কেউ একজন হেজে-মেজে মরে গেলে না হয়, তখন, ১৭বার জ্বালানি ফুরিয়েও ১৮ নম্বর জ্বালানিটা ভরে, আসমানে হেলিকপ্টার ঘুরিয়ে, ঝিঁঝিঁ পোকার মত উড়ে উড়ে হাওয়া তুলে, ধুলোবালি ছিটিয়ে এই গ্রামের কত দিনকার পুরোন সাপ-খোপে ভরা কুঠিটায় বাস করতে আসা মেকিয়াভেল্লি সাহেবের এহেন আব্দুর রহমানের ভিটায় এমন করে ওৎপেতে বসে থাকাটাকে জাস্টিফাই করা যেত – কিন্তু সেই রকম আর তো কিছু ঘটেনি।
আব্দুর রহমান যুতসই অ্যানসার না পেয়ে, তাই, আরও ভাবে – কেউ একজন হেজে-মেজে মরে গেলে নাহয়, তখন, মহল্লার এইসব বালবাচ্চা সমেত বুড়ো, আইবুড়ো, মুরুব্বিদের তার দরজা ভেজানো আঁতুড় ঘরটার সামনে এইরকম করে ভিড় জমানোটাকে কিংবা এই জটলার মধ্যিখানে লোকাল কেবল চ্যানেলের সোনি হ্যান্ডিক্যাম নিয়ে এইরকম কুত্তার মত শুঁকে শুঁকে, দরজার ফুটোফাটা দিয়ে যদি কিছু একটা দেখা যায়, অর্থ্যাৎ, ছোঁকছোঁক করাটাকে নিশ্চিত ভাবেই জার্নালিস্টদের ইহাই ধর্ম কিংবা প্রকৃত মানুষজনের ইহাই একান্ত প্রবণতা – এইসব বলেকয়ে, ভেবে নিয়ে, দুদণ্ড রিলিফ পাওয়া যেত।
আব্দুর রহমান যুতসই অ্যানসার না পেয়ে, তাই, আরও ভাবে – কেউ একজন হেজে-মেজে মরে গেলে নাহয়, তখন, মহল্লার এইসব বালবাচ্চা সমেত বুড়ো, আইবুড়ো, মুরুব্বিদের তার দরজা ভেজানো আঁতুড় ঘরটার সামনে এইরকম করে ভিড় জমানোটাকে কিংবা এই জটলার মধ্যিখানে লোকাল কেবল চ্যানেলের সোনি হ্যান্ডিক্যাম নিয়ে এইরকম কুত্তার মত শুঁকে শুঁকে, দরজার ফুটোফাটা দিয়ে যদি কিছু একটা দেখা যায়, অর্থ্যাৎ, ছোঁকছোঁক করাটাকে নিশ্চিত ভাবেই জার্নালিস্টদের ইহাই ধর্ম কিংবা প্রকৃত মানুষজনের ইহাই একান্ত প্রবণতা – এইসব বলেকয়ে, ভেবে নিয়ে, দুদণ্ড রিলিফ পাওয়া যেত।
কিন্তু কেউ তো আর হেজে-মেজে গিয়ে মরে যায়নি। তবে?
আব্দুর রহমান তাই জটলা থেকে বেরিয়ে এসে, একখানা বিড়ি ধরিয়ে আবার জটলাটার দিকে তাকায়। ওখানে মেকিয়াভেল্লি সাহেব কাকে যেন কী বোঝাচ্ছেন। ভেতর থেকে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল। মইনুদ্দিন হাজি ফুচুৎ করে পানের পিক ফেললেন হ্যান্ডিক্যামওলা লোকটার পায়ের পাশে। লোকটা অমনি সরে দাঁড়াল। মইনুদ্দিন হাজি, তখন, দাড়ির ফাঁক দিয়ে লারেলাপ্পা ছোকরাদের মতন সেইদিকে তাকিয়ে হাসি ছাড়েন।
দরজার ফাঁক দিয়ে এই যেন কান্নার সাউন্ড পাওয়া গেল না? আব্দুর রহমান চমকে ওঠে। বিড়িতে শেষ টানটা দিতে দিতে আবার নিজের ভুল বুঝতে পারে সে। তার খালাত বোন এই তো এক হাঁড়ি গরম পানি নিয়ে দরজার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, ওই। সেই সুযোগে ভেতরের সট্-টা মিস করে মাটিতে পা ছড়ছে কেবল চ্যানেল। আব্দুর রহমানের কেমন হাসি হাসি পায়। কিন্তু এত লোকের সামনে সে হাসতে পারে না। দাঁতে দাঁত চেপে, চোয়াল দুটো শক্ত করে, যেন হেভি চিন্তায় আছে সে, এমন ভান করে দাঁড়িয়ে থাকে।
- আরে...ওই, ওই তো।
মইনুদ্দিন হাজি মেকিয়াভেল্লি সাহেবকে তার কাছে নিয়ে এসে বলেন, এই তো উনি।
মেকিয়াভেল্লিকে সকলে মেকি সাহেব বলে ডাকে। মেকি সাহেবের ভাষা কেউ বোঝে না। তবে তিনি কথা বলার সাথে সাথে হাত-মুখ নেড়ে নিজের ভাবটা বুঝিয়ে দিতে পারেন। আবার অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝিতে কেলেঙ্কারিও ঘটে। তো, মেকি সাহেব বলেন, Endresto le felasco?
আব্দুর রহমান ভ্যাবাচাকা খেয়ে মইনুদ্দিন হাজির দিকে তাকায়। মইনুদ্দিন হাজি অবাক চোখে মেকিয়াভেল্লির দিকে তাকিয়ে থাকেন। সাহেব বুঝতে পারেন, এরা কিছু বুঝতে পারেনি। তিনি ডান হাতের মাঝখানের আঙুলটা দিয়ে বুড়ো আঙ্গুলের পাশের আঙুলটা চেপে দু আঙুলের মধ্যিখানে ডিমের মত ফাঁক তৈরি করলেন। তারপর বাম হাতের কড়ে আঙুলটাকে সেই ফাকের ভেতর গলিয়ে মুখ দিয়ে Tick tick, tick tick শব্দ বের করলেন। মইনুদ্দিন হাজি এতক্ষণ চুপ ছিলেন। এবার সাহেবের কৃত্তি দেখে, হাসব হাসব করেও শেষে তোয়বা তোয়বা করে, মাথা নাড়াতে নাড়াতে ওখান থেকে বেরিয়ে গেলেন। আব্দুর রহমান মেকি সাহেবের কাছে এগিয়ে এসে, কানে কানে বলে, খুব মস্তি, না?
মেকি সাহেব আর কি বলবেন! তিনিও তো আব্দুর রহমানকে ঠিক ঠাহর করতে পারছেন না। তবু মানুষটার চোখ মুখের চাউনি দেখে যেন ভরসা পান। কোনমতে বলতে পারেন, Incesto la felasco undruma?
আব্দুর রহমান আর বোঝার চেষ্টা করে না। নিজের মনেই বলে, ইনচেস্টো, ইনচেস্টো।
তারপর খানিক দূর হেঁটে ইটের গাঁথুনি করা চাতালটায় এসে বসে। মেকি সাহেব এইখানে পৌঁছুলে আবার সে বিড়বিড় শুরু করে।
এই সময় তার মুখনিঃসৃত ‘বিড়বিড়’কে যদি শোনা যেত বা লিখিত অবস্থায় পড়া যেত, তবে নিশ্চিত ভাবেই আব্দুর রহমানকে অনেকটা অনুধাবন করবার সুযোগ পেতাম আমরা। সেক্ষেত্রে, আব্দুর রহমানের অতীত-বর্তমান ঘেঁটে একটা গল্প খাড়া করা (যারা গল্প লিখতে পারেন, তাদের পক্ষে) খুব মুশকিলের হত না। কিন্তু আব্দুর রহমানকে আমরা অনুধাবন করতে যাবই বা কেন? – এই প্রশ্ন মাথাচাড়া দিলে, মেকি সাহেব তৎক্ষণাৎ উত্তর দিবেন, যেহেতু এই গল্পে আব্দুর রহমান ইতিমধ্যেই উপস্থিত, সুতরাং, তাকে টপকিয়ে এই গল্প এগোতেই পারে না। তখন, হয়ত কিছু মনে পড়ায় আব্দুর রহমান বিড়বিড় করা থামিয়ে মেকি সাহেবের দিকে তাকায়। মেকি সাহেবের অমন লাল-লাল সাদা গাত্রবর্ণের সহিত তার নিজের এমন পিচ রাস্তা সদৃশ কেলে কুচকুচে রঙের বৈসাদৃশ্য দেখে সে বুঝতে পারে, সেদিন ভোটার কার্ডের জন্য ছবি তুলতে যাবার সময় নিলু কেন রুমালে করে ফেসপাউডার নিয়ে গেছিল।
ও, বলা হয়নি, নিলু মানে নিলুফার - আব্দুর রহমানের বিয়ে করা বউ। বিয়ে করার আগে অব্দি নিলু আব্দুর রহমানের কেউ ছিল না। সে তার খালাত বোনের বৌভাতে সাদা লুঙ্গির উপর কচি কলাপাতা রঙের ভেলভেটের সার্ট চাপিয়ে গোশ-ভাত খেতে গেলে নিলুফারকে প্রথম দেখে। এর কিছুদিন পর, সাত আটদিন পর হয়ত, এক রাতে বর্জ্রবিদ্যুৎ সহযোগে বৃষ্টি নামলে, পরের দিন সকালবেলায় মইনুদ্দিন হাজির আম গাছটার তলায় সে বাজে পোড়া খাতা দেখতে পায়। খাতাটার পাশে আবার গাছের ডাল থেকে খোসে পড়া একখানা চিকন পাখির বাচ্চাও রয়েছে। সে গাছে উঠে পাখির ছানাটাকে ডালের ফাঁকে গুঁজে দিতে গেলে ভাবে, আর একটু উঠি – আর একটু উঠলে ভাবে আরও একটু উঠি, এইভাবে বেশ খানিকটা উপরে উঠে এলে তার মনে সন্দেহ জাগে - আরে, চিকন পাখির বাসাটা হয়ত এই গাছটায় ছিল না, আশপাশের অন্য কোন গাছে ছিল, কিংবা কেউ হয়ত ইয়ার্কি করে খাতাটার পাশে চিকন ছানাটাকে অমন করে রেখে দিয়েছে। সে এইসব ভেবে নিচে তাকায়। নিচে তখন বর্জ্রবিদ্যুত ভর্তি খাতাটা নিয়ে নিলুফার তার দিকে হাসি ছাড়ছে।
অথচ, বিয়ের পরেও নিলুফার কখন স্বীকার করে না, সেই মুহুর্তে সে খাতাটা বুকে চেপে আমগাছে উঠে পড়া আব্দুর রহমানের লুঙ্গির ফাঁক দিয়ে কোণ কিছু দেখে আকৃষ্ট হয়ে ছিল; তাই সে হেসে ছিল। বরঞ্চ এই সব প্রসঙ্গ এলেই সে সাদা সাদা বালিকাদের মত ভ্যা করে একধরণের আওয়াজ তুলে পাশ ফিরে শোয়। এতে আব্দুর রহমান তার বিয়ে করা বউটাকে চিকন পাখির ছানার মতই নরম ভাবতে শুরু করে। কিন্তু সে তো আসলে হাতঘড়ি সারানোর মেকানিক, সে জানে, কোণ স্প্রিং-এ কতটুকু প্যাচ দিলে কোন কাঁটা কতক্ষণ ঘুরতে পারে – ফলে, সে চোখের উপর ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস আঁটে; এর ওদিকে নিলু, অর্থ্যাৎ, নিলুফার ঘর ঝাঁট দিয়ে, ঘর মুছে রান্না করে, নিজে খেয়ে নিয়ে, বরের জন্য খাবারটা চাপা দিয়ে, পা দুটো পেটের কাছে টেনে এনে ঘুমিয়ে পরে কখন।
- La grendo est lovery undrosto que la felasco?
মেকি সাহেবের কথায় কব্জি ঘুরিয়ে টাইম দেখে আব্দুর রহমান। নিজেকে থতমত খাওয়া পুরুষ বলে মনে হয় তার। সে এমনি একবার মেকি সাহেবের দিকে চেয়ে হাসে। তার ঘরের সামনে লোকজনের ভিড় আগের মতই রয়েছে। এই প্রথম নিলুর জন্য তার মনটা নিংড়ে ওঠে। সে জটলাটার দিকে পা বাড়ায়। ওদিকে কেবল চ্যানেলের লোকটা নিলুর বাচ্চা পাড়ার ছবি তুতে না পেরে মইনুদ্দিন হাজির বাইট নিতে শুরু করেছে।
কে চ্যাঃ আপনার নাম?
ম হাঃ মইনুদ্দিন মোল্লা। হাজি মইনুদ্দিন মোল্লা।
কে চ্যাঃ আপনি তো এই অঞ্চলের একজন বিশিষ্ট ব্যাক্তি। আপনি জনাব আব্দুর রহমানকে কতদিন ধরে চেনেন?
ম হাঃ বলব?
কে চ্যাঃ বলবেন না কেন? মন খুলে বলুন।
ম হাঃ তা প্রায় ওর জন্ম থেকেই চিনি।
কে চ্যাঃ আব্দুর রহমানের জীবিকা কি?
ম হাঃ জীবিকা মানে কী কাম-কাজ করে, তাই তো?
কে চ্যাঃ হ্যাঁ। উনি কী কাজ করেন?
ম হাঃ বলব?
কে চ্যাঃ আরে, বলুন বলুন।
ম হাঃ ও ঘড়ি সারানোর মিস্ত্রি। ওর বাপও ঘড়ি সারাত। তাই ও নিজেও ঘড়ি সারায়। গঞ্জের মুখে ওর বাপের ঘড়ি সারানোর একটা দোকান ছ্যালো। এখন আব্দুর ঐ দোকানটাতে বসে। ও আমার ঘড়িটা সারিয়ে দিয়েছে। ও আমার ছেলের ঘড়ির বেল্টটাও সাইজ মত কেটে ছোট করে দিছিল। ও ঘড়ি সারায়।
কে চ্যাঃ সময়ের সঙ্গেই ঘর বাঁধেন আব্দুর রহমান। সম্যকে উনি সঠিক পথ দেখান। তাই তো?
ম হাঃ বলি?
কে চ্যাঃ নিশ্চয়। তবে তার আগে আমরা জানতে চাই, আব্দুর রহমানের বিয়েতে কি আপনি উপস্থিত ছিলেন?
ম হাঃ বলব?
কে চ্যাঃ কি মুশকিল। অত বাইট খাচ্ছেন কেন? শুধু উত্তর গুলো দিন।
ম হাঃ হ্যাঁ। ওর সাদিতে খেইছিলুম।
কে চ্যাঃ কতদিন আগে বিয়ে হয়েছিল?
ম হাঃ তা ৫-৭ বছর তো হবেই।
কে চ্যাঃ কতজন লোক এসেছিল বিয়েতে?
ম হাঃ তা ১০০, না ১৫০-২০০ও হতে পারে। ওই ধরেন ১৫০ জন তো হবেই।
কে চ্যাঃ আপনি বললেন ৫-৭ বছর আগেই ওনার বিয়ে হয়ে গেছিল। এদিকে আপনারা তো বছর ঘুরতেই বাচ্চা নেন। এতদিনে ওনার অন্তত দুটো বাচ্চা হয়ে যাবারই কথা। অথচ এই প্রথম ওনারা বাচ্চা নিচ্ছেন। এর পেছনে আপনি কি অন্য কিছুর সন্ধান পাচ্ছেন?
মইনুদ্দিন হাজি ফিক করে হেসে ফেলেন। আবার উত্তর দিতে গেলেও হাসি থামাতে পারেন না। এর মধ্যে কে যেন, মাথা দেখা যাচ্ছে, বলে চেঁচিয়ে উঠল। চারদিকে হুলস্থুল বেঁধে গেল। কেবল চ্যানেলের লোকটা মইনুদ্দিন হাজিকে গোত্তা মেরে সেদিকে ছুটল। এদিকে আব্দুর রহমান হাজি সাহেবের কাছে গেলে মইনুদ্দিন হাজি তখনও হাসতেই থাকেন। এতে আব্দুর রহমান সিরিয়াস হয়ে যায়। তখন HMT-এর অত ছোট ডায়ালের উপর চোখে আইগ্লাস এঁটে সে যেরকম ঝুঁকে পড়ে খরিদ্দারদের তোয়াক্কা না করেও থাকতে পারত, সেইরকম মুখভঙ্গি করতে পারে। মইনুদ্দিন হাজি বলে, কী?
আব্দুর রহমান উত্তর করে না। তবে ঘটনা হল অন্য – মোবাইল ফোনের চলন বেড়ে যাওয়ায় মানুষেরা হাতঘড়ি পরা ছেঁড়ে দিচ্ছে প্রায়। এখন সময় দেখতে চাইলেই ফোনের বোতাম টেপে। তার দোকানের সামনেই একটা মোবাইল সারানোর দোকান হয়েছে। দুই ছোকরা ভাই মিলে এই দোকান চালায়। দোকানে লোকজন আসা যাওয়া করে বেশ। দোকানের ভেতর একটা ছোট্ট ল্যাপটপও আছে। এই ল্যাপটপ দিয়ে নাকি আবার ফোনের ভেতর গান, ভিডিও, থ্রি-এক্স, জাকির নায়েক এইসব লোড করা যায়। আব্দুর রহমানেরও মোবাইল আছে। তবে তার ফোনে গান শোনা যায় না। এখনও সে কব্জি ঘুরিয়ে টাইম দেখে।
তবে উপরের লাইনগুলো পড়ে আমরা যদি ভেবে নিই আব্দুর রহমান সময়ের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছেন না – সেই ধারণা হবে নিতান্তই ভুল। মইনুদ্দিন হাজির কাছ থেকেই জানা যায়, আব্দুর রহমান বেশ নতুন নতুন ডিজাইনের ঘড়ি কিনে দোকানের দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছিল। তার মতে, হাত ঘড়ির ব্যবহার কমে এলেও এখনও মানুষে বিয়ে-শাদিতে দেয়াল ঘড়ি গিফট দিতে ছাড়ে না। দেয়াল ঘড়ির দামও কম, আবার রংচঙে কাগজে মুড়ে দিলে উপহারটাকে বড়ও দেখায়। তাছাড়া বইয়ের ঠিক আগে, নিলুফারের বাপের পয়সায়, সে ল্যান্ডলাইন টেনে দোকানের বাইরে একটা STD-ISD মার্কা হলুদ বাক্স ঝুলিয়ে ছিল। মেয়েরা ফোন করতে এলে সে আঁড়ি পেতে কথাবার্তা শুনত। ইয়ং মেয়েরা কত নতুন নতুন শব্দ জানে। ইয়ং মেয়েদের প্রশ্নগুলো শুনে ওপারের কলেজের ছেলেরা কী কী উত্তর দিতে পারে, সেইসব সে নিজের মনে সাজাত। কখনও সুযোগ পেলে তা নিলুর উপর প্রয়োগ করত। যেমন-
- তোমাকে একঘর লাগছে।
- একঘর মানে কী?
- একঘর মানে হেভি।
নিলু তখন হাত দুটো বুকের কাছে টেনে এনে দিদিমণিদের মত হয়ত বলত, ইসস।
কিংবা সে এইসব কিছুই না বললেও, অন্যকোন দিন যদি ইয়ং ছেলেরাও ফোন করতে আসে তো আব্দুর রহমান মিনিট, সেকেন্ড, আওয়ার হুইল আর পিনিয়ন নিয়ে ঝুঁকে পড়ে কান খাড়া করে বসত।
সেই রকম একদিন, সবে সে টেবিল ঘড়িটার কেসিং-এর ভেতর মেসিনের স্ক্রু ঢিলে করছে, মইনুদ্দিন হাজি তার দোকানে ঢুকে একটা টুল টেনে বসে খালি খালি পিচপিচ করে হাসেন।
- কী গো হাজি সাহেব?
- মইনুদ্দিন হাজি বলেন, এই এলুম। তবে তার চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি যেন কিছু বলতে চাইছেন। বলতে না পেরে খালি হাঁকপাঁক করছেন।
আব্দুর রহমান তাকে সুযোগ করে দেয়, চা খাবেন?
মইনুদ্দিন হাজি বাইরে বেরিয়ে মুখের পানটা ফেলে আসেন।
আব্দুর রহমান ফ্লাস্ক থেকে দুটো প্লাস্টিকের কাঁপে চা ঢালতে ঢালতে বলে, কী?
এবার মইনুদ্দিন হাজি চায়ে চুমুক দিয়ে নিজের ভেতর কথা গুলো তৈরি করে নেন। তারপর অনায়াসেই বলতে পারেন, ভোটার কার্ডে নাকি ভুল্ভাল নামপত্তর এইচে?
আব্দুর রহমান হাসে, অনেকের নামের বানানই তো ভুল্ভাল এইচে। রমজান কয়ালের নাম এইচে রমজান কয়লা।
- না, না। ঐরকম ভুল না।
- তবে?
মইনুদ্দিন হাজি চারদিকে তাকিয়ে বলেন, তা লুকোনোর তো কিছু নেই। এখন তো সব্বাই জেনে গেছে।
- কী জেনেছে?
- ঐ যে, মইনুদ্দিন হাজি চোরা হাসি ছাড়েন, শুনলুম বউমার ভোটার কার্ডে পিতার নামের পাশে নাকি তোমার বাপের নাম ঢুকে গেছে? এ তো মুশকিল গো।
- হুম। কার্ডটা চেঞ্জ করাতি হবে।
- তা করাতি পারো। মইনুদ্দিন হাজি টুলটা টেনে আনেন, তবে বাতাসে অন্য কথা ভাসছে।
- কী কথা?
- ঐ যে, তোমার আর তোমার বউ-এর বাপের নাম যদি এক হয়, তো, তোমরা তো ভাইবোন হয়ে গেলে। সরকার তোমাদের ভাইবোন বাইনে দিছে।
চা-টা শেষ করে আব্দুর রহমান বলে, কী সব হেজিপেজি বলো হাজি সাহেব?
- তোয়বা তোয়বা, কথাটা আমার না। মইনুদ্দিন হাজি দুদিকে মাথা নেড়ে বলেন, মেকি সাহেব বলেছে এইসব একটা ডিজাইন। নক্সা। এই নক্সায় তোমাদেরকে ফেলে গভরমেন্ট নক্সাটাকে যাচাই করতে চায়। আবার গভরমেন্টের কাছে নাকি সার্চলাইট না কী একটা আছে। ঐ বাতির তলায় সবকিছু দেখা যায়।
- সার্চলাইট?
- হু।
- তা মেকি সাহেবের এতসব কথা তুমি বুঝলে কী উপায়ে?
- ঐসব বোঝাটোঝা যায়। মইনুদ্দিন হাজি নিজের চা শেষ করে বলেন, এবার যাই গো। উঠতে গিয়ে তিনি আবার বসে পড়েন, এই যা। যে জন্যি এইছিলুম। তিনি পকেট থেকে একটা সোনালি বেল্টের ঘড়ি বের করে বলেন, ছেলে এবের মাধ্যমিক দেবে, বুঝলে। ঐ দিকে ছেলেটা তো হাড্ডিসার। খায়দায় না। দাও তো দু ঘাঁট বেল্টটা কমিয়ে দাও তো।
সেইরকম কোন একদিন ঘড়ির যন্ত্রপাতি খুলে কলকব্জা নাড়বার আছিলায় সে তখন ডান হাতের তালু চুলকায়। তখনি তার ঘরের সামনের ভিড়টা চেঁচিয়ে ওথে হঠাৎ। কয়েকজন ছুট লাগিয়েছে ওদিকে। সেও দ্রুত হেঁটে ভিড়ের দিকে যায়। মাকি সাগেব তার কাঁধে চাপড় মেরে বলেন, La menastro ceilino un jest gazing. মেকি সাহেব আঙুল নির্দেশ করেন। সে তাকিয়ে দেখে, কেবল চ্যালেনের লোকটা তার টালির ছাদে উঠে, ক্যামেরা লাগিয়ে, হামাগুড়ি দিচ্ছে। টালির ফাঁক দিয়ে সে কি নীলুর বাচ্চা বের করা দেখতে পাচ্ছে? আব্দুর রহমান কিন্তু এইসব ভাবে না। সেই যে, একটু আগে, তার খালাত বোন গরম পানি নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকেছিল, এখন সে পানিতে ন্যাকড়া ভিজিয়ে কেমন ভাবে নীলুর সেবা করছে – এইটা দেখবার জন্য সে নিশপিশ করে ওঠে। কেননা, কোন একদিন, নীলু তখনও পোয়াতি হয়নি, সে দোকানে যাবার আগে বলে, আজ আর রান্না কোরো না। দোকান ঠেকে ফেরবার পথে একখানা ম্যাগির প্যাকেট কিনে আনে। তারা দুপুরবেলা ম্যাগি ফুটিয়ে খায়। পরস্পরকে আদর করে। আদর করার পরে, উদোম গায়ে টিভি চালিয়ে খবর শোনে কতক্ষণ। তারপর বিকেলের দিকে, হলুদ প্লিথিন ব্যাগে নীলুর মুখ ঢেকে দিয়ে, নিজে আর একটা প্লিথিনে মাথা ঢুকিয়ে বসে থাকে। বসে বসে খুকখুক করে হাসে। বলে, এই পেলাস্টিকের ভেতর হাসাহাসি করলি যেরম আওয়াজ হয়, চিকন পাখির ঝাঁক রাতেরবেলা উড়লি ওইরম শব্দ ভাসে। তুমই চিকন পাখির ঝাঁক দেখবে?
- তোমার মতলবটা কী? সরকার আমাদের ভাইবোন বাইনে দিছে। এখন আমাকে দেখলি তোমার নিজের বোনের কথা মনে ভাসে, না?
- আমার আবার বোন কোথায়?
- তবে যে বোন ভূমিতে আসেনি, তার কথা ভেবে আমাকে আদর কর? আদরে আরাম পাও?
আব্দুর রহমান পলিথিন থেকে মুন্ডু বার করে। নীলুর বুকে হাত বোলায়। নীলুকে উপুড় করিয়ে দেয়। নীলুকে উপুড় করিয়ে তেল মাখায়। তেল মাখালে, সন্ধ্যা পড়ার মুখে নারকেল গাছে যেমন চকচকে ডাব ঝুলে থাকে, ডাবের ভেতর যেরক্ম অতি গোপনে পানির মত রস থইথই করে – নীলুকে তেমনি তার নিজের ঘরের, একান্ত নিজের থইথই করা পুকুর মনে হয়। সে নীলুকে বলে, এই রকম।
- এই রকম?
সে আবার বলে, হ্যাঁ, এইরকম, এইরকম। ঠিক এইরকম।
কিন্তু মানুষের বাচ্চাটাকে পেটে ধরবার পর থেকে সে আর নীলুকে গোপনে রাখতে পারে না। গোপনে থেকে নীলুকে দেখতেও ভুলে যায়। নীলুর খাটা খাবার সখ হলে রহমজান কোথা থেকে আমলি নিয়ে আসে। পুকুরে থালাবাসন মাজতে গেলে তার খালাত বোন হয়ত চোখ নাচিয়ে বলে, তোরা কি সত্যিই ঐরকম?
এদিকে নীলুর শরীরে গরম বেড়ে গেছে। সে মেঝেতে চিৎপাত হয়ে ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে দেয়।
তখন হয়ত মইনুদ্দিন হাজি চা খেতে খেতে আবার বলে, ভাইবোনের থাকা-খাওয়াটা হারাম।
- নীলু কি আমার নিজের বোন নাকি?
- তোমাদের বাপ তো একজনই।
- ও তো ভোটার কার্ডের জন্যি।
- কিন্তু কাগজটা তো সরকারি।
- আর সত্যি জিনিসটা?
- সত্যি আবার কী?
আব্দুর রহমান ভ্যাবাচ্যাকা খায়, কী বলো গো হাজি সাহেব? আমাদের বে-টা তবে ভুল ছিল? হারাম জিনিস?
- ভোটার কার্ড তো সেই কথাই বলে।
- এখন?
- দেখো কেতাব-হাদিস এসব তো আর সরকারি কাগজ দিয়ে চলে না। সেই দিক দিয়ে তোমাদের কোন দোষ নেই। আবার কেতাবে আছে, যখন যেইখানে থাকবে সেইখানের আইন মোতাবেক চলতে হবে। এইদিক দিয়ে আবার তোমরা দোষ করেছ। মানে দোষ করনি, কিন্তু দোষ করেছ।
- মানে?
- ঐ যে বলেছিলুম, নক্সা। এইটাই সেই নক্সা। এই নক্সাটাকেই যাচাই করা চলছে।
- কিন্তু আমরাই কেন? শুধু আমাদের কেন এই নক্সাটায় ফেলল?
- আহা কী যে বলো। মইনুদ্দিন হাজি চা শেষ করে মুখে পান নিয়ে বলেন, আচ্ছা বল তো দেখি, এইসবে তোমার কি কোন ক্ষতি হইছে? এতসবে তোমাদের আরাম-আদর কি বেড়ে যায়নি?
আব্দুর রহমান এইসব শুনে নিজের মনেই হাসে। কিন্তু হাসিটা সে নিজের ভেতরই আঁটকে রাখতে পারে না। মইনুদ্দিন হাজি সেই হাসি দেখে ফেলেন ঠিক।
এরপর দুবেলা দোকানে যাওয়াআসা করার সময় সে খালি গুজগুজ ফুসফুস শোনে। এইসব শুনলেই তার খটকা লাগে। লোকজন তবে নীলুকে নিয়েই কথাবার্তা চালাচ্ছে? প্রথমে সে ঠিক করে, এইসব কথাবার্তার কোন উত্তর দেবে না। কদিন পর গুজগুজ ফুসফুস এমনিতেই থিতিয়ে যাবে। কিন্তু একসময় সে নীলুর ফুলে ওঠা পেটে কান পাতলে মানুষের বাচ্চাটার কেমন ঠোক্কর খাবার শব্দ শুনেও রোজকারের কাজ-কাম ঠিক্টহাক করতে পারে। তার মনে হয়, নীলুর সাথে তার সংসার কত দিনের পুরনো হয়ে গেল। এতদিনে তাদের ভাইবোনের সংসার কতদিনের পুরনো; তাই জমাট বেঁধে এল।
সে বলে, সকলে এখন তোমার কথা বলে।
নীলু চুপ থাকে।
- সকলের যেন আর তর সইছে নায়া।
নীলু কথা বলে না।
- সকলে তোমার বাচ্চা পাড়াটা দেখতে চায়।
নীলু তবু চুপ থাকে।
রহমজান মেকি সাহেবের কুঠিতে ফাইফরমাস খাটে। রহমজানের মারফত মেকি সাহেব আব্দুর রহমানকে তলব পাঠিয়েছেন।
আব্দুর রহমান কুঠিতে গিয়ে দেখে, সাহেব আরাম কেদারায় বসে বই পড়ছেন। তিনি আব্দুর রহমানকে দেখে বইয়ের পৃষ্ঠা মুড়ে টেবিলে রেখে দেন। বলেন, Elasdine las cruesto timos?
আব্দুর রহমান ডান হাতের দুটো আঙুল দেখায়।
সাহেব উঠে এসে তার পিঠে হাত রাখেন, Loversoize loverine. Loverine mosalure sicki loist.
আব্দুর রহমান হুম হুম করে এমন ভান করেন যেন সে সব বুঝতে পেরেছে। সাহেব তাকে দুটো টিন দিয়ে মাথায় চাপড় মেরে, পরে হাতের পেশী ফুলিয়ে দেখান। আব্দুর রহমান জানে, এর মানে টিনে পাউডারটা খেলে মানুষের বাচ্চাটার হাড়গোড় শক্ত হবে, মাথায় বুদ্ধি আসবে। সে খুশি মনে ঘরে ফেরে।
আর একদিন তাকে রাস্তার মধ্যে জনা-দশেক লোক ঘিরে ধরে। তারা বলে, আমাদের একটা আবদার আছে।
- আবদার?
- জী। তোমাকে দিয়ে সরকার মোদের মহল্লায় এতবড় জিনিস করতেছে। সেই জিনিসটায় মোরা গাওয়া থাকতে চাই।
- কী বোলতোছো? খুলে বল।
- না, মানে, তোমার যদি আপত্তি থাকে সেই কথাটা আলাদা। তবু মোদের কথাটা একবার চিন্তা করেন।
- কি কথা?
ভিড়ের ভেতর থেকে মইনুদ্দিন হাজি এগিয়ে এসে বলেন, বউমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে?
- কোনটা?
- ঐ যে, ঐ সময় যদি মোরা হাজির থাকি। মোরা ত আর কোন ডিস্টাব করতি যাব না। শুধু জিনিসটার সাক্ষী থাকতি চাই।
আব্দুর রহমান বিরক্তি দেখায়, মেয়েমানুষের মানসম্মান বলে ত কিছু আছে, নাকি!
- আহা রেগে যাচ্ছ কেন? মইনুদ্দিন হাজি আব্দুর রহমানের দুহাত চেপে বলেন, ব্যাপারটা ঐরকম কিছু না।
- তবে?
- আচ্চা বলো ত তুমি ভাল জিনিস দেখতে চাও, নাকি খারাপ জিনিস।
- ভাল জিনিস!
- মরে যাওয়াটা ভাল, না জন্মানোটা?
- জন্মানোটা।
- তবে কেউ মরে গেলে সক্কলে মিলে কবর দিই। আর জন্মানোটা দেখবার জন্যি হাজির থাকতি পারব না? এ কেমন কথা?
আব্দুর রহমান আর কথা চালাতে পারে না। কথার ফাঁসে ফেঁসে যায়। লোকজনের ভেতর মেকি সাহেব এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। আব্দুর রহমান তাকে লক্ষ্যও করেনি। এবার তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, Hulla libra. Hulla libra.
কেবল চ্যানেলের লোকটা ইতিমধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে, ফুটি-ফাটা খুঁজে পেয়ে, শেষে ফুটোয় ক্যামেরা লাগিয়ে ঘরের ভেতরকার ছবি তুলছিল। এই ফুটো দিয়ে নীলুর মুখ ঠিকঠাক ধরা যাচ্ছে না। তাছাড়া ঘরের মধ্যে লাইটও কম। ছবিতে গ্রেইন এসে যাচ্ছে। সে পাশে একখানা আধলা পেয়ে ফুটোটা ভাংতে যায়। ভাংতে গেলে হড়কে পড়ে। হড়কে গিয়ে খানিক নিচে নেমে এসে একখানা টালি জাপ্টে ধরে। টালিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গেলে মচমচ আওয়াজ পায়। পা দুটো কেঁপে ওঠে। তারপর কিছু বোঝবার আগেই, ধপাস করে, দুটো-তিনটে টালি ভেঙে সটান ঘরের মধ্যে আছড়ে পড়ে।
ক’মুহূর্ত ভিড়টা থমকে দাঁড়াল। ভিড়ের ভেতর থেকে প্রথমে চেঁচিয়ে উঠলেন মেকিয়াভেল্লি সাহেব। তিনি Ernesto Undresto বলে চেঁচাতে চেঁচাতে আঁতুড় ঘরটার সামনে এসে থামলেন। আব্দুর রহমান আর কী করে, গাল পাড়তে পাড়তে মেকি সাহেবকে ফলো করলো। মইনুদ্দিন হাজি কিন্তু এগিয়ে এলেন না। তিনি ভিড়ের মধ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে সামনের দিকে কী হচ্ছে তা দেখবার চেষ্টা করছেন। ক’জন ছোকরা আবার ভাঙা টালির ছাদটায় উঠবার চিন্তায় মশগুল। মেকিয়াভেল্লি সাহেব Ernesto বলে সেই দিকে হুঙ্কার ছাড়লেন।
আর কাউকে রোখা যাচ্ছে না। সবাই ঠেলাঠেলি শুরু করে দিয়েছে। সাহেব দরজা আগলে কখনও
Incesto কখনও Felasco কখনও Undresto এইসব বলে ভিড় সামলাচ্ছেন।
আব্দুর রহমান দরজায় ধাক্কা দেয়। সেও ‘ইনচেস্টো’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে। একসময় কে যেন তাকে ধাক্কা মেরে, মেকিয়াভেল্লির গায়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালাল।
ঐ পালাচ্ছে, ঐ।
দেখা যায়, কেবল চ্যানেলের লোকটা গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে দৌড় লাগিয়েছে। জটলাটা মুহুর্তে সেই দিকে ছুট লাগায়। সাহেব কিন্তু ভিড়ের মধ্যে এগোলেন না। তিনি ঘরের পেছন দিক দিয়ে বাগানের ভেতর ছুট লাগালেন। আব্দুর রহমান মেকি সাহেবের পিছু ধড়ল।
মইনুদ্দিন হাজির আমগাছটার তলায় তারা ক্যামেরাম্যানের মুখোমুখি। মেকিভেলি সাহেব Incesto বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। আব্দুর রহমান সেইদিকে তাকিয়ে, খনিক নীচু গলায় বলল, ইনচেস্টো।
ক্যামেরাম্যান হাঁপাচ্ছে।
মানুষজনের এদিকে আসার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
ক্যামেরাম্যান বলে, ভেঙে দেবে। ওরা ক্যামেরা ভেঙে দেবে। তার চে’ এটা আপনার কাছেই রাখুন।
সে ক্যামেরাটা মেকি সাহেবকে দিয়ে ধপাস করে ওখানেই বসে পড়ে। এদিকে এখান থেকে মেকি সাহেবের কুঠি বেশ দূর। অত দূরে যাবার টাইম নেই। মেকি সাহেব কী যেন চিন্তা করলেন। তারপর ক্যামেরাটা গলায় ঝুলিয়ে, তরতর করে আমগাছে উঠে, মগডালে পা ঝুলিয়ে বসলেন।
আব্দুর রহমানও কাছা বেঁধে নিয়েছে। তবে সে সেই চিকনপাখিকে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি গাছে উঠেছিল, এখন অত সহজে আর উঠতে পারে না। ঘষটা লেগে হাঁটুর কাছটা ছলে যায়। একটা ডাল ধরতে পারলে ডালটা যেন নুইয়ে আসে। তারপর কোনও মতে মেকিয়াভেল্লির কাছে পৌঁছুলে সাহেব তাকে হাতের ইশারায় বসতে বললেন।
ইতিমধ্যে গাছটাকে ঘিরে ভিড় জমে উঠেছে। ভিড়ের ভেতর ক্যামেরাম্যাঙ্কে নিয়ে লোকজন চেঁচামিচি শুরু করে দিয়েছে। মইনুদ্দিন হাজি তাদের আর সামলাতে পারছেন না।
মেকি সাহেব ফাস্ট-ফরোয়ার্ড করে আস্ল জায়গাটায় থামলেন। প্লে বটনে চাপ দিতেই, আব্দুর রহমান দেখল, ক্যামেরার অত ছোট স্ক্রীনের ভেতর নীলু কাতরাচ্ছে। দুটো হাত ন্যাকরা দিয়ে নীলুর মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে। তারপর দুপায়ের ফাঁক। দুপায়ের ফাঁকের ভেতর কী যেন হচ্ছে, ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। কালো কালো বিজকুড়ি অন্ধকার। সেই অন্ধকারের ভেতর দুটো হাত ঢুকে গেল। হাত দুটো কী ধরে টানছে। টেনে বার করতে চাইছে।
আর কী আশ্চর্য্য, খানিক পর, দেখা যাচ্ছে, সেই কালো কালো অন্ধকারের দানার ভেতর একটা হড়হড়ে শ্লেষ্মা মাখা, রক্তজল মাখা, নাপাক শিশুটিকে ধরে আছে দুটো হাত।
তখন মেকিয়াভেল্লি সাহেব, ক্যামেরা অফ করে, অস্থির ভাবে আব্দুর রহমানের দিরে তাকায়।
আর আব্দুর রহমান নীচের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বুঝতে পারে – এই এত যুগ পরেও, এত বছর পরেও, এখনও কত সহজে একজন হারামের বাচ্চা এই দুনিয়ায় জন্মে যেতে পারে।
0 মন্তব্যসমূহ