
(১)
ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের বাসায় বারান্দার অনেকটা অংশ ঘিরে ফেলা হয়েছে। ঘুম ভাংছে আমাদের মোরগের কোঁকর কোঁ শব্দে। ব্যাপার কি? দাদুভাই ভাবছে পরিবারের সকলের ফ্রেশ মুরগীর ডিম খাওয়া দরকার। অনেকগুলো মুরগী বারান্দার উপর ঘোরাফেরা করছে। ভুষি খাচ্ছে। মাঝে মাঝে কোথা থেকে যেন শামুক, ঝিনুক আসছে। তারা তাও খাচ্ছে। ঝিনুকের ভিতরের প্রাণটা আমার তখনই দেখা। চামচ দিয়ে কুঁড়ে ঝিনুকের ভিতরটা খেতে দেওয়া হচ্ছে। আর খোলসটা গুঁড়ো করে ভুষির সাথে মিশিয়ে।
শামুক ঝিনুক খেলে নাকি ওদের ডিমের খোলা শক্ত হবে। মুরগি পোষা শুধু ডিমের জন্য। শুধু ডিম। পোষা মুরগি তো আর ধরে খাওয়া যায় না। ওরা পুষ্যি। বড় আদরের। কিছু ডিম আবার রেখে দেওয়া হচ্ছে বাচ্চা তুলবার জন্য। ব্যাতিব্যস্ত অবস্থা।
এরকম নানা 'ফিরে চল মাটির টানে' জাতীয় আবেগের ফল স্বরূপ নানা কিছু গজাতেও শুরু করল দাদুভাই এর বাগানে। গ্রাম নয়, ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস। কিন্তু তাতে কি?দাদুভাই এর বাগানে কলাগাছ আছে। কলা খাই। কলাগাছের থোড়, মোচা দিয়ে ঘন্ট বানায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাঁধুনি আমার দিদা। থোড়ে মুগডালের ছিটা, ঘি। মোচার ঘন্টে চৌকো চৌকো আলু, আতপচাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বাগানে আলু, গাজর, টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, শিম, বরবটি, পালংশাক - এইসব মামুলি জিনিষ তো আছেই। সেই সাথে আছে গন্ধপাতালির লতা। বড়া বানিয়ে ঘির সাথে খেতে হয়।জীবনের এইসব ছোট ছোট জিভের আনন্দ নেশার মত। দাদুভাই এর বাগানে অনেকগুলো লেবু গাছ। কাগজি লেবু, গন্ধরাজ লেবু। লেবু খাওয়াই তো শুধু লেবুগাছের কাজ নয়। লেবুর পাতাও নানা কাজে লাগে। আমার বা ছোটবোন শ্যামার কিছু একটা পেট ব্যথা জাতীয় রোগ হলেই দিদার ধারণা হত তার সোনার টুকরা নাতনি দের উপর কারো নজর লেগেছে। তাড়াতাড়ি লেবু পাতায় তেল মাখিয়ে আমাদের পেটে ছুঁইয়ে তা চুলার আগুনে দিত। চূলাও কতরকম দিদার। মাটির খড়ির চূলা। ইলেক্ট্রিক হীটার। সে হীটারের পাশটা যদিও মাটি দিয়ে লেপা। আবার মার ওভেন। চুলার আগুনে লেবুপাতা ফটফট করে ফুটত। দিদা মাথায় ফুঁ দিয়ে বলত, যাও এবার শরীর ঠিক হয়ে যাবে। লেবুপাতা পুড়িয়ে আর মাথায় ফুঁ দিয়ে শরীর ঠিক করে দেওয়া এইসব নাদুস নুদুস তুলতুলে ডাক্তাররা আজ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু লেবুপাতা, সরষের তেল আর আগুনের গন্ধটুকু থেকে গেছে।
ছেলেবেলায় খুব গাজর খেতে ভালোবাসতাম। এখনকার মত নয় । কমলা রঙের কচি কচি মিষ্টি গাজর যেন মাটির নিচের খনি থেকে উঠে আসত। কিন্তু দাদুভাই মনে হয় বাগানের গাজর গুনে রাখত। কেয়া, পিয়া , আমি, শ্যামা আর অন্যান্য বন্ধুরা মিলে গাজর খেয়ে তাই উপরের সবুজ পাতা আবার মাটিতে গুঁজে রাখতাম। কিন্তু দুই তিন ঘন্টা পর নেতিয়ে যাওয়া পাতা দেখে দাদুভাই-এর সেকি উত্তেজনা! মারতে তো আর পারে না। বকাঝকা দিয়েই মানুষ খরগোশদের শায়েস্তা।
বাগানের আলু তোলা সেও এক দক্ষ যজ্ঞ । আমার মামী আর মামাতো ভাই অয়ন তখন আমাদের সাথে থাকে। অয়নের জন্ম দুবাই-এ। আমাদের এখানে এসে ক্যাম্পাসে আর পিওন কোয়ার্টারের সামনে চড়ে বেড়ানো ছাগল, গরু দেখে আনন্দে আটখানা ও । অয়ন দাদুভাই-এর বাগানে আলু তোলে আর ভাবে মাটি থেকে ডিম তুলছে। টমেটো দেখে টম্মা টম্মা বলে কি চিত্কার তার। দুপুরে টমেটো আর শশা কুচি করে তখন সবসময় বাড়িতে সালাদ করা হতো । দাদুভাই-এর জন্য অবশ্য চাক চাক টমেটো। অয়ন বাবা মার সাথে আমেরিকায় চলে যাবার পর ওর রেখে যাওয়া জামা কাপড়ের গন্ধ শুকত মা। খাওয়ার টেবিলে বসে কত যে অয়নের সেই টম্মা র কথা। সালাদের লেবুর রস আর পিয়াজ কাচা মরিচের ঝাঁঝে নয়, টম্মা শব্দটায় চোখ জলে ভোরে উঠত সবার।
আলু তুলে নানা ভাগে রাখা হত। মাঝারি, বড়, মেজো। আর সবচেয়ে কুচি গুলোর সবচেয়ে নাম ডাক । খোসা সহ দু ভাগ করে মুচমুচে করে ভাজা হবে। ঘি এর সাথে, ঘি এর ছাকার সাথে বা মুশুরির ডালের সাথে খাওয়া হবে।
দাদুভাইয়ের বাগানে ছিল বকফুল গাছ। মটরশুটির ফুলকে টেনে ছয় ইঞ্চি মত লম্বা করে দিলে যেমন হবে বকফুল তেমন দেখতে। বুকের কাছে গোলাপি আভা মতো। প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেছে বকফুলের বড়া খাইনা।
ছিল সজনে ডাটা র গাছ। শুনলাম বসন্ত কালে সজনে ডাটা খেলে চিকেন পক্স হবে না। আলু ভেঙে আদা কুচি দিয়ে সজনে ডাটার ঝোল করে দিদা। ঘি তো থাকবেই। ঘি ছাড়া দিদার রান্না হয় না।
পেঁপে গাছ, জাম গাছ, আম গাছ - কিছুরই অভাব নেই দাদুভাই এর বাগানে। কিন্তু আমি সবচেয়ে মুগ্দ্ধ হতাম পাটগাছ দেখে। কচি পাটগাছ থেকে মুশুরির ডাল ছিটা দিয়ে শাক হ'ত। কিন্তু তারপর? দাদুভাই চললো পাট গাছ নিয়ে নালার জলে ডুবিয়ে রাখতে। সত্যি সত্যি পচিয়ে নাকি পাট হবে। স্বর্ন তন্তু। সোনার আলোয় পাট এলো ঘরে। দাদুভাই তা থেকে রশি পাকাল। আমি তো হতবাক।
দৌড় দৌড় দৌড়। এ ঘর থেকে ও ঘর। আমি দৌড়াচ্ছি, শ্যামা দৌড়াচ্ছে। পিছন পিছন বাতের ব্যথা নিয়ে হেলেদুলে নাদুস নুদুস দিদাও। ঘোল মথিয়ে মাখন করেছে। হাতে মাখন লেগে আছে। তা আমাদের মুখে মাখিয়ে দেবে। মুখের চামড়া তুলতুলে হবে। কিন্তু ডলে ডলে মাখন মাখানোর উতপাতে আমরা তটস্থ। দৌড় দৌড় দৌড়।
কোলের উপর দুধশাদা কেক নিয়ে বি আর টি সি র বাসে করে ঢাকা থেকে চলেছি রাজশাহী। মাঝে যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে। সকাল সাতটায় রওয়ানা দিয়ে বিকাল পাঁচটা নাগাদ পৌঁছাব। নদীতে ফেরিতে ঘন্টা তিনেক। নদীর পাড়ে ছোট ছোট গ্রাম। কাশফুল ফুটে আছে। জাল ফেলে মাছ ধরছে জেলে। নৌকা ভেসে যাচ্ছে। লাল ছেঁড়া পাল। মাঝে মাঝে শুশুক দেখতে পাচ্ছি। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা।
হঠাত ঝপাত করে শব্দ। পাড় ভেঙে পড়বার। জল মাটির নিচে চুপিচুপি চলে যায় অনেকদূর। উপর থেকে বোঝাই যায় না। তারপর হঠাৎ সব শেষ।
ছোট্ট প্রীতম, লিমন মামী, কাজলমামা সবাই সাথে। কেকের গন্ধে আমার জিভে জল। হবে নাই বা কেন? পূর্বাণী হোটেলের কেক। তুলতুলে শাদা তুলার মত কেকের উপরটা। তাতে গোলাপি গোলাপ আর প্যাস্টেল সবুজে পাতা বানানো। হলুদ রঙের ছোট ছোট ফুল। থ্রি ডাইমেনশনাল। যেন সত্যিকারের। কাজলমামা, মামী প্রথম ছেলের প্রথম জন্মদিন প্রীতমের ঠাকুরদা, ঠাম্মার মানে আমার দাদুভাই দিদার কাছে করবে।
রাজশাহী এসে লাল নীল কাগজের শিকল বানালাম আমরা। ঢাকা থেকে আনা ক্রেপ কাগজ দিয়ে দেওয়াল থেকে লম্বা ঝিরিঝিরি। ভাগ্যিস মনে করে কাজলমামা ক্রেপ কাগজ এনেছিল। রাজশাহী তে তখন ক্রেপ কাগজ দেখিনি। আমি তো বিস্ময়ে ক্রেপ কাগজের গায়ে হাত বোলাই। কিভাবে করে এমন ? কি ছোট ছোট কুচি কুচি ভাঁজ।
ছোট্ট প্রীতম পড়ল সাদা রঙের ধুতি পাঞ্জাবি। মনে হয় ইন্ডিয়া থেকে আনা হয়েছিল। সাথে ঘন নীল রঙের ভেলভেটের জ্যাকেট। তাতে রুপালি জরির কাজ।
“শুভ কোথায়? শুভ কোথায়?” ডেকে ডেকে সারা। কিন্তু শুভর পাত্তা নেই। কুংকিমার (আমার মেজমাসি কুমকুম এর ) দুই ছেলে জয় শুভ। বিচ্ছু বললে কম বলা হয়। ছেলেবেলায় শুভ ঢাকায় ঝিকাতলার দোতালা বাসার উঁচু তাকে বসে থাকত। তারপর আয়নাতে দেখে বাড়ির সামনে যে লোক যেত তার গায়ে ঢিল মারতো। ওদের যন্ত্রনায় আমার মাসি মেসোর জনসমাজে মুখ দেখানো কঠিন ছিল।
তাই যখন ওদের পর আমার মাসতুত বোন মৌটুসীর জন্ম হ'ল দাদুভাই সারা ক্যাম্পাসের চেনা শোনা সব বাড়িতে রসগোল্লা পাঠিয়ে দিল। ঘর আলো করে সোনা রঙের নাতনি এসেছে। মৌটুসীকে সোনালী রঙের একটা ডলপুতুল বলেই মনে হত। মাথা ভর্তি ঝাঁকরা কোঁকড়ানো চুল। দাদুভাই এর বক্তব্য এবার মেয়েটার হয়তো একটু শান্তি হবে। দুই জলদস্যু নাতির পর শান্তমত এক রাজকন্যা নাতনি।
এদিকে শুভর তো পাত্তা নেই। কুংকিমারা ফেরত যাবে। বাসের সময় হয়ে গেছে। শুভ নেই। শুভ নেই। আসলে কুংকিমারা ঢাকা থেকে গরমের ছুটিতে রাজশাহী আমাদের বাড়ি এসেছে। এমনি সবসময়। হয় আমরা ঢাকা যাই নয় ওরা রাজশাহী আসে। পূজার ছুটি, ঈদের ছুটি, গরমের ছুটি বা শীতের ছুটি কোনোটাতেই কোনদিন কুলু, মানালি যাওয়া হয়নি আমাদের । বরফে ঢাকা পাহাড়চূড়া , ঝাঁপিয়ে পড়া ঝর্ণা কিংবা পাহাড়ের মাঝের সবুজ উপত্যকা দেখা হয় নি। শুধু মানুষের হৃদয় দেখেছি , মানুষের সাথেই সময় কাটিয়েছি। অপরূপ সব সময়।
অবশেষে শুভকে পাওয়া গেল। বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। ও বাড়ি ফিরে যাবে না।
দিদার কাছে শুনেছি আমি নাকি ছেলেবেলায় সবাইকে বলে বেড়াতাম আমরা দুই ভাই দুই বোন। কিন্তু ভাই দুটো খুব দুষ্টু। মা সামলাতে পারে না বলে আমার মাসির কাছে ভাই দুটোকে দিয়েছে। জানি না নিজের ভাই এর থেকেও আপন হয় কিনা।
ঠুক ঠুক ঠুক। দরজায় কড়া নাড়বার শব্দ। কি ব্যাপার? কে? ভদ্রস্যার দাঁড়িয়ে আছেন। দিদার গ্রামের বাড়ি সরিষাবাড়ী। এখন আর খুব কেউ নেই সরিষাবাড়ীতে দিদার। নদীতে যেমন ভাঙ্গন হয়, ঠিক তেমন ভাঙ্গন ধরে একটি দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রেও । দিদার পরিবারের প্রায় সবাই ইন্ডিয়াতে। হিন্দু বলে বাংলাদেশে থেকে যাবার সাহস হয় নি ওদের।
ভদ্রস্যার সরিষাবাড়ী র মানুষ। এ যে নাড়ির টান। নিজের গ্রাম থেকে দূরে দিদাই তাঁর পরম আত্মীয়। ঠিক হয়ে গেল যতদিন ভদ্র স্যারের পরিবার রাজশাহী না আসছেন, উনি আমাদের বাড়িতেই থাকবেন। অসম্ভব মেধাবী শিক্ষক ভদ্রস্যার। অংক, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, বাংলা, ইংরেজি সব বিষয় সমান দক্ষতায় শিখিয়ে দিতে পারেন। আমাদের তো পোয়াবারো। ঘরের ভিতরই স্কুলঘর। যত প্রশ্ন তার সাথে সাথে উত্তর। এক পা হেঁটে অন্য কোথাও যেতে হচ্ছে না। সেই সাথে একটু ইমপ্রুভড ডায়েট ও পাওয়া গেল। বাড়িতে কেউ থাকলে একেবারে এলেবেলে খাবার তো আর দেওয়া যায় না। সম্মান বলে একটা শব্দ আছে তো।
আসলে আমাদের বাড়িতে অনেক মানুষ। প্রতিদিন দুপুরে আট থেকে দশ জন খেতে বসি। দাদুভাই দিদা প্রানপন চেষ্টা করে আমাদের সকলের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবারের ব্যবস্থা করতে। চিরতা, আমলকি, হরিতকির জলের অভাব নেই। কিন্তু বহু বহু বছর পর একদিন শুনি কুংকিমা বলছে ডিমের ঝোলে আসলে আস্ত ডিম দেয়। প্রত্যেকে আস্ত ডিম খায়। ছেলেবেলায় জানতাম দেশি মুরগির ডিম অর্ধেক করে রান্না করলে মসলা ঢোকে ভিতরে, স্বাদ ভালো হয়।
বসবার ঘরে মাটিতে বিছানা হয়েছে। মাটিতে গড়াগড়ি দিতে দিতে কাছাকাছি জড়ো হয়ে আসছি আমরা সবাই। ভুতের গল্প শুরু হবে। জোরে জোরে নি:শ্বাস পড়ছে আমাদের । হাত পা টানটান। কানের ভিতরটা কেমন গরম হয়ে আসছে। এমনই সবসময়। অনিল মেসো এসেছে ঢাকা থেকে। কুংকিমা ,
জয় , শুভ, মৌটুসী তো আগে থেকেই ছিল। গরমের ছুটি। বড় ঘরটায় যে দাদুভাই দিদার বিয়ের বার্মা টিকের খাটটা আছে তা কুংকিমা, মেসোকে দেওয়া হয়েছে । আমরা কুচো কাচার দল সব ঢালাও বিছানায়। বাড়িতে যত মানুষ তত ঘর নেই, বিছানাও নেই। তাতে কি? মাটি তো আছে। পরে বড় হয়ে আমি এই মাটির বিছানা নিয়ে অনেক ভেবেছি। যে বাড়িতে যত এই মাটিতে বিছানা হয়েছে সেই মানুষগুলো যেন তত বেশি উদার। নিজেরটুকু অন্যের সাথে ভাগ করে নিতে শিখেছে তারা। স্বার্র্থপরতা এক রোগ। কোন চিকিৎ সা নেই তার।
এ বছর বেশ গরম পড়েছে। রাজশাহীর গরম বলে কথা। মাটির বিছানায় শীতল পাটি বিছানো হয়েছে। তাও জ্বলে যাচ্ছে গা। গরমের জন্য কাঠের জানালার যেটুকু কাচের, সেটুকু সবুজ রঙ দিয়ে লেপা। বালতি বালতি জল রাখা সব ঘরে। বাষ্প হয়ে একটু যদি ঠান্ডা করে ঘর। দিনে কমপক্ষে দু'বার ক'রে ঘর মোছা হচ্ছে। সারাদিন বের হওয়া যায় না। সন্ধ্যার দিকে একটু ঠান্ডা হয়। বেলিফুল , গন্ধরাজ ফুটতে শুরু করে। গন্ধরাজকে ভালবাসবার জন্যই যেন গরমকালে বেঁচে থাকা।
গরমকালের দুপুরে কালো পোশাক পড়ে চোঙ্গা হাঁকিয়ে হজমিওয়ালা আসে। 'হজমিদানা , তেলাপোকা মারা ছারপোকা মারা হজমিদানা, পেটের মামলা ডিসমিস করে, হজমিদানা ...' আমাদের ভাইবোনদের পেটে কোন মামলা নেই, কিন্তু কালো আচারের মত হজমিদানা চেটে চেটে খাওয়ার খুব লোভ। কিন্তু বাড়ির স্বাস্থ্যমন্ত্রীর জন্য বাইরের কিছুই খাওয়া হয়না আমাদের। খেতে পারি না সবুজ রঙের বেলি আইসক্রিম পর্যন্ত । নিঝুম দুপুরের ঘুঘুর ডাক ছাপিয়ে টুং টাং ঘন্টা বাজিয়ে আইসক্রিম ওয়ালা হেটে চলে যায়। জয় শুভ স্বান্তনা দেয়। 'মন খারাপ কোরনা দিদিভাই, রাঙাদি। ঢাকা গেলে তোমাদের নিয়ে গিয়ে ইগলু আইসক্রিম খাবো , সে তো আর রাস্তার না। কেউ ছড়ি ঘোরাতে পারবে না। ' বিজ্ঞদের কথায় মন ভালো হয়ে যায়।
বিকাল হলেই কচলে কচলে আম আর কাঁঠালের রস করে দিদা। তালপাতার পাখা দিয়ে অন্য হাতে মাছি তাড়ায়। দুধ ভাতের সাথে মিশিয়ে দেয়। এটাই বিকালের খাবার। আমি দুধের সর পাওয়া নিয়ে মারামারি করি সব ভাইবোনদের সাথে। ওরা নির্ধিদ্ধায় বলে ওঠে, 'সরটা তুমি ই নাও, দিদিভাই। ' আজ ভিগান হয়ে খাসির কষানো মাংসের লোভ আমার চলে গেছে, কিন্তু দুধের সরের লোভ টা আজো ছাড়তে পারি নি।
আকাশ কালো করে আসে। বাইরে কালবৌশাখী ঝড়। আর ভিতরে আমরা ততক্ষনে তারস্বরে গান ধরেছি
'ঝড় এল
এল ঝড়
আম পড় আম পড়
কাঁচা আম ডাসা আম
টক টক মিষ্টি এই যা এল বুঝি বৃষ্টিই...'
কে একটা কাসুন্দি আর কাঁচা মরিচ দিয়ে কাঁচা আম মেখে নিয়ে আসে । চেটে চেটে হাতের চামড়া তুলে ফেলি আমরা।
শিউলি ফুল সাদা হয়ে পরে আছে জাকির ভাইদের দেয়ালের বাইরে। কমলা রঙের বোঁটা। হাঁসের ঠোঁটের মত রঙ। আমি আর প্রিয় বন্ধু কেয়া যত তাড়াতাড়ি পারি ফুল কুড়াচ্ছি। ফুল কুড়ানো শেষ হলেই সাইকেল চালানো প্র্যাকটিস করতে যাব। এ বছর স্কুলের প্রতিযোগিতায় মেয়েদের ও সাইকেল চালানো দিয়েছে। দিলে কি হবে? দেখা গেল আমি চারজনের মধ্যে ফোর্থ হলাম আর শিলু অন্য সব খেলার মত ফার্স্ট। পৃথিবীতে কিছু জিনিস আছে যা চেষ্টা করেও হয় না। অনেক মনোযোগ দিয়েও না। দমবার পাত্র আমি নই। সাইকেল চালানো প্র্যাকটিস করবার পর পরই যাব সাঁতার শিখতে। গোপাল মামা কেয়া, পিয়া, শ্যামা আর আমাকে শেখাবে। গোপাল মামা মার কাকাতো ভাই। আমাদের বাসায় থেকে রাজশাহী কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ে। একদিন দাদুভাইকে বলতে শুনেছিলাম। 'আমি হলাম আমাদের বাড়ির প্রথম জেনারেশন যে গ্রাম থেকে শহরে এসেছি। আমার উচিত অন্যদের টেনে আনা। ' দাদুভাই জীবনভর টানাটানি অনেক করেছে। উপরি পাওনা হিসাবে আমরা সাঁতার শিখেছি।
কিন্তু সাঁতার শেখা কি মুখের কথা? গোপালমামা আমাদের পেটে র কাছে ধরে থাকে। আমরা উল্টো হয়ে ভাসবার চেষ্টা করি। স্কুলের সামনের বড় পুকুরটায় শিখি। বাঁধানো ঘাট। ভেজা ভেজা শেওলার গন্ধ নাকে এসে লাগে। গভীর জলের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয় জলের নিচে বুঝি পাতালপুরী আছে। হয়ত কোন রাজকন্যাও । কোনদিন যে মাটির উপর আসতে পারেনি। কিছু কিছু মানুষ রাজকন্যা হয়েও জীবনভর বন্দি হয়ে থাকে। আমাদের টিনের চাল দেওয়া স্কুল ঘরটার পাশে জারুল গাছের সারি। তা থেকে বেগুনি রঙের ফুল মাটিতে ঝরে পড়ে।
প্রিয় বন্ধুর কথায় পরম বন্ধুদের কথা বলতে ইচ্ছে করে। অনুপ, রঞ্জন, দীনু, সন্তু, হিতু, সুদীপ, পথিক, নিলয়, শৈবাল, করবী।
অসুস্থ শরীর নিয়ে বহুবার বি সি রয় হসপিটালে ভর্তি আমি। বিকাল হলেই ওরা হাজির। সাথে আমার বিড়ালছানা সাশা। সাশার একটা চোখ নীল একটা চোখ খয়েরি। এমন দেখি নি। মাঝে মাঝেই রাতে আমার বিছানায় শুয়ে রাত কাটাত ও। আর আমি চেয়ারে বসে। খড়গপুরের ঠান্ডায়।
বালিয়াপালে মিসাইল লঞ্চের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হবে।খড়গপুর থেকে চললাম সাইকেল চালিয়ে। অতটা পথ। কিভাবে সম্ভব ছিল? আমি তো কোন বীর নই। কিছু পর পর আর যেতে পারি না। ওরা আমার সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে প্রায় টেনে নিয়ে চলে। গ্রামে গ্রামে থেমে পথনাটক করে। গ্রামের পুকুরে নেমে স্নান করি। ছাপড়ায় লাউ-এর ঘন্ট দিয়ে ভাত জোটে। রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে মাটিতে ঘুমিয়ে থাকি। আমি কিছু বুঝে আর কিছু না বুঝে শুধু প্রাণের টানে ওদের সাথে সাথে চলি।
দল বেঁধে দলছুট হওয়ার গল্প বলত ওরা। হোস্টেলে বিপ্লবের লাল ছবি ওদের দেয়ালে আঁকা।
'আমি শুনেছি সেদিন তুমি
তুমি তুমি তুমি মিলে
তোমরা সদলবলে সভা করেছিলে
আর সেদিন তোমরা নাকি
অনেক জটিল ধাঁধা না-বলা অনেক কথা
কথা তুলেছিলে.....
আমি শুনেছি তোমরা নাকি
এখনও স্বপ্ন দেখ, এখনও গল্প লেখ
গান গাও প্রাণভরে
মানুষের বাঁচামরা এখনও ভাবিয়ে তোলে
তোমাদের ভালবাসা এখনও গোলাপে ফোটে'
একদিন বিকালে ওরা একটা গোলাপি রঙের সূতির শাড়ি নিয়ে হাজির। জড়ি পাড়। আমি খড়গপুর থেকে পাশ করেই বিয়ে করবার জন্য প্রস্তুত। ওই শাড়ি পড়েই নাকি বিয়ে হবে। সেবার স্বপ্নটা ছোঁয়া হয় নি। শাড়িটা এখনো আমার কাছে আছে। ছাব্বিশ বছর হয়ে গেছে। গোলাপি রঙের সূতির শাড়ি। জড়ি
পা--ড়। মাঝে মাঝে চোখের জল চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে না। বুকের ভিতর থেকে একটা শক্তমত কিছু গলার কাছে এসে আটকে যায়। আমার পরম বন্ধু।
তখন আমরা রংপুরে থাকি। সকালবেলা বেশ কয়েকটা বই বগলদাবা করে বাড়ির সামনের বেলতলাতে যাই। পনেরো বিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকি। তারপর ঘরে আসি। বিকালেও একই অবস্থা। পরিতোষমামা জিজ্ঞাসা করে, 'কি করছ রমা?' হাতেনাতে ধরা পড়ে উত্তর দেই,'স্কুলে যাচ্ছি আর স্কুল থেকে ফিরছি।'
পরিতোষমামাও মার কাকাতো ভাই। গোপালমামার বড়। আমাদের বাড়ির আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। কারমাইকেল কলেজে পড়ে। মণিমাও(আমার ছোটমাসী) কলেজ যায়। আশেপাশের বাড়ির বাচ্চারাও দিন শুরু হলেই স্কুলে চলে যায়। আমারই শুধু চার বছর, আমারই শুধু স্কুল নেই। তাই বাড়ির সামনের বেল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে ভাবি আসা যাওয়ার পথে লোক তো অন্তত দেখবে আমি বই হাতে চলেছি; তার মানে আমিও স্কুলের সম্মানিত, মাননীয় একজন।
পরিতোষ মামার গুণের শেষ নেই। পুকুরে জলের উপর পদ্মাসন করে ভাসতে পারে। খপ করে খালি হাতে পুকুরের জলের ভিতর থেকে মাছ ধরতে পারে। আমি ভাবি পরিমামা নির্ঘাত চাইনিজ সার্কাসের মেম্বার।
পরে পরিমামার মাঝরাতে দৌড়ে ছুটে আসবার মহৎ গুণও প্রকাশ পেল। বড় ডাক্তার হ'ল পরিতোষমামা।
রাত দুটায় দিদার শরীর ধড়ফড় করছে কিংবা দাদুভাই, মণিমা, মা, মেসো বা কুংকীমার জ্বর, হয়ত নি:শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সাথে সাথে পরিতোষমামা মাথার কাছে।
রংপুরের গুপ্তপাড়ার বাড়িতে থেকে পরিতোষমামা যখন কারমাইকেল কলেজে পড়ত, দাদুভাই কাঠের খড়ম পড়ে লাল মেঝের উপর দিয়ে হেঁটে যেত। খড়মের শব্দ শুনতে পেতাম। কিন্তু জানতে পারিনি মনে মনে দাদুভাই ভাবত কিনা যে এই ভাইএর ছেলেটিই একদিন পরিবারের সকলের প্রাণ বাঁচাবে।
রাত শেষ হয়ে হয়ত ততক্ষণে কাছের মসজিদ থেকে আজানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। বিপদ কেটে গেছে। ভোর হচ্ছে।
গলায় বেলিফুলের মালার এক একটি ফুলের মত আর একটি ফুল মা-দের রেখাপিসি। আমরা তো দিদা বলিনা অল্প বয়স বলে। ডাকি রেখাদি। দাদুভাই-এর মামাতো বোন। নিকলীর গ্রাম থেকে এসেছেন আমাদের সাথে থেকে রাজশাহী গভ: কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়বেন বলে।
নিকলিকে বাংলাদেশের ভেনিস বললে কম বলা হয়। চারদিকে শুধু জল আর জল । হাওর এলাকা। বর্ষাকালে প্রায়ই এক বাড়ি থেকে আর এক বাড়িতে ডিঙি নৌকা করে যেতে হয়।
সেবার যখন গিয়েছিলাম দেখি ড্রাম ড্রাম মাছ। এতো মাছ আমি জীবনে একসাথে দেখি নি। মোটা চালের ভাতের উপর উঁচু করে পুঁটিমাছ ভাজা। মাছের পেটের তেল দিয়ে ভাত মেখে খেতে হয়। ট্যাঙরা মাছ, বাটা মাছ, কেঁচকি মাছ, পাবদা মাছের ঝোল কিংবা সর্ষে বাটা দিয়ে রাঁধা । এত মাছ যে খেয়ে শেষ করা যায় না। করা হয় শুঁটকি। খেলাম পুঁটি মাছের চ্যাপা শুঁটকি। অসম্ভব ঝাল, টকটকে লাল রং, অনেক রসুন দেয়া, অসংখ্য কাঁচা মরিচ উঁকি দিচ্ছে। কোন সবজি নেই তাতে, শুধু মাছ। একেই বলে চাঁছনি। ভাবলেই জিভ থেকে জল পড়ে।
রেখাদি তো এলো, কিন্তু তার জামা কাপড় গ্রামের মেয়েদের মত। সালওয়ার বা চোস্ত পাজামা চলছে তখন শহরে। কিন্তু রেখাদির পরনে ঢোলা পাজামা - ছেলেদের মত। কামিজটা ছোট মত। মা-র তো মহা চিন্তা। না, এভাবে তো শহরের অন্য মেয়েদের সাথে মিশে থাকতে পারবে না পিসি। জামা, সালোয়ার বানানো হ'ল শহুরে ছাঁটে। আমার শেখ সাদির ব্যঙ্গ মনে পড়ল। মানুষের পোশাকেই পরিচয় ?
অসম্ভব অধ্যবসায়ী ছাত্রী রেখা দি। সন্ধি, সমাস দুলে দুলে পড়ে সে । ইংরেজি গ্রামারের নিয়ম মুখস্ত করে। ততদিনে আমার গায়ে হাওয়া লেগেছে। ইংরেজি নাটক পড়ছি। গ্রামার পড়বার মত ধৈর্য্য বা মন মানসিকতা কিছুই আমার নেই। তবে রেখাদির চারপাশে ঘুরতে ভুলিনা। রেখাদির জোরে জোরে পড়া শুনে আমারও জ্ঞান লাভ হয়। পরীক্ষা উৎরাতে অসুবিধা হয় না।
রেখাদি জীবনে এখন অনেক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু নিজে নয় , নিজের অন্যান্য আত্মীয় স্বজন কেও হাত ধরে টেনে এনেছে। মা বলে ও তো একা নয়, ওর বর ও হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
ছেলেবেলায় সমাজ বিজ্ঞান বইতে পড়েছিলাম মা , বাবা , ভাই বোন নিয়ে হয় পরিবার। আর কিছু কিছু পরিবার থাকে যারা হল যৌথ পরিবার। সেখানে থাকে দাদা, দাদি, চাচা, চাচী, চাচাতো ভাই বোন।
আমসত্ত্ব শুধু নিজের ভাইবোন নয়, চাচাতো, মামাতো, কাকাতো, ফুফাতো, মাসতুত ভাইবোনদের সাথেও ভাগ করে খেতে হয়। আর পুর্নিমার রাতে সবাই মিলে একসাথে একটা মাদুরে বসতে হয়। একটা একলা ফুল নয়, থোপা থোপা বেলিফুল ই দেখতে সবচেয়ে সুন্দর।
গ্রামের মানুষকে শহরে এনে পড়াশোনা শেখানোর মহান প্রচেষ্টা সব সময় সফল হয় না। আমার বাবার বাড়ি সিলেটের হবিগঞ্জের চুনারুঘাট । মার খুব ইচ্ছা আমার জ্যাঠার ছেলে মেয়েদের জন্য কিছু করে। বাবার দিকে খুব আত্মীয় স্বজন নেই আমাদের। ঠাকুমা, ঠাকুরদা মারা গেছেন। আমার কোন পিসী নেই। বাবারা কেবল দুই ভাই। বাবা মারা যাওয়ার পর শুধু আছেন জ্যাঠামশায়।আর জ্যাঠামশায়ের ছেলেমেয়ে - কুসুমদিদি, কোকিলদিদি, কাঞ্চন , পুষ্প আর বংশের একমাত্র ছেলে নারায়ণ।বিয়ের পরপর ঢাকায় বুয়েটের কোয়ার্টারে কুসুমদিদিকে কাছে এনে রেখেছিল মা। এবার নিয়ে এল কাঞ্চনকে। আমরা তখন রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে থাকি। কাঞ্চন এল। সিলেটের ভাষা বাংলা বলেই মনে হয় না। হবিগঞ্জের ভাষা সে তুলনায় কিছুটা সুবিধার হলেও খুব কিছু বুঝি না আমরা। কাঞ্চন খুব প্রাণবন্ত মেয়ে। অনেক কথা বলে। আমরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। কাঞ্চনের চুল লালচে মত, সব আগা ফাটা। নাহ, এভাবে চলবে না। খুব ছোট করে প্রায় বয়কাটের মত করে কেটে দেওয়া হল চুল। কমলা, হলুদ ছোপ ছোপ স্কার্ট আর ভারি সুন্দর অফ হোয়াইট ক্রেপ কাপড়ের টপ পড়ল কাঞ্চন। শহরে এসে আমাদের সাথে মিশে যাওয়ার সব অত্যাচার মুখ বুজে মেনে নিল ও। কিন্তু আসল যে জন্য ওকে আনা সেই পড়াশোনায় লবডঙ্কা। অনেক বয়স হয়েছে, কিন্তু গ্রামে থেকে খুব কিছু শেখেনি ও। ক্লাশ ফোরে ভর্তি করবার চেষ্টা ক'রা হল বয়স তেমন বলে । কিন্তু ও পড়াশোনা জানে ওয়ানের মত। স্কুলে নিল না। তখন বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করতে থাকল ও। আমাদের সাথে বিকালে খেলতে যায় অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে। যতটুকু মিশে থাকা যায়। বাচ্চাদের মত নিষ্ঠুর প্রাণি খুব কম হয়। কাঞ্চনের চুল, ভাষা, পড়াশোনা, হেঁটে চলা, বয়স কোনকিছু থেকেই পাঁচগাতিয়া গ্রামকে মুছে ফেলা যায় নি। অনেকদিন থাকল আমাদের কাছে কাঞ্চন। মা আর দাদুভাই এর কপালে অনেক ভাঁজ দেখলাম।
তারপর একসময় কাঞ্চন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস ছেড়ে পাঁচগাতিয়া গ্রামে ফিরে গেল। ততদিনে ওর উপর আমাদের খুব মায়া পড়ে গেছে।
কাঞ্চনও চোখ মুছে বলল, "ফরে এখবার মাতমু নে। ( পরে একবার কথা বলব) "
কি জানি ওই বিরাট সুরমা নদীর মাছও এ্যাকোয়ারিয়ামে আটকা পরে কাচের দেয়াল ভালোবেসে ফেলেছিল কিনা।
কাঞ্চন গ্রামে চলে গেল। জ্যাঠামশায় সিলেট থেকে মাঝে মাঝে আসেন। তখনো যোগাযোগ অবস্থা অত ভালো না। সিলেট থেকে রাজশাহি অনেকটা পথ। বাংলাদেশের এ প্রান্ত আর ও প্রান্ত। জেঠু হয়ত খাওয়ার টেবিলটায় বসে সবার সাথে গল্প করছেন। আমি ভয়ে ভয়ে আশেপাশে ঘোরাফেরা করছি। মণিমার এক ধমক। যা কাছে যা। এটাই তোর রুট। নিজের রুট টা চিনে নে। জেঠু সাথে করে নিয়ে আসতেন আমাদের গ্রামের জমির চাল। জেঠু মারা যাবার পর নারায়ণ সব সময় চাল নিয়ে এসেছে। বিন্নির চাল, আতপ চাল।
পাঁচগাতিয়াতে বিন্নীর ভাত সাধারনত: সকালে খেয়ে কাজে যায়। পেটভরা থাকে। আর ফেনা ভাতও করে।
ফেনা ভাত আতপ চাল দিয়ে হয়। একটু জল বেশী দেয়। ফেন গালেনা। বিন্নির ভাতও স্টিকি হয়। মাড় গালেনা।বিন্নির ভাত কেউ সিদ্ধ দিয়ে খায়। কেউ মাছভাজা দিয়ে খায়। যে যেমন যোগাড় করতে পারে।
নারায়ণ যে চাল দেয় তা থেকে অল্প হলেও মা প্রতিবার আমার হৈ, তাথৈ আর শ্যামার রিভু, তিথির জন্য নিয়ে আসে আমেরিকায়। একদিন সকালে ফেনা ভাত করে। বিন্নি চালের ভাত করে। দুধ সিরিয়াল না খেয়ে সেদিন ওরা তা আলু সিদ্ধ, ঘি দিয়ে মেখে খায়। আমার এত অদ্ভুত লাগে। সেই কোন পাঁচগাতিয়া গ্রামের থেকে বয়ে আনা চাল খাচ্ছে আমার ছেলে মেয়েরা এই সুদূর ম্যাডিসনে বসে। বিন্নির ছোট ছোট চাল ছোট ছোট কথার মত মাথার ভিতর গল্প গাঁথতে থাকে।
আমি খড়্গপুর আই আই টি তে পড়তে যাবার আগে মা শ্যামাকে আর আমাকে নিয়ে পাঁচগাতিয়া গ্রামে গেল। সকলের আশির্বাদ নিয়ে আসবার জন্য। সিলেটের মানুষের কাছে লন্ডন নামটা খুব পরিচিত। বহু মানুষ সিলেট থেকে লন্ডন গেছে ছোটখাট নানা কাজ নিয়ে জীবিকা অর্জনের জন্য। বছরের পর বছর। শুনেছি লন্ডনে সিলেটী পাড়া পর্যন্ত আছে। আমাকে অনেকে বলল, "ইন্ডিয়া কেন যাবা? লন্ডন যাও।" গ্রাম ভেঙে মানুষ এসেছে শ্যামাকে, আমাকে আর মাকে দেখতে। আশেপাশের গ্রামও বাদ নেই। ওরা একবার শুধু চোখ ভরে দেখবে ক্ষিতীশের মেয়েদের। আর মা তো ওদের কাছে দেবীর মত। সাতাশ বছর বয়সে বিধবা হয়ে কিভাবে মানুষ করল মেয়ে দুটো। কিভাবে সম্ভব? আর ক্ষিতীশ? সে তো শুধু গ্রাম নয় চেনাশোনা সব মানুষের কাছে কিংবদন্তী। আমরা যখন পাঁচগাতিয়া গ্রামে গেলাম, শেষ ক'মাইল হেঁটে যেতে হল। রিক্সা পর্যন্ত চলে না। গ্রামে পড়াশোনার কোন খবর নেই। সেই নাম না জানা গ্রাম থেকে উঠে এসেছে বাবা। মুক্তার মত হাতের লেখা। অসম্ভব মেধাবী। নিজের চেষ্টায় বুয়েটে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে সেখানেই শিক্ষকতা। কলম্বো প্ল্যান স্কলারশীপ নিয়ে পি এইচ ডি করতে ইংল্যান্ড যাওয়া।দেশে ফিরে ঢাকায় সায়েন্স ল্যাবরেটরীতে যোগ দেওয়া। পরে ১৯৭১ এ বম্বে আই আই টি তে রিসার্চ এর কাজ। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। পড়িমড়ি দেশে ফিরে আসা। সাথে সাথে মৃত্যু। এক অসম্ভব প্রতিভাবান, প্রাণবন্ত জীবন শেষ হয়ে গেল ।
গ্রামের মানুষ আজো বিশ্বাস করতে পারে না। তাদের ক্ষিতীশ? কিংবদন্তীর ক্ষিতীশ? ওরা কেউ যা পারেনি, ক্ষিতীশ তা পেরেছিল। ক্ষিতীশের মেয়ে দুটোর হাত, মাথা ছুঁয়ে দেখে ওরা। জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরের ভিতর দেখে। এক মুহুর্ত চোখের আড়াল হতে দেবে না। গ্রামের মানুষের এত সারল্য সহ্য করবার মত মনের গঠন আমাদের ছিল না। এত ভালোবাসা আমাদের হাতের মুঠো থেকে উপচে পড়ল। উত্তেজনায় শ্যামার একশ দুই জ্বর এসে গেল। আমরা বেশিদিন থাকতে পারলাম না। মনে আছে আসবার আগের দিন পূর্নিমা ছিল। জ্যোতস্নায় আমাদের মাটির ঘরের ভিটেটা ভেসে যাচ্ছিল।
বিয়ের পর আমি কোলকাতায় কাটিয়েছি সাত বছর। লেকটাউনের বিরাট বাড়ি। বাড়িতে লাল ছাড়া কেউ নেই। বাংলাদেশে ফেলে আসা ঘর ভর্তি মানুষদের কথা মনে হয়। পাগল পাগল বেশি লাগলে বাসে চেপে যাদবপুরে মীরাদিদার বাড়ি চলে যাই। মীরাদিদা আমার দিদার সবচেয়ে ছোটবোন। নানা কিছু রান্না করে খাওয়ায় আমাকে। লইট্যা মাছ, লাউ চিংড়ি, নারকোলের পুর ভরা পটল।
যে সব মেয়েরা অনেক মানুষের মধ্যে বড় হয়েছে বিয়ের পর তারা একা থাকতে পারে না। ওদের দমবন্ধ হয়ে আসে। লেকটাউনের ছাদে গিয়ে দাঁড়াই। ছাদ থেকে গায়ে গায়ে লাগা পাশের বাড়ি দেখা যায়। বাড়ির বড় ছেলেটা আবার মদ খেয়ে ফিরেছে। নতুন বিয়ে করেছে। প্রতিদিনই এমন। আকাশ কালো করে এসেছে। ঝড় হবে। বাড়ির পাশের নারকেল গাছগুলো এলোপাথাড়ি মাথা ঝাঁকাতে থাকে।
সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসি। লেকটাউনের বাড়িতে দাদুভাই, দিদা কিছুদিনের জন্য থাকতে এসেছে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান দাদুভাই এর খুব প্রিয়। আমার মুখে হাসি না দেখলেই দাদুভাই বলত
"হবিগঞ্জের জালালী কইতর
সুনামগঞ্জের কুড়া,
সুরমা নদীর গাংচিল আমি
শূইন্যে
শূইন্যে
দিলাম উড়া,
শূইন্যে দিলাম
উড়া রে ভাই
যাইতে চান্দের চর,
ডানা ভাইঙ্গা
পড়লাম আমি
কইলকাত্তার উপর
তোমরা আমায় চিননি
তোমরা
আমায় চিননি..."
মানুষ ভাসমান কচুরিপানা নয়। তার শিকড় মাটির অনেক নীচ থেকে জল টেনে আনে। মানুষের বুকের ভিতর একটা মাটির গন্ধ থাকে। আমি সিলেটি ভাষা বলতে পারি না। বুঝতে পারি আমার ছেলেমেয়েরা যতটুকু বাংলা বোঝে তার থেকেও কম। তবু দাদুভাই এর ভাঙা ভাঙা গলায় এই গান শুনে আমার চোখ জলে ভরে যায়।
ভীষণ মনখারাপ থেকে মন সরাতে সাদা সাদা চন্দ্রমল্লিকা ফুলের কথা ভাবতে থাকি। আমার জীবনের ঘিরে থাকা অসংখ্য মানুষদের কথা ভাবতে থাকি। সুন্দরের কথা ভেবে মানুষ বুঝি মৃত্যু থেকে ও ফিরে আসতে পারে।
সাদা সাদা চন্দ্রমল্লিকা। মাঝে হালকা ঘিয়ে রঙ। চন্দ্রমল্লিকার উপর কুঁচকুঁচে কালো ভোমরা বসে আছে।কিছু মানুষও এমন বিষাক্ত হয়। বিষাক্ত ভোমরা দেখে ভয় পাই না। বিষাক্ত মানুষ দেখে ভয় পাই।
রাজশাহীর এ মাথা থেকে ও মাথা বিশাল লম্বা বারান্দায় দাদুভাই-এর প্রায় একশো'র উপর টব। দুই সারি ক'রে রাখা। চন্দ্রমল্লিকার সাদা রঙ দেখে মনে হয় রাজশাহীর মত জায়গাতেও যেন বরফ পড়েছে। নরম তুলার মত পেঁজা পেঁজা । প্রতি শীতকালে বারান্দার বাগান দেখবার মত। কোন মালি দিয়ে নয়, নিজেই সব ক'রে দাদুভাই। এক বছর চন্দ্রমল্লিকা , পরের বছর বড় বড় সোনালি-হলুদ গাঁদা। কাজলার মোড়ে এসে কেউ আমাদের বাড়ির ঠিকানা চাইলে লোকজন বলে, 'চলে যান, যে বাড়ির বারান্দায় গাঁদা ফুল উপচে পড়ছে, সেটাই বাড়ি। '
ফুলের রানী গোলাপ করতে দেখিনি কোনদিন । কি জানি নানা পেস্টিসাইড স্প্রে করতে হয় বলেই কিনা। ফুলেল কোট পড়া সাহেবি জীবন থেকে চিরদিন দূরে দূরে থেকেছে দাদুভাই। আর হ'ত পিটুনিয়া। আমার ওদের কোনো জাতের ফুল বলে মনে হয় না যদিও। জংলী মত। তবে রাজশাহীর কাঠফাটা গরমে গ্রীষ্মকালেও টিকে থাকত এই পিটুনিয়া।
দেশে ফুল করবার যুদ্ধ উল্টো। আমার এই উইস্কনসিনে শীতকালে কিছু করা যায় না , রাজশাহীতে গরমকালে শুধু বেলি, গন্ধরাজ, কৃষ্ণচুড়া - ডালিয়া নেই, চন্দ্রমল্লিকা নেই, গাঁদা নেই। খাঁ খাঁ রোদ।
বারান্দার বামদিকটায় বিশাল এক মাধবীলতা, হালকা গোলাপি, গাঢ় গোলাপি, সাদা মেশানো তার রং। আমরা মাধবীলতার পাপড়ি ছিঁড়ে হাতের নেলপলিশ দেওয়া নখ বানাতাম। কত যে ঢং! বারান্দার ডানদিকটায় জুঁইফুলের বিরাট লতা।আমাদের শোওয়ার ঘরের পাশেই। মাতাল মাতাল লাগত পাগলকরা গন্ধে। আর চাঁদ উঠলে তো কথাই নেই। গলা ছেড়ে সবাই মিলে গান ধরতাম, 'চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো, ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো।'
শুধু ফুলই নয়। বারান্দার উপর লাউ ঝুলছে। রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আমাদের বাড়ির পাশেই। দেয়ালে ইঁটের সিঁড়ি করা। বিকাল হলেই ছেলেরা ওই সিঁড়ি বেয়ে আমাদের ক্যাম্পাসে বেড়াতে আসতো। ধপাস শব্দ। কি ব্যাপার। দোতালার বারান্দায় দাদুভাই-এর লাউ দেখে আকাশে চোখ রেখে হাঁটতে গিয়ে একটি ছেলে পপাৎ ধরণীতল।
দাদুভাই-এর গ্রীন থাম্ব পেয়েছে কুংকিমা (আমার মেজমাসি) । ঢাকায় শ্যামলীর বাড়ি অনেক বড়। কিন্তু জমি কই? পিছনে আছে প্রিয় কুকুর সুজির বাঁধানো কবর। তার পাশে দোলন চাঁপার ঝাড় । যেন সুজি ভালোবাসার গন্ধ পাবে। আছে শেফালী ফুল, কিছু পাম গাছ - এই। তাই চারতলার উপরে ছাদে ফুলের আর সবজির মেলা কুংকিমার। যেখানে বাংলাদেশে বেশির ভাগ হিন্দু ভাড়া বাড়িতেই পুরো জীবন কাটিয়ে দেয় অনিশ্চয়তার কথা ভেবে, সেখানে কোন হিন্দুর চারতলা বাড়ি বিস্ময় জাগায় বৈকি। সাহস আছে!
চারতলার উপর চারপাশে ফুটে আছে মেরুন ডালিয়া , রক্ত গাঁদা, হলুদ গাঁদা, সোনালী গাঁদা, বসরাই গোলাপ, হাস্নাহেনা, লিলি, সন্ধ্যামালতী, ঝুমকো জবা, পুটুস, জুঁই, বেলি, হলুদ কলকে ফুল , দোপাটি , কৃষ্ণচূড়া ।
টব ছাড়াও ড্রামগুলোকে অর্ধেক ক'রে মাটি ভরা হয়েছে। তাতে লাগানো হয়েছে আম, ডালিম, কামরাঙ্গা, শিউলি ফুল, জামরুল, আমড়া। ডালিম আর আম ধরে আছে। গাছের নীচে থানকুনি পাতা। আমের মুকুলের মিষ্টি গন্ধ ঢাকা শহরের লোহা, ইঁট, কাঠ, চুন, সুঁড়কির জঙ্গলে কোমল কোন ভোরের কথা মনে করিয়ে দেয় । ডালিম ফুলের লাজরাঙা মুখ অপুর্ব সুন্দর। ধরে আছে লাল লাল করমচা। হাততালি দিয়ে দিয়ে 'আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে, লেবুর পাতায় করমচা, যা বৃষ্টি ঝরে যা'।
একবার এই ছাদে দাঁড়িয়ে আমি খুব বড় একটা সোনালী রঙের চাঁদ দেখেছিলাম। ঢাকায় আজকাল চাঁদ খুঁজে পাওয়া যায় না। চারপাশের মাল্টি স্টোরিড ব্লিডিং -এর জন্য ঘরের ভিতর রোদ আসে না, চাঁদের আলোয় ভেসে যায় না মেঝে।
কুংকিমার বাগানে গমের প্লাস্টিকের বস্তাও পিছিয়ে নেই। খালি বস্তা গুলোতে মাটি ভরে লাগানো হয়েছে কালো বেগুন, সাদা বেগুন, বেগুনি বেগুন। আকাশের দিকে মুখ ক'রে তাকিয়ে আছে ঢেঁড়স।
ছাদের উপর মাচা ক'রে ঝুলছে কচি লাউ। আড় মাছের মাথা দিয়ে কি ভালো যে লাউ রান্না ক'রে কুংকিমা। উপরে ধনে পাতা ছড়িয়ে।
আসলে দিদার রান্নার হাত পেয়েছে কুংকিমা। পাঁচমিশালি লাবড়া, পায়েস , লুচি, রুই মাছের কালিয়া, চিঙড়ি মাছের মালাইকারি , পাবদা মাছের জিরা দিয়ে ঝোল… আর আজকাল ক'রে ইলিশ পোলাও। বাড়িতে এমন আর কেউ নয়।
একবার আমার অসুখ হয়েছে। আমি রাজশাহীতে আর মণিমা(আমার ছোটমাসি), কুংকিমা ঢাকায়। বাস স্ট্রাইক চলছে। তাতে কি? অনেক অনুনয় বিনয় ক'রে এক ট্রাকওয়ালাকে বলে ট্রাকে চেপে বসল কুংকিমা আর মণিমা। আমাকে যে দেখতেই হবে।
মণিমা কিছুটা সৈনিক মত। অবাক হলেও বিশ্বাস করতে পারি মণিমার ট্রাকে চেপে বসা। কিন্তু কুংকিমা? সবসময় খুব নরম মত মানুষ বলেই তার নাম ডাক। কত গল্প শুনেছি। অসম্ভব সুন্দরী। নিষ্পাপ প্রতিমা যেন। ঢাকা ইউনিভার্র্সিটিতে তখন পড়ে। খুবই অল্প সংখ্যায় মেয়ে তখন। এক নামে সবাই চেনে। ছুটিতে বাড়ি গেছে। দিদা তখন দুপুর হলেই ফেরিওয়ালার কাছ থেকে শাড়ি কিনত। এইসব ফেরিওয়ালা আসত যখন বাড়িতে শুধু মেয়েরা আছে তখন । যা খুশি গছাত। দিদা তো মুক্তাও কিনেছে অনেক এভাবে। পরে দেখা গেছে অবশ্য ওগুলো সব নকল। দাদুভাই-এর ট্রাঙ্ক থেকে দিদা চুপিচুপি পয়সা দিয়েছে জগতের সব ফেরিওয়ালাকে। দিদার বক্তব্য , "তোর দাদুকে কি বলব? চাইলে নানা প্রশ্ন করবে। তার চেয়ে এভাবে ই ভালো। আসলে তোর দাদু সামনে দিয়ে সুঁচ যেতে দেবে না, পিছন দিয়ে হাতি গেলেও জানতে পারবে না। "
শাড়ি তো কেনা হ'ল। কুংকিমার আবদার সবার শাড়ি সেই পড়বে সবার আগে। কিন্তু নতুন তাঁতের শাড়ি। কুংকিমার ননীর মত নরম পা। পাড়ে লেগে পা কেটে গেল। রক্ত ঝরছে। আমার এই কুংকিমা শুধু আমাকে দেখবার জন্য আজ ট্রাকে চেপে বসেছে।
মণিমার কথা আর একদিন বড় ক'রে বলব। আজ শুধু বলি তখন আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা। আমি খুব ভয় পাই পরীক্ষাকে । মণিমা তখন রাজশাহীতে মুনসেফ। এক মাস আর্নড লিভ নিয়ে ফেলল আমার জন্য। আমি নিজের মেয়ে নই। বোনের মেয়ে। আমি আমার নিজের ছেলে মেয়ের পড়াশোনার জন্য আজ পর্যন্ত কোনদিন এক মাস ছুটি নেই নি।
আমার অস্তিত্বের কারণ এইসব মানুষের ভালোবাসা। আমার নি:শ্বাস নেওয়ার কারণ এইসব মানুষের ভালোবাসা।
তাই যখন দেখি পুরো পৃথিবীটা আসলে ঠিক এমন ভালোবাসায় ভরা নয়, সেখানে মমতা নেই, স্বার্থপরতা জীবনের মূলমন্ত্র -আমি চমকে যাই। দু:স্বপ্নগুলো মেনে নিতে পারি না।
আসলে যুক্তি দিয়ে, প্রমাণ দিয়ে পৃথিবীর বহু মানুষের বিশ্বাসই বদলানো যায় না । তারা যাকে সত্য বলে মনে করে তা মিথ্যা হলেও সেটাই তাদের কাছে সত্য। বড় অসহায় লাগে। তবু পৃথিবীতে খারাপ মানুষগুলো জিতে যায়। তারা ভালো মানুষগুলোকে কামড়ে আঁচড়ে রক্ত বের করে শিস দিতে দিতে চলে যায়। বিষাক্ত এই মানুষগুলোই পৃথিবীতে টিকে থাকে। খুব কমই তারা তাদের পাপের শাস্তি পায়। বংশ পরম্পরায় ইতিহাসের পুনরাবৃতি ঘটে। মানুষ সামনে না এগিয়ে ঘুরে ফিরে আবার পিছনের দানবটুকুই হ'যে যায়। আপেল কখনো গাছ থেকে বেশি দূরে পড়ে না। আমি বিধ্স্ত হয়ে যাই।
খুব একটা সাদা বিছানার কথা মনে পড়ে। হাসপাতালের । আজকাল খুব এমন হয়। ছেলেবেলার মানুষগুলোর ভালোবাসা দূরে ফেলে এসেছি। মনে হয় হাসপাতালের বেডে গিয়ে শুয়ে থাকি। ছেলেবেলায় হাসপাতালে যেতে খুব ভয় করত আমার। অথচ আজকাল মনে হয় আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গাই বুঝি হাসপাতাল। ডাক্তার , নার্স যত্ন করবে। ওদের এত আপন মনে হয়। আমায় যেন তুলার চাদর দিয়ে মুড়ে রাখবে ওরা। মাথার নিচে বালিশটা উঁচু করে দেবে। গ্লাসে ক'রে অরেঞ্জ জুস্ খাওয়াবে। ধরে ধরে হাঁটাবে যেন এক বছর বয়স আমার। আবার হাঁটতে শিখব। ওরা আমার সব ওষুধের নাম জানে। তা কখন খেতে হ'বে তাও জানে। নিজে নিয়ে নিজের ওষুধ খেতে হবে না। ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের কাপ-এ করে নীল, গোলাপি ওষুধ নিয়ে আসবে নার্স। জলটুকু পর্যন্ত দেবে। ইনজেকশন দিলে অল্প রক্ত বের হবে, বেশি তো না। তাও আবার ওরা তুলা দিয়ে মুছে নেবে। শরীরের চাদরটা ঠিক ক'রে দেবে। ডাক্তার বার বার এসে জানিয়ে যাবে আমি কত ভালো ভাবে সেরে উঠছি। কিছুদিনের মধ্যেই আবার জীবনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারব। জীবন, লোভনীয় জীবন। যে জীবনের জন্য আমি ছেলেবেলায় কমলালেবু খেতে ভালোবাসতাম। ভাবতাম বুঝি সূর্য শুষে খাচ্ছি। জীবনের রস আমার জিহবা ভিজিয়ে দিত। চোখ বুজে আসত।
হাসপাতালে আমার ঘরটার একটা পুরো দেয়াল জুড়ে কাচের জানালা। স্বচ্ছ সি থ্রু সাদা পর্দা । বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি দেখতে থাকি হাসপাতালের বাগানে অনেক লাল রঙের টিউলিপ ফুটে আছে।
আজকাল হাসপাতাল ছেড়ে বাইরের পৃথিবীতে যেতে বড় ভয় ক'রে আমার।
(চলবে)
0 মন্তব্যসমূহ