মনমোহন মহাজনের ৩য় কন্যার বিবাহ-বাসরে পাশা খেলা দেখবো বলে আমরা সবাই মহাজন-বাড়িতে রাত জেগে উত্তেজনা বাড়াই। মহাজনের শ্যাওলা-ধরা দোতালা ঘরে দিনের বেলায় রাত হয়ে থাকে। পুরনো আমলের ঘরটিতে আলোবাতাস ঢুকতে পারে না বলেই মনে হয়।
এমনিতেই এতো বড়ো শানদার বাড়িতে গাছ-গাছালির আব্রু ভেদ করে রোদ এসে উঠানে নামা সম্ভব হয়ে উঠে না। দীঘির সমান পুকুরটি তাই কালো মিজমিজা ছায়ার জলে ডর জিইয়ে রাখে অষ্টপ্রহর। এতো নির্জন ছেবা-বাড়িতে মানুষের কোলাহল আজ রাতের বেলায়ও আলো নিয়ে আসে। ‘আজ পাশা খেলবো রে শ্যাম’- দীন হীনের পাশা খেলা আমাদের নির্ঘুম চোখে বাদ্য হয়ে বাজে। ৩য় কন্যার নাম অবশ্য রাধা নয়, কল্পনা।
আমরা সবে আজমনি বহুপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ি। শ্রীমতি কল্পনা রানী দত্ত, রুল নং ৪২? উপস্থিত। আমাদের কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। শ্রীমতি কল্পনা রানীর শ্রী আমাদের নজর কাড়ে না। কণ্ঠও আমাদের কাছে সুরহীন লাগে। মনমোহন মহাজন, যাকে আমরা মনমহাজন ডাকি, শ্রীহীন সপ্তকন্যা নিয়ে বিপাকে পড়লে লোকজন আনন্দিত হয়। মনমোহন সুদখোর। কিন্তু সুদ নিয়ে কাউকে সে বাড়ি ছাড়া করেছে, হালের গরুহীন করেছে- এমনতর সংবাদ কোথাও শুনিনি। তারপরও সুদখোর বলে কথা! বিজাতী মনমোহনকে সকলেই তাই সুদখাউরা-মনমন বলে ডাকে, তবে আফর্কে। অর্থ্যাৎ আড়ালে। সামনে এলে মহাজন হয়ে যায়। মহাজনের সাতকুলের আর কেউ বাকি নাই।
সকলেই বর্ডার পাড়ি দিয়েছে। মনমন কেনো যায়নি? আমরা মাঝেমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ হই, কিন্তু কোনো সমাধানে আসতে পারি না। শ্রীমতি কল্পনা রানীর বিবাহ-বাসরে এসেও আমরা তা ইয়াদ রাখি। শতে ২০ টাকা সুদ নিয়েও মনমহাজন কেনো বিলের পর বিল ধানী জমি জাবেদ মিয়ার কাছে পানির দামে বিক্রি করে দেয়- আমরা তার কূলকিনারা করতে পারি না।
জাবেদ মিয়ার বড় ভাই লন্ডনে থাকে। মনমন-মহাজন চারপাশের সমাজে কাউকেই বিশ্বাস করে না, তবে জাবেদ মিয়া ব্যতিক্রম। একমাত্র তার কাছেই সে কেনো জায়গা বিক্রি করে দেয়, আমরা তারও কোনো কূলকিনারা করতে পারি না। মহাজনের দিন পড়তে থাকে। সপ্তকন্যার দ্বার গ্রহণের জন্য যারা আসে, তারাই কি তার কারণ? নাকি অন্য কিছু? কেউই কিছু বলতে পারে না। জায়গা-জমি বিক্রি করতে করতে একসময় বাড়িও সে বিক্রি করে দেয়।
জাবেদ মিয়া মহাজন-বাড়িতে উঠে আসে। তবে পুরনো দিনের দোতালা ঘর এখনও মহাজন ছেড়ে যায়নি। পাশের অংশে জাবেদ মিয়ার পরিবার বাস করে। আমরা তাদের ঘরে পানি খাই, মহাজনের ঘরে জল। মনমোহনের বুড়ি-মা দেবতা-ঘরে সন্ধ্যায় উলুধ্বনি দিলে পাশের ঘরে জাবেদ মিয়ার বুড়ি-মা নামাজে দাঁড়িয়ে পড়েন। জাবেদ মিয়া জোরে জোরে আকামত দিয়ে নামাজের সুরা পাঠ করে।
কোথাও কোনো ছন্দপতন নাই। একমাত্র জাবেদ মিয়ার কাছে জায়গা বিক্রি করায় আশপাশের সকলেই তাকে আড়চোখে দেখে। জ্বালাতন বাড়ায়। তারপরও মহাজনকে সারাক্ষণ জাবেদ মিয়ার কাছেই পড়ে থাকতে দেখি। এ-বাড়ি আর মহাজনের নয়। কল্পনা রানীর বিবাহের পরেই তাকে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। বিয়েবাড়িতে মহাজনকে তাই মনমরা দেখায়। আমাদের তাতে মাথা ব্যথা নাই। আমরা শ্রীমতি কল্পনা রানীর বিবাহ বাসরে মজে থাকি।
হঠাৎ আত্মীয় জাবেদ মিয়ার ডাকে পাশা খেলার উত্তেজনা বাদ দিয়ে সাড়া দিতে হয়। নিরক্ষর জাবেদ মিয়ার কিছু একটা লিখে দিতে হবে। তার মাখরা গাই বাতিছে। খোঁড়া রোগে খয়েরি গাভীটির পা ফোলে ঢোল। খুর পড়ে-পড়ে অবস্থা। পোকাগুলো কিলবিল কিলবিল করে। খাবার বন্ধ করে গাইটি শুধু ঝিমায়। তার মুখ দিয়ে সাদা সাদা ফেনা পড়ে। ডেটল দিয়ে ধুয়াধুয়ি করেও কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। পেক-কাদায় সারাদিন দাঁড় করিয়েও অবস্থা যেইসেই।
লোকজন বলে- তাবিজ লেখো, গলায় টাঙ্গিয়ে দাও, পায়ের কিরাগুলো মরে সাফ হয়ে যাবে। কী সেই তাবিজ? তা-ও তারা বাতলে দেয়। সাত সুদখোরের নাম লিখে গলায় টাঙ্গিয়ে দিতে হবে। এতোই ঘৃণ্য নাম, পায়ের কিরাগুলো মরে যেতে মিনিটও সময় নেবে না। সুদখোরদের নাম ক্রমান্বয়ে লিখতে হবে। প্রথমেই লিখতে হবে সব চেয়ে বড় সুদখোরের নাম।
জাবেদ মিয়া কাগজ-কলম এগিয়ে দেয়- পয়লাই লেখো মনমন সুদখোরর নাম।...শ্রীমতি কল্পনা রানীর বিবাহ-বাসরের পাশাখেলা তুচ্ছ করে জাবেদ মিয়ার মুখের দিকে চেয়ে থাকি এক আফের্তা বালক।
0 মন্তব্যসমূহ