ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর নিবন্ধ - হুমায়ূন আহমেদ

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সূত্রপাত হইলেও বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ নাগাদ বাংলা কথাসাহিত্য, বলিলে অত্যূক্তি হইবে না, বেশ দৃঢ়মূল হইয়া উঠিয়াছিল। পরবর্তী পঞ্চাশ বত্সরে পরিলক্ষিত হয় নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কবিতার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকে (জন্ম-মৃত্যু সাল) অতিক্রমণ লইয়া তিরিশ এবং তিরিশোত্তর আধুনিক কবিদের রীতিমতো জবাবদিহি করিতে হইয়াছে; জগদীশ গুপ্ত (জন্ম-মৃত্যু সাল) বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে (জন্ম-মৃত্যু সাল) এইরূপ বিড়ম্বনার সম্মুখীন হইতে হয় নাই। তিরিশ এবং তিরিশোত্তর কবিদের ইউরোপীয় কবিদের পদাঙ্কানুসরণের অভিযোগের মুখোমুখি হইতে হইয়াছে।
এইরূপ অভিযোগের কাঠগড়ায় কথাসাহিত্যিকদের খুব একটা দাঁড়াইতে হয় নাই। অশ্লীলতার অপবাদ সহ্য করিতে হইয়াছে যদিও, তবে তাহাতে লেখকের কলম কিছুমাত্র বিচলিত হইয়াছিল এবংবিধ মনে হয় না। জীবনানন্দের তিরিশ-চল্লিশ লিখিত এবং সঙ্গোপনে রক্ষিত উপন্যাস ও গল্পগুলি পাঠ করিলে এমন এক লেখক সত্তা সম্পর্কে অবহিত হইতে হয় যিনি না ঐতিহ্য না প্রচল শিল্পরীতি না পাঠকানুগ্রহের কিছুমাত্র তোয়াক্কা করিয়াছেন। বিংশ শতকের প্রথমার্ধে বাঙ্গালী কথাসাহিত্যিকদের শিরঃদাঁড়া যথেষ্ট দৃঢ় ও স্বাবলম্বী ছিল সন্দেহ নাই।
হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে লিখিতে গিয়া এই ভণিতাটুকু করিতে হইল এই কারণে যে, তাহাকে লইয়া সমসাময়িক বিদ্বত্সমাজের সবিশেষ অস্বস্তি রহিয়াছে। কিন্তু কবি জীবনানন্দ দাশ যেমন বাঙ্গালীর মাপে বড় লেখক তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিভূতিভূষণ, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি দূরের কথা আদৌ আন্তর্জাতিক তুলনার যোগ্য বলিয়াই গণ্য করেন নাই (বর্তমান বিদ্বত্সমাজে হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে ততটা নিঃসংশয় হইয়া তাহাকে বাতিল করিয়া দিতে পারিতেছেন না। এইখানেই সমস্যার বীজ থাকিয়া গিয়াছে।
হুমায়ূন আহমেদকে লইয়া অস্বস্তির কারণটি ঈর্ষাপ্রসূত বলিলে কাহিনীর মূলাংশ অকথিত রহিয়া যায়। প্রতীয়মান হয়, বিদ্বত্সমাজের জন্য হুমায়ূন আহমেদ একটি প্রবল ধাঁধা হইয়া আবির্ভূত হইয়াছেন। কেহ কেহ তাহাকে ‘জনপ্রিয় ধারার লেখক’ হিসেবে আখ্যায়িত করিয়া সংক্ষেপে মামলা চুুকাইয়া ফেলিতে তত্পর। কিন্তু তাহাতে ধন্দের নিরসন হয় নাই। কারণ হুমায়ূন আহমেদ যাহাই লিখিয়াছেন বাঙ্গালী পাঠক তাহাই সাদরে গ্রহণ করিয়াছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি জনপ্রিয়তার যে উত্তুঙ্গ দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন তাহা বিস্ময়কর। কিন্তু কেন এই নিবিড় ও পরিব্যাপ্ত জনপ্রিয়তা তাহার কার্যকারণ সূত্রগুলি অদ্যাবধি কোন সহূদয় ও যোগ্য সমালোচকের হাতে নিরূপিত হয় নাই। যতদিন এই রহস্যের উম্মোচন না হইবে ততদিন কথাসহিত্যিক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের প্রকৃত মূল্যমান নির্ণীত হইবার আশা দূরাশাই থাকিয়া যাইবে। আশঙ্কা হয়, এই সমস্যায় জীবনানন্দ দাশের গল্প-উপন্যাসকেও নিপতিত হইতে হইবে; আর রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম তো ঐ সমস্যারই নিগড়ে অদ্যাবধি বন্দি রহিয়াছেন।
হুমায়ূন আহমেদ কী করিয়া বাঙ্গালী পাঠক সমাজের মর্মমূলে পৌঁছিয়া গিয়াছিলেন অদ্যকার ক্ষুদ্র পরিসর সেই রহস্য উন্মোচনের প্রচেষ্টার সুযোগ প্রশস্ত নহে। তবে উপস্থিত এই প্রসঙ্গে দুই-একটি কথা বলা অসঙ্গত হইবে না। পাঠক জানেন, হুমায়ূন আহমেদ সেই বিরল প্রজাতির সাহিত্যিক, যিনি সমসাময়িক মানবজীবনের গল্পকেই তাহার রচনার উপজীব্য করিয়াছেন। যে জীবন সম্পর্কে পাঠক সম্যক অবহিত সেই জীবনের কাহিনীই তিনি পাঠককে শুনাইয়াছেন। এবং পাঠক সেই কাহিনী সানন্দে গ্রহণ করিয়া আনন্দিত হইয়াছেন। তিনি কখনই পূরাণের দ্বারস্থ হন নাই, শাসকবর্গ বা রাজনীতি লইয়া মাথা ঘামান নাই। জীবনের শেষভাগে কখনো কখনো তিনি ইতিহাসের কাহিনী অবলম্বন করিয়াছেন বটে, কিন্তু তাহা শুদ্ধ অবলম্বনই বটে (তিনি ইতিহাস রচনা করেন নাই। মানুষই তাহার উপজীব্য, মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচরণ ও সুখ-দুঃখর বয়ানই তাহার গল্প কিংবা উপন্যাস। তাহার রচনায় গল্প ও উপন্যাসের ভেদ নিরূপণ করা কঠিন যদি না কলেবর প্রধান নিয়ামক গণ্য হয়। তাহার কাহিনী মানুষের মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়া গ্রন্থিত হইয়া ওঠে; যেন লেখক একটি দাবার ছকে গুটিগুলি সাজাইয়া দিয়া সটকিয়া পড়িয়াছেন; অতঃপর লেখকসৃষ্ট বিভিন্নরূপ চরিত্রসমূহের জীবনযাপনের স্বাভাবিক মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়া আখ্যানভাগ গড়িয়া উঠিয়াছে। এই জন্য লেখকের বয়ান সংকীর্ণ, অন্যদিকে সংলাপ লাভ করিয়াছে প্রাধান্য। সংলাপের প্রাধান্যে ক্ষুদ্র পরিসরেই বিশদ বর্ণনার কার্যসমাধা হইয়াছে। কার্যত তাহার রচনা যেন ‘আনা কারেননিনা’ বা ‘ব্রাদার্স করমাচভ’, বা হালের ‘নেইম অব রোজ’ বা ‘ফুুকো’স প্লেলাম’-এর মেদবর্জিত চিত্রনাট্য।
ইহা একটি অসাধারণ ঘটনা যে আহমদ শরীফের মতো সাহিত্যের পণ্ডিত হুমায়ূন আহমেদের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসের ভূমিকা লিখিয়াছেন। 
কীরূপ প্রেরণা হইতে হুমায়ূন আহমেদ গল্প-উপন্যাস লিখিয়াছেন সেই প্রশ্ন সঙ্গতভাবেই উত্থাপিত হইতে পারে। কেননা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হইতে শুরু করিয়া শতাধিককাল যাবত্ উপন্যাসের মধ্যে অহরহ যে প্রকট উদ্দেশ্যমূলকতা প্রত্যক্ষ হয় হুমায়ূন আহমেদের রচনায় তা পূর্বাপর অনুপস্থিত। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাহার রচনায় কার্যত সমাজসংস্কারকের ভূমিকা পালন করিয়াছেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ কখনই ‘আমি বাংলাদেশের নীতিহীন রাজনীতিবিদদের স্বরূপ উন্মোচন করিব’ কিংবা ‘এই উপন্যাসে নূরজাহানের ঘটনাকে আশ্রয় করিয়া মৌলবাদ ও ফতোয়াবাজির চিত্র তুলিয়া ধরিব’ এই রকম কোনো প্রতিজ্ঞা নিয়ে কখনই লিখিতে বসেন নাই। তথাপি বিংশ শতাব্দীর শেষ এবং ঊনবিংশ শতকের নাগরিক ও গ্রামীণ উভয়বিধ মানুষের জীবনই তাহার উপজীব্য। সমাজ সংস্কার বা নৈতিকতার প্রচার সাহিত্যের কাজ কিনা সেই প্রশ্ন শত বত্সর যাবত্ উত্থাপিত হইয়াছে। কিন্তু বস্তুত মানুষ নানা প্রকার এবং একই সঙ্গে সততা ও শঠতাকে সমানভাবে ধারণ করিতে পারে। এই সত্য হুমায়ূন আহমদ প্রশ্রয়ের সহিত গ্রহণ করিয়াছেন। পাঠক জানেন, চরিত্র নির্মাণে হুমায়ূন আহমেদ কখনো মানুষকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিতে পছন্দ করেন নাই; কে আসামি আর কে সাধু তাহার সিদ্ধান্ত পাঠকের এখতিয়ারেই রহিয়া গিয়াছে। কর্ম-অপকর্ম নির্বিশেষে মানুষের প্রতি হুমায়ূন আহমেদের যে মমত্ববোধ তাহা বিশ্বসাহিত্যে অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত।
উপন্যাসে আমরা কাহিনী ও চরিত্রের ধারাবাহিক বিস্তারে অভ্যস্ত। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সমান্বয়ী ভঙ্গিতে রাঢ় অঞ্চলের মানুষের জীবনচিত্র চিত্রায়িত করিয়াছেন। সাধারণত মূল কোনো একটি চরিত্রকে কেন্দ্র করিয়াই আবর্তিত হয় আখ্যানভাগ ইংরেজিভাষী সাহিত্যবিদরা যাহাকে প্রোটাগনিস্ট বলিয়া থাকেন। মিসির আলী বা হিমু শ্রেণীর উপন্যাসগুলি বাদ দিলে, কিংবা বাদ না দিলেও, হুমায়ূন আহমেদের প্রতিটি উপন্যাসই বহুকেন্দ্রিক বিবরণী, যাহা লেখক নির্বাচিত কয়েকটি ঘটনার সমন্বয়ে গড়িয়া উঠিয়াছে। মূলত চরিত্রচিত্রণের মধ্য দিয়াই হুমায়ূন আহমেদ তাহার আখ্যান আকর্ষণীয় করিয়া তুলিয়াছেন।
মানব মনের জটিল ও রহস্যময় দিকের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিবার লক্ষ্যেই লেখক নানাবিধ চরিত্র সৃষ্টি করিয়া থাকেন। লেখকরা সাধারণত এই জটিলতার ব্যাখ্যা দিতে অভ্যস্ত; তাঁহারা ঘটনার কার্যকারণ অনুসন্ধানে আগ্রহী। —তাহাতে মননশীলতার স্বাক্ষর রচিত হয়, রচনার পরিধি বাড়ে। হুমায়ূন আহমেদ এ দায়িত্বটি পাঠকের জন্য নিরঙ্কুশভাবে সংরক্ষণ করিয়াছেন। অন্যদিকে ঘটনার ময়নাতদন্তে না-গিয়া তিনি সেই সব ঘটনা  উত্থাপন করিয়াছেন যেইগুলি পূর্বজদের রচনায় স্থান লাভ করে নাই। ফলে তাঁর গল্প হইয়াছে অভিনব। এই সব গল্পে দর্শন আছে, দার্শনিকতা নেই। তাহার সাহিত্য কোনো বিশেষ বক্তব্য প্রতিষ্ঠার জন্য লেখা হয় নাই। লেখকের বিশেষ কোনো দর্শনোপলব্ধিও পরিদৃষ্ট হয় না, কোনো বানোয়াট জীবনজিজ্ঞাসার ভারে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য ভারাক্রান্ত নহে। এই লেখক কখনই স্বীয় জীবন জিজ্ঞাসা বা স্বীয় দর্শনকে পাঠকের সম্মুখে উন্মুক্ত করেন নাই। তাই বলিয়া হুমায়ূন আহমদের কোনো উপন্যাসই ঘটনাসর্বস্ব গল্পাবর্ত মাত্র নহে। গল্পের গর্ভে মানবজীবন ও সভ্যতার গূঢ় প্রশ্নগুলিও যথাস্থান লাভ করিয়াছে।
দীর্ঘ রচনা হুমায়ূন আহমেদের ধাতে ছিল না। তাহার অধিকাংশ গ্রন্থই স্বল্পাবয়ব। ইহার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হলো স্বল্প পরিসরে চরিত্রচিত্রণের ক্ষমতা। ইনাইয়া-বিনাইয়া বর্ণনা তাঁঁর রচনায় পাওয়া যায় না। ঝটিতে মাত্র কয়েকটি বাক্যে একটি মানুষের ছবি তিনি পরিপূর্ণভাবে ফুটাইয়া তুলিতে পারেন। পাঁচ-সাতটি মোক্ষম সংলাপে ফুটিয়া ওঠে এক-একজন মানুষের চারিত্রিক প্রবণতা। পৃথিবীতে আর কোনো লেখক এত স্বল্প পরিসরে একটি মানব চরিত্র সুনির্দিষ্টভাবে নির্মাণ করিতে পারেন, এই রূপ উদাহরণ সহসা পরিদৃষ্ট হয় না।
পৃথিবী রূপ বুঝাইতে গিয়া কোনো চিত্রশিল্পী রঙ-তুলি লইয়া পুরো পৃথিবীর ছবি আঁকিতে বসিয়া যান না; সহস্র দৃশ্যপট হইতে বাছাই করিয়া তিনি কয়েকটি দৃশ্যপট তৈরি করেনমাত্র। এইখানে তাহার বিবেচনাবোধ ফুটিয়া ওঠে। এই বিচারে হুমায়ূন আহমেদের বিবেচনাবোধ অসাধারণ। উপন্যাসের আখ্যান নির্মাণে ঘটনা নির্বাচনে তাহার দক্ষতা প্রশ্নোর্ধ। বিভিন্ন ঘটনার পরিসর নিয়ন্ত্রণেও তাহার মনোযোগ সর্বদাই সযত্ন ও সতর্ক। ঘটনা গ্রহণ ও বর্জ্জনে তিনি অসামান্য দক্ষতার প্রমাণ দিয়া তাহার রচনার কলেবর নির্মেদ রাখিতে সমর্থ হইয়াছেন। বাস্তবতা সঙ্গে অসম্ভবের সন্ধি হুমায়ূন আহমদের প্রিয় কৌশল। যাকে আমরা জাদু বাস্তবতা বলতে অভ্যস্ত হুমায়ূন আহমদ তার দক্ষ কারিগর। তাঁর বিভিন্ন গল্পে আমরা লক্ষ করি অসম্ভবের বহুবর্ণ উপস্থিতি। অতুলনীয় বিশ্বাসযোগ্যতা লইয়া হুমায়ূন আহমেদ বয়ান করিয়াছেন মানুষের অভিজ্ঞতা, কল্পনা, বিশ্বাস ও চিন্তার ভারসাম্যমণ্ডিত সংশ্লেষ। কখনো কখনো অতিলৌকিক ও অতিপ্রাকৃতিক ঘটনাবলি রহস্যের ঘেরাটোপে বন্দি ঘটনাও তাহার লেখনীতে বিশ্বাসযোগ্যতার লাভ করিয়াছে।
যদিও পাঠকের মনোরঞ্জনই গল্পকার হুমায়ূন আহমেদের প্রধান লক্ষ্য, তবু সমাজের সর্বপ্রকার চালচিত্র হুমায়ূন আহমেদের গল্পে স্থান লাভ করেছে। সর্বপ্রকার মানবচরিত্র ভূমিকা রাখিয়াছে তাঁর গল্পের মানচিত্রে। ব্যাপক অভিজ্ঞতার সঙ্গে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও কল্পনাশক্তি যুক্ত হওয়ার ফলে তাঁর চরিত্রগুলো সর্বদাই কৌতূহলোদ্দীপক। এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য যে সমাজ ও মানুষের সঙ্গে এই লেখকের সম্পর্ক নির্বিরোধী। ফলে চরিত্রচিত্রণে তাঁর নিঃসক্ত অবস্থান স্পষ্ট। তাঁর রচনায় পাঁকের ছবি থেকে পদ্ম বাদ পড়ে যায় না। হুমায়ূন আহমেদের মানুষেরা ‘ভালো-মন্দ সকলি মিলায়ে’ মানুষ। চরিত্রচিত্রণে তিনি রাজনীতি করেন না; সাহিত্যের মানুষদের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের সম্পর্ক অরাজনৈতিক। প্রতিহিংসাপরায়ণতা বা বিদ্বেষের চরিতার্থতায় ব্যবহূত হয়নি তাঁর কলম। লেখকের রাজনীতি শিল্পবিরোধী। হুমায়ূন আহমদের গল্পে সকল চরিত্র সমান গুরুত্ব লাভ করে যেমনটি আমরা দেখি মিলন কুণ্ডেরার উপন্যাসে।
মধ্যাহ্নহুমায়ূন আহমেদের অন্যতম প্রধান কীর্তি
মধ্যাহ্ন দূর অতীতের আবহে লালিত। এ উপন্যাসের কাঠামোয় তিনি একটি ঐতিহাসিক পটভূমিকে পরোক্ষে আশ্রয় করিয়াছেন। ঐতিহাসিক উপন্যাস সচরাচর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা কেন্দ্র ক’রে আবর্তিত হয়। সেই অর্থে মধ্যাহ্ন কোনো ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। এ উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ তার জন্মপূর্ববর্তী একটি বিশেষ কালখণ্ড পুনর্নির্মাণ করার প্রয়াস পেয়েছেন মাত্র। ইতিহাস ঝুলে আছে সময় রেখার মতো, নিছকই মঞ্চের বাইরে, যদিও বেশকিছু চরিত্র বাস্তব। মধ্যাহ্নে ইতিহাস আছে, ঐতিহাসিকতা নেই। ঐতিহাসিক পটভূমি নির্মাণের জন্য হুমায়ূন আহমেদ বাছিয়া লইয়াছেন বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের বাংলাদেশের নেত্রকোনা এলাকা। ১৯০৫-এ কাহিনী শুরু হয়েছে বান্ধবপুর নিবাসী সফল ও সত্ ব্যবসায়ী হরিচরণ সাহাকে লইয়া যিনি মুসলমান একটি বালককে আদর করার দোষে সমাজচ্যুত হন এবং পরবর্তীতে ঋষিসুলভ জীবন বাছিয়া লন। এর পর একে-একে যুক্ত হয়েছে এলাকার ব্রাহ্মণ অম্বিকা ভট্টাচার্য ঘটনাক্রমে মুসলমান হ’তে হ’লে যার নাম হয় সিরাজুল ইসলাম ঠাকুর; কাঠমিস্ত্রি সুলেমান; সুলেমানের রূপবতী জুলেখা তালাকের পর যে আশ্রয় নেয় বেশ্যাপল্লীতে যদিও শেষাবধি কোলকাতায় গিয়ে সে চানবিবি নামে সুকণ্ঠি গায়িকা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে; সুলেমানের রূপবান পুত্র জহির; সোনাদিয়ার জমিদার বাবু শশাংক পাল; অন্যতম সমাজপতি ন্যায়রত্ন রামনিধি চট্টোপাধ্যায়; শল্লার দশআনির মুসলমান জমিদার নেয়ামত হোসেন এবং তার অর্থে নির্মিত জুম্মাঘরের ইমাম মাওলানা ইদরিস; সোনাগঞ্জ লঞ্চঘাটের টিকেটবাবু ধনু শেখ পরবর্তীতে যে হয় লঞ্চের মালিক, জমিদার এবং বিপ্লবী জীবনলালকে ধরাইয়া দিয়া লাভ করে ব্রিটিশরাজের দেয়া খানসাহেব উপাধি; কলিকাতা প্রবাসী মণিশংকর দেওয়ান; স্বদেশী-করা যুবক শশী ভট্টাচার্য যার প্রকৃত নাম কিরণ গোস্বামী এবং তাঁর সতীর্থ জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়; কবিরাজ সতীশ ভট্টাচার্যের কন্যা যমুনা যাকে ধর্ষণের কারণে সমাজপতিরা বেশ্যালয়ে আশ্রয় গ্রহণের বিধান দেন; অদূরবর্তী সোহাগগঞ্জ বাজারের রঙিলা নটিবাড়ির মালেকাইন সরযুবালা; মোহনগঞ্জের বরান্তর গ্রামের মসজিদের ইমাম এবং গায়ক আব্দুল হক যার ডাকনাম উকিল মুনসি ও তার নিঃসন্তান স্ত্রী ‘লাবুসের মা’; মোহনগঞ্জের বাম গ্রামের বিদ্বান মানুষ শৈলজারঞ্জন মজুমদার এবং সর্বশেষে জোড়াসাঁকোর ব্রাহ্ম জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি গান লেখেন, গানে সুর দেন। অনুপস্থিত থাকিয়াও ভূমিকা রেখেছে হরিচরণ সাহার কন্যা শিউলি— সে শৈশবে পুকুরে ডুবে মারা গিয়াছিল।
উপন্যাসে আমরা কাহিনী ও চরিত্রের ধারাবাহিক বিস্তারে অভ্যস্ত। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সমান্বয়ী ভঙ্গিতে রাঢ় অঞ্চলের মানুষের জীবনচিত্র চিত্রায়িত করেছেন। সাধারণত মূল কোনো একটি চরিত্রকে কেন্দ্র ক’রে আবর্তিত হয় আখ্যানভাগ ইংরেজিভাষী সাহিত্যবিদরা যাকে বলেন প্রোটাগনিস্ট। অন্যদিকে হুমায়ূন আহমেদের অন্যসব উপন্যাসের মতোই মধ্যাহ্ন একটি বহুকেন্দ্রিক বিবরণী যার মধ্যে লেখকের দৃষ্টি কেবল কয়েকটি ঘটনার ওপর আলো ফেলে গেছে। ফলে মধ্যাহ্ন যাকে বলে একটি বিশেষ জনপদের আলেখ্য সে রকম কোনো ঐতিহাসিক দলিলে পর্যবসিত হয়নি। হুমায়ূন আহমদের অন্যান্য রচনার মতোই মধ্যাহ্ন কয়েকটি মানব চরিত্রের একটি উপভোগ্য উপাখ্যান। কোনো বিশেষ বক্তব্য প্রতিষ্ঠার জন্য এটি লেখা হয়নি, লেখক কোনো বিশেষ দর্শনোপলব্ধি থেকেও এটি লিখেছেন এমন ভাবার কারণ পরিদৃষ্ট হয় না, কোনো বানোয়াট জীবনজিজ্ঞাসার ভারে মধ্যাহ্ন ভারাক্রান্ত নয়। 
একথা বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে, মধ্যাহ্ন একটি ঘটনা সর্বস্ব গল্পাবর্ত মাত্র। হরিচরণ সাহার ঋষি সুলভ চারিত্র্যের বিপরীতে জমিদার শশাংক পালের ভোগবাদিতা বা মাওলানা ইদরিসের নিষ্কলুষ ব্যক্তিমানসের বিপরীতে ধুরন্ধর ধনু শেখের নির্লজ্জতা ও শঠতার তুলনা অনেক প্রশ্ন ঘনিয়ে আনে। তালাকের পর কাঠমিস্ত্রি সুলেমানের স্ত্রী জুলেখা বাপের বাড়ি না গিয়ে বারবনিতার জীবন বাছিয়া নেয়। তার এই কঠিন অথচ অকাতর সিদ্ধান্ত মানবমনের জটিল ও রহস্যময় দিকের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে, পাঠককে ভাবিত করে। লেখকেরা এই সাধারণত এই জটিলতার ব্যাখ্যা দিতে অভ্যস্ত; তাঁরা ঘটনার কার্যকারণ অনুসন্ধানে আগ্রহী। তাতে মননশীলতার স্বাক্ষর রচিত হয়, রচনার পরিধি বাড়িয়া যায়। হুমায়ূন আহমেদ এই দায়িত্বটি পাঠকের জন্য নিরঙ্কুশভাবে সংরক্ষণ করিয়াছেন। ঘটনার অনুসন্ধানে না গিয়ে তিনি সেই সব ঘটনা টেনে আনেন, যা পূর্বজদের রচনায় স্থান লাভ করেনি। ফলে তাঁর গল্প অভিনব এবং এ গল্পে দর্শন আছে, দার্শনিকতা নাই। কবি নিজের কথা বলেন, গল্পকার অন্যের কথা। মাওলানা ইদরিসের ধার্মিক চরিত্রে পাঠক সহজেই হুমায়ূন আহমেদের নিরঞ্জন-অনিরঞ্জন ঐশ্বরিকতার হদিশ পাইয়া যাবেন। কিন্তু লেখক সর্বদাই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছেন যদিও সহনুভূতির কোমল স্নিগ্ধতায় মাওলানা ইদরিসের কাহিনী আর্দ্র।
দীর্ঘ রচনা হুমায়ূন আহমেদের ধাতে নেই; তার অধিকাংশ বই স্বল্পাবয়ব। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হলো স্বল্প পরিসরে চরিত্রচিত্রণের ক্ষমতা। ইনিয়ে-বিনিয়ে বর্ণনা তাঁর রচনায় পাওয়া যায় না। ঝটিতে মাত্র কয়েকটি বাক্যে একটি মানুষের ছবি তিনি পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তুলিতে পারেন। পাঁচ-সাতটি মোক্ষম সংলাপে ফুটে ওঠে একটি মানুষের চারিত্রিক প্রবণতা। পৃথিবীতে আর কোনো লেখক এত স্বল্প পরিসরে কোনো মানব চরিত্র সুনির্দিষ্টভাবে দাঁড় করাতে পারেন এমন উদাহরণ সহসা খুঁজে পাওয়া যায় না।
হুমায়ূন আহমেদের তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ রচনাগুলোয় কাঠামোর শৃঙ্খলা আনুপূর্ব রক্ষিত হয় না। এই উপন্যাসে তিনি ব্যতিক্রমী। মধ্যাহ্নের গাঁথুনি আনুপূর্ব দৃঢ়; অভিন্ন একটি ছন্দ কাহিনী প্রবাহে সৌষাম্য রক্ষা করেছে, যা যে-কোনো বড় মাপের রচনার অন্যতম শর্ত। বিভিন্ন ঘটনার পরিসর নিয়ন্ত্রণ করেছেন তিনি সযত্ন মনোযোগে। ঘটনাবলির পরম্পরা রক্ষিত হয়েছে স্বাভাবিক ধারাবাহিকতায়। ঘটনা গ্রহণ ও বর্জ্জনে তিনি অসামান্য দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন। পৃথিবী রূপ বোঝানোর জন্য শিল্পী রঙ-তুলি নিয়ে পুরো পৃথিবীর ছবি আঁকতে বসেন না; সহস্র দৃশ্যপট থেকে বাছাই ক’রে তিনি কয়েকটি দৃশ্যপট তৈরি করেন মাত্র। এইখানে তাঁর বিবেচনাবোধ ফুটিয়া ওঠে। এই নিরিখে হুমায়ূন আহমেদের বিবেচনাবোধ অসাধারণ। এই উপন্যাসে ঘটনা নির্বাচনের স্বাভাবিকতা প্রশ্নোর্ধ।
বাস্তবতার সঙ্গে অসম্ভবের সন্ধি হুমায়ূন আহমদের প্রিয় কৌশল। যাকে আমরা জাদু বাস্তবতা বলতে অভ্যস্ত হুমায়ূন আহমেদ তার দক্ষ কারিগর। তাঁর বিভিন্ন গল্পে আমরা লক্ষ্য করি অসম্ভবের বহুবর্ণ উপস্থিতি। অতুলনীয় বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ বয়ান করেন মানুষের অভিজ্ঞতা, কল্পনা, বিশ্বাস ও চিন্তার ভারসরাম্যমণ্ডিত সংশ্লেষ। যদিও মধ্যাহ্ন একটি ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস, তবু প্রিয় এই কৌশলটি সার্থকভাবেই প্রয়োগ করিয়াছেন লেখক এই রচনায়। অতিলৌকিক ও অতিপ্রাকৃতিক ঘটনাবলি রহস্যের ঘেরাটোপে বন্দি থেকেও বিশ্বাসযোগ্যতার জোরে স্বাভাবিক মনে হয়। তাঁর সৃষ্ট ঘটনাগুলো উপভোগ্য অথচ কষ্টকল্পনা কিংবা অপ্রাসঙ্গিকতার অভিযোগ দায়ের করার অবকাশ কখনো নাই।
যদিও পাঠকের মনোরঞ্জনই গল্পকার হুমায়ূন আহমেদের প্রধান লক্ষ্য, তবু সমাজের সর্বপ্রকার চালচিত্র হুমায়ূন আহমেদের গল্পে স্থান লাভ করেছে। সর্বপ্রকার মানবচরিত্র ভূমিকা রেখেছে তাঁর গল্পের মানচিত্রে। ব্যাপক অভিজ্ঞতার সঙ্গে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও কল্পনাশক্তি যুক্ত হওয়ার ফলে তাঁর চরিত্রগুলো সর্বদাই কৌতূহলোদ্দীপক। এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য যে সমাজ ও মানুষের সঙ্গে এই লেখকের সম্পর্ক নির্বিরোধী। ফলে চরিত্রচিত্রণে তাঁর নিঃসক্ত অবস্থান স্পষ্ট। তাঁর রচনায় পাঁকের ছবি থেকে পদ্ম বাদ পড়িয়া যায় নাই। হুমায়ূন আহমেদের মানুষেরা ‘ভালো-মন্দ সকলি মিলায়ে’ মানুষ। চরিত্রচিত্রণে তিনি রাজনীতি করেন না; সাহিত্যের মানুষদের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের সম্পর্ক অরাজনৈতিক। প্রতিহিংসাপরায়ণতা বা বিদ্বেষের চরিতার্থতায় ব্যবহূত হয়নি তাঁর কলম। লেখকের রাজনীতি শিল্পবিরোধী। হুমায়ূন আহমেদের গল্পে সকল চরিত্র সমান গুরুত্ব লাভ করে, যেমনটি আমরা দেখি মিলন কুণ্ডেরার উপন্যাসে।
মধ্যাহ্নে শেষে লেখা হয়েছে এটি ‘প্রথম খণ্ড’। আমরা অধীর আগ্রহে পরবর্তী খণ্ডের অপেক্ষায় থাকব। কেননা এই গ্রন্থ হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম প্রধান শিল্পকীর্তি হিসেবে স্বীকৃত হইবে। হুমায়ূন আহমেদ মূলত গল্পকার। ‘ঔপন্যাসিক’ বা ‘কথাসাহিত্যিক’ কোনো অভিধাই তাকে যথাযথভাবে ব্যক্ত করে না যতটা ক’রে ‘গল্পকার’ অভিধাটি। তবে বিশ্বাস হয় মধ্যাহ্ন তাঁর ঔপন্যাসিক অভিধাটিকে ন্যায্য ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হইবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ