
অলাত
এহ্সান
একজন জ্যান্ত মানুষ অনুভব করছেন তার ডান পায়ে উরুর নীচের অংশ থেকেও নেই। কী অসহনীয় লঘুতার ভেতর জীবনের অস্তিত্ব অনুভব! নাগরিক মানুষটার এ অনুভূতির পেছনে একটা অতীত, গভীর কারণ আছে, আর আছে একটা গল্প। আর সমস্ত বিষয় নিয়েই গল্পটা বর্তমান। যে বর্তমানের ভেতর এমন অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হওয়ার একটা বাস্তবতা থাকে।
এ নিয়েই সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমামের গল্প ‘পা’। এই গল্প দিয়ে তাকে চেনা যেত। সম্ভবত এটা তার প্রকাশিত তৃতীয় গল্প এবং প্রথম গল্পগ্রন্থের নাম গল্পও। প্রসঙ্গটা গৌণ হলেও, এখানে মনে রাখা যাক, প্রথম বইয়ে তিনি ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার-২০১৫’ পেয়ে ছিলেন। সংখ্যাবাচক প্রথম আর তৃতীয় শব্দের মাঝের শব্দটিই--দ্বিতীয়। দ্বিতীয় শব্দের পরিপুরক দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘রক্তমূলে বিচ্ছেদ’, বেরিয়েছে অমর একুশে গ্রন্থ মেলা ২০১৭-এ। আর গল্পকার সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমামকে অধিক চেনার জন্য বইটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রহেলিকার মতো শোনালেও এ কথা বলা যায়, প্রথম গল্প গ্রন্থ যেসব পাঠক পড়েছেন তাদের জন্য বইটি গুরুত্বপূর্ণ, আর যারা কখনোই সাদিয়ার গল্প পড়বেন না, তাদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাদের জন্য, যারা সাদিয়া মাহ্জাবীনের তৃতীয় গল্পগ্রন্থও পড়তে চাইবেন। এটা তো ঠিক, এক সদস্য বিশিষ্ট চাঁদ দেখা কমিটি বা চির বিবাদমান দুইটি পক্ষের তুলনায় তৃতীয় মতের উপস্থিতি অপেক্ষাকৃত নির্ভুলকে নির্বাচন করতে সহজ করবে।
‘রক্তমূল’ শব্দটি আমাদের গর্ভমূল, উৎসমূল তথা নাড়ির সঙ্গে যুক্ত। আমাদের যাপিত জীবনের নানা সম্পর্কের ভেতরে সেই ‘রক্তমূল’ সম্পর্কটিই সব চেয়ে গভীর। এই সম্পর্কের বিচ্ছেদ কখনো কখনো অনমনীয়ভাবে মানুষের অস্তিত্বকে ফেলে দেয় হুমকির মুখে। সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম মানুষের রক্তমূলের সম্পর্ক যে কত জায়গায় কত গভীরে বিরাজিত আর বিচ্ছেদের অনিবার্য বহিঃপ্রকাশ কী--তার স্বরূপ অনুসন্ধান করেছেন গল্পগুলোতে। এটাই তার ‘রক্তমূলে বিচ্ছেদ’ গ্রন্থের কেন্দ্রীয় ভাবনা। নানাভাবে আবর্তীত হয়েছে এই সম্পর্ক আর বিচ্ছেদের গল্প। প্রথমগ্রন্থে বিচিত্র ভাবনার (ভাবনার নৈরাজ্য নয় অবশ্যই) স্থলে এটাই তার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থের কেন্দ্রীয় ভাবনা। মূলত যা, রক্তমূল দিয়ে গল্পের নাভিমূলে যাত্রা।
আদতে প্রচলিত সম্পর্ক ধারণার বইরে এসে সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম জীবনকে স্থাপন করেছেন প্রকৃতির সঙ্গে, রক্তমূল সম্পর্কের ভিত্তিতেই। মর্মঘাতী তীরের যেমন ফিরতি আল থাকে, তেমনি সময়ের প্রেক্ষিতে গল্পকার যেন মনে করে দিতে চান অমোঘ আল-কথাটি--মানুষ প্রকৃতির সন্তান। একে ধ্বংস করে বা বিরুদ্ধে গিয়ে মানুষের অস্তিত্ব অর্বাচীন হয়ে যাবে। লেখক সবই বলেন গল্পের ভেতর দিয়ে। অথচ গল্প বলতে গিয়ে টের পান মানুষের শরীরের অজস্র চোরা নালির মতো শত শত ঘটনা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে তার কলমের ডগায়। সেখান থেকে বাছাইকৃত বীজের উৎকৃষ্ট ফসল ঘরে তোলাই গল্প চাষীর সাধনা। কিন্তু বীজ নির্বাচন না করায় মাহ্জাবীনের গল্পের জমির অনেক জায়গায় সদস্য টাক বেরুতে থাকা খুলি উপরি ভাগের মতো অফসলী অঞ্চলগুলো চিহ্নিত করাও কঠিন কিছু নয়।
২.
এক ডজন গল্পে--প্রসুতি স্ত্রীর সঙ্গে তার প্রেমিক স্বামী (জলের দাগ), বৃক্ষে জীবন বাঁধা জননীর সঙ্গে প্রকৃতির ¯স্নেহহীন তার সন্তান (প্রাণের বন্ধক), মুক্তিযুদ্ধের মুখে একাত্তরের মার্চের ভয়ালদিনে মধ্যবিত্তের প্রেম (গন্তব্য), আত্মহননকারী প্রিয়তম স্ত্রীর সঙ্গে প্রয়াত সন্তানের জন্য পাগল পিতার ভালবাসা (জল মাটির আঘাত), প্রয়াতার সন্দেহ প্রবণ স্বামীর মুখোমুখি প্রেমিক লেখক (গল্পটা দুজনের), নদী পীরে বিশ্বাসী এক বৈরাগ্য মানুষের সঙ্গে নদীর আলিঙ্গণ (অবিশ্বাসের পিনিস), স্মৃতির ভারবাহী একটি নিম গাছের সঙ্গে সংসারে প্রান্তিয় হয়ে যাওয়া জননী (নিম সত্য), প্রত্যাখাত এক প্রেমিক যুবকের সঙ্গে আত্মসংকোচে ভোগা যুবকের হাল (ভাঙন), পুরনো বাড়ির সঙ্গে ভাড়াটিয়া (নাগরিক ছাদের ঘর), শ্যামবর্ণা এক নারীর সঙ্গে তার বৈবাহিক পুরুষ (কার্তিকের দিনে), পিতার স্মৃতিবাহী শহরে চাকুরিজীবী কন্যার সঙ্গে তার মা (রক্তমূলে বিচ্ছেদ), কন্যা হারিয়ে গোর খোদক বনে যাওয়া কারওয়ানবাজারের ফল বিক্রেতার সঙ্গে সেদিনে চতুর চাকুরিজীবী (গোর)-এর এই সম্পর্ক ও বিচ্ছেদ বিপুল বৈচিত্র্যে আবর্তিত হয়েছে।
যদিও ১২টি গল্পেই কেন্দ্রীয় ভাবনা যেমন--সম্পর্ক আর বিচ্ছেদ--ধরা সম্ভব, তেমনি গল্পের সাধারণ গঠন ২-১-৩ ধরাও কঠিন নয়। অর্থাৎ গল্পগুলো কাহিনীর মাঝ থেকে শুরু হয়ে সূচনা বা অতীত বর্ণনার ভেতর দিয়ে পরিণতির দিকে গিয়েছে। অধিকাংশ গল্পে ভূমিকা তুল্য ছোট্ট এক মুখবন্ধ থাকে। প্রায়স এই মুখবন্ধ আভূমিক উপস্থাপন করে একটা দর্শন বা অবস্থার। তারপর রসুনের কোয়া খসাতে খসাতে, খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে গল্পে প্রস্ফটিত হয় ওই অবস্থা বা দর্শনের সত্যতা।
* মানুষ দৃশ্য দেখে আনন্দ পায়। অস্বীকার করা যায় না, মর্মান্তিক ঘটনাতেও দেখার এক সুখ আছে। (জল মাটির আঘাত)
* সব অনুভূতির নগদ বর্ণনা হয় না। আলোর উৎসবে অন্ধকারের উল্লাস মিশে গেলে তা ভাষা দিয়ে বোঝানো কঠিন। (নিম সত্য)
* অনেক সময় দেখবেন শব্দটা শুনছেন কিন্তু আপনার ভেতরের অব্দি পৌঁছায় নি। এসব ক্ষেত্রে মানুষের সাধারণত শুনেছিলাম এমন একটা স্মৃতি থাকে আর বিশেষ কিছু মনে থাকে না। (প্রাণের বন্ধক)
সাদিয়ার অধিকাংশ গল্পের সূচনাই এমন। এটা তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থেও পাওয়া যায় খানিকটা নমিত স্বরে। বিশ্বের অনেক লেখক তো বটেই, স্বাতন্ত্র বজায় রেখেই অগ্রজদের মধ্যে বাংলাদেশে শাহাদুজ্জামানের কয়েকটি গল্পে লেখার এই গাঁথুনির ব্যবহার দেখা মিলে। কিন্তু সাদিয়ার গল্পগুলোর বহুতল ও বহুস্বরের নির্মাণের দিকে খেয়াল না রাখলে আলগা ফিতার জুতা পায়ে চলা পাঠকের পা অনিকেতের আঘাতে রক্তাক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে রেহায় পাবে না হয়তো। যেমন, তিনি কাহিনী হতে দেননি একরৈখিক। আপাত আবহে লতিয়ে ওঠা কাহিনী বদলে গেছে ছোট্ট কোনো ঘটনায়। তাতে গল্পের শেষে এসে কখনো কখনো জরুরি হয়ে পড়ে পুরো গল্পটিকে আবার খতিয়ে দেখার।
শব্দ, উপমা-উৎপ্রেকাক্ষার সঙ্গে গল্পকার অন্ধ নিরঙ্গম চর্চা চলে লেখা শুরুর আগে থেকেই। সাদিয়া মাহ্জাবীন গল্পে খুঁজে পেয়েছেন কোনো কোনো নিজস্ব লাইন। লেখকের স্বাতন্ত্র ও বহু বিন্দুর সমাবেশে তৈরি বৈচিত্র্য বোঝার জন্য এসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ--
* বেশ সময় নিয়ে পুড়ে যাওয়ার পরও বাতাসের স্মৃতিতে শিখার অস্তিত্ব থেকে যাওয়ার মতো এক আকাঙ্ক্ষা ছড়িয়ে রইল বুকের ভেতর। (গন্তব্য)
* বুকের জমিন ছারখার হয়ে গেলে প্রথম ফসলের মতো উর্বর আবাদ আর হয় না কোনোদিন। (ভাঙন)
* কোথায় কোন চৌকাঠে নেলপলিশের দাগ লেগেছে মনে পড়ে...। (নাগরিক ছাদের ঘর)
আজকের দিনে ভাস্বর হওয়া জন্য দুনিয়ার তাবদ লেখকের কাছ থেকে অকাতরে গ্রহণের আর অকৃপণ ব্যবহারের সাবলিলতা থাকতে হয়। সাদিয়া মাহ্জাবীন নিশ্চয় তার বাইর নয়। ‘বাবা অনেকদিন ধরে দেয়ালের ছবি হয়ে গেছে, সেই যে প্রেশারটায়’(রক্তমূলে বিচ্ছেদ)--সচেতন পঠক মাত্রই বুঝতে পারেন, এই লাইনটা একান্তভাবেই শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের। সেক্ষেত্রে গল্পকারের আহরণের উৎস যত বিচিত্র হবে ততই সমৃদ্ধ হবে লেখা।
৩.
‘রক্তমূলে বিচ্ছেদ’ গ্রন্থে প্রকৃতি ছাড়াও মিথ ও প্রাকৃত বিশ্বাসের নিত্য উপস্থিতির সরব কারণ লেখকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা স্থানে ভেতরে খুঁজে পাওয়া যায়। ফরিদপুর অঞ্চল নিয়ে প্রচলিত উপকথার দিকে খেয়াল করলে তার সত্যতা পাওয়া যাবে। যেমন ‘ফরিদপুরের পুত / আগুন জ্বালায় ফাতফুত’ ; ‘ফরিদপুর, আলিয়াবাজ (আলিয়াবাদ)/ তাবিজ বেইচা মহারাজ’। অর্থাৎ যাদু, অলৌকিক বিশ্বাস, পীর-মুরশিদের বিশ্বাস, তাবিজ-কবজের বিশ্বাসের এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-যাপনে বহুল প্রভাব বিস্তার করে আছে। ফলে গল্পে চরিত্র নির্বাচন আর তাদের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের বিস্তার ঘটাতে গিয়ে লেখক প্রায়শ এর সম্মিলন ঘটান। তবে এই বিশ্বাস কতটা আধুনিক--এই প্রশ্নের মতো গভীর দিক হলো, অজস্র নদী আর অলস পলি বিধৌত বঙ্গীয় ব-দ্বীপে এই বিশ্বাসের সংস্কৃতি বহুকাল আগে থেকেই। লেখক তাতেই সাড়া দিয়েছেন। কিন্তু এ-ও সত্য, আধুনিক মোবাইল আর সহজলভ্য টেলিভশেনের আকাশ সংস্কৃতির বিপুল প্রভাবের এই দিনে কোনো গ্রাম কি আর প্রাকৃত গ্রাম রয়েছে? শহর থেকে অনেক দূরের গ্রামেও যখন ‘স্টার জলসা’, ‘জি-বাংলা’র হাজার পর্বে ধারাবাহিক দেখা নিয়ে সংঘর্ষে শতাধিক আহতের ঘটনা ঘটে, তখন অনুন্নয়নের অতলে ডুবে থাকা গ্রামের মানুষের বিশ্বাস ও চর্চার যে অতল বদল হয়েছে তা বোঝার বাকি নেই। সেখানে শুভ বোধের গল্পে ফাঁকে প্রাকৃত জীবনের উপস্থিতি খানিকটা খটকা লাগে বইকি। তবে একটা জনপদের গল্প বলতে গিয়ে তাদের ঘুম পাড়ানিয়া গানে কথা থেকে সময় ও ইতিহাসের অনিবার্য ঘাতে যে দ্বন্দ্ব ও বদল উপস্থিত তা দেখাটাই সময়ের দর্পন হতে পারে। গল্পকার সেই দ্বন্দ্ব ও বহু সংস্কারের মোকাবিলা করে ভবিষ্যৎ যাত্রাটা দেখানো দায় এড়াতে পারেন না।
মাহ্জাবীনের গল্প নিয়ে কথা বলতে গেলে অনিবার্যভাবেই তার প্রকৃতি নিয়ে কথা বলতে হয়। মানুষ ও প্রকৃতি একেবারে কেন্দ্রে অবস্থান করে আছে সাহিত্যের সূচনা থেকেই। প্রকৃতির এক-একটি বদল, যাদুকরের চেয়েও সুনিপুন হাত সাফাইয়ে গোটা জনপদের ইতিহাস, এমনকি গোটা সভ্যতাই লুকিয়ে ফেলতে পারে পৃথিবী থেকে। বদলে দিতে পারে যখন-তখন। প্রকৃতিকে এড়িয়ে তাই অনেকই কিছু হয় না। বিশেষ করে আজকের দিনে বুদ্ধিসম্পন মানুষমাত্রই, রাষ্ট্রীয় প্রপাগাণ্ডার ভেতরেও রামপাল কয়লা ভিত্তি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন যে প্রাণঘাতি, সুন্দরবন বিনাসী কাজ তা বুঝতে পারেন। প্রকৃতির কথা বলতে গিয়ে, ‘প্রাণের বন্ধক’ গল্পে তাই এ প্রসঙ্গের ক্ষীণ রেখা উপস্থাপন এড়াতে পারেন নি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, লাউয়াছড়া বনে ভেতর ভূমি জরিপের নামে বিষ্ফোরণ, উন্নয়নের নামে নদী হত্যার প্রসঙ্গ উহ্য থাকলেও মাহ্জাবীন স্বভাবসুলভ দূরত্বে থেকেও অংশগ্রহণ করেন প্রতিরোধকামী সংগ্রমীদের সঙ্গে। কোনো কোনো গল্পে প্রকৃতির উপস্থিতি একটি চরিত্রের মতো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
সাহিত্যে প্রকৃতি উপস্থান বা উপস্থিতি নিয়ে প্রচলিত ধারণা ভাঙার ক্ষেত্রে ভারতীয় বংশভূত ঔপন্যাসিক অমিতাভ ঘোষ-এর ‘আইবিস ট্রিওলজি’, বিশেষ করে ‘দ্যা হাংরি টাইড’ ও সম্প্রতি প্রকাশিত ‘দ্যা গ্রেড ডেনজারমেন্ট’ উপন্যাস দুটিকে মাইল ফলক বলা যাবে। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কের পাশাপাশি মানুষের অবিবেচক কার্যক্রমের ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের যে অমোচনীয় ক্ষতির সম্মুখিন হতে যাচ্ছে তার একটা রূপরেখা এঁকেছেন। (কী আশ্চর্য, এখনো আমাদের দেশের লেখক-সাহিত্যিকরা প্রকৃতির সন্তান মানুষের প্রতি দরদ অনুভব করলেও প্রকৃতির ধ্বংসের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কাতারে নিজেকে দেখতে পান না।) অমিতাভ ঘোষ টের পেয়েছিলেন--সুন্দরবনে সামান্য ক্ষতিও সীমান্ত বিভাজিত পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের জলবায়ুর বিপুল পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রভুত ক্ষতির কারণ হবে। তার ‘দ্যা হাংরি টাইড’ উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে এ নিয়েই। পরে টম যুব্র্যাকি তা চলচ্চিত্র রূপ দেন। প্রসঙ্গটি ‘দ্যা গ্রেট ডেনজারমেন্ট’ উপন্যাসে আরো বড় ভূ-চিত্র এঁকে অমিতাভ ঘোষ দেখিয়েছেন, তথাকথিক উন্নতবিশ্বের আগ্রাসন যন্ত্রের প্রাচুর্যের এই দিনে প্রকৃতি কি বিপর্যয়ই নিয়ে ধেয়ে আসছে, যা বিশ্ব জলবায়ু-রাজনীতিরও সূচনা করেছে। অথচ কিছু না করেও তার সকরুণ ভুক্তভোগী হবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো। ঔপন্যাসের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ভেঙে প্রকৃতিকেই উপন্যাসের কেন্দ্রে নিয়ে আসায় আমরা আশ্চর্য হতে পারি। মানে কি না, উপন্যাসে কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে জলবায়ুর পরিবর্তন! যেন এটা হতেই পারে না। বরং অমিতাভ ঘোষ এক সাক্ষাৎকারে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেন, সমাজ ও মানব জীবনের এতসব বিষয় যদি সাহিত্যের উপাদান হতে পারে, তাহলে সমস্ত কিছুই সার্বক্ষণ যে প্রকৃতি-জলবায়ুর মধ্যে অবস্থান করে, তা নিয়ে উপন্যাস কেন নয়? বরং তিনি জানান, তিনি যেহেতু একজন ঔপন্যাসিক, তাই যেকোনো বিষয়কে উপন্যাসের কাঠামোতে নিয়ে আসাই তার ধর্তব্যের মধ্য পড়ে। গ্রিক দেবতার আয়নার মতো এই প্রশ্নের আলোকে আমাদের দেশের সাহিত্যিকদের অবস্থান, সাহিত্যের বিবেচনা বোধ কোন অতলে অবস্থান করতে, তা বিবেচনার দাবি রাখে।
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম গল্পে অমিতাভ ঘোষের মতো প্রবল বাস্তব বিবেচনা নিয়ে প্রকৃতির প্রসঙ্গ আসে না। তার গল্পের চরিত্ররা অতটা বিবেচকও নয়, যতটা প্রকৃতির প্রতি দুর্দমনীয় প্রেম আর আস্থা দেখা যায়। সর্বপ্রাণে বিশ্বাসী এই মানুষগুলোর প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ জাগ্রত থাকে তাদের হৃদয়ে। ফলে তাদের কাছে প্রাণের বন্ধক প্রকৃতি থাকে নিরাপদ ও শান্ত। যে কারণে বিজ্ঞাপনী রকমারি-ঝকমারিতে আচ্ছন্ন হয়ে রাসায়নিক সার না ছিটিয়ে, গাস্বী করে আফলা জমিকে উর্বর করা চেষ্টা করে আজইগাঁতি গ্রামের মানুষ (জলের দাগ), নয়নশ্রী গ্রামের প্রাকৃতি স্বর্গের প্রাকৃতজন সফেদ ফরাজী ব্যথিত হন সেখানে রিসোর্ট গড়ে তোলার শঙ্কায় আর দূরের অচিহ্নিত হরিতকি গাছের গোড়ায় জীবন বন্ধক রাখা দাদি মারা যান গাছ কাটার মর্ম পীড়ায় ভুগে (প্রাণের বন্ধক), পদ্মা পাড়ের সৌখীন মানুষ মাশুক ভাঙন ফেরাতে খোয়াইন খিজিরের শিন্নি নিয়ে মেনে যায় নদীর গভীরে (অবিশ্বাসের পিনিস), ছেলে সংসারে প্রাংক্তেয় জননী পারভিন মজিদের নিঃসঙ্গতার সারথী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্মৃতির নিমগাছটি--বজ্রপাতে পুড়ে যাওয়ার মধ্যদিয়ে আদতে তার নাতি আইমান বাবুকে বাঁচিয়ে দিয়ে যায় (নিম সত্য), মইশ্যার চরের শেফালির প্রেম প্রত্যাখাত যুবক বেলায়েতের হৃদয়ের ক্ষ্মরণ আড়িয়াল খাঁ বিলের ভাঙনের সঙ্গে হয়ে যায় এককার (ভাঙন)। এবার যদি সাহিত্যে আর্জি তোলা হয়--দাদীর মৃত্যু, মাশুকের ডুবে যাওয়া, আইমানের অসুস্থতা, বেলায়েতের হৃদয়ে ক্ষরণের জন্য দায়ি কে? আমাদের স্বীকার করতেই হবে--প্রাকৃতিক বিপর্যয়। অথচ একটি গল্পে গাছ-ঘাস কেটে রিসোর্ট তৈরি আর সভ্যতার অগ্রগতির নামে আত্মঘাতি রামপাল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রসঙ্গ ছাড়া কোথাও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষ কারণ উপস্থিত নেই। তবু সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমামের গল্পে প্রকৃতি ও মানুষের মিথস্ক্রিয়া আমাদের সেই সত্যের কাছেই নিয়ে যায়।
৪.
সম্পর্ক আর বিচ্ছেদের কেন্দ্রীয় ভাবনার বাইরেও প্রতিটি গল্পের আছে নিজস্ব জগৎ। ‘প্রাণের বন্ধক’ গল্পে একটি মিথকে সত্য হয়ে ওঠতে দেখা যায়। যদিও শুরুতে অনেকটা চটুল ভাষার মাধুর্য তৈরি করতে পারলেও, দুইটি ভিন্ন অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে পুনরায় সেই সৌকার্যে ফিরতে লেখক ব্যর্থ হয়েছেন বলে মনে হয়। তো, মিথের সত্য হয়ে ওটা সত্যের বিস্তার দেখা যাবে ‘নিম সত্য’ গল্পেও। গাছেরও জীবন আছে, অনুভূতি আছে--এই সত্যটা সত্য হওয়ার গল্প এটি। কখনো মনে হয় নারী হচ্ছেন গাছের মতো কিংবা গাছও নারীর মতো। ফলত বিপন্না নারী বৃক্ষসম ছায়াময়ী হয়েও বেঁচে থাকতে হয় উপেক্ষিত নিমগাছ অবলম্বন করে। প্রচলিত অর্থে ‘নিম সত্য’ বলতে অপ্রিয় সত্যকে বোঝায়। পুরো গল্পটাই আমাদের সমাজের সেই অপ্রিয় সত্যটিকে সামনে আনে। একটি গাছের সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্কে এই গল্পটি পড়তে পড়তে পাঠকে মনে পড়তেই পারে, বনফুলের ‘নিমগাছটি’ কিংবা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাক্ষী ছিল গাছটি’ গল্পটি।
শোষণ-বঞ্চনার ঘোরপাকে আত্মহুতি দেয়া মানুষের শিশুকন্যার কাপড়ের পুতুলটি ধনির দুলালীর হাত থেকে উদ্ধার করে ‘জল মাটির আঘাত’ গল্পটি এই সত্য প্রতিভাত করে, এখনো শোষকের ঘরে শোষিতের অনেক লুণ্ঠিত সম্পদ করেছে, যা উদ্ধার করা আবশ্যক। ভাবনা আরেকটু পরিসরে নিলে দেখা যাবে, ভারতীয় উপমাদেশে ব্রিটিশরা একই আচরণ করে নি? এখনো ব্রিটিশ মিউজিয়ামগুলো এই অজ¯্র প্রমাণ মিলে। এমনি বাংলাদেশেও দ্বি-দলীয় শাসনে আমলে সততই যে লুণ্ঠন চলছে তা অস্বীকার করা যায়। ‘জল মাটির আঘাত’ গল্পটি তারই প্রতীক বহন করে। সাদিয়ার গল্পটি সেই স্টিং বহন করে। অধিকন্তু, গল্পের এই দিকটি খেয়াল না করলে বা উন্মোচন করতে না পারলে গল্পটি তুচ্ছই মনে হবে। অস্বীকার করার সুযোগ নেই, আমাদের গল্পগুলোর স্টিং দূর পর্যন্ত পৌঁছায় না বলে শুষ্ক চরাচরে মুখ ধুবড়ে পড়ছে। যদিও গল্পে আবেগ অতিসয্য ও কাহিনীর জীর্ণতার দায় লেখক কখনোই এড়াতে পারেন না। স্মরণ করা যেতে পারে, প্রথমে এই গল্পটির নাম ছিল ‘আত্মজা ও জল মাটির আঘাত’।
স্মৃতিমেদুর সময়ে শহরে ঠাঁই গাড়া মধ্যবিত্তের অনুসূচনা আর অনুতাপের গল্প ‘নাগরিক ছাদের ঘর’। একদিন যা অমূলক মনে হয়েছে আজ তা স্মৃতির উজ্জ্বল পাথর। একদিন ছুটা-বুয়া মাজেদা চুরি করে মাছ খাওয়াকে তিরষ্কার করলেও এখন মনে পড়ছে। লেখক প্রকারান্তে বুয়ার চোর সাব্যস্ত করলেও, আড়ালে রেখেছেন এই বক্তব্য যে, এই মাছ চুরি করে খাওয়া তার সমৃদ্ধ অতীত আর বর্তমান অনাপ্রাপ্তি থেকে উৎসারিত। মাজেদার স্বজনপ্রীতিতেও তার ইশারা মেলে। সাদিয়া মাহ্জাবীনের অনেক গল্পই এমন--কখনো কখনো ‘সাইড স্টোরি’ মূল গল্পকেও বদলে দেয়। যেমন ‘ভাঙন’ গল্পে মৃত মাছ দেখা বাইরেও থাকে তরুণ-তরুণীর প্রেম ও বিচ্ছের ঘটনা।
‘ভাঙন’ গল্পে প্রেম প্রত্যাখাত হৃদয়ের ভাঙন মাটি-ঘর-নদী ভাঙণের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রতীকি এই গল্পে ব্যথিত হৃদয়ের যুবক দুঃখ নিবারণের জন্য নারীর প্রেম সরোবরে ঝাঁপ দিতে পারছে না, সরোবরটি নারী সঙ্গে তার বিষাদের বিষ আর মৃত মাছের মিছিলের মতো স্মৃতিরা ভেসে আছে বলে। লেখকের ভাষায় : ‘জীবনের সমস্ত রং তো সে-ই (শেফালী) দিয়েছিল বেলায়েতের। আবার ফিরিয়েও নিল স্বার্থপরের মতো। বেলায়েতের নিজের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে সেইদিন থেকে। এই ঘটা-মাটি-নদী ভাঙনের চেয়ে কি কম সেই অনুভূতি!’
বহুস্তরিয় গল্প ‘গল্পটা দুজনের’। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটা সাসপেনশন নিয়ে পড়তে হয় গল্পটি। জমজমাট গল্পটি সাব-লজিক আর এন্টি-লজিকের দ্বৈরথ। একদিকে সন্দেহের সাপ গিলে খাচ্ছে পোশা কুকুর, ঔরসজাত সন্তান, শেষ পর্যন্ত নিজেকে আর স্ত্রীকে করছে উন্মাদিনী; অন্যদিকে সন্দেহের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনার বীজ অঙ্কুরোদগম ঘটাচ্ছে লুকানো সত্যের সুটকেস। যেখানে লেখকের অতীত জীবন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে এক চাকুরিজীবীকে, আর চাকুরিজীবী খুঁজে নিচ্ছেন অপরাধী লেখককে। অনেকটা অপরাধ শাস্তি খুঁজে পাওয়া আর শাস্তির অপরাধ খুঁজে পাওয়ার মতো বিখ্যাত সাহিত্য চিন্তা। যদিও লেখক এই কিছু ভেবেছেন বলে হয় না। বরং সুরিয়ালিস্টি আর মিস্ট্রির ‘গোর’ গল্পটিতে সেই মধ্যবিত্তেরর অনুসূচনা আর ইল্যুশনের ভেতর উন্মোচিত হয়েছে, প্রতিটি মানুষের ভেতর অনেক গল্প থাকে। যেমন গোরস্থানে এসে বিপদগ্রস্ত এক সন্তানের পিতার মনে হচ্ছে, তার চালিয়ে দেয়া নকল পাঁচশ টাকার নোটের কারণে এক ফল বিক্রেতার কন্যা আত্ম হত্যা করেছে, যার অনিবার্য ফল হচ্ছে তার সন্তান আজ মুমূর্ষ। অপর দিকে থেকে বললে, সন্তানের অসুস্থতাকে নিজের অপকর্মের ফল হিসেবে মনে করছেন বিপদগ্রস্ত এক পিতা।
’৭১-এ যুদ্ধাবস্থা যে শহুরে মধ্যবিত্তদের বহুদ্বন্দ্ব ভেঙে মুক্তির গন্তব্যে সাহসী যাত্রী ওঠতে বাধ্য করেছে, ‘গন্তব্য’ গল্পটি সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের জনপ্রিয় ইতিহাসে পুরুষের দাপটে নারীর অবস্থান নির্মম প্রান্তিক হলেও, মাহ্জাবীন অন্তত, এই সত্য প্রতিভাত করতে চেষ্টা করেন যে, যুদ্ধের না গেলেও মুক্তিযুদ্ধ মিনুকে আরিফের অধিক সাহসী করে ছিল। আবার সত্তুরের দশকেই ঢাকার শহরে বাড়িওয়ালা আরিফ বাবা ইসমাইল তরফদার মুক্তিযুদ্ধের মাঝেও পাকিস্তান সরকারের কর্মচারী (ওয়াপদার একাউনটেন্ট)। নিজে তো ননই, আরিফকেও না করেছেন ‘গ-গল’-এ না জড়াতে। শহরে পরিচয় দেয়ার মতো বাড়িয়ালার পুত্র আরিফ তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দ্বন্দ্বে ভোগে। কিন্তু যুদ্ধে যায় শহরে পরিচয়হীন তার ভাড়াটিয়া দুই বন্ধু, যারা মনে করে যুদ্ধের ভেতর দিয়ে নিজেদের পরিচয় নির্মাণ করবে। সাদিয়ার এই ইঙ্গিতটুকু ঢাকা শহরের অনেক বাড়িয়াওয়ার মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাস তুলে ধরে।
গল্পের চরিত্র আর ঘটনা বিন্যাসের মুন্সিয়ানা সত্বেও, স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে গিয়ে লেখক আটকা পরেন সেই সময়ে আবহ তৈরির ফাঁদে। অনেক সময় তা কষ্ট কল্পনাও বলা যায়। অথচ সেদিন যেমন, আজও তেমনি, মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি ও অর্থনীতি, যুদ্ধোত্তর মুক্তিযুদ্ধের জনপ্রিয় ইতিহাসে দখলদারিত্ব কায়েমের রাজনীতি, পক্ষ ইত্যাদি ছিল এবং আছে। মুক্তিযুদ্ধ একটা চলমান প্রক্রিয়া--শুরু আছে, শেষ নেই। সশস্ত্র যুদ্ধের ভেতর দিয়েই তা শেষ হয় যায় না। ফলে উত্তর প্রজন্মের গল্পকাররা যুদ্ধের আবহ তৈরি চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের চলমান প্রক্রিয়া ও যুদ্ধের রাজনীতির প্রেক্ষিতে গল্প তৈরি সচেষ্ট হলে বরং সফলতার সম্ভাবনা বেশিই থাকে। যেহেতু এখন পর্যন্ত মনে করা হয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস লিখিত হয়নি, উপেক্ষিত রয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষার রাষ্ট্র, সাহিত্যেও মুক্তিযুদ্ধ গভীরে নিয়ে লেখা হয়নি, তাই অগ্রবর্তী চিন্তার মানবিক মানুষ হিসেবে উত্তর প্রজন্মে গল্পকাররা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখার ভেতর দিয়ে সেই সাফল্য দেখাতে পারেন। যদিও গল্পের মধ্যবিত্ত নায়ক আরিফের মতো আমাদের মধ্যবিত্ত সাহিত্যিকদের, আটে-টারে শুনে গন্তব্য ঠিক কেবল যাত্রাটাই সার হতে পারে, শেষ পর্যন্ত যাত্রাটা ধরে রাখবে কি না বা গন্তব্যে পৌঁছেতে পাছেন কিনা তার কোনো পরিষ্কার নির্দশন থাকে না।
৫.
চরিত্র চিত্রণের তুলির বলিষ্ঠ টান গল্পে অভূতপূর্ব না হলেও, মাহ্জাবীনের ক্ষেত্রে সভূতপূর্ব বলা যাবে, অন্তত তার প্রথম বইয়ের তুলনায়। অভূতপূর্ব পর্যবেক্ষণের ভূতপূর্ব বর্ণনা ক্ষমতাও সুন্দর হয়ে ওঠেছে। অতিসুক্ষ্ম উপমা আর দুরূহ সংকেতের লোভে লেখাকে সাধারণ পাঠকের জন্য কন্টকিত না করে বরং সহজিয়া গল্প বলার প্রবণতা তার শুরু থেকে। সেই সহজিয়া ভাবনা যে ঝক্কি--কম্প্যাক্ট ভাবনা, পাঠকের জন্য ভাবার অবকাশ না রেখেই--তাই ঘটেছে কখনো কখনো। ফলে একটি গল্প শেষ হলে একটি গল্পই শেষ হয়, কিন্তু নতুন ভাবনার সূচনা হয় না। উত্তর প্রজন্মের লেখদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প লেখার ঝক্কির মতো গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে গল্প লেখার ঝক্কি হলো উদ্ধার রহিত দারিদ্র দর্শন। এই নৈনাগরিক সময় প্রায় প্রতিটি গ্রামই যখন আকাশ সংস্কৃতি ও প্রযুক্তি মারকিতে আচ্ছন্ন, সেখান--প্রয়াত সন্তানের পুতুল উদ্ধারের জন্য পাগলের আবেগী তৎপরতা, পোয়াতী স্ত্রীর মৃতে্যু ছুটাছুটি, ভাঙন দেখে হৃদয়কে মেলানো, শিরনি দেয়ার নামে আত্মহনন, যৌতুকের জন্য অপছন্দের মেয়ে বিয়ে ও হত্যা, মদ্যপ নারীর পিতার সঙ্গে বৈশাখের স্মৃতিচারণ কিংবা গোরস্থানে গিয়েই অপরাধ প্রবণতায় ভোগার আবেগ লেখকের আবেগকেও আচ্ছন্ন করেছে বলা যাবে। এসব চরিত্র চিত্রণ আর কাহিনীর সমাবেশ বহু ব্যবহারে আজ জীর্ণ। গল্পকারগণ এদের প্রায়স এদের বুক দিয়ে আগলে রাখতে গিয়ে শরীর পেষা করে ফেলছেন, তা খেয়াল করেন না।
সাদিয়ার গল্পে মিথের উপস্থিতি জোরালো ও বৈশিষ্ট্য পূর্ণ। কিন্তু তা খিচুরির ভেতর আফোটা ডালের মতো আলগাই রয়ে গেছে। চমৎকার মিথস্ক্রিয়ার করেনি। সাদিয়া মাহ্জাবীন এটা হয়তো ধরেতে পেরেন, বঙ্গ-ব-দ্বীপীয় মিথের যথাযথ ব্যবহার করতে পারলে গল্পের এদেশীয় একটা গড় দেয়া যেত, যা বহিঃ দুনিয়ায় বাংলা গল্পের একটা প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। সেই সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন লোকায় জ্ঞান ও সংস্কৃতির সমন্বয়। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ শুধু নয়, প্রায় সবাই এই কাজটাই করতে পারেন নি। ফলে গরম চায়ে চুমুক দেয়ার মতো পাঠক হয় তা গিলেছেন, নয়তো ফেলে দিয়েছেন, কিন্তু জিভ পোড়ার বিষাদ তার থেকেই গেছে। সাদিয়া মাহ্জাবীনের বৈশিষ্ট্য পূর্ণ অঞ্চলে, এবং অবশ্যই পরিবারে, বেড়ে ওঠা তাকে ভবিষ্যতে এ বিষয় সহযোগিতা করবে। পরিবার প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, তার পিতাও মফিজ ইমাম মিলন, একজন সাহিত্য বোদ্ধা যিনি সম্প্রতি ‘উঠোন’ নামে একটা সমৃদ্ধ সাহিত্যের ছোটকাগজ শুরু করেছেন।
৬.
আমাদের গল্পকারগণ আধুনিক ও সমকালীন প্রপঞ্চ দুটি ভুলে যান, গুলিয়েও ফেলেন কখনো। সমকালীন গল্প হয়ে উঠতে হলে, ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ও সময়ের ঘাতে মানুষে যে নতুন নতুন দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়েছে, তার বর্তমান রূপ ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য রূপান্তর দেখাতে হয়। গল্পে উপাদান যে কিছুই হতে পারে, কিন্তু তার মাঝেও মানুষের চিন্তার যে পরিবর্তন ও প্রবণতা, তাকে ধরতেই হবে। অথচ এর বড় অভাব। রোলা বার্তীয় লেখকের মৃত্যু তো আরো দূরের বিষয়।
গল্প অনেক আগেই কাহিনী নির্ভরতার চিরায়ত ধারা থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও কৌশলী হয়ে গেছে। সাদিয়া মাহ্জাবীন গল্প বলেন সেই চিরায়ত ধারায়। অনেকটা পাল বংশীদের মতো চিরায়ত ধারায় কেবল প্রতিমা গড়েন। তারা প্রতিমা গড়েন পুজার জন্য। পুজা হয়ও, বিশেষত মন্দিরে। বাড়িতে থাকে প্রতিমার ছবি। যে ঘরে প্রতিমার ছবি থাকে, সেই ঘরেই টিভিতে সারাক্ষণ হলিউড-বলিউডের সিনেমা চলে; সেই নায়ক-নায়িকা, কমিকসের চরিত্র ও সুপার হিরোদের ছবি থাকে। আধুনিক কিংবদন্তীর নায়ক তো তারাই। রোলা বার্ত আধুনিক মিথ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাও দেখিয়েছেন। পুজারীরা পুজা করলেও প্রতীমাকে জীবন ভাবেন না। হতে চান ওই সব আকাশ সংস্কৃতির চরিত্রদের মতো। তবুও পুজা চলে তাই প্রতীমা গড়া হয়। একসময় যে ব্যাপক মাত্রায় প্রতিমা গড়া হতো এখন হয় না। মৃৎ শিল্পী পাল বংশও বিলুপ্ত হতে বসেবে, কিংবা পেশা বদলেছে। তাই বলে শিল্প উঠে যায়নি। এসেছে ভাস্কর্য। বিশ্ব অনেক আগেই ভাস্কর্যের যুগে প্রবেশ করেছে। সেখানেও তৈরি হয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সাদিয়া মাহজাবিন ইমাম (এখানে ‘রা’-ও যোগ করা যেতে পারে) যে গল্প লিখেন তা পাল বংশীয় গল্প। গল্পে কাহিনী নির্বাচন ও বলার ঢং (ফর্ম) অনেক বদলে গেছে। একথা তো সত্য, আজকের দিনে গল্পে ভাষা আর ভঙ্গিমার (ফর্ম) দিকে নজর না দিয়ে সাহিত্যে দাগ কাটা সহজ নয়। তরুণ লেখকরা প্রথমের এই দিকে নজর দেন। তবে অনেক সময় ফর্মে নজর দিতে গিয়ে নিজের নাড়িভুরিতে হাত-পা পেঁচিয়ে চলার গতিই হারিয়ে ফেলেন। ফর্মের বাইরেও সাহিত্যে মানুষের জীবন ও মনের যে অংশ দিক তা উন্মোচন করা ছড়া কোনো সাহিত্যই মানুষের মনে দাগ কাটবে না। তবে জীবনে ব্যতিক্রমের চমক খোঁজার প্রবণতা অনেক সময় গল্পকাররা অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েন। মাহ্জাবীনের লেখায় ভাষা ও ভঙ্গিমার দিকে ততটা সচেতনতা না দেখালেও মনের দিক উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন নিজের মতো। ফলত তার গল্পে আবিষ্কারের প্রবণতাই সত্য, ব্যতিক্রম চমকের থেকে। কিন্তু জীবন দেখার আলোকোৎসবে নতুন রং-রেখা টানতে না পারলে তা আলোর প্লাবণেই হারিয়ে যাবে। পাল বংশীদের কাজ যেহেতু পুজার সঙ্গে যুক্ত, তাই সম্প্রদায়ভুক্ত ও আঞ্চলিক হলেও প্রতিমাশিল্পী হয়তো কখনোই বিলুপ্ত হবে না। এই বিচারে আমাদের গল্পকাররা নিজেদের পাল বংশীয় কারুকাজ থেকে উত্তোরণ ঘটাতে পারেন নি। দেশের সমালোচক, সাহিত্যিক ও পুরস্কার দাতাদের মধ্যেও চিরায়ত প্রতিমার প্রশস্তি গাওয়া প্রবণতা দেখা যায়। ফলে নতুন লেখকরা অনেক সময়ই সেই কোলা হলে খেই হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু শিল্পের সার্বজনীনতা অর্জন করেতে হলে গল্পকারকে অবশ্যই ভাস্কর হতে হবে। সেদিক দিয়ে ‘গল্পটা দুজনের’ অনেক বেশি আধুনিক গল্প।
গল্প প্রথমত গল্প তার পর অন্যকিছু। এই গল্পের ভেতরে গাল্পিকতা বজায় রেখে কে কত বেশি ভাবনা, চিন্তা, প্রস্তাব, বিষয়বস্তু, ভড়ং হেঁদিয়ে দিতে পারেন, এটা বলিয়ের চোয়াল আর অঙ্গ সৌষ্ঠব চালনার দক্ষতার ওপর নির্ভর করেন। সাদিয়া মাহ্জাবীন নিপাট একটা গল্পই বলতে চান আমাদের আছে--আপাত নিরীহ এই উদ্দেশ্য পরিষ্কার। সব চেয়ে বড় কথা, লেখক জানেন তিনি কি লিখতে চান। অধিকন্তু জমিয়ে গল্প বলা দক্ষতা তিনি অর্জন করেছেন। ফলে কথনের (অনাবশ্যক ও অতিকথনও) ভেতর দিয়ে বাস্তবতা, কেচ্ছা, প্রতীকি ও পরাস্তাবতার ভেতরে তিনি দক্ষতার সঙ্গে গাস্বী, খোয়াইন খিজিরের শিন্নি, হালগাত, বিপন্ন সুন্দরবন, গণেশ পূজা, গোর খোদা, পুরাণ, পৌরাণিক কাহিনী, কিংবন্তী, মানুষে সঙ্গে নদী ও বৃক্ষের প্রেম, জীবন ও প্রকৃতির মথস্ক্রিয়া ঘটাতে পারেন। এই সব উপাদান রক্তমূলের মতো বাংলার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে আছে। এর থেকে বিচ্ছেদই রক্তমূলে বিচ্ছেদ। এই বিচ্ছেদ প্রদর্শনের মধ্যে লুকিয়ে আছে তার আলিঙ্গণেন তীব্র আকাক্সক্ষাও--অনুল্লিখিত থাকলেও, অজ্ঞাত থাকে কারোই। প্রথম গ্রন্থে চিন্তার বৈচিত্র্যের সমাহার থেকে বিচ্ছেদের বিয়োগান্তক পথে বাংলা গল্পের রক্তমূলে যাওয়ার জন্য সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম যে ‘পা’-এ হাঁটা শুরু করেছেন, তা গল্পের কোন উপশিরা দিয়ে নাভীমূলে পৌঁছায়, তা দেখার জন্যই তার তৃতীয় গ্রন্থের জন্য আমাদের অপেক্ষা। ০
লেখক পরিচিতি
অলাত এহ্সান,
গল্পকার।
প্রবন্ধকার।
পেশা সাংবাদিকতা।
ঢাকায়
থাকেন।
1 মন্তব্যসমূহ
কৃতজ্ঞতা জানাতে এবং 'পা' ও 'রক্তমূলে বিচ্ছেদ' দুটো বইয়ের পাঠ প্রতিক্রিয়ায় নিজের আলোচনাটুকু তুলে ধরতে কয়েকবার পড়তে হোল লেখাটা।
উত্তরমুছুনগল্পপাঠ ও অলাত এহসান ধন্যবাদ। অলাত, আপনি যে যত্ন নিয়ে আলোচনা করেছেন তা বাংলাদেশের দুটি বইয়ের লেখক হিসেবে আমার জন্য অনেক প্রাপ্তি। প্রতিটি পর্যবেক্ষণ মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছি। গল্পে ভাষা, উপমা এবং মিথ নিয়ে আপনি যে কথাগুলো বললেন, তা আমাকে সতর্ক রাখবে লেখার সময়।
একটি বিষয় লক্ষ্য করুন।
# আপনি ভারতীয় বংশোদ্ভুত অমিতাভ ঘোষের আইবিওস ট্রিওলজির সাথে একটা দেড় বা দু হাজার শব্দের গল্পের তুলনা টেনেছেন। উপন্যাসে যে বিস্তৃত স্থান পাওয়া যায় গল্পে তা অসম্ভব। গল্পে একটি গল্প পাঠকের কাছে পৌছে দেওয়াই গুরুত্বপূর্ণ। এজেন্ডা নিয়ে গল্প লিখলে তা প্রবন্ধ বা মুক্ত গদ্যের জায়গা পায়। # নির্ভেজাল গ্রামের কথা বলেছেন, নির্ভেজাল গ্রাম কিন্তু নেই আর তা গল্পে বলাও হয়নি, আপনি ধারণা করে নিচ্ছেন। যেমন জলের দাগ গল্পে স্পষ্ট ই্ঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, নদীর ঘাটের ডাক আসছে এবং ক্ষেতি না করে লোকটি তার পেশা বদলাচ্ছে। জল মাটির আঘাত গল্পে, গল্প শুরুই হয়েছে একটি টিভি সিরিয়ালের দৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে। তবুও আপনার মনে হয়েছে কারণ মানুষের বিশ্বাস লালনের যে বিষযগুলো এসেছে তা থেকে। যেমন গাস্বী, হালখাত, খোয়াইজ খিজির। অলাত, আমার জীবন দেখায় এ বিশ্বাসগুলো এখনো মানুষের মধ্যে আছে ।
# 'সমসাময়িক' নয় একটি প্রসঙ্গ এনেছেন। এখানে পর্যবেক্ষণটা কিছুটা ভিন্ন, 'খোয়াবনামা' বা 'প্রদোষে প্রাকৃতজন' ভিন্ন সময়ের গল্প তা কিন্তু পাঠক নিয়েছে। গল্পের জন্য সমসাময়িক হতেই হবে এটা খুব জরুরী কিনা বুঝতে পারছিনা। গল্পটা পাঠককে দেওয়াই যথেষ্ট। আর ওই যে বললেন দাগ রেখে যাওয়ার কথা। কেন যেন মনে হয়, দাগ রাখবো এই ইচ্ছে নিয়ে লিখলে আসলে, না দাগ, না আকঁড় না গল্প লেখার আনন্দ কিছুই থাকে না কোন কোন লেখকের। লিখব আনন্দে। একটি বক্তব্য থাকেব। সেটা পৌঁছাতে পারলাম কিনা তা জরুরী।
# এজেন্ডা বাস্তবায়ন ছোট গল্পের কাজ নয়। তবে সেই বক্তব্যটাই দিতে পারছি কিনা এটা লেখকের বুঝতে পারা জরুরি। আমার মনে হচ্ছে নিজের লেখায় যথেষ্ট খামতি রয়েছে, সেক্ষেত্রে আপনার উল্লেখ করে দেওয়া বিষয়গুলো যেমনঃ শব্দের ব্যবহার, মিথকে মেলানো, গল্পের নির্মাণ কৌশল এসব নিয়ে আমি সতর্ক হবো নিশ্চই।
# আপনার অধিকাংশ পর্যবেক্ষণ সচেতনভাবে মনে রাখছি কয়েকটি বাদে। যেগুলোর সাথে লেখককের নিজের বোঝাপড়া রয়েছে তা নিশ্চই বদলানো উচিত নয়। তাতে আকঁড় তৈরি হোক বা না হোক। একটি বাক্য । আনন্দ। লেখার আনন্দ নষ্ট হলে কোন পুরস্কারই সে আনন্দ ফিরিয়ে দিতে পারেনা লেখককে। সেই আনন্দেই যুক্ত হবে সমাজের কথা, মানুষের গল্প আবার কখনো কখনো বিচ্যুতও হবে বৈকি।