রমাপদ চৌধুরী না লিখে লেখক। ঠিক এই কথাটাই শুনতাম সেই তিরিশ বছর আগে। তখন তিনি ষাটের কাছে পিঠে। বছরে একটি উপন্যাস। সেই উপন্যাস কখনো খারিজ, কখনো রূপ কখনো অভিমন্যু বা বাড়ি বদলে যায়। রমাপদ চৌধুরীই একমাত্র লেখক যিনি ঘোষণা করে লেখা থামিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি কোনো সভায় যান না।
টেলিভিশনে তাঁর মুখ কেঁউ দেখেছে বলে জানি না। বিদেশ ভ্রমণের আমন্ত্রণ সযত্নে ফিরিয়েছেন। তরুণ লেখকদের পছন্দ করতেন। এখন তিনি ৯১ পার। রমাপদ চৌধুরীর একটি গল্প ‘ভারতবর্ষ’ তাঁকে চিনিয়ে দিয়েছিল তাঁর আরম্ভের দিনে, সেই ষাট বাষট্টি বছর আগে। খড়গপুর রেল কলোনিতে বড় হওয়া রমাপদ চৌধুরীর কাছে শুনেছি সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কথা, এই কলকাতা শহর, সেই রেল কলোনি, মার্কিন সোলজার, নিষ্প্রদীপ রাত্রির কথা। ভারতবর্ষ গল্পটি একটি অখ্যাত হল্ট স্টেশন আন্ডা হল্টের কথা। সেইখানে মার্কিন সোলজারে ভর্তি ট্রেন এসে দাঁড়াত। তারা প্রাতরাশের জন্য নামত গাড়ি থেকে। আন্ডা দিয়ে ব্রেক ফাস্ট তাই আন্ডা হল্ট। কাঁটা তারের ওপারে ভারতবর্ষ। মাহাতোদের গ্রাম। তাদের খেত-খামার। ঋজু মেরুদন্ডের মাহাতো পুরুষ রমনীরা চাষবাস আর ফসল নিয়ে বেঁচে থাকত। এইভাবে বেঁচে থাকা মানুষগুলিকে ভিখিরি করে দেওয়ার গল্প ভারতবর্ষ। অনুদান, সাহায্য যে কীভাবে একটি জনজাতি একটি দেশের মেরুদন্ডকে বাঁকিয়ে দেয়, ভিখিরি করে দেয়, সেই গল্পই ভারতবর্ষ। সেই গল্পই বহুদিন ধরে টিকে থাকে যে গল্প সময় থেকে সময়ান্তরে গিয়েও প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকে। রমাপদ চৌধুরীর ভারতবর্ষ গল্পটি তেমন। এই গল্পের নানা মাত্রা। দেশটা সেই যে আন্ডা হল্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল হাত বাড়িয়ে, সেই হাত তো নামে নি এখনো। নামবে না কখনো। উচ্ছিষ্টের লোভে মানুষ তো হাত বাড়িয়েই আছে। ভারতবর্ষ শুধু এই ভারতবর্ষের গল্প নয়, এই গল্প গোটা তৃতীয় বিশ্বের হয়ে গেছে। আমি অপেক্ষাকৃত অপরিচিত গল্প পোস্ট মরটেমের কথা বলছি। এই গল্প একটি আত্মহত্যার। সতীশবাবু নিপাট এক মধ্যবিত্ত মানুষ, সকালে শুনলেন প্রতিবেশী ধনঞ্জয়বাবু আত্মহত্যা করেছেন। যে মানুষটির সঙ্গে গতকালও দেখা হয়েছে, দুদিন আগে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন অনেকসময় ধরে, সেই মানুষটি গলায় দড়ি দিয়ে মরেছেন। আর এক প্রতিবেশী ব্যানারজিবাবুকে ডেকে সতীশবাবু বেরোলেন। ধনঞ্জয়বাবুর লাল বাড়িটির সামনে স্বাভাবিক জটলা। আশপাশের কৌতুহলী মানুষজন, নানা প্রতিবেশী জড়ো হয়েছেন, লোকটি কেন আত্মহত্যা করল তা খুঁজে বের করতেই যেন তাঁর বাড়ির সামনে জটলা করা। একে অন্যকে নিজের অনুমানের কথা বলছে, মন্তব্যের উপর মন্তব্য নিয়েই এই গল্প। গল্প নয় মধ্যবিত্তের ভিতরের চেহারাটা একটু একটু করে উন্মোচন করা। একটি কঠিন মৃত্যুকে ঘিরে নানা রসের সন্ধান। রমাপদ চৌধুরীর গল্পে উপন্যাসে, মানুষের ভিতরের হাড় কঙ্কাল বেরিয়ে আসে। সত্য উন্মোচনে তিনি অতি নির্মম। ভারতবর্ষ গল্পে যে মাহাতো বুড়ো প্রত্যাখ্যান করতে করতে মাথা উঁচু রেখেছিল, সেই বুড়োই শেষ পযর্ন্ত, বকশিস বকশিস বলে চিৎকার করে ওঠে। যে মাহাতো বুড়োকে নিয়ে ভারতবর্ষ তার মাথা উঁচু করে রেখেছিল, সেই মাহাতো বুড়োই গোটা দেশটাকে ভিখিরি বানিয়ে দেয়। পোস্ট মরটেম গল্পে গলায় দড়ি দিয়ে মরা ধনঞ্জয়বাবুর বাড়ির সামনে যাঁরা সক্কালে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁরা নিরাপত্তার বৃত্তে থাকা মধ্যবয়স্ক পুরুষ, একটু করে খোলস ছেড়ে বেরোচ্ছে। তাদের ভিতরে এই মৃত্যুর কারণ খোঁজায় কাজ করছে এক ধরণের তৃপ্তি। তাঁরা বেঁচে আছেন, একটি লোক আত্মহত্যা করেছে, আত্মহত্যা আসলে লুনাসি ছাড়া কিছু নয়, ব্যানারজির কথায় সতীশবাবু না করেন। আসলে কার যে কী হয়, কোথায় লাগে কেউ জানে না । এঁদের কথা শুনতে শুনতে একটি যুবক বলে ওঠে, আসলে কারোর তো এই অভিজ্ঞতা নেই। সেই কথায় দুজনে চমকে ওঠেন। সরে যান যুবকটির কাছ থেকে। ব্যানারজি গিয়ে দাঁড়ান উচ্চপদের চাকুরে সুমন্তবাবুর সামনে। তিনি চুরুট হাতে এসে দাঁড়িয়েছেন খোঁজ নিতে। তাঁকে ঠিক পছন্দ করেন না সতীশ। অহঙ্কারী মনে হয় মানুষটিকে। সতীশ করেন সামান্য চাকরি। নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। সুমন্ত জিজ্ঞেস করেন, কী হতে পারে, ক্যান ইউ গেস? ব্যানারজি বলেন, মনে হয় তো সুখী পরিবার। শুনে বাধো বাধো গলায় সতীশ বলেন, ওসব কিছু নয়, ওর বাড়িতে তিনি গেছেন, গতকালও ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ওঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। ব্যানারজি শুনতে শুনতে বলেন, নো ওয়ান ইজ হ্যাপি, তাই বলে কি সবাই সুইসাইড করে বসবে? তখন সেই যুবকটি বলে, ‘কে কতখানি আন-হ্যাপি তার থারমোমিটার তো আমাদের হাতে নেই।‘ যুবকটি পিছু পিছু ঘুরছে যেন, তাঁদের কথা শুনছে। গল্পটি এই রকম। প্রতিবশীরা নানা ভাবে আত্মহত্যার কারণ খুঁজে বের করতে গিয়ে যেন যুবকটির ব্যঙ্গের মুখে পড়ে বারবার। যুবকটি যেন তাদের প্রতিপক্ষ। তাঁরা তাকে এড়াতে সরে যান। খুঁজতে থাকেন আত্মহত্যার কারণ। তাঁদের কৌতুহল অপরিসীম। কোনো চিঠি লিখে রেখে গেছেন কি ধনঞ্জয়বাবু? একজন বলেন, তেমন কান্নাকাটি তো শোনা যাচ্ছে না। সতীশ এই কথায় ক্ষুব্ধ হন। একজন কেউ বলেন, ‘এখন ওদের কতরকম ভয়, কতরকম ঝামেলা, এখন ওঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য বউটাকে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে হবে। নুইসেন্স।‘ কথা শেষ করে তিনি আবার বলেন, ‘ধনঞ্জয়বাবুর বউ তো কান্নাকাটির পারটি নয়, স্লিভলেস ব্লাউজ পরে। ‘ এই রকম কথায় কথায় গল্প এগোয়। আসলে মৃতের নয়, জীবিতের ময়না তদন্ত হয়ে যেতে থাকে। জীবিতের হাড়-কঙ্কালের ছবি দেখাতে থাকেন লেখক। গল্প কাহিনি নির্ভর নয়। এই গল্পে একটিই ঘটনা ঘটে, তা হলো ধনঞ্জয়বাবুর আত্মহত্যা। আর কিছুই নয়। বাকিটা হৃদয়হীন প্রতিবেশীর নিষ্ঠুরতা। নিষ্ঠুরতা তাদের কৌতুহল আর মন্তব্যে ক্রমশ ফুটে উঠতে থাকে। আরো হৃদয়হীনতার দিকে এগোয়। শুধু একবার ওবাড়ির কাজের মেয়েটি বেরিয়ে তার বাচ্চাটিকে সেই জটলার মধ্যে দেখে পিঠে চাপড় দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, কেন এয়েছিস, যা ঘরে যা, বাবুদের মতো হুজুগ দেখতে এয়েছেন......। পাঠক এই গল্প পড়ে রমাপদ চৌধুরীকে উপলব্ধি করুন। তাঁকে আমার প্রণাম।
মূল গল্পটি পড়ুন-
0 মন্তব্যসমূহ