হুলিও কর্তাসারকে নিয়ে গার্সিয়া মার্কেসের স্মৃতিচারণ

অনুবাদ : যুবায়ের মাহবুব 

[লাতিন আমেরিকার ‘বুম’ সাহিত্য-আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দের একজন আর্জেন্টিনিয় ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার হুলিও কর্তাসার। ১৯৮৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যুর পরপরই লেখক-বন্ধুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গার্সিয়া মার্কেস এই লেখাটি পাঠ করেছিলেন মেক্সিকোর গুয়াদালাহারা বিশ্ববিদ্যালয়ে । লেখাটি মূল ভাষা থেকে অনূদিত।]

শেষবারের মত আমি প্রাগে গিয়েছিলাম ৬৮-র সেই ঐতিহাসিক বছরে, কার্লোস ফুয়েন্তেস ও হুলিও কর্তাসারের সাথে। উড়োজাহাজ-ভীতি আমাদের তিনজনের মধ্যেই বিদ্যমান বিধায় প্যারিস থেকে যাত্রা করি আমরা ট্রেন মারফত। দুনিয়ার সকল বিষয় নিয়ে আড্ডা দিতে দিতে পাড়ি দিয়েছিলাম দুই জার্মানির দ্বিখন্ডিত রাত্রি, বীটগাছের সমুদ্র, সুবিশাল সব ফ্যাক্টরি আর কারখানা, নৃশংস যুদ্ধ আর অপরিমিত ভালোবাসার ধ্বংসাবশেষ।

যখন ঘুমোনোর সময় হলো, হঠাৎ করেই কার্লোস ফুয়েন্তেসের মাথায় একটি প্রশ্ন এলো, ছুড়ে দিলেন কর্তাসারের উদ্দেশ্যে—কিভাবে, কবে, ঠিক কার উদ্যোগে জ্যাজ সঙ্গীতে পিয়ানোর প্রচলন হয়েছিল? প্রশ্নটা এমনিই করেছিলেন ফুয়েন্তেস, স্রেফ একটি তারিখ আর একটি নামের বেশি কিছু জানতে চাননি, কিন্তু উত্তরে যা এলো, তা চোখ-ধাঁধানো জ্ঞানগর্ভ এক উপাখ্যান, ভোর পর্যন্ত চললো, বিয়ারের লম্বা গেলাস আর ঠান্ডা আলু সমেত সসেজ খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে। কিভাবে মেপে মেপে কথা বলতে হয় কর্তাসার খুব ভালো জানতেন, দারুন নৈপুণ্য আর প্রায়-অবিশ্বাস্য সরলতায় তিনি আমাদের জন্যে জ্যাজের ইতিহাস আর নন্দনতত্ত্বের পুনর্নিমাণ করলেন, শেষ করলেন থেলোনিয়াস মংক-এর পক্ষে এক মহাকাব্যিক সাফাই গেয়ে, আলো তখন সবে ফুটতে শুরু করেছে। গুরুগম্ভীর অর্গানের মত কন্ঠস্বর দিয়েই শুধু কথা বলতেন না তিনি– ‘র’ অক্ষরটা সবসময় উচ্চারণ করতেন টেনে টেনে—বরং কথা বলতেন তার প্রকাণ্ড দুটো হাত দিয়েও, এত জীবন্ত অভিব্যক্তিময় হাত আর কারো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। অনুপম সেই রাত্রির অবাক বিস্ময়ের কথা কখনো ভুলতে পারিনি, না ফুয়েন্তেস, না আমি।

১২ বছর পর হুলিও কর্তাসারকে দেখেছিলাম আমি নিকারাগুয়ার রাজধানী মানাগুয়ার এক পার্কে মানুষের ভীড়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তার সম্বল ছিল শুধু তার অপূর্ব কন্ঠ এবং তার লেখা অন্যতম দুরূহ একটি ছোটগল্প। গল্পের বক্তা কলঙ্কিত এক মুষ্টিযোদ্ধা, নিজের কাহিনী বলছে ‘লুনফার্দো’ মানে বুয়েনোস আইরেসের অপরাধজগতের কথ্যভাষায়, এর মর্ম হয়তো সম্পূর্ণই আমজনতার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতো যদি না আমরা এত শঠতার পেছনের নেপথ্য চিত্রটি চকিতে দেখতে না পেতাম; যাই হোক, গল্পটি কর্তাসার নিজেই বেছে নিয়েছিলেন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিশাল আলোকসজ্জিত বাগানে সমবেত জনতার সামনে পড়বেন বলে, সেই সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন সকলেই, পূজনীয় কবি আর বেকার দিনমজুর থেকে শুরু করে বিপ্লবী কমান্ডার এবং তাদের বিরোধী প্রতিপক্ষ।

চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা ছিল সেদিনটিও। গল্পের আক্ষরিক অর্থ বোঝা মোটেও সহজ ছিল না, লুনফার্দো অপভাষায় যারা সবচেয়ে দীক্ষিত তাদের জন্যেও না, কিন্তু তবুও আমরা অনুভব করতে পেরেছিলাম, নিঃসঙ্গ বক্সিং রিঙে হতভাগা মুষ্টিযোদ্ধার শরীরে প্রতিটি আঘাতে আমরাও ব্যথিত হয়েছিলাম, তার অলীক স্বপ্ন আর কায়ক্লেশ কাঁদিয়েছিল আমাদেরও, কারন কর্তাসার তার শ্রোতাদের সাথে এতটাই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন যে শব্দগুলো ঠিক কী বলতে চাইছে বা না চাইছে সেটা কারো কাছে আর ব্যাপার ছিল না, বরং ঘাসের উপর বসে থাকা জনতা যেন তার অপার্থিব কন্ঠের সম্মোহনে স্বর্গীয় মোক্ষে উত্তরণ লাভ করেছিল।

এই যে তার দুটো স্মৃতি আমাকে এত আলোড়িত করে, মনে হয়ে কর্তাসারের পরিচয় তুলে ধরতেও এগুলো সবচেয়ে যথাযথ। ঘটনা দুটো ছিল তার ব্যক্তিত্বের দুই মেরু। নিভৃতে, যেমন প্রাগের ট্রেনে, মানুষকে তিনি মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারতেন, তার বাগ্মীতা দিয়ে, তার প্রাণবন্ত পান্ডিত্য দিয়ে, তার ক্ষুরধার স্মৃতিশক্তি দিয়ে, তার মারাত্মক রসবোধ দিয়ে, মোদ্দা কথা তিনি যে সমস্ত কারণে শ্রেষ্ঠ একজন বুদ্ধিজীবী হতে পেরেছিলেন, শব্দটির প্রাচীন অর্থে, উৎকৃষ্ট অর্থে, সে সমস্ত কারণে। জনসমক্ষে নিজেকে প্রদর্শনীর বস্তু বানাতে তার বেজায় অনীহা ছিল, কিন্তু তবুও তার অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তিত্ব দর্শকদের বিমোহিত করে ফেলতো, অতিপ্রাকৃত কিছু একটা ছিল যেন তার চরিত্রে, কোমল একই সাথে অদ্ভুত। উভয় ক্ষেত্রেই আমার দেখা সবচেয়ে আশ্চর্য মানুষ ছিলেন তিনি, তার সঙ্গে পরিচয় ছিল আমার সৌভাগ্য।

পরিচয়ের প্রথম লগ্ন থেকেই বলতে হবে—১৯৫৬ সালের বিষন্ন হেমন্তের শেষে, প্যারিসের এক কাফেতে যার নামটি ছিল ইংরেজিতে, যেখানে তিনি মাঝে মাঝে যেতেন কোনার এক টেবিলে বসে লেখার উদ্দেশ্যে—ঠিক যেমন তিনশো গজ দূরে বসে লিখতেন জঁ-পল সার্ত্র—স্কুলের নোটখাতায় লিখতেন তিনি একটি ফাউন্টেন পেন দিয়ে, কালির ছোপ লেগে থাকতো হাতের আঙ্গুলে। তার প্রথম গল্প সংকলন ‘বেস্তিয়ারিও’ (‘চিড়িয়াখানা’) আমি পড়েছিলাম বারাংকীয়া’র এক সস্তা হোটেলে, সেখানে ঘুমোতাম এক টাকা পঞ্চাশ পয়সার বিনিময়ে, অল্প বেতনের ফুটবলার আর হাস্যোজ্জ্বল বেশ্যাদের মাঝে, বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠা পড়েই বুঝতে পেরেছিলাম যে বড় হয়ে ঠিক যেমন লেখক আমি হতে চাই, তেমনই একজন লেখককে পেয়েছি। প্যারিসে থাকতে কে একজন আমাকে বললো যে ওল্ড নেভি কাফে’তে বসে তিনি লেখালেখি করেন, বুলভার্দ সাঁ-জের্মা’র উপর, সেখানে গিয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করেছিলাম কয়েক সপ্তাহ, তারপর একদিন তাকে দেখতে পেলাম কাফেতে প্রবেশ করছেন, যেন সাক্ষাৎ ছায়ামূর্তি। কল্পনাতীত লম্বা ছিলেন তিনি, মুখাবয়ব শয়তান-শিশুর মত আর পরনে ছিল অনন্ত-অক্ষয় এক কালো কোট, কোট তো নয় যেন কোন বিপত্নীক বুড়োর আলখাল্লা, আর তার চোখ দুটোর মাঝে ফাঁক ছিল অনেক, ষাঁড়ের চোখের মত, এত তীর্যক আর এত স্বচ্ছ, স্বয়ং ইবলিশের চোখও হতে পারতো যদি না তারা হৃদয়ের শাসনের অধীনস্থ না হতো।

কয়েক বছর পর—তদ্দিনে আমরা বন্ধু হয়ে গেছি—মনে হলো তাকে আবার যেন সেই প্রথম দিনের মত করে দেখলাম, কারন তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প “অপর আকাশ” পড়ে মনে হয়েছিল যে কর্তাসার নিজেকেই পুনরায় সৃষ্টি করেছেন এই গল্পে, প্যারিসে বসবাসরত এক ল্যাটিন আমেরিকানের চরিত্রে যে কিনা নিখাদ কৌতুহল থেকে গিলোটিনে শিরোচ্ছেদ দেখতে যায়। চরিত্রটির এমন বর্ণনা দিয়েছেন যেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি—“তার অভিব্যক্তি ছিল আনমনা-বহুদূর, অথচ অদ্ভুতরকম স্থির, মুখটি যেন স্বপ্নের কোন মুহূর্তে স্থবির হয়ে গেছে, সজাগ অবস্থায় ফিরে যেতে যা করা প্রয়োজন, তা করতে সে ঢের নারাজ।” লোকটা হেঁটে যাচ্ছিল লম্বা কালো জোব্বা গায়ে জড়িয়ে, প্রথম দেখার দিনে কর্তাসারের সেই কোটটির মতই, তবে গল্পের বক্তা যে এই মানুষটির কাছে গিয়ে নাম-পরিচয় জানতে চাইবে সে সাহস পাচ্ছিল না, কারন সে নিজেই অনুরূপ ব্যাঘাতের জবাব দিয়েছে মাত্র শীতল ক্রোধের স্বরে।

অবাক ব্যাপার হলো যে ওল্ড নেভি কাফে’র সেই বিকেলে আমিও কর্তাসারের কাছে যেতে সাহস করিনি, একই ভয় ছিল আমারও। দূর থেকে তাকে দেখেছিলাম, এক ঘন্টারও বেশি সময় ধরে লিখে গেলেন অনবরত, চিন্তা করার বিরতি ছাড়াই, আধা-গ্লাস মিনারেল ওয়াটার ছাড়া আর কিছু মুখে দিলেন না, বাইরের রাস্তায় যখন আঁধার নামতে শুরু করে কলমটা পকেটে পুরে বেরিয়ে গেলেন তিনি নোটখাতা বগলদাবা করে, যেন পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘকায়, কৃশকায় স্কুলবালক। পরবর্তী বছরগুলোতে আমাদের অনেকবার দেখা হয়, কিন্তু তার মধ্যে কেবল একটি পরিবর্তনই দেখেছিলাম, তার দাড়ি আরো ঘন কালো হয়েছিল, মৃত্যুর দুই সপ্তাহ আগে পর্যন্তও তিনি যে অমর, এই কিংবদন্তীটা সত্যি মনে হতো, কারণ দাড়ি তার কখনো বাড়া থামেনি, যে বয়সে এই দাড়ির জন্ম হয়েছিল সে বয়সটাকেই তিনি সব সময় ধরে রেখেছিলেন। ব্যাপারটা সত্যি কিনা কখনো সাহস করে জিজ্ঞেস করিনি, যেমন একথাও কোনদিন তাকে জানাইনি যে ৫৬-র বিষাদমাখা হেমন্তে তাকে দেখেছিলাম ওল্ড নেভি কাফে’তে তার নিজস্ব কোনে, সেদিনও কিছু বলার সাহস পাইনি, এও জানি যে তিনি যেখানেই থাকুন না এখন, জানতে পারলে ঠিকই আমার লাজুক প্রকৃতিকে গালি দিতেন।

দেবতাদের প্রাপ্য সম্মান, প্রশংসা, ভালবাসা, এবং অবশ্যই প্রবল ঈর্ষা। এই সমস্ত আবেগ কর্তাসার যেভাবে জাগ্রত করতে পারতেন, খুব অল্পসংখ্যক লেখকই তা পেরেছেন, কিন্তু আরো একটি অনুভূতি তিনি উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন যেটা সচরাচর মেলে না—প্রগাঢ় ভক্তি। হয়তো নিজের অজান্তেই এই আর্জেন্টিনীয় হয়ে উঠেছিলেন সকলের ভালোবাসার পাত্র। তবে মৃতরা যদি সত্যি সত্যি মৃত্যুবরণ করে থাকেন, আমি এতটুকু সাহস করে মনে করি যে কর্তাসার নিশ্চয়ই লজ্জায় আবার মারা যাচ্ছেন, তার মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী শোকের বিহ্বলতা দেখে। নিজেকে এত ভয় তার মত আর কেউ পেতো না, সেটা বাস্তব জীবনে হোক বা বইয়ের পাতায়, মরণোত্তর সম্মানে বা জমকালো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। উপরন্তু, আমার সব সময়ই মৃত্যুকে বড় অশ্লীল মনে হয়েছে। ‘আশি বিশ্বে একদিন ভ্রমণ’ বইটির এক পর্যায়ে একদল বন্ধু আর হাসি বরদাশত করতে পারে না, যখন তাদের কাছে প্রমান আসে যে তাদেরই আরেক বন্ধু মৃত্যুর মত হাস্যকর পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। সেজন্যেই—তাকে চিনতাম বলে, তাকে এত ভালবাসতাম বলে—হুলিও কর্তাসারের জন্যে আহাজারি আর এলিজিতে অংশ নিতে আমার ইচ্ছা করেনি। আমি সেভাবেই তাকে স্মরণ করতে চেয়েছি যেমনটা নিশ্চয়ই তিনি নিজেও চাইতেন—বেঁচে থাকার প্রবল উল্লাসে, তার সান্নিধ্য পাবার অন্তরঙ্গ আনন্দে, অপার কৃতজ্ঞতায় যে তিনি এই পৃথিবীর জন্যে এমন এক সাহিত্যসম্ভার রেখে গেছেন যা হতে পারে অসমাপ্ত কিন্তু তার স্মৃতির মতই অপরূপ ও অবিনশ্বর।



টীকা: থেলোনিয়াস মংক (১৯১৭-১৯৮২)—কিংবদন্তীতুল্য কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন জ্যাজ পিয়ানিস্ট।




সূত্র : arts.bdnews24.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ