের দিক থেকে কোনো সাড়া নেই। ফরিদ খুনখুন করে কাঁদতে শুরু করেছে। মতি মিয়া একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। আর তখনই ফুলজান ফরিদকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকল। এক হাত দূরে থাকা কুপির সবটা আলো পড়েছে তার মুখে। মুখ থমথম করছে তার। বোধহয় কেঁদেছে খানিকক্ষণ আগে। ফুলজান মাঝে মাঝে রাত জেগে কাঁদে । মতি মিয়া সরে নাতির জন্যে জায়গা করে দিল । ফরিদ চোখ বন্ধ করে আছে। ঘুমের ভান। এমন বজ্জাত হয়েছে। ফুলজান দাঁড়িয়ে আছে কুঁপি হাতে। কিছু বলবে বোধ হয়।
“কিছু বলবা নাকি মা?
'ना।'
“শীতটা পড়ছে মারাত্মক। রশিদ সাহেবের কাছে একবার যাইবা নাকি? কম্বল যদি দেয় একটি।
ফুলজান কিছু বললো না। কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে রইল। মতি মিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস গোপন করল। ফরিদের মা যাবে না। যে-কোনো কারণেই হােক রশিদ সাহেবের কাছে সে যেতে চায় না। রিলিফের গম এল একবার। সবাই গেল, ফুলজান গেল না। পা টেনে টেনে যেতে হলো মতি মিয়াকেই।
‘ও ফরিদের মা ।” ‘
কী কইবেন কেন?’
“যাইবা নাকি কাইল একবার রশিদ সাবের কাছে?”
“কম্বলের আমার দরকার নাই। শীত লাগে না আমার ।”
“তোমার না লাগলে কি, আমার তো লাগে।”
‘আপনের লাগলে আপনে যান’
' মতি মিয়া উঠে বসার চেষ্টা করে। ফরিদ শুয়ে আছে তার গা ঘেঁষে। সে অন্য রকম একটা উত্তেজনা অনুভব করে।
‘বুঝলা ফরিদের মা, আমার হক আছে। আমার ছেলে মরে নাই যুদ্ধে? কও তুমি, যুদ্ধে মরে নাই?"
“হেতো কতই মরছে।”
“সবের হক আছে। বুঝলা? কম্বল আমার হকের জিনিস।”
ফুলজান হাই তুলে কুপি হাতে রান্নাঘরে ঢুকল। বাতি নিভে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। রাত কতটা বাকি কে জানে? মতি মিয়ার প্রস্রাবের চাপ হয়েছে। শীতের মধ্যে উঠতে ইচ্ছা হচ্ছে না। প্রস্রাবের চাপ এমন এক জিনিস যা ক্ষিধের মতো হু-হু করে বাড়তে থাকে।
“ফরিদ ঘুমাইছস?”
'হুঁ।"
“ঘুমাইলে কথা কস ক্যামনেরে ছাগল?”
ফরিদ খুকখুক করে হাসে। মতি মিয়াও হাসে। বড় ভাল লাগে তার। বড় মায়া লাগে।
‘কাইল কম্বল আনতে যামু বুঝলি ফরিদ?'
‘আইচ্ছা।’
‘তুইও যাবি আমার সাথে। হকের কম্বল ঠিক না?’
‘‘হুঁ’
‘ফরিদ ঘুমাইছস?’
‘ঘুমাইছি।’
পেসাব করন দরকার।
মতি মিয়া চিন্তিত হয়ে পড়ে। এই প্রচন্ড শীতে উঠা সম্ভব নয়। কিন্তু ইতিমধ্যে তলপেটে ব্যথা শুরু হয়েছে। মাবুদে এলাহী, বুড়ো হওয়ার বড় কষ্ট।
‘ফরিদ ঘুমাইছস’
ফরিদ জবাব দেয় না। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয় । মতি মিয়া ঘুমন্ত ফরিদের সঙ্গেই কথাবার্তা চালাতে থাকে। কথাবার্তায় ব্যস্ত থাকলে মনটা অন্য দিকে থাকে । তলপেটের চাপের কথাটা মনে থাকে না ।
‘বুঝলি ফরিদ, ‘কাইল যামু রশিদ সাবের কাছে। তোর বাপের নাম কইলে না দিয়া উপায় নাই। বুঝছস? তুইও যাবি আমার সাথে। চুপ কইরা বইসা থাকবি ফাইজলামি বাদরামি করলে চড় খাইবি। বুঝছস?”
মতি মিয়া অনবরত কথা বলতে থাকে। কথা বলতে বড় ভালো লাগে তার।
সকালটা শুরু হয়েছে খুব চমৎকারভাবে। চনমনে রোদ উঠেছে। কুয়াশার চিহ্নমাত্র নেই। কে বলবে মাঘ মাসের সকাল । মতি মিয়া আয়েশ করে রোদে বসে আছে। বড় আরাম লাগছে।
ফুলজান ফরিদকে টিনের থালায় মুড়ি দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। এটা একটা ভালো লক্ষণ । এর মানে হচ্ছে ঘরে পান্তা নেই। যেদিন পান্তা থাকে না সেদিন দুপুরে ফরিদের মা গরম ভাতের ব্যবস্থা করে। আজও করবে। দুই-একগাল মুড়ি খেলে হতো। ফরিদ থালা নিয়ে ঘুরছে দূরে দূরে। মুড়ি শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাছে ভিড়বে না। মতি মিয়া ডাকল, “ওই ফরিদ, ওই। এদিকে আয় দাদা।” ফরিদ না শোনার ভান করল। মহা বজাত হয়েছে ছোকরা ।
ফুলজান দারোগা বাড়ি যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। দুপুরবেলা মনে করে এলে হয়। আসবে ঠিকই। মায়া-মহব্বত আছে মেয়েটার। ভালো মেয়ে।
“দারোগা বাড়ি যাও নাকি গো মা?”
হুঁ ।
“আইচ্ছা ঠিক আছে। যাও। রইদটা একটু তেজি আমিও যাইতাছি রশিদ সাবের কাছে।”
ফুলজান কোনো জবাব দিল না। মতি মিয়া ইতস্তত করে বলেই ফেলল, "চিড়া-মুড়ি কিছু আছে? শইলডা জানি কেমন কেমন লাগে।
চিড়া -মুডি কিছু নাই।
“ঠিক আছে। অসুবিধা নাই। তুমি যাও”
রোদটা এত আরামের যে উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত ইচ্ছা হয় না। তবু মতি মিয়া উঠল। রশিদ সাহেবের কাছে যাওয়া দরকার । মতি মিয়ার মন বলছে আজ গেলে কিছু-একটা হবে। না হয়েই পারে না।
‘আয়রে ফরিদ ।”
ফরিদ তার থালার মুড়ির শেষ দানাটি মুখে ফেলে দাদার হাত ধরল। চিকন গলায় বলল, “কোলে নাও’ কোলে নেবার বয়স কি আছে মতি মিয়ার? তবু সে ফরিদকে কোলে নিল। কিছুদূর নিয়ে নামিয়ে দিলেই হবে। পুলাপান মানুষ, একটা শখ হয়েছে।
রশিদ সাহেব সোহাগীর সি.ও. রেভিন্যু ।
লোকটি ছোটখাট । তাঁকে দেখেই মনে হয় সবার উপর বিরক্ত হয়ে আছেন। ভুরু না কুঁচকে তিনি কারো দিকে তাকাতে পারেন না। কম্বলের প্রসঙ্গে তাঁর কোনাে ভাবান্তর হলো না।
তিনি অফিসের উঠোনে একটা চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিলেন। চায়ের কাপ থেকে দৃষ্টি সরালেন না। মতি মিয়া দ্বিতীয়বার বলল, “শীতে বড় কষ্ট পাইতেছি।”
রশিদ সাহেব সে কথারও কোনো জবাব দিলেন না। শুকনো চোখে তাকিয়ে রইলেন। মতি মিয়া ভেবে পেল না কথাগুলি কীভাবে বললে শীতের কষ্টটা পরিস্কার বুঝা যাবে। রশিদ সাহেব কম্বলের প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে এলেন, নিরাসক্ত গলায় বললেন, “এই ছেলে কে?”
'জি, আমার নাতি। মেছের আলির ছেলে।”
'কার ছেলে ?”
“মেছের আলির। মেছের আলিরে চিনলেন না, যুদ্ধ করল যে মেছের আলি।”
রশিদ সাহেব বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। তিনি চিনেছেন। মতি মিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল। এই লোকটা বিরক্ত হচ্ছে কেন? তার ছেলের কথায় বিরক্ত হওয়ার কি আছে?
গত বছর রিলিফের গম এল। মতি মিয়া গম আনতে গিয়ে বলল, “চিনছেন তো আমারে? আমি মেছের আলির বাপ । যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গেল যে মেছের আলি।”
চ্যাংড়া মতো একটি অপরিচিত ছেলে গম দিচ্ছিল। সে চােখ-মুখ শক্ত করে বলল, “মেছের আলির জন্যেও গম দেয়া লাগবে? সেও রুটি খাবে?” লাইনে দাড়িয়ে থাকা সবাই হেসে উঠল। যেন এ রকম মজার কথা ওরা বহুদিন শুনে নাই।
রশিদ সাহেব বিরক্ত হচ্ছেন। কিংবা কে জানে হয়তো রেগেও যাচ্ছেন। অফিসার মানুষ। রেগে গেলে প্রথম দিকে বোঝা যায় না। তারা রাগ চেপে রাখে। চোঁচামেচি হইচই শুরু করে ছোট লোকেরা। মতি মিয়ার মতো মানুষরা।
মতি মিয়া গলা পরিস্কার করে বললো ‘জবর যুদ্ধ করেছিলো মেছের আলী। নীলগঞ্জে একটা সড়কের তারা নামে দিছে ’মেছের আলি সড়ক।” নীলগঞ্জ হইল গিয়া আপনার এইখান থাইক্যা।
“চিনি, নীলগঞ্জ কোথায় চিনি।
রশিদ সাহেবের ভূরু কুচকানো। মতি মিয়া চুপ করে গেল। বেলা অনেক হয়েছে। পেটের ক্ষিদে জানান দিচ্ছে। মুখ ভর্তি করে থুথু জমা হচ্ছে। রশিদ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন নির্লিপ্ত গলায় বললেন, ‘দাঁড়ান আপনি, একটা কম্বলের ব্যবস্থা করছি। চা খাবেন?”
মতি মিয়ার চোখে পানি এসে গেল। বলে কি এই লোক? মতি মিয়া চোখ মুছল। ধরা গলায় বলল, 'গত বৎসর বড় কষ্ট করেছি জনাব। দানাপানি নাই। শেষে ফরিদের মা কইল, বুধবারের বাজারে একটা থালা লইয়া বসেন। বসলাম গিয়া। নিজ গেরামের বাজারে ভিক্ষা করা শরমের কথা। বড় শরমের মধ্যে ছিলাম জনাব।'
মতি মিয়া ক্রমাগত চোখ মুছতে লাগল। ফরিদ তাকিয়ে আছে। সে বড়ই অবাক হয়েছে।
রশিদ সাহেব শুধু যে কম্বল দিয়েছেন তাই না, পঞ্চাশটি টাকাও দিয়েছেন। সেই টাকার খানিকটা ভাঙিয়ে মতি মিয়া চা ও চিনি কিনে ফেলল। ফরিদকে বলল, “বুড়াকালে চা-টা খুব দরকার। বুকে কফ জমে না। ভালো ঘুম হয়।
বুঝলিরে বেকুব । বুড়াকালে চা হইল গিয়া অষুধ ।”
তারা দু'জন সাড়া দুপুর বাজারে ঘুরল। মতি মিয়া পরিচিত সবাইকেই নতুন কম্বল দেখাল। তার গাল ভর্তি হাসি, ‘মেছের আলির কারণে পাইলাম, বুঝলা না? মেছেরের নাম কইতেই মন্ত্রের মতো কাম হইল। বিলাতি জিনিস, হাত দিয়া দেখ । জবর ওম । চাইর পাঁচ শ” টেকা দাম হইব, কি কও?’
মতি মিয়ার মনে ক্ষীণ আশঙ্কা ছিল ফরিদের মা কম্বলটা হয়তো নিজের জন্যে দাবি করবে। মেছের আলির কম্বলে ওদের দাবিই তো বেশি। কিন্তু তা সে করল না। চকচকে নতুন কম্বলের প্রতি তার কোনো রকম আগ্রহ দেখা গেল না। যথারীতি ফরিদকে নিয়ে রান্নাঘরে ঘুমুতে গেল। দীর্ঘদিন পর আরাম করে ঘুমুতে গেল মতি মিয়া। এত আরাম যে চট করে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে না। জেগে গল্প করতে ইচ্ছা করে।
“ফরিদের মা, ঘুমাইলা নাকি?’
না।
জবর ওম কম্বলটার মইধ্যে। বিলাতী জিনিস তো। বিলাতী জিনিসের ওম অন্য রকম। ভালো ঘুম হইব।”
‘ঘুমান ভালো কইরা।’
“ফরিদের মা ।”
“কন কি!”
মেছেরের কথা কইতেই রশিদ সাব খুব ইজ্জত করল । চা খাওয়াইল । শরিফ আদমী ।
ফুলজান জবাব দিল না। মতি মিয়া বলল, “ফরিদরে দিয়া যাও, আমার সাথে বাপের কম্বলের নীচে ঘুমাউক।” ফুলজান সে কথারও জবাব দিল না। ঘুমিয়ে পডেছে নাকি।
গভীর তৃপ্তিতে ঘুমাবার আয়োজন করল মতি মিয়া। ছেলের প্রতি গাঢ় কৃতজ্ঞতায় তার মন ভরে যাচ্ছে। বড় শান্তি লাগছে। ঘুমের মধ্যেই সে শুনল, ফুলজান কাঁদছে। সে প্রায়ই কান্দে। তার কান্না শুনতে মতি মিয়ার কোনো কালেই ভালো লাগে না। কিন্তু আজ ভালো লাগছে। কেমন যেন গানের সুরের মতো সুর।
আরাম করে ঘুমায় মতি মিয়া। বাইরে প্রচণ্ড শীত। ঘন হয়ে কুয়াশা পড়ছে। উত্তর দিক থেকে বইছে ঠাণ্ডা হিমেল হাওয়া। -
0 মন্তব্যসমূহ